#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৪|
পাঁচদিন কাঠফাটা রোদের পর আজ সকাল হতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। পিচডালা সড়ক পিচ্ছিল, গাছের পাতা হতে পানির বিন্দু চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। ভীষন সুন্দর আবহাওয়া। প্রিয়ন্তি রিকশা খুঁজে চলেছে। পেল না। বৃষ্টির দিনে রিকশা পাওয়া বড্ড মুশকিল। অথচ পিচ্ছিল রাস্তায় পা ফেলা মানে এই বুঝি হুমড়ি খেয়ে পরল। সিএনজি ধরবে তারও উপায় নেই। যা ভাড়া আজকাল সিএনজির। আকাশচুম্বী ভাড়া চেয়ে বসে একেকজন। তাই উপায় না খুঁজে হেঁটেই চলল প্রিয়ন্তি। অর্ধেক রাস্তা পাড় হল। হঠাৎ একাকী এক গলির পথে হেঁটে যাবার সময় হঠাৎ পথ আটকালো লিমন ও তার সঙ্গপাঙ্গ। প্রিয়ন্তি ভয় পেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। ডান কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগের ফিতে শক্ত করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
‘ পথ আটকেছেন কেন আমার? ‘
লিমন দাত কেলিয়ে হেসে উঠল। দুদিন ধরে হাসতেও কষ্ট হচ্ছে। মুখের মধ্যে সেদিন দু চার ঘা খেয়েছে। মুখ বোধহয় বেঁকে-টেঁকে গেছে। আয়না দেখেনি। আজ প্রিয়ন্তির গা নোংরা করে বাসায় গিয়ে আয়না দেখবে। ক্লিন শেভ করে ভদ্র মানুষের বেশ ধরবে। লিমন এবং তার দলের দুজন লোকেরা প্রিয়ন্তির আশেপাশে চক্রক্রারে ঘুরতে শুরু করল। প্রিয়ন্তি এদের মাঝখানে আঁতকে উঠে হতভম্ব হয়ে পরল। লিমন বলল,
‘ নাগর দিয়া আমারে মা”ইর খাওয়াও। আজ যদি তোর গা ছুঁয়ে নোংরা না করছি তয় আমার নাম লিমন না। ‘
পাশ থেকে ওহী বলল,
‘ হ, ভাইয়ের নাম আমরা আকিকা দিয়া পালটামু। টাকা কি কম আসে নাকি আমাগো? এক লাখ টাকার গরু ধরমু, বুজসত? ‘
প্রিয়ন্তি এসব কথা শুনে রুহ কেঁপে উঠল। প্রিয়ন্তির গা কাঁপুনি দেখে লিমন উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল,
‘ ডরাইস না, ডরাইস না। ব্যথা পাবি না একদম। ফুলেরে ছুঁইতে গেলে কেউ ব্যথা দেয়? ‘
লিমন প্রিয়ন্তির ওড়নার অগ্রাংশ চেপে ধরে প্রিয়ন্তির কানের কাছে ঝুঁকে এসে বিশ্রী কণ্ঠে বলে,
‘ ব্যথা দেয় না। বরং ফুলের গা হইতে পাপড়ি খুবলে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। আর বাঁচতে দেয় না ওরে। ‘
প্রিয়ন্তি বুঝতে পারল, অবস্থা বড্ড খারাপ জায়গায় যাচ্ছে। সম্পূর্ণ একা একটি মেয়ে, গলিতে মানুষের খোঁজ নেই। এমন অবস্থা একটি মেয়েকে কেউ ছিঁড়ে খেলে কাকপক্ষীও টের পাবে না। প্রিয়ন্তি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করল। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করার কিঞ্চিৎ চেষ্টাও করল বটে। অতঃপর শেষবারের ন্যায় আশপাশ পরখ করে বলল,
‘ আমাকে ছাড়ুন। নয়ত আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করব। ‘
‘ করো। চিৎকার করো। তোমার ঐ সুরেলা চিৎকার শুনলেও তো প্রাণ শান্তি পায়। ‘
প্রিয়ন্তি বুঝতে পারল, তার গলা ফেটে চিৎকার করে কেউ শুনবে না। প্রিয়ন্তি এক হাতে ব্যাগের ফিতে চেপে ধরে অপরহাতে ওড়না চেপে ধরল। লিমন এগিয়ে এল। প্রিয়ন্তির গা থেকে ওড়না এক টানে সরিয়ে ফেলতেই প্রিয়ন্তি তাকে ব্যাগ তুলে আঘাত করল লিমনের চোখে। ব্যাগের নিচের দিকে একটা সরু রাবারের অংশ বেরিয়ে ছিল সে অংশ লিমনের চোখে এসে আঘাত করল। লিমন চোখ ডলে ছটফটিয়ে উঠল। দলের লোকেরা প্রিয়ন্তিকে ছেড়ে লিমনকে নিয়ে মগ্ন হয়ে পরল। এ ফাঁকে প্রিয়ন্তি দৌঁড়ে পালাতে লাগল। লিমন চোখে বেশ ব্যথা পেয়েছে। তবুও প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ হয়ে চিৎকার করল,
‘ ওই শালিরে ধর। পালাতে যেন না পারে। ‘
লিমনের দলের লোকেরা তার কথা শুনে প্রিয়ন্তির পিছু ছুট দেয়। প্রিয়ন্তি ওড়নাবিহীন দৌঁড়াতে থাকে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সিএনজি পায়। দ্রুত আগপিছ চিন্তা না করে সিএনজিতে চেপে বসে। হাপাতে হাপাতে সিএনজিচালককে বলে,
‘ চা-চাচা, শ-শান্ত মরিয়ম ইউনিভার্সিটি যান। দ্র-দ্রুত, দ্রুত যান,চাচা। ‘
সিএনজিচালক যেতে ইচ্ছে না হলেও প্রিয়ন্তির ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে আর বারণ করতে পারলেন না। প্রিয়ন্তির ওড়নাবিহীন জামা, এলোমেলো চুলের বিন্যাস দেখে তিনি আন্দাজ করতে পেরেছেন, মেয়েটা বিপদে পরেছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব ইঞ্জিন চালু করে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে লাগলেন। প্রিয়ন্তি সিএনজিতে বসে হাঁপাচ্ছে। বারবার সিএনজি থেকে বাইরে মুখ বের করে দেখছে, কেউ পিছুপিছু আসছে কি না! না, কেউ নেই। আসছে না কেউ। প্রিয়ন্তি বুকে হাত চেপে মুখ ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিল। গায়ে ওড়না নেই বিষয়টি খেয়াল হলে ব্যাগ বুকের সামনে ঝুলিয়ে নিল। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে চোখে মুখে পানি ছেটাল। সিএনজি চালক এসব দেখে সামনে থেকে বললেন,
‘ আপনারে কেউ ধাওয়া করছিল? ‘
প্রিয়ন্তি সিটে হেলান দিয়ে গা ছেড়ে দিল। বুকের ভেতর এখনো ধপাস ধপাস করছে। এই বুঝি চোখ বুজে এল! প্রিয়ন্তি মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ কিছু কুকুর ধাওয়া করেছে। ‘
সিএনজিচালকের বিষয়টি বিশ্বাস হল না। বলল,
‘ কুকুরের ধাওয়া খাইয়া এই অবস্থা? ‘
প্রিয়ন্তি আর কথা বাড়াল না। চোখ বুজে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। আল্লাহ আজ না বাঁচালে….কি হত? ভয়ে এখনো গা কেঁপে উঠছে প্রিয়ন্তির!
__________________________
সিএনজি থেকে নেমে দৌঁড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর চলে গেল প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তিকে আসতে দেখে এগিয়ে এল নিপা এবং দৃষ্টি। প্রিয়ন্তি আপন মানুষকে দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঝাঁপিয়ে পরল নিপার গায়ের উপর। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। নিপা ভীষন অবাক হল। দৃষ্টি প্রিয়ন্তির পিঠে হাত বুলিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ কি হয়েছে রে? এত ভয় পেয়েছিস কেন? ‘
প্রিয়ন্তি আর চোখের জল আটকে রাখতে পারল না। শব্দ করে শরীর ঝাঁকিয়ে কেঁদে ফেলল। প্রিয়ন্তির ন্যায় কঠিন হৃদয়ের মেয়ের চোখে কান্না দেখে বেশ খানিক অবাক হল নিপা এবং দৃষ্টি। নিপা তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ এই মেয়ে? কাঁদছিস কেন? এখানে বস। শান্ত হ একটু। আল্লাহ! ভয় পেয়ে চোখ মুখ লাল কর ফেলেছিস? কি হয়েছে তোর? ‘
নিপা প্রিয়ন্তিকে একস্থানে বসাল। নিপা পানি দিল প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তি পানি খেল। এক পানির বোতল খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। নিপা প্রিয়ন্তির মাথায় কিছু পানি ছেটাল। মাথার তালু গরম হয়ে গেছে। বোধ হচ্ছে ধোঁয়া উড়ছে। প্রিয়ন্তি কিছুটা শান্ত হল। দৃষ্টি তার চাদর প্রিয়ন্তির গায়ে মেলে দিল। প্রিয়ন্তি এখনো কাঁদছে। ভয় পেয়েছে ভীষন। কান্না থামতে চাইছে না। বুকের ভেতর অস্থির বোধ হচ্ছে তার। নিপা এবং দৃষ্টি আশ্বস্ত করল প্রিয়ন্তিকে। কিছুটা শান্ত হয়ে একে একে কাহিনী সব খুলে বলল। নিপা ও দৃষ্টি এসব শুনে হতভম্ব হয়ে পরল। নিপা বলল,
‘ আল্লাহ! শুনেই তো আমার হাত পা কাঁপছে। তুই কি করে বেঁচে এসেছিস? ‘
দৃষ্টি বলল,
‘ আল্লাহ এবার রক্ষা করেছেন। নয়ত…. ‘
প্রিয়ন্তির চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে মৃদু স্বরে বলল,
‘ এসবের মূল কারণ হচ্ছে মাহতিম। আমি ওকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি ওকে। আমার জীবনের সুখ শান্তি সব নষ্ট করে দিয়েছে সে। আজকে যদি আমার কোনো ক্ষতি হত তবে সে দায়ী থাকত। আমার আর ভালো লাগছে না। এই কলেজে পড়তে ইচ্ছে করছে না। দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কি করব? কোথায় যাব? এতটা টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছি। উফ! মাথা ধরছে আমার! ‘
#চলবে