#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৭
১২.
সকালে ঘুম থেকে উঠে সুব্রত নিজের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা তপসীকে আবিষ্কার করলো। একদম বিড়াল ছানার মতো নিজেকে গুটিয়ে সুব্রতের শরীরের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে।
সুব্রত তপসীর কপালে চুমু দিলো। মেয়েটা কে দেখলেই তার মায়া লাগে। কতোটা কষ্ট সে এই ছোট বয়সে সহ্য করেছে সুব্রত জানে। তাই হয়তো তপসীকে মা পছন্দ করার পর আর না করতে পারে নি।
প্রেম ভালোবাসা বলতে সুব্রতের জীবনে হয়তো তপসীই প্রথম। অনেকেই একপক্ষিক ভালোবাসা নিবেদন করেছে তাকে।
কাউকে মনে ধরে নি। হয়তো তার এই বাচ্চা বাচ্চা বউটার জন্যই। যাকে সে উজার করে নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিবে।
সুব্রত তপসীর কপালে আরেকবার চুমু খেল। এরপর ঠোঁট নামিয়ে আনলো তপসীর অধরে। অধর যুগল একত্রিত করতেই তপসী জেগে উঠলো। সুব্রত সড়লো না।
শব্দ করে চুমু দিলো তপসীর ঠোঁটে।
সুব্রতের এমন ব্যবহারে তপসী লজ্জায় জমে যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে যাওয়ার জন্য উদ্দ্যত হলে সুব্রত হাত ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
—— ডোন্ট মুভ!
তপসী শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে রইলো। সুব্রত এক হাতের উপর মাথা ভর দিয়ে মাথা উচু করিয়ে তাকালো তপসীর দিকে। এক নজরে তপসীকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো।
তপসী লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সুব্রত নিজের হাত দিয়ে তপসীর মুখ আবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল৷ তপসী চোখ বন্ধ করে ফেললো। সুব্রতের চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
কেমন এক মোহ গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে ক্ষণে ক্ষণে।
সুব্রত এগিয়ে আসলো তপসীর দিকে। তপসীর কানে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তপসী কেঁপে উঠলো। সুব্রত মৃদ্যু হেসে কানের সামনে ফিসফিস করে বললো,
—— যদি ভুলে যাই কাল রাতের কথা? যদি বাড়াতে চাই মনের ব্যাকুলতা?
তপসী আমতা আমতা করে বললো,
—— সকাল অনেক হয়ে গেছে তো। প্লিজ উঠুন না।
—— এ্যাই বাচ্চা, মারবো কিন্তু।
তপসী চমকে উঠলো। তার স্বামী তাকে বিয়ের তৃতীয় দিনই মারতে চাচ্ছে। তপসী চুপসে গেল।
সুব্রত কিছু আন্দাজ করতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,
—— কি হলো?
—— কিছু না।
—— আমি কাছে আসলে কি তোমার আনইজি ফিল হয়?
তপসী হড়বড়িয়ে বললো,
—— না না। আপনার এমন কেন মনে হলো?
—— এইযে চলে যেতে চাইছো। চুপ করে রইছো।
—— আম,,, মার লজ্জা লাগছিলো তো।
—— ও বাব্বাহ, বাচ্চারা কেন লজ্জা পাবে? তারা শুধু ভয় পাবে বুঝলে!
—— ভয়ই তো দেখাচ্ছেন মারের কথা বলে। আর আমি মোটেও বাচ্চা না৷ আমি ভোটার হয়েছি বুঝলেন। এইটিন প্লাস আমি।
—— ইসস, এসেছে আমার দীদা।
তপসী অভিমান করে বললো,
—— আমি এতোও বড় না।
—— আমিও তো বলি তুমি বাচ্চা। তুমি নিজেই না নিজেকে বড় বললে।
—— আপনি খুব কথার খেলা খেলেন।
—— আমি আবার কি খেললাম?
—— জানি না ছাড়ুন তো।
—— একদম কোলে উঠিয়ে ফেলে দিবো।
—— আরেহ, আপনি শুধু আমায় মারতেই চাচ্ছেন কেন!
—— আদর তুমি করতে কোথায় দিচ্ছো?
তপসী লজ্জায় লাল বর্ণ ধারন করলো। সুব্রতের বুকে মুখ লুকালো।
সুব্রত মৃদ্যু হেসে বললো,
—— এই যাহ, আমার থেকে লজ্জা পেয়ে আমার কাছেই আসা হচ্ছে।
—— যেতেও তো দিচ্ছেন না।
—— এই মেয়ে তো সত্যিই বাচ্চা। ওহ মাই গড, নো নো।
তপসী চমকে উঠলো। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— কি হয়েছে? এমন করছেন কেন?
—— তপসী আমাদের বেবি হলে আমি দুইটা বাচ্চা একসাথে কিভাবে সামলাবো? আমি তো বেশিদিন বাড়িতেও থাকতে পারি না। কি হবে তখন তপসী!
তপসীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সুব্রত এখনই বাচ্চার কথাও ভেবে ফেলেছে! তবে দুইটা একসাথে কেন?
তপসী লজ্জা রাঙা হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
—— আপনার কি টুইন বেবি পছন্দ?
সুব্রত হেসে বললো,
—— টুইন বেবি পছন্দ। কিন্তু আমি দুইটা বাচ্চা বলতে একটা তোমাকে বুঝিয়েছি৷
তপসী কপোট রাগ দেখিয়ে বললো,
—— এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেন? এতোই যখন অসুবিধা?
সুব্রত উত্তর না দিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। সুব্রতের আচমকা উঠে যাওয়াতে তপসী অবাক হলো। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বিছানা থেকে নেমে গেল।
সুব্রত দ্রুত তপসীর সামনে এসে দাঁড়ালো। কোলে তুলে তপসীকে। তপসী আরেক দফা অবাক হলো।
সুব্রত হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—— যেন যখন তখন বউ কোলে তুলে তাকে অবাক করে দিতে পারি। সাথে আমার ব্যায়াম করাও হয়ে যাবে। উফ, ডাবল বেনিফিট।
তপসী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিনমিন করে বললো,
—— আপনি আর্মড পারসন হওয়া স্বত্বেও একটা অসভ্য হয়েছেন।
সুব্রত হিম ধরা শীতল কণ্ঠে বললো,
—— তোমার জন্য আরো অনেক অসভ্যতামি তোলা আছে বউ। বউ গো, গলা জড়িয়ে ধরো না। দুইটা ডান্স স্টেপ দেই।
তপসী অবাকের চরম পর্যায়ে আছে। সে আর অবাক হতে পারবে না। একসাথে এতো ধাক্কা সে সামলাতে পারবে না।।
সবসময় গম্ভীর মুখ করে বসে থাকা, মাঝেসাঝে লাজুক ভাবে মুচকি হাসি দেওয়া মানুষটার এমন রূপ তার হজম হচ্ছে না।
,
দরজায় করা নরছে। একটা বাচ্চা মতোন কণ্ঠস্বরী মেয়ে ডাকছে,
—— দাদা বাবু, দরজা খোলেন তো। মাসি চ্যাঁচায়।
সুব্রতের কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো। তুলিকে আজ একটা জোড়সে চড় মারবে সে। তপসীকে নিচে নামিয়ে দিল। সুব্রত দরজার ফিকে পা বাড়ালেই তপসী পিছন থেকে বাদ সাধে।
—— দাঁড়ান, আমি খুলি।
দরজা খুলতেই তপসীর নজরে পড়লো একটা তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটি হাত নেড়ে নেড়ে বললো,
—— বৌদিদি, মাসি মা অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।
সুব্রত ধমকে উঠলো,
—— চুপ পাজি, অনেকক্ষণ ধরে ডাকলে তুই মাত্র এখানে কেন এসেছিস?
—— আরেহ দাদা বাবু,,,,
—— মিথ্যা বলবি না। পুচকে মেয়ে খালি বানিয়ে কথাবলা শিখেছে।
তপসী সুব্রত কে থামালো।
—— ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে, আপনি ওকে এভাবে বকছেন কেন?
—— এই মেয়ে হারে হারে বজ্জাত। সবাই আদর দিয়ে মাথা তুলেছে, তুমি আর নতুন আস্কারা দিয়ো না।
তুলি ঠোঁট উলটে বললো,
—— দাদা বাবু, সবাই মাথায় তোলে আর আমনে আমারে উপর থেইক্কা আছাড় মাইরা প্যাডা বাইর কইরা দেন।
সুব্রত এবার আরো রেগে গেল।
—— আজই তোর শায়েস্তা করছি। তোকে কতোবার বলেছি শুদ্ধ ভাষায় সুন্দর করে কথা বলতে!
—— ওইযে হুদ্ধ ভাষা আমার গলায় আইটকা যায়। বাইর হইতে চায় না।
সুব্রত তুলির কান মলে দিল। কান ছাড়তেই তুলি এক দৌড়ে চলে গেল।
তপসী হা করে তাকিয়ে আছে। এই লোক মিনিটে মিনিটে রূপ বদলায়। এখনই তো এতো ভাল মনে ছিল, এখন এই মেয়েটার সাথে শুধু শুধু কেন এমন ব্যবহার করলো!
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৮
১৩.
তপসী স্নান করে নিচ তলায় রান্নাঘরে গেল। শ্বাশুড়ি মা রান্না করছে। পাশে সুব্রতের কাকিও আছে। তপসী মা’কে জিজ্ঞেস করলো,
—— আমি কিছু একটা করে দেই?
সুব্রতের মা ধমক দিয়ে বললো,
—— কাজ করার অনেক সময় আছে মেয়ে৷ এখন এতো কাজ দেখাতে হবে না। চুপচাপ দাঁড়াও তো। কথা বলো আমাদের সাথে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হবে।
তপসী মৃদ্যু হাসলো। মা হয়তো এমনই হয়। একটু আদর করবে। একটু শাসন করবে। তপসীর নিজের মায়ের কথা স্পষ্ট মনে নেই সব। কিছু কিছু স্মৃতি মনে আছে।
তার মাও তো তাকে আদর শাসন করতো। নিতা আন্টিকেও সে নিজের মা ভাবতে চেয়েছে। বারংবার চেয়েছে একটু আপন হতে। কিন্তু হয়তো তপসীর নিজের মধ্যেই কোনো ঘাটতি ছিল। নয়তো সারাজীবন কেন একজন মানুষের এতো অপ্রিয় হয়ে থাকবে সে!
তপসী হেসে উত্তর দিলো,
—— আমার সম্পর্কে কিছুই বলার নেই মা।
কাকি বলে উঠলো,
—— কিছুই বলার থাকবে না কেন? তোমাদের বিয়ে তো অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে গেছে। ওতো কিছু জানাই হয় নি। পড়াশোনা করো দূর করার ইচ্ছে আছে, চাকরি টাকরি করার ইচ্ছে আছে কি না, তা বলবে না?
তপসী বিষন্ন হয়ে গেল।
—— উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা টা শুধু দিলেই হবে।
মা বললো,
—— তা তো দিবেই। এরপর?
—— এরপর আর দরকার নেই।
—— কেন দরকার নেই?
—— আরে মা, থাক না।
কাকি জিজ্ঞেস করলো,
—— আরে ছোট বেলায় ইচ্ছে থাকে না? এই যেমন এটা হবো সেটা হবো! এমন কিছু ইচ্ছে তো ছিল নাকি? সেটাই বলো।
তপসী আড়ষ্টতা নিয়ে বললো,
—— মায়ের শখ ছিল ডাক্তার বানানোর। সে জন্যই আমিও সায়েন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। এখন তো আর সম্ভব না।
সুব্রত নিচে নেমে এসেছে। রান্নাঘরের সামনে কফি নেওয়ার জন্য আসতেই তপসীর কথা শুনতে পেল।
সুব্রত জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— এখন কেন সম্ভব নয়?
তপসী সুব্রতের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—— কি?
—— তোমার ডাক্তার হওয়া। এখন কেন সম্ভব নয়?
সুব্রতের মাও তাল মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— সত্যিই তো। এখন কেন সম্ভব নয়?
তপসী আমতা আমতা করে বললো,
—— বাদ দিন না।
সুব্রত ছোট করে বললো,
—— আচ্ছা বাদ দিলাম।
,
ঘরে এসে তপসী ব্যাগ গুছাচ্ছে। বাবার বাড়ির যাবে সে দ্বীরাগমনে। তার কাপড়, সুব্রতের কাপড় সব প্যাক করা শেষ। সুব্রত সোফায় বসে বসে তপসীর দিকে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
তপসী বার বার আড় নয়নে সুব্রত কে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
—— কি দেখেন?
—— দেখি না, চিন্তা করছি।
—— কি?
—— তুমি আমায় ‘তুমি’ করে ডাকলে কেমন শোনাবে।
তপসী ঠোঁট চেপে হাসলো। সুব্রতের সবসময় মজা করার এবার একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে। বললো,
—— ছিঃ কেমন বাঁজে মতোন লাগবে। একটা বাচ্চা মেয়ে অর্ধশত বয়সের এক লোক কে আদিখ্যেতা করে ‘তুমি’ সম্বোধন করছে।
তপসী সুব্রতকে যতনা অবাক করতে চেয়েছিল, তার চেয়ে কয়েকগুন অবাক বেশি হলো সুব্রত। মেয়েটাকে দেখে সে কখনোই ভাবে নি এমন চটপট স্বভাবের।
সুব্রত চোখ টিপে বললো,
—— মেয়েটা শুধু উপর থেকে বাচ্চা। ভেতরে ভেতরে সে একদম বড় হয়ে গেছে। আমি কাল রাতেই টের পেলাম তো! একটা ছেলেকে একা পেয়ে তার গায়ে হাত দেয় তো মেয়েটা।
তপসীর চোখ বড় হয়ে গেল। হড়বড়িয়ে বললো,
—— আপনি এতো অসভ্যের মতো কথা কেন বলেন? হুহ!
—— আগেই তো বলেছি। তোমার তখন বিশ্বাস হয় নি? এতো অবিশ্বাস করো আমায়? এই ছিল তোমার মনে তপসী?
তপসী হা করে তাকিয়ে আছে। রায়া বলেছে তার ভাই প্রচন্ড স্ট্রিক্ট। নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার মানুষ বলেই হয়তো এমন। মজা করা তার ধাতে নেই। কিন্তু তপসী যেন নতুন এক মানুষ দেখছে। বাচ্চাসুলভ আচরণও যে করতে পারে।
তপসী নিশ্চুপ হয়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। বাড়ি যাওয়ার জন্য তার মন কাঁদছে। তুষার হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করে আছে!
সুব্রত কাছে এগিয়ে আসলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
কানের সামনে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—— আমি চলে গেলে তুমি আমায় মিস করবে?
তপসী থমকে গেল। অবশ্যই মিস করবে। তপসী মানুষ টাকে ভালোবাসে৷ প্রচন্ড ভালোবাসে। এতো অল্প সময়ে কিভাবে সম্ভব তা তপসী জানে না, তবে সে সত্যিই মায়ার জালে আঁটকে গেছে।
তপসী মাথা দুলিয়ে না-বোধক উত্তর দিলো। সুব্রত তপসীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। তপসী মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ ভিজে আসছে কেন তার? এতো কিসের কষ্ট হচ্ছে?
সুব্রত তপসীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তপসীর চোখ থেকে এবার অশ্রু বেয়ে পড়লো। বিয়ের পরও সে কেন কষ্ট পাবে?
—— তুমি জানো, সামরিক বাহিনীর লোকজনদের স্ত্রীদের তাদের চেয়েও সাহসী হতে হয়। তুমি এতো কাঁদলে কিভাবে হবে? তুমি তো আমার শক্তি হবে, আমায় সাহস জোগাবে৷
—— আমি কি জানতাম, এতো জলদি ভালোবাসা সম্ভব?
সুব্রত প্রফুল্ল মনে জিজ্ঞেস করলো,
—— কার আবার ভালোবাসা হলো?
—— আপনি অনেক পঁচা।
সুব্রত হেসে ফেললো।
—— বিয়ে নামক সম্পর্কটাই এমন। বিয়ে ভালোবাসতে শেখায়, অপেক্ষা করতে শেখায়, দ্বায়িত্ব নিতে শেখায়। জীবনের পূর্ণতা দেয়।
—— সে পূর্ণ জীবনে আপনি আমায় অপূর্ণ রেখে চলে যাবেন!
—— চলে যাচ্ছি কই? আবার আসবো। এছাড়া তো কথা হবে আমাদের রোজই । ওকে?
তপসী সুব্রতের বুকে মাথা রাখলো। এখন কান্না আসছে না তার। তাকে শক্ত হতে হবে যে! সুব্রতের শক্তি হতে হবে তাকে।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ০৯
১৪.
দ্বীরাগমনের জন্য তৈরি তপসী। সুব্রত রুমে তৈরি হচ্ছে। তপসীদের সাথে যাবে রায়া, তুলি আর শুভ্র। রায়ার স্বামী প্রদীপও যাবে কিন্তু রাতে। তার অফিস আওয়ার শেষ হলে।
সুব্রত তৈরি হয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসলো। গাড়িতে উঠে বসলো সবাই।
তপসীদের বাড়িতে পৌঁছাতেই তুষার ছুটে এলো তপসীর কাছে। তপসী জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
নিতা হাসি মুখে এগিয়ে এসছে সবাই কে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিয়ের যে স্থানে কুঞ্জ ছিল, সেখানে সুব্রত আর তপসীকে বসানো হলো। ধান দূর্বা দিয়ে বরন করা হলো তাদের।
,
তপসীর ঘরে বসে আছে সুব্রত। তপসী শাড়ি পালটে পাশে বসলো। সে বুঝতে পারছে না, নিতা আন্টি তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে! তার শ্বশুর বাড়ির মানুষ কে কোনোভাবে অসম্মানিত করলে সে কি করবে!
তপসী সুব্রত কে ঘরে বসিয়ে রেখে বাবার ঘরে গেল। ঘরে তার বাবা নেই। হয়তো কোথাও কাজে আছে! ঘরে তৈথী অপেক্ষা করছিল, তখন নিতা আন্টি রুমে আসলো।
নিতা আন্টি তপসীর দিকে তাকিয়ে উপেক্ষামূলক হাসি দিলো। বললো,
—— মেয়ে তোর কপাল ভালো আছে বলতে হবে!
তপসী কোনো উত্তর করলো না। না শোনার ভান করে বসে থাকলো। সে চায় না বাড়িতে কোনো শোরগোল হোক।
নিতা আন্টি মুখ ভেঙচি দিলো। বললো,
—— এমন সব সময় ডিম পাড়া মুরগীর মতো বক বক করা তপসী শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দুইদিনেই শান্ত হয়ে গেল! বাহ চমৎকার। যা আমি পারলাম না, তা শ্বাশুড়ি দুইদিনেই করে দিলো।
তপসী বিরক্ত হচ্ছে। উঠে চলে যাওয়ার জন্য উদ্দ্যোত হলো। আন্টির সামনে বসে থাকার কোনো ইচ্ছে তার নেই। বাবা আসলে সে একসাথে বসে কথা বলে নিবে।
তপসী নিতার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নিতা অবজ্ঞার স্বরে বললো,
—— না জানি এবার আর কতো ঝামেলা পোহাতে হয়!
তপসী এ পর্যায়ে মুখ খুললো। বললো,
—— আমি জানি তুমি আমায় উস্কে দেওয়ার জন্যই বলছেন। কি চাও? বাড়িতে অশান্তি হোক? আমার শ্বশুর বাড়ির লোক তোমার আসল রূপ দেখুক? আমার নিজের বাড়িতেই আমার কোনো সম্মান নেই!
—— কারেকশন করো মাই ডিয়ার। এটা তোমার বাড়ি না।
—— আমি তোমার সাথে কথা বাড়াতে চাই না। তোমার যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। যা ভেবে খুশি থাকতে পারবা তাই ভাবো। ইউ নো, পাগলের সুখ মনে মনে!
নিতা রাগী চোখে তাকালো তপসীর দিকে। তপসী মাথা ঘামালো না। নিজের ঘরে চলে গেল। সুব্রত ঘুমিয়েছে একটু। তাই তপসী রায়াদের থাকার ঘরের দিকে গেল। তুলি আর রায়া কিছু নিয়ে হাসাহাসি করছে।
তপসী চুপ করে রায়ার পাশে বসলো। তুলি এই পরিবারের কি হয় তপসী এখনো তা জানে না। রায়া তপসীকে দেখে বললো,
—— তোমাদের বাড়ি এতো খালি কেন? আমি তো জানি দ্বীরাগমণ পর্যন্ত কাছের আত্নীয় সবাই বাসায়ই থাকে।
তপসী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেও লক্ষ্য করেছে সবাই চলে গেছে। শুধু কাকি আছে। হয়তো যাওয়ার ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও পরিবারের বউ হওয়ার কারনে দ্বায়িত্ব পালন করতে রয়ে গেছে।
তুলি তপসীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
—— বৌদিদি তোমার কি কান্না পাচ্ছে?
তপসী নড়েচড়ে উঠলো। তার সত্যিই কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চোখ একটু একদম শুষ্ক। বাচ্চা মেয়েটা কি মনের খবর বলতে পারে নাকি?
তপসী না-বোধক মাথা নাড়ালো। মুখেও বললো,
—— না তো। কান্না কেন পাবে?
—— আমার মনে হচ্ছে। একচুয়ালি তুমি এখন একা ঘরে থাকলে সিউর কান্না করতে।
রায়া ধমকে উঠলো,
—— তুই তোর কথা বন্ধ করবি তুলি? নয়তো মারবো এক চড়।
—— মার খাওয়ার মতো কি করলাম?
তপসীর টনক নড়লো। মেয়েটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে ! কিন্তু সকালে তো সে অন্য কথাই বলেছিল।
তপসী নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
—— তুমি শুদ্ধ কথা বলতে পারো, তুলি?
তুলি হেসে ফেললো। রায়া ও হাসছে সাথে।
তুলি হাসতে হাসতেই উত্তর দিলো,
—— আরে আমি তো দাদাবাবুর সামনে শুধু এভাবে কথা বলি।
—— বিশেষ কোনো কারন?
—— দাদাবাবু এতে প্রচুর ক্ষেপে। আর মজার কথা কি জানো বৌদিদি? দাদাবাবুও নিজেও জানে আমি শুধু তার সামনেই ওইভাবে কথা বলি।
তপসী হা করে তাকিয়ে রইলো। ওই বাড়ির সব গুলো লোকই কি এমন দুমুখো? এরা কি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় নাকি?
তুলি এখনো হাসছে। কোনো মতে হাসি আটকে বললো,
—— বৌদিদি তুমি কি ভাবছো আমরা ডাবল ফ্যাসড? আমিই শুধু এইটুকু মজা করি আর কেউ ব্যবহার বদলায় না।
তপসী এবার অবাক হলো। মেয়েটা সত্যিই এবার তার মনের কথার উত্তর দিয়েছে। রায়া বললো,
—— তপসী, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এই ধরো, ও চোখ দেখে মানুষের মনে কি চলছে তা অনেকটা ধারনা করতে পারে। দেখা যায় এইটি পার্সেন্টই সঠিক হয়।
,
সুব্রতের পায়ের পাশে এসে বসলো তপসী। বিকেল হয়ে এসেছে। সুব্রত এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। কাকি খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। তপসী সুব্রতের মাথার সামনে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চট করে চুমু দিতে সোজা হয়ে বসলো।
এরপর ধীরে ধীরে সুব্রতকে ডাকলো। সুব্রত নড়েচড়ে উঠলো। চোখ মেলতেই তপসীর হাসি মাখা মুখ চোখে পড়ল সুব্রতের। সুব্রত নিজেও হেসে ফেললো। মাথা উচু করে তপসীর ঠোঁটে চুমু দিয়ে আবার বালিশে মাথা এলিয়ে দিলো।
তপসী হঠাৎ চমকে গিয়ে পিছিয়ে যায়।
সুব্রত ঠোঁট উলটে বললো,
—— এ মা, তুমি ভূত দেখার মতো চমকে গেলে কেন?
—— আপনিই তো চমকে দিলেন।
সুব্রত ঠোঁট টিপে হাসলো। বলল,
—— চুমু দিলে কেউ চমকায় নাকি? চুমু দিলে তো, ,,
তপসী সুব্রতের মুখ চেপে ধরলো।
—— একটাও কথা না। খালি শয়তানি। উঠুন। হাত মুখ ধুয়ে আসুন। কাকি খেতে ডাকছে।
সুব্রত বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,
—— তোমার নিতা আন্টি ডাকে নি?
—— কেন? সে না ডাকলে কি আপনি খেতে পারবেন না?
—— আমি তা বললাম নাকি?
—— তাহলে আপনি কি বললেন?, উনার কেন আলাদা করে ডাকতে হবে?
সুব্রত চোখ উলটে বললো,
—— এ্যাই, তুমি যে আমায় বকছো, তোমায় একদম বউ বউ লাগছে আমার কাছে।
—— আমি বউ ই আপনার। নতুন করে লাগার কি আছে?
—— যাহ মেয়েটা একবারে আনরোমান্টিক।
—— ফ্রেশ হয়ে আসবেন আপনি? সবাই বসে আছে আপনার জন্য।
—— আসছি গো বউ। আমার কি দোষ বলো? বেহায়া মন সুন্দরী বউয়ের সামনে থেকে সড়তে চায় না।
—— আপনি ন্যাকামোও পারেন বটে।
১৫.
বিছানায় তপসীর পাশে শুয়ে তার চুল নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে সুব্রত। তপসী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
তপসী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
—— তুলি সম্পর্কে আমার কি লাগে?
—— ননদ।
—— কেমন ননদ?
সুব্রত শান্ত স্বরে বললো,
—— আসলে ওর সাথে আমাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ওর মা আমাদের বাড়িতে কাজ করতো। আমাদের বাড়িতেই থাকতো। চার বছর আগে মারা গেল মাসি। ওকে তখন আমার মা এ বাড়িতেই রেখে দিল। স্কুলে যায়, পড়ালেখা করে। এইতো, আমার দাদা ডাকে, সে হিসেবে তোমার ননদ লাগে।
—— মেয়েটা ভারী মিষ্টি।
—— কি বলছো? ও বাঁদরের চেয়ে কম না। সারাদিন টৈটৈ চৈচৈ।
—— তুমি এমন করে বলো কেন?
কথা শেষ করেই তপসী নিজের মুখ চেপে ধরলো। সে সুব্রতকে মুখ ফসকে ‘তুমি’ করে বলে ফেলেছে। সুব্রত কেমন করে তাঁকিয়ে আছে তার দিকে!
তপসী মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
সুব্রত তপসীর গালে হাত ছোঁয়ালো। বললো,
—— তুমি আমায় এতো বেশি মায়ার বাধনে কেন বাঁধছো । এখন থেকে আমার কর্মদিবস গুলো যে খুব কঠিন হতে যাচ্ছে বউ।
তপসী সুব্রতের গলা জড়িয়ে ধরলো।
—— আমি নিজের জন্যও সব কেমন কঠিন করে ফেলছি। এরপরের একাকিত্ব আমি সহ্য করতে পারবো না।
সুব্রত তপসীকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। সুব্রতের উষ্ণ আর্দ্র নিঃশ্বাস তপসীর গলায় অনুভূত হচ্ছে। তপসী কেঁপে উঠছে বারংবার ।
সুব্রত ফিসফিস করে বললো,
—— মনের ব্যাকুলতা এবার সত্যিই বাড়তে চলেছে বউ। তোমায় সম্পূর্ণ নিজের না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই, একদম নেই।
তপসী সুব্রতের চুলে আঙুল চালাতে লাগলো। সুব্রতের কানের চুমু দিলো।
—— আপনার ভালোবাসায় হারিয়েও আমি সার্থকতা খুঁজে পাবো।
এইতো শুরু ভালোবাসার। ব্যাকুলতা বাড়বে, অপেক্ষা বাড়বে। অনেকটা দূরে থেকেও কাছে আসার ইচ্ছা জাগবে মনে, এতেও যেন প্রশান্তির রেশ খুঁজে পাওয়া যাবে।
চলবে………
চলবে…………
চলবে………