প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প পর্ব -০৫

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৫|

ধ্রুবর সাথে দেখা হওয়ার পরদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, কলেজে যাব। এমন ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকার মতো কিছু ঘটেনি। সুতরাং বসে থাকা চলবে না। মুখে মুখে এমন হাজারও স্তবক ঝাড়লেও মনের ভেতর আস্ত এক ভূমিকম্প নিয়ে কলেজে পৌঁছালাম। শীতের সকাল। কুয়াশায় স্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ। চায়ের দোকানে উনুন জ্বলছে। দু’একজন পথচারী ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছেন গন্তব্যে। আমি আর প্রিয়তা কিছুটা উদ্বেগ নিয়েই ক্যাম্পাসে পৌঁছালাম। ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির কাছে আসতেই ক্যাফেটেরিয়া থেকে ডেকে উঠল কেউ। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু ঝংকার তুলল। আমি আর প্রিয়তা একে অপরের দিকে চেয়ে পিছন ফিরে চাইলাম। ছেলেটি ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

‘ তুমি নিশু না?’

ভীষণ লম্বা, দৈত্যের মতো দেখতে ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে মাথা নাড়লাম। ছেলেটি মৃদু হাসল। আমাকে চিনতে পেরে সে পরম আনন্দিত। কিন্তু আমি আনন্দিত হতে পারলাম না। এই লোকটিকে আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে হলো না। আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম,

‘ আপনি?’

লোকটি হাসল। হাত দিয়ে বাইরের দিকে ইশারা করে বলল,

‘ আমি ওই ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। এবার মাস্টার্স শেষ হলো।’

আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন শুনে অভিনন্দন জানানো উচিত নাকি অযথা বক্তব্যে বিরক্ত হওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারলাম না। লোকটি হাসিমুখে প্রস্তাব করলেন,

‘ নাস্তা করেছ? আমাদের সাথে এক কাপ চা খাও, ছোট আপু?’

আমি চমকে চাইলাম। হঠাৎ এতো বিনয় পেয়ে হকচকিয়ে গেলাম। ঠোঁটটা টেনে কোনো রকম বললাম,

‘ অন্যদিন ভাইয়া। ন’টায় আমার ক্লাস আছে।’

আমার প্রত্যাখ্যানে ভদ্রলোকের খুব একটা ভাবাবেগ হলো না। আমার দিকে চেয়ে থেকে নিজের মনে হাসলেন। তারপর মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে আবারও ক্যাফেটেরিয়াতে অন্তর্ধান করলেন। ভদ্রলোক চলে যেতেই চোখ বড় বড় করে চাইল প্রিয়তা। কয়েক সেকেন্ড সন্দিহান চোখে চেয়ে থেকে একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল,

‘ এই ছেলেরে তুই কেমনে চিনিস? হাও?আমি কেন চিনি না? আমার গাঢ়ে বসে কাঁঠাল খাচ্ছিস অথচ আমি জানি না? সর্বনাশ!’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা এবার দুঃখের সাগরে ভেসে গেল। ওকে না জানিয়ে এতোবড় কান্ড করে ফেলেছি ভেবে তার মরে যেতে ইচ্ছে হলো। ঠিক এমন সময় সিঁড়ির মাঝ বরাবর এসে হুট করেই দাঁড়িয়ে পড়ল এক যুবক। গায়ে কালো জ্যাকেট। হাতে ক্যামেরা। লম্বাচওড়া ছিমছাম চেহারা। আমায় দেখে বিগলিত হেসে বলল,

‘ আপনি নিশু আপু না? কেমন আছেন?’

আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে মাথা নাড়লাম। ছেলেটি হাসল। ক্যামেরার ফিতেটা হাতে জড়াতে জড়াতে বলল,

‘ আপনার ছবি কিন্তু ক্যামেরায় দূর্দান্ত আসবে আপু। কখনো ছবি তোলার হলে আমায় জানাবেন। আজ আসি?’

আমি ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ এমন ঘটা বিনয়ের কারণ বুঝতে না পারলেও, তারা প্রত্যেকে যে আমার সিনিয়র তা বেশ বুঝতে পারলাম। ছেলেটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই হাহাকার করে উঠল প্রিয়তা। কাঁদো কাঁদো চোখে চেয়ে বলল,

‘ তুই এতো নিষ্ঠুর নিশু! এতো হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ছেলেদের সাথে তোর পরিচয় অথচ আমায় বলিসনি? এজন্যই সবাই প্রেমিক প্রেমিক করছে। আমি হাঁচি দিলেও তোকে বলি আর তুই হালি হালি প্রেমিক পালছিস অথচ বলিস নি?’

প্রিয়তা বুক ফাঁটা কষ্ট নিয়ে আমার সাথে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিল। প্রিয়তার হাহাকারে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকেও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না। অসহায় কন্ঠে বিড়বিড় করলাম,

‘ এতো নিষ্ঠুর তুই নিশু! এতো এতো ছেলেপুলে তোর পরিচিত অথচ তুই আমাকেও জানতে দিলি না! আমার খেয়ে, আমার মধ্যে থেকে, আমাকেই ধোঁকা!’

আমরা দু’জনেই মর্মাহত মন নিয়ে ডিপার্টমেন্টে পৌঁছালাম। দুটো লেকচার শেষ হতেই কোথা থেকে দৌঁড়ে এলো বিথিকা। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বলল,

‘ তোর কাজে খুব দুঃখ পেয়েছি নিশু। তুই ধ্রুব ভাইয়ার সাথে সম্পর্কে জড়ালি অথচ একটিবারও আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? আমরা কী তোকে ধরে রাখতাম?’

আমি যারপর নাই অবাক হয়ে বললাম,

‘ মানে কী! কোন ধ্রুব?’

বিথিকা সরু চোখে চাইল,

‘ একদম নাটক করবি না। তোদের কাহিনি এখন পুরো ডিপার্টমেন্টই জানে। সুতরাং নাটক ফাটক করে লাভ নেই।’

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। প্রিয়তা সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া হৃদয় নিয়ে আমার দিকে চাইল। মর্মাহত চোখে চেয়ে বাপ্পারাজের মতো ডায়েলগ ঝাড়ল,

‘ না! না, আমি বিশ্বাস করি না। তুই আমার কোলে চড়ে আমারই উপরতলার ছেলেকে পটিয়ে ফেললি? আর আমি বেকুব, গরু, গাধা এতটুকু খোঁজ পর্যন্ত পেলাম না? ইয়া আল্লাহ! আমার বুকটা এমন ধরফর করছে কেন? আমি বোধহয় আর বাঁচব না। হে বিধাতা! ইয়া মা’বুদ! আমি আর বাঁচতে চাই না। এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি আমার হাজারখানেক প্রেমিক, স্বামী, সন্তান উৎসর্গ করে দিলাম।’

আমি বিরক্ত চোখে প্রিয়তার নাটক দেখলাম। আমার যে প্রেমের কাহিনি আমি ছাড়া সবাই জানে? সে কাহিনিটা আগাগোড়া বুঝার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা সফল হলো না। আমার চেষ্টাকে পুরোপুরি অপচেষ্টা করে দিয়ে প্রফেসর আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পড়াতে পড়াতেই হঠাৎ জিগ্যেস করলেন,

‘ এইযে আপনি? আপনার নাম নিশু?’

আমি চমকে উঠলাম। স্যার আমার সাথে কথা বলছেন বুঝতে পেরেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। প্রিয়তা আমায় ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিতেই থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। স্যার জহুরি চোখে চেয়ে বললেন,

‘ হোমটাউন কোথায়? এখানকার মেয়ে? নাকি বাইরের শহর থেকে এসেছেন? বাবা কী করেন?’

স্যারের পর পর এতো প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলাম আমি। ক্লাসের সকলের চোখেই উৎসুক দৃষ্টি। মাত্র এক মাস হচ্ছে ক্লাস জয়েন করেছি। শহরেও নতুন। স্যারের ক্লাস পেয়েছি মোটে একটি। এই অল্প সময়ে তাঁর আমার নাম জানতে পারার কথা নয়। আমি উত্তর দিতেই মৃদু হাসলেন প্রফেসর। আর আমি রহস্যের অতলে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে খুব অসহায় বোধ করলাম। প্রিয়তা আরেক দফা দুঃখের সাগরে ভেসে গেল। এদিকে আমি পড়লাম বিপদে। মহাবিপদে! যার প্রেমিকা হিসেবে আমি ক্যাম্পাস খ্যাত তার সাথে যে এই জীবনে আমার ‘ক,খ’ ধরনের কথাবার্তাও হয়নি, সে কথা কেউ বিশ্বাস পর্যন্ত করল না। তার চা পছন্দ নাকি কফি? সে কেমিস্ট্রি পছন্দ করে নাকি ফিলোসোফি? সে সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা আমার নেই। অথচ আমি তার ভাইয়ের ভাবী। বন্ধুদের ছোট আপু আর জুনিয়রদের হিংসার কারণ। ভাবা যায়? না, ভাবা যায় না। আমি আর ভাবতে পারলাম না। ভয়াবহ প্রেমিকহীনতায় ভোগেও হঠাৎ কারো প্রেমিকা হয়ে যাওয়ার দুঃখে প্রাণটা যেন ফেঁটে গেল আমার। মাথাটা দপদপ করতে লাগল। পড়াশোনা, লেখালেখি সব লাটে তুলে দুঃখবিলাস করতে বসলাম। প্রায় তিন চারদিন বাদে হঠাৎ লাইব্রেরি যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো। ঘরে বই ফুরিয়ে গিয়েছে। দুঃখবিলাস ঠিকঠাক চলছে না। আমি ঘরের দোর খুলে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু সিঁড়ির দুই ধাপ নামতেই ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটে গেল। সিঁড়ির গোড়ায় আবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝাঁঝ নিয়ে বললাম,

‘ তুমি কী জানো? তোমার ভাইয়ের মতো বেয়াদব মানুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই?’

আবির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমার কথার তেজে স্তব্ধ হয়ে গেল তার পা। ঘাড় ফিরিয়ে বিস্মিত চোখে চাইল। ডান ভ্রু’টা ঈষৎ উঁচু করে নিচু কন্ঠে শুধাল,

‘ কেন? কী করেছে ও?’

আমার মাথায় তখন আকাশ সমান রাগ। দু’দিন যাবৎ শান্তিতে কলেজ যেতে পারছি না। ছায়ার মতো ল্যাপ্টে থাকা প্রিয়তা পর্যন্ত কুটিল চোখে তাকাচ্ছে। মুদির দোকানের সবচেয়ে অপরিচিত মামাটাও দিনে দু’বার করে হালচাল জিজ্ঞেস করছে। ভাবা যায়? আমি রাগ নিয়ে বললাম,

‘ কী করেছে মানে? তার জন্য আমার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছে। আমার তো এই মুহূর্তে তার নামে মানহানির মামলা করা উচিত।’

আবির ভ্রু কুঁচকাল। শান্ত, শীতল কন্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা?’

আবিরের কথায় অচেনা এক শীতলতা ঠাহর করে সচেতন চোখে চাইলাম। আমার বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক বাংলা সিনেমার পুলিশদের মতো অত্যন্ত দেরি করে হলেও তাদের অস্তিত্বের জানান দিল। মাথার ভেতর লাল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বুঝাল, ‘নিশুমণি? ইউ আর ইন দ্য রং নাম্বার!’ মস্তিষ্কের এই দূর্দান্ত বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পর আমার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। সকল তেজ হাওয়ায় মিলাল। মেঘমন্দ্র কন্ঠ মুহূর্তেই শালিক পাখির মতো চিওচিও করতে লাগল। ভয়াবহ বিপদে পড়ে গিয়েছি বুঝতে পেরে ভেতরটা কেমন দুরুদুরু করে উঠল। আমি ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে এক পা পিছিয়ে গেলাম। মনে মনে এক দৌঁড়ে বর্ডার পাড় করার চিন্তা জপতে জপতে অত্যন্ত লক্ষ্মী মেয়ের মতো বললাম,

‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন?’

ধ্রুব শান্ত কন্ঠে সালামের জবাব নিয়ে বলল,

‘ তোমার নামই নিশু, তাই না? কোথায় যাচ্ছ? নিচে নামো।’

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ আর দুরুদুরু বুক নিয়ে এক ধাপ নিচে নামলাম। অসহায় কন্ঠে বললাম,

‘ সরি ভাইয়া। আমি আপনাকে আবির ভেবেছিলাম। সরি!’

ধ্রুব আগের মতোই চেয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

‘ সেই তো! আবিরের ভাই তোমার কী ক্ষতি করল?’

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বেকুবের মতো হাসলাম। অথচ ধ্রুব নিরুদ্বেগ। ধ্রুবর গম্ভীর, শীতল চাহনি দেখেই ভেতরটা কেমন নড়েচড়ে উঠল। পা দুটো আপনাআপনিই পেছন দিকে ছুটে যেতে চাইল। কিন্তু ধ্রুব সেই সুযোগটা দিল না। আমাকে আকাশসম অবাক করে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ পালানোর চেষ্টা করবে না। নিচে নামো। সিঁড়ির নিচে আসো।’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। সন্দেহে চিকচিক করে উঠল চোখ। এই স্বল্পভাষী, চুপচাপ ছেলেটিকে তো আমি মহা গাধা মনে করেছিলাম। বানিয়ে বসেছিলাম, ভদ্রতার পিরামিড। সাগর, মহাসাগর। কিন্তু এ তো দেখি মহা ধুরন্ধর। ফাঁকা সিঁড়ি দেখেই মেয়েদের অন্ধকার সিঁড়ির নিচে ডাকে! ইয়া মা’বুদ! কী সাংঘাতিক!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here