কবুল বলার কাজ সম্পন্ন হতেই সফেদের মা এগিয়ে এলো নতুন বউয়ের মুখ দেখতে।যেই না তিনি ঘেমটা তুললেন সাথে সাথে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলেন।ওনার চিৎকারে আশেপাশে যারা হাসাহাসি আর আড্ডাতে মশগুল ছিল তারা ছুটে এলো ব্যাপার কি দেখতে!সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো নতুন বউয়ের মুখ দেখে।
সফেদ বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল,বন্ধুরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন রসিকতা করছে।করবেই তো,যাকে এতদিন ধরে ভালোবেসে এসেছে সেই প্রিয়তমাকে আজ বউ হিসেবে পেয়েছে এরচেয়ে সুখের বিষয় কি হতে পারে!কিন্তু তার এ সুখ খুব বেশি স্থায়ী হলো না যখন মায়ের চিৎকার পেয়ে সে দৌড়ে গেলো।তার মা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আর সেই দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে তাকাতেই পা আটকে গেলো সফেদের। এ কাকে দেখছে সে,তিমির?তিমির যদি বউয়ের সাজে এখানে থাকে তাহলে তুরফা কই,আর তুরফাই যদি কবুল বলে তবে তিমির আসলো কোথা থেকে? সফেদ বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে তিমিরের দিকে আর তিমির তো ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। সফেদের মা,নিপা বেগম যেভাবে চিৎকার দিলেন তার কান বরাবর তাতে যে কারো হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো।তিমির মোটামুটি এ চিৎকারের সাথে পরিচিত বলে ভয় পেয়ে একপাশে সরে গেছে। সফেদের মা আবারও চিৎকার করে উঠলো,
“এ মেয়ে এই তুমি এখানে কি করছো আমার পুত্রবধু কই?”
তিমির চারপাশে তাকালো তারপর সফেদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আন্টি আপনার ছেলে কি দুই বিয়ে করেছে?”
নিপা বেগমের মাথা এমনিতেই গরম তার ওপর এ মেয়ের হেয়ালিপনা কথা শুনে তিনি আরো রেগে গেলেন।সোজা এগিয়ে এসে তিমিরের বাহু চাপ দিলেন।
“ফাইজলামি পাইছো বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার,আমার ছেলে দুই বিয়ে করেছে বলে?বেয়াদপ মেয়ে,তুমি এখানে কেনো,এখানে তো তুরফার থাকা কথা ছিল তাহলে তুমি এলে কোত্থেকে? ”
“আমিই তো ছিলাম এতক্ষণ এখানে।কেনো আপনি খেয়াল করেন নি?ও আচ্ছা মনে পড়েছে আমার তো ঘোমটা দেয়া ছিল তাই হয়তো লক্ষ্য করেন নি।”
দাঁত কেলিয়ে হেসে আরেকবার নজর বুলালো তিমির।আশেপাশে মাকে দেখছে না কেনো,এতক্ষণে তো তার কানে খবর পৌঁছে যাওয়ার কথা।চারপাশে তাকাতে তাকাতে তার দৃষ্টি পড়ে সফেদের দিকে।সফেদ স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তিমিরের দিকে।তর দৃষ্টির কোনো নড়চড় হচ্ছে না যেন একটা পাথরের মূর্তি বনে গেছে সে।দৃষ্টির ভেতর যে আগুন বয়ে যাচ্ছে সেটা তিমির বুঝতে পারছে।আপাতত সে নিজের ভেতর সাহস নিয়ে আবারও তাকালো নিপা বেগমের দিকে।তিনি ইয়া বড় বড় চোখে চেয়ে আছেন।
“এ মেয়ে পরিষ্কার করে বলো ঘটনা কি,তার মানে কি কবুল বলার সময় তুমিই ছিলে ঘোমটার নিচে,আর তুমিই কবুল বলেছো?”
“এ কেমন কথা আন্টি, ঘোমটার নিচে যখন আমিই ছিলাম তবে আমাকেই তো কবুলটা বলতে হবে তাই না?নাহলে তো আপনারা আবার কবুল বলো কবুল বলো বলে মুখ ব্যাথা করবেন তাই আপনাদের কষ্ট না দিয়ে আমি নিজেই এক কথায় তিনবার কবুল বলে দিয়েছি,ভালো করেছি না আপনাদের কষ্ট না দিয়ে?”
আবারও দাঁত কেলালো তিমির।সাথে সাথে ছুটে এলেন তিমিরের মা, শান্তা বেগম।মেয়ের বিয়ের কষ্ট দেখতে পারবেন না বলে রুমে ছিলেন কিন্তু যেই না শুনলেন তুরফার জায়গায় তিমির ছিল সাথে সাথে শর্ট জ্ঞান হারালেন।আর জ্ঞান ফিরতেই তিনি রণচণ্ডীর রূপ নিয়ে নিচে এসে সোজা উঠে এলেন ডায়াসে।ইতিউতি না দেখে তিমিরকে টেনে এনে টাটিয়ে লাগিয়ে দিলেন এক চড়।চড়ের বল প্রয়োগ এতটা প্রবল ছিল যে তিমির সোজা ডায়েস থেকে পড়ে ফ্লোরে গিয়ে পড়লো।তিনি নেমে এসে তিমিরের চুল ধরে তুললেন।
“হারাম*জাদি বল তুই এখানে কি করছিস,আমার মেয়ে কোথায়?”
“মা লাগছে ছাড়ো,প্লিজ মা ব্যাথা পাচ্ছি তো”।
“মা* চুপ থাক।ব্যাথা পাচ্ছি (মুখ ভেংচি কেটে) আগে বল আমার মেয়ে কোথায়?তুই এখানে এলি কীভাবে? ”
তিমির চুল ছাড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু শান্তা ছাড়ছে না দেখে কবির সাহেব এগিয়ে এলেন মেয়ের চুল ছাড়াতে।
“কি করছো কি শান্তা পাগল হয়ে গেলে নাকি,এভাবে সবার সামনে তুমি ওকে এমনভাবে চুল ধরে মার*ছো কেনো?”
“চুপ একদম কথা বলবে না।তোমার লাই পেয়ে এই হারাম*জাদি আজ এ কাজ করার সাহস পেলো। আগে ওকে জিজ্ঞেস করো তুরফা কোথায়?”
“মা প্লিজ চুল ছাড়ো প্লিজ!”
শান্তা বেগম তখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।মনে হচ্ছে তার সারা শরীরের রক্ত সাপের বিষের মতো তার মাথায় গিয়ে ফণার কাজ করছে।
” আজ তোকে আমি মে*রেই ফেলবো যদি তুই আমার মেয়ের খবর না বলিস বল বলছি?”
“মাআআআআআআ”
সিড়ির মাথায় চিৎকার করে উঠলো তুরফা।তুরফার আওয়াজ শুনে সবাই সেদিকে তাকালো।এলোমেলো চুল,সাজের অবস্থা নাজেহাল,সেই সাথে গায়ে রয়েছে বিয়ের পোশাক।তুরফা দৌড়ে আসতেই শান্তা বেগম তিমিরকে ছেড়ে তুরফার কাছে চলে এলো।তুরফা মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলো।তিমিরকে বাদ দিয়ে এখন তুরফাকে দেখছে সবাই। এতো ভালোই নাটক চলছে একের পর এক টুইস্ট যাকে বলে ফাটাফাটি।
“মা আমার,তোর এই অবস্থা হলো কি করে মা,বল আমায়,আর তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
“মা, মা তিমির আমার এ অবস্থা করেছে।সে আমাকে মাথায় আ*ঘাত করে ওয়াশরুমে হাত মুখ বেঁ*ধে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল।আমি অনেকক্ষণ চেঁচানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু উপায় পাই নি।তাই শেষমেশ বাঁধন খুলে দৌড়ে এলাম। কিন্তু মা সফেদ কোথায়, কাজি কোথায়,আমার বিয়ে,আমার বিয়ে হবে না?
বিয়ের কথা শুনে শান্তা বেগম কেঁদে দিলেন।আর অগ্নিদৃষ্টি দিলেন তিমিরের দিকে।তুরফাকে ছেড়ে তিনি তিমিরের দিকে এগিয়ে আসতেই কবির সাহেব বাধ সাধলেন।
“শান্তা অনেক হয়েছে এবার যদি তুমি ভরা মজলিশে আরেকবার তিমিরকে কিছু করো তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
শান্তা বেগম কবির সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে তিমিরের কাছে এলেন।তিমিরের সারা মুখে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেনো করলি তুই এসব,কেনো করলি?কেনো আমার মেয়ের সাথে এ পরিবারের সাথে তুই এমন করলি?লজ্জা করলো না বড় বোনের হবু জামাইকে ঠকিয়ে বিয়ে করতে।বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার,সবার সাথে এত বড় প্রতারণা করতে একটুও বুক কাপলো না তোর?”
তিনি সজোরে আরেকটা লাগিয়ি দিলেন চড়।এবার তিমির নিজেকে আর সামলতে পারলো না।সোজা গিয়ে পড়লো ডায়াসের কোণায় আর তাতে লেগেই কপাল কেটে গেলো। উহ্ শব্দ বলেই নিচু হয়ে রইলো। এ মুহুর্তে সে কি বলবে,যে এ সবটা তুরফা আপুর সাজানো ছিল।সে এসব করতে চায় নি,তাকে জোর করে এটা করতে বাধ্য করেছে তুরফা আপু,শুধু তাই নয়,তুরফা আপু এও বলেছে বিয়ে শেষ হলে সবটা তিনি সামলাবেন।কিন্তু ট কেমন সামলানোর পদ্ধতি? এখানে তো উল্টো তিমিরকেই ফাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পর কীভাবে সে এসব বলবে আর বললেও কে বিশ্বাস করবে তার কথা?
শান্তা বেগম এগিয়ে আসতেই এবার কবির সাহেব রেগে উঠেন।ফিসফিসিয়ে জানালেন,তিমিরের গায়ে হাত দিলে এবার তিনিও হাত তুলবেন। সেটা বুঝতে পেরে দমিয়ে গেলেন শান্তা। এত মানুষের সামনে নিজের সম্মান খোয়ানোর ইচ্ছে নেই। কিন্তু কি করবে রাগ যে সামলানো মুশকিল?এমন বনেদি ঘরের বউ বানানোর স্বপ্ন কতদিনের ছিল মেয়েকে,শেষে কিনা সব বানচাল করলো এই কালো মেয়ে?না এ হতে দিবে না তিনি?
অতিথিরা এক এক করে চলে যাচ্ছে। অনেক প্রহসন দেখা হলো আর থাকা যায় না।এবার যে যার নীড়ে ফিরবে।সফেদ আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তার খোলা চোখ দেখেই যাচ্ছে, তার খোলা কান শুনেই যাচ্ছে কিন্তু মাথার অন্তরালে প্রবেশ হচ্ছে কিনা কে জানে?সে শুধু ভাবছে তুরফা তার হয় নি,তার প্রিয়তমা তার হয় নি?তার শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে নড়ার শক্তিটুকুও শেষ শুধু শ্বাস নিতে হচ্ছে বলে আপনা থেকে বুক উঠানামা করছে।বাড়ির দরজায় এসে চারপাশের নিস্তব্ধতা দেখে ঘাবড়ে গেলেন জিন্নাহ সাহেব, সফেদের বাবা।কাজের চাপে ছেলের পুরো বিয়েতে না থাকলেও অন্তত বিদায় বেলায় থাকার মতো সময় নিয়ে তিনি এসেছেন কিন্তু বিয়ে বাড়ির নিরবতায় তিনি কিছুটা ভয় পেলেন।ঘটনা কি জানতে ভেতরে ঢুকার মুখে দুই পরিবারের ছিটিয়ে ছড়ানো অবস্থায় দেখে তিনি দাড়িয়ে পড়েন।সেই সাথে আটকে যায় তুরফার এলোমেলো অবস্থা ফ্লোরে পড়ে থাকা তিমিরকে দেখে। দুজনেরই গায়ে বিয়ের পোশাক কিন্তু তার জানামতে সফেদের সাথে তুরফার বিয়ে হচ্ছে তাহলে তিমির কেনো এ পোশাকে,তার মানে কি এখানে কেনো অঘটন ঘটেছে কিন্তু কি সেটা?
“ওগো সর্বনাশ হয়ে গেলো গো আমাদের? এ কালো মেয়েটা সব শেষ করে দিলো।আমাদের সফেদ কে ঠকিয়ে বিয়ে করে নিলো।”
সুরেলা কান্না করে নিপা এগিয়ে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন।জিন্নাহ সাহেব বউয়ের এই কথায় বুঝে নিলেন যা বোঝার তবে তার চেহারায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন হলো না।তবে বোঝাও যাচ্ছে না আসলে তিনি কি খুশি হলেন না বেজার হলেন।
অবশেষে বৈঠক করা হলো, তিমিরকে নিয়ে কি করা যাবে?যতই হোক স্বীকার করুক না করুক তিমির তো এখন সফেদের বউ চাইলে তো আর তাকে অস্বীকার করা যায় না।তাই সিদ্ধান্তে আসতে হবে তিমির কোথায় থাকবে?শান্তা বেগম কার্টসিট জবাব দিলেন তিনি আর তিমিরকে এ বাড়িতে রাখবেন না এরজন্য যদি স্বামীর সাথে তার দ্বন্দ্ব হয় তাতেও তিনি পিছপা হবেন না কথা শেষ করে তিনি হনহনিয়ে রুমে চলে গেলেন।নিপা বেগমও একি সুরে গলা ধরলো,এ কালো মেয়েকে কোনোভাবে ছেলের বউ হিসেবে বাড়ি তুলবেন না।কিন্তু যতই হোক বাপের বাড়ির সাথে তিমিরের সম্পর্ক এ মুহুর্ত থেকে শেষ। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি আসল ঠিকানা তাই কূলকিনারা না পেয়ে জিন্নাহ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন তিমিরকে তিনি বাড়িতেই নিয়ে যাবেন।স্বামীর সিদ্ধান্তে রাগে গজগজিয়ে উঠলেন নিপা কিন্তু তিনি নিপার কথায় কান না দিয়ে কবির সাহেবকে জানালেন তিমির তাদের বাড়িতে যাবে পরে যা হবার তা হবে।আপাতত এ প্রহসন বন্ধ হোক।নিপা বেগম আগে আগে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।জিন্নাহ সাহেব মেয়ে আর ছেলের বউকে নিয়ে একাই বাড়ি ফিরলেন।এরমধ্যে তিমিরের চোখ হন্যে হয়ে সফেদকে খুঁজলেও কোথাও তার টিকিটি চোখে পড়ে নি।তিমির বুঝলো খুব জটিল সমস্যায় সে আটকে পড়েছে।এ সমস্যা থেকে কেউ তাকে বাঁচাবে না!
.
.
.
সূচনা
#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে
#তানিয়া
()