#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৭তম_পর্ব
দিগন্তের কথার ভোল সন্দীহান ঠেকলো। ধারাকে ঠেস মেরে যখন কথাটা বললো, তখন ই বন্ধুমহলের উত্তেজনা বাড়লো। ধারার ভ্রু কুচকে এলো, শান্ত কন্ঠে বললো,
“দিগন্ত তোর এই কথাগুলো সত্যি আমরা বুঝছি না। যা বলার বলেই ফেল না, অহেতুক কথা প্যাচাচ্ছিস কেনো?”
“আমি প্যাচাচ্ছি নাকি তুই রীতিমতো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস! তোর মিস্ট্রি বরটি যে অনল স্যার সেটা বলতে কিসের আপত্তি বলতো!”
দিগন্তের আকস্মিক উক্তিতে কিছুটা হলেও তাজ্জব বনে যায় ধারা। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। উপরন্তু সকলের দৃষ্টি ধারার দিকে। করিডোরে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি ধারার দিকে। তাদের মাঝে গুঞ্জন উঠেছে। এতো বড় খবরটি যে কোনো বি’স্ফা’র’কের চেয়ে কম নয়। ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে,
“ঠিক শুনলি! ধারার বিয়ে হয়ে গেছে?”
“তাই তো শুনছি! তাও আবার অনল স্যার। অনল স্যার নাকি ধারার হাসবেন্ড!”
“থাম শুনতে দে”
ধারার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতোকালের সুপ্ত সত্যিটা আকস্মিকভাবে সকলের সামনে আসবে এটা কল্পনাও করে নি ধারা। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন দিগন্ত এই সত্যটি জানলো কি করে! বন্ধুমহলে মাহি ব্যাতীত এই খবরটি কেউ জানে না। ধারা মাহির দিকে আড়চোখে চাইলো, মাহি ডান বামে ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে “না” বুঝালো। দিগন্ত ব্যাপারটি লক্ষ্য করতেই বললো,
“ওর দিকে তাকাচ্ছিস কেনো? মাহি আমাকে বলে নি”
কথাটা বলেই সে তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে ধারার চোখে সামনে ধরলো। ছবিটি অনল এবং ধারার। ধারা অনলের বাইকের পেছনে বসে রয়েছে। অনলের কোমড় জড়িয়ে কাধে থুতনি ঠেকিয়ে রেখেছে সে। ছবিটি কিছুদিন পূর্বের। এই পরীক্ষার সময়কালীন যেদিন অনলের গার্ড ছিলো না সেদিন সে ধারাকে নিতে এসেছিলো। যথারীতি ভার্সিটি গেট থেকে বহুদূরেই দাঁড়িয়েছিলো অনলের বাইক। ধারা বরাবরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের বরের পেছনে বসেছিলো। কিন্তু ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলা! দিগন্তের নজরেই পড়লো সেই প্রেমঘন দৃশ্য। দিগন্ত ছবিটি দেখিয়ে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“কি ধারা! আমি কি মিথ্যে কথা বলছি! অনল স্যার ই তো তোর হাসবেন্ড তাই না? এখন প্লিজ বলিস না সে তোর কাজিন, কারণ তুই যে তোর কাজিনের সাথে এতোটা ঘনিষ্ঠভাবে বসবি না সেটা কেউ না জানুক আমি জানি”
“আমি কি বলেছি তুই মিথ্যে বলেছিস?”
কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে উঠলো ধারা। দিগন্ত ভেবেছিলো ধারা হয়তো উত্তর দিবে না। কিন্তু তার ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করলো ধারা। বরং তার মুখোভাব বদলালো, এতোসময়ের শান্ত, অসহায় ঘুঘুটি যেনো হুট করেই কঠিন, হিং’স্র বাঘিনী হয়ে উঠলো। ধারা মুখ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“তারপর বললো, হ্যা অনল স্যার আমার হাসবেন্ড। তো এতে কোন মহাভারতটি অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে শুনি?”
“আমাদের থেকে লুকোনোর কি মানে?”
“আমার জীবনের সব কিছু কি তোদের বলতে হবে? কেনো রে, আমার পার্সোনাল লাইফ নেই! যখন আমি লুকিয়েছি তার মানে আমার কিছু কারণ ছিলো। সময় হলে ঠিক বলতাম। কিন্তু তোর তো সহ্য হয় না, সব খবর প্রয়োজন। শান্তি হয়েছে আমাকে ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে? এখন সকলের মুখে মুখে আমি আর অনল স্যারের বিয়ের চর্চা হবে। খুশী তো তুই?”
“সত্য তো ফাঁস হবার ই ছিলো। এখন এটা নিয়ে আলোচনা হবে না সমালোচনা সেটা নিয়ে এতো চিন্তা করছিস কেনো তুই? নাকি তোর ভয়টা অন্য জায়গায়! যে মানুষ এটা নিয়ে আলোচনা করবে, তুই শুধু মার্ক পাবার লোভে অনল স্যারকে বিয়ে করেছিস! বা তার স্ট্যাটাসের জন্য তাকে ফাঁসিয়েছিস! অথবা তোর অনল স্যারের পার্শিয়ালিটি নিয়ে মানুষ সমালোচনা করবে! এটাও বলতে পারে, যে পরীক্ষার আগে সে তোকে পুরো প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়েছে। নয়তো যে ধারা ক্লাস এসেসমেন্ট ৩০ এ ৩ পায় সেই ধারা কিনা ১০০ মার্কে এতো ভালো পরীক্ষা দেয়”
দিগন্তের কথাগুলো বিষাক্ত সুই এর মতো চুবছে ধারার হৃদয়ে। দিগন্তের স্বভাব যেমন ই হোক কিন্তু তার থেকে এমন বিষাক্ত কথা কখনোই কল্পনা করে নি ধারা। সে যেমন ই হোক, বন্ধু হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এই দিগন্তকে যেনো বিচিত্র লাগলো ধারার কাছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন, আলাদা। তবে কি এতোকাল মানুষ চিনতে ভুল করেছে সে। ধারা কিছুসময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দিগন্তের মুখোভাবের পরিবর্তন হলো না। তার মনে দ্বিধাবোধ কিংবা গ্লানির ছিটেফোঁটাও নেই। বান্ধবীকে নির্দ্বিধায় কটুক্তি বলে গেলো সে। এটাই বন্ধুত্ব! এর মাঝেই নীরব তীব্র স্বরে বলে উঠলো,
“দিগন্ত, তুই লাইন ক্রস করছিস। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে সিন ক্রিয়েটের মানে নেই। তুই ইমোশনালি হার্ট হয়েছিস বলে ধারাকেও হার্ট করবি এটা অন্যায়। তার পার্সোনাল লাইফ, সে আমাদের শেয়ার করবে কি না, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের এর মধ্যে নাক গলানোটা অহেতুক”
“নীরবের সাথে আমি একমত, দিগন্ত তুই বাড়াবাড়ি করছিস”
নীরবের সাথে তাল মেলালো অভীক। দিগন্ত এতেও ক্ষান্ত হলো না, সে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“তাই বুঝি? আমি বাড়াবাড়ি করছি! আর এদিকে আমাদের ধারারাণী তার বরের বদৌলতে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করছে সেটা কারোর নজরে পড়লো না। আচ্ছা ও কি তোদের বলেছে কি কি প্রশ্ন আসবে? বলে নি! কিন্তু ও তো ঠিক ই জানতো! বর তার বউ কে জানাবে না এটা হয়? আসলে ও কেনো বলে নি জানিস? যেনো আমরা ভালো না করি। আর খাতাও ওর বর ই দেখবে, সেই ফাঁকে ধারার নাম্বার ও ভালো আসবে। রেজাল্ট দিক, যা বলছি সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই না ধারা!”
কথাটা শেষ না হতেই দিগন্তের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো ধারা। এতো সময় চুপ করে তার আজেবাজে কথাগুলো শুনছিলো সে। কিন্তু আর নিজেকে সংযত রাখা সম্ভব হলো না। নিজের সম্পর্কে বললে হয়তো এতো গায়ে মাখাতো না, হেসে উঁড়িয়ে দিতো। কিন্তু যার সম্পর্কে বলছে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন করাটা অনর্থক। ধারা জানে মানুষটি কতটা পরিশ্রমী, কতটা সৎ৷ ধ্যা, অনল প্রশ্ন করলেও ধারা সেই প্রশ্নের এক বিন্দুও চোখে দেখে নি। অনল তাকে পড়ার উপর রেখেছে, দিন রাত তাকে দিয়ে পরিশ্রম করিয়েছে। কিন্তু কখনো অসদুপায় অবলম্বন করে নি। সর্বদা সে নিজের পেশা এবং পারিবারিক জীবনকে পৃথক রাখে। সুতরাং যখন কেউ অনলের সততা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখন সহ্য হয় না ধারার। ধারার আকস্মিক চ’ড়ে বিস্মিত হয়ে যায় দিগন্ত। তটস্থ চাহনীতে তাকায় সে ধারার দিকে। ধারার কঠিন, ক্ষুদ্ধ চাহনীতে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। ধারা আর চুপ করে রইলো না, কড়া কন্ঠে বললো,
“অনেক বলেছিস আর না, আমি শুনেছি তবে আর না। অনল স্যারের সততার উপর তুই প্রশ্ন তুললে তো আমি চুপ করে থাকবো না। মানলাম না হয় অনল স্যার প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু আমরা সবাই জানি প্রশ্ন মডারেট হয়। এটা কি ভুল বললাম? আর একটা মানুষ এসেসমেন্টে ৩ পেয়েছে বিধায় সে ভালো পরীক্ষা দিতে পারবে না এটা কেমন যুক্তি? তুই ও তো ৪ পেয়েছিলি, অভীক ও। তোরা কি খারাপ পরীক্ষা দিয়েছিস? কারণ উনি আমাদের পড়িয়েছে। উনার পরীক্ষা কেউ খারাপ দেয় নি। আর যদি আমি ভালোও করি তবে সেটা আমার কষ্টের জন্য, আমি পড়েছি তাই। অনল স্যার আমাকে প্রশ্ন আউট করে দিয়েছে বলে নয়। আজ প্রথম বার মনে হচ্ছে আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। লজ্জা করছে তোকে বন্ধু ভেবেছি। তোর আমার উপর ক্ষোভ থাকলে আমাকে বলতি, এভাবে সবার সামনে অনল স্যারের সততা নিয়ে কেনো কথা বললি? এতোকাল তোর এই মানুষের জীবনের কথা পাচারটাকে আমরা বিনোদন হিসেবে নিতাম। আজ প্রথম নিজেকে সেই পর্যায়ে দেখে বুঝছি ব্যাপারটা কতোটা বিরক্তিকর, অপমানজনক”
ধারা এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। সে হনহন করে হেটে চলে গেলো। মাহিও পিছু নিলো। দিগন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ধারা চলে যাবার পর শিক্ষার্থীর ভিড় একটু হলেও কমলো, নীরব এবং অভীক গেলো না। ভিড় কমতেই নীরব শান্ত কন্ঠে বললো,
“অনল স্যারকে তোর অপছন্দ বলে এভাবে ধারাকে কষ্ট না দিলেও পারতি। যদি এটাকে ভালোবাসা বলে তবে আমি বলবো তুই ভালোবাসা কি জানিস না। আমি জানি তুই কষ্ট পাচ্ছিস, কিন্তু তাই বলে তোর আজকের ব্যাবহারটা মানতে পারলাম না৷ ধারা লুকিয়েছে কারণ সে আমাদের ভার্সিটির রুলস জানে। আমাদের টিচাররা আত্নীয়দের ক্লাস নিতে পারে না। হয়তো অনল স্যার এবং ধারার বিয়েটা সে কারণেই লুকানো। তুই না জেনে অহেতুক যা তা বললি! এটা কি মানা যায়? আমি সত্যি তোর উপর হতাশ। এখন আমাদের বন্ধুমহল ভাঙ্গলে দায়ী থাকবি তুই”
বলেই প্রস্থান নিলো নীরব, অভীক ও তার পিছু নিলো। শূন্য করিডোরে দাঁড়িয়ে রইলো দিগন্ত। সত্যি কি রাগ, ক্রোধে সীমা অতিক্রম করলো সে!! এই বন্ধুত্ব কি আর থাকবে না?
******
কৃষ্ণাচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। পড়ন্ত বিকেলের ঈষৎ কমলা আঁছড়ে পড়ছে ধারার কঠিন মুখশ্রীতে। তার ঠোঁটের উপরে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঈষৎ কাঁপছে শরীর। এখনো দিগন্তের রাগ কমে নি। মাহি তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে শান্ত হতে বলার ও ভাষা নেই, দিগন্তের কাছে সেও বিরক্ত। মাহি একটু রয়ে সয়ে বললো,
“তুই বাড়ি যাবি না?”
“যাবো, একটু পর”
এর মাঝেই অনলের আগমন ঘটে। সে এবং প্লাবণ হেসে হেসে আসছিলো৷ কৃষ্ণাচূড়া গাছের নিচে ধারাকে দেখতেই থমকে গেলো সে। ধারার মুখখানা স্বাভাবিক লাগছে না। প্রচন্ড রেগে রয়েছে সে। তার চোখগুলো রক্তিম হয়ে রয়েছে। আশপাশ টা ফাঁকা বিধায় অনল এগিয়ে গেলো। কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
“কি হয়ছে? তোকে এমন লাগছে কেনো?”
প্রশ্নের উত্তর দিলো না ধারা। তার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অনলের প্রশ্নের উত্তরটা দিলো মাহি। একটু রয়ে সয়ে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে ঘটিত সকল ঘটনা বর্ণনা করলো। অনল কিছুসময় চুপ করে রইলো। তারপর ধারার মাথায় আলতো করে হাত রেখে নরম গলায় বলে,
“আমি সামলে নিবো, চিন্তা করিস না”
অনলের নরম কন্ঠের স্বান্তনা যথেষ্ট ছিলো ধারার ক্রোধকে বাস্পায়িত করার জন্য। মানুষটা নিজেও জানে কি ঝড় অপেক্ষা করছে তার জন্য তবুও সে ধারাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। আশ্বাস দিচ্ছে “কিছু হবে না”। ধারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“আমি এখন বাসায় যাবো, আমার মাথা ব্যাথা করছে। তুমি আমাকে বাসায় নিয়ে যাও।”
অনল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর তার হাতখানা নিজের বলিষ্ট হাতের ফাকে পুড়লো। পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।
বাড়ি পৌছাতে সন্ধ্যে হলো। আজ বাইক না থাকায় অনল এবং ধারা রিক্সাতেই বাড়ি ফিরলো। ধারার মন খারাপ বিধায় তাকে সরাসরি বাড়ি না এনে রিক্সা ভ্রমণ করলো তারা। ইট পাথরের ঢাকা শহরে রিক্সা নিয়ে ঘোরাটা বড্ড বিচিত্র। দশমিনিটের দূরত্বে সময় ব্যয় হয় আধা ঘন্টা। ধারা এবং অনলের ক্ষেত্রেও তাই হলো। এক রিক্সাভ্রমণে হলো সন্ধ্যে। এর পর শুরু হলো আষাঢ়িয়া বৃষ্টি। শীতল বৃষ্টিতে ভিজলো সারা শহর। রিক্সার পর্দা না থাকায় ভিজলো দুজন ই। অনল তার আর্টিফিশিয়াল লেদার ব্যাগ দিয়ে ধারাকে ভেজা থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না ঠিক। ভিজলো ধারা নির্বিশেষে। অনলের বাচ্চামো কাজে হাসি পেলেও ধারা কিছুই বললো না। শুধু অপলক নজরে দেখে গেলো তার প্রণয়নকে। কাকভেজা হয়ে বাড়ি ভিড়তেই দরজা খুলে দিলেন সুভাসিনী বেগম। তার মুখ থমথমে। অনল কারণ শুধাতেই তিনি বললেন,
“সেলিম ভাই এসেছেন”……….#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৮তম_পর্ব
কাকভেজা হয়ে বাড়ি ভিড়তেই দরজা খুলে দিলেন সুভাসিনী বেগম। তার মুখ থমথমে। অনল কারণ শুধাতেই তিনি বললেন,
“সেলিম ভাই এসেছেন”
সুভাসিনীর কথাটা বজ্রপাতের ন্যায় ঠেকলো ধারার কাছে। এই নামটি তার অতি অপছন্দের একটি নাম। নামটি যখন ই কর্ণপাত হয়, মনের অন্তস্থলটা ঘৃণায় তিতকুটে হয়ে উঠে। আজ ও তার অন্যথা হলো না৷ অনল জুতো খুলতে খুলতে বললো,
“দাদাজান কোথায়?”
“উনাকে, তোর বাবা সামলে রেখেছেন। তোরা ভেতরে আয়”
অনল ভেতাজুতোখানা এক পাশে রাখলো। তারপর আড়চোখে তাকালো ধারার পানে। তার মুখশ্রী কঠিন, বিরক্তির সূক্ষ্ণ ছাপ দেখা যাচ্ছে৷ আর যেটা স্পষ্ট তা হলো, বিষাদের নীল প্রতিচ্ছবি। বাবার প্রতি তার অনুভূতি গুলো বরাবর ই শীতল। সেলিম সাহেব তাকে ফোন দিলে সে থাকতো উদাসীন কিংবা চিঠি পাঠালে কখনো উত্তর দেবার চেষ্টা করে নি। সুতরাং সেই মানুষটাকে হুট করে বছরখানেক বাদে সামনে দেখলে তার প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হবে বুঝে উঠতে পারছে না অনল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা কোমল হাতখানা আকড়ে ধরলো। তার শীতল হাতের স্পর্শ পেতেই ভাবনার জোয়ার থামলো ধারার। পাশ ফিরতেই অনল নরম গলায় বললো,
“আমি আছি। চিন্তা করিস না। শ্বশুর আব্বার সাথে তো দেখা হতেই হতো”
ধারা না চাইতেও নিস্প্রভ হাসি হাসলো। তারপর ভেতরে গেলো তারা।
বসার ঘরের সোফায় কালো স্ট্রাইপ শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরিহিত মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ বসে আছেন। তার বয়সটি পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মুখে মাঝারি গোঁফ, বেশ ঘন কাঁচা, পাকা দাঁড়ি। চোখের দৃষ্টি ক্ষীন হয়তো, কারণ সোনালী রঙ্গের মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে আছে সে। তার মুখ গম্ভীর, চোখের দৃষ্টি ধারালো। ধারার নিজ বাবাকে চিনতে বেশ কষ্ট ই হলো। শেষ বাবাকে দেখেছিলো যখন মা মারা গিয়েছিলো। এর পর থেকে ধারার এই নামমাত্র বাবার দর্শন হয় নি। ধারাকে দেখামাত্র সেলিম সাহেবের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। তার চোখজোড়া চকচক করছে তের বছর বাদে মেয়েকে দেখে। কিন্তু ধারার প্রতিক্রিয়া শান্ত। সে দেখছে সেলিম সাহেবের পাশে বসা সুন্দরী নারীটিকে। মুখশ্রীতে বাঙ্গালীর ছাপ থাকলেও তার পোশাক আশাকে বাঙ্গালীর ছিটে ফোটা নেই। বেশ একটি নীল শার্ট এবং একটি নিকষকালো জিন্স পরিধান করেছে সে। মুখে জৌলুশপূর্ণ হাসি। বয়স চল্লিশোর্ধ্ব হলেও মুখে বয়সের ছাপ নেই। মহিলাটিকে চিনতে কষ্ট হলো না ধারার। তার নাম রোকসানা। মহিলাটি এক সময় তার বাবার প্রেমিকা ছিলো। মায়ের মৃত্যুর পূর্বে তারা বিয়ে করেন। ধারাকে দেখতেই নরম আদুরে কন্ঠে রোকসানা বলে উঠলো,
“ধারা কেমন আছো?”
ধারা কাঠ কন্ঠে সালাম দিলো। তারপর অনলের পাশের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। সেলিম সাহেব বললেন ও একবার,
“আমার পাশে এসে বয় মা”
কিন্তু ধারা রইলো নির্বিকার। তার হেলদোল হলো না। জামাল সাহেব, রাজ্জাক এবং ইলিয়াস একটি সোফায় বসে আছে। জামাল সাহেবকে রাজ্জাক শান্ত থাকার অনুরোধ করেছেন। জামাল সাহেব নিজেও জানেন তার শরীরটি ভালো নেই। তাই তিনিও নিজের ক্রোধ সংবরণ করে রাখলেন। তিনি ধারার আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন। যাকে নিয়ে বৈঠক সে থাকাটি আবশ্যক। তাই মৌণতা ভাঙ্গলেন৷ রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“সেলিম, তোমার আসবার কারণডা খোলশা করো। তোমারে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। ডাক্তার কইছে সেই সব অপদার্থ থেকে দূরে থাকতে”
“দেখুন আব্বা..”
“আমার মেয়ে মইরা গেছে, আর তোমারে তার স্বামী হিসেবে আমি মানি না। তাই আমি তোমার আব্বা না। তোমার আব্বা তোমার মতো একটা অপদার্থরে আমার মেয়ের গলায় ঝুলায়ে দিয়ে মইরা গেছে। ওরে আমি কোনোদিন মাফ করুম না।”
“বেশ, জামাল কাকা আমি জানি আপনি আমার উপর ক্ষিপ্ত। হবার কারণ ও আছে। কিন্তু সেই শোধটি আমার মেয়ের উপর দিয়ে নিলে তো আমি মানবো না। আমার মেয়ের বিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে হবে সেটা আমি কিভাবে সহ্য করবো? এই বিয়ে আমি মানি না। আমি আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। সেখানেই ধারার বিয়ে হবে”
সেলিম সাহেব কাঠকাঠ কন্ঠে কথাটা বললেন৷ তার উত্তরে ইলিয়াস বলে উঠলো,
“এতোকাল মেয়েটিকে আমরা পেলেছি সুতরাং তার ভালোমন্দটাও আমাদের দেখতে দিন সেলিম ভাই। আমার বোন আর বোনঝি কে রেখে যখন এই মহিলার সাথে আপনি সুখের দিন কাটাচ্ছিলেন তখন ই সেই অধিকার হারিয়েছেন। এখন বাবা বলে বড়াই করতে আসবেন না। আমরা মানবো না। আর আমাদের অনল কম কিসে! আমাদের মেয়েকে অনেক সুখে রাখছে।”
“ইলিয়াস, মেয়েটি আমার। যতই যাই করো তার পিতার স্থানে আমি ই থাকবো। সুতরাং তার ভালোমন্দটি দেখার দায়িত্ব ও আমার। আর ভুলে যেও না, আমি আমার মেয়েকে ভুলি নি। তোমরা জোর করে তাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছো। সে তো আমার ভালো স্বভাব, কোনো কেস করি নি। ভেবেছি, মেয়ের খুশিতে আমার খুশি”
“তাহলে এবারো তাই ভেবে নাও, তোমার মেয়ে সুখে আছে”
সেলিম সাহেবের কথা শেষ না হতেই রাজ্জাক সাহেব বলে উঠলেন। সেলিম সাহেবের চোখ কুচকে গেলো। তিনি ধারার দিকে আড়চোখে তাকালেন। ধারা তখন ও অনলের হাত আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেলিম মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন,
“ও বাচ্চা মানুষ। ও কি ভালো মন্দ বুঝে। এখন উঠতি বয়স। এখন তো সব ই ভালো লাগে। আমার ও এই বয়সে কত কিছু ভালো লাগতো। সুরাইয়া আর আমার বিয়েটাও তো এভাবেই দিয়েছিলেন আপনারা। লাভ টা কি হলো! কি জামাল কাকা! আমরা কেউ সুখী হলাম না। আর যাই হোক জোর করে সম্পর্ক টানা যায় না। একটা সময় সেটা নষ্ট হয়েই যায়। হয়তো ক্ষণিকের ভালোলাগা কাজ করে কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না। অনল এবং ধারার ক্ষেত্রেও তাই হবে”
“তুমি চুপ করবা? তোমার নষ্টামিরে এখন আমাদের মাথায় চাপাইতাছো? তোমারে কেউ জোর করে নাই! আমার মাইয়ারে যদি ভালো নাই বাসছিলা ছাইড়ে দিলা না ক্যান। ক্যান তারে তিলে তিলে মা’র’ছো? মাইয়াডা আমার কি কষ্টটা পাইছে। তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শেষমেশ আমাদের ছাইড়্যা চইল্যা গেছে। তোমার একখান চিঠির জন্য বইয়্যা থাকতো। তুমি তো জানতা সে অসুস্থ জানতা না? আরে নিষ্ঠুর, মাইনশ্যে তো কুকুরের লগে থাকলেও একটু মায়া জন্মায়। আমার মাইয়্যাডার লগে তুমি দশটা বছর এক সাথে ছিলা। মিথ্যা, মিথ্যি ফোন করতা। তুমি সেটা করো নি। তোমার জন্য কি কি না সইছে সে! তুমি বিদেশে যাইব্যা বইলে নিজের বিয়ের গয়না বেঁইছে দিলো। তুমি জানতা, ওই সময় মাত্র ওর বাচ্চাডা নষ্ট হইয়া গেছে। ওর মাথা খারাপ খারাপ অবস্থা, ধারাডা ছোট। তাও অমানুষ তুমি, তুমি না তুই। তুই ওরে ছাইড়ে বিদেশ গেলি। কি কইলি তুই এক বচ্ছরে ওদের লয়ে যাবি। হ আইলি ঠিক, আমার মাইয়া মরার পর। তাও এই লজ্জাহীন মহিলারে লইয়ে। তুই আমারে শিখাবি সম্পর্ক কেমনে কাটে? তুই? আরে তুই জানোস কিছু! এখন আমার নাতিনরে লইতে আইসো। শোনো হইতে পারো তুমি অনকে বড়লোক কিন্তু আমার নাতিন এখন অনলের বউ। তাই আমার নাতিনরে নিতে চাইলেও আমার নাতবউরে লইতে পারবা না”
জামাল সাহেব চোখ মুছলেন। তার কন্ঠ কাঁপছে। এতোকালের জমা ক্ষোভ তিনি সেলিমের উপর বর্ষণ করলেন। মনটা এখন একটু হলেও হালকা। সেলিম এতো সময় চুপ করে রইলেন। কথাগুলো ভুল নয়। ওই সুরাইয়া না থাকলে তার পক্ষে কিছুই সম্ভব হতো না। মেয়েটা সত্যি অন্যরকম ছিলো। কিন্তু মেয়েটি ছিলো অল্পশিক্ষিত, পড়াশোনা বেশি ছিলো না। খুব একটা সামাজিক ও ছিলো না। ব্যাপারটা তখন কাঁটার মতো লাগতো সেলিম সাহেবের। কিন্তু এখন আফসোস হয়। ভালো স্ত্রী হতে হয়তো এগুলোর কিছুই দরকার হয় না। রোকসানার সাথে থাকতে থাকতে সে বুঝেছে সুরাইয়া তার জন্য কতোটা মূল্যবান ছিলো। মেয়েকেও তাই অসামান্য ভালোবাসে সে। হয়তো সেটা দেখাবার সুযোগ পায় নি। বৃদ্ধ শ্বশুরটির সাথেও ছত্রিশের আখড়া বেধে রয়েছে। তাই তো তাকে না জানিয়েই ধারার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন এই বৃদ্ধ। ফলে প্রচন্ড ক্ষোভ হয় তার, আঁতে ঘা লাগে। সুতরাং সেলিম সাহেব ও হার মানবার পাত্রটি নয়। শ্বশুরের সামনে তো নয় ই। স্মিত হেসে বললো,
“আপনি তো আপনার কথাটা বললেন, এবার আমি বলি! আমার মেয়েটির এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র আসে নি। তার জন্মসনদে আপনার বড় ছেলে অতি বুদ্ধিমত্তা দেখাতে বয়স কমিয়ে রেখেছে। তার সনদ অনুযায়ী বয়স সতেরো বছর আট মাস। সুতরাং আমার মেয়ের বয়স উনিশ হলেও সে আইনের চোখে নাবালিকা। এই বিয়েটি বাল্য বিবাহ। কোর্ট প্রমাণ চায়। আমার কাছে প্রমাণ আছে। তাই আমি আপনাদের কোর্ট অবধি টানতে পারি। আর তখন আপনার নাতিটি থাকবে জেলে৷ এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের। আসছি আজকে”
বলেই উঠে দাঁড়ালেন সেলিম সাহেব। জামাল সাহেব রাগে গজগজ করছেন। এদিকে রোকসানা লোক দেখানো আদর করতে এগিয়ে গেলো ধারার দিকে। কিন্তু ধারার শীতলতা তাকে মাঝপথে আটকে দিলো। সেলিম সাহেব যেতে ধরলে অনল নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
“এজন্যই বুঝি দীপ্তকে পাঠিয়েছিলেন? যাতে মেয়ের সকল খবর নিতে পারেন! ভালো বুদ্ধি ছিলো। কিন্তু কি ফুপা, বাবার অধিকার জমাতে হলে বাবা হতে হয়। আর আপনি সেটা নন। নিতান্ত স্বার্থপর মানুষ আপনি। সুতরাং এসব ভয় দেখাবেন না। চার মাস, এরপর কি করবেন? এর পর ধারা আইনের চোখে একজন এডাল্ট। তখন কি এইসব যুক্তি খাটবে?”
“অনেক বর হয়ে গেছো। শেষ দেখেছি, ছোট ছিলে। ছুটে এসে চকলেট চেতে। এখন আমাকে যুক্তি দেখাচ্ছো। ভালো, দাদার মতোই হয়েছো। কিন্তু আমিও মানুষটা ভালো না। তাই আমাকে চ্যালেঞ্জ দিও না। অস্ট্রেলিয়ায় থেকে মেয়ের সকল খোঁজ নিতে পারলে তাকে নিজের কাছে কিভাবে আনতে হয় সেটাও জানি”
“সেটা নাহয় সময় বলুক”
সেলিম সাহেব আর অপেক্ষা করলেন না। রোকসানাকে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। তার বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে জামাল সাহেব রাজ্জাককে ঝাঁঝিয়ে বললেন,
“এই গা’ধা’র বাচ্চা গা’ধা, তোরে কে কইছিলো ধারার বয়স কমাইতে? ব’ল’দ কোথাকার একটা”
“আব্বা, আমি কি জানতাম নাকি সেলিম ভাই এই সুতো ধরবে! ধারারে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় মাস্টার বললো, বয়স কমাতে। নাকি সরকারি চাকরিতে অনেক কাজে দিবে”
“হ, দিছে খুব। আ’হা’ম্মক কোথাকার। কথা কবি না আমার সাথে”
জামাল সাহেবকে কিঞ্চিত ভীত মনে হলো অনলকে। এই প্রথম তিনি ভয় পাচ্ছেন, সেলিম সাহেবের কথায় যুক্তি আছে। উপরন্তু আইনগত ধারা এবং অনলের বিয়েটা হয় নি। ধারার বয়স কম বিধায় ধার্মিকভাবেই বিয়েটা হয়েছিলো। রেজিট্রি করাটা এখনো বাকি। জামাল সাহেব ভেবেছিলেন সময় হলে অনল এবং ধারার ধুমধাম করে বিয়েটা দিবেন। কিন্তু আগেই সেলিমের আগমন হলো। সুতরাং একটা ঝামেলা বাধাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। অনল তবুও হাল ছাড়লো না। কারণ ধারা এবং তার মনের মেলবন্ধনটি হয়ে গেছে। কাগজ দিয়ে তো সম্পর্ক হয় না। সম্পর্ক সর্বদা মনের ব্যাপার। অনল দাদাজানের সামনে হাটু গেড়ে বসলো, নরম গলায় বললো,
“দাদাজান, আপনি ধারার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন এই ভেবে যে আমি তাকে সামলে রাখবো। তাহলে আপনি কেনো ভয় পাচ্ছেন? ধারা না চাইলে ওকে কেউ জোর করতে পারবে না। আমি হতে দিবো না”
“তোমারে দেখলে আমার শান্তি লাগে, আমার ধারারাণীরে দেইখে রাইখো”
জামাল সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। বৃদ্ধ মানুষটি সত্যি ই ভীত আজ। এদিকে এশা আশা এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। আশা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“অস্ট্রেলিয়ান ফুপা ভালো কাজ করলো না। আমাদের ধারাপুকে এভাবে নিয়ে যাবে! হুমকি পর্যন্ত দিলো”
“এতো সহজ? এর শোধ তো তুলবোই। তুই চিন্তা করিস না। ধারাপু আমাদের কাছেই থাকবে।”
“করবি কি তুই!”
“অনেক কিছু, কিন্তু এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা। অস্ট্রেলিয়ান ফুপাও বুঝবে কত ধানে কত চাল”
বলেই সফেদ দাঁত বের করে হাসলো এশা। আশর মুখেও হাসি ফুটলো। বোনের দুষ্টু মস্তিষ্কের উপর বিশাল বিশ্বাস তার।
******
আজ সব কিছু মিলিয়ে ক্লান্ত ধারা। প্রথমেই দিগন্তের সাথে কথা কাটাকাটি। উপরন্তু এখন বাবার ঝামেলা। যখন বাবা অনলকে জেলের ভয় দেখাচ্ছিলো ধারার বুকটা কামড় দিয়ে উঠেছিলো। নিজেকে আজ বড্ড অপদার্থ মনে হচ্ছে। অনলের জীবনে সে যেনো একটা বিরাট বড় পাথর। তার কারণে অনলের উপর আজ বিপদেরা নৃত্য করছে। অথচ তার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। কলেজে না হয় সামলে নিবে, কিন্তু বাবা তাকে কিভাবে সামলাবে! আচ্ছা লোকটি এমন কেনো! কেনো কিছুতেই ধারার জীবন থেকে সরে যায় না সে। পেন্ডুলামের মতো শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। সে কি প্রমাণ করতে চাইছে, যে ধারাকে সেই ভালোবাসে! কিন্তু এটা তো তার ভুল ধারণা। ধারা চায় না যেতে অস্ট্রেলিয়া। ওই রোকসানা নামক মহিলার ধারে কাছে সে থাকতে চায় না। চিন্তার জোয়ার মস্তিষ্ক অকেজো করে তুলছে। ধারা দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। চুল আঁকড়ে বসে রইলো সে। এমন সময় পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো,
“চুল গুলো ছিড়ে গেলে তো টাক হয়ে যাবি। আমার টাক বউ কিন্তু চলবে না”
মাথা তুলে তাকালো ধারা। অনল তার হাতা গোটাতে গোটাতে বললো কথাটা। ধারা থমথমে গলায় বললো,
“তোমার ভয় করছে না?”
“কিসের ভয়?”
“জেলের ভয়! চাকরি হারানোর ভয়! সাসপেন্ডের ভয়!”
অনল অমলিন হাসলো। স্নিগ্ধ সেই হাসি। অর্ধভেজা শার্টটা খুলে ঝুলালো হ্যাঙ্গারে। তারপর মাঝে এসে বসলো ধারার। ধারার কপালে গভীর চুম্বন একে বললো,
“এসবের ভয় আমার নেই। তবে একটা ভয় আছে। জানিস সেটা কি?”
“কি?”
“তোকে হারানোর ভয়”……..
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৯তম_পর্ব
ধারার কপালে গভীর চুম্বন একে বললো,
“এসবের ভয় আমার নেই। তবে একটা ভয় আছে। জানিস সেটা কি?”
“কি?”
“তোকে হারানোর ভয়”
অনলের স্বর ঈষৎ কাঁপছে। টলমলে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ধারার হাতজোড়া নিজের রুক্ষ্ণ বিশাল হাতের ফাঁকে নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কপাল ঠেকালো সে। তার ঘননিশ্বাস জানান দিচ্ছে হৃদয়ের অন্তস্থলের আশংকা। না চাইতেও ক্ষীন ভয় হৃদয়ে জড়ো হয়েছে তার। সবকিছু যেনো এলোমেলো লাগছে। শান্ত জীবনটা যেনো মূহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠেছে। ধারা নিজের হাত জোড়া ছাড়ালো অনলের থেকে। আলতো হাতে তুলে ধরলো অনলের মুখখানা। অনলের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বললো,
“আমার পিছু ছাড়ানো এতো সোজা নয়। ঐ লোক বলবে আর আমি তার পিছু পিছু চলে যাবো ভাবলে কি করে! আমি জানি বিপদের মাত্রা বেশি, আমারো ভয় করছে। কিন্তু আমার ভয় তোমাকে নিয়ে, তোমাকে হারাবার নয়। পরিস্থিতি যাই হোক আমি তোমার পাশে থাকবো ইনশাআল্লাহ। যখন ই তোমার মনে হবে তুমি দূর্বল, তোমার ধারাকে পাশে পাবে।”
অনল কিছুসময় তার ছোট বউ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা। ধারার দৃঢ়তায় সে বিস্মিত। নিজের হাতদিয়ে ধারার হাতগুলো আঁকড়ে ধরলো অনল। ঠোঁট ছোঁয়ালো অগণিতবার। তারপর অমলিন কন্ঠে বললো,
“আমি জানি, আমার ধারা আমার পাশে আছে। তাই তো এতোটা শক্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছি।”
ধারাও তার প্রণয়নের বুকে মাথা ঠেকালো। অনল চুপ করে রইলো কিছু সময়। ধারাও নিঃশব্দে তার হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো। কাজটি ধারার খুব পছন্দের একটি কাজ। প্রিন্স উইলিয়ামের বেসামাল হৃদস্পন্দনের ধ্বনি তাকে বার বার বুঝায় সে ধারাকে কতোটা ভালোবাসে। এর মাঝেই হুট করে অনল ম্লান কন্ঠে বললো,
“যদি মানুষটা তোর বাবা না হতো আমি হয়তো ভয় পেতাম না। যতই হোক, রক্তের একটা টান তো কাজ করেই”
কথাটি কর্ণকুহিরে ঝংকার তুললো। ধারা উত্তর দিলো। নিস্তব্ধতা ঘিরে রইলো শীতল ঘরটিতে। বুক চিরে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। হ্যা, বাবা। কিন্তু এই শব্দটির সাথে তার পরিচিতি খুব স্বল্প। যখন সেলিম দেশ ছাড়েন তখন ধারার বয়স পাঁচ। স্মৃতিগুলো খুব ই ঝাপসা। তার মনেও নেই বাবা কবে তাকে কোলে নিয়েছিলো। কবে তাকে ঘাড়ে করে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলো। তার মনেও নেই তার বাবা আদৌ তাকে ঘুম পাড়িয়েছে কি না! তার মনে নেই যখন হাটতে শিখেছিলো তখন তার বাবা তাকে ধরেছিলো কি না। আচ্ছা, যখন সে ব্যাথা পেতো বাবা তাকে জড়িয়ে আদর করতো? ব্যাথায় মলম লাগিয়ে দিতো! মনে নেই। মস্তিষ্কে জড়ো সেই স্মৃতিগুলো কোন সিন্দুকে বন্দি কে জানে! ধারা খানিকটা ধরা গলায় বললো,
“ঘৃণা শব্দটি অনেক ছোট জানো তো! আমার মনে সেলিম আহমেদের জন্য ঘৃণাও অবশিষ্ট নেই। বাবা শব্দে নাকি অনেক স্নেহ জড়িয়ে আছে। বাবারা নাকি বটগাছের মতো! কিন্তু সেই ছায়াটা আমার জন্য নয় বোধহয়। জানো! ছোটবেলায় না স্কুল শেষ হলে দেখতাম সবার বাবা-মা তাদের নিতে আসতো! আমার না খুব হিংসে হতো জানো। আমার না খুব জানার ইচ্ছে হতো কেমন লাগে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরতে। এখন আর মনে হয় না। এখন আর আফসোস হয় না। উনি উনার বাবা হবার সুযোগ হারিয়েছেন। আমার জীবনের সেই মূহুর্তগুলো সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সেলিম আহমেদের সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হয়। বাবা ডাকটা আমার কাছে খুব বিশ্রী লাগে জানো তো! আমি না ভেবেছিলাম উনি সামনে আসলে আমি উনাকে অনেক কথা শুনাবো, ইচ্ছেমতো অপমান করবো। কিন্তু যখন উনি সামনে এলেন উনার সাথে হিসেব মিটানোর ইচ্ছে হলো না। থাকুক হিসেব জমা। থাকুক কিছু অভিমান। বলে দিলে তো শেষ হয়ে যাবে। ঘৃণা শেষ হয়ে যাবে। থাকুক না অভিমান গুলো জড়ো।”
ধারা ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যার্থ হলো। অনুভব করলো কোমল গাল জোড়া লবনাক্ত পানিতে ভিজে গেছে। অনল বা হাত ডুবালো ধারার কেশে। আলতো পরশ বুলিয়ে দিলো ক্ষতহৃদয়ে। ধারা ধীর স্বরে বললো,
“তুমি ভয় পেও না, সেলিম আহমেদ এবারও হার মানবেন। ওবারের মতো এবার ও উনাকে হার মানতে হবে। আমি কোথাও যাবো না”
অনল এর বাহুর বেষ্টনী শক্ত হলো। নিবিড়ভাবে ধারাকে বুকের সাথে লেপ্টে রাখলো। ধারা কিছু সময় নিঃশব্দে কাঁদলো। তার নোনাজলে অনলের নগ্ন বুক ভিজলো কিছুটা। কিছু অনল বাঁধা দিলো না। তখন ধারা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সেলিম সাহেবের দিকে। কিশোরীর মনে কতোটা ঝড় বইছিলো সেটা কেউ না বুঝলেও অনলের বুঝতে সময় লাগে নি। তাই ধারাকে আজ কোনো বাঁধা দিলো না। কাঁদুক, কাঁদলে মন হালকা হবে। বাহিরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, হয়তো তুফান উঠবে। হয়তো আবার বৃষ্টি শুরু হবে, হয়তো আবারো ভিজবে এই আঁধারে ডুবে থাকা শহর।
ধারার ভার্সিটি বন্ধ। পরীক্ষা শেষে দশদিনের ছুটি দিয়েছে। বন্ধুদের সাথে তার কথা হয় না। সহজ বাংলাভাষায় ধারার ইচ্ছে হয় নি। মাহি ফোন দিয়েছিলো। তার সাথেই কথা হয়েছিলো। এছাড়া দিগন্ত একবার ফোন করেছিলো কিন্তু ধারা তার ফোন ধরে নি। উপরন্তু তাকে ব্লক লিষ্টে দিয়ে রেখেছে। তাই সারাদিন ই বাসায় সে। বাসায় বসে বসে পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখছে। তাও বহু পুরানো, উত্তম কুমারের। এই স্বভাবটি নানাভাই এর কাছ থেকে প্রাপ্ত। নানাভাই যখন ই সিনেমা দেখেন নাতি নাতনীদের বসিয়ে রাখবেন। যেনো এটা কোনো শাস্তি! অবশ্য এতে লাভ ই আছে। যেমন উত্তম কুমারের অভিনয়ের কাছে ধারার কাউকেই ভালো লাগে না। তার মনে হয় মহানায়ক সত্যি ই মহানায়ক। তবে একা একাই তাকে সিনেমা দেখতে হয়। কারণ অনল খাতা দেখতে ব্যাস্ত। সে এই বার মোট ৩খানা কোর্স নিয়েছে। সেই সব খাতা সে বাড়ি নিয়ে এসেছে। এক এক করে দেখে শেষ করছে। ধারার ইচ্ছে করছিলো শুধাতে, “আমাকে কত দিলে? পাশ কি করলাম?” কিন্তু অনলের কাছে প্রশ্নটি করা আর ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে নৃত্য করা একই। ধারা উত্তর কুমারের “পথে হলো দেরী” সিনেমাটি দেখছিলো তখন ই সুভাসিনী বেগমের আগমণ ঘটলো। তিনি ইতস্তত স্বরে বলে উঠলেন,
“ধারা মা তুই কি ব্যস্ত?”
“না বড়মা, এই তো সিনেমা দেখছি”
“একটা কাজ করতে পারবি?”
“বলো”
“আমি শুটকি রেধেছিলাম৷ একটু পাশের বাসার খালাম্মাকে দিয়ে আসবি? এশা আর আশাটা দরজা আটকে কি জানে করছে। বললাম বলে, ব্যাস্ত৷ তুই একটু যাবি?”
“ব্যাস্ত না ছাই। যেয়ে দেখো কিছু একটা আকাম করছে। ওদের বিশ্বাস নেই। দাও আমাকে আমি দিয়ে আছি”
“সোনা মা আমার”
বলেই সুভাসিনী বেগম চলে গেলেন। ধারা আড়চোখে অনলকে দেখলো। লাল কলমে খাতায় কাটাকুটি করছে সে। খানিকটা জোরে বললো,
“আমি কিন্তু পাশের বাড়ি যাচ্ছি”
“তো আমি কি করবো? ভাব এমন দেখাচ্ছিস যেনো যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছিস।”
“না পরে আবার বলতে পারবে না, আমাকে না জানিয়ে কেনো গেসিস”
এবার চোখ তুলে তাকালো অনল ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“আমি কি কানে কালা?”
“বালাই ষাট তা হবে কেনো?”
“তাহলে তোর কেনো মনে হলো মায়ের কথা আমি শুনি নি!”
“তাহলে গেলাম আমি”
বলে যেতে ধরলেই অনল বলে উঠলো,
“শোনো, বেশি দেরি করবা না। ওখানে যেয়ে গল্প জুড়ে বসবা না। তরকারি দিয়েই চলে আসবে”
“যথাআজ্ঞা প্রিন্স উইলিয়াম”
বলেই বেড়িয়ে গেলো ধারা। অনল বাঁকা হাসলো। হয়তো এই ছোট ছোট সুখগুলোকে খুজে নেওয়াকেই জীবন বলে।
বাড়ি থেকে বের হতেই সূর্যের তীব্র ঝলসানো রোদটা মুখের উপর এসে পড়লো আর চোখ মুখ কুঞ্চিত হলো ধারার। বাসায় থেকে এই জ্বালাময়ী তেজটা আন্দাজ করতে পারে নি সে। সাথে সাথে মাথায় ঘোমটা টানলো। পাশের বাড়ির এই ভদ্রমহিলার নাম শিল্পী। ধারা তাকে শিল্পী দাদী বলে ডাকে। এই শিল্পীদাদীর সাথে বড়মার ভাব ই আলাদা। তিনি কুমিল্লার মানুষ আর বড় মার বাবার বাড়িও কুমিল্লা। তাই দেশের মানুষ বিধায় এনাদের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যখন এ বাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসেন সুভাসিনী তখন থেকেই মহিলাটি বেশ স্নেহ করতেন তাকে। প্রায় দেখা যেতো মহিলাটি সুভাসিনীর জন্য বিভিন্ন পিঠে বানিয়ে পাঠাতো। সুভাসিনীও বিভিন্ন খাবার রান্না করে পাঠাতো তাকে। এবং এই সখ্যতা আজ ও অটুট আছে। তাই তো এখনো শুটকি বা ম্যারা পিঠে বানালে এই খালাম্মাকে দিতে ভুলে না সুভাসিনী। এই ব্যস্ত ঢাকা শহরে এই দৃশ্য এখন বিরল। পাশের ফ্লাটে মানুষ ম’রে থাকলেও তাদের খোঁজ নেবার সময়টি হয় না। শিল্পী দাদীর বাসায় ঢুকতেই দেখা গেলো বাহিরে মালামাল সমেত ট্রাক দাঁড়ানো। হয়তো নতুন ভাড়াটে এসেছে অথবা কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ধারা বেশি ঘাটালো না। সে বাড়িতে ঢুকতেই ২ জন শ্রমিক দেখতে পেলো। তারা ঘরে মাল ঢুকাচ্ছে। এর মাঝেই একটা পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেলো। ছেলেটি শ্রমিকের সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ধারাকে দেখতেই এগিয়ে এলো সে। মুচকি হেসে বললো,
“কেমন আছো ধারা? আমাদের দেখা হয়েই গেলো”
মানুষটি দীপ্ত। দীপ্তকে প্রায় মাস খানেক পর এখানে দেখবে আশা করে নি ধারা। তাকে দেখতেই ভেতরের সব আনন্দগুলো মাটি হয়ে গেলো। সাথে সাথেই এক অসামান্য বিরক্তি ঘিরে ধরলো তাকে। সে দীপ্তের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই উপরে চলে গেলো। দীপ্ত ধারার যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধারার আচারণ তাকে খুব অবাক করলো না। সে জানে ধারা তাকে অপছন্দ করে। শুধু মলিন হাসি হাসলো সে৷ তারপর শ্রমিকদের সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
শিল্পী দাদীকে খাবার দিয়ে নিচে নেমে দীপ্তকে দেখতে পেলো না ধারা। কিছু স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেললো সে। এ বাড়ির মানুষদের কাছ থেকে জেনেছে দীপ্তরা এই বাড়ির নিচ তলা ভাড়া নিয়েছে। ধারার বুঝতে বাকি রইলো না, এটাও সেলিম সাহেবের কাজ। সে ধারার আশেপাশে থাকার জন্যই এই ফন্দি এটেছেন। সুতরাং এখন থেকে এই লোকটির সাথে দেখা হবার মাত্রা অনেকটাই বাড়বে যা ধারাকে খুব ই বিরক্ত করছে। বাসায় যেয়েই অনলকে বিষয়টা জানাতে হবে। সর্বদা নাকের উপর রাগ জমিয়ে রাখা নানাভাই শুনলে ঘর মাথায় করবেন। তিনি বাড়ি ছেড়েও চলে যেতে পারেন৷ এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কেঁচিগেট দিয়ে ঢুকছিলো ধারা তখন ই একটি রাশভারী কন্ঠ কানে এলো তার। পেছনে ঘুরতেই বিরক্তি আসমান ছুলো। সেলিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ধারার কাছে এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর কন্ঠটি নরম করে বললেন,
“দীপ্ত বললো তুমি নাকি ওই বাড়িতে এসেছিলে। তাই ছুটে বের হলাম আমি, কিন্তু তুমি তো তার আগেই চলে এসেছো। যাক তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। সেদিন তো কথা বলতে পারি নি। তো কেমন আছো?”
“আপনি আসার আগে ভালো ছিলাম। এখন ভালো নেই। আপনার আর কোনো কথা না থাকলে আমি ভেতরে গেলাম”
“তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো ধারা?”
ধারা শীতল দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। একটা মানুষ এতোটা নির্লজ্জ কিভাবে হয়! কিভাবে এতোটা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে! সে অবাক হয় নিজের পিতাকে দেখে। একটা মানুষের মাঝে একবিন্দু আত্মগ্লানি নেই। ছিটেফোঁটাও অনুতাপ নেই। অথচ সেই মানুষটি গর্বের সাথে দাবি করে সে মানুষ। ধারা গাল ফুলিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
“আপনি কে হন, যে আপনার উপর আমি রাগ করতে যাবো? দেখুন মিষ্টার সেলিম আহমেদ আপনার হয়তো অজস্র খালি সময়, কিন্তু আমার নেই। দয়া করে আমাকে এমন ভাবে বিরক্ত করা বন্ধ করুন৷ এতোদিন যেমন অস্তিত্বহীন ছিলেন আজও তাই থাকুন প্লিজ”
“আমি তোমার বাবা ধারা, বাবাটুকু তো বলতেই পারো। আমি কিন্তু আমার দায়িত্ব কখনো এড়াই নি ধারা। আমি তোমাকে নিতে চেয়েছি, বার বার। বহুবার। তোমার নানা সেটা হতে দেয় নি। তোমার জন্য প্রতিমাসে আমি খরচ পাঠিয়েছি। ভেন এখনো তোমার মা তোমার জন্য অজস্র শপিং করে এনেছে। তোমাকে প্রথম দেখবো এতো বছর পর, খালি হাতে কিভাবে আসি”
“প্রথমত সে আপনার স্ত্রী, আমার মা নন। আমার মা মারা গেছেন। আর দ্বিতীয়ত টাকা দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আপনার উপর ঘৃণাও করতে ইচ্ছে হয় না জানেন কেনো? কারণ আপনার মতো অভাগা আমি জীবনেও দেখি নি। যাক গে, আপনি তো আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে সুখে আছেন আমার জীবনটাতে আ’গু’ন না জ্বালালেই কি নয়? আমি তো সুখে আছি। কেনো আপনি উঠে পড়ে লেগেছেন বলুন তো আমার জীবনটা নষ্ট করতে। আমার মার জীবন ছারখার করে কি শান্তি পানি নি? আমি অনুরোধ করছি প্লিজ আমাকে উত্যোক্ত করবেন না। আপনার এই দেখানো ভালোবাসায় আমার ঘৃণা হয়, দমবন্ধ লাগে। ছোটবেলায় বড়মামু ই আমার সব গার্ডিয়ানশীপে সাইন করতো। আজ ও আমি তাকে বাবার স্থান দিয়েছি। যখন ছোটবেলায় সি সো খেলতে যেয়ে আমার হাতে ফ্রাকচার হয়, বড়মামু সারারাত আমাকে কোলে নিয়ে রেখেছিলেন। কোথায় ছিলেন তখন আপনি? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসতেন নিজের সুখের আগে আমার কথাটা ভাবতেন”
ধারার কন্ঠ জড়িয়ে আসছে। সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে মানুষ্টির প্রতি। মৌচাকের মতো জমে থাকা ক্ষততে আঘাত করলে তো কামড় খেতেই হবে। তাই ধারাও নিজেকে সংযত রাখলো না। সেলিম সাহেব কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। মেয়ের কথাগুলো সুঁচের মতো ফুটছে। কিভাবে বোঝাবেন এই মেয়েটির জন্য সে আর সন্তানও নেন নি। হয়তো চাইলেও নিজের কৃতকাজের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারবেন না। তিনি ব্যাখ্যা দিবেন ও না। কারণ ব্যাখ্যা গুলো অযৌক্তিক। তবে নিজের মেয়েকে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। সেদিন মনে হয়েছিলো মেয়েটি তার মায়ের মতো হয়েছে, শান্ত চুপচাপ, ধীর গতির একটি ঝিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে ভুল, মেয়েটি তার মতোই জেদি হয়েছে, আত্মসম্মান তার প্রবল। সেলিম সাহেব স্মিত হাসলেন, তারপর বললেন,
“তুমি আমাকে বাবা মানো বা নাই মানো। আমি তোমার বাবা, এবং তুমি আমার একমাত্র মেয়ে। তাই তোমার বাবা হওয়া স্বত্তে আমি চাইবো একজন ভালো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হোক। যেহেতু তুমি বলছো তুমি সুখে আছো আমিও সেই সুখের মাত্রাটুকু দেখতে চাই”
“মানে?”
“মানে টা খুব সোজা, তোমার জন্য অনল কতটা যোগ্য সেটার পরীক্ষা করতে চাই আমি। বলা তো যায় না সে আমার মতোই একজন অযোগ্য স্বামী প্রমাণিত হলো!”………..
চলবে