# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
বাসায় দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজালাম। ধ্রুব এসে দরজা খুলে দিলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম,”আন্টি কই?”
—“ভেতরে আসো?”
আমি জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ধ্রুব দরজা আটকে দিলো। ওর পরনে একটা শর্টস আর টি-শার্ট, পায়ে বাসার স্যান্ডেল। আমি স্কার্ট বদলে গোলাপি রংয়ের একটা ফুলহাতা থ্রিপিস পরে এসেছি। ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে কিউট করে হাসলো। আমার কেন জানি না লজ্জা লাগছিলো ওকে এভাবে দেখতে। আমি আন্টির ঘরে চলে গেলাম। ধ্রুব পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো। আন্টির ঘরে কেউ নেই। কিচেনেও কাউকে খুঁজে পেলাম না। ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলাম,”আন্টি কোথায়?”
ধ্রুব বললো,”মা বাসায় নেই। তরুকে চেকাপে নিয়ে গেছে।”
—“কিন্তু মা যে বললো আন্টি আমাকে ডেকেছেন?”
—“ফোন করে বলেছে।”
—“তুমি আমাকে বলো নি কেন আন্টি বাসায় নেই?”
—“কেন বললে কি হতো? তুমি তো আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ। আন্টি, আন্টি করছো কেন?
—“আমি দুজনের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। বরঞ্চ তুমি বাসায় একা আছো জানলে আমি আসতাম না।”
—“কেন আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলবো?”
—“তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি হচ্ছো একটা ডাকু! সত্যি করে বলোতো আন্টি কোথায়?”
—“বললাম তো মা বাসায় নেই।”
—“তুমি তাহলে সত্যিই আন্টিকে ফোন করে আমায় বাসায় ডেকে নিয়ে আসার কথা বলেছো?”
—“হুম!”
—“কেন? তোমার কি একটুও লজ্জা করলো না আন্টিকে কথাটা বলতে! তুমি একা বাসায়। আন্টি কি ভাববেন?”
আমি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললাম। ধ্রুব আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,”রিলেক্স। তুমি এত রেগে যাচ্ছো কেন? আগে আমার পুরো কথাটা তো শুনবে?..আগামীকাল তরুর জন্মদিন। তাই মাকে বলেছি তুমি আর আমি মিলে ওর জন্য সারপ্রাইজ পার্টির প্ল্যান করবো! মা আন্টিকে ফোন করে সেই কথাই বলেছেন।”
—“কাল তরুর জন্মদিন?”
—“হ্যাঁ!”
তরুর প্রতি মনে মনে একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে আমার। তাই ওর জন্মদিন নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারলাম না। গম্ভীরমুখে বললাম,”আমাকে কি করতে হবে?”
ধ্রুব আমার মুখের দিকে চেয়ে নিরবে হাসলো। আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে বলল,”জেলাস?” আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম,”সেটা জেনে তুমি কি করবে? আমাকে কি করতে হবে তাই বলো।”
ধ্রুব আমার গালটা টেনে দিয়ে বললো, “একটুখানি হাসতে হবে। নইলে এতকিছু কারজন্য করলাম?”
—“শুধু শুধু হাসবো কেন?”
—“শুধু শুধু যখন মুখ ভার করেছো তখন নাহয় শুধু শুধু একটু হাসো?”
—“পারবো না।”
—“তুমি এত নিষ্ঠুর কেন নিশাত? তোমার জন্য আমি লাভ ম্যারেজ কে এরেঞ্জ ম্যারেজ বলে চালাচ্ছি। মায়ের হাতে মার খেয়েছি। এমনকি বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করেছি, তুমি আমার জন্য একটু হাসতে পারবে না?”
—“না পারবো না। তুমি তো এসব আমার জন্য করো নি। আসল কথাটা হলো তরুর সাথে তোমার বনছিলো না,তাই। আমি কিছু জানি না মনে করেছো?”
আমি ইচ্ছে করে ধ্রুব রাগানোর জন্য কথাটা বললাম। তরুর জন্মদিন নিয়ে আদিক্ষেতা আমার সহ্য হচ্ছিলো না। কিন্তু ধ্রুব রাগলো না। মুচকি হেসে বললো,”বনছিলো না তো। কিন্তু কার জন্য বনলো না? তোমার জন্যই তো।”
—” ও এখন আমার দোষ? আমি কি তোমাকে তরুকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছি?”
—“না করো নি।”
—“তাহলে নিজের দোষ কাটাতে সবাইকে আমার নাম বলে বেড়াচ্ছো কেন? তোমার জন্য সবাই আমাকে রাক্ষসী, ডাইনী ভাবছে। সুমাইয়া তো বলেই ফেলল,” আমি নাকি তোমার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছি।”
—“খাও নি বুঝি?”
—“মোটেও না।”
—“তাহলে আমি তরুকে বিয়ে করলাম না কেন?”
—“আমি কি জানি! খুব আফসোস হচ্ছে মনে হয়?”
—“হচ্ছে। খুব হচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছে
করছে!”
—“তাহলে আমাকে ডেকেছো কেন? আমি বাসায় যাচ্ছি।”
আমি ধ্রুবর ঘর থেকে রাগ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ডেকে এনে আমাকে এভাবে অপমান করলো? অসভ্য ছেলে একটা! আর ডাকিস আমাকে!
ধ্রুবর ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে গ্লাসে পানি নিলাম খাওয়ার জন্য। বকবক করে গলা শুকিয়ে গেছে।
ধ্রুব আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে গ্লাসটা নিয়ে পানিটা খেয়ে নিলো। আমি পাজলড হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শেষ চুমুকটুকু গিললো না ও। আমার কোমর সমেত টেনে ধরে ঠোঁটে ঠোঁটে মিলিয়ে দিলো। ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমি মুখ বন্ধ করার জন্য ছটফট শুরু করলাম। কিন্তু ওর সাথে পেরে উঠলাম না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইলো অসভ্যটা। বাধ্য হয়ে আমি মুখের পানিটা গিলে ফেললাম। সাথে সাথেই ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলো। সেই সাথে গা জ্বালানো হাসি! লজ্জায় অস্বস্তিতে আমার আরক্তিম অবস্থা! মাথা তুলে তাকাতে পারছিলাম না। অতঃপর ধ্রুব নিজেই সদর দরজা খুলে ইশায়ায় আমাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। আমি নড়লাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব দরজাটা সামান্য ভেজিয়ে পুনরায় আমাকে কোমর চেপে ধরে দুষ্টু হেসে বলল,”ভালোয় ভালোয় বলছি, চলে যাও। আমি কিন্তু খুব অসভ্য!”
আমি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। সারা শরীর শিরশির করছে। উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে। দাঁড়ালাম না। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। ফলাফলস্বরূপ সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। অসাবধানতায় পা মচকে গেলো। অস্পষ্ট গোঙানি বেরোলো মুখ দিয়ে। আওয়াজ শুনে ধ্রুব বাইরে বেরিয়ে এলো। আমি পা চেপে ধরে সিঁড়িতে বসে ছিলাম। ও দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে আমার এসে সামনে দাঁড়ালো , মুখে বিটকেল হাসি। আমি পারলে চোখ দিয়েই ওকে ভস্ম করে দেই। ও একটু ঝুঁকে আমার পায়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলল,”দেখো খোঁড়া টোড়া হয়ে গেলে কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।”
—“তোমার মত অসভ্য, আনসিভিলাইজড পার্সন আমি জীবনে দুটো দেখি নি ধ্রুব। তোমাকে লোকে সহ্য করে কি করে আমি বুঝি না। অসহ্য একটা!”
—“আমার হেল্প লাগবে সেটা ভালোভাবে বললেই তো হয়। মেজাজ গরম করছো কেন?”
—“তো এখন আমার কি করতে হবে? আমাকে উপরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তোমার পায়ে ধরতে হবে?”
—“নো, জানেমন! পায়ে ধরবে কেন? খালি একটু আদর করে বলতে হবে!”
—“শখ কতো! দরকার হলে আমি এখানে বসে থেকে রাত কাটিয়ে দেবো তবুও তোমাকে সাহায্য করতে বলবো না।”
—“ওকে। তাহলে আর কি করা! বসে থাকো এখানে। আমি গেলাম।”
ধ্রুব সত্যি সত্যি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। পা ভালো মতই মচকেছে। ব্যথায় নড়তেও পারলাম না। সিঁড়িতে বসে রইলাম। কিন্তু আমার মন বলছে ধ্রুব বেরোবে। এবং ধ্রুব বেরোলো! পরনের শর্টস বদলে ট্রাউজার পরে এলো। টি-শার্টের ওপর ফুলহাতা একটা শার্ট পরলো। বাসার স্যান্ডেল রেখে জুতো পরে নিলো।
আমার দিকে ঝুঁকে হাসলো। তারপর আমাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। একটা কথাও বললো না। আমি ওর গলা জড়িয়ে ধরে আরামসে বসে রইলাম। ম্যারিন অফিসারের ফিট বডি। ঝগড়াটে ভাবটা কেটে গিয়ে রোমান্টিক রোমান্টিক একটা ফিলিংস আসছিল। ব্যথার কথা ভুলে গেলাম!
চারতলা বেয়ে উঠার পর ধ্রুব দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন দম নিলো। আমাদের সিঁড়িগুলো প্রচন্ড খাঁড়া ধরনের। একা উঠতেই জান বেরিয়ে যায় তারওপর ও তো আমাকে নিয়ে উঠছে। বেচারার চেহারা দেখে মায়া হলো। কিন্তু এতক্ষন আমার সাথে যা করেছে তার কথা ভেবে ওকে ক্ষমা করতে পারলাম না। ভার আরো বাড়ানোর জন্য বেশি করে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার দিকে একপলক তাকিয়ে হাসলো কেবল। তারপরই আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। আমি খেয়াল করলাম ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতের চাপে ঘাড়ের রগ ফুলে গেছে। ওর অবস্থা দেখে আমার হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেলো। ও এবারো হাসলো। মধুর কন্ঠে বললো,”নিশাত তুমি নিজেও জানো না তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো!” আমি জবাব দিলাম না। ওর বুকে নাক ঘষলাম। ও মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললো,”কি করছো। সুড়সুড়ি লাগছে তো!” আমার সব রাগ,ব্যথা, দুঃখ, অভিমান মিলিয়ে গেলো ওর হাসিটা দেখে। ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলাম। ওর হৃদপিন্ডের উঠানামা গুনছিলাম আর ভাবছিলাম ধ্রুবকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি! বোধহয় একপৃথিবীর চাইতেও অনেক বেশি।আমার সকল আনন্দ, বেদনা, হাসি,কান্না, ভালোলাগা, ভালোবাসা জুড়ে মোটকথা সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু ওর বসবাস!
.
.
.
চলবে





