“প্রিয় অসুখ শেষ পর্ব

প্রিয় অসুখ
শেষ পর্ব
মিশু মনি
.
শ্রবণা ফোন কানে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘হ্যালো।’

ওপাশ থেকে শীতুলের নরম কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, ‘আচ্ছা জীবনানন্দ দাশ কি বনলতাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন?’

শ্রবণা এরকম প্রশ্ন শুনে খানিকটা অবাক হলো। তবে অন্যকিছু না বলে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলায় কিছুটা খুশি হয়েই বললো, ‘তা বলতে পারবো না। ভালোবাসতে তো দেখিনি, শুধু সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখতে দেখেছি।’
– ‘এটা বুঝো না? কাউকে প্রচন্ড ভালো না বাসলে কি তাকে নিয়ে কবিতা লেখা যায়?’
– ‘এ আমার জানা নেই বাপু। হয়তো যায়, হয়তো যায় না।’
– ‘আমার তো যায় না।’
– ‘আপনি আবার কবিতা লেখা শুরু করেছেন নাকি?’

শীতুল একটা জোরালো নিশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করলো,
‘আমার দিবস নিশিতে হৃদপিন্ডটুকুন প্রতি স্পন্দনে কারো কথা ভাবে,
যাকে ভাবতে গেলেই আমার শিরা উপশিরা, সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগে।
আমি প্রফুল্লিত হই, উন্মাদিত হই,
মাঝেমাঝে হয়ে যাই মাতাল,
বুকের ভেতর কিছু একটা হারিয়ে গেছে,
ফুড়িয়ে গেছে, কেড়ে নিয়ে গেছে আমার প্রাণের উচ্ছলতা।
আমি নির্জীব হয়ে গেছি, কোথাও ভয়াবহ শূন্যতা, আমার কিছু একটা চুরি হয়ে গেছে।
আমার মাঝে আমি নেই, আমি কোথায় যেন সবটুকু ফেলে এসেছি ,
কার কাছে যেন নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এসেছি,
আমি সর্বনাশের শুরুটা দেখিনি, তবে শেষটা দেখেছি।
কেউ একজন আমাকে নেশাগ্রস্তের মত উন্মাদ করে দিয়েছে।
বুকের ভেতর একটা অচেনা শব্দ শুনি,
বোধহয় কারো অস্তিত্বকে আমার ভেতর ধারণ করেছি।”

এতদূর বলার পর শীতুল থামলো। এটা কি কবিতা ছিলো? শ্রবণার শরীর শিউড়ে উঠেছে। গায়ের প্রত্যেকটা লোম দাঁড়িয়ে গেছে। শীতুলের উচ্চারিত শব্দগুলো কানে বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে। কেবলই মনে হচ্ছে, শীতুলকে চুরি করতে পেরে এ জীবনটা ধন্য করেছে শ্রবণা। শীতুলকে ছাড়া যে কোনোভাবেই ওর চলবে না।

শীতুল বললো, ‘তোমার কাছে একটা চিঠি লিখবো। ঠিকানা দাও, চিঠিটা পাঠিয়ে দিবো।’
শ্রবণা চমকে উঠে বললো, ‘না না। আমার ঠিকানায় চিঠি পাঠাতে হবে না। আপনি বরং ফোনেই বলুন।’
– ‘চিঠিতে যেভাবে সমস্ত অনুভূতিকে জড়ো করতে পেরেছি, ফোনে সেভাবে পারবো না।’

শ্রবণা চুপ করে রইলো। কি বলবে এবার? একই বাসায় আছে তো দুজনে। বাসার ঠিকানা কেমন করে দেবে সে। ভাবতে ভাবতে কোন কূল কিনারা না পেয়ে শ্রবণা বললো, ‘আপনাকে আগামীকাল সকালে একটা চিঠি পাঠাবো। যে চিঠি নিয়ে যাবে, তার হাতেই আপনার চিঠিটা দিয়ে দেবেন।’
– ‘আমাকে আরো কিছুদিন যন্ত্রণায় রাখতে চাচ্ছো তো? রাখো। আমার কষ্ট নেই। তবু তুমি শান্তিতে থাকো। তবে আজ আমি এমন চিঠি লিখবো, তুমি আর দূরে থাকতে পারবে না।’

শ্রবণার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠলো। বললো, ‘ইস! তাহলে তো আমার এখনই চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে।’
– ‘উহুম। এবার বোঝো কেমন লাগে।’

শ্রবণা কি বলবে বুঝতে পারলো না। অনেক্ষণ নিঃশব্দে রইলো ও। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। ইচ্ছে করছে শীতুলের কাছে ছুটে চলে যাই। এ কেমন মন কেমনের ক্ষণ এলো কে জানে!

শ্রবণা বললো, ‘আপনি চিঠির কথাগুলো ফোনে বলবেন প্লিজ? আমি না আর সইতে পারছি না। আমার খুব মন কেমন করছে।’

শীতুলের বুকটাও এখন ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে। ও উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘মন কেমন করছে?’
শ্রবণা উত্তরে বললো, ‘মনের ভিতর একটা কিছু খুব করে লাফাচ্ছে। এটা বর্ণনা করার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’
– ‘আমি বলবো?’
– ‘হুম বলুন?’

শীতুল কিছুক্ষণ থেমে আবারো কবিতার লাইন বললো দুটো। লাইন গুলো ছিলো এরকম,

‘বুকের ভেতর একটা অচেনা ব্যথা,
কেমন কেমন যেন করে,
আমাকে ভাঙে, আমাকে গড়ে,
কোথায় যেন সমুদ্রের মত উথাল পাথাল করে।
চোখে বালি ঢুকে গেলে যেমন খচখচানি হয়,
মনের ভেতর তেমন একটা জটিল যন্ত্রণা।
মনের মণিতে বারবার লেগে খোঁচা দেয়।
তোমার থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা,
চোখের খচখচানির চেয়ে এতটুকুও কম না।
পা মচকে গেলে, মাটিতে পা ফেললে যেমন ব্যথা অনুভূত হয়,
তোমাকে দেখার জন্য মনের ভিতর এমন উচাটন করে।
যেন মনটা মচকে গেছে, যতবার ভাবি ততবার ব্যথা পাই।
আশেপাশে কোথাও তুমি নাই।
তোমাকে দেখবার জন্য মনটা কেমন করে,
চোখের বালি পলক ফেললে যেমন যন্ত্রণা করে।’

শ্রবণার চোখ জলে টলমল করছে। নাহ, আর পারছে না ও থাকতে। এত কাছে থেকেও দূরে থাকার কষ্টটা ও আর নিতে পারছে না। মানুষটাকে জানাতে হবে, বলতে হবে সমস্ত অব্যক্ত অনুভূতির কথা।

শীতুল বললো, ‘বুকটা খা খা করে রে। তোমার সুগন্ধি তেলের সুবাস মাখানো মাথাটা খুব শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরতে পারলে শান্তি পেতাম। তোমাকে বুকের ভেতরে, না ঠিক কলিজার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতাম।’

শ্রবণা আর স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। বলল, ‘প্লিজ ফোনটা রাখো। রাখো, রাখো।’

কল না কেটে দিয়েই শ্রবণা ফোন রেখে দিলো। শীতুল অনেক্ষণ হ্যালো হ্যালো করলো কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। শীতুলও কল না কেটে ফোন কানে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো শীতুল জানেনা। দরজায় ঠকঠক শব্দ করছে কেউ। শীতুল ফোনটা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালো। এত রাতে দরজায় শব্দ হওয়ায় মুখে বিরক্তির ছাপ।

রাত বেড়েছে অনেক। নিস্তব্ধ রাত, আজ যেন চারিদিকে সব যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সবখানে নিঝুম, সবাই শীতুলের ব্যথায় নিরবতা পালন করছে। শীতুল একটা ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। মৃদু পায়ে হেঁটে এসে দরজা খুলে দিলো।

দরজায় ওপাশে একজন মানবী দাঁড়িয়ে। পড়নে আসমানী রংয়ের শাড়ি। তেল দেয়া চুলগুলো বেণী করে বাম কাঁধের উপর দিয়ে এনে সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। চুল থেকে সুগন্ধি তেলের সুবাস আছে। কপালে কালো টিপ, চোখে মোটা করে কাজল দেয়া। ঠোঁট দুটো নিষ্পাপের মত, থরথর করে কাঁপছে। চোখজোড়া কঠিন, কোনো ভাষা নেই সেই চোখে। কিন্তু জলের মত কিছু একটা চোখে পড়ছে।

শীতুলের ঘোর আরো গাঢ় হয়ে এসেছে। ও বললো, ‘তুমি! এই বেশে?’

শ্রবণার কোনো শব্দ নেই। শব্দহীন পায়ে ধীরেধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো ও। এগিয়ে গেলো শীতুলের টেবিলের কাছে। শীতুল দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রবণাকে এই সাজে দেখে ওর ঘোর আরো প্যাঁচময় হয়ে যাচ্ছে।

শ্রবণা টেবিলের উপর থেকে ডায়েরিটা নিয়ে খুব দ্রুত কি যেন লিখে চলেছে। শীতুল নিঃশব্দে এসে বিছানার উপর বসলো। কিন্তু শ্রবণা কি লিখছে সেদিকে ওর কোনো আগ্রহ নেই। ও কেবল নির্বাক হয়ে শ্রবণার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে।

শ্রবণা লেখা শেষ করে পৃষ্ঠাটা ছিড়ে ডায়েরিটা এগিয়ে দিলো শীতুলের দিকে। শীতুল লেখাগুলোর দিকে তাকানো মাত্র বুকের ভেতর একটা বড়সড় কম্পন অনুভূত হলো। সেই চিরচেনা হাতের লেখা! শ্যামলতা! যতই পড়তে লাগলো ততই চোখ জলে ভিজে উঠছে ক্রমশই।

চিঠিটা ছিলো এরকম-

প্রিয় অসুখ,
এত খারাপ অসুখ কখনো কারো হয়েছিলো কিনা বলতে পারো? একই অসুখে দুজনে দিনের পর দিন, পুড়ে পুড়ে মরছি। এ অসুখের নাম, “তুমি”। তুমিময় একটা আমি হয়ে গেছি জানো তো? সেই ছোট্টবেলাকার কথা। আমি হাইস্কুলে পড়তাম। একটা ডায়েরি কিনে আনি, কিসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরিতে লিখতে শুরু করি। তোমার কথা, আমার কাল্পনিক প্রেমিকের কথা। হুট করেই যে আমার জীবনে এসে সমস্তটা রাঙিয়ে দেবে। যাকে প্রথমবার দেখেই মনে হবে, এই আমার সেই প্রিয় অসুখ। যে অসুখে ভুগছি আমি নিরন্তর। এই অসুখ আমাকে সারাক্ষণ ভাবাতো, শুধুমাত্র তোমার কথা। তোমাকে নিয়ে জোৎস্নায় স্নান করবো, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাত ধরে হাঁটবো। সকাল দেখবো, পেয়ারা পাতা আয়রনযুক্ত পানিতে চুবালে পানি যে রং ধারণ করে, সেই রঙা একটা নিজস্ব ভোর থাকবে আমাদের। এই ভোরে তুমি আর আমি গায়ে চাঁদর জড়িয়ে কুয়াশায় ভিজবো। একজন আরেকজনকে দেখবো, জানবো, ভালোবাসবো, কলিজার ভিতর ঢুকিয়ে রাখবো৷ তোমাকে নিয়ে আমার শত শত, কোটি কোটি স্বপ্ন জানো তো? সবই লিখেছিলাম আমার প্রিয় ডায়েরিতে। ওমা, ডায়েরিটা একদিন হারিয়ে গেলো। আমি পাগলপ্রায় হয়ে গেলাম। কোথায় ফেলে এসেছিলাম জানিনা। পাগলের মত খুঁজলাম, পেলাম না। এরপর রুমে শুয়ে শুয়ে মন খারাপ করে কাঁদছিলাম। তোমার সাথে সেদিনই প্রথম দেখা হয়ে গেলো। আমার সমস্ত শরীরে আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। এই তো আমার প্রিয় অসুখ। আমি তোমাকে দেখেই ডায়েরি হারানোর ব্যথাটা ভূলে গেলাম। এরপর থেকে শুরু হলো আমার পাগলামি। তুমি রাগ করে আমাকে রিসোর্টে একা ফেলে চলে গেলে। আমি আরো পাগলের মতন হয়ে গেলাম। অনেক কাঁদলাম। তোমাকে ফেসবুকে নক দিলাম, পেলাম না। তোমার নাম্বারে ফোন দিলাম, বন্ধ। তোমার বন্ধুকে নক দিলাম, সে জানালো তুমি আরেকজনকে ভালোবাসো। কি কষ্টটাই না পেয়েছিলাম সেদিন। এরপর কয়েকটা দিন আমার প্রচন্ড কষ্টে কাটে। তারপর একদিন ট্রেনে দেখা হয়ে গেলো। সময় বড্ড অদ্ভুত, আমাদেরকে ঠিকই সবসময় একত্র করে রাখার চেষ্টা করলো। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে চাইলেও সময়টা চাইছিলো না। তবে আমার দিনগুলো কাটছিল চরম বেদনা নিয়ে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, শুধু তুমিময় একটা যন্ত্রণা। তুমি স্ট্যাটাস দিলে, আমি দেখলাম না। তুমি সব দেখলে, আমার আইডিতে ঢুকে আমার নিকনেম টাই দেখলে না। রাজ্যের সব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে তাদের নাম, আমাকে ই করলে না। কেন? পুরো শহরে পোস্টার লাগাতে দেখলাম, অথচ পোস্টার টা আমি নিজে কখনো দেখলাম না। এত অদ্ভুত সবকিছু! তুমি অন্যকারো ভেবে নিজেকে কত আঘাত করেছি। অথচ সেই অন্যকেউটাই আমি, এটা জানার পর থেকে আমার ভেতর কি বয়ে যাচ্ছে জানো? শীতুল, আমার প্রিয় অসুখ, এটা আমার সবচেয়ে বড় সুখে পরিণত হয়েছে। আমি এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে সুখী মেয়ে।

চিঠিটা পড়ার পর শীতুলের গাল বেয়ে শুধু জলের স্রোত বইছে। হাত টেনে ধরে হেচকা টানে শ্রবণাকে বুকে টেনে নিলো শীতুল। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম। তুমি শুনতে চাওনি। আর আমিও কেমন যেন! তুমি যখনই রুমে আসতে, আমি ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলতাম। কি অদ্ভুত তাই না?’

শ্রবণা শব্দ করে জোরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। শ্রবণার কান্নার শব্দ শুনে শীতুলও কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তোকে আমার কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখবো। দেখি আর কোথায় যাস তুই। ভালোবাসি রে, খুব ভালোবেসে ফেলছি।’

দুজনের কান্নার শব্দে বাবা মা ছুটে আসলেন। দেখলেন শীতুল খুব শক্ত করে শ্রবণার মাথাটা বুকে চেপে ধরে অনবরত কেঁদে চলেছে। মা বাবাকে দেখে শীতুল ছুটে এসে চিঠিটা দিয়ে বলল, ‘মা, ও আমার শ্যামলতা। আমার অসুখ মা।’

শীতুলের চোখেমুখে যে আনন্দের ছটা মা দেখলেন, এমন আনন্দ বোধহয় আর কোনোদিনো তিনি দেখেননি। চিঠিটা পড়ে শীতুলের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন ,’কালকেই ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। নয়তো সুখটা আবার অসুখে পরিণত হবে বুঝলে?’

শীতুল খুশিতে মাকে জাপটে ধরলো। শ্রবণা গাল মুছতে মুছতে শীতুল ও মা দুজনেই বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো। ঠিক মুহুর্তে শ্রবণা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েদের একজন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here