“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১৫.
পানির ছিটকা মুখে পরতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সিনথিয়া। আতঙ্কে পুরো শরীর থরথর করে কাপছে। সিনথিয়া এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। জাভেদ ভ্রু কুচকে বললো,
— “আর ইউ ওকে সিয়া? কি হয়েছে তোমার? এভাবে ভয় পেয়েছো কেনো?”
— “পা..পানি ক..কে মেরেছে?”
— “আমি মেরেছি। কেনো?”
— “কেনো?”
— “ফজরের সময় হয়েছে। তোমাকে তখন থেকে ডাকছি উঠছোই না তাই হালকা পানি মেরেছি।”
— “ওহ আচ্ছা। আযান দিয়ে দিয়েছে?”
— “হু.। একটু আগেই দিয়েছে।”
— “ঠিকাছে আপনি মসজিদে যান।”
— “তুমি তখন এভাবে ভয় পেয়েছিলে কেনো?”
— “কি..কিছু না।”
জাভেদ সিনথিয়ার সামনের চুল এলোমেলো করে হেসে বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া জাভেদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ পানি মারায় ভিষণ ভয় পেয়েছে। কারণ সায়ান প্রায় মধ্যেরাতে নিজের কামভাব পূরণের জন্য এইভাবে পানি মেরে তুলতো। আজও তাই ভেবেছে। যার কারণে আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিলো।
সকাল দশটার দিকে জাভেদ বাসায় ফিরলো। সাথে দুইজন বন্ধু। তারা নতুন ভাবি দেখতে এসেছে। জাভেদ রুমে এসে সিনথিয়াকে রেডি হতে বললো। কারণ জানতেই সিনথিয়া ভয় পেলো। আবার বুঝি পরপুরুষের মনোরঞ্জনের বস্তু হতে হবে? জাভেদ বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। এখন কি করবে? আবার সেই একই ঘটনা ঘটছে ওর জীবনে। বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। আর পারছে না লড়তে।
সাবিনা রুমে এসে সিনথিয়াকে এভাবে দেখে বিচলিত হলো। সিনথিয়াকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বললো,
— “কাদছিস কেনো?”
— “মা আমি..।”
সিনথিয়া কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। বারবার আটকে আসছে। সাবিনা শান্ত করলেন সিনথিয়াকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “এবার বল কি হয়েছে?”
— “উনার দুইজন বন্ধু এসেছে আমাকে দেখতে। আর উনিও বলে গেলেন রেডি হতে। মা আমি আর পারছি না। যেই দিন থেকে দীনে ফিরেছি সেইদিন থেকে লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমি আর পারছি না।”
সিনথিয়া গলার স্বর বসে গেছে। সাবিনা রেগে গেলেন। রেগে বললেন,
— “গর্দভটা দিনদিন আরো গর্দভ হচ্ছে। তুই আমার রুমে যা। দেখি কিভাবে তোকে নিয়ে যায় ওদের সামনে। আজকে যদি বাড়াবাড়ি করে তো চড় খাবে আমার হাতের।”
সাবিনা সিনথিয়াকে অতশির রুমে রেখে গেলেন। জাভেদ রুমে এসে দেখলো তার মা বসে আছে রেগে। জাভেদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
— “মা তুমি এখানে? কিছু হয়েছে? সিনথিয়া কই? ওরা ওয়েট করছে।”
— “এই তোর কি আক্কল জ্ঞান সব লোপ পেয়েছে? কি বলছিস তুই তোর কোনো ধারণা আছে? শুন তোর যদি খুব বেশি দেখা সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা থাকে তুই যা বাইরে। জনে জনে দেখা সাক্ষাৎ করে আয়। আমার ঘরের বউ, মেয়ে কোনো পরপুরুষের সামনে যাবে না। যদি জোর করিস তো ঘর থেকে বের করে দেবো তোকে।”
সাবিনা হনহন করে চলে গেলেন। জাভেদ হতভম্ব। কি জন্য ওর মা রেগেছে বুঝলো না। এভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজেই নিজের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,
— “শালা আম্মু আপু ঠিকই বলে। তুই দিন দিন গর্দভ হচ্ছিস। কিভাবে ভুলে গেলি সিনথিয়া একজন সম্মানিত নারী। সে কোনো পরপুরুষের সামনে যায় না। ধুর ছাই! সবসময় শুধু উলটা কাজ করি। ভাগ্যিস আম্মু এসেছিলো। আপু আসলে নিশ্চিত আমার পিঠে পরতো। বাবাগো।”
জাভেদ তার বন্ধুদের বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাইয়ে দিলো। বাসায় আসতেই দেখলো সিনথিয়া রুমে বসে আছে। জাভেদ অপরাধীর ন্যায় রুমে ঢুকলো। সিনথিয়াও ভয় পাচ্ছে। সিনথিয়া ভাবছে ওর কারণে মা বকা দেয়ায় জাভেদ ওর উপর চিল্লাবে। কিন্তু সিনথিয়ার ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে জাভেদ সিনথিয়ার সামনে হাটু গেড়ে বসে দুই কান ধরে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষ্ময়ে সিনথিয়া দাঁড়িয়ে গেলো। জাভেদ অপরাধীর মতো মুখ করে বললো,
— “সরি সিয়া। এবারের মতো মাফ করে দাও। সত্যিই আমার মাথায় ছিলো না তোমার পর্দানশীলের ব্যাপারটা। মায়ের বকা খাওয়ার পরেই বিবেক কাজ করেছে। প্লিজ বউটা মাফ করে দাও।”
— “উঠুন আপনি।”
— “আগে বলো মাফ করেছো?”
— “হুম করেছি। উঠুন।”
জাভেদ উঠে দাড়ালো। কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। তা দেখে সিনথিয়া জাভেদকে বিছানায় বসিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে গেলো। দুই মিনিটের মধ্যেই ট্যাং-এর শরবত বানিয়ে এনে জাভেদকে দিলো। সিনথিয়া জাভেদের পাশে বসে নরম স্বরে বললো,
— “আপুর কাছ থেকে শুনেছি আপনি হাফেয। এটা কি একেবারেই মিথ্যে?”
— “না।”
— “তাহলে?”
জাভেদ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ফাইল নিলো। সেটা সিনথিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— “এখানে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আছে।”
সিনথিয়া অবাক হয়ে ফাইল খুলে কাগজপত্র বের করলো। বিষ্ময়ে দাঁড়িয়ে গেলো। একটার পর একটা সার্টিফিকেট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে আর সিনথিয়া অবাক হয়ে দেখছে। সিনথিয়া একবার জাভেদের দিকে আরেকবার সার্টিফিকেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আকীদা কোর্স ইন তাইবা একাডেমি। কুরআন বুঝার মূলনীতি, হাদিস বুঝার মূলনীতি, ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্টাডিজ। এরাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স, অনার্স কমপ্লিট। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, মাস্টার্স। বিজন্যাস কম্পানি থেকে পুরষ্কার, ম্যাডেল এগুলো সত্যি? কুরআন হিফয কোর্স? আট মাস। আট মাসে কতটুকু শেষ হয়েছে? আ..আঠারো পারা.?”
সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ খুলে আবার হাতের কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি নাকি আমি এখনো ঘুমিয়ে আছি? এসব কিভাবে..? আকীদাও সহিহ। সালফে সাহলীনদের আকীদা।” জাভেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “আপনিও আমার স্বপ্নে এভাবে এসেছেন? এতো সুন্দর স্বপ্ন দেখছি আমি?
জাভেদ মুচকি হাসছে। সিনথিয়ার মুখে অভিব্যক্তি দেখে খুব ভালোলাগা কাজ করছে। সিনথিয়া জাভেদের মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
— ” আমি স্বপ্নে আপনাকে ছুয়ে দিয়েছি। সত্যিই এতো সুন্দর স্বপ্ন কিভাবে দেখছি? বাস্তবের মতো লাগছে। আল্লাহ প্লিজ এই স্বপ্ন যেনো কোনোদিন না ভাঙে। আমি এই স্বপ্নের ভেতরেই থাকতে চাই। আহ…!”
সিনথিয়া ভ্রু কুচকে নিজের হাতের দিকে তাকালো। জাভেদ চিমটি দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। সিনথিয়া রেগে তাকালো জাভেদের দিকে। জাভেদ হেসে বললো,
— “দেখো রক্তও বের হচ্ছে। তারমানে তুমি স্বপ্ন দেখছো না। বাস্তবেই ঘটছে।”
সিনথিয়া অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলো না। এতটা বিষ্মিত হয়েছে যে কেঁদে ফেলেছে। জাভেদ কিছু বলেনি। সিনথিয়াকে এই মুহুর্ত অনুভব করতে দিয়েছে। সিনথিয়া সব কাগজপত্র হাত থেকে রেখে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তাহলে এখন আপনার এ অবস্থা কেনো? মানে নেশা করেন কেনো? আর..।”
— “এইতো বছর তিনেক আগে একজন নারীর প্রেমে পরে সব নিয়ামত হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। সে আমার সব সম্পত্তি নিয়ে চলে গেছে আরেকজনের কাছে। আর আমি ধীরে ধীরে দীন থেকে ছিটকে গেলাম। আমার এই অবস্থা বাবা মেনে নিতে পারেনি। তিনিও হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান দুই বছর আগে। আমি আরো ভেঙে পরি। তারপর ধীরে ধীরে নেশার জগতে পা দিয়েছি।”
সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জাভেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “আমি জানি এসব আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারছিলাম না আমি কি করছি কেনো করছি। সব হারানোর পর অনুভব করতে পেরেছি ফ্রি মিক্সিং কাজের ভয়াবহতা। কিন্তু আমি এই জগত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। বারবার দোয়া করতাম কেউ একজন এসে আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাক। আমিও সহ্য করতে পারছিলাম না এই অন্ধকার জগতের ভার। আর তারপরই তুমি এলে আমার জীবনে।”
সিনথিয়া মাথা নিচু করে নিলো। জাভেদ সিনথিয়ার হাত ধরে বললো,
— “সিয়া তুমি আমাকে আবার গড়ে তুলবে প্লিজ? আমি না একদম ভেঙে গুড়িয়ে গেছি। আমার সাহায্যের প্রয়োজন। আমাকে সাহায্য করবে প্লিজ? আমাকে আবার আমার হাসিখুশি জীবনে নিয়ে যেতে পারবে? আমি এভাবে থাকতে চাইনা। আমারও কষ্ট হচ্ছে। শুধু একজোড়া হাতের প্রয়োজন যে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করবে। তুমি হবে জাভেদ নামক এই ঘুড়ির নাটাইয়ের মালিক?”
সিনথিয়ার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পরলো। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। জাভেদ ফ্লোরে বসেই সিনথিয়ার কোলে মাথা রাখলো। একহাতে সিনথিয়ার হাত ধরে রাখলো শক্ত করে। সিনথিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ খুব ভালো লাগছে। খুউউব!
_____________________________
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। জাভেদ আজ দোকানে যায়নি। ঘরেই আছে। জাভেদের ছোটখাটো একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেটা দিয়েই সংসারের সব সমস্যা মিটে যায় আলহামদুলিল্লাহ।
সিনথিয়া চায়ের কাপ নিয়ে রুমে এলো। জাভেদ চেয়ারে বসে ছোট টেবিলটার উপর ডায়েরি, ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব নিকাশ করছে। চায়ের কাপ জাভেদের সামনে রেখে চলে যেতেই খপ করে হাত চেপে ধরলো জাভেদ। সিনথিয়া ফিরে তাকিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে?”
— “এখানে বসো।”
পাশের চেয়ারে বসলো সিনথিয়া। জাভেদ ওর ডানহাতটা চেক করে কিছুটা শাসনের সুরে বললো,
— “এসব কি সিয়া? তোমার হাত পুড়েছে আর তুমি অয়েন্টমেন্ট না লাগিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছো?”
— “আরে এটা তো সামান্য। ও কিছু হবে না।”
জাভেদ চোখ রাঙিয়ে বললো,
— “সামান্য মানে কি? কতটুকু পুড়েছে তুমি দেখেছো? বসো এখানে। আমি অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।”
সিনথিয়া বাধ্য মেয়ের মতো বসে রইলো। জাভেদ ড্রয়ার থেকে অয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলো। সিনথিয়ার হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে লাগাতে বললো,
— “সিয়া তুমি খুব কেয়ারলেস। নিজের একটুও যত্ন নাও না। এতোটা উদাসীন হলে কি চলে বলো? আমি তো সারাদিন বাসায় থাকি না। তাই সেরকম যত্নও নিতে পারি না। প্লিজ নিজের একটু যত্ন নিবে।”
সিনথিয়া এতোক্ষন শীতল চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো জাভেদের দিকে। সামান্য একটা পোড়া জায়গার জন্য এতো কেয়ার? সায়ানদের বাড়িতে যখন ছিলো তখন তো কত হাত পুড়েছে। ফোসকা পরেছে। অথচ সায়ান ফিরেও তাকায়নি। অথচ এই লোকটা কতটা করছে সামান্য একটুর জন্য। সিনথিয়া মোলায়েম চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। ধীরে ধীরে অশ্রু জমলো চোখে। জাভেদ এখন কাজে ব্যস্ত। একটু আগেই মলম লাগানো শেষ হয়ে গেছিলো। সিনথিয়া উঠে এলো। হৃদয় জুড়ে ভালোলাগার শিহরণ বয়ে চলেছে। সিনথিয়া যেতেই জাভেদ তাকালো। মুচকি হাসলো। সামান্য একটু কেয়ারে মেয়েটার চেহারায় যেই মুগ্ধতা এবং অভিব্যক্তি ছিলো সেটা জাভদেকে মায়ায় ফেলে দেয়। মায়ায় পরতে তো বাধ্য। তার সিয়া যে খুব মায়াবতী।
.
আজ আকাশটা বেশ মেঘলা। তবে বৃষ্টি নেই। চারিদিকে শীতল হাওয়া বইছে। সিনথিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ওয়েদারটা ওর সবসময় পছন্দের। খুব ভালো লাগে। এমন সময় ফুসকা খেতে ইচ্ছে করে খুব। সিনথিয়া মনে মনে ভাবছিলো এখন যদি জাভেদ ফুসকা নিয়ে আসতো তাহলে দুজন মিলে আনন্দ করে খেতে পারতো।
অনেকটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়েই কেটে গেলো। এরমধ্যে রুমের দরজা লাগানোর আওয়াজ এলো। সিনথিয়া ঘুড়ে দাড়াতেই দেখলো জাভেদ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফুসকার প্লেট। সিনথিয়া এতোই বিষ্মিত এবং অভিভূত হয়েছে যে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। সিনথিয়ার অভিব্যক্তি দেখে জাভেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। সিনথিয়াকে একটু সময় দিলো। আসলে মেয়েটা সুখ এতোই কম পেয়েছে যে, সামান্য একটুতেই খুব বেশি আশ্চর্য হয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে।
জাভেদ চেয়ারে বসলো। সামনের ছোট্ট টেবিলের উপর ফুসকার প্লেট রাখলো। সিনথিয়া দাঁড়িয়েই ছিলো। জাভেদ ওকে টেনে পাশের চেয়ারে বসালো। ফুসকায় তেতুলের পানি ঢেলে সিনথিয়ার মুখের সামনে ধরলো। সিনথিয়া খাচ্ছে না দেখে নিজেই জোর করে মুখে পুরে দিলো। অবাক চোখে জাভেদকে দেখছে সিনথিয়া। জাভেদ মুচকি মুচকি হাসছে আর সিনথিয়ার মুখে ফুসকা পুরে দিচ্ছে। অনেক লম্বা সময় পর সিনথিয়া স্বাভাবিক হলো। জাভেদকে বললো,
— “সব আমাকে দিচ্ছেন যে? আপনি খাবেন না?”
— “কেউ কি সেই খেয়াল রাখে?”
— “মানে? আপনিও খান।”
— “কেউ নিজের হাতে খাইয়ে দিলে খেতাম আরকি।”
— “আ..আপনি আমার হা..হাতে খাবেন?”
— “নাহ। পাশের বাড়ির ভাবির হাতে খাবো। গর্দভ।”
সিনথিয়া খুব আশ্চর্য হলো। কারণ সিনথিয়া প্রায় চাইতো সায়ানকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবে। একদিন বলেছিলো। সায়ান নাক ছিটকে যা নয় তাই বলেছিলো। তারপর থেকে আর কোনোদিন সাহস হয়নি বলার। জাভেদ সিনথিয়ার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— “থাক আমি খাবো না। আপনিই খান।”
— “আপনি কিভাবে জানলেন আমার এখন ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছিলো?”
— “আমিতো তোমাকে হৃদয়ের কাছের মনে করি তাই দূরে থেকেও তোমার মনের খবর জেনে গেছি।”
— “কি..কিভাবে?”
— “ইটস ম্যাজিক।”
সিনথিয়ার অবাক চাহনি। জাভেদের মুগ্ধ নয়ন। সিনথিয়ার এই অভিব্যক্তি দেখতে বেশ লাগে জাভেদের। জাভেদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,
— “বুঝেছি। কেউ একজন নিজেই সব খেতে চায়। আমাকে দিবে না।”
সিনথিয়া একটা ফুসকা নিয়ে জাভেদের মুখের সামনে ধরলো। জাভেদ চোখ মেরে বললো,
— “দ্যাটস লাইক মাই গার্ল।”
জাভেদ ফুসকা নেয়ার সময় সিনথিয়ার হাতে কামড় বসালো। সিনথিয়াহ আহ! শব্দ করে ভ্রু কুচকে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এটা কি ছিলো?”
— “ফুসকা তো ঝাল। একটু চিনি নিয়েছি?”
— “চিনি নিয়েছেন মানে?”
— “চিনি মানে চিনি নিয়েছি। এখন একটু মিষ্টি লাগছে। তাও পুরোটা না।”
— “পুরোটা কেন লাগেনি?”
— “পুরোটা কিভাবে লাগবে? ওভাবে কি দিয়েছো নাকি?”
— “কিভাবে?”
— “উহ! সব বলে দিতে হয়?”
— “তো?”
— “চিনি চাই।”
— “নিয়ে আসবো?”
— “ওই চিনি নয় স্পেশালটা।”
— “সেটা কোথায়?”
জাভেদের ইশারায় সিনথিয়া থমকে গেলো। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে যখন বুঝলো তখন লজ্জায় পরে গেলো। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। ইচ্ছে করছে কোথাও মুখ লুকিয়ে নিতে। জাভেদ হাসলো। বললো,
— “হয়েছে মুখ লুকাতে হবে না। ফুসকা খাইয়ে দাও তো।”
— “আমরা যে সব খেয়ে ফেলছি আম্মু আর আপু খাবে না?”
— “ওদের জন্য আলাদা করে এনেছি। ফ্রিজে আছে।”
— “ওহ!”
খাওয়া শেষে জাভেদ প্লেট নিয়ে যেতে যেতে সিনথিয়ার উদ্দেশ্য বললো,
— “যেদিন সময় হবে সেদিন আমি স্পেশাল মিষ্টান্ন নিয়ে নেবো। তোমার অনুমতি সেদিন প্রাধান্য পাবে না। গট ইট।”
সিনথিয়া চুপ রইলো। তবে একদিকে শীতলতা অনুভব করলো।
_______________________
আজ জাভেদ এবং সিনথিয়াকে দাওয়াত দিয়েছে সিনথিয়ার বাড়ির পরিবার। সেখানে আরো অনেকে আসবে। সিনথিয়ার দুই ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদেরও দাওয়াত দিয়েছে। সায়ানরাও আসবে। জাভেদ বা সিনথিয়া কেউই যেতে চায়নি। বারবার ফোন করে বিরক্ত করায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে।
সিনথিয়া লাল একটা থ্রিপিস পরেছে। সেটার উপর জাভেদের কিনে আনা কালো বোরকা। জাভেদ নেভি ব্লু শার্ট পরেছে। দুজনে সাবিনা এবং অতশি থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। জাভেদের মটরসাইকেলে করেই রওনা দিলো সিনথিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
যথাসময়ে পৌছে গেলো তারা। দুইজনে একসাথে ঢুকলো ভেতরে। লিডিংরুমে সবাই ছিলো। আসমা সহ সিনথিয়ার দুই ভাবি এগিয়ে এলো। জাভেদ সালাম দিয়ে চুপ করে রইলো। মিম সিনথিয়াকে দেখে জাভেদকে টিটকারি করে বললো,
— “বাহ! জাভেদ ভাই দেখছি বউকে একেবারে প্যাকেট করে ফেলেছেন।”
— “আমরা ভেতরে যেতে পারি?” সিনথিয়া বললো।
— “হ্যাঁ অবশ্যই। কেনো নয়?”
— “ধন্যবাদ ভাবি।”
সিনথিয়া নিজের রুমে গেলো। জাভেদ সবার সাথে লিডিংরুমের সোফায় বসলো। সায়ানকে দেখেই গা জ্বলে উঠলো। হারামখোরটার জন্য সেদিন সিনথিয়ার গায়ে হাত তুলেছে। জাভেদ নজর সরিয়ে নিলো৷ এখানে আরো অনেকেই আছে। জাভেদ তাদের সাথে কথা বলছে। সায়ান আসছি বলে উঠে গেলো।
সিনথিয়া বোরকা খুলে ওড়নাটা মাত্রই গায়ে জড়িয়েছে। এরমধ্যেই সায়ান এসে উপস্থিত হলো ওর রুমে। সিনথিয়া ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। জলদি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। সায়ান কিটকিটিয়ে হেসে বললো,
— “ঢাকার আগেই দেখে ফেলেছি। আগের থেকে বেশ নাদুসনুদুস হয়ে গেছো দেখছি। ইশ! কেন যে তোমাকে ডিভোর্স দিলাম। নায়তো আজ তোমাকে…।”
— “বেরিয়ে যান ঘর থেকে। বেরুন বলছি।” সিনথিয়ার ভয়ে হাত কাপছে।
— “বেরিয়ে তো যাবোই। তার আগে একটু সময় দাও আমাকে। আফটার অল তোমার প্রাক্তন স্বামী বলে কথা। প্রমিজ কেউ জানতে পারবে না কিচ্ছু। এমন কি জাভেদও না।”
কথাটা বলেই সায়ান এগিয়ে আসলো সিনথিয়ার দিকে। হাত বাড়াতে যাবে তার আগেই জাভেদ এসে সিনথিয়ার সামনে দাড়ালো। জাভেদকে দেখে সিনথিয়া ওর পেছনে লুকিয়ে গেলো। জাভেদের চওড়া দেহের কারণে সিনথিয়াকে একটুও দেখা যাচ্ছে না। জাভেদ কিড়মিড় করে বললো,
— “তোর ছ্যাচড়ামির স্বভাব আর গেলো না তাইনা? শেষ পর্যন্ত অন্যের বউয়ের দিকেও নজর গেলো?”
— “শুন এতো ভাব নিস না। তোর বউ আমার ইউজ করা মাল।”
— “শালা এক ঘুষিতে মুখ ফাটিয়ে দেবো। মুখ সামলে কথা বল।”
সায়ান কিছু না বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। জাভেদ সিনথিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। জাভেদ আলতো জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আজ থেকে তোমার উপর কোনো খারাপ ছায়া পরতে দিবো না আমি। আমি সবসময় তোমার মাথার উপরে ছায়া হয়ে থাকবো।”
সিনথিয়া কিছু বলেনি। সায়ানের কথায় বেশ খারাপ লেগেছে। এই লোকটা কেনো যে ওর পেছনে এতোটা লেগেছে বুঝতেই পারছে না। ওর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। আর কি চায় এরা মা ছেলে? অসহ্যকর।
.
খাবার টেবিলে সবাই বসেছে। জাভেদও মাত্র বসলো। সিনথিয়া ওর পাশে দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করছে। জাভেদ বারবার চোখের ইশারায় বলেছে ওর পাশে বসতে। সিনথিয়া বসেনি। খাবার শুরুর এক পর্যায়ে মিম বললো,
— “সিনথিয়া তুমি তো আসলে বোরকা পরে। অথচ এই বোরকার ভেতরে করেও শয়তান নিয়ে হাজির হলে?”
— “মা..মানে?”
— “আসতে না আসতেই কি এমন ইঙ্গিত দিলে যার কারণে সায়ান তোমার ঘরে গিয়ে হাজির হলো?”
— “আম..আমি..।”
আসমা হুঙ্কার দিয়ে বললো,
— “সিনথিয়া এটা কি সত্যিই? তুই সায়ানকে ওর ঘরে যেতে বলেছিস?”
জাভেদ সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। অপ্সরাও সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। উৎসুক সবার দৃষ্টি সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। জাভেদের দিকে একবার তাকিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আম..আমি ব..বলিনি ম..মা।”
— “তুমি তো কিছুই বলো না সিনথিয়া। তারপরেও ছেলেরা তোমার রুপের মোহে পরে তোমার পেছনে ঘুড়ে তাইনা?” মিম বললো।
— “আম..আমি।”
— “সিনথিয়াই রুমে যাওয়ার আগে আমাকে ইশারা করেছিলো।” সায়ান বললো।
সিনথিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে। জাভেদ চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। অপ্সরা ঘৃণাভরা নজরে তাকালো সায়ানের দিকে। কারণ অপ্সরার কাছে সায়ানের মুখোশ খুলে গেছে। রিহা বললো,
— “আসলে এতাদিন পর আসলো। আর এসেই প্রাক্তন স্বামীকে দেখে পুরানো মায়া জেগে উঠেছিলো। তাই হয়ত কথা বলতে চেয়েছে। তাইনা সিনথিয়া?”
— “ন..না। আমি ক..কি..।”
— “তোমার চরিত্র দেখছি এখনো আগের মতোই আছে সিনথিয়া।” আরশি বললো।
আসমা এবার রেগে তেড়ে এসে সিনথিয়ার বাহু চেপে ধরে গালি দিয়ে বললো,
— “মা** এখনো নষ্টামি করে বেড়াস বাইরে তাইনা?”
কথাটা বলেই হাত উঠালো চড় মারতে। তৎক্ষনাৎ জাভেদ দাঁড়িয়ে গিয়ে সিনথিয়াকে টেনে নিয়ে এলো নিজের পেছনে। আর চড়টা এসে পরলো জাভেদের গালে। জাভেদ চোয়াল শক্ত করে নিয়েছে। উপস্থিত সবাই থমকে গেছে। ভয়ে সিনথিয়া থরথর করে কাপছে। পেছন থেকে খামছে ধরলো জাভেদের শার্ট। আসমা আমতা-আমতা করে বললো,
— “বাবা তুমি এগিয়ে এলে কেনো? আমিই ওকে ঠিক করে দিতাম।”
জাভেদ আসমার দিকে না তাকিয়ে সিনথিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “সিয়া রেডি হয়ে এসো আমরা এখনই বাসায় যাবো।”
— “বাবা এসব কি বলছো?” আসমা বললো। জাভেদ এবার ধমক দিয়ে বললো,
— “সিয়া কি বলেছি তোমাকে? যাও তাড়াতাড়ি।”
সিনথিয়া তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে বোরকা পরে নিলো। হামিদ জাভেদের হাত ধরে বললো,
— “ভাই তুমি কেনো এসবের মাঝে আসতে গেলে? এই মেয়েটার স্বভাবই এমন। যেখানেই ছেলে দেখবে সেখানেই লুটিয়ে পরবে। মা ঠিক করে দিতো ওকে। তুমি কেন..।”
জাভেদ হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো। এরমধ্যেই সিনথিয়া উপস্থিত হয়েছে। জাভেদ সিনথিয়ার হাত শক্ত করে ধরলো। খাওয়া শুরু আগেই এসব কথা উঠেছিলো তাই জাভেদ খাবারে হাত লাগায়নি। সিনথিয়াকে নিজের দিকে টেনে এনে বললো,
— “যেই ঘরে আমার স্ত্রীকে সম্মান করা হয়না। সারাক্ষণ পলিটিক্স চলে কিভাবে আমার স্ত্রীকে অপমান করবে, অপদস্থ করবে সেই ঘরে আর এক মুহুর্তও না। আর কোনোদিন আমরা এমুখো হবে না মনে রাখবেন।”
— “আরে জাভেদ তুমি কার জন্য এমন করছো বলো তো? এই মেয়ে কতটা ধুন্ধুর তা বুঝবে পরে।” মিম বললো।
— “কে কতটা ধুন্ধুর সেটা আমার বুঝা হয়ে গেছে। কে কতটা নিচ এবং চরিত্রহীন সেটাও আমার দেখা এবং জানা হয়ে গেছে। আরেকটা কথা ভাবি। আমি সেসব কাপুরুষদের মতো নই যারা নিজের স্ত্রীকে ছোট ছোট কাপড় পরিয়ে অন্য পুরুষের সামনে এনে মনোরঞ্জনের বস্তু করে দেয়। আমার সিয়া একমাত্রই আমার। ওকে দেখার অধিকারটাও আমার। পৃথীবির সব সম্পদ একদিকে আর আমার অর্ধাঙ্গিনী অন্যদিকে। সিয়া আমার কাছে এতোটাই মূল্যবান।”
সায়ানের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
— “ফারদার যদি তোকে আমার সিয়ার আশেপাশে বা ওর ছায়ার আশেপাশেও দেখেছি তো মনে রাখিস সেইদিনই তোর শেষ দিন হবে। এই সিয়ার কারণেই সেই জাভেদ আবার ফিরে এসেছে যার দিকে তাকাতেই সবাই ভয় পেতো। মাইন্ড ইট।”
বেরিয়ে আসার সময় আসমা এবং আরশের সামনে পরলো ওরা। সিনথিয়ার বাবা কিছু বলবে তার আগেই জাভেদ বললো,
— “মেয়ের কদর বুঝবেন একদিন সেদিন সিয়া আপনাদের হাতের নাগালের বাহিরে থাকবে। আসি। আসসালামু আলাইকুম।”
বাইরে এসে সিনথিয়ার বরাবর দাঁড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে একটা উষ্ণ ছোঁয়া দিলো। মোটরসাইকেলে বসতেই সিনথিয়া জাভেদের পিঠে মাথা হেলিয়ে দিলো। অনেকটা পথ আসার পর জাভেদ মোটরসাইকেল থামালো। এইদিকটায় মানুষ তেমন নেই। সিনথিয়া নেমে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে বললো,
— “আপনি কেনো এসবের মাঝে আসতে গেলেন। আমার জন্যেই অপমানিত হতে হয়েছে আপনাকে।”
— “সিয়া তুমি আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমার সম্মান মানে আমার সম্মান। আর তোমাকে অসম্মান করা মানে আমাকে অসম্মান করা। এতোগুলো মানুষের সামনে সবাই মিলে তোমাকে অসম্মানিত করছিলো, অপবাধ দিচ্ছিলো মানে ওরা আমার গায়ে অপবাদ দিচ্ছিলো। আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো? এতোটা কাপুরুষ আমি নই।”
সিনথিয়া হু হু করে কেঁদে ফেললো। জাভেদ ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,
— “অনেক হয়েছে, অনেক সয়েছো। আর নয়। এখন থেকে আর কেউ তোমাকে না অপবাদ দিতে পারবে আর না অসম্মানিত করতে পারবে।”
এভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো দুজনে। জাভেদ সিনথিয়াকে ছেড়ে মোটরসাইকেলে বসে বললো,
— “উঠো। আজ এক জায়গায় যাবো।”
সিনথিয়া মোটরসাইকেলে বসতে বসতে বললো,
— “কোথায় যাবেন।”
জাভেদ মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে বললো,
— “যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিলো গগণে।”
সিনথিয়া ফিক করে হেসে দিলো। জাভেদের কাধে হালকা থাপ্পড় মেরে বললো,
— “গান গাইছেন যে? এসব ঠিক নয় বুঝেছেন?”
— “হুর! স্ত্রীর জন্য রোমান্টিক সব লাইন জায়েজ আছে।”
— “তাহলে রোমান্টিক থেকে একটা বলুন।”
— “চলোনা ঘুড়ে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।”
সিনথিয়া হাসছে। হাসতে হাসতে জাভেদের কাধে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। কারণ জাভেদ গান গায়নি। এমন কমেডি করে বলেছে যে হাসতে হাসতে সিনথিয়ার পেট ব্যাথা হওয়ার উপক্রম।
সিনথিয়া এবং জাভেদ সত্যিই সত্যিই নদীর পাড়ে গেলো কিছুটা সময় কাটাতে। নদীতে পা ডুবিয়ে দুজনে বসে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে।
“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১৬.
রান্নাঘরের কাজ ফেলে রুমে দৌড়ে এলো অপ্সরা। মেয়েটা কাদছে সেই কখন থেকে। কেউ ধরছেই না। অপ্সরা বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো সায়ান প্রেমের আলাপ জুড়েছে তার নতুন প্রেমিকার সাথে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটা সায়ানের নয়। এখানে আসার আগে অপ্সরার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো একজন ফরেনারের সাথে। বিয়ের এক বছরের মাথায় মানুষটা মারা যায়। অপ্সরা একেবারেই ভেঙে পরেছিলো। সেই মুহুর্তে সায়ান এসেছিলো ওর জীবনে। প্রাক্তন প্রেমিক ছিলো বিধায় ওর বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন সায়ানের সাথে অপ্সরার বিয়ে দিবেন।
বিয়েটা ঠিক হওয়ার দুইদিন আগে সায়ান সিনথিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে অপ্সরাকে বিয়ে করে নেয়। তখনও বুঝতে পারেনি যে অপ্সরার ভেতরে নতুন একজন সদস্য বেড়ে উঠছে। এখানে আসার পর যখন ছয় মাস চলছিলো প্র্যাগনেন্সির তখন গিয়ে বুঝতে পেরেছিলো। সেদিন থেকেই মা, ছেলের অত্যাচারের পরিমাণ দেখেছে অপ্সরা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে সায়ানের আচরণে। প্র্যাগনেন্সির সময়ও ওর কামভাব পূরণ করতে একটুও ছাড় দেয়নি। এতোটা জালিম এই লোক। অপ্সরার চোখ থেকে কয়েক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। সেটা মুছে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে গেছে বাবুটা। মেয়েটা ওর বাবার মতো হয়েছে।
কোমড়ে চাপ পরতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো অপ্সরা। সায়ান ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। এই লোকটার সংস্পর্শে আসলে ঘৃণা হয় ভিষণ। অপ্সরা কিছুটা রেগে বললো,
— “সায়ান ছাড়ো আমাকে। এতোটা পাষাণ কেনো তুমি? মেয়েটা কাদছিলো তারপরেও ধরলে না?”
— “কেনো ধরবো? ও কি আমার মেয়ে নাকি? পরের মেয়ের জন্য এতো দরদ দেখাতে ভালো লাগেনা।”
— “সায়ান তুমি সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিলে।”
— “তখন কি জানতাম নাকি তোমার সাথে এই আপদটাও ফ্রি পাবো।”
— “সায়ান!!!!!”
— “চিৎকার করো না তো। কাছে আসো।”
— “যদি ওর বাবা মারা না যেতো তাহলে তোমার মতো জালিম, চরিত্রহীন লোককে কখনোই বিয়ে করতাম না। আমার সাথে এতোটা করছো। না জানি সিনথিয়ার সাথে কতটা করেছিলে।”
— “উফ এতো কথা ভালো লাগছে না। এখন মুডে আছি। মুড খারাপ করো না। নাহলে আজ তোমার সহ্যসীমা অতিক্রম হবে।”
— “কেনো এমন করছো? প্লিজ একটু তো রহম করো আমার উপর।” ভাঙা গলায় বললো।
— “আরে আসো তো বেডে।”
— “কেনো তোমার মিম ভাবি বুঝি এখন টাইম দিতে পারছে না? সেদিন দুজনে মিলে সিনথিয়াকে কি অপমানটাই না করলে। শেষ পর্যন…। আহ!”
সায়ানের হঠাৎ আক্রমণে অপ্সরা চুপ হয়ে গেলো। গালটা জ্বালা করতে লাগলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো নোনাপানি। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় এবং জালিম কি করে হতে পারে অপ্সরা ভেবে পায়না। সায়ান ছোট্ট বাবুটাকে কোলে নিয়ে বললো,
— “ফেলে দেই?”
— “সায়ান কিসব বলছো? ও একটা দুধের বাচ্চা। প্লিজ ওকে এসবে এনো না।”
— “আর যদি মুখ চালাও তো…।” সায়ান বাবুকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করতেই অপ্সরা কেঁদে দিয়ে বললো,
— “না না প্লিজ সায়ান। আমার মেয়েকে কিছু করো না। আমি আর কখনো কিছু বলবো না।”
— “গুড।”
অপ্সরা মেয়েকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে দোলনায় শুইয়ে দিলো। সায়ান হেচকা টানে অপ্সরাকে বিছানায় ফেলে দিলো। ওর উপর চড়ে বসলো। নিজের কামভাব মিটাতে মিটাতে বললো,
— “জানো সিনথিয়ার কোন দিকটা আমার ভালো লাগতো? ওর বোবা স্বভাবটা। যাই করতাম সবসময়ই বোবা হয়ে থাকতো। বেশ মজাও পেতাম।”
অপ্সরা চোখ বন্ধ করে নিলো। সায়ান জানোয়ারের মতো ব্যবহার করছে। এক সময় শরীরের ভার ছেড়ে দিলো অপ্সরা। তলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে। অপ্সরার সহ্যশক্তি সিনথিয়ার মতো নয়। যার কারণে প্রায় সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সায়ানের জানোয়ারের মতো আচরণে। আজও তাই হলো।
.
মধ্যরাত। অপ্সরা উঠে বসলো। ড্রিম লাইটের আলোতে ঘরটা আবছা আলোকিত হয়ে আছে। দোলনায় চোখ পরতেই দেখলো মেয়েটা হাত, পা নাড়ছে। অপ্সরা উঠে দোলনার পাশে গেলো। মেয়েটা নিজে নিজেই হাসছে আর হাত, পা নেড়ে খেলা করছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলো অপ্সরা। খুব ভালোবাসে মেয়েটাকে। মানুষটাকে সে খুব ভালোবাসতো। তার শেষ স্মৃতি এই ছোট্ট জানটা। পুরো মুখে অসংখ্য চুমু দিলো অপ্সরা। ও চায়না এখানে থেকে নিজের মেয়েটারও ওর মতো করুন পরিণতি হোক। যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে।
রুমে এসে খুব সাবধানে সায়ানের মোবাইলটা উঠিয়ে নিলো। বারান্দায় গিয়ে নিজের মায়ের নাম্বারে ফোন দিলো। সায়ান ওর ফোনটা ভেঙে ফেলেছে অনেক আগেই। আর নতুন ফোন কিনে দেয়নি। কারণ এরা চায়না এদের আসল রুপ কেউ জানুক। তাইতো বন্দীর মতো করে রেখেছে অপ্সরাকে। মায়ের ফোনে কয়েকবার রিং পরার পর অচেনা একজন রিসিভ করলো। অপাশ থেকে সবটা শুনে অপ্সরা মেঝেতে ধপ করে বসে পরলো। চোখ থেকে অশ্রুকণা ঝরে পরছে বাধাহীন ভাবে। এখন সে কোথায় যাবে? এখান থেকে পালিয়ে কোথায় আশ্রয় নিবে? অপ্সরার একমাত্র ভরসার জায়গা সেই বাবা-মা যে ফ্যাক্টেরিতে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে অপ্সরা।
অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়েছে। তবে যাইহোক এদের মতো জালিমদের সাথে আর থাকা সম্ভব না। কি করবে, কোথায় যাবে এসবই ভাবতে লাগলো অপ্সরা। তখনই মনে পরলো এখানে ওর একজন মামা আছেন। হুম, তার কাছেই যাবে। মামার বাসায় গিয়ে সায়ানকে প্রথমে ডিভোর্স দিবে। তারপর কোথাও চাকরি পেলে মেয়েকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছোট একটা ব্যাগে নিজের একজোড়া কাপড়, মেয়ের প্রয়োজনীয় সব নিয়ে ব্যাগটা লুকিয়ে রাখলো। আগামীকাল সুযোগ বুঝেই এখান থেকে পালাবে।
.
সারাদিন কাজের ফাকে অল্প সময় পেয়েছে মেয়েকে খাওয়ানোর। বান্দীর মতো খাটায় এখানে এরা। অপ্সরা অল্পতেই হাপিয়ে যায়। এসব কাজ করে অভ্যস্ত নয় তাই। বাবা-মায়ের ননীর পুতুল ছিলো সে। কখনো কাজ করায়নি। আর এরা? ইদানীং তো সায়ান যখন তখন গায়ে হাত তুলে। আগে এমনটা করেনি। হুট করেই এই পরিবর্তন হয়েছে। অপ্সরা ভাবতে লাগলো ওর বাবা-মায়ের মুত্যুর খবর নিশ্চয়ই সায়ান জানে। এখন তো কোনো গার্জিয়ান নেই ওর। তাই এখন ওকে টর্চার করলেও কেউ ওর পক্ষে বলবে না। এইজন্যই হয়ত এমন করে।
দুইমাস আগেই অপ্সরা জানতে পেরেছে সিনথিয়ার বড় ভাবি মিমের সাথে সায়ানের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক মেয়ের সাথেও সায়ানের সম্পর্ক আছে। প্রথম প্রথম কষ্ট পেয়েছে। এসব নিয়ে ঝগড়া করেছে। এখন আর কিছু বলে না। বলে লাভও নেই। তাছাড়া এখন এসব নিয়ে কিছু বললে উল্টো মার খেতে হয় অপ্সরার।
সারাদিন সুযোগ খুজেছে পালিয়ে যাওয়ার কিন্তু পায়নি। সন্ধ্যায় সায়ান এলো। ওকে দেখেই অপ্সরার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কেমন করে তাকাচ্ছে। ওর হাসিটা দেখলে অন্তর আত্মা কেপে উঠে অপ্সরার। যেদিন এভাবে হাসে সেদিনই অপ্সরার জন্য কাল হয়েছে। সায়ান অপ্সরার চারপাশে ঘুড়ে ঘুড়ে বললো,
— “পাখি বুঝি খাঁচা থেকে পালাতে চাইছে?”
অপ্সরা ভয়ে কেপে উঠে। ভাবছে সায়ান কি করে জানলো? মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ওর উপর রেগে গিয়ে না জানি মেয়ের ক্ষতি করে বসে। আচমকাই সায়ান গাল চেপে ধরলো অপ্সরার। হিসহিসিয়ে বললো,
— “বেশ সাহস বেড়েছে তোর তাইনা? পালাতে চাইছিস আমার খাঁচা থেকে? কিন্তু পালাতে তো তুই পারবি না। এখানেই থাকতে হবে তোকে। আমার রক্ষিতা হয়ে।”
— “ছাড়ো আমায়। তোমার মতো জানোয়ারের সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।”
— “তাহলে মরে যা।”
কথাটা বলেই হাত উঠালো অপ্সরার গায়ে। চড় মেরেছে সায়ান। মনে হচ্ছে যেনো কাঠ দিয়ে বাড়ি মেরেছে গালে। ভনভন করে ঘুড়তে লাগলো অপ্সরার চারপাশ৷ সায়ানের বেধড়ক মারের কারণে লুটিয়ে পরেছে মেঝেতে। আজ জ্ঞান হারায়নি অপ্সরা। সায়ান হাপিয়ে গিয়ে সোফায় বসেছে। অপ্সরা কোনোরকমে উঠে। মেঝে থেকে মেয়েকে কোলে নিলো। মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। বিছানার পাশের ড্রয়ারের উপর থেকে ফুলদানি নিয়ে ছুড়ে মারলো সায়ানের দিকে। নিশানা বরাবরই পরেছে। সায়ান আর্তনাদ করে উঠলো। এই সুযোগে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছে অপ্সরা। দাঁড়িয়ে গিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। কোন রাস্তায় এসেছে জানা নেই ওর। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। সামনে থেকে একটা মোটরসাইকেল আসতে দেখে অপ্সরা সেদিকে ছুটলো। দাঁড়িয়ে গেলো মোটরসাইকেলের সামনে। মোটরসাইকেলে বসা লোকটা তাড়াতাড়ি ব্রেক কষলো। আরেকটু হলেই এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো। লোকটা কিছু বলবে তার আগেই অপ্সরা বলে উঠলো,
— “জাভেদ ভাই আপনি?”
— “আপনি কে? আমাকে কিভাবে চিনেন?”
— “আমি.. আমি অপ্সরা। সায়ানের বউ। আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ।”
— “মানে? এতোরাতে আপনি এখানে কেনো?”
— “প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি খুব বিপদে পরেছি।”
জাভেদ কাজ শেষ করে বাসায় যাচ্ছিলো। পথিমধ্যেই অপ্সরার সাথে দেখা হলো। জাভেদ দুশ্চিন্তায় পরলো। বারবার মনে হচ্ছে এটা কোনো ফাঁদ। সায়ান যেই ধুন্ধুর পাবলিক। নিশ্চয়ই এখন বউকে লেলিয়ে দিয়েছে। জাভেদ কিছু বলবে তার আগেই অপ্সরা কেঁদে বললো,
— “ভাই দয়া করুন আমার উপর। আমার এখানে থাকাটা মোটেও সুবিধার নয়। যেকোনো সময় সায়ান এসে যাবে। একবার যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় তো ও আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। আর আমার সাথে কি করবে সেটা আমার জানা নেই।”
জাভেদ এবার ভালো করে তাকালো অপ্সরার দিকে। মুখে মারের চিহ্ন স্পষ্ট। ঘোমটা দেয়ার কারণে যদিও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কোলে বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। জাভেদ এবার কিছুটা নরম হলো। বললো,
— “আপনার এ অবস্থা কেনো?”
— “সব পরে বলবো। আমাকে প্লিজ এখান থেকে নিয়ে চলুন।”
— “কোথায় যাবেন?”
অপ্সরা ঠিকানা বলতেই জাভেদ বললো,
— “ওহ! আমাদের বাসাও ওইদিকেই। আচ্ছা উঠুন আপনি।”
অপ্সরা তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। এমনভাবে বসলো যাতে জাভেদের গায়ের সাথে একটুও না লাগে। মেয়েকে শক্ত করে চেপে ধরেছে বুকের সাথে। রাত এগারোটায় পৌছুলো তারা অপ্সরার মামার বাসায়। জাভেদদের বাসা শহর থেকে দূরে। কিছুটা গ্রাম এরিয়া এদিকটা। এখানে এগারোটা মানে অনেক রাত।
ঘরে বেল বাজানোর কিছু সময় পর দরজা খুললো মাঝ বয়সি এক লোক। অপ্সরার দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে বললো,
— “অপ্সরা এই অবস্থা কেনো তোর? আর উনি কে?”
— “সব বলছি। আগে বাসায় ঢুকতে দাও মামা।”
— “হ্যাঁ আয় আয়।”
জাভেদও ঢুকে সোফায় বসলো। এরমধ্যে অপ্সরার মামি এসে উপস্থিত হয়েছে। অপ্সরাকে দেখেই মৃদু চিৎকার দিয়েছে। জাভেদও বুঝতে পারছে না বিষয়টা। পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হলো অপ্সরা। মেয়েকে ঘুম পারিয়ে মামা-মামির পাশে রুমে শুইয়ে দিলো। উনাদের ছেলেমেয়ে নেই। একাই থাকে এতবড় বাড়িতে। অপ্সরা এবার সবার সামনে বসলো। একে একে সব খুলে বললো।
সিনথিয়ার সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনাও খুলে বললো অপ্সরা। এমনি ওর মিচক্যারেজ এর ব্যাপারটাও বললো। জাভেদ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে, সিনথিয়ার সাথে এতোটা জুলুম করেছে সায়ান এবং ওর মা। সবশেষে অপ্সরা বললো,
— “ভাইয়া সিনথিয়া সুখ খুবই কম পেয়েছে। তাই আপনাকে বলবো ওর ব্যাপারে কেউ কিছু বললে বিশ্বাস করবেন না। ওকে সুখে রাখুন। আগলে রাখুন এবং ভালোবাসুন।”
— “হু! ধন্যবাদ। আমাকে সব জানানোর জন্য।”
অপ্সরা মলিন হাসলো। জাভেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— “আজ আসি। কোনো দরকার হলে ফোন দিবেন।”
জাভেদ নিজের দোকানের একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। অপ্সরার মামা-মামি থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো।
_____________________________
দরজার টোকা পরতেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুললো সিনথিয়া। এতোক্ষণ অপেক্ষায় ছিলো প্রিয় মানুষটার। জাভেদ ঘরে ঢুকে এক পলক সিনথিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখে মৃদু হাসি। জাভেদ জানে এখনো খায়নি মেয়েটা। এতোক্ষণ ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো।
জাভেদের তোয়ালে, টাউজার, গেঞ্জি এগিয়ে দিলো সিনথিয়া। সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। সিনথিয়া একটু চিন্তায় পরেছে। প্রতিদিন বাসায় আসলে লোকটা খুব দুষ্টুমি করে। আজ এতো নিরব কেনো? কিছু হয়েছে কি?
জাভেদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সিনথিয়া শরবতের গ্লাস নিয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জাভেদকে জিজ্ঞেস করলো,
— “কিছু হয়েছে কি? আপনাকে কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে।”
জাভেদ কিছু বললো না। শরবত খেয়ে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। হঠাৎই মনে পরলো সেদিন অযথাই চড় মেরেছিলো মেয়েটাকে। সিনথিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে ফেললো জাভেদ। সিনথিয়া হতভম্ব। কি হলো কিছুই বুঝলো না। সিনথিয়া মাথা তুলে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে আপনার? কাদছেন কেনো? কোনো বিষয়ে কি কষ্ট পেয়েছেন?”
জাভেদ কিছু বললো না। আরেকটু শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো সিনথিয়াকে। বারবার শুধু অনুতপ্ত হচ্ছে সেদিনের ঘটনার জন্য। আচমকা চড় মারায় মেয়েটা একদম বোবা হয়ে গেছিলো। সিনথিয়াও চুপ করে রইলো। মনে হাজার প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। জাভেদ মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
— “তোমার মিচক্যারেজ হয়েছিলো তাইনা?”
সিনথিয়া চমকালো। চমকে বললো,
— “আপনি কিভাবে জানলেন? এসব কে বলেছে আপনাকে? আমার বাসার কেউ তো এসব জানে না।”
— “এতোটা কষ্ট চেপে রেখেছিলে নিজের মধ্যে? আমাকে একটু জানালেও না।”
— “এম..এম…নি।”
— “আমি ভাবতাম আমার কষ্ট বেশি। ভালোবাসার মানুষটা বিট্রেয় করে ছেড়ে চলে গেছে এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমার কারণটা নিতান্তই তুচ্ছ ছিলো। তোমাকে দেখে অবাক হচ্ছি সিয়া। শুধুমাত্র দীনের উপর অটল থাকার কারণে এত অত্যাচার সহ্য করেছো। সবার অমানবিক অত্যাচার মেনে নিয়েছো। আর আমি…।”
সিনথিয়া মুখ নামিয়ে রেখেছে। জাভেদ এখনো আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে সিনথিয়াকে তার প্রশস্ত বক্ষে চেপে ধরে রেখেছে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সিনথিয়া মুখ তুলে বললো,
— “আপনি এসব কিভাবে জানলেন?”
— “অপ্সরার সাথে দেখা হয়েছিলো। সেই-ই বলেছে।”
— “এত রাতে?”
সিনথিয়া খানিকটা অবাক হলো। জাভেদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়াকে চিন্তিত লাগছে। চিন্তিত স্বরে বললো,
— “অপ্সরা কি কোনো বিপদে পরেছে? আমার মনে হচ্ছে ওরা অপ্সরার সাথেও জুলুম করেছে। কিন্তু ওরা তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।”
— “ভালোবাসা না ছাই। সায়ানের স্বভাবই হলো মেয়েদের নিয়ে ড্যাটিং করা। শালা চরিত্রহীন একটা। অপ্সরার স্বামী মারা যাওয়ার পর ফুসিয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করেছে হারামখোর।”
জাভেদের চেহারায় বিরক্ত দেখা গেলো। সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সিনথিয়া বললো,
— “অপ্সরার আগে বিয়ে হয়েছিলো?”
— “হু! একজন ফরেনারের সাথে। বিয়ের একবছরের মাথায় সে লোকটা মারা যায়। তখন ওদের পরিবার প্রায় ভেঙ্গে পরেছিলো। বিশেষ করে অপ্সরা। তখনই সায়ান সহমর্মিতার নাম করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। শালা বিশ্বাসঘাতক। এরপর যখন জানলো অপ্সরার বাবা-মা মারা গেছে তারপর থেকেই নির্যাতন শুরু করেছে।”
— “ইশ! কতটা খারাপ হলো। আমি ওকে নিয়ে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ওদের মেয়েটার কি হবে?”
— “ওটা সায়ানের মেয়ে নয়। অপ্সরার আগের স্বামীর মেয়ে। সায়ানের সাথে বিয়ের সময় জানতেই পারেনি যে সে গর্ভবতী।”
— “ওহ! এখন কি হবে?”
জাভেদ সিনথিয়াকে অপ্সরার পরিকল্পনার কথা জানালো। সিনথিয়া এবার চুপচাপ বসে আছে। জাভেদ তাগাদা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— “চলো খেয়ে নিই। এখনো তো খাওনি।”
— “হু..। চলুন।”
______________________________
তিনদিন পর। বিকেলবেলা। সিনথিয়া ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে। সেটাই উপভোগ করছে সিনথিয়া। জাভেদ এসে পাশে দাড়ালো। সিনথিয়ার মতো করে আকাশের দিকে তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
— “মেঘ দেখতে ভালো লাগে?”
— “হু..। অনেক। আমার ইচ্ছে করে মেঘেদের ছুঁয়ে দিতে।”
— “ছুঁয়ে দিতে চাও?”
— “হু চাই। কিন্তু কিভাবে?”
সিনথিয়ার বলার ভঙ্গি দেখে জাভেদ হেসে ফেললো। নাকটা হালকা টেনে দিয়ে বললো,
— “অপেক্ষা করো কয়েকদিন। তারপর…. উম! উম!”
— “তারপর কি?”
— “সারপ্রাইজ। বলা যাবে না এখন।”
সিনথিয়া গাল ফুলিয়ে ফেললো। অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। জাভেদ হাসে। সিনথিয়ার অভিমান ভরা মুখটা দেখতে খুব মায়াবী লাগে। নিজের বাহু দিয়ে সিনথিয়ার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “বউ দেখছি অভিমান করেছে।”
— “মোটেও না।”
— “আহা এটা কি হলো।”
সিনথিয়া মুখ ঘুড়িয়ে জাভেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে?”
— “তোমার নাক।”
— “আমার নাক কি হয়েছে?”
— “লাল টমেটো হয়ে আছে। কুটুস করে কামড় দিয়ে দেবো কিন্তু।”
সিনথিয়া তৎক্ষনাৎ নাকে হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো। জাভেদ এবার হো হো করে হাসছে। সিনথিয়া ভেঙচি কেটে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো জাভেদের। হাসি মুখে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে মোবাইল কানে ঠেকালো। অপাশের কথাবার্তা শুনে অনেকটা বিচলিত হয়ে গেলো। কোনোরকমে ব্যাপারটা সামলে নিতে বলে ফোন কেটে চিন্তিত হয়ে গেলো। সিনথিয়া এগিয়ে এসে জাভেদের হাত ধরে বললো,
— “কি হয়েছে? আপনাকে চিন্তিত লাগছে।”
— “সায়ান অপ্সরার মামার বাসায় গিয়ে অনেক হাঙ্গামা করছে। সে অপ্সরাকে নিয়ে যেতে চাইছে। তাই ফোন দিলো।”
— “এখন কি হবে?”
— “ওদেরকে বলেছি ব্যাপারটা সামলে নিতে। আমি সেখানে গেলে বিষয়টা খুব বিশ্রী হয়ে যাবে। আর সায়ানকে তো তোমার চিনায় আছে। ইনিয়ে বিনিয়ে হাজার কথা রটাবে। ফালতু লোক।”
— “হুম বুঝতে পারছি। কিন্তু অপ্সরা এবং ওর মেয়ের কি হবে?”
— “সেটা ভাবার জন্য ওর মামা-মামী আছে। আমরা বেশি নাক গলাতে গেলে সব দায়ভার এসে আমাদের উপর পড়বে।”
সিনথিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
— “আমি একটু অপ্সরার সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে নিয়ে যাবেন প্লিজ।”
— “আচ্ছা সময় করে নিয়ে যাবো।”
_____________________________
একমাস কেটে গেছে চোখের পলকেই। সিনথিয়া আজ অপ্সরার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে একটা প্রপোজাল নিয়ে এসেছে। যদিও জানে না অপ্সরা এতে রাজি হবে কিনা। কিন্তু রাজি না হলে ওর-ই বিপদ। সিনথিয়া অপ্সরার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করলো। ঘুমিয়ে যাওয়ায় দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বললো,
— “এরপর কি ভাবলে কি করবে?”
— “সায়ানকে ডিভোর্স দিবো।”
— “তারপর?”
— “কোথাও জব পেলে মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবো। মা-মেয়ে দুজন মিলে বেশ চলে যাবে।”
— “আমার মনে হয়না সায়ান তোমাকে এতো সহজে মুক্তি দিবে।”
অপ্সরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— “ওর সাথে সংসারের এই দেড় বছরে কখনো মনে হয়নি আমি ওর স্ত্রী। সায়ান সবসময় আমাকে ফিল করিয়েছে আমি ওর রক্ষিতা ছাড়া কিছুই না।”
— “হুম জানি।”
অপ্সরা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করবে। সিনথিয়া ঠিকই বলেছে সায়ান ওকে এতো সহজে মুক্তি দিবে না। তাই এবার ভাবলো সে আবার কানাডা ফিরে যাবে। পরমুহূর্তেই মনে পরলো সায়ান ওর পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেছিলো। লোকটা সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। সিনথিয়া অপ্সরার হাত ধরে বললো,
— “তোমাকে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করো।”
— “হু..।”
— “তুমি আবার বিয়ে করে নাও।”
— “সিনথিয়া এটা কখনোই সম্ভব না। সংসারের স্বাদ মিটে গেছে আমার। ভয় হয় এখন। পরবর্তী লোকটা যদি সায়ানের মতো নরপশু হয়!”
— “আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। কিন্তু তুমি ভাবো একবার এইভাবে অভিভাবক বিহীন তুমি টিকে থাকতে পারবে না। আর না সায়ান তোমাকে ভালো থাকতে দিবে। তাই বললাম।”
অপ্সরা চিন্তায় পরলো। সিনথিয়ার কথা ফেলার মতো নয়। কিন্তু মনের ভয় কিছুতেই কাটতে চাইছে না। সায়ানের সাথে সংসারের মাঝামাঝি সময় থেকেই ওদের আসল রুপ দেখেছে অপ্সরা। সেই বিভৎস দিনগুলোর কথা ভাবলে ভয়ে অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠে। সিনথিয়া জানালো,
— “উনার একজন বন্ধু আছে। এইতো বেশকিছু দিন আগে স্ত্রী মারা গেছে। দু বছরের একটা ছোট্ট ছেলে আছে। সারাদিন কাঁদে মা মা বলে। তিনি বাচ্চাকে কিছুতেই সামলাতে পারছেন না। তুমি যদি রাজি হও তাহলে তোমার মেয়ে বাবার আদর পাবে আর ওই পিচ্চি বাবুটা মায়ের ভালোবাসা পাবে।”
— “কিন্তু.. সায়ানের সাথে আমার এখনো ডিভোর্স হয়নি। আর আমি আসলে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে চাইছি না। আমার একটু সময় প্রয়োজন।”
— “ঠিকাছে নাও সময়। তারপর ভেবে দেখো। আজ আসি।”
সিনথিয়া বেরিয়ে গেলো। জাভেদের মোটরসাইকেলে বসে পরলো। জাভেদ মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি বললো সে?”
— “সময় চাইছে।”
— “হু..। আমি অপ্সরার মামা-মামীর সাথে কথা বলেছি। উনারা রাজি আছেন। এখন শুধু অপ্সরা মানলেই হলো।”
তারপর আর কথা হলো না দুজনের মাঝে। মোটরসাইকেল নিয়ে দুজনেই পারি দিলো একটা অজানা গন্তব্যে। যদিও জাভেদের জানা আছে সে কোথায় যাচ্ছে। সিনথিয়া জানে না। তাই অধির আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে সেই পথের দিকে।
চলবে,,
® ‘নুরুন নাহার।’
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার
~চলবে,,
® ”নুরুন নাহার’
#মেঘমালার_গল্পকথা_নুরুন_নাহার