পর্ব ৬+৭
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-০৬
রোকসানা আক্তার
নিজমনে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত প্রায়,তবুও নিলয় ভাইয়ার রুমে ছাঁয়া পড়ছে না।আমি এখনো বদ্ধ রুমে একা বসে আছি।রুমের চারপাশটা আবছা আবছা অন্ধকারে ঘেরা।রুমের জানলা দিয়েও যে আলো আসবে সে উপায়ন্তর টুকু নেই।কারণ,জানলাগুলো বন্ধ করা।
আমার চোখগুলো দেয়ালের দিকে একমগ্নে স্থির।হঠাৎ করে রুমে একটু আলোর প্রতিসরণ পড়ে।আমি ফ্লোর ছেড়ে দরজার দিকে চোখ রাখি।নিলয় ভাইয়া দরজা হালকা ফাঁক করে এইমাএ রুমে ঢুকলেন এবং দু’হাত ভাঁজ করে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছেন।উনাকে দেখামাএই আমার মনে একটু সাহস আসে।কারণ,এতক্ষণ ভয়েও আধপোড়া হয়ে গিয়েছিলাম।উনি রুমের লাইটটি জ্বালিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমার চোখদুটো ঝলসে উঠে।ঘনঘন চোখের পলক ফেলার পর উনার দিকে মাথাতুলে তাকাই।উনি এখন আমার একদম কাছে চলে এসছেন।দীর্ঘ সাইলেন্সের পর গম্ভীরস্বরে বলেন,
-এতক্ষণ ভয় পেয়েছিস খুব,না?
আমি উনার কথায় কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ না করে অন্যদিক তাকিয়ে থাকি।
-কি হলো কথা বলছিস না যে?
আমি টানা একটা দম ছেড়ে ছোট করে বলি,
-আমি বাড়ি যাবো।
ভাঁজ করা হাতদুটো সরু করে মেঝের উপরে রাখা চেয়ারটি টেনে উনি শান্তমনে বসে পড়েন।ডানহাতটা চোয়ালের নিচে গুঁজে আবার বলে উঠেন,
– আরো এক সপ্তাহ এখানে থাকতে হবে তোকে।
-ভাইয়া, আপনি কি মানুষ নাকি কোনো পশু,বলুনতো?নরপিশাচের মতো আমায় এখানে জোর করে ধরে এনে কেমন ফলা ফলছেন আপনি!?আমিতো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি!তাহলে,কোন উদ্দেশ্যে আমায় এখানে নিয়ে এলেন?!
-কোনো উদ্দেশ্য নয়, মিথিলা।আমার এংগেইজমেন্ট ডেটের টাইমটা ওভার হোক,তারপর নাহয় তোকে ছেড়ে দিব।তবে বাংলাদেশে নয়,ইংল্যান্ড।আর ওদিক দিয়ে ফ্লাইটটাও ৭ তারিখের পরে পড়বে।
উনার এ’কথায় আমার চোখে-মুখে রাগের আভা ভেসে উঠে।ক্রুদ্ধতায় সারা গা আমার গজগজ করতে থাকে।হঠাৎ মনের অজান্তেই গড়গড়িয়ে দু’গাল বেয়ে দু’ফুটো অশ্রু বের হয়।আমার সেই বেদনাতীত অশ্রুর অনুভূতি নিলয় ভাইয়া হয়তো বুঝতে পারেন।আমার অশ্রুসিক্ত দু’নয়নের দিকে উনি হাল চোখে তাকিয়ে আছেন।আর উনার হাতদুটো আমার দিকে বাড়িয়ে পরম আদরের সহিত চোখের পানি মুছে নেন এবং ভ্রু নাঁচিয়ে বলেন,
-এখানে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না?তুই না বললেও আমি বুঝি।আর মাএ ৩/৪ দিন একটু কষ্ট কর।আই প্রমিস,আই উইল রিলিজ ইউ ফ্রম দিস প্রিজন ।দ্যান,উই ফ্লাই এ ওয়ে ইন প্লেন।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড?
-ভাইয়া, আর ইউ ম্যাড??আপনি কি’সব যা তা বলছেন, এসব?আপনি জানেন,আমার মা কতটা শক খেয়ে আছেন?প্লিজজ আমায় যেতে দিন…!
উনি ঠোঁট বেঁকে হেসে বলেন,
-চিন্তা থেকে পরিএাণের জন্যেইতো তোকে নিয়ে নিঁখোজ একটা আর্টিকেল ছাপিয়ে আসলাম মাএ।বাবা,আঙ্কেল সবাই পুলিশ লাইনে এন্ড হ্যাল্পলাইনে যোগাযোগ করার বিশেষ চেষ্টায় অব্যাহত আছেন।তুই চিন্তা করিস না আন্টিকে সামলানোর জন্যে এন্জিলা আছেন,বিকজ ও সবটা জানে।তারপর আর কি একটু নাটকই তো!!নাটকতো আর সত্য নয়।এই আমাদের ফ্লাইটটার জন্যেই তোকে এতটা দিন আঁটকে রাখা।নাহলে,সেই কখন এনগেজমেন্টের আগেই তোকে নিয়ে ইংল্যান্ড গো……।
আমার ভীষণ অবাক লাগতেছে।এসব কিছুর পেছনে উনারই সবটা চক্রান্ত।আর উনি সাধু বেশে চোর সাজতেছেন!(মনে মনে)
-দেখছিস আমার ড্রামা!এই ড্রামার জন্যেই তো অক্সফোর্ডের অনেকগুলো প্রাইজ চুকাইছি।
আমি আরো বেশি নাঁজেহাল অবস্থায় পড়ি। কারণ,উনি আমার মনের ভাষা বুঝলেন কিভাবে!!
-আমি যে তোর মনের মানুষ তাই!!
উনার কথায় আমার কাশি চলে আসে।গলায় ঝাল ঝাল অনুভূতি হতেই উনি একগ্লাস পানি আমার দিকে এগিয়ে দেন।আর শান্তধীরে বলেন,
-তুই-না আমায় ভীষণ ভালোবাসিস, মিথি?তাহলে,আমাকে পেতে সামান্য এই বদ্ধ ঘরেও থাকতে পারছিস না??
উনার কথায় আমার পুরো শরীর থরথরে কাঁপতে থাকে।মুহূর্তেই যেন শরীরের তাপমাএা বেড়ে জ্বর ১০৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মাএায় যাবে।
-ভ-ভ-ভাইয়া…???
এ বলে আমি প্রায়ই কেঁদেই ফেলি।আমার চোখের পানি উনার কথায়ও যেন আজ হার মানছে না।
-প্লিজজ মিথি,কাঁদিস না।তুই এতটা বছর আমায় লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে আসছিস,কিন্তু বলিস নি।আজ কেন জানি তোকে খুব মারতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার!এ’কথা অনেক আগে বললেই তো আমি মায়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করে ফেলতাম।আর তুই কি-না বোকার মতো…..
আমি সাবিলার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে যেতাম??ভীষণ রাগ উঠছে তোর প্রতি আমার এখন….
এ বলে ভাইয়া দাঁতগুলো কটমটাতে থাকেন।
আমি কাঁপা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠি,
-ভা-ভা-ভাইয়া,আপনি এসব কিভাবে জানেন??
-তোর ডায়েরী থেকে।
-ড-ড-ডায়েরী থেকে ম-ম-মানে??
-হু।কিছুদিন আগে আমি বিজনেস ডিরেক্টর পদে লাস্ট সিলেক্ট হয়েছি।ওই বিষয়টি আন্টিকে জানানোর জন্যে তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম,সেদিন তুই ভার্সিটি ছিলি।তারপর কি ভেবে তোর রুমে যাই।আর রুমে আসতেই তোর টেবিলের উপর রাখা ডায়েরীর দিকে আমার চোখ পড়ে।পরে আমি ডায়েরীর সবগুলো পেইজে চোখবুলাতে থাকি।অতঃপর,দেখতে পাই যে তুই…….
বায় দ্য ওয়ে,মিথি তুই জানিস?তোকে যে আমার আগ থেকে অনেক ভালোলাগে???আমি সাবিলার জন্যেই তোকে পেয়েও ছুঁতে পারছি না। ইভেন,এখনো!?৭ তারিখে যদি ট্রুলি এংগেইজমেন্ট টা হয়েই যায়,তাহলে তোকে এখানে আঁটকে রাখাটা আমার বৃথা ব্যর্থ!!আমি জাস্ট এংগেইজমেন্টটি আঁটকাতে তোকে এখানে বদ্ধ করে রেখেছি যাতে সবাই তোর চিন্তায় আংটি পড়ানো এরেন্জ রিজেক্ট করে।
বিলিভ কর,আমি তোর মায়ায় পড়েছি,মায়ায় পড়েছি তোর ওই টানাটানা ডাগর চোখে।আমি মায়ায় পড়েছি তোর সেদিন নীল শাড়ি পরিহিতা অবস্থায়।তোর মায়ায় নেশাঘোরে আমি তোকে নিয়ে হারাতে চাই!!
আজ কেন জানি আমার অতি শোকে কান্না চলে আসে।
-বাবা খুব কঠিন মনের মানুষ!দাদার প্রতিটি কথা বাবা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছেন।এখন, সাবিলা এবং আমার ব্যাপারে বাবার তাও কোনো ছাড় নেই।তোকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই মিথি!
-ভ-ভ-ভাইয়া,এসব কেমন কথা বলছেন??সবাই কি ভাববে হুটহাট ইংল্যান্ড চলে গেলে!আমার মা,বাবা,খালামণি,আঙ্কেল কি ভাববে আমাদের??
-ফ্যামিলির কথা ভাবলে এখন তোকে হারাতে হবে আমার।আমি পারবো না তোকে ছাড়তে মিথি!তাই পরিস্থিতির সম্পর্কে বুঝেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।প্লিজজ তুই আমায় বাঁধা দিস না,নাহলে আমি তোকে হারিয়ে ফেলবো।
আমার চোখের পানি বৃষ্টির মতো ঝরেই যাচ্ছে।আমি আর মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে পারছি না। খুব ইচ্ছে হয় দৌড়ে গিয়ে দু’হাত দিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরি।আর কেঁদে কেঁদে বলি,
ভাইয়া,এতদিন আমায় কেনো বুঝনি, তুমি!।কিন্তু চাইলেও তা পারবো না।কারণ এখনো আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
ভাইয়াও নিজেকে আগলে রেখে চোখের পানি মুছেন।
হুট করে উনার টনক নাড়তেই উনি বুঝে ফেলেন আমি যে এখনো গাধার বেশে বাঁধা।
।উনি তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে এসে আমার দু’গাল চাপড়ে ধরেন।
-মিথি,তুই যে এতক্ষণ বাঁধা অবস্থায় ছিলি আমার মোটেও খেয়াল ছিল না।তড়িঘড়ি আমার হাত-পা বাঁধা দড়ি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমায় বুকের মধ্যে মিশিয়ে নেন।আর মলিন সুরে,
-এতটা দিন আমায় কেন কষ্ট দিয়েছিস তুই?একটুও কি আমার জন্যে তোর মায়া হয়নি?আমি যে তোর ভালোবাসার এতদিন ভিখারি ছিলাম!!৭ তারিখের পরই আমি তোকে আমার রানী করে নিয়ে যাব দূরে।কেউ আমাদের বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারবো না,পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
ভাইয়া এসব বলেন আরো বেশি তার দিকে আমায় মিশিয়ে নেন।আমার কেন জানি ভাইয়ার এই স্পর্শের ছোঁয়া আমার মনে অনুভূতি জাগাতে থাকে।আর সারাটা জনম এই বুকেই মাথা রেখে বাকিটা পথ কাটাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।।
হুট করে শরীরে ব্যথা অনুভব করতে থাকি।”আআআ”- করে চিৎকার দিতেই ভাইয়া তার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেন।আমার মুখটা উনার মুখের সামনে এনে বলেন,
-ভালবাসছি বেশি সেইজন্যে এই চিৎকার?!
উনার কথায় আমি লজ্জা পেয়ে যাই।আর পরক্ষনে মাথা নেড়ে মাথাটা নিচু করে আনি।
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-০৭
রোকসানা আক্তার
এখন রাত ৯ টা বেঁজে ৩০ মিনিট…
ভালোবেসে..যদি হাতটা ধরো ছেরে দেবো যে সবই।
কাছে এসে..যদি জড়িয়ে রাখো ভুলে যাবো যে পৃথিবী।
বুকের মাঝে চিনচিন করে, জানি নাতো এমন পুড়ে।
এভাবে আর দূরে থেকো না…
–
–
তোমাদ মাধে দুবি বাসি নিজের থ্যাকে আরু বেশি।ভালু-বাহসি কিনো বুদোনা।।।
লাস্টের লাইনটা শুনামাএই ধড়ফড়িয়ে উঠি।কান থেকে এয়ার ফোনটা সরিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি “তোমার মাঝে ডুবি ভাসি নিজের থেকে আরো বেশি,ভালোবাসি কেন বুঝনা”-এই লাইনটি কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর থেকে ভেসে আসছে।
কে গেয়েছে…বুঝে উঠতে না পেরে দরজার দিকে তাকাই। দরজার দিকে চোখ রাখতেই চোখদুটো আমার ছানাবড়া। দরজার সামনে এন্জিলা সিস্টার দাড়িয়ে আছেন।সিস্টার,ইউ??
উনি হেলেদুলে আমার কাছে আসেন আর বলেন,
-yeh,cuty.Now,you are surprised on me how i can sing the bengali song,righ??
(হুম,সুন্দরী।তুমি এখন আমার উপর বিস্ময় কিভাবে আমি বাংলা গান গাইতে পারি,রাইট??)
আমি এন্জিলা সিস্টারের কথায় কি ভেবে উওর দিব নিজেই বুঝতে পারছি না।তারপর, তোতলাতে তোতলাতে বলি,
-হু।
-you know how excited i am for Bangladesh!!. When i make friends with Niloy,i start to hear/see the bengali song from then.Besides , some songs commit to my memory although i don’t understand these song’s meaning. But,you have been hearing now that song at this moment,this song is my fvrt.
(তুমি জানো আমি বাংলাদেশের জন্যে কতটা উৎফুল্ল।যখন আমি নিলয়ের সাথে বন্ধুত্ব করি,তখন থেকেই আমি বাংলা গান শুনা/দেখা শুরু করি।তাছাড়া,কিছু গান মুখস্ত করা যদিও আমি এসব গানের অর্থ বুঝি না।কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি যে গানটি শুনতেছিলে,ওই গানটি আমার অনেক পছন্দের।)
-বুঝলাম,সিস্টার।তবে,আপনি হুটহাট এখানে।বুঝলাম না কিছু।
-Niloy sends me here to take away you with me.He is waiting for us out of building .Quickly, Mithila.No let in a moment too….
(নিলয় আমাকে এখানে পাঠিয়েছে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে।সে আমাদের জন্যে নিচে অপেক্ষা করছে।তাড়াতাড়ি, একমুহূর্তের জন্যেও দেরী নয়।)
-স-স-সিস্টার,আমি কিছু বুঝতেছি না।ভাইয়া এখ-এখানে….
এন্জিলা সিস্টার আমায় আর কিছু না বলতে দিয়ে আমার হাত টেনে বদ্ধ রুম থেকে নিচে নিয়ে আসেন।নিচে আসতেই নিলয় ভাইয়াকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমি দৌড়ে নিলয় ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলি,
-ভা-ভা-ভাইয়া, এসব কি হচ্ছে??
-মিথি এখন কথা বলার একদম সময় নেই।আমি যে প্ল্যান করেছি তা বিনে পানিতে গেল।আমি এখন বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। প্ল্যান ফেইলড,এংগেইজমেন্ট রিজেক্ট করতে পারিনি আমার একগুঁয়ে বাবার জন্যে ।আজ ১০ টার দিকে আমাদের এংগেইজমেন্ট এরেন্জ হওয়ার কথা ছিল।আর কালই আমাদের ফ্লাইট ডেট পড়ে গিয়েছে ভোর ৪টায়।তাই কোনে মতে দম খিঁচে বাহানা করে ঘর থেকে বের হয়ে এসছি।বাবা হয়তো বাড়ি দেখতে না পেয়ে এখন আমায় তন্নতন্ন করে খুঁজছেন।যে-করেই হোক তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে।
এ বলেই ভাইয়া আমার হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে গাড়ির মধ্যে উঠিয়ে ফেলেন।আমার কেন জানি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মন চায় মায়ের কাছে দৌড়ে চলে যাই।এতগুলো আপন মুখকে রেখে ভিনদেশে যাচ্ছি,ভাবতেই বুকের বাম পাজরে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হতে থাকে।চোখগুলো আমার মুহূর্তে পানিতে ভরে যায়।ভাইয়াকে অস্থিতিশীল মন বলতে চায়,ভাইয়া প্লিজজ আমরা বাংলাদেশেই থেকে যাই।দরকার হলে দু’জন যুদ্ধ করে ভালোবাসা জয় করে নিব।তবুও কাপুরুষের মতো করে নয় পালিয়ে নয়…।
কিন্তু এসব ভাবনা গলায় এসেই আঁটকে যায়।মন বলে ঠোঁট নড়ে না।ঠোঁট কেঁপে উঠে না এবার বলবেই,কিন্তু বলতে যেয়েও আর বলা হয়না।
নিজেকে দমিয়ে রেখে অনেক কষ্টে চুপসে থাকি।
তারপর আমাদের গাড়িটি একটি বিল্ডিং এর সামনে এসে থামে।গাড়ি থেকে নেমে ভালেভাবে এলক্ষ করে বিল্ডিংয়ের সাইন বোর্ডে তাকাই।সাইন বোর্ডে চোখ রাখতেই আমার পুরো গা শিরশির করে উঠে।এবার সত্যিই আমার চোখের পানি ঝড়ঝর বেয়ে পড়ে।কান্নার আড়মোড়া ভেঙ্গে ভাইয়াকে বলে উঠি,
-ভাইয়া,আমাকে কাজী অফিসে কেন নিয়ে আসলেন??
উনি হাত দিয়ে আমায় ইশারা করেন চুপচাপ থাকতে,আর কোনোরকম কথা না বলতে।পরে আর কি——–!!!
২৫ লাখ টাকার দেনমোহর ফাইলে সিগন্যাসার করে কবুল বলিয়ে আমাকে উনার বউ করে নেন।তারমানে আজ থেকে আমি নিলয় ভাইয়ার অর্ধাঙ্গিনী!!!!!
সত্যি একি স্বপ্ন নাকি বাস্তব!এখনো যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না।কখন আমি কবুল বললাম,আর কখনই বা সিগন্যাসার করলাম নিজের মাথায়ই বোধগম্য হচ্ছে না।আমি সন্দেহকে ক্লিয়ার করতে আমার হাতে একটা চিমটি কাটি।উফস,সত্যিই হাত চিনচিন ব্যথা করছে।তারমানে এটা কোনো স্বপ্ন নয় বাস্তব!!
আমি এখনো হতভম্ব যে স্বপ্নের রাজকুমার আজ বাস্তবে আমার জীবনে আসলো।এই জীবনে এসে কি উনি আমার জীবনটা ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ করে দিতে পারবে?নাকি সেই ফুলের মাঝে কাঁটার আঘাত সহ্য করা লাগবে।আমি কি কোনো ভুল করে ফেললাম?নাকি বেহুঁশে কবুল বলে ফেললাম।
এসব ভাবনার সবটাই যেন আমার স্বপ্নের জগৎ।আর আমি দিকে দিকে স্বপ্নগুলো দেখতেছি..।।।
-মিথি,চলো??
নিলয় ভাইয়ার হাতের স্পর্শেই আমার ধ্যান ফিরে আসে।আমি ভাইয়ার দিকে আড়নয়নে তাকিয়ে বলি,
-ভা-ভা-ভাইয়া,এ আমি ক-কি করে ফেললাম!?
-কিছুই করিস নি।তুই এখন থেকে জাস্ট অনলি নিলয়ের স্ত্রী এবং আমার অধিকারিণী, আমার প্রাণ….!!
এ বলে উনি আমার কোমর চেপে গাড়ির দিকে নিয়ে চলেন।গাড়ি আবার রান করেন।আমি এখন উনার সাথে সামনের সিটে বসা,আর উনি ড্রাইভিং সিটে।ঘুটঘুটে এই অন্ধকারের মাঝে নিরিবিলি গাড়িটি চলতে থাকে।।এন্জিলা সিস্টার পেছন থেকে কিছুক্ষণ পর পর হাঁক ছাড়েন।।
এই গভীর অন্ধকারের মাঝে আমার মনে নানান চিন্তাগুলো ঘুরপাক খায়।আমি কি ভুল কিছু করে ফেললাম?আচ্ছা,মা,বাবা,খালামণি,সাবিলা,আঙ্কেল সবার চোখের সামনে আমি কি এখন অপরাধী?
উনারা কি আমায় ক্ষমা করবেন??কিভাবে উনাদের এ মুখটা দেখাবো!!
এসব ভাবনার মাঝে নিলয় ভাইয়া আমার কাঁধে হাত রেখে উনার কাছে টেনে নেন,আর অন্যহাত দিয়ে ড্রাইভিং করেন।আমি এখনো আমার ভাবনায় মর্ত।
অতঃপর গাড়িটি ঢাকা এয়ারপোর্টের সামনে এসে থামে।নিলয় ভাইয়া আমার হাত ধরে নিচে নামায় এবং এন্জিলা সিস্টার ও নেমে পড়েন।আমি আন্দাজ করতে পারছি না এখন রাত আনুমানিক কয়টা বাজে।ভাইয়া উনার মোবাইলটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে কারো নাম্বার খুঁজতে থাকেন কল করতে।আমি এরফাঁকে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি,
-আচ্ছা এখন ক’টা বাজে??
ভাইয়া আমার দিকে চোখ দু’টে সরু করে আবার মোবাইলে স্কিনে তাকান।ছোট স্বর এনে বলেন
– ১ টা ৫ বাজে এখন।
হুট করে উনার এই চোখের চাহনি আমার মনে লজ্জার রেখা টানে।অতি রক্তিমতায় তড়িঘড়ি মাথাটা নিচু করে ফেলি।।কারণ,এই মুহূর্তে ভাইয়ার চোখে চোখ পড়া অপরাধী অনুভূতি।
কিছুক্ষণ পর আমাদের সামনে একজন লোক এসে উপস্থিত হয়।ভাইয়া উনাকে দেখামাএই এগিয়ে গিয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে তুলে দেন।বুঝতে আর সমস্যা হয়নি ভাইয়া গাড়িটা ভাড়া করে এনেছেন।আর ভাইয় বোধহয় ড্রাইভারকেই একটু আগে কল দিয়েছিলেন।
তারপর আমরা পার্শ্বস্ত একটা হোটেল থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে নিই।।আমার ডিনার করার একদম মোড ছিল না।নিলয় ভাইয়ার জোরের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেয়ে নিই।।
আমরা ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি।আর মাএ আড়াই ঘন্টা পর আমরা প্লেনে ল্যান্ডিং করছি।তবে আমার ভীষণ ভয় হতে থাকে কোনো অঘটন ঘটে যাবে নাতো!?
জানিনা বিধাতা একপালে কি লিখে রেখেছেন।এসব ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তে নিলয় ভাইয়ার দিকে আমার চোখ পড়ে।উনি আমার পাশেই বসে আছেন।আর উনার চোখদু’টে ফ্লোরের দিকে স্থিরভাবে তাকানো।বাল্বের ধবধবে আলোতে ভাইয়ার লাল চুলগুলো ঝকঝক করছে,মুখে একটা নিষ্পাপ ছাপ।উনাকে দেখে কেনজানি চোখগুলোকে আগলে রাখতে পারিনি,মুহূর্তে চোখের পানি টগবগ করে উঠে।সৃষ্টিকর্তা এই মানুষটিকে খুব যত্ন করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন!ছেলে মানুষ এত সুন্দর হয় কি’ভাবে মাথায়ই আসছে না।উনাকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে এখনো সুন্দর মানুষ আছে।যাদের লাবণ্য হাসি লক্ষটা হিরের সমান,যাদের চোখের চাহনি আকাশে ফুটন্ত তারার মৃদু আলো।এদের দেখলে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয়…
এসব ভাবতে ভাবতে চোখদুটো ঘোর হয়ে আসে।চোখদুটো তন্দ্রে তন্দ্রে যেন ঘুমের দেশে যেতে চাচ্ছে।কিছুক্ষণ পরপর আমি মাথাটা ছাটা দিয়ে উঠি,আর যখন চোখকে সামলাতে না পেরে ফ্লোরের পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, ওই মুহূর্তেই নিলয় ভাইয়া আমার মাথাটাকে টপকে ধরে ফেলেন এবং আলতোভাবে নিজের কাঁধে এলিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।এই প্রথম কোনো স্বামীর পরম আদরের পরশ অনুভব করতে পারছি।
আমি উনার আদরের নেশায় আরো ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই।একটা মুহূর্তে ঘুমিয়েই পড়ি।।
হঠাৎ কারো শোরগোলের আওয়াজ কানে বাজতেই কাঁচা ঘুমটা আমার ভেঙ্গে যায়।চোখদুটো কচলাতে কচলাতে সামনে তাকাতেই আমার অস্তিত্ত্ব এই মুহূর্তে বিলীন।কিছু যে বলবো মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না।কারণ,এখন আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন আমার মা,আঙ্কেল(নিলয় ভাইয়ার বাবা) এবং সাবিলার মম!!
নিলয় ভাইয়া মাথাটা নিচু করে উনার বাবার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা শুনছে আর গিলছে।এন্জিলা সিস্টার সবাইকে বুঝাতে যেয়েও পেরে উঠতে পারছে না।
নিলয় ভাইয়ার বাবা এন্জিলা সিস্টারকে তেড়ে বলে উঠেন,
-You get lost!!তোমার কারণেই সব হয়েছে!!তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ থেকে চলে যাও।আর নেক্সট বার যেন এদেশের মাটিতে না দেখি…!!!
-please auncle,you have some mistaken..
-No,you stop,,,,i don’t want to hear from you in this matter ….
এন্জিলা সিস্টারের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।যদিও কেউ তা পরক্ষ করতে পারছে না,কিন্তু আমার চোখ মোটেও ভুল দেখে নি।
-শাপলা আপা(আমার মা),তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।আর নিলয়?তুই আমার সঙ্গে বাড়ি চল!!!
-ব-ব-ব্বাহ, তুমি এসব কি বলতেছ??মিথিলা আমার এখন বিবাহিতা স্ত্রী!!আমি ওকে ছাড়া যেতে পারবো না,স্যরি!!
-নিলয়???তুই আমার উপর কথা বলার সাহস পেলি কথেকে??যেটা বলছি সেটা কর,নাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে দিলাম।
-বাবা,এসব বললেই হয়?ওকে আমি বিয়ে করেছি। আর বিয়ের পর খামখেয়ালি কথা যায়না।এখন আমার উপর ওর এবং ওর উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
-এধরনের বিয়ে ছেলেখেলা।ডিভোর্স হয়ে গেলেই ওকে।তা তুই আমাকে বুঝাতে হবে না।কারণ,তুই আমার আগে পৃথিবীতে আসিস নি!
আমি মাথানিচু করে কাঁদি, আর এন্জিলা সিস্টারের দিকে তাকাই।এন্জিলা সিস্টারও আমার দিকে তাকিয়ে উদাস মনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন।আজ আমরা বাঁক প্রতিবন্ধী।আমাদের বাঁক স্বাধীনতা কেউ যেন হরণ করে নিয়েছে।
এরই মধ্যে ফ্লাইট ঘোষনার ভয়েস ভেসে আসে।এন্জিলা সিস্টার ওদিকে একবার তাকিয়ে আবার আমাদের দিকে চোখ রাখেন।আমি এন্জিলা সিস্টারকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই,
-সিস্টার তুমি চলে যাও।টাইম একদম শর্ট।আর দেরী করো না।প্লিজজ,লেটস গো..??
এন্জিলা সিস্টার তারপরও অনড় দাড়িয়ে আছেন।অপেক্ষা করছেন আমরাও যদি তারসাথে যেতে পারতাম?নিলয় ভাইয়া উনার বাবার হট্রগোলের মধ্যে এন্জিলা সিস্টারের উদ্দেশ্যে বলেন,
-এন্জিলা?গো কুইকলি,নো লেট।প্লিজজ, ডোন্ট ওয়েট ফর আস।আওয়ার হেড ইজ ব্যাড লাক।
যদি কখনো বেঁচে থাকি দেখা হবে…
আমিও চোখের ইশারা করি চলে যাও সিস্টার…এন্জিলা সিস্টার মুখে একটা কান্নাভাব এনে পা গুলোকে হালকা পিছু হটে চোখের পানি মুছে মাথা ঘুরিয়ে ল্যাগেজ নিয়ে দৌড়ে চলে যান।হয়তো,এই কষ্টের মুহূর্তটা উনি আর নিতে পারছেন না।
আর আমার মা আমাকে টেনে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।আমি নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠি “ভাইয়া” হাতদুটো বাড়িয়ে দিই।তারপরও ভাইয়ার নাগাল পাইনি।ভাইয়াকে আঙ্কেল আঁকড়ে ধরে রাখছেন,আর মা আমায় বাড়ি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে তুলে ফেললেন।।
চলবে….