# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১০
এই কয়দিনে ধ্রুবকে ভালো করে খেয়াল করি নি। এবার ছুটিতে আসার পর ধ্রুব খুব শুকিয়ে গেছে। গাল ভেঙ্গে গেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। কন্ঠার হাড় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সবশেষে ওর সুন্দর মুখটায় বিষন্নভাব। খোলা ছাদে ওর চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আমাকে দেখে নেভাতে গিয়েও নেভালো না। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিরবে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বললাম,
—“তোমার সাথে আমার কথা আছে ধ্রুব!”
ধ্রুব আকাশ পানে চেয়ে থেকে শান্ত কন্ঠে বললো,”বলো।”
—“তার আগে তুমি সিগারেট ফেলো।”
কথাটা শুনে ধ্রুব আবারো অগ্নিবর্ষণ করলো আমার ওপর। তবে সিগারেট ফেলে দিলো। পায়ের তলায় পিষে নিভিয়ে ফেললো। দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সিগারেট ফেলে দেওয়ায় আমি মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলাম না। অভিমানী কন্ঠে বললাম,
—“তুমি আমাকে কেন বলো নি তরুর সাথে তোমার বিয়ে হয় নি?”
—“বলে লাভ?”
—“আশ্চর্য? লাভ কি তুমি জানো না?”
আমার প্রশ্নটা যে ধ্রুবকে আরো বেশি রাগিয়ে দিয়েছে সেটা ওর চেহারা দেখেই আমার বোঝা হয়ে গেলো। রাগে অভিমানে চেঁচিয়ে উঠে বলল,”না জানি না। আমি কেন তরুকে বিয়ে করি নি সেটা যখন তুমি জানো না তখন তরুর সাথে আমার বিয়ে হয় নি জানলে তোমার কি লাভ তাও আমি জানি না।”
ধ্রুবর রাগ দেখে আমি হেসে ফেললাম। ধ্রুব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। চোখ লাল করে বললো,”হাসছো কেন?”
আমি ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। ধ্রুব চোখ পাকিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওর একটু কাছে এগিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
—“তোমার সাথে তরুর বিয়ে হয় নি জানলে আমার লাভ আছে কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবার তুমি বলো তুমি কেন তরুকে বিয়ে করো নি?”
ধ্রুব ঠান্ডা হলো। পরোক্ষনেই প্রচন্ড অভিমান ভর করলো মুখের ওপর। কিছুক্ষন সময় নিয়ে বলল,”ঐ কারণেই।”
আমি ভ্রু নাচিয়ে বললাম,”কি কারণ?”
ধ্রুব হেসে ফেললো। এক ঝটকায় আমাকে টেনে সিঁড়িঘরের দিকে নিয়ে গেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে দ্বিতীয় বারের মত তপ্ত চুমু খেলো আমার ঠোঁটে। আমি ছাড়া পাবার জন্য ওর বুকে দুই তিনটা ঘুষি দিলাম। আমার ছটফটানিতে ধ্রুব বাধ্য হলো আমাকে ছেড়ে দিতে। আমি ঠোঁট মুছে ভয়ে ভয়ে চারপাশটা চাইলাম। আশেপাশে কেউ নেই, থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। আমি ধ্রবকে সরিয়ে নিচে নেমে আসতে চাইলাম। ও পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। বললো,” আই হেইট ইউ!” আমি ওকে ঠেলে সরিয়ে নিচে নামতে শুরু করলে ধ্রুবও তাল মিলিয়ে নামতে শুরু করলো। পেছন দিক থেকে আমার ওড়না চেপে ধরে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করছিলো।
হঠাৎ দুই তিন সিঁড়ি নামার পর সুমাইয়ার সাথে দেখা হয়ে গেলো। সুমাইয়া হাসিমুখে জানালো সে আমার কাছেই এসেছে। আমি ধ্রুবর দিকে চাইলাম। বেচারার মুখ কালো হয়ে গেছে। আমার ওড়না ছেড়ে দিয়ে ভালো ছেলের মত নিচে নামতে শুরু করলো। আমি মুচকি হেসে সুমাইয়াকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলাম। সুমাইয়ার বান্ধবীর গায়ে হলুদ। সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে যাবে। তাই আমার কাছে মেহেদী পরতে এসেছে।
আমি মেহেদী পরিয়ে দিতে দিতে সুমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম ধ্রুবর বিয়ের দিন সে ছিলো কি না। সুমাইয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। মুখ বিকৃত করে বললো,”আর বলো না। সেদিন যা কান্ড হলো।” যদিও তরুর কাছ থেকে আমি সবই শুনেছি তবুও অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,”কেন কি হয়েছিলো সেদিন?”
সুমাইয়া বিরক্ত মুখে বললো,”তোমাকে নিয়ে হস্পিটালে যাওয়ার পর ফিরে এসে ধ্রুব ভাইয়া হঠাৎ জানালো সে তরুকে বিয়ে করবে না। আন্টি, ধ্রুব ভাইয়ার মামারা, আত্মীয়স্বজন সবাই কত করে বোঝালো, তবুও রাজী হলো না। তরুর তো হাতে পায়ে ধরার বাকি ছিলো। কিন্তু ধ্রুব ভাইয়ার এক কথা, তিনি কিছুতেই তরুকে বিয়ে করবেন না।” সুমাইয়ার মুখ থেকে নতুন কিছু জানা যায় কি না সেই ভেবে বললাম,”কেন? ধ্রুব তো তরুকে ভালোবাসতো। তাহলে বিয়ে করে নি কেন?” সুমাইয়া মুখ বাকিয়ে বললো,” আমরাও তো তাই ভেবেছিলাম। ধ্রুব ভাইয়া তরুকে ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ের দিন সে অন্য কথা বললো। তরুকে সহ্যই করতে পারছিলো না। আল্লাহই জানে কোন রাক্ষসী ধ্রুব ভাইয়ার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে।তরুর মত ভালো মেয়েটাকে এত কষ্ট দিলো।” আমি মেহেদী লাগানো থামিয়ে সুমাইয়ার দিকে চাইলাম। বললাম,” ধ্রুব কি কারো কথা বলেছে, সে কাকে ভালোবাসে? ” সুমাইয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,ধ্রুব ভাইয়া প্রথমে বলতে চায় নি। কিন্তু সবার সন্দেহের চাপে পড়ে অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। সে নাকি অন্য একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু কোনভাবেই ডাইনীটার নাম বলতে রাজি হয় নি।”
সুমাইয়া যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন ওর রিয়েকশন কি হতে পারে ভেবে আমি মনে মনে হাসলাম! বললাম,
—“ডাইনী কেন বলছো? সে তো ধ্রুবকে জোর করে নি।”
—“জোর না করলে কি হয়েছে। মাথাটা তো খেয়ে নিয়েছে। তারজন্যই তরুর সাথে ধ্রুব ভাইয়ার বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। বেচারা আন্টির হাতে মার পর্যন্ত খেলো অথচ বিয়ে করতে রাজী হলো না।”
সুমাইয়ার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আন্টি ধ্রুবকে মেরেছে? অবাক হয়ে কথাটা আবার জিজ্ঞেস করলাম ওকে। সুমাইয়া মুখ ভার করে বললো,
—“মারে নি আবার! সবার সামনে ঠাস ঠাস করে গালে চড় মেরেছেন। তবুও কি গোঁ! একবারও বললো না বিয়ে করবো! এতবড় ছেলে মার খেয়ে নিরবে সহ্য করে গেছে। টুঁশব্দটি পর্যন্ত করে নি। অবশ্য আন্টির দোষ দিয়েও বা কি লাভ! ধ্রুব ভাইয়া তো মার খাওয়ার মতই কাজ করেছে। যতই নিজের ছেলে হোক তরুকেও তো তিনি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।”
আমি মনে মনে দুঃখ বোধ করলাম। আবারো ধ্রুবকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা মনে পড়লো। সেদিন যদি আমি ধ্রুবকে ফিরিয়ে না দিতাম তাহলে ওকে কখনোই এমন পরস্থিতিতে পড়তে হতো না। আমার জন্যই সবার কাছে ছোট হয়ে গেলো। সবাই ওকে ভুল বুঝলো। আমি বিষন্ন কন্ঠে বললাম,
—“এমনও তো হতে পারে তোমার ধ্রব ভাইয়া তরুকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি? হতে পারে না?”
—“পারে। আমরা তো আর কারো মনের ভেতর ঢুকে বসে নেই!”
মেহেদী পরানো শেষে সুমাইয়া চলে গেলো। আমি বালিশে মুখ ঢেকে কিছুক্ষন শুয়ে রইলাম।
পরেরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় দোতলার সিঁড়িতে ধ্রুবর সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমাকে দেখেই হাসি দিলো। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। খুব কিউট লাগে তখন। জবাবে আমিও হাসলাম। ধ্রুব খুব সিরিয়াস সিরিয়াস মুখ করে বললো,”আমরা নেক্স মান্থে বাসা ছেড়ে দিচ্ছি নিশাত!” আমি অবাক হয়ে গেলাম। ধ্রুব হঠাৎ বাসা ছাড়ার কথা বলছে কেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” হঠাৎ বাসা ছাড়া কথা মনে হলো কেন?”
ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো,”মা বলেছে বউয়ের বাপের বাড়ি কাছে থাকলে বউ দুষ্ট হয়ে যায়। কথায় কথায় বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি দেয়। অতএব এই বাসাটা আমাদের ছাড়তে হবে।”
কথাটা শেষ করে ধ্রুব একদৃষ্টিতে আমার দিয়ে চেয়ে রইলো। ওর চোখে সম্মোহন। ঠোঁটে হাসি! আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,” সত্যিই চলে যাবে নাকি মজা করছো?”
—“একদম সত্যিই চলে যাবো। অবশ্য তোমার বাবা যদি বাড়িটা আমার নামে লিখে দেয় তাহলে থাকার কথা ভেবে দেখতে পারি।”
আমি ভেংচি কেটে বললাম,”কথাটা বাবাকে বলতে পারবে?
—“পারবো না কেন? একশোবার পারবো। মেয়ের জামাই হিসেবে বাড়িটা তো আমি পেতেই পারি!”
—“খুব সাহস না? বাবা জানতে পারলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে।”
ধ্রুব খুব ভাব নিয়ে বললো,”শোনো সুন্দরী, যতই বাপের ভয় দেখাও না কেন তুমি যে আমার গলায় ঝুলে পড়ার জন্য একপায়ে খাড়া সেটা আমি ভালো করেই জানি।”
ওর ভাব দেখে সহ্য হলো না। আমিও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,”সেই আসাতেই থাকো।”
ধ্রুব ফট করে দুই তিন সিঁড়ি লাফিয়ে উঠে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছে। এতটা কাছে যে আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছিলাম। ফিসফিস করে বললো, “কেন করবে না আমাকে বিয়ে?”
ওর তপ্ত নিশ্বাস গালে পড়তেই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। হি ইজ ট্রায়িং টু হিপনোটাইজ মি! কিন্তু আমি ওর ফাঁদে পা দিচ্ছি না। কারণ আমি জানি আমার মুখ থেকে স্বীকার করিয়ে একটু বাদে আমাকেই খোঁটা দেবে অসভ্যটা। আমি নিশ্বাস চেপে রেখে বললাম,”না, করবো না। তুমি সরো আমার সামনে থেকে।” অতঃপর জোরপূর্বক ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। ওর দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
—“এখন খুব ভাব দেখানো হচ্ছে তাই না! আমার কিন্তু সব মনে আছে!
আমি নিজের ভাব বজায় রাখার জন্য জোর গলায় বলল,”বাজে কথা বলবে না। কি মনে আছে তোমার?”
—“ও, এখন সব বাজে কথা তাই না? মা মার্কেটে গেছে শুনে সেদিন একলা বাসায় কে কেঁদেছিলো আমার কাছে? খুব তো কেঁদেছিলে সেদিন।”
আমি থতমত খেয়ে বললাম,” কেঁদেছি। বেশ করেছি। তুমিও তো আমাকে জোর করে রুমে ঢুকিয়ে চুমু খেয়েছিলে?”
—“চুমু খাওয়ার জিনিস, খেয়েছি। তোমার মত তো আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিনি।”
—“আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছি?
—“অফকোর্স তুমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছো। আমার স্পষ্ট মনে আছে।”
তারপর ধ্রুব আমার কান্নার দৃশ্য অনুকরণ করে বললো,”আমার ভুল হয়ে গেছে ধ্রুব, ভ্যাঁ..আই অ্যাম সরি ধ্রুব! ভ্যাঁ…আমি তোমাকে ভালোবাসি ধ্রুব, ভ্যাঁ…আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না ধ্রুব, ভ্যাঁ..এগুলো কে বলেছিলো?”
আমি জানি ধ্রুব সুযোগ পেলেই আমাকে খোঁটা দেবে। তাই সবসময় ওর সামনে নিজের ফিলিংস লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু অসভ্যটা পইপই করে সব মনে রেখেছে, এমনকি আমার কান্নার ভঙ্গিটাও! প্রতিবার কান্নার ফাঁকে সে আমাকে নকল করে নাক টানলো। এবং অবিকল আমার মত করে টিস্যু দিয়ে নাক মুছলো। কান্না শেষে আমার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিলো।
আমি চোখ লাল করে চেয়ে রইলাম। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, “আমি তোমাকে এই জীবনে বিয়ে করবো না। মরে গেলেও না!”
ধ্রুব আঙ্গুল দিয়ে চিরুনির মত চুল আঁচড়ে ফিচেল হাসি দিয়ে বললো,”দেখা যাবে।” তারপর আমাকে রেখেই তরতর করে নিচে নেমে গেলো। আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে ওর যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
.
.
.
চলবে