#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
ড্রয়িংরুমের সামনের বড় বারান্দায় ছোট একটি টেবিলে ক্যান্ডেল সাজিয়ে রাখা। তার মাঝখানে কালো গোলাপের বুকে’টা নিজস্ব সৌন্দর্য ছড়িয়ে টেবিলটার শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। বারান্দার চারদিকেই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। তার মাঝখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছোট টেবিল। নিকষ কালো আঁধারে ডুবে থাকা বারান্দায় মোমবাতির হলদে আভা দিগ্বিদিক ছুটে চারপাশটাকে আলোকিত করে তুলেছে।
সাজানোর মতো আর কোনো সামগ্রী পায়নি বিধায় এগুলো দিয়েই কাজ চালালো ইনশিতা। ওভেনে কেক বেক করতে আরও সময় লাগবে, সেই সুযোগে ইনশিতা নিজেকে তৈরি করলো। আজ জেহেরকে তার ভালোবাসার কথা বলবেই। তাই জেহেরের পছন্দ মতো সেজে নিলো। ফিনফিনে পাতলা কাপড়ের সোনালী পাড়ের কালো শাড়ির সাথে ছোট্ট একজোড়া কানের দুল আর ম্যাচিং চুড়ি। শাল আজ পরবে না। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক লাগিয়ে নিলো। খোলা চুলগুলো পিঠে ছড়ানো। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। ঠোঁট থেকে হাসি যেন সরছেই না তার।
কেক ডেকোরেট করা হয়ে গেলে শুধু জেহেরের আসার অপেক্ষা। রেড ভেলভেট কেকের উপর খুব চমৎকারভাবে ‘আই লাভ ইউ’ লিখে ছুরিটাকে পাশে রেখে ড্রয়িং রুমে চলে আসে ইনশিতা। আজ আসলেই সাথে সাথে জেহেরকে নিজের ভালোবাসা কনফেস করে ফেলবে। নয়তো পরে যদি আর সুযোগ না পায়! বারবার ঘড়ির দিকে নজর ঘুরাচ্ছে সে। রাত আটটা বেজে দশ। জেহের সবসময় সন্ধ্যা নামার সাথেই চলে আসে। আজ যেন একটু বেশিই দেরি করে ফেলছে জেহের। সময় যেন ফুরোচ্ছেই না। তবুও এই অপেক্ষাটাও মধুর ঠেকছে তার কাছে। কারো জন্য অপেক্ষা করাটা যে এত মধুর হয়, সেটা আজ টের পেল ইনশিতা। ইশ! হঠাৎ এমন সারপ্রাইজ পেয়ে জেহের কী চমকানটাই না চমকাবে! কেমন হবে তার রিয়েকশন?
ইনশিতার ভাবনা বেশিদূর এগোলো না। তার ফোনটা বিপবিপ আওয়াজে বেজে ওঠে ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায়। চমকে উঠে ইনশিতা। আজ আবার সে ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছে। কোনোরকমে শাড়ি সামলে দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। বারবার ফোনটাকে সাইলেন্ট করতে ভুলে যায় সে। এখন যদি জেহের বাসায় থাকতো? কী হতো? এত সুন্দর সময়ে না জানি তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাতো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার মা ফোন করেছে। ভ্রু জোড়ার মধ্যভাগ কুঞ্চিত হলো তার। এই সময়ে মা তো কখনোই কল করে না। তাহলে হঠাৎ এখন?
দ্রুত কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই তার মায়ের কান্নারত আওয়াজ শোনা গেল। থমকে গেল ইনশিতা। হঠাৎ মায়ের কান্না তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম ব্যথার জন্ম দিচ্ছে। কোনো বিপদ হলো না তো? উত্তেজিত ইনশিতা কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মা যা বলল তা শুনে ইনশিতার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। পায়ের তলাটা শিরশির করে উঠল। হাত আলগা হয়ে ফোন পড়তে গিয়েও পড়ল না। চারিদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসলো। এই মুহূর্তে এমন ভয়ানক খবর শুনবে হয়তো আশা করেনি সে। ধরা কন্ঠে বলল,
-“এখন কোথায় আছে বাবা?”
ইনশিতার মায়ের ফোঁপানির আওয়াজ শোনা গেল,
-“হাসপাতালে। মা রে, তুই চলে আয়। ঐ জন্তুর সাথে সংসার করতে পারবি না তুই। তুই চলে আয় মা।”
ইনশিতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-“মা, তুমি শিওর তো? তুমি কি ঠিক দেখেছিলে? দেখার কোনো ভুল নেই তো? হতে পারে ওটা জেহের না…”
কান্নারত অবস্থাতেই তিনি বললেন,
-“একদম সঠিক দেখেছি। কীভাবে তোর বাবাকে মারলো ঐ জানোয়ারটা! সেদিন তুই নাকি আমাদের কারণেই এসেছিস বলে কিসের বিপদে পড়েছিস। আর তার জন্য আমরা নাকি দায়ী। সেই জন্যই আজ বিকেলে জেহের এসে তোর বাবাকে মেরে গেল। আমার মাথায় ফুলদানী ছুঁড়ল। তোর বাবাকে লাথি ঘুষি কোনোটাই বাদ রাখেনি। মা’রে, আর একটু হলে বোধহয় তোর বাবার জানটাই উড়ে যেত। আমার চিৎকারে অনেক মানুষ এসে জমা হলে জেহের তোর বাবাকে ছেড়ে দেয়। আর শাসিয়ে চলে যায়। তোর বাবার অবস্থা খুব খারাপ। আমার কী হবে রে মা? কী হবে…”
ইনশিতা থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মাথা ফাকা হয়ে যেতে লাগল তার। চোখের অশ্রু গড়িয়ে চিবুক বেয়ে পড়ল। ইনশিতার মা থামলেন না। তিনি বলে চললেন,
-“তুই বলেছিস না ওটা জেহের না? আমিও ভাবছিলাম জেহের না, তবে ওর চোখ দেখেছিলাম, নীল চোখ। আর-আর, তুই বলেছিলি না, জেহের কালো স্যুট পরেছিল, ভেতরে সাদা শার্ট। তেমনটাই ছিল। মা, তোর বাবা ছাড়া আমি কী নিয়ে বাঁচবো রে মা? আমি মরে যাব ঐ মানুষটা ছাড়া। জেহেরের পা জড়িয়ে ধরেছিলাম পর্যন্ত, তাও জানোয়ারটা ছাড়েনি তোর বাবাকে। পশুর মতো মেরে গিয়েছে। তোর বাবার শরীরে কত রক্ত…”
ইনশিতার মা আর কিছু বলতে পারলেন না। ভেঙে পড়লেন কান্নায়। ইনশিতা কিছুই বলল না। তার মুখে কোনো শব্দ আসছিল না। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হলো তার। তার প্রিয় মানুষ তার বাবা। শত কষ্টেও যিনি তাকে আগলে রেখেছিলেন। সেই বাবা এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। আর তার কারণ একমাত্র তার স্বামী জেহের! আজ জেহেরের জন্যই তার প্রিয় বাবা মৃত্যুর সাথে লড়ছে। নিজেকে দিশেহারা লাগল ইনশিতার। যেই মানুষটাকে আজ ভেবেছিল ভালোবাসার কথা বলবে সেই মানুষটাই কিনা তার জীবন থেকে আরেকজন ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল!
না না, এখন আর ভালোবাসার মানুষ না সে। সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি এখন ইনশিতার কাছে। ভেবেছিল জেহের ভালো হয়ে যাবে, তবে আজকের ঘটনার পর তা আর কোনোদিন হওয়ার নয়। মাথা চেপে ধরল ইনশিতা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। অদ্ভুতভাবে তার মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের হচ্ছে না। জেহেরের প্রতি কিছুদিন আগের নুইয়ে পড়া রাগ আর ঘৃণা মাথায় দপদপ করে জ্বলে উঠল। ইচ্ছে করছে শেষ করে দিতে জেহেরকে। এমন একটা মানুষকে সে কী করে ভালোবাসতে পারল যে কিনা নিজের রাগ মেটাতে মানুষ মারতেও পিছপা হয় না?
হুট করে তার রুমের লাইট আলো ছড়ানো বন্ধ করে দিলো। ভয় পেয়ে গেল ইনশিতা। এভাবে লোডশেডিং হলো কেন হঠাৎ! সচরাচর এই বাড়িতে লোডশেডিং একদমই হয় না। তাহলে এই মুহুর্তে…আকস্মাৎ কিছু একটার শব্দ হলো। ইনশিতা ভাবল জেহের এসেছে। মোবাইলটা আর লুকালো না। চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে ফ্ল্যাশ অন করে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। আজ জেহেরের প্রতি সমুদ্র সমান ঘৃণা বইছে তার মনে। যতই হোক না কেন, জেহেরকে সে আর কোনোদিন মেনে নেবে না। কোনদিন না মানে কোনোদিনই না।
মেইন দরজা তো বন্ধই। জেহের তো আসলো না। তাহলে আওয়াজ হলো কোথায়? আবারও কিছু একটার আওয়াজ হলো, চকিতে তাকাল ড্রয়িংরুমের বারান্দার দিকে। হ্যাঁ, ওখান থেকেই আওয়াজ আসছে। ইনশিতার ভীতু মনে অজানা ভয়ের শিহরণ ঢেউ খেলে গেল। দুরুদুরু বুক নিয়ে ভীতু পায়ে এগিয়ে গেল ব্যালকনির দিকে। ফ্ল্যাশ অফ করল। মোমবাতির আলোতে ড্রয়িংরুম উজ্জ্বল। কাঁচের দরজা ঠেলে সাজানো টেবিলটার সামনে দাঁড়াতে পিলে চমকে উঠল সে। কালো গোলাপের সবগুলো পাপড়ি ছিঁড়ে টেবিলের ওপর ছিটানো। যেন কালো গোলাপ দিয়েই টেবিলটা কেউ সাজিয়েছে। তার মাঝেই পাপড়ি দিয়ে একটা শব্দ লেখা ‘লাভ’। ঢোক গিললো ইনশিতা। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েকটা মোমবাতি নেভানো। যার ফলে আলোটাও হ্রাস পাচ্ছে। হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বেড়েই চলছে ইনশিতার। এই শীতেও বাহির দমকা বাতাস বইছে। তাতেও ইনশিতার শরীরে কাঁপন ধরল না। বাতাসের তোড়ে মোমবাতি সবগুলো নিভু নিভু প্রায়।
আচমকাই তার নজর চেয়ারের পাশে চলে গেল যা দেখে ইনশিতার হাত পা মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে লাগল। আরেকধাপ চমকানোর পালা বোধহয় এসে গিয়েছে তার। কেক কাটার জন্য যে ধারালো ছুরিটা সে নিয়েছিল তা নিচে পড়া। ছুরিতে টকটকে লাল রঙের তরল লেগে আছে। আর চারপাশেও রক্তের ছিটা ছড়িয়ে। ইনশিতার মাথা ঘুরতে লাগল। রক্তের দাগ অনুসরণ করে একটু এগিয়ে সামনে যেতেই তার পায়ের সামনে গড়িয়ে কিছু একটা আসলো। বিস্মিত আর ভয়াতুর দৃষ্টিতে দেখল মারবেলের মতো দুটো চোখ তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইনশিতার হার্টবিট দ্রুতগতিতে চলছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। হাত পা কাঁপছে তার ভয়ে।
সেই মারবেলের মতো কদর্য দৃশ্যটি অনুসরণ করে বারান্দার কোণার চিমনির পাশে তাকাল। চিমনির পাশের জিনিসটা দেখতে পেয়ে তার পা চলা বন্ধ হয়ে গেল। চিমনির পাশের অর্ধেক ফ্লোর রক্তে ভেসে গেছে। সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে এলো তার। গা গুলিয়ে বমি পেল। এমন ভয়ানক, বিশ্রী, বিভৎস দৃশ্য জীবনেও তার চোখের সামনে আসেনি। গলায় বমি এসে আটকে গেল। মাথা ঘুরানো শুরু করল তার। এমনটা কে করবে তার বুঝতে বাকি রইল না। মুহুর্তেই দুনিয়াসুদ্ধ ঘৃণা উপচে পড়ল তার প্রতি।
মুখ দিয়ে অস্ফুটে শব্দ বের হলেও শোনা গেল না। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় নোনাজল নির্বিঘ্নে বইতে লাগে। তখনই পেছন থেকে কেউ একজন শক্ত কন্ঠে ধমকে উঠে,
-“নিজের কর্মের ফল ভোগ করেছে সে। এতে কান্নার কী আছে? স্টপ ক্রায়িং রোজ।”
.#প্রহেলিকা
#পর্ব_৩০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
রক্তে ভেসে যাওয়া ফ্লোরের উপর নয়নিকার লাশ নিস্তেজ ভাবে পড়ে আছে। চোখের কোটর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। দুইহাত কেটে কোলের উপর রাখা। মাথার চুলের অবশিষ্টাংশও বাকি নেই। এমন চোখ আর হাতবিহীন নয়নিকার বিভৎস লাশ দেখে ইনশিতার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। রেলিংয়ে নিজের শরীরের ভর রেখে দাঁড়িয়ে আছে ইনশিতা। বুক কাঁপছে তার। নয়নিকার মুখটা একদম তার দিকেই ঘুরানো। যেন চোখবিহীন রক্তমাখা চেহারা নিয়ে ইনশিতাকে পর্যবেক্ষণ করছে সে প্রখর ভাবে।
ইনশিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। জেহেরের বিরক্ত লাগল ইনশিতার এত কান্না দেখে। ইনশিতার হাত ধরে জোরে নিজের দিকে টান মেরে ঘুরালো।
-“এই মেয়েটা তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল আর তুমি কিনা তার জন্য কাঁদছো? নট ফেয়ার রোজ। ইউ হ্যাভ টু এনজয় দিস মোমেন্ট।”
ইনশিতা খেয়াল করল জেহেরের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। উচ্ছাস উপচে পড়ছে তার চোখমুখ থেকে। যেন এখনকার ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিক তার কাছে। ঘৃণা হলো ইনশিতার। মুখ ফিরিয়ে নিলো। ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল ইনশিতা,
-“আমি অবাক হচ্ছি আপনাকে দেখে। আপনার মধ্যে কী কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না? কী করে আপনি এনজয় করতে বলছেন?”
জেহের ভাবলেশহীন গলায় বলল,
-“অপরাধীরা শুধু তাদের শাস্তি পেয়েছে। কর্মের ফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। এতে তো আমার কোনো অপরাধ দেখছি না।”
-“আপনি দেখবেন কীভাবে? আপনি তো একটা জন্তু জানোয়ার। তারা যা করে সেটাকেই ঠিক ভাবে।”
জেহেরের শান্ত দৃষ্টি এবার শক্ত হয়ে আসলো। শীতল গলায় বলল,
-“যা বলার ভেবেচিন্তে বলবে। জবান সামলাও।”
ইনশিতার গা জ্বলে উঠল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“গায়ে লাগছে না খুব? হ্যাঁ? সত্যি কথা বলেছি দেখে গায়ে লেগেছে নাকি? বলেছি, বেশ করেছি। একশোবার বলব। তুই জানোয়ার, তোর মধ্যে কোনো হৃদয় নেই, তুই একটা হৃদয়হীন পশু। কী করবি বল? মারবি আমায়? মারবি? তোর মতো জানোয়ারের থেকে এটাই আশা করা যায়।”
ইনশিতার মুখের বেঁধে রাখা লাগাম ছুটে গেল। সে নিজেও জানে না কী বলছে। বাবার অবস্থা আর নয়নিকার লাশ দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। মাথা অগোছালো হয়ে গিয়েছে। আর এসবের জন্য তার কাছে একমাত্র দায়ী জেহের। আর তাই সে মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।
জেহেরের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। তীব্র রাগের আগমন ঝিলিক দিচ্ছে তার চোখে। চোখ বন্ধ করে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বিড়বিড় করল সে,
-“কন্ট্রোল জেহের, কন্ট্রোল। রোজ অতি শোকে পাগল হয়ে গিয়েছে, ভুলভাল বকছে। তাই তোকেই তোর রোজকে সামলাতে হবে। কন্ট্রোল।”
কিন্তু জেহেরের এই রাগ আর কন্ট্রোল থাকলো না ইনশিতার একটি বলা কথাতে।
-“থাকবো না আমি তোর সাথে। চলে যাব আমি। তোর মতো জানোয়ারের সাথে থাকা মানে নিজের লাইফটাকে নরকে রাখা। চলে যাব।”
জেহের ঝট করে চোখ খুলল। রোজ যাই বলুক না কেন, তার থেকে দূরে যাওয়ার কথা বলল কোন সাহসে? এটা জেহের কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। এতক্ষণের পুষে রাখা রাগ বেরিয়ে আসতে চাইল। রাগের তেজ ক্রমশই বাড়ছে তার। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল ইনশিতার দিকে। কথার মাঝে হঠাৎ জেহেরের হিংস্র চাহনি দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল ইনশিতা। এতসময়ের সব রাগ নিমিষেই রূপ বদলিয়ে ফেলল। যেন সে এতক্ষণে হুশে আসলো। জেহেরের রাগের পরিণাম তার অজানা নয়। এতক্ষণ কীভাবে জেহেরকে সে এসব বলল? বুকের ভেতর ধুপধাপ পা চালিয়ে ভয়েরা জমা হচ্ছে। কিন্তু এখন তো আর নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে পারবে না সে। তাকে যে যেতেই হবে জেহেরের সান্নিধ্য হতে বহুদূর। একজন ক্রিমিনালের সাথে সে কখনোই বাকি জীবন কাটাতে পারবে না।
এদিকে জেহেরকে ডিঙিয়েও যেতে পারবে না। হাতে আর কপালে নীল রগ ভেসে রাগের আভাস জানান দিচ্ছে। ফর্সা মুখে আগুনের ফুলকি ছাপিয়ে উঠছে। তা দেখে ইনশিতার মন সংশয়ে আলোড়িত হয়ে উঠল। ভেবে পেল না এই মুহূর্তে সে কী করবে! ঠিক তখনই চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে অকল্পনীয় কাজ করে বসল। মোমবাতি নিয়ে টেবিলটায় আগুন ধরিয়ে দিলো সে। দাউদাউ করে জ্বলে উঠে শুভ্র কাপড় কৃষ্ণবর্ণের ছাইয়ে পরিনত হতে লাগল ধীরে ধীরে। জেহের আর ইনশিতা টেবিলটার দুদিকে ছিল। আর আগুন ছলকে পড়ছিল জেহেরের সাইডটায়। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ইনশিতা দৌড়ে ঘরটার বাহিরে চলে আসলো।
আগুন অল্প ধরলেও টেবিল অতিক্রম করে দরজায় যাওয়ার রাস্তা নেই। মেজাজ বিগড়ে গেল জেহেরের। সময় ওয়েস্ট না করে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে লাফ দিলো নিচে। রেলিংটা তেমন উঁচু ছিল না তাই পড়লেও কোনো ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জেহের হাত ঝেড়ে ঘরের সামনের দিকটায় লম্বা লম্বা পা চালালো। রাগে তার চোখ থেকে যেন অগ্নি প্লাবিত হচ্ছে। হাত মুঠ করে রেখেছে। এই জঙ্গলের মধ্যে রোজ আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? ঠিক ঠিক জেহেরের কাছেই ফিরতে হবে।
ইনশিতা মেইন গেইট পেরিয়ে খেই হারিয়ে ফেলল। এখানকার রাস্তায় নিয়নের আলো নেই যে দিক খুঁজে বের করা যাবে। এত অন্ধকারে কিছু ঠাওর করা গেল না। মোবাইলের ফ্ল্যাশও অন করলেও বিপদ। তাতে জেহেরের তাকে খুঁজে পেতে সহজ হবে। একহাতে মোবাইল আরেক হাতে শাড়ি ধরে জঙ্গলের দিকেই দৌড় মারল সে। এই জঙ্গলে লুকোবার হাজারো জায়গা আছে। সেখানেই সে লুকাবে।
এদিকে শীতটাও কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। হাত পা জমে বরফ হবার জোগাড়। ঠকঠক কাঁপুনি শরীরে জড়িয়ে প্রাণপণে ছুটছে ইনশিতা। জেহেরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তাকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিচ্ছে সে। না, সে কখনোই এমন খুনির কাছে যাবে না যে কিনা তার বাবাকে মারার চেষ্টা করেছে।
জঙ্গলের রাস্তায় দৌড়াতে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে প্রচুর ইনশিতার। একেক জায়গায় লতাপাতা, ডালপালা ছড়ানোর কারণে দোড়ানো যাচ্ছে না। তার উপর শাড়িটাও গা থেকে খুলে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।
ইনশিতা কোথায় কোথায় দৌড়াচ্ছে তা জেহের খুব সহজেই বুঝে যায়। নিস্তব্ধ জঙ্গলে একমাত্র ইনশিতার দৌড়ানোর জন্য লতাপাতর আওয়াজ আর কিছুরই আওয়াজ নেই। তাই জেহের সেই আওয়াজ ধরেই ইনশিতার পিছু নিচ্ছে। হাতে তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করা।
ইনশিতা হাঁপিয়ে পড়েছে। কোনপথে সে এসেছে নিজেও জানে না। আসার সময় কয়েকটা গাছের সাথেও জোরে বারি খেয়েছে যার ফলে হাত ছিঁলে গিয়েছে আর কপালেও ব্যথা পেয়েছে। সে যেখানেই যাচ্ছে না কেন জেহেরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। তখনই একটা উৎকট গন্ধ তার নাকে ভেসে আসলো। এতটাই বাজে গন্ধ ছিল যে তার পেটের সবকিছু উগড়ে দিতে চাইল। গন্ধের উৎস খোঁজার জন্য স্ক্রিনটা অন করে দেখল সামনে একটা কুকুর চারটি টুকরায় পড়ে আছে। ভয় পেয়ে গেল ইনশিতা। খুব বাজে ভাবে মারা হয়েছে কুকুরটাকে। যেন সব রাগ এই কুকুরটার প্রতি ঢেলে দিয়েছে। একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল এটা সেই কুকুরটা যেটা একবার বাগানবাড়ির সামনে সে দেখেছিল। সে আর জেহের যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার মুহূর্তে ব্যস্ত ছিল তখন এই কুকুরটাই ডেকে উঠে ব্যাঘাত ঘটায়। ইনশিতার মায়া পড়ে গেল। এমন একটা নিষ্পাপ প্রাণীকে কেউ এভাবে হত্যা করতে পারে? ছিঃ!
এসব ভাবনার মাঝেই সে আবার আওয়াজ পেল। এবার জেহেরের আওয়াজ খুব কাছ থেকে শোনা গেল। আর আলো দেখা যাচ্ছে মৃদুভাবে। তার মানে জেহের খুব কাছে এসে পড়েছে? ভয় পেয়ে গেল ইনশিতা। বুক ধড়ফড় করছে তার। মোবাইলের স্ক্রিন আরেকবার অন করে চারপাশ দেখে অফ করে নিলো তাড়াতাড়ি। দ্রুত একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। লুকোতে না লুকোতেই চারপাশটা আলোকিত হয়ে এলো। জেহের বড় গাছটির সামনেই। আর গাছটির পেছনে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে ইনশিতা।
এক মিনিটের মতো জেহের চুপ থাকল। সে তার বুদ্ধিদীপ্ত নীল চোখ দ্বারা চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নিলো। চারপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। তার মানে রোজ এখানেই লুকিয়ে আছে। এবার সে হিসহিসিয়ে উঠল,
-“এত সহজে জেহেরের থেকে ছাড়া পাবে না। ভালো হবে নিজ থেকে চলে এসো। আদারওয়াইজ তোমার জন্য ভালো হবে না। আই সেইড কাম আউট ড্যাম ইট।”
হুংকার ছাড়লো জেহের। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে জেহেরের হুংকারে সর্বত্র কেঁপে উঠল। ইনশিতা কেঁদে ফেলবার জোগাড়। তার মনে ভয় হতে লাগল এই ভেবে যে, জেহের তাকে সামনে পেলে বোধহয় মেরেই ফেলবে। কান্নার আওয়াজ যাতে জেহেরের কানে না যায় তার জন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। আর এটাই বোধহয় ইনশিতাকে খুঁজে পাওয়ার সহজ রাস্তা বের করে দিল। চুড়ির রিনিঝিনি বেজে ওঠার কারণে জেহের ইনশিতার অবস্থান বের করে ফেলল। এমন একটা কাজে ইনশিতা নিজেই বোকা বনে গেল। সে নিজেই তো নিজেকে ধরা দিয়ে ফেলেছে।
জেহের বাঁকা হাসল। ফ্ল্যাশ অফ করে ফেলল হঠাৎ। কয়েক মুহূর্ত সবকিছু নিরব থাকল। ইনশিতা ভেবে পেল না জেহের হঠাৎ কোথায় চলে গেল! তবে গিয়েছে ভালোই হয়েছে। এবার সে আরো কিছুক্ষণ থেকে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাকে দ্রুত বাবার কাছে যেতে হবে। মা বলেছিল বাবার অবস্থা ভালো নয়। বাবার কথা ভাবতেই অশ্রু কণারা হুড়মুড় করে এসে ভীড় করে ফেলল। ইনশিতা লাইট অন করার জন্য মোবাইলটা হাতড়ে খুঁজতে লাগল। মোবাইলটা সে পাশেই রেখেছিল। অথচ পেল না। অবাক হলো ইনশিতা। দু’হাত দিয়ে মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে সে। অথচ ভেজা মাটি ছাড়া কিছুই হাতে লাগছে না। এদিকে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এই শীতে বৃষ্টি কেন বুঝতে পারল না ইনশিতা। গাছ থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে ইনশিতার শরীরে পড়ছে। শীতে তার শরীর কেঁপে উঠছে। পাতলা শাড়িতে শীত মানছে না। তবুও কম্পিত শরীর নিয়েই ভেজা মাটিতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। হাত জমে বোধহয় বরফ হয়ে যাবে।
মোবাইল যখন পেল না তখন ইনশিতার মনে হুট করে ভয় ঢুকে গেল। ঘোর অন্ধকারে চোখের সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে অন্ধ মনে হচ্ছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নয়নিকার বিভৎস লাশ। চোখ নেই, হাত নেই, রক্তে ভেসে যাওয়া ফ্লোর, চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভয়ে ইনশিতার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল। এই এক সমস্যা, অন্ধকার হলেই দুনিয়ার সব ভুতুড়ে কাহিনী মনে পড়ে। ইনশিতারও তাই। ভুতের কাহিনী, নয়নিকার লাশ এখন তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে তার সামনেই নয়নিকার বিভৎস লাশ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। চোখ বন্ধ করলেও নয়নিকার লাশ, চোখ খুললেও নয়নিকার লাশ। ইনশিতা উঠে দাঁড়াল দ্রুত। শাড়ির আঁচল মুঠ করে ধরল। কী করবে বুঝতে পারল না। এই শীতেও তার শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। এখান থেকে বেরোতে হলে সকালের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে আর একটু থাকলেই সে হার্ট অ্যাটাক করে বসবে।
ইনশিতা আন্দাজে যেই এক পা এগোলো অমনি কপালে আবার বারি খেল। কপালে হাত দিয়ে সেই গাছটার কাছে হাত নিলো। গাছ ধরে ধরে যেতে হবে। বিরক্ত আর ভয় নিয়ে গাছটা ধরতে গেল। গাছের মধ্যে না জানি সাপ জড়িয়ে আছে! হাত গাছের মধ্যে লাগতেই ভয়ের শীতল শ্রোত বয়ে গেল ইনশিতার শরীরে। গাছটা একদম মসৃণ লাগছে। আর কেমন চওড়া। ইনশিতা এবার ভয় নিয়েই দুহাতে গাছটা আকড়ে ধরতেই চমকে উঠল। এক হাত উঁচু করে গাছ ধরল। যখন বুঝতে পারল এটা গাছ না তখনই হাত ছিটকে সরিয়ে নিতে চাইল। তার আগেই কিছু একটা তার হাত শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। ইনশিতা এবার জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল। কারো হাত তার মুখ চেপে ধরে নিজের বুকে চেপে ধরল জোরালো ভাবে। শক্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
-“এবার কোথায় যাবে? বেশ তো চাইলে পালাতে। পেরেছো? তোমাকে বহুবার বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে না যেতে। তুমি আমাকে গালি দেও, মারো যা ইচ্ছে তাই করো। বাট ছেড়ে যাওয়ার কথা তোমার এই ছোট্ট মাথাতেও আনবে না। কিন্তু তুমি কী করেছো?”
ইনশিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল জেহেরের থেকে। কিন্তু লোহার মতো শক্ত বাঁধন থেকে ছুটতে পারল না। ইনশিতার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরল জেহের। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-“আমার পুরো কথা না শুনেই আমার থেকে পালিয়ে আসলে! আর এসেই বা কী হলো? শুধু শুধু এত কষ্ট করার দরকার কী ছিল? সেই তো আমার কাছেই আসতে হলো।”
ইনশিতা রাগে ফেটে পড়ে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলল। জেহের পাত্তা দিলো না। ইনশিতাকে জড়িয়ে ধরে ফ্ল্যাশ অন করে এগিয়ে যেতে লাগল। শাড়ির কারণে বারবার হোঁচট খেয়ে চলছে ইনশিতা। মুখ আর হাত দুটোই জেহেরের হাত দ্বারা বন্দী। এবার হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কুচিটাই খুলে গেল। ইনশিতার বিরক্ত হবার থেকে বেশি জেহের বিরক্ত হলো। কোলে তুলে নিলো ইনশিতাকে। মুখ ছাড়া পেয়ে ইনশিতা এবার বিরামহীন চিৎকার দিতে লাগল আর মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল। জেহের চোখ গরম করে তাকাল। ইনশিতাকে নামিয়ে বাহু ধরে জোরে ঝাঁকাল ইনশিতাকে। শক্ত করে বাহু চেপে ধরায় ব্যথায় কুঁকড়ে গেল ইনশিতা। জেহেরের রাগ এখনো কমেনি। উল্টো ধীরে ধীরে যেন বাড়ছেই। কেমন ভয়ানক দেখাচ্ছে তাকে। কটমট করে বলল,
-“এইজন্যই তোমাকে কোলে নিতে চাইনি। কোলে নিলেই সাপের খেলা দেখানো শুরু হয়ে যায় তোমার। যাস্ট অ্যানোয়িং!”
বলেই শড়িটার কুচি খুলে দেওয়া জায়গাটায় জোরে টান মেরে দিলো। পাতলা হওয়ার দরুন শাড়িটা নিমিষেই ছিঁড়ে গেল। আর সুরসুর করে শাড়িটা ইনশিতার শরীর থেকে নেমে মাটিতে গিয়ে পড়ল। ইনশিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগতেই কেঁপে উঠল সে। জেহের নিজের জ্যাকেট খুলে ইনশিতার জড়িয়ে আবার কোলে তুলে নিলো।
রাস্তায় আসলে জেহের গেইটের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। তার চোখেমুখে এখনো রাগের আভাস স্পষ্ট। ইনশিতা হঠাৎ করে ব্যথায় কাতরিয়ে উঠল। জেহের হতচকিত হয়ে ইনশিতার মুখপানে তাকাল। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আছে সে। ভ্রু কুঁচকালো জেহের। গম্ভীর গলায় বলল,
-“হোয়াট হ্যাপেন?”
ইনশিতা কিছুই বলল না। ইশারায় পা দেখিয়ে দিলো। ইনশিতার ইশারায় পা দেখতে গিয়ে জেহের হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়ল। ইনশিতাকে রাস্তায় বসিয়ে সে তাড়াতাড়ি পায়ের কাছে গেল। পায়ের পাতায় কাঁটার মতো কিছু একটা ঢুকে গেছে। ইনশিতা আর্তনাদ করছে। কাঁটা বের করতে গিয়ে জেহের বারবার ইনশিতার মুখপানে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য সে তার রাগের কথা ভুলে গেল। একটানে কাঁটা বের করে নিলে ইনশিতা শক্ত করে জ্যাকেট খামচে ধরে। জেহের ইনশিতার মুখটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অস্থির হয়ে বলল,
-“কিচ্ছু হয়নি। যাস্ট একটা কাঁটা বিঁধেছে। ঠিক হয়ে যাবে, রিল্যাক্স রোজ।”
ইনশিতা কাতরাতে থাকে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জেহের উতলা হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি ঘরে নিতে হবে রোজকে। যেই কোলে তুলে নিতে যাবে অমনি বিকট আওয়াজ করে তীব্র আলোর ঝলকানি জেহের আর ইনশিতার চোখে এসে পড়ল। জেহের হাত দিয়ে আলো আটকিয়ে দেখার চেষ্টা করল।
দেখল কয়েকজন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। এই জঙ্গলের রাস্তায় কখনোই কেউ আসে না। তাহলে এরা কারা? তবে জেহেরের এত কিছু ভাবার টাইম নেই। রোজের পায়ে তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করতে হবে। রোজের আর্তনাদ তার সহ্য হয় না।
তাদের সামনে কয়েকজন এসে ঘিরে ধরলে ইনশিতা মাথা তুলে দেখল পুলিশ। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। পুলিশ কেন আসলো এখানে? জেহের বিরক্ত হলো। ইনশিতাকে রেখেই দাঁড়িয়ে পুলিশদের দিকে চোখ ফেরাল। শক্ত গলায় বলল,
-“হোয়াটস দ্যা প্রবলেম?”
পুলিশ নির্বিকার তাকে চেয়ে দেখল। কনস্টেবল হাতের ইশারায় কয়েকজনকে বাড়ির মধ্যে পাঠাল। কিছুক্ষণের মাঝেই পুলিশের কয়েকজন ট্রলিতে করে নয়নিকার লাশ নিয়ে আসলো। এবার ইন্সপেক্টর মুখ খুললেন,
-“চলুন মিঃ চৌধুরী। আপনাকে নতুন ঠিকানায় যেতে হবে।”
জেহের ভ্রু কুঁচকায়। বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“হোয়াট?”
ইন্সপেক্টর নির্বিকারভাবেই বললেন,
-“আপনার নামে মার্ডার কেস আছে। মিস নয়নিকাকে নৃশংস ভাবে খুন করার।”
জেহেরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
-“এনি প্রুভ?”
-“অফকোর্স মিঃ চৌধুরী। কাশেম, দেখাও তো একে।”
কাশেম নামের লোকটি একটি ভিডিও চালু করল যেটাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জেহের নয়নিকার হাত কাটছে, ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আর ভিডিওতে সেই ড্রেসই যেটা এখন পরে আছে সে। ভিডিও দেখে জেহের কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল।
-“চলে যান আপনারা।”
ইনশিতা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বুঝতে পারছে না পুলিশকে খবর কে পাঠাল? তবুও যেন একটু সাহস পেল। তার বাবাকে মারার প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ যেন নিজ থেকে এসেই ধরা দিয়েছে। সে প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,
-“এই জানোয়ারকে ধরে নিয়ে যান, শুধু নয়নিকাকে নয়, আমার বাবাকেও মারার চেষ্টা করেছে।”
ইন্সপেক্টর বলল,
-“বাহ! দেখলেন মিঃ চৌধুরী? আপনার স্ত্রীও কিন্তু আপনার বিপক্ষে। আপনার নামে আরও একটাও কেস যোগ হলো। ভালোয় ভালোয় চলুন।”
জেহের এবার শীতল চাহনি নিক্ষেপ করল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা অনুভব করল জেহেরের রাগের তেজ। জেহের শান্ত গলায় বলল,
-“কোথাও যাবো না আমি। আবারও বলছি চলে যান আপনারা।”
কথাটি সম্পূর্ণ ইনশিতার দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে বলল। ইন্সপেক্টর হাসলেন।
-“জানতাম আপনি সহজে মানবেন না। তাইতো পুরো ফোর্স নিয়েই এসেছি। আপনাকে ধরা যে কঠিন, তাই প্রস্তুতি নিয়েই আসলাম।”
তখনই আওয়াজ তুলে আরো দুটো পুলিশের গাড়ি আসলো। জেহের ইনশিতার দিকে তাকাল। ইনশিতার চোখে মুখেও রাগ। এতগুলো লোকের সামনে রোজ দাঁড়িয়ে আছে এটা তার ভালো লাগল না। তাও আবার একটা জ্যাকেট আর পেটিকোট পরা। সে ইনশিতার হাত টেনে ধরেই ঘরের দিকে ফিরে যেতে নিলে কয়েকজন পুলিশ এসে জেহেরকে পেছন থেকে জাপটে ধরে।
ইন্সপেক্টর বলেন,
-“ভালোয় ভালোয় এসে পড়ুন মিঃ চৌধুরী। তাহলে এত নাটক সহ্য করতে হবে না।”
জেহেরকে ধরায় সে বেশ রেগে গেল। তার গায়ে অন্য লোকেরা টাচ করুক এটা তার খুবই অপছন্দনীয়। ইনশিতাকে ছেড়ে একজনের হাত মুচড়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর হুড়মুড় করে ইন্সপেক্টর সহ সবাই এসে জেহেরকে ধরল। জেহেরের রাগ এবার তুঙ্গে। একজনের পেট বরাবর লাথি দিয়ে বসল সে। তখনই একজন পুলিশ সুযোগ পেয়ে গুলির পেছনভাগ দিয়ে জেহেরের মাথায় জোরে আঘাত করল। জেহের একহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলে ইন্সপেক্টর দ্রুত মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো জেহেরকে। জেহেরের মাথা থেকে রক্ত পড়ছে কিছুটা। সকলেই টেনে হিঁচড়ে জেহেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো।
ইনশিতা হতবাক দর্শকদের ভূমিকা পালন করল শুধু।জেহেরকে ধরে নেওয়ায় সে খুশি হয়েছিল বৈকি। তবে জেহেরকে যখন মারা হলো তখন ইনশিতার ইচ্ছে হলো ছুটে নিয়ে গিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। তার কান্না পেয়ে গেল। অজান্তেই তার কপোল গড়িয়ে নোনাজল বেয়ে পড়ল। তার কষ্ট হতে লাগল। ভেঙেচুরে যেতে লাগল ভেতরটা। যেখানে জেহেরকে শাস্তি পেতে দেখে তার আনন্দ হওয়ার কথা সেখানে দুঃখরা তাকে ঘিরে ধরেছে কেন? কেন এত বুক ভেঙে আসছে? জেহেরের চাহনি কেন এত পোড়ায় তাকে? চোখের সামনে এত প্রমাণ দেখেও কেন মনে হচ্ছে জেহের নির্দোষ? ইনশিতার মন বলছে কোথাও একটা ভুল হয়েছে। কারো প্রহেলিকার জালে সবাই আটকা পড়েছে।
-“ম্যাডাম চলুন আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ইনশিতা চলল তাদের সাথে। তবে তার মন খচখচ করছে। কিছু একটা ভালো হচ্ছে না। ভুল হচ্ছে। অনেক বড় ভুল।
.
.
চলবে…