প্রিয় অপরিচিত পর্ব -০৪

#প্রিয়_অপরিচিত [০৪]

পাত্র বদল হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে চরম আশ্চর্যের লাগছে!
আর কাকতালীয়ভাবে পাত্র বদল হয়ে যাওয়াকে আমার ভাগ্যের সাথে মিলাতে শুরু করে দিয়েছি। সত্যি সত্যিই যদি উনি আমার সেই অপরিচিত হয়ে যেতো, নিজেকে ধন্য মনে করতাম! আর এ জীবনে আমি বোধহয় নিজেকে একজন সার্থক মানুষ বলে গণ্য করতাম!
এমনকি এটার আশংকায় মনে মনে আল্লাহর কাছে বিভিন্ন রকম প্রতিজ্ঞা করে ফেলছি, তাকে পেলে সব পাপকর্ম ছেড়ে দিবো, বদলে নেবো সব খারাপ অভ্যাস! সাথে জীবনের সব অন্যায় কাজের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকার করবো। এসবের বিনিময়ে শুধু আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার যাক,একদম চিরদিনের জন্য আমার হয়ে যাক, বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন তার সাথেই শুরু হোক, আর তার সাথেই শেষ হোক!

কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষজন এবং সকল বরযাত্রী আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকলো। আমি লুকিয়ে অবশ্য বরকে দেখতে কয়েকবার উঁকি মেরেছি কিন্তু অপ্রয়োজনীয় মানুষ ছাড়া কাউকেই দেখিনি! তবে দেখার মধ্যে বাবার মুখটা স্পষ্টই দেখেছি, মনে হচ্ছে বাবা বিয়ে একদম রাজী। মুখটার ফ্যাকাসে ভাব ইতোমধ্যে কেটে গেছে।
আমি পাত্রকে এক নজর দেখার জন্য আসন ছেড়ে যেতেও পারছিনা, আবার অন্যভাবে দেখারও কোনো অপশন পাচ্ছিনা।
তারই মধ্যে তাড়াহুড়ো করে মা সামনে একটা পর্দা টানিয়ে বললো,
‘ সরো সবাই, বড় হুজুর আসছে, বিয়ে পড়াবে।

আমি পুরো থমকে গেলাম, কি হচ্ছে এসব? আমাকে কিছু না বলে, না জানিয়ে পাত্র বদল করে এতো দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!? যার সাথে দেখা তো দূরে থাক মুখের কথাটাও পর্যন্ত হয়নি! মাও আমাকে এটা আলাদা করে জানায়নি! তারা কি চাচ্ছে আমি না জানি? কিন্তু আমি তো জেনেই গেছি। সবাই এমন ছলচাতুরী কেন করছে?

পারলাম না কোনো কথা বলতে, বড় হুজুর কাজীর দায়িত্বে বিয়ে পড়ালেন, এতগুলো মানুষের দিকে তাকিয়ে আর কোনো উপায় ছিলোনা। তবে এই বিয়েকে মেনে নিলাম! এমনিতেও তো আমার সে অপরিচিত ছাড়াই একজনকে বিয়ে করতে হতো, সেখানে সে আর ভিন্ন কি?
তারপর তাড়ার মধ্য দিয়েই বরযাত্রীর খাবার পরিবেশন হলো, খুব অল্প রীতি মেনে ছবি তোলাকেও সীমিত পরিসরে টেনে নিলো। আর অনেক রাত হওয়ার আগে আগেই বিদায় পর্ব চলে এলো। অদ্ভুত হলেও সত্য, বর ওইদিকের ঝামেলা সামলাতেই হিমসিম, তাই এইখানে কনে পর্যন্ত আসার ভাগ্য তার হয়নি। তার আগেই বিদায় নেওয়ার জন্য বরযাত্রীরা তাড়া করছে। এমনিতেই রাত হয়ে গেছে, যেখানে সন্ধ্যার আগেই তাদের বউ নিয়ে ফেরার কথা!
তাই সবকিছু কোনো রকম সামলে ফিরতে চাচ্ছে৷

আমি আমার বাড়িতে থাকাকালীন আমার নতুন বরকে দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছি, একদম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দেখা হবে, কাঙ্ক্ষিত সে হলে তো কথাই নেই। নাহলে উনার ভাইয়ের মতো উনাকেও আমার ভালোবাসার গল্প শুনিয়ে দূরে থাকার অনুরোধ করতে হবে। কি জানি এসব শুনে কেমন মেজাজ দেখায়!? সবাই তো আর এক মানসিকতার হয়না।

বুক দুরুদুরু করছিলো, সাথে একঝাঁক ভয় ও আতঙ্ক! আবার অল্প আশার সঞ্চার করা মন নিয়ে ভীষণ কান্নাকাটিতেই আমার বিদেয় হলো। মা বোধহয় আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তা করছিলো। নিজের অপছন্দে বিয়ে করে সংসারে মনোযোগ দিতে পারবো কিনা এটা নিয়ে মা’দের চিন্তা থাকাটাই স্বাভাবিক। বাবাও মেয়েকে পাত্র বদলের সংবাদ না বলার অপরাধে চুপচাপ হয়ে আছেন, আমার অগ্রহণযোগ্য আশঙ্কাকে বাবা ভয় পাচ্ছিলেন মনে হয়।

আমাকে বরের পাশেই বসানো হয়েছে, কিন্তু ঘোমটা খোলে দেখার পরিস্থিতি পাইনি। উনিও বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছেন, কোনো প্রকার কথাও বলেনি।

তাদের বাসায় পৌঁছলাম ৮ টায়,খুব এক হইহট্টগোল অবস্থা এখানে নেই। কেন নেই আমি জানিনা, তবে থাকার কথা ছিলো। প্রথমত পাত্র পালিয়ে গেলো,তারপর আবার তারই ছোট ভাই বিয়ে করলো! সেটাও বেকার পাত্র, সব মিলিয়ে অনেক ঝামেলা বটে। কিন্তু ঘটনার তুলনায় এমন কোনো ব্যতিক্রম টান কারোর মধ্যেই নেই, অল্প সংখ্যক যারা উপস্থিত আছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা অন্য রকম কিছু দেখছেনা। যেন যার সাথে বিয়ের কথা ছিলো আর তার সাথেই হয়েছে। এখানে কৌতূহলের কিছু নেই।

আমার বরের বড়ভাই,মানে যার সাথে বিয়ে করার কথা ছিলো, যে কিনা বলেছিলো আমাকে বিয়ে করা তার জন্য অতীব জরুরী,তার কোনো হদিস নেই এখনো । উনিই জানে কেন এই জরুরী বলেছিলেন,আবার কেনই পল্টি মেরে আবার পালিয়েছেন! উনার ফোন বন্ধ সাথে সব রকম যোগাযোগ থেকেও বিচ্ছিন্ন। সবার কথা অনুযায়ী জানলাম উনার তেমন কারো সাথে সম্পর্কও ছিলোনা, মা-বাবার সিদ্ধান্তের উপর বেশ দায়িত্বশীলও ছিলেন, কিন্তু এভাবে পালিয়ে যাওয়াটা তাদের ভাবনার বাইরে ছিলো, উনার মা তো কেঁদে কেঁদে বারবার বলছে,
‘আমার মানিকের কোনো সমস্যা হয়েছে ও কোনো বিপদে পড়েছে, কিংবা কেউ ওকে জোর করে আঁটকে রেখেছে। আমার ছেলে তো এই কাজ করার মানুষ না৷

উনার বোনও মার সাথে সায় দিচ্ছে আর বলছে,
‘ বড়ভাই আসলেই এমননা। নিশ্চয়ই কেউ উনার সাথে ষড়যন্ত্র করছে।

আমি সবার কথাগুলো অদ্ভুতভাবে নিচ্ছি, এমন কিছু করার হলে তো একমাত্র আমিই করতাম, কেননা বিয়েটা আমার অমতে হচ্ছিলো, আর সেই পাত্রকে শায়েস্তা করার যথেষ্ট কারণও ছিলো, কারণ তিনি আমার সাথে বড় রমমের চিটিংবাজি করতে যাচ্ছিলেন, যেখানে আমিই কিছু করিনি, সেখানে উনাকে আর কে বিপদে ফেলবে? অবশ্যই অবশ্যই পালিয়ে গেছে উনার নিজ ইচ্ছায়, উনার প্রিয় কারো সাথে! যার কথা পরিবারে বলার সাহস নেই৷

এরই মধ্যে আমি বারবার সব মানুষের ভীড়ে একটা আকাঙ্ক্ষিত মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছি, বরের প্রতি এতো আগ্রহের কারণ একটাই উনি আমার অপরিচিত কিনা!

১০ টার দিকে ননদের সাথে বিয়ে পূর্বকালীন কথায় মশগুল ছিলাম, হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে একজন গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ তোয়ালেটা দে আমার!

আমি চমকে উঠলাম, বেশ ভারী স্বর। চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম শ্যাম বর্ণের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের একটা ছেলে দরজায় নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে শ্যাম্পুর বোতলের মুখ খুলছে আর লাগাচ্ছে। আধভেজা গেঞ্জি পরনে, বাবরিকাটা চুল, মুখভর্তি দাঁড়ি যা গলা অব্দি ঢাকা। উনাকে দেখে আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছি আমার সেই অপরিচিত দেখতে কেমন ছিলো? শুধু মনে পড়ছে গোল চেহেরা আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি দিয়ে পরিপূর্ণ একটা মুখের একপাশ, বাবরি চুল তো একদমই ছিলোনা। তবে কি সে নয়?
আমি আমার চোখ নামিয়ে ফেললাম! আশারা দল বেঁধে ছুটে চললো, আগ্রহের রেশ অজানা প্রান্তরে দৌঁড়ে পালালো। জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি হাঁটুতে মাথা ঠেকালাম।
শেষ সব শেষ আমার। আমার রুমালটাও নিখোঁজ, ঘুম থেকে উঠে বালিশের নিচে রেখেছিলাম, হতে পারে সেখানেই, আবার হতে পারে বিয়ে বাড়ির কেউ হাত মোছায় ব্যবহার করে ফেলে দিছে৷ আমার হৃদপিন্ড ধুকপুক করতে থাকলো! বারবার ভুলেই যেতে থাকলাম আমি নামক একটা প্রাণীর অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে?

রাত এগারোটা,
চির কল্পিত জায়গায় আসন পেতে বসা আমি! চারদিক সজ্জিত, কল্পনার তুলনায় যা কিছুটা কম জাঁকজমক।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, গলা খাঁকর ছাড়াই তাড়ার সাথে প্রবেশ করলো একজন। কে হবে আমি জানি, তবে চোখ তুলে দেখিনি।
রুমের মাঝামাঝি এসে তার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ আমি জানি আপনি কাউকে ভালোবাসেন, আর এই বিয়েতে আপনার মত ছিলোনা। আমার ভাইয়ারও এই বিয়েতে কোনো আগ্রহ ছিলোনা। সেটা তিনি পূরণ করতে পারলেও আপনি ঠিকঠিক ফেঁসে গেছেন,সাথে আমাকেও ফাঁসিয়েছেন৷ তবে হ্যাঁ আমার প্রাক্তন থাকলেও আপাতত কেউ নেই, আর ভিন্ন মানুষের প্রতি টান থাকা মানুষদের আমি কখনো আপন করিনা, চেষ্টাও করিনা। এমন মানুষ চাই, যে আমার সে শুধুই আমার প্রতি ঝোঁক রাখবে। বুঝতেই পারছেন আমাদের মধ্যে কখনোই কোনো সম্পর্ক হতে পারে না।

আমি আমার ঠোঁটে চিরায়ত খুশির উদ্ভাবন ঘটালাম, ভেতর থেকে অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে সেই হাসি প্রকাশিত হয়! সাথে সাথে ঘোমটাও তুলে ফেললাম।
আমার উপর উনার চোখ পড়তেই উনি জোরে বলে উঠলেন,
‘ আপনাকে চেনা চেনা লাগছে! দেখি দেখি
বা পাশের গালের তিল দুটো অরিজিনাল কিনা!

খুব কাছে এসে উনি আমার তিলটা পরখ করে আরো উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
‘ আমাকে আপনার মনে আছে? ওই যে যানবাহনপূর্ণ রাস্তার মধ্যে আপনি পা মচকে থেমে গিয়েছিলেন। আমি আপনাকে…

আমি চমৎকৃত হয়ে বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার মাথা গিয়ে উপরে টানানো ফুলে ঠেকলো।

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here