# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২
মেয়েটার নাম তরু। হিরো মহাশয়ের মামাতো বোন। তবে অনাথ। ছোট বেলায় মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তরু ধ্রুবর মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ওদের বাসাতেই ছিলো। ইউনিভার্সিটিতে উঠার পর হোস্টেলে শিফট হয়ে যায়। বর্তমানে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বোধহয় বাসায় এসেছে। ধ্রুবর সাথে ওকে দেখে সীমা আর সুমাইয়া ধ্রুবর গার্লফ্রেন্ড ভেবে বসে আছে। তবে তরু ভীষণ সুন্দরী। মেকাপে ওকে যতটা সুন্দর লেগেছিলো নরমালি তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। গলার স্বরটাও দারুণ মিষ্টি। জিনিসপত্র নামাতে ধ্রুবকে হেল্প করছিলো। আমি আড়চোখে ওদের দেখছিলাম। জিনিসপত্র নিয়ে নিচে নামার সময় হিরো মহাশয়ের সাথে চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম। ওরা নিচে নেমে গেলো।
অনেক রাত হয়ে গেছে। আমিও সুমাইয়া আর সীমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। বাসায় ঢুকে দেখলাম অলরেডি তিনটা বেজে গেছে। দৌড়াদৌড়ি চেইঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম। সকালেও তো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। বারবার মনে হচ্ছে ধ্রুবকে একটা সরি বলা আসা উচিৎ ছিলো। আমার জন্যই বেচারার পায়ে ব্যথা পেলো। পরে ভাবলাম আমি তো আর ইচ্ছে করে পাড়া দিই নি। অ্যাক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। যে কারো সাথেই হতে পারতো। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারবো না।
পরেরদিন সকালে মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিলো। আন্টিরা নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রেডি হতে হবে। আমি মাকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে ধীরেসুস্থে রেডি হয়ে নিচে নামলাম। বারোটার দিকে সেন্টারে পৌছে গেলাম সবাই। বিয়ে পড়ানো হলো যোহরের নামাজের পর। এরপর শুরু হল খাওয়া দাওয়া পর্ব। তারপর কনে বিদায়। কনের সাথে যাওয়ার জন্য তরুকে পাঠানো হলো। ওর সাথে আরো দুটো মেয়েও গেলো। আমি চিনি না। আত্মীয় হবে বোধহয়।
কনে বিদায় শেষে আমরা বাসার ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। আন্টি খুব কান্নাকাটি করছিলেন। মা আন্টির কাছে বসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো আর নিজেও কাঁদছিলো। হয়ত নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ বিয়ের দিন কল্পনা করেই কাঁদছিলো। আমি কাছেই বসে ছিলাম। এত কিছুর মাঝখানে ধ্রুবকে একবারও দেখলাম না। হয়ত ব্যস্ত। আমার বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। আন্টিদের বাসায় এখনো প্রচুর মেহমান। আমি মাকে বলে আমাদের বাসায় চলে এলাম। তারপর আর নিচে নামি নি। বৌভাতের দিন আমার শরীর খারাপ ছিলো তাই যাওয়া হয় নি।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সব আবার আগের মত শান্ত হয়ে গেলো। এক এক করে মেহমানরাও সবাই চলে গেলো। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম এই বিয়ে উপলক্ষ্যে মায়ের সাথে আন্টির খুব ভালো মেলামেশা তৈরী হয়ে গিয়েছে। মা এখন আর ধ্রুবকে নিয়ে কোন সতর্কবাণী করে না। আমি মনে মনে খুশি হলাম। যাক এবার নিশ্চিন্তে ছাদে ওঠা যাবে।
একদিন সন্ধ্যা বেলায় মা আন্টির সাথে গল্প করতে ধ্রুবদের বাসায় গেলো। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও ফিরছিলেন না দেখে আমি ডাকতে গেলাম। কলিংবেল চাপতেই ধ্রুবদের কাজের লোক এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। আমি আন্টির ঘরে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে জানালো মা এবং আন্টির দুজনে মিলে মার্কেটে গেছে। ফিরতে দেরী হবে। আন্টির বিছানায় দেখলাম তেরো চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে। একে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। যাইহোক ওকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমার কোন লাভ নেই। তাই বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিউজিকের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি মাকে খোঁজার বাহানায় চুপিচুপি তাঁর ঘরে উঁকি দিলাম। দরজা খোলাই ছিলো। ধ্রুব চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কি যেন টাইপ করছে। চুপিচুপি আবার বেরিয়ে আসার সময় গানের লিরিকসগুলো আমার কানে আসলো। থমকে গেলাম।
‘সখি, ভাবনা কাহারে বলে?
সখি, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বল,
দিবস-রজনী, ভালবাসা, ভালবাসা।
সখি, ভালবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?
খেয়াল করে দেখলাম ধ্রুবকে আজকে অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব। আমার ঘোর লেগে যাচ্ছিলো। হার্টবিট বন্ধ হয়ে আসছিলো। বুকটা ধকধক করে উঠলো। আমি মনে মনে অনুভব করতে পারছিলাম আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। মনে মনে দোয়া করছিলাম,”হে খোদা এমনটা যেন না হয়। তুমি রক্ষা করো মাবুদ।”
হঠাৎ ইংলিশ গানের সফট মিউজিক বেজে উঠতেই চমকে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম ধ্রুব তখনো মন দিয়ে টাইপ করছে। বুকে থুথু দিলাম। আগের গানটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়ালই করি নি। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক। ধ্রুব দেখার আগেই আমি দ্রুত সরে পড়লাম।
সেদিনের পর থেকে আর ধ্রুবকে দেখি নি। আমিও আর ওদের বাসায় যাই নি। ছাদে যাওয়ার সুযোগ থাকলে যেতাম না। আন্টি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন। আন্টির কাছে থেকেই জানতে পারলাম, ধ্রুবর ছুটি শেষ। সে চলে গেছে। আমি মনে মনে খুশি হলাম। ধ্রুব না থাকলেই ভালো। বস্তুত এভাবে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়াটা আমি নিজেও সহ্য করতে পারছিলাম না। অসহ্য লাগছিলো।
ধ্রুব চলে যাওয়ার পর আমার ছাদে উঠতে কোন অসুবিধে রইলো না। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছিলাম। তারপর ভালোই চলছিলো দিনকাল। রোজ নিয়ম করে ভার্সিটিতে যাই। ঘোরাফেরা করি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। হঠাৎ একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পর দেখলাম বাসায় ছোটমামা এসেছে। ভেবেছিলাম আমাদেরকে দেখতে এসেছে। কিন্তু বিকেলবেলা ড্রয়িংরুমে বসে তিনি এবং বাবা, মায়ের গোপন আলোচনার কিছুটা কানে আসতেই আমার বুঝতে বাকি রইলো না ছোটমামা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
রাতেই অবশ্য মা নিজেই আমাকে সব জানালো। ভালো একটা প্রপোজাল এসেছে। ছেলে কলেজের প্রফেসর। তারা আমাকে দেখতে আসতে চায়। পছন্দ হলে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হবে। সেই সাথে মা কাল ইউনিভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করে দিলো। আমি বিরক্ত হলেও চুপ করে রইলাম।
পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকেই উঠে দেখলাম মা ইতোমধ্যে রান্নাবান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। ছেলেপক্ষ দুপুরে আমাকে দেখতে এলো। সাজুগুজু করে তাদের সামনে গেলাম। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। প্রচন্ড মাথাব্যথা করছিলো। ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চিন্তা করলাম। ঘুম আসলো না বরং মাথার ভেতর হাবিজাবি চিন্তা ঘুরছিলো। তবুও চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলাম।
রাতে মা জিজ্ঞেস করলো, ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে কি না? আমি গোমড়ামুখে বসে রইলাম। ছেলে অবশ্য দেখতে শুনতে খারাপ না। কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই। মাকে সে কথা জানাতে তিনি বললেন, বিয়ে এখন হচ্ছে না। তোর পরীক্ষা শেষে আকদ করা হবে। তারপর সময় সুযোগ মত বিয়ে।”
প্রতিউত্তরের কোন সুযোগ না পেয়ে আমি বিরক্তমুখে বসে রইলাম। মা কিন্তু থেমে থাকলেন না। নিরলসভাবে ঐ ছেলের গুণকীর্তন চালিয়ে গেলেন। পরদিন তার সাথে আন্টিও যোগ দিলেন। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন ভালোছেলে হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। বাবা রাতে তার ঘরে ডেকে মতামত জিজ্ঞেস করলেন। সেই সাথে ছেলে, ছেলের পরিবারের খুব প্রশংসা করলেন। ছেলের পরিবারে ছোট ছেলে। তিনভাই এবং দুই বোনেদের মধ্যে সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ঝামেলা নেই, এইসব হাবিজাবি কথাবার্তা!
আমার মাথায় তখন অন্যচিন্তা ঘুরছিলো। আমি বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিলাম। দুটো কারণে আমি বিয়েতে সম্মতি দিলাম। প্রথম কারণটা হলো এতে বাবা মা খুশি হবে। আর দ্বিতীয় কারণটা হলো ধ্রুব! ইয়েস ধ্রুব! মাই এক্স! যার সাথে প্রায় দুবছর আগে আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো। একবছর আগে সেই সম্পর্কের ইতিও ঘটেছিলো।
কিন্তু আমি জানি ধ্রুব আমার জন্যই এখানে ভাড়াটিয়া হিসেবে এখানে উঠেছে। আমাকে ইম্প্রেস করার জন্যই এতসব কিছু করছে।
ও ভেবেছে এসব করলে আমি ওর কাছে ফিরে যাবো। বাট সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। হি ওয়াজ অনলি মাই এক্স অ্যান্ড অলওয়েজ বি মাই এক্স। আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার এবাউট হিম!
.
.
.
চলবে