তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
পঞ্চদশ পর্ব
রাত প্রায় দেড়টার উপর বাজে। অনিমাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা বেজে গেছে। এর পরে বেশ কিছুটা সময় ধরে কয়েকটা জব অ্যাপ্লিকেশন করছিল মুনির। সব শেষ করে যখন ঘুমাতে গেল তখন শরীরজুড়ে ক্লান্তি কিন্তু ঘুম নেই।
অনিমার সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরী। ও কি ঠিক করল তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বলতে গেলে ওর গোটা জীবনটাই নির্ভর করছে।
মুনির বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালো। দেশে থাকতে শেষের কয়েকটা বছরে এই বারান্দায় বহু সময় কাটিয়েছে ও। তীব্র অপরাধবোধ ছিল। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হত। মনে হত এই যা কিছু হচ্ছে সবকিছুর জন্য ও নিজেই দায়ী। কেন যে আগে কোন কিছু বুঝতে পারেনি। কিছুই বুঝতে পারেনি। ও এমনকি নিজের মনটা পর্যন্ত না।
মুনির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ফিরে এলো। আজ বোধ হয় আর ঘুম আসবে না। অবশ্য এটা নতুন কিছু না। গত পাঁচ বছর ধরে এমনই হয়ে আসছে।শুরুটা হয়েছিল খুব অদ্ভুত ভাবে। তখন মুনির কেবল মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি শুরু করেছে। ফল সেশনের ক্লাস শুরু হয়েছে। পড়াশোনা ,পার্ট টাইম জব সব মিলিয়ে দারুণ ব্যস্ততা। ওর রুমমেট গ্রিসে গেছে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মুনির ঘরে একাই ছিল। হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। কোন দুঃস্বপ্ন দেখে নয়, ঠাণ্ডা কিংবা অন্য কোনো কারণেও নয়। হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেল। সাধারণত ঘুম ভেঙে গেলেও আমাদের মধ্যে একটু ঘুমের রেশ থেকে যায়, কিন্তু সেরকম কিছুই না। প্রতিটি ইন্দ্রিয় একেবারে সজাগ। ঘুম থেকে জেগে ওর মনে হলো বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে আছে। তীব্র হাহাকার অনুভব করল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় তিনটা বাজে মনে হলো হয়তো দেশের জন্য খারাপ লাগছে। দেশে তখন দিনের বেলা। ও বাড়িতে ফোন করে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলল। লাভ হল না। কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও টুকটাক কথা হল। তারপরেও ভিতরকার অস্থিরতাটা কমছেনা। একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করল। কিছুক্ষণ পর মনে হল শূন্যতা, হাহাকার, আর অস্থিরতার সঙ্গে এখন একটা দমবন্ধ ভাব যোগ হয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে মুনির তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। পাশের রুমে ওর দুই বন্ধু ঘুমাচ্ছে। তখন পাতা ঝরার দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গাছের নানান রঙের পাতাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করেছে। মুনির অনেকক্ষণ রাস্তায় এলোমেলো হাটলো। ততক্ষনে ভোর হয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে সামনের পার্কটাতে ঢুকে পড়ল। পার্কটা বেশ বড়। সামনে খানিকটা খোলা জায়গা তারপর প্লেগ্রাউন্ড। পুরো পার্ক জুড়ে অনেক গাছ।,মুনির হাঁটতে-হাঁটতে ভেতরের দিকে চলে গেল। ততক্ষনে ভোর হয়ে গেছে। চারিদিকে নরম আলো। একসারি ম্যাপল গাছের সামনে এসে দাড়ালো মুনির। গাছগুলো সব লাল, কমলা, হলুদ পাতায় ছেয়ে আছে। প্রচুর পাতা ঝরে পড়ছে সবগুলো গাছ থেকে। মুনির অপলক চেয়ে রইল। গাছের পাতা ঝরার দৃশ্য দেখতে অনিমার অনেক ভালো লাগতো। মুনির গাছগুলোর উল্টো দিকের একটা বেঞ্চে এসে বসলো। এতক্ষণ পর একটু ভালো লাগছে। মুনির বেঞ্চে হেলান দিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। ঠিক ওর পাশেই বসে আছে অনিমা। টুকটুকে লাল একটা সল জড়ানো গায়ে। কেমন ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানি ভঙ্গীতে বসে আছে। মুনির আনমনে বলল
– অ্যাংরি বার্ড কোথায় হারিয়ে গেলে
পরবর্তী দুই দিন মুনির তন্ন তন্ন করে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় অনিমাকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও ওর কোন চিহ্ন নেই। বাধ্য হয়েই মুনির অনিমাকে চিঠি লিখতে বসলো। কিন্তু সেই চিঠি পোস্ট করার মতন কোনো ঠিকানা ওর কাছে নেই। অগত্যা মেসেঞ্জারে সেন্ড করতে লাগল একের পরে এক। কোন না কোন একদিন তো দেখবে নিশ্চয়ই। এরও প্রায় বছর চারেক পরে একদিন ফেইসবুক এ বড় চাচীর কনভোকেশনের ছবিতে অনিমাকে দেখে চমকে গিয়েছিল মুনির। পিএইচডি তখন শেষ পর্যায়ে তাই হুট করে দেশে আসতে পারেনি। তবে পরবর্তী এক বছর খুব চোখে চোখে রেখেছে অনিমাকে। অনিমে কি সত্যিই চিঠিগুলি দেখেছে? বোধহয় দেখেনি। কি জানি? মুনির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা হাতে নিল। আশ্চর্য এত রাতে অনলাইনে কি করছে ও? তবে কি অনিমা ও ঘুমাতে পারছে না? মুনির একটা মেসেজ পাঠাল
– ঘুমাওনি?
– ঘুম আসছেনা
– কল করি?
-ওকে
অনিমা রাতজেগে মুনিরের মেসেজগুলো পড়ছিল। আজকাল প্রতিরাতেই পড়ে। একেকটা অনেক বার করে। ফোন পেয়ে একটু অবাক হয়ে গেল। বলল
– এদেশের টাইম জোনের সাথে এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি তাই না?
– না সেরকম কিছু না। আমার অনেকদিন ধরেই ঘুমের সমস্যা
– তুমি কবে ফিরে যাচ্ছ মুনির?
– কোথায়?
– তোমার পোস্ট-ডক আরম্ভ করতে
– পুরোটাই তোমার উপর নির্ভর করছে
– আমার উপর? অনিমা অবাক হয়ে জানতে চাইল
– তুমি নিশ্চয়ই এখন বাবা-মাকে ছেড়ে আমার সঙ্গে যেতে পারবে না। সেরকম হলে আমি পোস্ট- ডক করব না। একটা কথা জানার ছিল
– বলো
– তুমি কি ঢাকা ইউনিভার্সিটি চাকরিটা নিচ্ছ?
– না
– কেন? তোমার তো স্বপ্ন ছিল
– কত স্বপ্নই তো ছিল। অনিমা মন খারাপ করা কন্ঠে বলল। তারপর একটু থেমে বলল
– তুমি আমাকে মেসেজ পাঠাতে মুনির?
– হ্যাঁ। যখন তোমার কথা মনে পড়তো তখন পাঠাতাম। কেন তুমি আগে দেখনি?
– না আগে দেখিনি। প্রতিদিনই পাঠিয়েছো ?
– প্রতিদিনই মনে পড়তো
অনিমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কেন যেন হঠাৎ করে চোখে জল এসে গেল
– তুমি কাঁদছো অনিমা ?
অনিমা চোখ মুছে বলল
– না
– একবার তোমার কাছে আসতে খুব ইচ্ছা করছে
অনিমা খুব নিচু গলায় বলল
– আমার ও
মুনির হঠাৎ উৎফুল্ল কন্ঠে বললো
– চলো কাল দেখা করি। কাল তোমার ক্লাস কয়টা পর্যন্ত?
– কালকে আমার ক্লাস নেই। শুধু খাতা জমা দিতে যাব
– তাহলে আমি তোমাকে পিক করে নেব। কালকে সারাদিন একসঙ্গে ঘুরবো। কেমন ?
অনিমা চেষ্টা করেও এড়াতে পারল না। বলল
– আচ্ছা
পরদিন সকাল বেলা অনিমা খুব যত্ন করে সাজলো। একটা সাদা পাড় গোলাপী রঙের মনিপুরী তাঁত পরলো। সঙ্গে মুক্তার গয়না। আজ আর খোপা বাধলো না। স্নান করে চুলটা ছেড়ে দিল। ডিপার্টমেন্টের কাজ সেরে নিচে নেমে দেখল আজও মুনির সেদিনের মতোই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ও ব্লু টি-শার্ট পরে এসেছে সঙ্গে জিন্স। অনিমাকে দেখে হাসল সুন্দর করে ,তারপর গাড়ির দরজা খুলে দিল।
মুনির যেখানে গাড়ি থামালো সেটা একটা বিলাসবহুল বহুতল ভবন। অনিমা বেশ অবাক হয়ে গেল কিন্তু কিছু বললো না। মুনির ওকে নিয়ে লিফটে করে একেবারে টপ ফ্লোরে চলে গেল। তারপর চাবি দিয়ে কোনার দিকের একটা ফ্ল্যাট খুললো। অনিমা অবাক হয়ে জানতে চাইল
– এটা কার বাড়ি?
– আমাদের
অনিমা চারপাশে তাকিয়ে দেখল। বেশ বড় একটা ফ্ল্যাট। টপ ফ্লোর বলে অনেক আলো। বিশাল ড্রইং ডাইনিং। ডানদিকে ওপেন কিচেন আর সামনে তিনটা শোবার ঘর। অনিমা ড্রইংরুমের বড় জানালাটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
– তোমরা এখানে কবে উঠছো?
– তোমরা না আমরা। এই ফ্ল্যাটটা আমি কিনেছি, তোমার আর আমার জন্য
– মানে?
– মানে বিয়ের পর আমরা এখানে উঠবো তোমার বাবা-মা সহ
অনিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। মনে হলো ও ভুল শুনছে। এসব কি হচ্ছে? মুনির এসব কি বলছে?
মুনির এগিয়ে এসে অনিমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল
-আমি জানি তুমি কেন বিয়ে করতে চাও না। তুমি এখন যেভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে আছ বিয়ের পরও সেভাবেই থাকবে।
-তোমার বাসার সবাই সব জানে?
– জানবে না কেন?
– উনাদের কোন সমস্যা নেই?
– না। আমিতো এখনো বাইরেই থাকি।
– দুটো এক না। এটা ভালো দেখাবে না। ওনাদের ভালো লাগবে না।
অনিমা হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে মুনির ওর হাতটা ধরে আবার কাছে টেনে নিল। তারপর বলল
– আমি বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। উনাদের কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া নাজমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর ও ক্যানাডা চলে যাবে। কদিন পর বাবা-মা ও চলে যাবে।
– সবকিছু তো আর এত তাড়াতাড়ি হবে না
– না হলেও কোন সমস্যা নেই
– এটা সম্ভব না
মুনির দুই হাতে অনিমার মুখটা তুলে ধরে করুণ কন্ঠে বলল
– কেন জেদ করছ? আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই?
– আমার স্বপ্ন দেখতে খুব ভয় করে মুনির। আমার সব স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হযে যায়। এর আগেও হয়েছে।
-আমি জানি। আর এরকম হবে না। আমি আছি তো তোমার পাশে।
অনিমা হঠাৎ করেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলে না। মুনিরের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুনির বাধা দিল না। বরং খুব আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নিশ্চয়ই অনেক দিন ও কাঁদে না। হয়তো এতদিন কেউ ছিল না এমন করে যার বুকের মধ্যে মাথা রেখে কাঁদতে পারে। অনেকটা সময় লাগলো অনিমার শান্ত হতে। মুনির ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলল
-তোমার বাসা দেখবে না?
অনিমা মুখ তুলে চোখ মুছলো। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললো
-চলো
মুনির হাত ধরে ওকে বড় ঘরটাতে নিয়ে গেল। এই ঘরের সঙ্গে একটা বিশাল বারান্দা। অনিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। টপ ফ্লোর বলে বাইরের কোলাহল একেবারেই ভেতরে আসে না। মুনির ওর কাছে এসে বলল –
-চলো আমাদের ঘরটা দেখে আসি।
অনিমা একটু চমকালো তবে কিছু বলল না। অন্য ঘরটা একটু ছোট এর সঙ্গে কোন বারান্দা নেই। কিন্তু ঘরটা বেশ সুন্দর। বিশাল জানালার ওপারে অনেক গাছে ঘেরা একটা খেলার মাঠ। মুনির ওর কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল
-বাসা পছন্দ হয়েছে?
অনিমা উপরে নিচে মাথা নাড়লো। মুনির দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল
-আমাকে কি দেবে বলো
কি চাও তুমি?
তোমাকে, শুধু তোমাকে চাই
চলবে ….তোমাকে, শুধু তোমাকে চাই
ষষ্ঠদশ পর্ব
জীবনটা কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে অনিমার। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সারাদিন যা ঘটেছে সেগুলো সত্যি ছিল। আজ সারা দিন ওরা দুজন একসঙ্গে ঘুরেছে । ঠিক আগের মতন । দুপুর বেলা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ করেছে একটা রেস্টুরেন্টে, তারপর বিকেলবেলা অনেকক্ষণ রিক্সা ঘুরেছে। পুরোটা সময় মুনির ওর হাত ধরে ছিল। আগে যখন ওরা রিক্সা করে কোথাও যেতো, অনিমার খুব ইচ্ছা করত এই রকম ভাবেই হাত ধরে যেতে। কিন্তু কখনো বলা হয়ে ওঠেনি।
সন্ধ্যেবেলা মুনির ওকে একটা শপিংমলে নিয়ে গেল। বাসার জন্য কিছু টুকটাক কেনাকাটা করলো দুজন । একটা জুয়েলারি শপে ও নিয়ে গিয়েছিল। অনেক রিকোয়েস্ট করেছে একটা আংটি কেনার জন্য কিন্তু অনিমা রাজি হয়নি, বলেছে ওর বাসার সবার সাথে এসে কিনতে। একটা শাড়ি কিনে দিতে চেয়েছিল সেটা ও নেয় নি।
শপিংমল থেকে বেরিয়ে অনেক বছর পর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দুজন ফুচকা খেল। বাসায় পৌছে দেয়ার সময় মুনির বলল
– তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না
– কেন?
– ইচ্ছা করছে নিয়ে বাসায় চলে যাই
অনিমা খুব হেসেছে শুনে। মুনির বলেছে ওরা শুক্রবার দিন বিকেলে আসবে বাবা-মা সহ I বিয়ের কথা বলতে। শুনে অনিমা আঁতকে উঠেছিল। আজকে শনিবার। তার মানে হাতে এক সপ্তাহ সময় ও নেই। এর মধ্যেই সবকিছু গুছাতে হবে। বাসার যে অবস্থা, তারপর বাজার করা আরো কত রকমের কাজ আছে। মুনির ওর চিন্তিত মুখ দেখে বলল
– তাহলে বাইরে কোথাও দেখা করি। মানে বাসায় যদি ঝামেলা হয়।
– না , বাইরে হলে বাবা যেতে পারবে না
– ও আচ্ছা I তাহলে বাসায় থাকুক। তোমরা কোন ঝামেলা করোনা। আমরা বিকাল নাগাদ আসব
– ঝামেলা কি? আসো তোমাদের সুবিধা মত
মুনির গাড়ি করে ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। অনিমা বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে বারান্দায় গুনগুন করে গান গাইছিল। আজকে মনটা এত ভালো লাগছে কেন ?
কদিন ধরেই রুবিনা লক্ষ্য করছে মেয়েটা কেমন যেন অন্য রকম আচরণ করছে। তবে আজকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর মন খুব ভালো। কত বছর পর গুনগুন করে গান গাইছে। রুবিনা এরকম একটা পরিবেশের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেয়ের কাছে কথাটা বলে ফেলাই ভালো। যদিও মেয়ের বাবা এখনো পর্যন্ত মেনে নেয়নি। ঘরে গিয়ে মেয়ের খাটে বসল রুবিনা। বিছানার উপর ফোনটা ভাইব্রেট করছে। রুবিনা মেয়েকে ডেকে বললেন
– তোর ফোন বাজে। দেখ। অনিমা তড়িঘড়ি এসে ফোনটা তুলে নিল। মুনির ফোন করছে । অদ্ভুত এক ঘন্টাও হয়নি। অনিমা লাইন কেটে দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-কিছু বলবে মা
-তোর কালকে ক্লাস কয়টায় ?
– সকাল আটটায় । তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে
– আচ্ছা তাহলে কাল কথা বলবো
রুবিনা মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটু রয়ে সয়ে বুঝেসুঝে কথাটা পড়তে হবে। তা না হলে সমস্যা। আজ দুপুরে মিনহাজ ভাই এসেছিলেন সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটাকে আগেরবার দেখে ভ্যাগাবন্ড মনে হলেও এবার বেশ ভালো লেগেছে। এমনিতে মিনহাজ ভাই দেখতে সুন্দর। ছেলেও হয়েছে তার মতোই। লম্বা, চওড়া। রংপুরের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে নাকি এমবিএ করেছে। এখন ঢাকায় কি একটা চাকরি নিয়ে এসেছে। ওরা খুব চাইছে সবাই ঢাকায় শিফট করতে। মিনহাজ ভাই এসেছিল বিয়ের কথা বলতে। টেলিফোনে অবশ্য আগেই কথা হয়েছে। রুবিনা বেশ রান্নাবান্না করেছিল দুপুরবেলায়। ওরা খাওয়া-দাওয়া করেছে তারপর বিকেলবেলা কথাবার্তা হয়েছে। বিয়ের পর সবাই মিলে একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে নেওয়া যাবে। অনিমা যদি বাইরে পিএইচডি করতে যেতে চায় তাহলে যাবে। দরকার হলে তৌহিদ ও যাবে সঙ্গে। অবিবাহিত মেয়েকে তো আর একা বাইরে পাঠাতে পারবে না। মেয়েটার এত শখ ছিল। তাছাড়া বয়স ও তো হয়ে যাচ্ছে। হাসান সাহেব অবশ্য একেবারেই রাজি না। ওদের সঙ্গে ঠিক মতন কথা পর্যন্ত বলেননি। ওনার এক কথা,এরা স্বার্থপর। এখন নিজের স্বার্থ দেখেছে তাই বিয়ের কথা বলছে। আমার মেয়ে এদের সাথে ভালো থাকবে না। স্বার্থ দেখছে এটা রুবিনা ও বোঝে। কিন্তু নিঃস্বার্থভাবে এখন কে আসবে, যে বাবা-মা সহ মেয়ের দায়িত্ব নিতে চাইবে। বাবা মাকে ফেলে অনিমা কখনো বিয়েতে রাজি হবে না। এটা হলেই সব থেকে ভালো হবে । একটু বুঝিয়ে বলতে হবে ।
মুনির ফোন করেই যাচ্ছে। অনিমা বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরে বলল
-কি হলো ? এত বার ফোন করছ কেন?
-ফোন ধরছিলে না কেন?
– মা ছিল ঘরে
– একটা মেসেজ দিতে পারতে
– আচ্ছা, ভুল হয়ে গেছে। বল এখন কি ব্যাপার?
-কিছু না, এমনি
-এমনি! একটু আগেই না দেখা হল
– হ্যাঁ তো? একটু আগে দেখা হলে আর ফোন করা যাবে না?
– আচ্ছা বল
– কি রঙের শাড়ি কিনব?
– কিসের শাড়ি ?
– বিয়ের । আবার কিসের?
অনিমা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো । হাসতে হাসতেই বললো
– তুমি এমন ভাব করছো যেন কালকেই বিয়ে
– এটা হলে তো সবচেয়ে ভালো হতো । যাইহোক ঠিক মতন বল। শুক্রবার দিন সব নিয়ে আসব।
– শুক্রবার দিন তো কথা বলতে আসবে।
-এত কথা বলার কি আছে? শুক্রবার দিন সব নিয়ে আসবো। আর শনিবার দিন অথবা সম্ভবত শুক্রবারেই…
– তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এমন পাগল হয়েছ কেন?
– তোমার কোন ভরসা নেই
– মানে?
– কবে আবার পালিয়ে যাও
অনিমা হাসতে হাসতে বলল
– পালিয়ে কোথায় যাব?
– কোথাও যেতে পারবেনা। তোমাকে আমি কোথাও যেতেই দেব না
তাড়াতাড়ি ঘুমাবে বললেও রাত দুইটা পর্যন্ত গল্প চলল। এরপর মুনির নিজেই বলল
– অনিমা ঘুমিয়ে পড়োI কালকে সকাল সকাল তোমার ক্লাস ।
পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ওকে দেখে অনেকেই বললো
– কি ব্যাপার অনিমা ? তুমি এরকম ব্লাশ করছ,গুড নিউজ আছে নাকি ?
অনিমা লজ্জা পেয়ে বলল
– না, সেরকম কিছু নয়
– তাই ? আর যে হ্যান্ডসাম ছেলেটা তোমাকে প্রতিদিন নিতে আসে, সে কে?
-কার কথা বলছেন?
কলিগেরা মিটিমিটি হাসে, তারপর বলে
-একেবারে নায়ক এর মতন দেখতে। একদিন আলাপ করিয়ে দিও।
অনিমা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিছু বলতে পারেনা ।
অনিমার খুব ব্যস্ততায় সময় কাটছে। মুনির অনেক রকমের প্ল্যান করে ফেলেছে। বিয়ের পর কোথায় কোথায় যাবে, নতুন ফ্ল্যাটের জন্য একসঙ্গে কেনাকাটা করবে আরো অনেক কিছু। অনিমাকে বলেছে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে, কারণ সামনে ছুটি নিতে হবে। অনিমা ভাবল কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখা ভালো। মিড-টার্ম এর কোশ্চেনগুলো এখন করে ফেললে আর সমস্যা থাকবে না। তাই সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে কোশ্চেন করতে বসে গেল। মুনির সম্ভবত শপিং করতে গেছে, রেহানা আন্টি আর নাজমাকে নিয়ে। তাই ফোন করতে পারছেনা। তা না হলে এতক্ষনে ফোন করে জ্বালিয়ে মারত। ভালোই হয়েছে, এই সুযোগে কোশ্চেন গুলি করে ফেলা যাবে। মাথাটা খুব ধরেছে। কখন মাকে বলেছে একটু চা দিতে। অনিমা ভাবল নিজেই উঠে নিয়ে আসবে। ঠিক তখনই ফোনটা এলো। প্রথমে ভেবেছিলো মুনির। কিন্তু আননোন নাম্বার দেখে একটু অবাক হয়ে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে রিনরিনে গলায় একটি মেয়ে বলল
– হ্যালো, অনিমা আপুর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
– বলছি। কে বলছেন?
– আমার নাম মিথিলা
– জি বলুন
– আমি মুনির ভাইয়ের খালাতো বোন
অনিমা অনেকটা অবাক হলো। মুনির কি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে নাকি?
– ও, ভালো আছেন ?
– আমাকে তুমি করে বলতে পারেন। আমি আপনার মত বয়স্ক নই।
অনিমার একটু কানে লাগলো কথাটা। সাধারণত মুনিরের বাসার কেউ ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলে না। ও স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
– হ্যাঁ আপু বলো
মেয়েটা নাক টেনে বললো
– আপনি আমার এত বড় সর্বনাশ কেন করলেন ?
– এক্সকিউজ মি! আমি ঠিক বুঝলাম না
– আপনি কি জানেন না মুনির ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ?
– কি!?
– মুনির ভাই বিদেশে যাওয়ার আগেই তার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর এখন ফিরে এসে আপনাকে দেখে উনি আর বিয়ে করতে চাইছে না। এখন তার মন ঘুরে গেছে।
অনিমা কি বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটা বলেই যাচ্ছে
– আপনি কি করে নিজের স্বার্থের জন্য এমনটা করতে পারেন? আপনার একটুও খারাপ লাগছে না? উনাদের বাড়িতেও কেউ খুশি না। কিন্তু কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। তা না হলে নাকি উনি আবার বিদেশে চলে যাবেন আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। তাই বাধ্য হয়ে সবাইকে মেনে নিতে হচ্ছে।
অনিমা থমথমে গলায় বলল
– মুনির তো আমাকে এসব কিছুই বলিনি
– সে কেন বলবে? আর বললেই বা আপনি সেটা স্বীকার করবেন কেন? আপনিতো শুধু নিজেরটাই দেখছেন। কিভাবে আপনার বাবা-মা কে নিয়ে উনার ফ্ল্যাটে উঠা যায়।
অনিমার মনে হল কেউ ওর সমস্ত শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এজন্যই মুনিরএত তাড়াহুড়া করছে? বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার ওর দেখা পর্যন্ত করালো না। হয়তো সবাইকে বাধ্য করে শুক্রবার দিন নিয়ে আসবে। অনিমা কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
– আমার জন্য তোমার কোন সমস্যা না
– আপনি আবার এসব ওনাকে বলে ঝামেলা লাগাবেন না তো?
– না। আমি এই বিয়েটা ভেঙে দেব
– থ্যাংক ইউ আপু
অনিমার মনে হল যন্ত্রণায় ওর মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। দুইহাতে কপাল চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। এখন কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। মুনিরের সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ নেই। ও কিছুতেই মানবে না। অনিমা ওকে চেনে। অসম্ভব একরোখা ছেলে ও। দূরে কোথাও চলে যাবে? বাবা মাকে নিয়ে এখন সেটাও সম্ভব না। অনিমার মাথায় কিছু আসছে না ।
রুবিনা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন মেয়ে কপাল চেপে ধরে বসে আছে। আহারে! নিশ্চয়ই মাথা ধরেছে। কাছে এসে আদুরে কণ্ঠে বলল
– কিরে মাথা ধরেছে? চা নে
অনিমা চায়ের কাপ নিল। রুবিনা তবু দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল
– কিছু বলবে মা ?
রুবিনা সাহস করে বিয়ের কথাটা বলেই ফেলল। তারপর জানতে চাইল
– এখন ওদের কি বলবো ?
– হ্যাঁ বলে দাও
রুবিনা আশ্চর্য হয়ে গেল। মেয়ে এত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ভাবতেও পারেনি। বলল
– তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি না ?
– দরকার নেই আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলব
রুবিনা খুশি মনে বলল
– ঠিক আছে তাহলে আমি এখনই ওদের ফোন করছি
একটু পরে ফিরে এসো বলল
– ওরা একটু তাড়াহুড়া করছে। এই শুক্রবারে কাবিন করে ফেলতে চায় ।
– ঠিক আছে
চলবে …..