প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব -২১

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২১)

রিয়াদ অন্ধকারে কোথাও মিলিয়ে গেল,আশেপাশে রিয়াদকে হন্তদন্ত হয়ে খোঁজতে লাগল সে অজ্ঞাত ব্যক্তি,রিয়াদ তাকে আড়াল থেকে দেখছে,শরীর থেকে র*ক্ত ঝড়ার বেগ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে, সাথে দূর্বল হয়ে পরছে রিয়াদ,তাকে যে করেই হোক প্রমত্ত অঙ্গনার হাত থেকে নিজের প্রাণ রক্ষা করতেই হবে,তবে বেরুতেও ভয় করছে রিয়াদের,মৃ*ত্যু যে তার পিছনেই,তার গতির বেগ স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ,যেন দক্ষ কোনো দৌঁড় প্রতিযোগী,শরীরের জোরও কম না,তার সাথে পেরে ওঠার শক্তি ও সাহস ঝুটিয়ে ওঠতে পারছে না রিয়াদ,তবুও মন শক্ত করে অজ্ঞাত সে ব্যক্তির অগোচরে বের হলো,কিন্তু পারল না তার চোখ ফাঁকি দিতে,সাথে সাথে ধাওয়া শুরু করল তাকে সে,প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে ছুটতে মেইনরোডের বেশ পাশে চলে এলো রিয়াদ,মনে জেগে উঠল বেঁচে যাওয়ার বড় এক আশা।তবুও ভয় দূর হলো না মন থেকে,পিছনের জন যে মোটেও দূর্বল বা মাত দিয়ে যাওয়ার কোনো পাত্র নয়,তাই মেইন রোডের বেশ পাশে এসে গেলে প্রাণপণে ছুটতে লাগল, কিন্তু আবারও পিছন থেকে ভারি কিছুর আঘাতে মুখ থুবড়ে পরল রিয়াদ,শরীর পুরো অবশ হয়ে আসছে তার,হাত পা কাঁপছে,কাজ করা যেন বন্ধই করে দিয়েছে,তাও হুমড়ি দিয়ে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল, এবার সেই অজ্ঞাত ঘাতক তাকে টেনে পাক ফিরিয়ে নিল,ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে অস্পষ্ট বাক্যে বলল রিয়াদ।

″প্লিজ আমাকে মেরো না,ছেড়ে দাও প্লিজ। ″

″ভয় পাস নে এখনই ছেড়ে দিব।″

কথাটা বলে রিয়াদকে টেনে দাঁড় করাল,রিয়াদ ভালো করে কিছু বোঝে ওঠার আগেই তাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রবল এক ধাক্কা দিলো যাতে রিয়াদ রাস্তায় গিয়ে আঁছড়ে পরার আগেই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে গেল,পলকেই রিয়াদের শরীর বেশ দূরে গিয়ে ছিটকে পরল,গাড়িটা একটা ব্যক্তিগত কার ছিল,হয়ত চালক ভালো মানুষ ছিল তাই গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে গেল রিয়াদের কাছে,প্রমত্ত অঙ্গনা নামক সেই অজ্ঞাত ঘাতক আর পা বাড়াল না সেদিকে,বরং গাছগাছালির আড়াল হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আদ্রিশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে বুকে পাথর রেখে,হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করল রিদিকা।

″কি এখন তোমার আসার টাইম হলো?″

″আরে কি করব বলো? আমার ওই বান্ধবী তো আসতেই দিচ্ছিল না,বলে না কি আজকে থেকে যেতে,কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারি না বলে এসেছি ওকে।ওর স্বামী নিজে এসে আমাকে বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেন।″

″হুম ভালো করেছ।আমি নিজে থেকেই তোমায় কোথাও দূরে থাকতে দিব না কখনও,তুমি শুধু আমার কাছেই থাকবে।″

″হুম বুঝেছি,তা হাতে ওটা কি?″

″আমার আর আঁখির ডিভোর্স পেপার,সাইন করে দিয়েছি।″

″তুমি অবশেষে আঁখিকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে?এমনটা কেনো করলে তুমি?আমি কখনও তা চাই নি।আমার জন্যই আজ তোমরা আলাদা হয়ে গেলে।″

″আরে তুমি শুধু শুধু প্যারা নিচ্ছো,আঁখি আমার কাছেই ফিরবে দেখে নিও,যখন দেখবে আমি সাইন করে দিয়েছি ডিভোর্স পেপারে, যখন বুঝতে পারবে আমাকে ও সত্যিই হারিয়ে ফেলছে,আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তখন সব ফেলে আবারও আমার কাছে ফিরে আসবে।″

″আর তুমি ওকে মেনে নিবে!″

″অবশ্যই।″

″তোমাকে ও এতো অপমান করল তারপরও!″

″হুম,ও আমার সাথে যা তা করতে পারে কারণ আমি ওকে ভালোবাসি।আমি সেই অধিকার ওকে দিয়েছি।তুমি ফ্রেস হয়ে নাও আমি আসছি।″

অতঃপর আদ্রিশ কক্ষ ত্যাগ করল,রিদিকা বেশ খানিকক্ষণ তার যাওয়ার পাণেই তাকিয়ে রইল।

রাত ১ টা,রিয়াদের এক্সিডেন্ট যে গাড়ির সাথে হয়েছে সে গাড়ির মালিক তারই দূরসম্পর্কের আত্নীয় হন,তার এ অবস্থা দেখে লোকটি তাকে তাড়াতাড়ি করে পাশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।ইমারজেন্সিতে নিতে হবে রিয়াদকে,শরীরের বিভিন্ন অংশ তার থেঁতলে গেছে, এদিকে বর্তমানে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নেই,পেরেশানিতে পরল নার্সেরা।নার্স ইরা ফোন করল ডা.আশরাফ খানকে।

″স্যার ইমারজেন্সি রোগী এসেছে,অনেক র*ক্ত*পা*ত হচ্ছে তার,আধ ঘন্টার মাথায় চিকিৎসা শুরু না করা গেলে নিশ্চিত মা*রা যাবে কিন্তু বর্তমানে কোনো ডাক্তার এখানে নেই।″

″তোমরা যেভাবে পারো রোগীর টেক কেয়ার করো,র*ক্ত বন্ধ রাখার চেষ্টা করো আর হাসপাতালের সবথেকে কাছে যে ডাক্তার থাকেন উনাকে কল করে ইমারজেন্সি আসতে বলো।″

″ওকে স্যার।″

হাসপাতালের সব থেকে কাছে একমাত্র আঁখির বাড়ি পরে,সেখান থেকে তার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা তাই নার্স তাকেই ফোন করল।ইমারজেন্সির ডাক কখনও অবহেলা করে না আঁখি।যতো তাড়াতাড়ি করে পেরেছে চলে এসেছে।প্রায় ২ ঘন্টা অপারেশনের পর আঁখি রিয়াদকে বাঁচাতে সক্ষম হলো,যদিও আঁখির তাকে মোটেও পছন্দ না কিন্তু আঁখি নিজের দায়িত্ব পালনে কখনও পিছপা হয় না।এতসময়ে সেখানে রিয়াদের পুরো পরিবারই চলে এসেছে,কান্নায় ভেঙে পরেছে সকলেই।রিয়াদ বেঁচে গেলেও আশংকা মুক্ত নয়,তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে,জ্ঞান ফিরলে ভালো খারাপ কিছু বুঝা যাবে।

কাজ শেষ করেই আঁখি আবারও চলে যায় তার শান্তির নীড়ে।

রাত ৪ টা,ব্যস্ত শহর ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে,চারিদিক নিরবতার দখলে,জনশূন্য সবদিক,প্রমত্ত সে অঙ্গনার প্রিয় একটা পরিবেশ যে আশপাশে ভালোই জমে উঠেছে,এই ঘন অন্ধকার জনশূন্য নিরব পরিবেশেই তো পাপীদের মৃ*ত্যু আর্তনাদ শুনতে মজা পায় সে,নিজের কাজ অপূর্ণ রাখার অভ্যেস যে তার কখনোই নেই,তাই চলে আসলো অপূর্ণ কাজে পূর্ণতা দান করতে,হাসপাতালে এসে সোজা আইসিইউ রুমে ঢুকে পরল ,এগিয়ে গেলো রিয়াদের ধারে,অতঃপর খুবই ধীর গতিতেই তার শরীরে দেওয়া সকল সে*লা*ই ও ব্যান্ডেজ আস্তে আস্তে খুলতে লাগল, তার যেন এসব মজাই লাগছে,অতঃপর রিয়াদকে সেই আগের হালে ফিরিয়ে দিয়ে সে তার পথ ধরল।

আদ্রিশ সকাল হতে না হতেই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে আঁখির কাছে,প্রফুল্ল মনে নাস্তা সেরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য প্রস্তুত হবে তখনই হাতে আসল পেপারটা,আদ্রিশের সাইন দেখে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল আরেকদফা তার মন,চোখে শোকের জল থাকলেও মুখে ফুটল তাচ্ছিল্যের হাসি।

অবশেষে তার ভালোবাসার পরাজয় ঘটল আদ্রিশের মিথ্যে ভালোবাসার ধাক্কা সামলাতে না পেরে।তাচ্ছিল্যের হাসিটা প্রখর করে বলল আঁখি।

বাহ রে ভালোবাসা,যে কাল অব্দি মৃত্যুর আগ অব্দি ছাড়বে না বলেছিল সেই আজ নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিল।মানুষ এতো নাটক জানে আদ্রিশকে না দেখলে জানতামই না।আল্লাহ তায়ালা আপনার কাছে হাজার শুকরিয়া আমাকে আদ্রিশের মিথ্যে ভালোবাসার জাল থেকে বাঁচানোর জন্য।অবশেষে আত্মসম্মানের সংগ্রামে জয়ী হলাম আমি,শুকরিয়া রাব্বুল আল-আমীন।

আদ্রিশ নাস্তা করছিল তখনই তার ফোনে কল আসে।কলটা রিসিভ করার পর ওপর পাশের বলা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আদ্রিশ,আর কিছু কাউকে না বলেই ছুটে বেরুলো বাইরের দিকে।রিদিকা শুধু লক্ষ্য করল আদ্রিশের কার্যকলাপ।

আইসিইউ রুমের বেড জুরে র*ক্তে*র ছড়াছড়ি,রিয়াদের লা*শে*র দিকে যে কারো তাকাতেই ভয় করছে,এতো ভয়াবহ অবস্থা সহ্য করার ক্ষমতা যে সবার থাকে না।রিয়াদের লা*শে*র পাশেও প্রমত্ত অঙ্গনা নামটা লিখা,তাজ্জবের ব্যাপার হলো নামের পাশে এবার বাক্যও লিখা আছে।

ভালোবাসার মর্ম যে প্রতারণা দিয়ে দেয় তার হাল এমনই হওয়া উচিৎ।
প্রমত্ত অঙ্গনা।

ইন্সপেক্টর জিসান নির্বাক হয়ে রইল,পা*ব এর একটা বন্ধ রুমে ইশানারও গলা কা*টা লা*শ পাওয়া গেছে যার পাশে লিখা।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
প্রমত্ত অঙ্গনা।

কি করবে জিসান ভেবেই পাচ্ছে না,এই প্রমত্ত অঙ্গনা যে তার রাতের ঘুম ও দিনের শান্তি হারাম করে দিয়েছে।তবে ছাড়বে না এই অজ্ঞাত খু*নি*কে পণ করে নিয়েছে সে।সে যেভাবেই হোক না কেনো তাকে তো জিসান ধরবেই।

হাসপাতালের সিসিটিভি ফোঁটেজ চেক করল জিসান,সেখানে শুধু হুডিওয়ালা,মাস্ক পরিহিত একজনকে দেখা গেছে,যার হাতে মোজা পায়ে সু।উপর থেকে নিচ অব্দি কালোতে ভরপুর,চেহারা দেখা বা শরীরের কোনো গড়ন কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না এমতাবস্থায় এই ফুটেজ দিয়েই বা কি হবে।গম্ভীর চিন্তায় পরে গেল জিসান।

হাসপাতালে পরেছে কান্নার রুল,পুলিশের দাবিতে রিয়াদের লাশ তাড়াতাড়িই পোস্টমর্টেমে নেওয়া হয়ে গেল।লা*শ কা*টা ঘরের বাইরের দিকে বসে কেঁদে যাচ্ছে রিয়াদের আত্মীয় স্বজন।একপাশে বসে কেঁদে যাচ্ছে তার স্ত্রী তার দুই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে।রিয়াদ তাকে সত্য অর্থে ভালো না বাসলে কি হলো সে তো ভালোবেসেছিল,তার ভালোবাসায় তো কোনো খুঁত ছিল না।আঁখি দাঁড়িয়ে প্রখড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে মাসুমার উপর,তখন আদৃত চলে আসল সেখানে আঁখির খোঁজে। আঁখির উদ্দেশ্যে বলল।

আঁখি,আধ ঘন্টার মধ্যে একটা ডিফিকাল্ট সার্জারি আছে,আমাদের দু’জনকে থাকতে হবে।

আদৃত লক্ষ্য করল আঁখি যেন তার কথায় কান দিল না,বরং তার পুরো মনোযোগ মাসুমার দিকে।আদৃত এবার আঁখির কাঁধে হাত রেখে বলল।

″এমন কি দেখছ আঁখি?″

″দেখছি কারো ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে কতোটা কষ্ট হতে পারে,তার গভীরত্বে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি,ভালোবাসার মানুষটা যেরকমই হোক না কেনো তাকে মন থেকে কখনও ঘৃণা করা যায় না,দেখো না ও কিভাবে কান্না করছে এক বিশ্বাসঘাতকের জন্য,যে তাকে রেখে অন্য নারীতে আ*স*ক্ত হয়েছিল আজ তার মৃ*ত্যু*তেই সেই অভাগীর চোখের জল ঝড়ছে।″

″রিয়াদ অন্য নারীতে আ*স*ক্ত ছিল মানে?আর এসব তুমি কি করে জানলে?

এবার আঁখি আদৃতের দিকে তাকিয়ে অনেকটা হেসে বলল।

সেটা না হয় আপনাকে নাই বললাম।সবকিছু শোনতে কেনো মন চায় আপনার?মনে এতো কৌতুহল থাকা ভালো না ডা.সাহেব।চলুন সার্জারির আগে রোগীর অবস্থাও তো জানতে হবে।

আঁখি আগে হাঁটা ধরলে পিছনে এলো আদৃত ঠিক তখন আঁখির সামনে পরল আদ্রিশ,আঁখির পিছনে আদৃতকে দেখে মুহুর্তেই তার র*ক্ত জ্ব*লে উঠল।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here