প্রিয় অপরিচিত পর্ব -০৬ ও শেষ পর্ব

#প্রিয়_অপরিচিত [০৬]

অনিক আমার বিষন্নতার কারণ বুঝতে পারছেনা, আর না বুঝতে পারছে আমার ভেতরকার ভয়ানক ভাংচুর!
কিন্তু অনিক কি মিথ্যা বলতে পারে? কেনই বা এই মিথ্যের প্রয়োজন তার?

আমি এখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম। অনিক তাকিয়েই রইলো!
সে আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলো আমি যা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমার আর কি বলার আছে? আমি কাল থেকে কতো খুশি ছিলাম, শুধুমাত্র সে আমার অপরিচিত এটা ভেবে।
কিন্তু সে তো অন্য কেউ! যে কিনা তার ভাইয়ের সাথে পরিকল্পনা করে এসে আমাকে ভুল পরিচয় দিতে চেয়েছিলো! কিন্তু আমি বোকা নই, আমি তো তা বুঝে গেছি। কারণ আমি নিশ্চিত রুমালটা আমার প্রিয় মানুষটারই ছিলো। আর অনিক সেই ছেলেটা হলে নিঃসন্দেহে রুমালের কথা ভুলে যেতোনা। আসলে সে অন্য কেউ!

আমি দ্রুত বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে আম্মু আমার মুখোমুখি হলো, খাবার নিয়ে আমার রুমের দিকেই যাচ্ছিলো। আমাকে সামনে দেখতে পেয়ে সেটা আমার দিকে এগিয়ে বললো,
‘ যা জামাইকে দিয়ে আয়।

প্রথমে মানা করলাম যাবোনা।
কিন্তু আম্মু চোখ লাল করে তাকাতেই আমি ভয়ে ভয়ে হাতে নিতে বাধ্য হলাম। তারপর ধীরে ধীরে আগাতে লাগলাম। আমার কেন জানি উনার সামনে যেতে ইচ্ছে করছেনা।
কিন্তু আমি না গেলে এই বাড়িতে আমার জামাইয়ের সামনে আর কে যাবে? আম্মু মেয়ের জামাইয়ের সামনে হুটহাট পড়তে চাইবেনা এটা স্বাভাবিক, আমার তো কোনো ভাবিও নেই যে মজার ছলে যখন তখন সামনে চলে যেতে পারবে! আর আমার ছোট ভাইয়ের কথা তো একেবারেই বাদ, সে সারাদিন কোথায় কোথায় থাকে আম্মু নিজেও জানেনা, প্রচুর দুষ্টু সে! আর বোন তো পিচ্চি লজ্জাবতী। লজ্জায় দুলাভাইকে কেমন আছে কথাটাও এখনো জিজ্ঞাসা করেনি।

আমি খাবারের ট্রে’ টা নিয়ে টি টেবিলে রাখতেই অনিক বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি চোখ তুলে তাকাতেই সে আমার চোখের সামনে আশ্চর্যজনক একটা জিনিস তুলে ধরলো, আমি দেখলাম বিধস্ত অবস্থায় আমার সেই রুমাল চোখের সামনে ঝুলছে।

আমি বিরবির করে উচ্চারণ করলাম আমার রুমাল! তারপর আমি একটানে হাতে নিলে বললাম,
‘ কোথায় পেলেন?

অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ এইতো বালিশে মাথা রেখেছিলাম,কিন্তু কেমন যেন অমসৃণ লাগছিলো, কাভারের ভেতর হাত দিতেই এটা পেলাম। একদম মুচড়ানো অবস্থায় পড়ে ছিলো।

আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। আমি আবার উনাকে পরখ করতে বললাম,
‘ এটার দিকে ভালো করে দেখুন। কিছু মনে পড়ে?

অনিক তাকিয়েই বললো,
‘ হ্যাঁ পড়ে।

আমি এবার বেশ উৎসাহের সাথে বললাম,
‘ কি মনে পড়ে বলুন আমাকে? আচ্ছা আপনার কখনো এমন একটা রুমাল ছিলো?

অনিক আমার থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
‘ পুরা পাগল এই মহিলা!

বলেই টেবিল থেকে শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো, তারপর ঢকঢক করে সবটা একসাথে খেয়ে জোরে শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ আপনি দয়া করে এখান থেকে যান। বিশ্বাস করেন আপনার এসব আচরণে আমি আৎকে উঠি, কখন যে কি আচরণ করেন মাই গড! পুরো পাগল পাগল লাগে আপনাকে।

আমি এটা শুনে রেগে গেলাম। আমাকে নাকি উনার পাগল মনে হচ্ছে!
রাগী গলায় বললাম,
‘ আমি পাগল? আমি মহিলা? আরে আপনার সমস্যা কি? পাগল তো আপনি! আপনার একেকটা আচরণে আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি চাচ্ছেন আর কি করছেন? সত্যি করে বলুন আপনি আমার কাছে কি চান?

অনিক বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ মুক্তি! একটা পাগল আর সাইকো মহিলার থেকে আপাতত মুক্তি চাই! আর হ্যাঁ আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার ছিলোনা। কিন্তু কেন বলছিলাম জানেন? ওই যে এক বছর আগের কাহিনী? আপনাকে দেখে মনে পড়লো তাই কাল রাতে সেটা জিজ্ঞাসা করছিলাম! ভুল হয়েছে সেটা মনে করিয়ে দেওয়া৷ সেদিন আমি রাস্তা থেকে না পার করালে তো মরেই যেতেন! কিন্তু আপনি যে এতো অকৃতজ্ঞ মানুষ ধারণা করতে পারিনি, তাহলে উপকার করতে যেতাম না।

এটা শুনে আমি আবার চমকে উঠলাম। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেভাবেই আবার স্থির হয়ে গেলাম ! কি বলছে সে? বারবার আমার ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে কেন? এখন এই ভাবনা আবার তো তখন ওই ভাবনা! মানুষটার মধ্যে সত্য বলতে আসলে কি আছে?

অনিক মুখে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
‘ আর ওই যে আপনার হাতের রুমালটা নিয়ে হাবিজাবি প্রশ্ন করছেন! এমন রুমাল আমার কখনোই ছিলোনা, কিন্তু আমার বন্ধুর ছিলো। অনেকদিন আগে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম, ফেরার সময় সিগারেট চাচ্ছিলাম, মানে তখন সদ্য ব্রেকাপ হয়েছিলো, তাই একটু আধটু খেতাম । আর ও যখনি আমাকে সিগারেট দিতে উদ্যত হলো তখনি ওর বাবা আমাদের মধ্যে উপস্থিত হলো, ওকে নিয়ে কি যেন একটা কাজ করবে বললো। তাই আমাকে আড়ালে গিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিলোনা, এইজন্য সে বুদ্ধি করে আঙ্কেলের সামনেই রুমালে পেঁচিয়ে দুইটা সিগারেট আমার হাতে দিয়েছিলো। ওই যে আমি রুমালটা পকেটে রাখছিলাম আর বের করিনি, হাতিয়ে দুটো সিগারেট পকেট থেকেই বের করে খেয়েছিলাম। ওই রুমালটা আর দেখাও হয়নি আর পরবর্তীতে এর অস্তিত্বও পাইনি। আপনি কি বলছেন আমি আসলেই বুঝতে পারছি না, কিন্তু রুমালটা দেখার পরে আমার ওই স্মৃতিটাই মনে হয়েছে, তাই বলে ফেললাম। এখন আপনি আমাকে রাস্তা দেন আমি বাইরে যাবো, দম বন্ধ লাগছে। প্লিজ!

আমি উনার শেষ কথায় নড়েচড়ে মৃদু হাসলাম। তারপর হাতে থাকা রুমালটাকে দ্রুত ফ্লোরের উপর ফেলে দিলাম। ছি! কার রুমাল নিয়ে আমি পড়ে ছিলাম? এবার আমার আর কোনো অবিশ্বাস হলোনা। উনিইই তিনি, আমার তিনি!
ততক্ষণে অনিক আমার দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে বের হয়ে গেছে। আমি জানিনা ও এখান থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে, আর আমাদের বাড়ির কিছু চিনে জানে কিনা? তবে অদ্ভুত লাগছে এটা ভাবতেই যে আমি জিতে গেছি! শুধু স্মৃতি হিসেবে রুমালটার প্রতি যাবতীয় আবেগই আমার ভুল ছিলো! কারণ এটা তার নয়।

আমি খেয়াল করলাম অনিক শরবত ছাড়া কিছুই খায়নি৷ ও আমার কথাবার্তায় আসলেই বড্ড বিরক্ত হচ্ছে? হবারই কথা। আমি আমার মতো করে অদ্ভুত উদ্ভট কথা বলেই যাচ্ছি, কিন্তু পরিষ্কার করে কিছুই বলছিনা।
যত দ্রুত সম্ভব বলা উচিত। এখন যাই দেখে আসি কোথায় গেলো?

আমি দু’হাত কোমরে একত্রে করে পা টিপে টিপে বের হলাম। কিছুদূর গিয়ে বা দিকে খেয়াল করলাম আমার বোন তনিমা বারান্দায় চুপচাপ বসে বসে যেন কি করছে। আমি আস্তে আস্তে ওর পাশে গিয়ে বসতেই ও চমকে উঠলো, হাত দিয়ে সাদা কাগজটা ঢেকে ফেললো, আমি হেসে বললাম,
‘ ছবি আঁকছিস?

সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলো! আমি হাত সরাতে যাবো তখনি পেছনে অন্য কারো অস্তিত্ব পেলাম। তাকাতেই দেখি অনিক।
অনিককে দেখে তনিমা কাগজটাকে একদম জামার ভেতরে লুকিয়ে ফেললো। আমি অবাক হয়ে জানতে জানতেই অনিক হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
‘ ওর রুমে গিয়েছিলাম, দেখলাম ও টেবিলে বসে কিছু করছে কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করতেই লুকিয়ে ফেললো, এরপর জিজ্ঞাসা করলাম কোন ক্লাসে পড়ে! জবাব দেয়নি, কোনো টুঁ শব্দটাও করেনি, উল্টো সুযোগ খুঁজে এক দৌঁড়ে কাগজটা হাতে নিয়ে পালিয়ে গেলো।

আমি অনিকের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আর তনিমাকে ইশারা করে বললাম,
‘ কেন কথা বলিস নি? উনাকে ভয় লাগে? আর তুই যে ক্লাস ফোরে পড়িস বলতে পারতি।

তনিমা কেমন যেন ভীতু ভীতু চেহেরা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর ফ্রকের দিকে খেয়াল করে দেখলাম সেখানে দুইটা কাগজ, একটার আংশিক দেখা যাচ্ছে। আমি সেটাকে টেনে বের করতেই তনিমা উঠে দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তনিমা আমার আঁকা একটা ছবি চুরি করে সেটা অনুকরণ করে নিজে আঁকছে।
অনিকও আগ্রহ নিয়ে সেটাকে দেখলো। আমি মাথায় হাত রেখে বসে আছি!
এই ছবিটাও আমার, কাল্পনিক সেই অপরিচিত’র, যতটা বৈশিষ্ট্য খেয়াল করেছিলাম ততটাই এখানে এঁকেছিলাম। এটা ছাড়া তনিমা সবগুলো আর্টকেই হুবহু আমার মতো করে অনুকরণ করে আঁকে, বিভিন্ন ফুল পাখি কিংবা প্রকৃতি। কিন্তু এটা লুকানো ছিলো। আমি জানি ওর আঁকিবুকিতে অনেক আগ্রহ, কিন্তু কিন্তু!

তখনি অনিক বলে উঠলো,
‘ এইটুকু বাচ্চা পুরুষের ছবি আঁকছে?

আমি সাথে সাথে বললাম,
‘ নাহ এইটা দেখুন, এটা আমার আঁকা। সে আমারটা দেখেই আসলে চেষ্টা করছিলো। অনেক আগে থেকেই ও এমনটা করে, আমি কিছু আঁকলে সেটা ওর আঁকতেই হয়!

অনিক আমার হাত থেকে নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে বললো,
‘ আপনার ওই প্রেমিক?

আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘ নাহ কখনো আমার প্রেমিক হয়নি, কিন্তু স্বামী হয়েছে এখন।

ভেবেছিলাম কিছু জিজ্ঞাসা করলে বিস্তারিত বলবো। কিন্তু তা না করে অনিক হাসলো। ভীষণ অদ্ভুত খোলামেলা হাসি। আমি ওর হাসির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম না আর। কারণ ওর হাসিতে কোনো রহস্য পাচ্ছিনা। একরাশ স্বচ্ছতা নিয়ে সে বারান্দার এক কর্ণারে তাকিয়ে শুধু হেসেই যাচ্ছে!

আমি একটু কাছাকাছি হয়ে বললাম,
‘ সবটা জানতেন?

অনিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ হু!

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ কেমন করে? বলেন নি কেন?

অনিক সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিলো,
‘ এতো বোকা কেন আপনি? আপনার কি মনে হয় আমার ভাইয়ার বিয়েটা আমি এমনি এমনি করেছি? শুনেন বিয়ে কাউকে চাপিয়ে দেওয়া যায়না, অন্তত একটা ছেলেকে তো কখনোই না, আমারও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকতে পারে, তাইনা? আর সবচেয়ে বড় কথা ভাইয়া কোনো প্রেমিকা নিয়েও পালায়নি, পালিয়েছে আমাকে সুযোগ করে দিতে।

কেন জানি আমার অভিমানসিক্ত চোখ বাঁধ মানলোনা, আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু অনিক আমার হাত ধরে আবার পূর্বের জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললো,
‘ এতটা পাগল কেউ হয়? আপনি আসলেই মানুষ? আর কালকের জন্য রাগ হচ্ছে? তাই চলে যাচ্ছেন? কিন্তু রাতে আমি আপনার কাছেই ছিলাম, পুরো রাতটাই আপনার দিকে তাকিয়ে ভেবেছি ভালোবাসাও এমন হয়? ভাইয়া আমাকে কেমন ঘটনা শোনাল? আমার জন্য কিনা একটা মানুষ এতটাও উতলা হতে পারে, যেখানে আমার সাথে মুখের কথাটাও হয়নি কিন্তু আমার জন্য অন্য কাউকে বিয়েই করবেনা! আমার সত্যি মনে হয়েছিলো সব জেনে আপনাকে আমি বিয়ে না করলে নিজের সাথে এবং আপনাদের সাথে বিরাট অন্যায় করা হবে। আর তাইতো ভাইয়ার সাথে যুক্তি করে…

আমি কাঁদতে কাঁদতে অনিকের কাঁধে কপাল ঠেকাতে যাবো সেসময়ই আমার ছোট ভাই এসে বলে উঠলো,
‘ আপুর অপরিচতকে পেয়েই গেলো তবে, স্পেশাল ট্রিট চাই কিন্তু।

বলেই আবার হাওয়া হয়ে গেলো।

আমি অনিকের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালাম। অনিক হাসতে হাসতে বললো,
‘ পাত্র বদলে যাবে তোমার বাবা সুন্দর করে বেকার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে ভাবলে কি করে? উনি সত্যিটা জেনেছে বলেই দিয়েছে, যেটা আমার পরিবারে আমার বাবা আমি আর ভাইয়া জানে! মহিলারা কেউ জানেনা।

আমি রেগে গিয়ে বললাম,
‘ আমাকেও আপনার পরিবারের মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন? তাই আমিও জানলাম না হ্যাঁ?

অনিক হাসতে হাসতে বললো,
‘ এই যে জেনে গেলে!
বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো!

আজ আমার চেয়ে সুখী কে? অপরিচিত সে আমার চির পরিচিততে রূপ নিয়েছে যেখানে!?

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here