‘নয়নতারা’
লিখা- ফারিয়া নোভা
(পর্ব-১২)
নয়নতারা- প্রহরী?
ইব্রাহিম শেখ- হুম। সেই খোঁজ এনে দেয় সেই পীরের, যে নিজের কালাজাদুর মাধ্যমে অনেক কিছু হাসিল করেছেন জীবনে।
যার নামে রীতিমতো মানুষ কেঁপে উঠে।
সব শুনে আমার চোখ যেনো ঝলঝল করে উঠে, আমি তো এমনি একজন কে খুঁজছিলাম।
রাতের আধারে সেই পীরের দরবারে যাই।
সেদিন আমি তার পাপাচার দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
তারপর রাতের পর রাত চলতো কালাজাদু বিদ্যা রপ্ত করা। যেকোনো মানুষকে বশে আনতে পারতাম, নিজের প্রয়োজনে অপরকে দোষী করে নিজের স্বার্থসিদ্ধী করতাম।
কি না পারতাম আমি!
তবে আশ্চর্যের বিষয়য় ছিলো, পীর সাহেব আমার থেকে কোনোদিন কিছুই নেন নি এসব কিছু শিখানোর বদলে। আমি তার প্রচণ্ড অনুগত ছিলাম।
হঠাৎ কানাঘুষা শুনতে পেয়েছিলাম উনি অনেক অসুস্থ, মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত।
সেসময় আমাকে উনি ডেকে পাঠান। সে ততদিনে প্রায় কংকালসার হয়ে গেছে, বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না।
আমার কাছে তিনি এজীবনে শেষ কিছু চেয়েছিলেন……
নয়নতারা – কি চেয়েছিলো উনি, নানাজান?
নয়নতারার মুখে নানাজান শব্দটা শুনে ইব্রাহিম শেখ বেশ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
ইব্রাহিম শেখ- পীর সাহেব, তার দেবতার কাছে তার জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তার সেই সাধনার জন্য প্রয়োজন ছিলো এক নাবালিকার, যাকে আত্মাহুতি দিয়েই আরোগ্য লাভ করবেন পীর সাহেব।
আমার কাছে আমার মেয়েকে তার গুরুদক্ষিণা হিসেবে চেয়েছিলেন, আমি পারি নি তুলে দিতে আমার মেয়েকে। বরং তাকে ফেলে আসি দূর শহরে এক অনাথাশ্রমের সামনে।
রাগে ক্ষুব্দ হয়ে পীরসাহেব তার মৃত্যুর আগ মুহূর্তে আমাকে অভিশাপ দিয়ে যায়। আমার বিশাল সম্পত্তির হবে বিনাশ, আমি একা তিলে তিলে পচে মরবো।
তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলিত হতে শুরু করে কিছুদিন পর ই। মেয়ের শোকে আমার স্ত্রীর পাগলপ্রায় অবস্থা।
একদুপুরে আমি ঘুমোচ্ছিলাম, ঘুম ভাঙ্গে আত্মচিৎকারে। দেখি আমার স্ত্রী নিজের গলায় ছুড়ি চালিয়েছে।
ওর শেষ চাউনি টা আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলো, কতটা ঘৃণা করে সে আমাকে।
আমি শোকে পাথর হয়ে গেছি ততদিনে । গ্রাম জুড়ে মহামারি তে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। শুধু তাকিয়ে দেখেছি আমার সাম্রাজ্যের ধ্বংস।
তারপর বহুবছর যাবত নিজেকে নিজের মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছি….
নয়নতারার চোখ ছলছল করছে, তার নানাজানের একটা ভুলে কত কিছু হয়ে গেলো । তবু মানুষটার জন্য অদ্ভুত টান কাজ করছে নয়নতারার।
নয়নতারা – মা, কি এসেছিলেন?
ইব্রাহীম শেখ- আমার মেয়ে, আমাকে ভুল বুঝে চলে যায়। আমার ওকে আটকানোর ক্ষমতা সেদিন ছিলো না।
শুনো মেয়ে, এই রিং আর চেইন আমাদের বহু বছর পুরোনো ঐতিহ্য। নিয়তিকে যেদিন রেখে এসেছিলাম সেদিন ওসব ওর পরহিত ছিলো।
আজ সেই পরম্পরায় এগুলোর ভাগীদার তুমি। তুমিই হচ্ছো শুভ শক্তির অধিকারীণি। এই অন্ধকার রাজ্যের জন্য তুমি নও। তুমি চলে যাও এখান থেকে….
নয়নতারা- খালি হাতে ফিরে যেতে আমি এখানে আসি নি যে।
ইব্রাহীম নয়নতারার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়।
ইব্রাহীম শেখ- কি চাও? তোমাকে দেয়ার মতো কিছুই আমার নেই।
নয়নতারা- আছে নানাজান, সেটা আপনি নিজেই। আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই। যাবেন আমার সাথে? আমিও যে বড্ড একা।
ইব্রাহীম শেখ হা করে তাকিয়ে আছে নয়নতারার দিকে।
তিনি আর কিছুই বলতে পারছেন না।
নয়নতারা হুইল চেয়ারটা টেনে বাইরে নিয়ে আসে। বের হতেই দেখে সেই ঘোড়ার গাড়ি, নয়নতারা বেশ অবাক হয়।
ইব্রাহীম শেখ- এই আমার সেই প্রহরী। আমি চলে যাচ্ছি রে আজ। তোর ও মুক্তি।
লোকটার চাহনি শিথিল হয়ে আসে, টপ টপ করে জল গড়ায়।
উনি চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে ওদের স্টেশন পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসেন।
ইব্রাহীম শেখ আসার আগে লোকটার হাতে একটা শিশি দিয়ে আসেন-
‘এটা রাখ, তোর কাজে লাগবে….’
ট্রেন ছুটে চলছে, নয়নতারা তার নানাজান কে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উদ্দেশ্যে…..
কুলসুম বানু ইব্রাহীম শেখ কে দেখে হকচকিয়ে যায়, উনাকে তো আগে কখনো দেখেন নি। এছাড়া কাজ নেয়ার সময় ও তো মেয়েটার কেউ নেই বলেই জেনেছে।
মেয়েটাকে নিয়ে এমনি সকাল থেকে চিন্তা হচ্ছিলো, এখন সে আবার কাকে নিয়ে এসেছে।
কুলসুম বানুর হুশ ফেরে নয়নতারার ডাকে-
‘নানাজানের জন্য বাবার রুমটা গুছিয়ে দিন। উনি আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন।’
কুলসুম বানু আর কথা বাড়ান নি, কাজে লেগে পড়ে।
এদিকে ইব্রাহীম শেখ পুরো বাড়িটায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। রোদিক আর নিয়তির ছবিটায় চোখ আটকে যায় তার।
বিন্দু বিন্দু জল জমে চোখের কোণে…..
নয়নতারা- নানাজান!
ইব্রাহীম শেখ- হু, বলো মা।
নয়নতারা – চলুন ঘরে যাওয়া যাক। বিশ্রাম নিবেন একটু।
ইব্রাহীম শেখ কে রুমে নিয়ে যায় নয়নতারা।
নয়নতারা- নানাজান, আমি যাই?
ইব্রাহীম শেখ- শোনো খুব ভোরে সূর্য উঠার পর ই তুমি এই রুমে আসবে, দরকারি কাজ আছে।
নয়নতারা – জ্বী।
এদিকে নয়নতারার মন আনচান করছে টগরের সাথে কথা বলার জন্য। রাত ঘনিয়ে আসছে, টগর ও নিশ্চিত ছটফট করছে নয়নতারার সাথে কথা বলার জন্য….
নয়নতারা নিজের রুমে এসে লাইট অফ করে দেয়। বিছানায় শুয়ে টগরের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু টগর আর আসে না।
নয়নতারার চোখ লেগে আসে, আধো ঘুম জড়ানো চোখে ও অনুভব করে কেউ পরম আদরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই মমতার পরশে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
নয়নতারার ঘুম ভাঙ্গে প্রচুর ভোরে। ও ফ্রেশ হয়ে নানাজানের রুমে গিয়ে দেখতে পায়, উনি সূর্যের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে আছেন।
নয়নতারা কিছুটা তাজ্জব বনে যায়। আরো কাছে যেতেই নয়নতারা দেখতে পায় নানাজানের সামনে কিছু অদ্ভুত সব জিনিস রাখা।
এর মধ্যে মানুষের মাথার খুলি, কিছু হাড়গুড়, কিছু ভেষজ উপাদান, জড়িবুটি আর ও অনেক কিছু।
নয়নতারা ভয়ে ভয়ে ডাকে – ‘নানাজান?’
ইব্রাহীম শেখ- তোমার জন্য পরিধেয় বস্ত্র ওয়ারড্রোবে রাখা আছে, যাও পরিধান করে এসো তরী।
নয়নতারা কিছু বলতে যাবে তখনি ইব্রাহীম শেখ হাত উঁচিয়ে বাধা দেন।
ইব্রাহিম শেখ- এখন কোনো প্রশ্ন নয়, তোমার সব কৌতুহল আমি পরে মেটাবো।
নয়নতারা আর কিছুই বলে উঠতে পারে না। নানাজান আজ তাকে তরী বলে সম্বোধন করলো কেন? কি বা বস্ত্র রাখা আছে ওয়ারড্রোবে?
নয়নতারা ওয়ারড্রোবের ড্রয়ার খুলে আরেক দফা ধাক্কার সম্মুখীন হয়। ও দেখতে পায়, ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজ রাখা ওর জন্য যেটা অবিকল ও দেখেছিলো ওর মায়ের পড়নে।
নানাজান যে অদৃশ্য শক্তির অধিকারী তা নয়নতারার বুঝতে বাকি নেই, নাহলে বিষয়গুলো কাকতালীয় হতে পারেনা।
কিন্তু এখন কোনো প্রশ্ন ও করতে পারছেনা। নয়নতারা সালোয়ার কামিজটা পড়ে আসে। মাথায় ঠিক মায়ের মতোই ঘোমটা টেনে নেয়।
নানাজান কিভাবে যেনো চোখ বন্ধ করেই ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।
ইব্রাহীম শেখ- আমার মুখ বরাবর সামনে এসে বসো।
নয়নতারা বিছানার উপর উঠে বসে ঠিক ইব্রাহীম শেখের মুখোমুখি। উনি নয়নতারার হাতে কিছু অশ্বজ গাছ ধরিয়ে দিলেন, বাকিটুকু নিজে হাতে মুট করে রেখেছেন।
ইব্রাহীম শেখ- তুমি এখন চোখ বন্ধ করে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখবে, আমি না বলা পর্যন্ত এক চুল ও নড়বে না যত যাই হোক।
নয়নতারা শুধু মাথা নাড়ে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ও চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড ধোয়া নয়নতারার চোখ- মুখে লাগছে। মনে হচ্ছে খুব কাছেই কিছু পুড়ছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, তাও সে চোখ খুলছে না।
আগুনের আঁচ ওর খুব কাছাকাছি চলে আসে, চামড়া পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। নয়নতারার জামার হাতায় আগুন লেগেছে, প্রচণ্ড জ্বালা করছে।
নানাজানের কথায় একচুল ও নড়তে পারছেনা, এদিকে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তাহলে কি উনি প্ল্যান করে নয়নতারাকে পুড়িয়ে মারতে চাইছেন?
যন্ত্রনার তীব্রতা বাড়ছে।
নয়নতারা প্রায় ঢলে পড়বে এমন সময় একটা শক্ত হাত ওকে ধরে ফেলে।
খুব শীতল এক মিশ্রণ ওর পোড়া জায়গাটা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, জ্বালা যন্ত্রণা নিমিষেই কমে গেছে।
ইব্রাহীম শেখ- চোখ খুলো, তরী।
নয়নতারা চোখ খুলে প্রথমেই ওর হাতের দিকে তাকায়, অবাক করা বিষয় ছিলো ওর হাত পুরো অক্ষতই আছে, শুধু হাতা টা একটু ভেজা।
ইব্রাহীম শেখ- তুমি আমার অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিলে যে মুহূর্তে, তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমার মনের ইচ্ছা আমি পূরণ করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো, এমন কি নিজের জীবন দিয়ে হলেও….
এজন্যই আজ প্রাতঃকালে তোমাকে আসতে বলেছিলাম, নিয়তির অতীত জীবনের সেই কালো জগত সম্পর্কে জানতে।
কিন্তু এ বাড়িতে আমার শক্তি কাজ করছে না এক অতৃপ্ত আত্মার কারণে।
নয়নতারা অবাক। নানাজান কি টগরের কথা বলতে চাইছেন?
ইব্রাহীম শেখ- হু তুমি ঠিকই ধরেছো। টগর আছেই বলে আমার শক্তি এখানে তেমন কাজ করছে না। উপরন্তু বারবার আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, শেষমেশ তোমার শরীরে আগুন লাগানো হলো। টগর এসে তোমাকে ধরে ফেললো।
আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। আত্মার বিরাজমান অবস্থায় শুভ শক্তি কোনোভাবেই কাজ করে না।
নয়নতারা- তাহলে উপায়?
ইব্রাহীম শেখ- উপায় একটাই। নিয়তি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের আশ্রমের ভেতর ধ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই শেষ উপায়।
আমি আমার শক্তি দিয়ে আর মাত্র একবার ই এই ধ্যান করতে পারবো। এই ধ্যান ভঙ্গ হলে আমার পক্ষে তোমাকে সাহায্য করা সম্ভব হবে না।
নানাজানের কথায় নয়নতারার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। আশ্রমের ভেতর? তা কিভাবে সম্ভব?
তখনি ভয়ানক ঝড় টা বয়ে যায়। রুম জুড়ে তুমুল ঝড় বইছে, সব উলটে পালটে যাচ্ছে।
প্রচন্ড ভ্যাপসা গন্ধ রুমের ভেতর।
ঝড়ের হাওয়ায় নয়নতারা বিছানা থেকে পড়ে যায়।
ইব্রাহীম শেখের মাথায় প্রচণ্ড বড় পাথর এসে পড়ে বাতাসের ধাক্কায়, উনি অচেতন হয়ে পড়েন।
এদিকে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেনো নয়নতারাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, ও উঠে বসার আগেই ওকে যেনো ঝটকা মেরে কাছের জানালায় ছুড়া হয়।
কাচ ভেঙ্গে নয়নতারার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঢুকে যায়, প্রচণ্ড রক্ত ঝড়ছে। সেদিকে ওর কোনো খেয়াল নেই।
ওদের দু’তলা বাড়ির কার্নিশ ধরে ঝুলে আছে নয়নতারা, বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে এই ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই!
হাত টা পিছলে পড়ে যায় নয়নতারা…..
নয়নতারার যখন হুশ ফেরে তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। শরীরে প্রচুর ব্যাথা, নাড়াতে পারছেনা একদম ই।
কিছুটা ধাতস্থ হতেই সে নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করে। নানাজান তার বিছানার পাশেই বসে আছেন।
তার কপালে ব্যান্ডেজ।
কুলসুম বানুর চোখে মুখে আতংক।
নয়নতারা – আমি এ ঘরে?
ইব্রাহীম শেখ- তুমি বিশ্রাম নাও তরী, তোমার শরীর ভালো নেই
নয়নতারা- আপনি কেমন আছেন? মাথায় বেশি লেগেছে?
ইব্রাহীম শেখ- তা তো একটু লেগেছে বটে, তুমি চিন্তা করো না। রেস্ট নাও।
কুলসুম বানু কিছুই বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে। ইব্রাহীম শেখের রুমটা লণ্ডভণ্ড অবস্থায় পেয়েছে, সে সাথে দুজনেই আহত।
কিন্তু মেয়েটা কে নিজের রুমেই পেয়েছে। কিভাবে যে কি হলো কিছুই বুঝতে পারে না। এ বাড়ির মানুষগুলোকে বরাবর ই তার অদ্ভুত লাগে।
নয়নতারাকে কিছু খাওয়ানো শেষে ইব্রাহীম শেখ, কুলসুম বানু ওর রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
নয়নতারা প্রথম থেকে ঘটনা টা ভাবছে, এটা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। যেই হোক তার এতো ক্ষোভ কেনো?
কিন্তু সে তো পড়ে যাচ্ছিলো, তাহলে তাকে বাঁচালো কে?
টগর?
টগর – কি এতো ভাবছো বলোতো?
হঠাৎ টগরের কণ্ঠস্বর শুনে নয়নতারা আতকে উঠে।
নয়নতারা- তুমি তাহলে এসেছো? (কান্নাজড়িত কন্ঠ)
টগর- তুমি কি ভেবেছিলে আমি আসবো না?
নয়নতারা- কাল তো আসো নি (অভিমান জড়ানো কন্ঠ)
টগর – এসেছিলাম বৈকি। তুমি তো অনেক টায়ার্ড ছিলে, তাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম।
নয়নতারা- আর আজ বাঁচালে আমায়?
টগর- তুমি তো জানোই সেটা।
নয়নতারা – আমায় যে এতো ভালোবাসো, মুখে কখনো বলো নি যে….
টগর কোনো কথা বলে না।
নয়নতারা- কি হলো কিছু বলবে না?
টগর – তোমার একটু ভালোবাসার জন্যই যে এ জীবন বেছে নিয়েছি তাই তো তুমি জানো না।
নয়নতারা- কি বললে?
টগর – নাহ কিছুনা।
নয়নতারা- আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা কি তুমি বুঝো না?
টগর – তোমার মাঝেই আমি, তুমি যে আমার আড়াল হতে পারবে না।
নয়নতারা- তাহলে দেখা দাও, আর কত অপেক্ষা।
দীর্ঘনিঃশ্বাস…..
টগর – হবে। এ জীবনের অবসান যে তুমিই করবে।
নয়নতারা – তোমার কথাগুলো এতো জটিল, আমি বুঝি না কিছুই।
টগর – এতো বুঝে কি হবে পাকা বুড়ি,
কাজের কথায় আসো।
নয়নতারা- কি কথা?
টগর – আশ্রমে কবে যাচ্ছো?
নয়নতারা- নানাজানের সাথে কথা বলতে হবে, উনার ডিসিশন ই সব।
টগর – যাক, তুমি একজন আপনজন পেলে।
নয়নতারা- একজন কে পেয়েছি বলছো?
টগর – আমায় ও বুঝি আপনজন ভাবো? না আছে আমার কোনো কায়া, না আমাদের মধ্যে আছে কোনো সম্পর্ক….
নয়নতারা- মায়ার টান নেই? ভালোবাসা নেই? তুমি কি অনুভব করো না?
টগর – এ ভালোবাসা নয়, শুধুই ভ্রম। একদিন কুয়াশার মতো এ ভ্রম কেটে যাবে। আমি হারিয়ে যাবো বহুদূর,
সময় যে সন্নিকটে….
নয়নতারা বেশ বুঝতে পারে টগর কাঁদছে। পৃথিবীর কি এক আজব লীলাখেলা। যা চায় তা পায় না।
আবার না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে যায়, যা শেষপর্যন্ত ধরে রাখা যায় না….
টগর – তরী!
নয়নতারা- হুম।
টগর- এতো মনমরা হয়ো না, জীবনের স্রোত বইবে তাই বরঞ্চ স্বাভাবিক।
তোমার জন্য উপহার এনেছি, দেখবে?
নয়নতারা- উপহার?
টগর- হু আমি চলে গেলে, তুমি ঘুমে আচ্ছন্ন হবে। কিন্তু খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গবে, তখনি পাবে সেটা।
এবার চোখ বন্ধ করো।
নয়নতারা লক্ষী মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে, মাথায় সেই মমতাময়ী পরশ……
আজানের শব্দে নয়নতারার ঘুম ভাঙ্গে, তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেনো ঘোরের মধ্যে আছে।
ঘোমটা টা মাথায় টেনে নিয়ে সে বাড়ির বাইরে পদক্ষেপ রাখলো।
চারদিকে কোনো খেয়াল নেই, আবছা ভোরের আলোতে নয়নতারা আপনমনে খালিপায়ে হেঁটে চলেছে।
কোনো গন্তব্য জানা নেই।
যখন পথের শেষ হয় সেখানে একটা খাম পড়ে থাকতে দেখে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে বহুবছর পুরোনো ।
নয়নতারা খাম খুলে দেখে সুন্দর হাতের লেখা। মনে হচ্ছিলো লেখাগুলো কেউ ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলছে-
‘ চোখের মায়ার খুঁজেছিলাম আমায় সেই খেলারছলে,
হারিয়েছি সব, আজও আছি পাশে কোনো মায়ার টানে…..’
লাইনগুলো কেনো জানি প্রচন্ড চেনা ঠেকছে নয়নতারার কাছে। সূর্যের মৃদু আলো ওর গায়ে এসে পড়ছে। নয়নতারার ঘোর কাটে।
কিন্তু একি! এখানে কিভাবে এলো সে! এ যে ওর মায়ের কবর….
তাহলে এটা মা কে উৎসর্গ করেই লিখেছিলে তুমি…
মনে মনে বলে নয়নতারা। ওর কানে প্রতিধ্বনিত হয়-
‘লিখেছিলাম বটে, দিয়েছি ১৮ বছর পর।’
নয়নতারা চোখের জল গোপন করে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
নিজের রুমে যাবার আগে নানাজানের রুমে উঁকি দিতেই –
‘তরী ভেতরে এসো। ‘
নয়নতারা- নানাজান, কিছু বলবেন?
ইব্রাহীম শেখ- তুমি হয়ত ভুলেই গেছো, আজ দিবাগত রাত পেরোতেই তোমার জন্মদিন।
নয়নতারা চমকে যায়, সে তো ভুলেই গেছিলো দিনটার কথা। মনে রেখেই বা কি লাভ, আর মায়ের চিঠি হাতে তুলে দিবেন না বাবা, বাবার সাথে ঘুরা হবে না….
ইব্রাহীম শেখ- তবু এই দিনের গুরুত্ব অনেক। তুমি কাল ১৮ তে পা রাখছো। কাল ই তোমাকে তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। সময় ঘনিয়ে এসেছে ….
নয়নতারা – আমি যে এখনো কিছুই জানি নাহ।
ইব্রাহীম শেখ- সঠিক সময়ে তুমি সব জেনে যাবে। তবে আজই আমাদের আশ্রমে যেতে হবে। আজ রাতটা যে করেই হোক আমাদের ওখানেই কাটাতে হবে….
নয়নতারা- রাতে থাকতে হবে? ফাদার কি রাজি হবেন?
ইব্রাহীম শেখ- সে দায়িত্ব তোমার, ভাবনাও তোমার।
ইব্রাহীম শেখের ঠোঁটের কোণে হাসি। এদিকে নয়নতারার মনে ভীতি কাজ করছে, দুঃচিন্তা তো সাথে আছেই।
নয়নতারা- নানাজান আমি যে কিছু ভেবে পাচ্ছিনা।
ইব্রাহীম শেখ- ভাবতে তোমাকে হবেই, আমরা বিকেলেই রওনা দিবো।
নয়নতারা- বিকেলেই?
নয়নতারা ভাবছে টগর যদি একটু সাহায্য করতো কতো না ভালো হতো।
ইব্রাহীম শেখ- হুম বিকেলেই উত্তম। আমাকে গিয়ে ধ্যানের স্থান নির্ধারণ করে সব ব্যবস্থাও তো করতে হবে।
নয়নতারা- জ্বী, আচ্ছা।
নয়নতারা এই বলে চলে যাচ্ছিলো, তখনি নানাজান পিছু ডাকে-
‘তরী শোনো….. ‘
নয়নতারা- জ্বী
ইব্রাহীম শেখ- ধ্যান শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি কোনোভাবেই ওর সাহায্য নিতে পারবেনা। এতে ধ্যান ভঙ্গ হবে।
নয়নতারা যেনো মুষড়ে পড়লো। টগর ছাড়া কে বা তাকে সাহায্য করবে?
সে নিজের রুমে এসে ভাবছে, ফাদার কে কি বা বলবে? আর নানাজানের ই বা কি পরিচয় দেবে?
ইয়েস!
এর চেয়ে ভালো অস্ত্র কিছুই হতে পারেনা।
নয়নতারা দৌড়ে নানাজানের রুমে যায়।
কিন্তু গিয়ে দেখতে পায় নানাজান ঘুমোচ্ছেন।
নাহ এখন আর উনাকে উঠিয়ে লাভ নেই। দুপুরেই নাহয় বলবো সব।
নয়নতারা বের হতে যাবে, তখনি দেয়ালে দেখতে পায় এক অবয়ব। যা রুমজুড়ে পায়চারি করছে।
ভয়ে ভয়ে সে পেছনে তাকায়।
কিন্তু একি! ঘরে তো কেউই নেই সে আর নানাজান ছাড়া। উনি তাও সেই কখন থেকে বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
তাহলে?
নয়নতারা নিজের মনে যতটা সাহস সঞ্চয় করা যায়, ততটুক নিয়েই দেয়ালের দিকে তাকায়।
সে দেখতে পায় অবয়ব টার পায়চারির মাত্রা বেড়েছে। সে সুক্ষদৃষ্টিতে দেখে বুঝার চেষ্টা করছে, তার পরিচিত কারো ছায়া পড়ছে কিনা?
হু বেশ চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু কোথায় যেনো ঘাপলা আছে।
সেটাই নয়নতারা ধরতে পারছেনা।
নয়নতারার মনে হলো হঠাৎ অবয়ব টা ওর দিকে মাথা ঘুরিয়ে যেনো মৃদু হাসছে।
নয়নতারা ভয়ে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে-
‘ নানাজান…..’
(চলবে)