পারবো না ছাড়তে তোকে পর্ব ২০+২১

পর্ব ২০+২১
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-২০
রোকসানা আক্তার

জেরিন আপু ভ্রু দু’টো কপালের দিকে উঁচিয়ে সাদমান ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—মিথি ভাবীর মা জানলো কিভাবে রে ভাবী এবং নিলয় যে আমাদের বাসায়?
—তা আমি কিভাবে বলবো।হয়তো কোনোভাবে জেনে গিয়েছেন।নিচে আসলেই জানতে পারবি।দেখ,মিথির মা কি বলে..

নিলয় ভাইয়া আস্তে আস্তে পা ফেলে আমার কাছে এসে হাত দিয়ে নিচে যাওয়ার ইশারা করেন।আমার পুরো গাঁ ছমছম করে উঠে এবং সাথে বুকটার ধুকপুকানি।জানি না এখন কি লিখন আছে দুর্ভাগা এই কপালে।
তারপর বুকে থুতু দিয়ে জোরে নিলয় ভাইয়ার বামহাতটা চাপড়ে ধরি।নিলয় ভাইয়াও উনার হাতের আঙ্গুলীর সাহায্যে আমার হাতটা শক্ত করে ধরেন আর সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেন।
জেরিন আপু,সাদমান ভাইয়া আমাদের পেছন পেছন আসছেন।
আমি চোখদুটো বুঁজে রেখে আস্তে আস্তে দৃঢ় পদক্ষেপে পা ফেলি নিলয় ভাইয়াকে অণুসরণ করে।
তারপর নিলয় ভাইয়া একটা জায়গায় এসে থেমে যান।ক্ষণিকে আমার বুকটার বামপাশটা ছ্যাৎ করে উঠে।এখন কি ড্রাইনিং-এ ?এসব ভাবি আর আল্লাহ আল্লাহ বলে চোখের পাতা একটু ফাঁক করে সামনের দিকটা দৃষ্টিগোচর করার চেষ্ট করি।আবছা আবছা চোখের সামনে বাবা এবং তারপাশেরই মাকে সোফার উপর বসা দেখতে পাই।
তারপর এক ছটাকে চোখদুটো পুরোপুরি খুলে ফেলি এবং চারপাশটায় ভালোভাবে তাকাতে থাকি। কারণ,মা-বাবা ছাড়া অন্যকেউ আছে কি’না তা পরখ করার জন্যে।

বাবা সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে আমার কাছে আসেন।আর থমথমে দু’চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।বাবার মুখ না বললে বাবার চোখ বলছে বাবা নিশ্চয়ই অনেকটা চিন্তিত ছিলেন।আমার কাঁধে হাত রেখে বাবা নিদারুণ স্বর টেনে বলেন,
–মারে?এতদিন তোর কথা খুব মনে পড়েছিল।খুব ভয়ে ছিলাম আমরা।তোরা কোথায় আছিস,কিভাবে আছিস…! কোনো প্রবলেম হলো না তো!জানিস মা?এই সপ্তাহ আমার নিদ্রা আকাশে উড়ে গেছে।এই আপাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তোরা এখানে আসছিস তা বলেছেন!
আমি হতভম্ব হয়ে ঠোঁট নাড়তে থাকি।কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছি না।নিলয় ভাইয়া পাশ থেকে বলে উঠেন,
–কোন আপা??

বাবা মুঁচকি হেসে বলেন,
–এই যে সাদমান বাবার মা বললেন।
নিলয় ভাইয়া একথা শোনার সাথে সাথেই উনার দিকে কটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।উনি থতমত খেয়ে পিটপিট চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকেন।পরে উনি হাই তুলতে তুলতে বলেন,
–না মানে তোমাদের এভাবে লুকিয়ে থাকাটা অনেক কষ্টকর!নিজের ফ্যামিলি মেম্বার,আত্মীয় -স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে রেখে দিনের পর দিন লুকোচুরি আর ক’দিন!সবার তো একটা সমঝোতায় আসা উচিত, না-কি?!
নিলয় ভাইয়া আর কিছু না বলে আমায় উদ্দেশ্য করে বলেন,
–মিথি,চলো??আমরা এখন আমাদের বাসায় চলে যাবো।
এ বলেই উনি হনহন করে গেস্ট রুমের দিকে চলে যান।মা নিলয় ভাইয়ার কথায় কিছুই বলছেন না।উনি প্রথম থেকেই থমকালো মুখ নিয়ে বসে আছেন।কথার খই ফোটানোরও প্রয়োজন বোধ করছেন না।কপাল কুঁচকে আমার কথা অনর্গল শুনে যাচ্ছেন।মায়ের মুখের ভ্যাঁপসা আভা আমাদের প্রতি কি অগ্নিশর্মা? নাকি অনেকটা কষ্ট পেয়ে মুখটা ভার করে বসে আছেন।আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে মায়ের থেকে।কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই আসছে না।

জেরিন আপুর মা এরফাঁকে বলে উঠেন,
–আপা?সে-কি এখন আসছেন,এখনই চলে যাবেন?দূরের পথ।আজ রাতটা নাহয় থেকে যান।কাল সকালে সবাই রওনা করবেন।
–আপনাদের এ ব্যাপারে ডিসিশন কী?আপনারা কি এই সম্পর্ক মেনে নিবেন?(সাদমান ভাই)
বাবা একরোখা মনে বলেন,
–তা এখনো জানি না।বাসায় গিয়ে এ বিষয়ে ডিসকাস করবো সবাই।
ইতোমধ্যে নিলয় ভাইয়া হাতে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হোন।আর মা নিলয় ভাইয়াকে দেখা মাএই সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ান এবং সদরের দিকে মুভ করেন।তারপরও মা কোনো কু-শব্দটি করলেন না।জেরিন আপুর মায়ের কথার জবাবও দিলেন না।নিলয় ভাইয়া গলাটা হালকা পরিষ্কার করে বলেন,
–জেরিন,আন্টি, সাদমান ভাই?আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।অনেক আপ্যায়ন করেছেন আমাদের,সত্যি তা ভুলবো না।আপনারা অবশ্যই ঢাকায় গেলে আমাদের বাসায় আসবেন।ওকে??
–কি এমন কষ্ট দিয়েছিস?সবেতো ৫/৬ দিন ছিলি!(জেরিন আপু)
–ইনসাল্লাহ বেঁচে থাকলে হয়তো আবার আসবো।ভালো থাকবেন আন্টি,ভালো থাকবেন সাদমান ভাই,আর জেরিন তুইও।ফোনে যোগাযোগ রাখিস সবসময়।
জেরিন আপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।বাবাও সবাইকে বিদেয় দিয়ে নিলয় ভাইয়ার পেছন পেছন হাঁটতে থাকেন।আমি সবার পেছনে হাঁটছি।জেরিন আপু,আন্টি, সাদমান ভাই উনারা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন।
ফস করে সাদমান ভাইয়া আমার পেছন পেছন এসে হাঁটার মাঝে বলে উঠেন,
–মিথিলা?তোমাকে অন্যকারো সাথে দেখলে আমার সারা শরীর এখনো শিরশির করে।সত্য কথা এটাই,আমি তোমাকে এখনো মন থেকে মুছতে পারিনি।তাই দুঃখ নিও না প্লিজজ?আমি যে আমার মাকে দিয়ে তোমাদের বাড়ি ডাক পাঠিয়েছি।
উনার বলা কথায় আমি থমকে যাইই।আর মুহূর্তে চোখদুটো পানিতে ভিঁজে উঠে।উনাকে মুখ দিয়ে কিছু না বলতে পারলেও মনটা বলে উঠে,
–আপনার মতো বেদম প্রহরের মানুষ অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে লাইফে কখনোই হ্যাপী হবে না।আপনাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি!!অভিশাপ!!

আমি মুখের ভাঁজ স্বাভাবিক এনে উনার কথায় কোনো রকম ভ্রক্ষেপ না করে আবার হাঁটতে থাকি।উনি আমার রেসপন্স আর না পেয়ে সেই স্থানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।আমরা প্রায়ই গাড়ির কাছে চলে আসি।
ঙবাবা সাথে করে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসছেন।আমরা ওই গাড়িতেই উঠে বসি।বাবা এবং ড্রাইভার সামনে বসেন।আর,আমি,নিলয় ভাইয়া এবং মা পেছনের সিটে বসি।
মা গাড়ির গ্লাসের পাশে বসে থমথমে মুখে গ্লাসটা খুলে দেন।মায়ের সারা শরীর ঘামে একাকার!হয়তো এই ঘামের কণা ক্ষোভ প্রকাশ!

নিলয় ভাইয়া গলা খেচকি দিয়ে বলেন,
–আন্টি? আমার মা এবং বাবা কেমন আছেন??
এতক্ষণ পর মা গলাটা ছাড়েন।ভার গলায় নিলয় ভাইয়ার কথায় উওর করেন।
–তা বাসায় গেলেই দেখবে।
–আন্টি আপনি কি আমাদের উপর এখনো রাগ?
উনি আড়নয়নে নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবার গ্লাসের দিকে পূর্বদৃষ্টি রাখেন।নিলয় ভাইয়া আবারও মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন।আমি নিলয় ভাইয়া হাত দিয়ে থামিয়ে চুপিচুপি বলি,
–আপনি একটু অফ যান।আমি মায়ের সাথে কথা বলে দেখি।
নিলয় ভাইয়া সম্মতি দিলে আমি মায়ের আরো কাছে ঘেঁষে বসি।আর গলার স্বর ছোট করে বলি,
–মা?আমার পেটের উপর একটু হাত রাখবে??
মা আমায় কথা শুনেও না শুনার ভান করে উনার দৃষ্টিতে মগ্ন।এবার আমি মায়ের আরো কাছে মিশে উনার হাতটা ধরি।উনার হাতটা টেনে ধরে আমার পেটের উপর রাখতেই উনি আমার দিকে এবার চোখ রাখেন।আমি উনার চাহনিতে মুঁচকি হেসে দিই।উনি আমার পেটের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে থাকেন স্থির দৃষ্টিতে।আমি মায়ের কানার পাশে আমার মুখটা গুঁজে ফিসফিস কন্ঠে বলতে থাকি,
–মা ক’দিন পর তুমি নানু হতে যাচ্ছো।

মা এবার এক ঝাপটে দূরে সরে বসেন।গদগদ গলায় মুখতুলে বলেন,
–আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে মিথি!তোর খালামণি,আঙ্কেল কি এই সম্পর্ক মেনে নিবে?তারউপর তুই মা হতে যাচ্ছিস!
মায়ের নতজানু ভাবভঙ্গি আমার পুরো শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।আমি মাকে আশ্বাস দিয়ে বলি,
–মা তুমি চিন্তা করো না।দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।এবার শুধু তোমরা একটু সাপোর্ট করো আমাদের,তাহলেই হবে।অল্প অল্প করে আমরা সব জয় করে নিতে পারবো!

মা বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমার মাথার উপর হাত রেখে আমাকে উনার দিকে জড়িয়ে নেন।হুট করেই মা কেঁদে উঠেন,
–মিথিরে?এ’কটা দিন কতটা যে কষ্ট পেয়েছি রে!আমাদের এভাবে ফেলে রেখে চলে গেলি! নিলয়ের মা-বাবার মুখ দিয়ে যা আসছে,সবার সামনে আমাদের তা বলছে।সমাজের কাছে আমাদের পতিতালয়ের মানুষ বলে সম্বোধন করেছে।লজ্জা-ভয়ে আমরা চুপ হয়ে থাকি।কিছুই বলতে পারিনি।আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার বোন আমার সাথে এরকম ব্যবহার করবে।ও’কি সত্যিই আমার মায়ের পেটের বোন যে সমাজের লোকজনের কাছে আমাদের ছোট করেছে!!

মায়ের মুখে কান্নার ছাপের প্রলেপে একটা মুহূর্তে আমি নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলি।আমার মা কখনোই কাঁদেন না।কিন্তু আজকের চোখের পানি বলছে মায়ের মনটা কঠিন পাথরের আঘাতে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে!সত্যিই কি খালামণি মাকে এতটা বেশি কষ্ট দিয়েছে!?
নিলয় ভাইয়া পাশ থেকে বলে উঠেন,
–আন্টি আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।এখন সামনের টুকু আমি দেখে নিব।বিষাক্ত ছোবলের প্রতিঘাত আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে প্রতিহত করবো।আপনারা শুধু আমাদের একটু দোয়া করবেন।ব্যাস এটুকু এনাফ!!

—বাবা আমাদের এসব নিয়ে মাথাব্যথা একদম নেই!আমরা শুধু এখন তোমার ফ্যামিলির কারণে ভয়ে আছি।উনারা কি তোমাদের মেনে নিবে?তোমরা এখন কোথায় থাকবা?কি করবা?আমার মাথায় কিছুই আসছে না।(মা)
নিলয় ভাইয়া মায়ের কথায় কিছুক্ষণ অব্দি চুপসে থেকে আবার বলে,
–আন্টি?বললামতো আপনি একদম চাপ নিবেন না মাথায়!কাস্ট কিপ সাইলেন্ট এন্ড সি!

পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-২১(বোনাস পার্ট)
রোকসানা আক্তার

গভীর রাত নেমে আসার সাথে সাথে গাড়ির বেগ বাড়তে থাকে দ্রুগতিতে।সামনের সিট থেকে বাবার নাক গোঙ্গানির শব্দ আসছে।বাবা এখন নির্বিঘ্নে অতল ঘুমে আচ্ছন্ন।
মাও হালকা ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ করে আছেন।নিলয় ভাইয়া নাক চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন।আর ড্রাইভার বিরামহীন গাড়ি চালাচ্ছে।
আমি হাঁক ছেড়ে নিলয় ভাইয়াকে বলি,
–সবাই তো ঘুমচ্ছে।আপনার ঘুম আসছে না?
উনি মাথাটা হালকা বেঁকে আমার দিকে দৃষ্টি রাখেন।আর আলতো মাথা নেড়ে বলেন,
–নাহহ।তুমিও তো ঘুমোচ্ছ না!
–আমি ঘুমালে সবাইকে পাহারা কে দিবে শুনি??
–ওরে আমাদের রক্ষিতা।
এ বলে উনি আমায় উনার দিকে আঁকড়ে নেন।
–আহ..!!
–কি হয়েছে মিথি?
–শরীরটা যেন গন্ডারের চামড়া।একটু আলতো ধরলেই তো হয়!এই দেখেনতে হাতটা ক্ষণিকে লাল করে দিয়েছন!

–উফস,স্যরি মিথি।আমিতো ভুলেই গেলাম আমার বউটা যে গুলুমুলু…
–ঢং।একথা আস্তে বললেই তো হয়,ড্রাইভারের কান হরিণের ন্যায়। বুঝলে??

নিলয় ভাইয়া মুখ চেপে একটা বেখেয়ালি হাসি দেন।আর ড্রাইভারকে টিটকারি করে বলেন,
–কি চাচা?তোমার আবার ঘুমটুম পাচ্ছে নাতো?
ড্রাইভার চাচা গলা খেচকি দিয়ে বলেন,
–আহা বাবা আমার আর ঘুম!আমি যদি ঘুমিয়েই যাই,তাইলে তোমরা বাসায় যাইবা কেমতে…
–সেটাই চাচা সেটাই।

আমার হাসি চলে আসে নিলয় ভাইয়ার তামাশা দেখে।পরে নিবৃওে রাতের আধারে শুনশান গাড়ি চলতে থাকে।আমি হালকা ঘুম ঘুম চোখে সিটের দিকে মাথাটা ঝুঁকে নিই।।।
গাড়ির হর্ণে আমি তন্দ্রাঘুম থেকে নিষ্কৃতি পাই।চোখগুলো ভালোভাবে কচলে বাহিরের দিকে চোখ রাখি।বাহিরে দিকে ঘোর আলো দেখতে পাইই।সবে অন্ধকার কেটে সূর্যিমামা আলোর প্রদীপ ছড়াচ্ছে চারদিকে।আর জায়গাটা দেখেই বুঝে ফেলি আমরা যে এখন ঢাকা শহরে পদার্পণ করেছি।
অতঃপর ৭ঃ০০ টার দিকে নিলয় ভাইয়া ড্রাইভার চাচাকে গাড়ি থামাতে বলেন।মা ভড়কে গিয়ে নিলয় ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেন,
–আরে বাবা, মাঝরাস্তায় গাড়ি থামাচ্ছো কেন?কিছু লাগবে??
–নাহহ,আন্টি তেমনটি নয়।আপনারা বাসায় চলে যান।আমি মিথিকে নিয়ে এখানে নেমে যাচ্ছি।।
–মিথিকে নিয়ে এখানে নামবে মানে??মিথিকে নিয়ে কোথায় যাবে?
–আমি মিথিকে নিয়ে আমাদের বাড়ি যাচ্ছি,আর আপনি এবং আঙ্কেল বাসায় চলে যান।
মা অবাক হয়ে নিলয় ভাইয়ার উপর আঁতকে উঠেন।
— এমতাবস্থায় তোমাদের বাড়ি কেন যাবে?
–আন্টি?আমি আমার বউকে আজ আমার ঘরে তুলবো।দেখি কে কি করতে পারে!!
–এসব কি বলছো তুমি?তুমি জানো? এখন তুমি তোমাদের বাড়ি গেলে অনেক বিপদ হয়ে যাবে বাবা!
–আন্টি ইনসাল্লাহ কিছুই হবে না।আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।আর মিথিকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।আমার প্রাণে দমটুকু থাকতে আমি মিথির কিছুই হতে দিবনা!ড্রাইভার চাচা আপনি উনাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েন।আর এই নেন ভাড়ার টাকাটা।

এ বলে নিলয় ভাইয়া ড্রাইভার চাচাকে টাকাটা হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় বাবা বাঁধা প্রদান করেন।
–আরেহ,এ কি করছো বাবা?আমরা বাসার সামনে নামলেই তো তখন ভাড়াটা দিয়ে দিতাম।
–নাহ আঙ্কেল কোনো সমস্যা না।টাকা যেকোনো একজন দিলেই হবে।
পরে,নিলয় ভাইয়া টাকাটা দিয়ে আমার মা-বাবাকে বিদেয় দেন।আর আমি নিলয় ভাইয়ার হাতটা শক্ত করে ধরি। চোখবুঁজে দু’ফুটো চোখের জল ফেলি।মনে মনে ভাবতে থাকি,
–নিলয় ভাইয়া ভুলবাল কিছু করছেন নাতো?হে খোদা,আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করো,,ইয়া মাবুদ!
আমার মনের মাঝে ভয়ভীতি নিয়ে নিলয় ভাইয়ার হাত ধরে উনার সাথে হাঁটতে শুরু করি।পরে ভাইয়া একটা সি.এন.জি ভাড়া করে নেন।অতঃপর আমরা সি.এন.জি করে এসে উনাদের বাড়ির সামনে এসে নামি।ভাইয়া সি.এন.জি ড্রাইভারকে ভাড়াটা পরিশোধ করে আমায় বলে উঠেন,
–মিথি?তুমি শুধু দু’চোখ বন্ধ করে আমার উপর ভরসা রাখো।মনে সাহস রাখো।আই হোপ,আমরা প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারবো।নো হ্যাজিটেশন ফিল,ওকে??
আমি নিলয় ভাইয়াকে সম্মতি দিয়ে উনার সাথে সদরের দিকে হাঁটা ধরি।অন্যদিকে আমাদেরকে গেটের দারোয়ান দেখা মাএই আনন্দে উল্লাস করে চিৎকার দিয়ে উঠেন,
–ওহ আপা?সাহেব আইছে?সাহেব আইছে?কোনে আপন্যারা??
খালামণি দারোয়ানের ধুকধুকি বাঁজার শব্দ শুনে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন হাতে ফুলের ঝুঁড়ি সমেত।
উনি আমাদের দেখামাএই চোখদুটো বড় করে কপালের দিকে উঁচিয়ে নেন।আর সড়াৎ সড়াৎ উনার হাত থেকে বকুল ফুলের ঝুঁড়িটা নিচে পড়ে যায়য়।উনি এতটাই হতবাক আমাদের দেখে,তা উনার কল্পনার বাহিরে ছিল।নিলয় ভাইয়া খালামণি কে দেখে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ করেননি।আগের মতো স্বাভাবিক মনে খালামণির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন এবং সঙ্গে আমিও।তবে আমার মনের অবস্থানের কথা যদি বলতে যাই তাহলে আমি পুরোই ফিদা।বুকের মধ্যে এতটা ভয়ই কিলবিল খাচ্ছে আমার তা বলে বুঝানো যাবে বা!!আর মনে মনে সূরা ইউনূস একশো বার পড়া শেষ অলরেডি।
নিলয় ভাইয়া খালামণির প্রায়ই কাছাকাছি চলে আসে।আর খালমণির সামনে এসেই বলতে থাকে,
–মা কেমন আছো তুমি?তোমাদের এতদিন খুব মিস করেছিলাম।দেখো?তোমাদের বউমাকে আমার সাথে করে নিয়ে এসছি।তাকে কোনেরকম অযত্ন করবে না।তোমার আপন মেয়ে ভেবেই স্নেহ করবে!!

খালামণি অগ্নিশর্মা হয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিলয় ভাইয়ার দিকে ইঙ্গিত করেন।আর ধারালো গলায় বলেন,
–এসব আমায় বলছিস কেন??!!আমি এসবের কিছুই জানি না!!.
এ বলে হনহন করে খালামণি অন্যএে চলে যান।হয়তো রাগের ভার না সামলাতে পেরে এখান থেকে চলে যান।নিলয় ভাইয়া আমাকে নিয়ে এবার বাসার মধ্যে ঢুকেন।বাসার মধ্যে ঢোকার পরই আঙ্কেলের দিকে দৃষ্টি যায়।উনি ড্রাইনিং এ বসে বসে নাস্তা করতেছেন।এখানে আমাদের উপস্থিতি এখন একদম নজরে আনছেন না।হয়তো বুঝেছেন আমরা এখন এখানে দাড়িয়ে আছি,তারপরও ভান করে নিজের খাওয়ায় মগ্ন।
নিলয় ভাইয়া গলাটা পরিষ্কার করে বলে,
–বাবা?কেমন আছো?
আঙ্কেল নিজের পূর্বদৃষ্টিতে চোখরেখে আমাদের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে উঠেন,
–তুই এই বাড়িতে কেন আসছিস?তোর এখন এ বাড়িতে কি?আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে চলে যা!
–বাবা তা কেমন কথা বললে?আমি তোমার ছেলে নয়?আমাকে কি ছোটবেলায় একবারও লালণ করো নি?
–আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার ইউর স্পিচ ইন দিস মোমেন্ট!গো টু দ্য হেল।
–ওকে শুনা লাগবে না বাবা!আমিও আপনার কোনো কথা মানতে রাজি নই।আমি এ বাড়ির একমাএ সন্তান!এ বাড়িতে আমার অনেক অধিকার আছে।এটা কোনে ছেলে খেলা নয় আমার লাইফটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে আর আমি রং-তামাশা দেখব!লাইফ আমার নিজের,সো আমার নিজের ভালোমন্দ দেখার অধিকারও আমার।আমার লাইফে অন্যকেউ হস্তক্ষেপ করা মানেই স্বাধীনতা হরণ করা!

এ বলে দমদম করে উনি আমার হাতে টান মেরে রুমের দিকে নিয়ে চলেন।আমাকে রুমে নিয়েই বিছানার উপর বসান।আর গদগদ গলায় বলতে থাকেন।
–এ বাড়িতে যদি থাকতে চাও তাহলে মাথা উঁচিয়ে থাকতে হবে।কারো কোনো কথা কানে নিবা না।কে কি বললো,কে কি শুনালো ওসব একদম এড়িয়ে।তুমি নিলয় চৌধুরীর বউ এবং এই বাড়ির একমাএ পুএবধূ!সো এটা মাথায় রেখে সবার সাথে নিজের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখবে।নিজে নিজের মতো করে চলবা।কোনো রকমের হীনমন্যতা যেন এই মনে না বাঁধতে দেখি।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড মি??

আমি উনার কথায় আলতো মাথা নাড়ি।তারপর উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দু’উরুতে জাপটে ধরে আবার বলেন,
–প্লিজজ মিথি?আই লাভ ইউ সো মাচ।আই ক্যান নট আন্ডার্সটেন্ড আমি ফিলিংস ইউ! তোমার মনের নিদারুণ কষ্ট আমায় দগ্ধ করবে।কখনো মন খারাপ করে থাকার চেষ্ট করবে না।এই তুমি না আমায় অনেক ভালোবাসো?
–হু…
–তাহলে কি আমার জন্যে পারবে না এ বাড়িতে হাসিমনে চলতে?কারো কথা গাঁয়ে না মাখতে?পারবে মিথি,বলো পারবে?
–আমি সবকিছু পারবো আপনার জন্যে।আপনার জন্যে পৃথিবীর সব মানতে রাজি,সব আত্মত্যাগ করতে রাজি।কারণ,যে মানুষটিকে ছোটবেলা থেকে অনেক বেশি ভালোবেসে এসেছি তারজন্যে আমার প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারবো।আমি পারবো,আমি পারবো…
নিলয় ভাইয়া বুকফুলিয়ে খুশির ছলকে হেসে উঠে।আর আমাকে উনার বুকের দিকে টেনে নিয়ে বলেন,
–ভালেবাসি মিথি!অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।
অনেকক্ষণ অব্দি জড়িয়ে রাখার পর আামকে উনার বুক থেকে ছাড়িয়ে নেন আরবলে,
–আমার জন্যে একগ্লাস পানি নিয়ে আসতে পারবে,মিথি?গলাটা খুব তৃষ্ণার্ত!
আমি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাই।আর মাথার উপর ওড়নাটা টেনে রুম থেকে বের হই।রুম থেকে বের হওয়ার পর মনের মধ্য লুকিয়ে থাকা ভয়গুলো আবার মাথাছাটা দিয়ে উঠে।আমি আস্তে আস্তে পা টিপে রান্না ঘরের দিকে এগোয়।কিচেনের দরজার ফাঁকে উঁকি মেরে নিই কেউ আবার রান্নাঘরে আছে কি’না!তারপর রান্নাঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে মনের আনন্দে নেচে উঠি।ধীর পা ফেলে গ্লাস খুঁজতে থাকি।হুট করে রান্নাঘরে একজন কাজের মহিলা প্রবেশ করেন। আমি চমকে গিয়ে বুকে থুতু দিতে থাকি।
–আহা,আপামণি?আপনে রান্না করার লাইগা আইছেন?আপনের রান্না করা লাগবে না।আপনে আপন্যার রুমে যান।
আমি ইতস্ততাবোধ নিয়ে বলি,
–ন-নাহ আসলে তেমনটি নয়!ইয়ে আমি পা-পানির গ্লাস খুঁজছি!
–ওউ,পানির গেলাস তো ড্রাইনিং টেবিলের উপর রাখা।
–আচ্ছা একটু কষ্ট করে একগ্লাস পানি এনে দিতে পারবেন??
–আইচ্ছা সমস্যা নাই আইনা দিতাছি।

এ বলে উনি ড্রাইনিং এর দিকে চলে যান।আর ড্রাইনিং থেকে একটু দূরে সোফার উপর বসে বসে নিলয় ভাইয়ার বাবা পএিকা পড়ছেন।আজ ফ্রাইডে,এইজন্যে বোধহয় আজ অফিসে যাননি। সামনের সাজানো গ্লাসের সারি থেকে একটি গ্লাস হাতে নিয়ে উনি ড্রাইনিং টেবিলের উপর জগ থেকে পানি ঢালতে থাকেন।নিলয় ভাইয়ার বাবা তা লক্ষ করে জোরগলায় বলে উঠেন,
–কারজন্যে পানি নিচ্ছিস?
–স্যার?আপামণি পানি লাইগা
–কোন আপামণি??(ভ্রু কুঁচকে বলেন)
–ছ্যার,আমগো সাহেবের বউ মিথি আপামণি!!।
একথা শুনামাএই উনি পএিকাটি পাশের সিটে ছিটকে ফেলে আবার বলে উঠেন,

–যার পানি তাকে নিয়ে যেতে বল।অন্যকারো ঘাড়ের উপর মাথাচাড়া দেওয়া এই বাড়িতে তার জায়গা নেই।
–না মানে স্য-স্যার…!
–কথা বাড়ানো আমি পছন্দ করিনা।যেটা বলছি সেটা কর!!যা এখান থেকে….!!

কাজের মহিলাটি আর কিছু না বলে নতজানু করে আমার কাছে চলে আসেন।
–এই ছ্যার এমনিতে খিটখিট্টা মেজাজের।কয়ডা টাকার লাইগা কত্ত কথা শুনা লাগে এদের।আল্লাহ যে ক্যান গরীব বানাইয়া অন্যের বাড়ি কাজ করার লাইগা দুনিয়াতে পাঠাইলো…
উনি এসব বলছেন আর কাপড়ের আঁচল টেনে চোখের পানি মুছতেছেন।উনাকে দেখে আমার বড্ড মায়া হয় উনার কাঁধে হাত রেখে বলি,
–মন খারাপ করবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আচ্ছা আমিই গিয়েই পানিটা নিচ্ছি…

চলবে…
(অনেকে বলতেছেন ওদের ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দিতে।কিন্তু দেখুন,পুরো গল্পজুড়ে ওদের শুধু পালানোর ইতিহাসটুকুই।তাছাড়া আমি গল্পটা শেষ করে দিব খুব শীঘ্রই।তাই আর অন্য উপ্যাখ্যান টেনে আনি নি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here