#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৯
আজ কতদিন পর যে হিয়া কলেজে এসেছে সে নিজেও ভুলে গেছে। সামনে বোর্ড এক্সাম। এমনিতেই বাড়িতে রিমি পেত্নীর জন্যে চিন্তায় বাচে না এখন আবার পরিক্ষার ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে সে। হাতে মাত্র অল্প কিছু মাস বাকি। দিবার একি অবস্থা। সারা বছর তাইরে নাইরে করলে যা হয়। দিবা ক্লাস শেষে বের হতে হতে বললো,” ধুর আর পড়ালেখা ভাল্লাগে
না। আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারে।”
হিয়া ভ্রূ কুচকে তাকালো তারপর বললো,” বিয়ে করলে বুঝি পড়তে হবে না।”
” নাহ্ সেটা না। বিয়ে দিয়ে দিলে বরের সাথে রোমান্স করে জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে পারতাম। তখন পড়ালেখায় বেশি মনোযোগ আসতো।”, দিবার কথা শুনে হিয়া হেসে ফেললো। দিবা আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। কিন্তু সামনে তাকাতেই শুভ্রকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দিবা ফিসফিসিয়ে বললো,” বাহ্। কি প্রেম! দিন দিন দেখছি প্রেম খালি বাড়ছে।”
হটাৎ দিবার এমন মন্তব্য শুনে হিয়া সামনে তাকাতেই শুভ্রকে দেখলো। হিয়া মনে মনে খুশি হলেও মুখে তা প্রকাশ করলো না। দিবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,” কিসের প্রেম? বেশী বলছিস।”
” হ্যা, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”,বলেই ফিক করে হেসে উঠলো। হিয়া আস্তে করে দিবাকে চিমটি কেটে থামালো। তারপর দিবাকে বায় বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর শুভ্রের সামনে দাড়িয়ে কোমরে দুই হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” আপনি এসেছেন কেনো? ড্রাইভার কাকু কোথায়?”
শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বাহ্ তাকে রেখে ড্রাইভার কাকুর কথা জিজ্ঞেস করছে। শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আজ সকাল থেকে হিয়ার এমন ব্যাবহারের কারণটা সে জানে। তাই শুভ্র কথা বাড়ালো না। গাড়ির দরজা খুলে হিয়াকে বসতে বললো। হিয়া মুখ বাঁকিয়ে গাড়িতে বসলো। বলার তো কিছু নেই তাই লোকটা এখন চুপ।
হিয়া গাড়িতে বসতেই শুভ্র তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। যাক অন্তত তার কথা তো শুনেছে। শুভ্র গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাঝে মাঝে হিয়ার দিকেও তাকালো কিন্তু হিয়ার চোখ মুখ স্বাভাবিক। মনে মনে কি না কি জটলা পাকিয়ে বসে আছে এই মেয়ে। শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
আজ সকালে হিয়া কলেজে আসবে রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। তখনই দেখলো রিমি শুভ্রের কানে কানে কি জানি বলছে তারপর শুভ্রের হাত ধরে কি জানি মিনতি করছে। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেছে তার। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে হনহনিয়ে বেড়িয়ে এলো। শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত না। তারপর ড্রাইভার কাকুর গাড়িতে করে কলেজে চলে এলো। সেই কারণেই সে শুভ্রের সাথে কথা বলছে না।
গাড়ি জ্যামে থামলো। শুভ্র কি বলবে বুঝতে পারছে না। রিমি কানে কানে রায়হানের কথা জানতে চেয়েছিল। শুভ্র সে ব্যাপারে কিছু জানে না বলেছিলো। কিন্তু রিমির জোরাজুরিতে আর হাত ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে তাই শুভ্র রায়হানের গ্রিসে চলে যাওয়ার কথাটা বলে আর সেই ফটোগ্রাফারের নামটাও জানিয়ে দেয়।
শুভ্র আর রিমির সম্পর্ক টা ভাইবোন ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও বেশি বন্ধুত্বসুলভ। এইটা হিয়াকে কে বোঝাবে? যেহেতু রিমি আমেরিকায় বেশির ভাগেই সময়ে ছিলো তাই সে তাদের কালচারে অভ্যস্ত। শুভ্র এক দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো চুপচাপ আছে কেনো সে? কিছু একটা তো এই মেয়ের মাথায় চলছে।
শুভ্রের গাড়ির পাশে হটাৎ একটা স্কুটার এসে থামলো। স্কুটারে একটা ছেলে। ছেলেটার মাথায় জেল দিয়েছে নাকি তেল, বুঝা যাচ্ছে না। এক সাইডে সিথি করা চুলগুলো। কাধেরর একপাশে ব্যাগ ছুলছে। চোখে ধরার মতন চকচকে নীল রঙের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট। স্কুটারে বসে ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। হিয়া অনেক্ষন হলো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা শুভ্র খেয়াল করছে। এই হাদারামের দিকে তাকিয়ে থাকার কি আছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
চকচকে শার্ট পরা ছেলেটা কয়েকবার সেটা খেয়াল করলো। প্রথম কয়েকবার তার ঠিক বিশ্বাস হয়নি, গাড়ীতে বসে থাকা মেয়েটা যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েকবার সন্দেহ হয়েছে কিন্তু হিয়া একটু হেসে তাকাতেই ছেলেটার চোখ রসগোল্লার মতন হয়ে গেলো। হিয়া ইচ্ছে করেই বেশ সুন্দর করে হাসলো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। শুভ্র সবটা খেয়াল করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। হিয়া কি করতে চাইছে। তাকে জ্বালাতে এইসব করছে?
হিয়া নিজে থেকেই ওই ছেলেটাকে হাত নাড়িয়ে ডাকতেই ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে হেসে তাকালো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে ফেললো আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাচটা তুলে দিলো। তারপর কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। এখন যদিও হিয়ার প্রচুর হাসি পাচ্ছে তাও সে না হাসার চেষ্টা করছে। হিয়া নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি থামাচ্ছে। শুভ্র রেগে গিয়ে বললো,” কি করছো এইসব?”
হিয়া আড় চোখে তাকালো। বোঝাই যাচ্ছে শুভ্র রেগে গেছে। হিয়া থমথমে গলায় বললো,” কি করেছি? আমি তো কাউকে গিয়ে জড়িয়ে ধরিনি কিংবা হাত ধরে টানাটানি করি নি।”
” হিয়া, আই ক্যান্ট বিলিভ তুমি সকালের সামান্য বিষয়টার জন্যে ওই ইডিয়েটের দিকে তাকিয়ে হাসছো।”, বলতে বলতে কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা এখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে।
হিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” সামান্য বিষয়? যখন জড়িয়ে ধরা, হাত ধরে টানাটানি করা সামান্য বিষয় হয় তাহলে কারোর দিকে তাকিয়ে হাসলাম সেটা তো আরো নগণ্য বিষয়। আপনি এতো রিয়েক্ট করছেন কেনো? আমিও শান্ত আছি আপনিও শান্ত থাকুন।”
মনে মনে হিয়ার শান্তি লাগছে। এইবার শুভ্র বুঝবে ঠিক কেমন লাগে।
শুভ্র ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে তাকালো। গ্রীন লাইট হতে সময় বাকি। হিয়া আড় চোখে তাকালো, শুভ্র নিজের সিটবেল্ট খুলছে। কিন্তু কেনো? ছেলেটাকে মারবে নাতো। শুভ্র হাত দিয়ে কপালের সামনের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে। এইদিকে ওই স্কুটারের ছেলেটা গাড়ির জানালায় নক করতেই হিয়া ভয় পেয়ে তাকালো। ছেলেটাকে দেখে খুব বেশিই সহজ সরল মনে হচ্ছে। শুভ্র যে কি করবে কে জানে। শুভ্র বির বির করে বললো,” আই সোয়ার আই উইল কিল দিস স্টুপিড।”, বলেই জানালাটা হালকা খুলে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলেটা একটা ঢোক গিললো। তারপর হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ” আমি রাকিব। আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগলো। আপনার বাড়ি কি ময়মনসিংহে?”
হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। কি অদ্ভূত এই ছেলে তাকে চিনে কি করে? হিয়া হা সূচক মাথা নাড়তেই ছেলেটা হেসে উঠলো। শুভ্র জানালা এতো অল্প খুলেছে হিয়া একটু উচু হয়ে মুখটা বের করে বললো,” আপনি আমাকে চিনেন?”
ছেলেটা হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” মনে আছে? তোমার মামার বাসায় অনেকবার গিয়েছিলাম নানা কারণে।”, বাকিটা বলার আগেই শুভ্র গাড়ির কাচ তুলে দিলো। অনেক কষ্ট নিজের রাগ সামলে রেখেছে সে। এই হাদারামকে এই জায়গায় এসেই নিজের স্কুটার থামাতে হলো। শুভ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। হিয়া শুভ্রের হটাৎ এমন কাচ তুলে দেওয়ায় ভীষন বিরক্তি বোধ করলো। আজব ছেলেটা কি ভাবলো তাকে? হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনি কাচটা এইভাবে তুলে দিলেন কেনো?”
শুভ্র কঠিন দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সে। গ্রীন লাইট জ্বলতেই সিটবেল্ট পড়ে নিলো। তারপর সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে আপাদত গাড়ি চালাতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখলো সে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ টাগ করলো নাকি আবার। হিয়ার একটু চিন্তা হলো। এই মশাই তো আবার রাগ করলে রাগ ভাঙ্গানো মুশকিল।
বাড়িতে ফিরে শুভ্র সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। হিয়া ভেবে পায় না শুভ্রের কিসের জন্যে এতো রাগ হলো। রাগটা হওয়ার কথা তার কিন্তু এই মশাই রাগ করে বসে আছে। এইদিকে রিমি নাকি চলে যাচ্ছে। হিয়া জানতো মেয়েটা আমেরিকা ফিরবে কিন্তু তাহলে গ্রিসে যাচ্ছে কেনো হটাৎ? যাক, এই দেশ ছেড়ে গেলেই সে বাঁচে। হিয়া ব্যাগ নিয়েই নিচে দাড়িয়ে রইলো রিমিকে বিদায় দিতে। শুভ্রকে রিমি আগেই বলে রেখেছে। তাই সবাইকে বলে এইবার তার একা একা গ্রিসে পাড়ি দেওয়ার পালা। সেই মানুষটাকে তো খুঁজে বের করতে হবে। সবার আড়ালে কেনো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছ জানতে হবে তো।
হিয়া পা টিপে টিপে ঘরে এলো। শুভ্র শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে এসি ছেড়ে বসে আছে। শুভ্রকে কেনো জানি অন্যরকম ভালো লাগছে। হিয়া ব্যাগটা একপাশে রেখে আস্তে আস্তে শুভ্রের পাশে এসে বসলো। শুভ্র আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখে বন্ধ করে ঘাড় পিছনে ফেললো। হিয়া মাথাটা উচু করে শুভ্রের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো। হিয়া কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
কি বলবে এখন? থাক পরে বলবে। হিয়া উঠে চলে যেতেই শুভ্র চোখ খুলে হিয়ার হাত ধরে ফেললো। তারপর সোজা হয়ে বসলো। হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শুভ্র হাতটা টেনে নিজের কাধের উপর রেখে হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো। হিয়া একটা ঢোক গিলে শুভ্র শীতল দৃষ্টির দিকে তাকালো। শুভ্র হিয়ার মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” লেটস স্টপ দিস ফাইট। অ্যাম ডান উইথ অল দিস।”
হিয়া চোখ তুলে বললো,” আমি কি ঝগড়া করেছি? আপনিই তো গাড়িতে রাগ দেখালেন।”
শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” ওই স্টুপিডটা কে ছিলো?”
হিয়া একটু ভেবে বললো,” আমি জানি না। একজন প্রায় মামার কাছে আসতো। উনি হয়তো সে।” পরক্ষনেই হেসে উঠে বললো,” এইবার টের পেয়েছেন কেমন লাগে?” শুভ্র শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,” আমি ইচ্ছে করে তোমাকে হার্ট করিনি। আই হ্যাভ বিন অ্যালওয়েস ট্রিট হার লাইক মাই সিস্টার। কিন্তু ওতো আমেরিকায় ছিলো, ওখানকার কালচারই এমন।”
হিয়া শুভ্রের গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললো,” সে যেই হোক না কেনো? আমি আপনাকে কারোর সাথে শেয়ার করতে পারবো না। আমি এমনই হিংসুটে আর এমনই থাকবে। এই হিংসুটে বউকেই আপনার সহ্য করতে হবে।”
শুভ্র নিঃশব্দে হাসলো তারপর হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে,হিয়াকে জড়িয়ে রাখলো। হিয়া উঠে যেতে চাইলো কিন্তু শুভ্র হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে বললো,” এভাবেই থাকো।”, বলেই হিয়ার চুলের ভাজে মুখ গুজে দিলো। হিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,” আমি চেঞ্জ করবো তো।” শুভ্র কোনো কথা বললো না,নিঃশব্দে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো হিয়াকে।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৪০
হিয়া পড়ার টেবিলে বসে আছে। পড়ার টেবিলে বসেছে ঠিকই কিন্তু পড়তে ভাল্লাগছে না। কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কখনো জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কিংবা কখনো কলম মুখে নিয়ে পায়ের উপর পা রেখে দুলাচ্ছে। শুভ্র রুমের দরজার পাশে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন পড়ালেখার ধরন?
শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাড়িয়ে বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্র কুচকে ফেললো। তারপর হিয়ার দিকে তাকালো। মুখে কলম নিয়ে হিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার মুখ থেকে কলমটা নিয়ে বললো,” এটা মুখে দিয়েছো কেনো?”
শুভ্রের এমন কাণ্ডে হিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আড় চোখে তাকালো শুভ্রের দিকে। শুভ্র হিয়ার সামনের বইটা হাতে নিয়ে বললো,” আমি রুম থেকে যাওয়ার আগেও তো তোমাকে এই পেজটা পড়তে দেখে গেলাম। এখনো পড়া হয় নি?”
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো কারণ সত্যি পড়া হয়নি। ধুর ভাল্লাগে না এই পড়ালেখা। আগে পড়তে খুব ভালো লাগলেও এখন লাগে না। বইটা হাতে নিলেই মনে হয় সবকিছু অচেনা অজানা। হিয়া ঠোঁট উল্টে বললো,” নাহ্ পড়তে ইচ্ছে করছে না।”
শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। পড়ালেখায় গাফিলতি সে একদমই পছন্দ করে না। বইটা হিয়ার সামনে রাখলো তারপর হিয়ার চেয়ার ধরে ঝুকে এসে বললো,” বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কোথাও?”
” না আসলে আমার আজকে পড়তেই ইচ্ছে করছে না। কালকে থেকে আবার স্টার্ট করবো।,” বলে উঠে যাওয়ার আগেই শুভ্র হিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো,” আজ থেকেই পড়তে হবে।”
তারপর আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো শুভ্র। হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে। কোনোভাবে কি সে ফেঁসে গেলো। পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুভ্র কি তার পাশে বসে থাকবে। শুভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” নাও, শুরু করো।’
হিয়া মুখ কালো করে বইয়ের দিকে তাকালো। আর কোনো উপায় নেই পড়া ছাড়া। হিয়া অনেক কষ্টে মন দিলো পড়ায়। নিজের চিন্তার চেয়েও বেশিক্ষণ পড়লো তারপর বই বন্ধ করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” হয়েছে আমি আর আজ পড়তে পারবো না। কালকে আবার বসবো।”
শুভ্র একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” এইভাবে ফাঁকিবাজি করলে তুমি টপ রেজাল্ট করতে পারবে না। তুমি যদি চেষ্টাই না করো তাহলে ভালো কিছু কি করি আসবে। তোমাদের কলেজ থেকে প্রতি বছর টপ স্টুডেন্টদের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়। বাবা বলছিলো তোমার নাম ঐ লিস্টে নাকি নিশ্চয়ই থাকবে। বাট নাও আই হ্যাভ ডাউটস।” বাবার কথাটা শুভ্রের বানানো কথা। শুভ্র চায় হিয়া যেনো জীবনে ভালো কিছু করতে পারে। এগিয়ে যেতে পারে সব ক্ষেত্রে। হিয়া চেষ্টা করলে পারবে সেই যোগ্যতা তার আছে। এর আগের বোর্ড এক্সামের মার্কস শুভ্র বের করে দেখেছে। মিথ্যেটা সম্পূর্ন মিথ্যে না। বাবার কথাটাই সে ঘুরিয়ে বলেছে।
শুভ্রের কথাগুলো শুনে হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকালো। তাকে যদি টপ রেজাল্ট করতে হয় তাহলে এই পড়ালেখায় তার কিছুই হবে না। হিয়া একটা ঢোক গিলে বললো,” বাবা সত্যি চায় আমি টপ রেজাল্ট করি।”
” কে কি চায় সেটা তো কোনো ম্যাটার না। কথা হচ্ছে তুমি কি চাও? কত দূর যেতে চাও।”,বলেই স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া মহা বিপদে পড়েছে। এইসব নিয়ে সে কখনো ভাবেই নেই। কিন্তু আসলেই তো সে কি হতে চায়। তার তো একটা স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু স্বপ্নটা যদিও অনেক আগে চাপা পড়ে গিয়েছিল। হিয়া ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বললো,” আমি আইনজীবী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাতে তো সময় অনেক অল্প আমি কিভাবে ভালো রেজাল্ট করবো? আমাকে দিয়ে হবে না।”
” সেটাই, তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি ছেড়ে দাও।”, কথাটা শুভ্র তাচ্ছিল্যের সুরে বলতেই হিয়ার গায়ে কাঁটার মতন ফুটলো সেটা। কিভাবে মুখের উপর বলছে পারবে না। হিয়া আড় চোখে তাকাতেই শুভ্র বললো,” তোমাকে তো দিন রাত জেগে কেউ পড়তে বলছে না। তুমি আকাশ দেখে ,পা নাড়িয়ে পড়লেই হবে। মানে অন্তত তুমি পাশটা তো করবে।”
হিয়ার রাগে গা জ্বলছে। তাকে খোঁটা মেরে কিভাবে বলেছে দেখো। হিয়া দাত কিরমির করে তাকালো শুভ্রের দিকে তারপর বললো,” আমি যদি টপ রেজাল্ট না করেছি তাহলে আমি আমার নাম বদলে ফেলবো বলে রাখলাম।”
” কি নাম রাখবে?”, কথার পিঠে প্রশ্ন করলো শুভ্র। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে কড়া চোখে তাকালো। শুভ্র নিজের হাসি লুকিয়ে বললো,” আগে থেকে ভেবে রাখা ভালো না? পরে কষ্ট কম হবে।”
হিয়া মুখ হা করে তাকালো। মানে উনি ধরেই নিয়েছেন যে সে পারবে না। কত খারাপ! হিয়া রাগে গজগজ করে বললো,” আপনি জান তো। গিয়ে ঘুমান। আমি পড়ছি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।”বলেই বই নিয়ে বসলো। তাকে তো এইবার পারতেই হবে। হনুমানের মুখ বন্ধ করতে হবে যে।
শুভ্র উঠে গিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। যাক তার উপর রাগ করে হলেও তো পড়ছে। শুভ্র সত্যি চায় হিয়া জীবনে এগিয়ে যাক। মানুষের মুখে হিয়ার প্রশংসা শুনবে সে। আর পাঁচটা মেয়ের মতন হিয়াও পিছিয়ে পড়ুক সে সেটা চায় না। হিয়া কিছুক্ষণ পর আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” বসে আছেন কেনো?”
শুভ্র ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,” আমার ইচ্ছা।” হিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। পড়তে তাকে হবে, বাবা চেয়েছেন। আর এমনিতেও সে আইনজীবী হবে এটা তার বাবারও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কিছু দুঃস্বপ্নের আড়ালে সেই স্বপ্নটাও হারিয়ে গিয়েছিল তার। আর এই হনুমানটার জন্যেও পারতে হবে। ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবে তা না দেখো খাটে বসে ঝিমুচ্ছে।
হিয়া পড়া শেষ করে বইটা বন্ধ করলো তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো। বাপরে এতো রাত হয়ে গেছে পরক্ষনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। হিয়া এগিয়ে আসলো শুভ্র আসলেই ঘুমিয়েছে কিনা সেটা দেখতে। লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে। হিয়া শুভ্রকে বালিশ দিয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। তারপর ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে শুভ্রের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো। কিন্তু হটাৎ হিয়ার মনে একটা ইচ্ছে জাগলো এগিয়ে এসে শুভ্রের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।
⭐ রবীউল সাহেবের দুঃসম্পর্কের খালা হয় এই বৃদ্ধা। তিনি কি এক প্রয়োজনে এসেছেন, বয়স হলেও কথা কিন্তু সে স্পট করে কথা বলে।
বৃদ্ধা কিছুক্ষন পর পর খালি পান চিবুচ্ছে। পান রাখার একটা পাত্র তিনি সঙ্গেই রেখেছেন। পাত্র ভর্তি পান। হিয়ার এই বৃদ্ধাকে ভীষন ভয় লাগছে। যখন থেকে এসেছে খালি ভুল ধরেই যাচ্ছে। এমনকি তার শাশুড়ির ভুল পর্যন্ত ধরেছে। তিনি খাবার পরিবেশনের সময় গ্লাসে পানি দিতে ভুলে গেছে। এটা দেখে বৃদ্ধা বলেছেন,” বড় বউ, তোমার জলদি জলদি কাম করার সভাব গেলো না এতো বছরেও। গেলাসে পানি দিবার কথাও ভুইল্যা গেছো।”
সাহারা খাতুন রীতিমত অতিষ্ট হয়ে আছেন। রবীউল সাহেবের কোনো মহিলা আত্মীয়কে তিনি সহ্য করতে পারেন না। কারণটা হলো তার প্রতি তাদের এমন আচরণ। মুখে কিছু বলেন না ঠিকই কিন্তু চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।
হিয়ার অবস্থা তিনি নাজে হাল করে ফেলেছেন। হিয়া ঠোঁট কামারানো নিয়ে বলেছেন,” এমনে ঠোঁট কামড়াও কি জন্যে? এইডা তো ভালা লক্ষণ না।”
হিয়া মনে মনে আতঙ্ক নিয়ে আছে আপাদত কারণ বুড়ির পাশে বসে আছে হিয়া। তখন থেকে বুড়িটা আজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে।
” নাতি পুতনির মুখ দেখাইবা কবে? বিয়ার এতদিনেও একটা সুখবর দিতে পারলা না? তোমাগো তো আবার ডিজিটাল যুগ প্ল্যানিং করা লাগে। আমাগো দিনে এইসব অসিলো না। আমার তো সাতটা মাইয়া একটা পোলা। বুঝছো?”, বুড়ির কথা শুনে হিয়ার মরে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। মোট আটটা সন্ত্তান এই বুড়ির। আস্তাগফিরুল্লাহ, আর তিনটা বাকি রেখেছিলো কেনো? পুরো টিম বানিয়ে ফেলতো। নিজের মুখে অনেক কষ্ট সে হাসি ধরে বসে আছে।
বুড়ি আরো বললো,” তোমরা তো এই কালের পোলামাইয়া। এতো বাচ্চা নিতে চাও না। তয় চাইরের নিচে যাইয়ো না।”, বুড়ির কথা শুনে হিয়ার মাথা ঘুরাচ্ছে। চারটা বাচ্চা! ভেবেই ঘাম ছুটছে। এদের ভয় ডর নাই কিছু। এমন ভাব যেনো বাচ্চাগুলো তো উনি পালবে। এদের জন্যেই দেশের জনসংখ্যার এই দশা।
হিয়া কিছু বলতে পারছে না মুখে হালকা হাসি রাখার চেষ্টা করছে এতেও বুড়ি বলে বসলো,” ওমা হাসো কি জন্যে? এইসব কথায় হাসতে হয় না। শরমের কথা।” হিয়ার ইচ্ছে করছে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে পড়ে আর কত কি শুনতে হবে তাকে?
মানে কি অবস্থা! হাসা যাবে না, নড়া চড়া করা যাবে না, জোরে কথা বলা যাবে না, সে কি রোবট যে পাথরের মতন বসে থাকবে। এমনিতেও উল্টা পাল্টা কথা বলে মাথার সিস্টেম নষ্ট করে দিচ্ছে। কথাগুলো যদি আস্তে বলতো তাও হতো। এতো জোরে বলছে রহিমা খালা দূর থেকে ঠোঁট চেপে হাসছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার।
বুড়ি আবার বললো,” একটা সময় আছে। এই সময়ে বাচ্চা না লইলে পড়ে সমস্যা হইবো।”, কথাটা শুনে হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো। কিন্তু হটাৎ শুভ্রের আওয়াজে হিয়া সামনে তাকালো। শুভ্র কঠিন গলায় বুড়িকে বললো,” আপনাকে আমাদের নিয়ে এতো ভাবতে হবে। আপাদত আপনি উল্টা পাল্টা কথা বলে হিয়াকে ভয় দেখনো বন্ধ করুন।”
বুড়ি সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফেললো। হিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র কি সবটা শুনেছে? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি পড়াশোনা রেখে এইখানে কি করছো? উপরে এসো।”
হিয়া চুপটি করে বসে আছে। কি করবে সে? উঠে গেলে আবার বুড়িটা কি বলে? হিয়া চুপ করে রইলো। শুভ্র ভারী গলায় বললো,” হিয়া,আমি আসতে বলেছি।”
হিয়ার কাছে আর কোনো উপায় নেই। শুভ্রের পিছু পিছু তাকে যেতেই হলো। সবাই তাকেই রাগ দেখায় খালি। রুমে গিয়ে আবার জনাবের মেজাজ সহ্য করতে হবে। যদিও সে এই ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চায় না। হিয়া রুমে এসে সঙ্গে সঙ্গে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো। একমাত্র পড়ালেখাই তাকে বাঁচাতে পারে। শুভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। এপ্রনটা খুলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সে। হিয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি যে যন্ত্রণা! হিয়া বসে বসে কিছুক্ষণ বইটা ঘাটলো। মাথায় এই মুহুর্তে তার কিছুই ঢুকছে না, বুড়ির কথাগুলো শুধু মাথায় ঘুরছে।
হিয়া ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো শুভ্র শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে, শুধু ট্রাওজার পড়ে। গা বেয়ে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতন পানি পরছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সামনে এসে পড়েছে। হিয়া একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। উফফ লোকটা এইভাবে বের হয়েছে কেনো? সবাই মিলে তাকে মেরে ফেলার ধান্দা।
[ #চলবে ]
[ #চলবে ]