#ধূসর_প্রেমের_অনুভূতি
#ফারহানা_ছবি
#পর্ব_১৮[বিয়ে স্পেশাল]
.
.
.ফারহা ড্রইংরুমের দিকে তাকিয়ে দেখে ফারহার বাবা মা আদিল রাফি তন্নি আর মেঘের বাবা মা ভাই সবাই হাজির ৷ সবাইকে চিনতে পারলেও একজনকে চিনতে পারলো না ফারহা! একজন হুজুর মতো ব্যক্তি সোফায় এক কোনে টুপি মাথায় দিয়ে বসে আছে৷ মেঘ ফারহাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ফারহার গলার ওরনার খানিকটা অংশ ফারহার মাথায় দিয়ে যা বললো সেটা শুনে ফারহা বিস্মিত হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে৷
” এই মুহূর্তে ফারুপাখি আর আমার বিয়ে হবে৷”
” বি,,বিয়ে! ”
” ইয়েস, বিয়ে ফারুপাখি৷ আজ আমাদের বিয়ে হবে৷ অনেক হয়েছে দুটো হৃদয়ের অনুভুতি নিয়ে খেলা৷ আজ এই মুহূর্তে আমাদের বিয়ে হবে৷”
” কিন্তু মেঘ এভাবে আমি বিয়ে করতে পারবো না৷ আমার বোনের অনুপস্থিতিতে এই বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব৷ আমি চাই আমার বিয়েতে আমার পুরো পরিবার থাকুক৷ কিন্তু এভাবে আংশিক অপরিপূর্ণ পরিবার নিয়ে আমি বিয়ের পিড়িতে বসতে পারবো না৷ ”
মেঘ ফারহার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য দম মেরে দাড়িয়ে থেকে বলল, ” আমাকে রাগিয়েও না ফারুপাখি৷ ফলাফলটা তোমার জন্য বিশেষ একটা ভালো হবে না৷ বিয়ে তো আজ আর এখুনি হবে ফারুপাখি তুমি চাও বা না চাও ৷ আর বাকি রইল ফারিহার বিয়েতে থাকা নিয়ে কথা? বড় করে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে যখন তখন না হয় ফারিহা উপস্থিত থাকবে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে যে নেই তার জন্য আমি অপেক্ষা করবো না৷ অনেক গুলো বছর অপেক্ষা করেছি কিন্তু আর নয় ৷ এতো গুলো বছরের অপেক্ষার আজ অবসান ঘটবে এবার৷ ”
মেঘের প্রত্যেকটা কথা ফারহার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে৷ মেঘ যে তাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে ফারহার আর বাকি নেই৷ ফারহা বিয়ে আটকানোর মতো আর কোন রিজেন খুজে পেল না৷ অগ্যতা ফারহা চুপ হয়ে গেল৷ মেঘ ফারহাকে সোফায় বসিয়ে কাজী সাহেব ভদ্রলোককে বলল,” আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন৷”
মেঘের অনুমতি পেয়ে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন৷ মেঘের বাবা মা ভাই আদিল রাফি তনু আর ফারহার মা বাবা সকলে মেঘের দিকে ভিতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ যে প্রচন্ড রেগে আছে তা বুঝতে কারোর বাকি নেই৷ কিন্তু এমন কি ঘটলো যেটার কারণে মেঘ এতো রেগে আসে? এটাই কেউ বুঝতে পারছে না৷ মেঘের বাবা মায়ের কোন ইচ্ছে ছিলো না এভাবে ছোট ছেলের বিয়ে হোক৷ কিন্তু মেঘের রাগ জেদের কাছে হারতে বাধ্য তারা৷
কাজী সাহেব মেঘকে কবুল বলতে বলায় মেঘ দেরি না করে তিন বার কবুল কবুল কবুল বলে সাইন করে দেয়৷ কিন্তু ফারহাকে কবুল বলতে বলায় ফারহা দম মেরে বসে থাকে মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয় না৷ ফারহাকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ রেগে ফারহার হাত শক্ত করে চেপে ধরতে ফারহা চোখ বন্ধ করে কবুল বলে ফেলে৷ আদিল রাফি দুজনে আলহামদুলিল্লাহ বলে দৌড়ে কিচেনে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আসে৷
সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে মেঘের কাছে এসে বলে,” জিজু আপনি এখন আপুকে মিষ্টি খাইয়ে দেও আর ফারহা আপু তুমিও জিজুকে মিষ্টি খাইয়ে দেও৷”
আদিলের কথা শেষ হতে ফারহা রক্তিম চোখে আদিলের দিকে তাকিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়৷ ফায়েজ খান আর আইরিন খানের চোখ মুখ ভার হয়ে আছে৷ ফারহাকে যেতে দেখে মেঘ পেছন পেছন যেতে নিলে আইরিন খান বলে ওঠে,” মেঘ বাবা তুমি এখানে থাকো আমি ফারহার কাছে যাচ্ছি৷”
মেঘ কি মনে করে মাথা নেরে সায় দিলো ৷ আইরিন খান তার মেয়ের রুমে এসে হতভম্ব হয়ে যায়৷ ফারহার কয়েক মুহূর্তে পুরো রুমের ভোল এভাবে পাল্টে ফেলবে তার ধারণা মটেও করেন নি৷
রুমের ভেতরে যেন টর্নেডো বয়ে গেছে এমন অবস্থা৷ আইরিন খান ফ্লোর থেকে বালিশ তুলে বেডের উপর রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে ফারহা হাটু মুরে বসে আছে৷ ফারহার চোখ দুটো শূন্য আকাশের দিকে; আইরিন খান তার মেয়ের পাশে বসতে ফারহা তার মায়ের কোলে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে৷ ফারহার এমন উৎভট আচরনের কারণ আইরিন খান খুজে পাচ্ছে না৷ যেখানে ফারহা মেঘ দুজন দুজনাকে ভালোবাসে সেখানে এমন আচরন আইরিনের কাছে অস্বাভাবিক লাগার কথা৷ আইরিন খান কিছু বলবে তার আগে ফারহা বলে,” মম আমি খুব খারাপ মেয়ে খুব খারাপ বোন তাই না?”
“না মা তুমি মটেও খারাপ না৷ খারাপ তো পরিস্থিতি৷”
” মম জানো তো আমিও না ফারিহার মতোই বিহেব করছি৷ ওর মতোই হিংসাত্মক হয়ে প্রতিশোধের নেশায় ওই হিংস্র নরপশু টেরোরিস্ট কিং ফায়ারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ ওখানে কিং ফায়ার ফারিহার সাথে ভিষণ জঘন্য ব্যবহার করবে৷ ওকে শেষ করে দিবে ৷ মম আমি বোন হয়ে কি করে পারলাম ওরকম ব্যবহার করতে? আমি পারি নি ওকে মানুষ করতে৷ ওকে বোঝাতে ৷ বরংচ আমি নিজে পাথর অনুভূতি শূন্য একটা রোবট মানুষে পরিণত হয়েছি৷”
ফারহার কথা শুনে আইরিন খান মুখে আচঁল গুজে নিঃশব্দে কাঁদছে৷ দুই মেয়ের জন্য প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আইরিনের তবুও কিছু বলছে না কারণ তার ছোট মেয়ে আর মানুষ নেই পশুর থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে গেছে৷ সম্পূর্ন বিকৃত মস্তিষ্কের হয়ে গেছে ফারিহা৷ ওকে ভালো করা এতো সহজ হবে না ফারহার জন্য এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে আইরিন খান৷
ফারহা কিছুক্ষণ কেঁদে উঠে বসে আইরিন খানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,” মম আমি ফারিহাকে ফিরিয়ে আনবো৷ ওকে ভালো হওয়ার আর একটা সুযোগ দিবো৷ ”
” ঠিক আছে ফারহা তুমি যেটা ভালো মনে করো করবে৷ তবে একটা কথাই বলবো ফারহা৷ সবার আগে আমাদের দেশ আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করা তোমার আমার সকলের কর্তব্য৷ কখনো নিজের কর্তব্য পালনে কার্পণ্য করবে না৷ আর একটা কথা মেঘের সাথে তোমার বিয়েটা হয়ে গেছে৷ তুমি মেঘকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না৷ মেঘ তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে ফারহা৷ তোমাকে হারানোর ভয়ে মেঘ তোমাকে এভাবে বিয়ে করেছে৷ মেঘের কথা শুনবে আর পারলে মেঘকে সবটা খুলে বলো আমার মনে হয় মেঘ তোমাকে সাহায্য করবে৷ আর নাও করলে আমি আছি তোমার ড্যাড আছে৷ ”
” আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছো তুমি?”
” ইয়েস মম৷”
” ওকে তুমি গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেও আমি সারভেন্টকে পাঠিয়ে রুমটা ক্লিন করার জন্য পাঠাচ্ছি৷”
মিসেস খান ফারহাকে নিয়ে রুম থেকে বের হতে তনু এসে হাজির হয়৷
” তনু মামুনি ফারহাকে নিয়ে তোমার রুমে চলে যাও আমি ওখানে ফারহার জন্য ড্রেস আর কিছু অর্নামেন্টস পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি ওকে রেডি করিয়ে দিও৷”
” ডোন্ট ওয়ারি আন্টি ৷ আমি ফারহাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবো৷ ”
তনু ফারহাকে নিজের রুমে যাওয়ার পর পর মেঘ এসে হাজির হয়৷
” আরে জিজু আপনি এখন এখানে?”
মেঘ ফারহার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বলে,” বউ আমার যেখানে আমিও সেখানে৷”
” ওহ মাই গড জিজু মাত্রই বিয়ে হলো আপনাদের আর এখনি বউকে চোখে হারাচ্ছেন সো কিউট ৷”
” শালী সাহেবা আপনি যদি আমাদের কিছু সময় একান্তে ছেড়ে দিতেন তাহলে এই অধম বাধিত হতো৷”
” একা ছেড়ে দিতে পারি যদি আপনি ট্রিট দেন?”
” ওকে ডান, ট্রিট পেয়ে যাবে৷”
” তাহলে তো আমিও আপনাদের একান্তে ছেড়ে দিতে পারি৷ ”
তনু ফারহার দিকে তাকিয়ে বেস্ট অফ লাক বলে দরজা বাইরে থেকে আটকে চলে যায়৷ তনু চলে যেতে মেঘের চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব ফুটে ওঠে৷ ফারহা মেঘকে ইগনোর করে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নিলে মেঘ ফারহার হাত ধরে হ্যাচকা টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,” ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ইগনোর মি ফারুপাখি৷ ভালোবাসি বলে এটা ভেবো না আমি তোমার ইগনোরনেস সহ্য করবো৷ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়কার করে দিবো সব কিছু৷ তুমি শুধু আমার আর মেঘ জানে তার ভালোবাসাকে কি করে নিজের করে রাখতে হয়৷ আমাদের ধূসর প্রেমের অনুভূতি গুলো বিয়ে নামক এক পবিত্র সম্পর্কের নাম পেলো ৷ হয়তো এই অনুভূতি কখনো শেষ হবে না আর আবছায়া হয়ে মিলিয়ে যাবে৷ ”
ফারহা মেঘের বাহুদ্বয়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার আপ্রান চেষ্টা করতে করতে বললো,
” অনুভূতি গুলো মিলিয়ে যাবে নাকি আরো প্রখর হয়ে ঝাঁপটে ধরবে? সেটা নাহয় সময় বলে দিবে মেঘ৷ এখন তুমি দয়া করে এই রুম থেকে বিদেয় হও৷ তোমাকে আমার এখন বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না৷ আমার কোন কিছু ভালো লাগছে না৷”
ফারহার কথা শুনে মেঘের হাতের বাধণ আলগা হতে লাগলো৷ সে সুযোগে ফারহা মেঘের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,” আমার সময় প্রয়োজন মেঘ৷ আশা করবো তুমি আমাকে সে সময়টা দিবে?”
মেঘ স্থির দৃষ্টিতে ফারহার দিকে তাকিয়ে হুট করে ফারহার চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে দিয়ে ফারহার ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দেয়৷ ফারহার কাছে এই মুহূর্তটা সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত সময়৷ ফারহা ভাবতেও পারেনি মেঘকে এতো কথা বলার পরেও মেঘ এমন কান্ড করতে পারে ৷
মিনিট তিনেক পর মেঘ ফারহার লাল টকটকে ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিয়ে বলে,” সময় চাই তোমার তাই তো? ওকে ফাইন রাতে আমি তোমাকে জানাবো৷ এখন আসছি সুইটহার্ট ৷ ” মেঘ ফারহার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷
(৩৬)
বিশাক্ত পোকা মাকড়ের কামড় খেয়ে ফারিহার অবস্থা যাচ্ছে তাই৷ ফারিহা অনেক চিৎকার করেও কারো কোন আওয়াজ না পেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সব কষ্ট হজম করছে৷ ফারিহার আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে ফারহার সাথে পূর্বের করা অন্যায়ের জন্য, ফারহা যে তাকে সব সময় আগলে রাখতো এতো কিছুর পরও সেটা ফারিহা কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি৷
ফারিহা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে,” আপুরে আমি সত্যি তোর সাথে জঘন্যতম আচরণ করেছি৷ তোর বোন হওয়ার কোন যোগ্যতা সত্যি আমার নেই৷ হিংসার বশবর্তী হয়ে তোর সাথে যে জঘন্যতম আচরণ করেছি তার শাস্তি এটা অতি নগন্যরে আপু৷ কিং ফায়ারের লয়াল হয়েও আজ আমি বিশ্বাসঘাতক উপাধি পেয়েছি৷ এটাই আমার প্রাপ্য আপু৷ আমি আমার শাস্তি পাচ্ছি দেখ আপু আমি আমার শাস্তি পাচ্ছি৷ ”
ফারিহা পোকা মাকড়ের কামড় সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ওঠে৷
এদিকে মদের গ্লাসে আইসকিউবের কয়েকটা টুকরো ফেলে, মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলে,” হুয়ার ইজ মারু হ্যারি?”
” কিং ফায়ার আমি মারুকে ওই নোংরা পোকা মাকড়ের রুমে আটকে রেখেছি৷ ”
” আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তো মারুকে পেতেই হবে আর সেটা আগামিকাল আমি নিজের হাতে ওকে মৃত্যু দিবো ৷”
” বাট কিং ফায়ার আরু যদি জানতে পারে আপনি ওর বোনকে মেরে ফেলার প্লান করছেন৷ তাহলে যদি আরু আমাদের বিপক্ষে চলে যায়?”
” সেটা কখনো হবার নয় হ্যারি৷ এই কিং ফায়ার সেটা কখনো হতে দিবে না৷ আর আরুকে তো আমি আমার রানী করবো তখন আরু চেয়েও আমার বিপক্ষে যেতে পারবে না হ্যারি৷”
” বস আমরা কানাডা কবে ব্যাক করবো?”
” খুব শীগ্রই আরুকে নিয়ে আমি দেশ থেকে চলে যাবো৷” মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে কিং ফায়ার তার রুমের দিকে চলে যায়৷
কিং ফারার চলে যেতে হ্যারির ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি এনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,” দাবার গুটির মতো এক এক করে ঘোড়া মন্ত্রী রানীকে আউট করে চেকমেট দিবো৷ আরাই চালের ঘোড়াকে যতোক্ষণ না আমি সরিয়ে দিচ্ছি ততোক্ষণ আমার শান্তি নেই৷ ”
.
.
.
.
লাল খয়েরি আর সাদার মিশ্রনে সাদা স্টোনের কাজ করা অসম্ভব সুন্দর একটি শাড়ি পরিহিতা নববধু আয়নার সম্মখে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছে৷ ডাগর ডাগর মায়াবি আখিদ্বয়ে লেপ্টে আছে গাঢ় কাজল৷ ঠোঁট জোড়ায় আকড়ে আছে লাল টকটকে লিপস্টিক৷ দু’হাত ভর্তি স্বর্ণের চুড়ি, নাকে ডাইমন্ডের নাকফুল, কানে বড় ঝুমকো, গলায় ভাড়ি হার, পায়ে নুপূর জোড়া ক্ষনে ক্ষনে রুমঝুম করে বেজে উঠছে ফারহার পায়ে পায়ে৷
ফারহা আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো,”কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি কারো জীবন এভাবে বদলাতে পারে? কয়েক ঘন্টা আগেও আমি ছিলাম আমার বাবার রাজকন্যা আর এখন আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী৷ ” ফারহা আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে আবার বলতে লাগলো,” এই কি সেই ফারহা যার হাত লেগে আছে অজস্র মানুষের রক্ত ৷ যার মনটা ধিরে ধিরে পাথরের ন্যায় শক্ত কঠিন আকার ধারণ করা মেয়েটি? এই কি সেই ফারহা যে আজই তার একমাত্র ছোট বোনকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না? এই কি সেই ফারহা যে তার মেঘরাজকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসে অথচ মুখ ফুটে কখনো ভালোবাসার কথা মানুষটার সামনে স্বীকার করেনি? এই সুন্দর হাসি খুশি থাকা মুখটার পেছনে ব্যর্থতার কষ্ট কি কখনো দূর হবে না?”
ফারহা নিজেকে ধাতস্ত করে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,” না এই ফারহা কখনো হারে নি আর না কখনো হারবে৷ এই ফারহা এবার তার মেঘরাজকে ফেরাবে না আর না নিজের বোনকে মৃত্যু দুয়ার থেকে অবশ্যই ফিরিয়ে আনবো৷ ”
তনু রুমে ঢুকতে ঢুকতে ফারহার বলা শেষের কথা গুলো কানে পৌছাতে আতঁকে ওঠে৷
-” কি বললি ফারু? তুই ফারিহাকে ফিরিয়ে আনবি ওই কিং ফায়ারের আস্তানা থেকে লাইক সিরিয়াসলি?”
ফারহা তার লম্বা চুল গুলো খোপা করে নিয়ে তনুকে বলে,” ক’টা বেজেছে খেয়াল আছে তনু? মেঘ কোথায়? আর আমি বা কখন আমার রুমে যাবো?”
তনু বুঝতে পারলো ফারহা তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে চায় না ৷ তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারহাকে বলে,” তুই আবারো আগুন নিয়ে খেলার চেষ্টা করছিস ফারু৷ তবে আমি একটা কথাই বলবো যা করিস না কেন সাবধানে করবি৷ আর আমাকে প্রয়োজন হলে জানাবি৷ এখন চল তোকে তোর রুমে নিয়ে যাই জিজু তার বউকে চোখে দেখার জন্য বার বার এরুমে আসার চেষ্টা করছিলো কিন্তু আদিল আর রাফির জন্য তা হয়নি৷ ”
ফারহা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে মুচকি হেসে তনুর সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়৷
মেঘ বাসর ঘরে ঢুকতে নিলে রাফি তনু আদিল শ্রাবণ দরজা আটকে দাড়িয়ে পড়ে৷ মেঘ তার ভ্রুযুগল কুচকে বলে,” কি বেপার তোমরা দরজা আটকে দাড়িয়ে আছো কেন? ”
রাফি দাঁত বের করে দিয়ে বলে,” কারণটা হলো টাকা৷ জিজু টাকা ছাড়ো রুমে ঢুকো না হলে আমি আমাদের বোনকে নিয়ে অন্য রুমে চলে যাবো৷”
” মানেটা কি? বউ আমার বাসরও আমি করবো তাহলে তোমাদের কেন টাকা দিবো?”
তনু তার চোখ জোড়া ছোট ছোট করব মেঘকে বলে,” এতো কষ্ট করে রুম সাজিয়েছি আপনার বউ সাজিয়েছি তার কোন মূল্য নেই আপনার কাছে?”
” অবশ্যই আছে কিন্তু তোমরা তো তোমাদের কতর্ব্য পালন করেছো তাহলে এখানে আমি কি করতে পারি?”
শ্রাবণ দাঁত কিড়মিড় করে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো, মেঘ তোর মতো কিপ্টা আমি দুটো দেখেনি৷ ছেলে মেয়ে গুলো এতো কষ্ট করে তোদের বাসর সাজালো আর তুই কিনা ওদের সামান্য আবদার মানতে পারছিস না?”
” এই ভাইয়া তুই এখানে কি করছিস? শিং ভেঙে বাছুরের দলে যোগ দিতে তোর লজ্জা করলো না?”
” নারে মেঘ বিশ্বাস কর আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা করছে না বরং বড় ভাই হয়ে তোর ঘাড় ভাঙতে ভিষণ আনন্দ হচ্ছে আমার৷”
” ভুলে যাস না ভাইয়া সামনে কিন্তু তোর বিয়ে৷ এমন না হয় বউ ছাড়াই তোকে একাই বাসর করতে হয়৷”
মেঘের থ্রেট শুনে শ্রাবণ সুর সুর করে কেটে পড়লো এদিকে রাফি তনু আদিল কেউ হার মানছে না৷ মেঘ সময় নষ্ট না করে তনুর হাতে ত্রিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিলো ৷
(৩৭)
রুমে প্রবেশ করতে মেঘের নাকে ফুলের তীব্র এক সুমিষ্ট ঘ্রান এসে পৌছায়৷ মেঘ রুমে ঢুকে বিছানার দিকে তাকাতে দেখে গোলাপের পাপড়ির দিয়ে সজ্জ্বিত বিছানার মাঝে তার একমাত্র ভালোবাসা প্রেয়সী ঘোমটা দিয়ে বসে আছে৷ রুমের ভেতর লাল নীল রঙের ছোট ছোট মরিচ বাতি , আর টাটকা ফুল দিয়ে অসম্ভব সুন্দর করে ডেকোরেট করা ৷ মেঘ হঠাৎ বিছানার দিকে তাকিয়ে ফারহাকে দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে যায়৷ এখুনি ফারহা এখানে ছিলো মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল কি ভাবে? মেঘ একটু ভেবে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার ফারুপাখি খোলা চুলে নববধুর সাজে দাড়িয়ে আছে ৷
আকাশে আর রূপালি থালার মতো চাঁদটা জ্বল জ্বল করছে৷ তার সাথে তারা গুলো টিম টিম করে জ্বলছে৷ মেঘ তার ফারুপাখিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে৷ চাঁদের আলোয় তার ফারুপাখিকে যে সিগ্ধতায় ডুবিয়ে দিচ্ছে ৷ ব্যালকনিতে থাকা গোলাপ গাছ থেকে দুটো গোলাপ ছিড়ে মেঘ ফারহার বাতাসে হওয়া এলোমেলো চুলে গুজে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে৷ মেঘের স্পর্শে শিউরে ওঠে ফারহা৷ ফারহা চোখ বন্ধ রইল৷ ফারহা শ্বাস ঘন হয়ে আসচ্ছে মেঘের ছোঁয়া পেয়ে৷ মেঘ ফারহার চুলে মুখ গুজে ফারহার উম্মুক্ত পেটে হাত রেখে বলে,” ভালোবাসি ফারুপাখি৷ ”
মেঘের মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনে ফারহার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো, মেঘ ফারহার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,” শুধুমাত্র তোমার হাসিটা দেখার জন্যে কয়েক হাজার
বছর এক নিমিষেই বেঁচে থাকা যায় ফারুপাখি৷ আমি তোমার ওই একচিলতে হাসির কারণ হতে চাই৷ তোমার ক্লান্ত দুপুরের এক প্রশান্তির হাওয়া হতে চাই৷ সন্ধ্যে বেলার তোমার এক কাঁপ চায়ের সঙ্গি হতে চাই৷ তোমার সুখের কারণ হতে চাই আমি৷ এক সাথে বৃদ্ধ হতে চাই তোমার সাথে৷ তোমার সকল সুখের কারণ হতে চাই আমি৷ হবে কি আমার ফারুপাখি? সব দ্বিধা দন্দ ত্যাগ করে আমার হবে কি তুমি? আমাদের ধূসর প্রেমের অনুভূতি আরো একবার হবে কি ফারুপাখি? কথা দিচ্ছি তোমার ওই আখিদ্বয় হতে অশ্রু ঝরতে দিবো না৷ আমার ভালোবাসার দিয়ে সারা জীবন তোমায় আগলে রাখবো৷ রক্ষা করবো সব বিপদ থেকে, কখনো কষ্ট পেতে দিবো না তোমায়৷ সারা জীবন ভালোবাসবো৷”
মেঘের বলা কথাগুলো গভীরতা মাপার ক্ষমতা ফারহার নেই৷ ফারহা স্তব্ধ হয়ে তার প্রেমিক পুরুষ তার অর্ধাঙ্গের কথা গুলো শুনছে৷ মেঘের বলা প্রত্যেকটা কথা ফারহার হৃদয়ে দাগ কেটে গেল৷ ফারহার সাধ্য নেই এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার৷ ফারহা চোখ জোড়া আনন্দ অশ্রুধারা পরিপূর্ণ৷ মেঘ পানি দেখে ভাবে হয়তো ফারহা তার কথায় কষ্ট পেয়েছে৷ এটা ভাবতেই মুহূর্তেই মেঘের চোখ মুখে আধার নেমে আসে৷ মেঘ চলে যেতে নিলে ফারহা মেঘের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে৷
মেঘের ভাবনা ভুল হওয়ায় মেঘের চোখ মুখ মুহূর্তে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো৷
ফারহা মেঘের বুকে মাথা রেখেই বলতে লাগলো,” ভালোবাসি মেঘরাজ৷ বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমায়৷ যতোটা না ভালোবাসলে নিশ্বাসটাই বন্ধ হয়ে যায় ঠিক ততোটাই ভালোবাসি তোমায়৷ সারাজীবন তোমাকে ভালোবেসে যাবো মেঘরাজ৷ তবে একটা কথাই বলবো আমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকালে কিন্তু তোমাকে খুন করে ফেলবো৷ আজ থেকে কোন মেয়ের সাথে তুমি কথা বলা তো দুরে থাক তাকাতে পারবে না ওকে৷”
” যথা আজ্ঞা বেগম সাহেবা৷ কিন্তু আজ যে আমার বেগম সাহেবাকে আদর করার বড্ড ইচ্ছে করছে তার কি হবে? ”
মেঘ একটু থেমে ফারহাকে বলে,” ফারুপাখি আমি তোমার একাউন্টে দেনমোহরের পুরো টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছি৷ এবার আমি নিশ্চয়ই আমার ফারুপাখিকে ভালোবাসতে পারি?
ফারহা মেঘের কথা লজ্জা পেয়ে বুকে মুখ লুকাতে ব্যস্ত৷ মেঘ ফারহার লজ্জা মাখা মুখ দেখে ফারহাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য হাটতে লাগলো৷ আজ রাতটা কারো জীবনে মধুময় রাত্রী হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে মনের মনি কোঠায় মধুময় স্মৃতি হয়ে বন্দি হয়ে থাকবে তো কারোর জীবনে এই রাতটা নরক যন্ত্রনায় বিশাক্ত স্মৃতি হিসেবে মনের স্মৃতির কোণায় লুকিয়ে সারা জীবন যন্ত্রনা দিয়ে যাবে৷
.
.
.
#চলবে……….
(সব থেকে বড় পার্ট আজ দিলাম ২৬৮৫ ওয়ার্ডে লেখা৷ আশা করবো আপনারা আপনাদের মূল্যবান বক্তব্য দিয়ে আজকের পার্টটা আপনাদের কাছে কেমন লাগলো তা জানাবেন৷)