প্রেমের মরা জলে ডুবে পর্ব -২২ ও শেষ

#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে

#তানিয়া

অন্তিম পর্ব

শুভ্র ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসলো।ইদানীং শরীরে তার ভালো এনার্জি আসে না সবসময় অবসাদ ক্লান্তি যেন ভর করে থাকে।সারাদিনের কাজ শেষে যখন নিজের রুমটাতে আসে মনে হয় যে চারপাশে তিমির আর বাচ্চার কলধ্বনি তার কানে বাজছে অথচ চারপাশে চোখ বুলালে কারো অস্তিত্ব নেই। তিন বছর আগেই তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে এ পৃথিবীর বুক থেকে। খুব করুণ করে তারা শুভ্রকে ছেড়ে চলে গেছে অথচ সন্তান বউ নিয়ে শুভ্রর আনন্দের একটা সময় পার করার কথা ছিল সবটা যেন কাল বৈশাখের হঠাৎ আসা কালো মেঘের মতো এলোমেলো করে গেলো।শুভ্র ভাবতে পারে না সেদিনের কথা যেদিন নিজের চোখে তিমির আর তিন মাসের অনাগত বাচ্চার মৃত্যু ্টা সচক্ষে দেখেছিল।মৃত্যু খুব ভয়ানক হয় তা শুভ্র প্রমাণ পেয়েছিল চোখের সামনে বাঁচা মরার অবস্থানে থাকা তিমিরকে দেখে।এতটা নিষ্ঠুর মৃত্যু না হলেও পারতো তাদের,এভাবে একা করে না গেলেও পারতো কিন্তু সব কি তার কথায় হবে ভাগ্যের লিখন যে আগে থেকে তৈরি ছিল আর তাই ঘটলো।

আলো টা জ্বলতে চোখ মুখ বিশ্রী করে কুঁচকালো শুভ্র। অন্ধকারটা বড্ড চোখ সওয়া হয়ে গেছে আলো বস্তুটা আর ভালো লাগে না।তিমির একটা কাজ ভালোই করেছে নিজের সাথে সাথে অন্ধকারের রেশটা শুভ্রর জীবনে রেখে গেছে। এখন আর কোলাহল আওয়াজ আনন্দের কোনোকিছু শুভ্রকে টানে না।চোখ খুলে দেখে শুভা দাঁড়িয়ে আছে তার চোখ থেকে পানি ঝরছে।শুভ্র হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো।শুভা ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে মাথা নিচু করে চোখ মুছলো।

কিরে কাঁদছিস কেনো,তোকে যতবার দেখি ততবার কাঁদিস এত ছিচকাদুনে কখন থেকে হলি?

ভাইয়া তুমি এমন কেনো হয়ে গেলে,তুমি কি ভাবো এভাবে দিনের পর দিন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে ভাবি ফিরবে? বরং তোমার নিজের প্রতি করা এসব অন্যায় সে সইতে পারবে না কেনো তুমি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?

তোর ভাবি যদি সইতে না পারে তবে চলে আসতে বল,আমি দেখতে চাই সে কতটা ভালোবাসে আমাকে?খুব তো বলতো আমাকে নাকি ভালেবাসে আমার জন্য সব পারে তাহলে তাকে বল আমার জন্য সে আবারও ফিরে আসুক?

ভাইয়া ভাবি ফিরবে না কেনো অবুঝের মতো কথা বলছো,সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে এ পৃথিবীর কোথাও সে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারতো না শুধু মাত্র মৃত্যুই ওকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করেছে কেন তুমি নিজেকে আঘাত করে ওকে শাস্তি দিচ্ছো?

শুভা আমি ওকে শাস্তি দিচ্ছি নাকি ও আমাকে শাস্তি দিচ্ছে?ও তো মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে একবারে চলে গেছে কিন্তু আমি, আমার অবস্থা দেখ এ দুনিয়াবি জীবনে আমি প্রতিনিয়ত জীবন্মৃত হয়ে লড়াই করছি।না বাঁচতে পারছি আর না ম*রতে?আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ওর প্ল্যান কত সুন্দর একবার দেখ,নিজে তো গেলো সাথে বাচ্চাটাকেও নিয়ে গেলো? আমার বেঁচে থাকার মতো শুধু রেখে গেলো সব বাজে স্মৃতি যা ভাবলে প্রতিটা রাত আমি কেঁপে ওঠি।তুই বলছিস আমি শাস্তি দিচ্ছি তাহলে ও আমাকে কি দিচ্ছে বল একবার?

শুভা ভাইয়ের কথায় কিছু বলতে পারেনা কাকে বুঝাবে সে এ দুঃখ, যে তিমির ভাইকে বুঝতো তাকে সামলাতো, সে তিমিরই তো ভাইকে ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে কি বুঝ দিবে সে ভাই ্কে?

ভাইয়া আমি জানি ভাবি তোমার কি ছিল তাই ওকে ভুলার কথা তোমায় বলবো না শুধু এটাই বলবো ও তোমাকে সবসময় সুখী দেখতে চেয়েছে তাই তুমি ওর আত্মার শান্তি ভেবে হলেও নতুন করে…

শুভা????তোর কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না।অন্তত তুই জানিস তোর ভাই কীভাবে দিন পার করছে।তুই যা বিরক্ত করিস না।

শুভা কান্না করতে করতে চলে গেলো। তিমিরের মৃত্যুর পর থেকে নিপা কিছু সময় চুপ থাকলেও পরে পরে ছেলের জন্য অনেক মেয়ে দেখে কিন্তু শুভ্র সাফ না জানিয়ে দেয়।নিপা ক্লান্ত হয়ে গেলে শুভাকে দিয়ে কাজ চালায় কিন্তু শুভা ভাইয়ের কষ্ট বুঝে প্রথম দিকে চুপ থাকলেও পরবর্তীতে বুঝে এভাবে ভাইকে একা রাখা মানেই তাকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে দেওয়া।প্রিয় সইকে হারিয়েছে এখন আর একমাত্র ভাইকে হারাতে চায় না। তাই সেও মায়ের মতো করে শুভ্র ্কে নতুন জীবনের কথা বুঝাল কিন্তু এতে ভালো কিছু হয় নি বরং বিপরীত ব্যবহার পেয়েছে শুভা।আর কিছু মাস পর নীল তাকে নিয়ে যাবে বাইরের দেশে এরপর হয়তো আর কখন দেশে আসে তাই যাওয়ার আগে ভাইকে একটা লাইন করে দিতে চায়।

শুভ্র দুলতে দুলতে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়টা আরেকবার স্মরণ করছে,যদিও স্মরণ করতে চায় না বারবার সে স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়।মৃত্যু যখন হবেই তখন শান্তির মৃত্যু দিলেও পারতো এতটা নিষ্ঠুরতম মৃত্যু কেনো হলো?শুভ্র যতবার সে মৃত্যুর কথা ভাবে ততবার তার গা শিউরে ওঠে। কী বীভৎস সে মৃত্যু উহ্!

দেখতে দেখতে তিমিরের বোর্ড পরীক্ষা শুরু হলো।আগের মতো নিজেকে এখন আর পড়ালেখায় দূর্বল মনে করে না তিমির।টেস্টের পর শুভ্র তার টিউশন ছাড়িয়ে দিয়েছে, ভালো কয়েকটা কোচিং এ দিয়েছে। কথা একটাই ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।তিমির তো কোচিং সংখ্যা দেখে অজ্ঞান হওয়ার দশা।নিঃশ্বাস ফেলার ফুসরত টুকু শুভ্র তার জন্য রাখে নি।শুভ্রর এক কথা কষ্ট একবার হবে বারবার না তাই ভালো করে মন দিয়ে পড়াশোনা করে পাবলিক ভার্সিটি ্তে ভালো একটা সাবজেক্ট পেলেই তবে তিমিরের মুক্তি। তিমির তো ভেতর থেকেই ম*রে যাচ্ছিল কিন্তু শুভ্রর শাসনের সাথে শুভ্রর ভালোবাসাটা তাকে সবসময় সাহস দিয়েছে।

পরীক্ষার পর্ব শেষ হওয়ার পর তিমিরের সকল ক্লান্তি যেন উবে গেলো।এতদিন তিমিরের কাছ থেকে শুভ্র দূরে ছিল আর তিমিরও শুভ্রকে তেমন চাপ দেয় নি।কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার ছুতো পেতেই তিমির এবার শুভ্রর পিছু ধরলো।পরীক্ষার জন্য দুজনের থাকা আলাদা ছিল তাই তিমির তার যাবতীয় জিনিস নিয়ে শুভ্রর রুমে হামলা চালালো।তিমির দেখেই শুভ্র রাজ্যের বিরক্ত নিয়ে তিমিরকে প্রশ্ন করলো,

তিমির চলে এলে কেনো শুভার রুম থেকে?

আপনার আমার প্রতি দরদ থাকতে না পারে আমার দরদদদ অনেকককককককক বেশি তাই চলে এলাম।আর আপনি এমন কেনো,স্বামী রা কীভাবে বউকে কাছে রাখবে সে চিন্তা করে আর আপনি আমাকে কীভাবে দূরে রাখবেন সে চিন্তা করেন,আমি কালো বলে কি আপনার আমাকে মেনে নিতে এখনো কষ্ট হয়?

তিমির হাসি হাসি মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলো তবে চোখ গুলো চিকচিক করছে।শুভ্র হঠাৎ বুকটা ধ্বক করে উঠলো।

তিমির, এসব কথা কেনো বলো,তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, তুমি তো জানো আমাকে এখন কত খাতা কাটতে হবে লাইট জ্বালিয়ে কাজ করতে হবে তাই তোমার যদি অসুবিধা হয়?পরীক্ষার পরে প্রত্যেকটা স্যাররা পরীক্ষার খাতা নিয়ে কী পরিমাণ ব্যস্ত থাকে সেটা যদি তুমি বুঝতে?আর আমি প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিরিবিলি করতে পছন্দ করি তাই?

ঠিক আছে সমস্যা নেই আমি চলে যাচ্ছি। আপনার অসুবিধা হয় এমন কিছু আমি কখনো করবো না।

তিমির হাতের বালিশটা নিয়ে দরজার কাছে যেতেই শুভ্র দ্রুত পায়ে তিমিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

তিমির রাগ করেছো বুঝি? সরি আসলে আমি স্বাভাবিক কথা বললেও সেটা কীভাবে যেন তোমার কাছে আঘাতের মনে হয় নাকি সত্যিই আমি তোমাকে বারবার আঘাত করি এটা আমার মাথায় আসে না।যাই হোক তুমি থাকলে আমার অসুবিধা নেই কিন্তু তোমার কোনো সমস্যা হবে কি যদি আমি আলো জ্বালিয়ে কাজ করি?

না থাক আমি থাকবো না আর।আপনার যখন সব কাজ ফুরোবে তখন আসবো।

তিমির ঘুরে যেতে শুভ্র হাত টান দেয়।

প্লিজ সরি বলছি তো।যাও ঘুমাও আমার রাত হবে।

তিমির শুভ্রর অসহায় মুখের ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়।শুভ্রর বুকের বা পাশে একটা পিঞ্চ মেরে তিমির বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।

রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। শুভ্র হাতের খাতাটা শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে নেয়। বিছানার কাছে আসতে হঠাৎ শুভ্রর নজর আটকে যায় তিমিরের খোলা কোমড়ে।তিমির সবসময় থ্রি পিছ পরে,শাড়ি বস্তটা কম পরে।হঠাৎ আজ শাড়ি পরলো বলে হয়তো এভাবে খোলা অংশটা শুভ্রর নজরে এসেছে।তিমিরের গায়ের রঙটা কালো বলা চলে না,কেমন টানটান মসৃণ ধরনের। শরীরের গঠনটা বাঁধুনী ধাঁচের।পুরো শরীরে ভরাট যৌবন।শুভ্রর হঠাৎ নেশা লেগে গেলো।শুভ্র পা টিপে টিপে এগোলো।বিছানায় বসে এক পা ভাজ করে খুব প্রেমময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তিমিরের পুরো শরীরে। হাতটা বাড়াতে হঠাৎ ভেতরে সংকোচ চলে এলো।বারবার তিমিরের ডাকে সাড়া না দেওয়া,তিমিরের চাহিদা বোঝার পরও সেটাকে এড়িয়ে যাওয়া সেই সাথে একটু আগের ব্যবহার শুভ্রর ভেতর অপরাধ দেখা দিলো।তাছাড়া তিমির হয়তো ঘুমে থাকবে কেনো তাকে জাগাবে,বিষয় ্টা মাথায় আসতে সে হাত সরিয়ে নিয়ে উঠবে এমন সময় হাত টান পড়লো শুভ্রর।পেছনে তাকাতে দেখে ফোলা চোখে তিমির তার দিকে তাকিয়ে আছে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি।

তুমি ঘুমাওনি?

না আপনার অপেক্ষায় ছিলাম?

তুমি কি জানতে আমি আসব?

হাফ নিশ্চিত ছিলাম কারণ মনে মনে আপনাকে চাইছিলাম যদি টেলিপ্যাথি পদ্ধতিতে আপনার মন অবধি সে কথা পৌঁছে যায়?

তা কি বুঝলে পৌঁছেছে কি?

তিমির হেসে উঠে বসলো। শুভ্র ্কে জড়িয়ে ধরলো।কানে ছোট্ট একটা বাইট করে বললো,

এই তো তার প্রমাণ!

শুভ্র ্কে ছাড়া তিমিরের দূরে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু উপায় ছিল না।পরীক্ষা অবধি তাকে এ দূরত্ব মানতে হবে কিন্তু পরীক্ষার শেষ দিন তিমির প্ল্যান করলো সে শুভ্র ্কে কাছে টেনে নিবে।তাই শাড়ি পরে এসেছিল শুভ্রর রুমে কিন্তু কথোপকথনে তিমির খুব কষ্ট পেলেও প্রকাশ করলো না।তাই নিশ্চুপ থেকে শুয়ে পড়লো।কিন্তু শোয়ার পর না ঘুমিয়ে অনবরত কান্না করছিল।মুখে কাপড় গুঁজে ছিল যাতে শুভ্রর কান্ অবধি সে কান্না না যায়।কিন্তু রাত যে বেশি হয়েছে এটা খেয়াল ছিল না হঠাৎ দেয়ালে ছায়া পড়তে দেখে তিমিরের শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো।তিমির ভাবছিল এ বুঝি শুভ্র তাকে কাছে টেনে নিবে তাই সে চোখ বড় করে দেখছিল কি হয় কিন্তু শুভ্র যখন হাত গুটিয়ে নিলো তখনি তিমির নিজেই শুভ্রর দিকে ফিরলো।আজ অন্তত এভাবে দূরে থাকা তিমিরের পক্ষে সম্ভব না যেখানে শুভ্র নিজেই হাত বাড়িয়েছে।

এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হওয়ার আগে তিমির নিপাকে জানালো যাতে কিছুদিনের জন্য তারা বেড়াতে যেতে পারে। নিপাও বুঝলো শুভ্র কাজ নিয়ে বিজি থাকবে তাই সে জোর করে তিমির শুভ্রকে বেড়াতে পাঠালো।কথা ছিল শুভাও যাবে কিন্তু নিপা সেটা করতে দিলো না। এমনিতেও শুভ্র তিমিরের হানিমুন হয় নি তাই নিপা ছোট একটা হানিমুন ট্রিপের ব্যবস্থা করলো।

জানুয়ারির মাঝামাঝি শীতের কনকনানিতে দাত কপাটি লাগার অবস্থা। তিমির শুভ্র গরম জামা কাপড় নিয়ে এসেছে। দুজনে পাহাড়ি এলাকা বান্দরবানে এসেছে হানিমুনে। পাহাড়ি আর গাছা গাছালি হওয়াতে ঠান্ডাটা এখানে বেশ পড়ছে।একটা মোটেলে আগে থেকে সিট বুকিং করা ছিল।মোটেলে পৌঁছেই দুজনে ফ্রেশ হয়ে নিলো।আসতে আসতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। নাশতা শেষ করে দুজনে রিসোর্টে বেড়াতে বের হলো।এরমধ্যে শুভ্র বাসায় কল দিয়ে জানিয়ে দিলো তাদের পৌঁছানোর খবর।তিমির একটা বয়কে ডেকে কি জানি বললো,শুভ্র কথার ফাঁকে সেটা দেখলো কিন্তু বুঝলো না কি কথা হয়েছে? কথা শেষ করে এসে তিমিরকে জিজ্ঞেস করতে সে হেসে মিথ্যা বললো।

রাতের খাবারটা খেয়ে শুভ্র বিল মিটিয়ে যায় তিমির রুমে যায়। শুভ্র রুমে ঢুকে দেখে পুরো রুম মেমবাতির আলোতে জ্বলজ্বল করছে।সে দরজা বন্ধ করতে খট করে আওয়াজ হলো।দেখলো তিমির দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশরুমের বাইরে।তিমির আটপৌরে শাড়ি পড়েছে অথচ তার উন্মুক্ত বাহুতে নেই কোনো কাপড়।রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিতে যেভাবে শাড়ি পড়ার বর্ননা ছিল ঠিক সেই শাড়িতে তিমির দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র অবাক নয়নে চেয়ে আছে তাকে।তিমির ধীর পায়ে শুভ্রর দিকে এগোচ্ছে একি গতিতে শুভ্র ্ও এগোচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তিমিরের আলো আধারে প্রকাশিত হওয়া এ সৌন্দর্য শুভ্র ্কে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
তিমির শুভ্রর চাহনিতে এমন একটা প্রেম দেখলো যা এরআগে সে খুজেছিল বারবার।

কি হে মশাই কি দেখছেন অমন করে?

তিমির তুমি আজ এটা কি করলে, তোমার শরীরের পুরো সৌন্দর্যতা আজ তো বিশ্বের সেরা সুন্দরীদের পিছিয়ে দিবে?

তাই নাকি, আমি তো কাউকে এ সৌন্দর্য নিয়ে হারাতে চাই না বরং আপনাকে ভালোবেসে বেঁধে রাখতে চাই।

শুভ্র তিমিরের খুব কাছে গিয়ে দুই হাতে তিমিরের মুখটা তুলে ধরলো।ঠোঁট দিয়ে লেহন করলো তিমিরের সারা মুখ।তিমির চোখ বন্ধ করে সেটা অনুভব করছে।শুভ্র আরো গভীর হওয়ার আগে তিমির কানের কাছে ঠোঁট নিলো।

শুভ্র এ ভালোবাসা কিন্তু আজ আমি একা নয় আমরা দুজনে উপভোগ করবো।

শুভ্র নেশাক্ত স্বরে জানালো,

হু তুমি আর আমি।

না আমি আর সে।

শুভ্র চোখ খুলে তিমিরের চোখে চোখ রাখলো। তিমির দেখলো শুভ্রর চোখে প্রশ্ন, ‘সে’ মানুষটা কে জানার জন্য। তিমির ঠোঁট কামড়ে হাসলো।শুভ্রর এক হাত পেটে রাখলো।

সে এখনো এ ঘরে আছে, এ পৃথিবীতে আসতে তার আরো ৬ মাস লাগবে।ততদিন আমিই ভোগ করবো তার ভালোবাসাটা।

শুভ্রর নেশা কেটে গেলো।সে চোখ বড় করে ফেললো।চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো মানে কি, তখনি তিমির জানালো অন্তঃসত্তা সে!শুভ্র এতটাই বিস্ময়ে চোখ বড় করলো যে মনে হলো আর সুযোগ থাকলে চোখ জোড়া কোঠর থেকে বেরিয়ে আসবে।সে একবার পেটে তাকায় তো একবার তিমিরের মুখে।
কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

কমাস?

তিনমাস হলো?

আগে জানাও নি কেনো

,সারপ্রাইজ দিব বলে?

এত লেট?

আমিও দেরীতে জেনেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো এমনি পিরিয়ড হচ্ছে না কিন্তু দ্বিতীয় মাসে জানলাম তখন পরীক্ষা চলছিল তখনো শিউর হয়নি পরে

শুভ্র তিমির থেকে আরকিছু জানতে চাইলো না তিমিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।

কাদলে হবে আমরা যে অপেক্ষা করছি আদর খাওয়ার।

না যদি তার সমস্যা হয়।

উহু হবে না আমি আসার আগে একজন গাইনী থেকে জেনে এসেছি।মা আমাকে নিয়ে গেছিলেন।তিনিই আমাকে সবটা জানালেন যে প্রথম তিনমাস অতিক্রম হলে সমস্যা হবে না মেলামেশায়।

তার মানে মা জানতো।

আপনি ছাড়া সবাই জানতো আমিই নিষেধ করেছিলাম যাতে আপনাকে আলাদা ভাবে সারপ্রাইজ দিতে পারি। এখন আমাকে আদর দিন।ভুলে যাবেন না এখন কিন্তু আমরা দুজন।

শুভ্র ভাবলো দেরীতে জানায় রাগ করবে কিন্তু তিমির বাচ্চাদের মতো এত কিউট আবদার করলো যে সেটা আর সম্ভব হলো না।সে আজ আদর দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিলো তিমিরকে।

ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিপা,শুভা,জিন্নাহ সাহেব।শুভ্রকে নরমাল রুমে রাখা হয়েছে। তিমিরকে রাখা হয়েছে ওটিতে।তিমিরের অবস্থা আশঙ্কা জনক।বাচার চান্স নেই বললেই চলে।শুভ্রর জ্ঞান ফিরতে সে চোখ খুলে তিমিরকে খুঁজলো।শুভা ভাই য়ের রুমে এসে দেখে শুভ্র স্যালাইন খুলছে।শুভা দৌড়ে এলো,

ভইয়া কি করছো তুমি?এটা তোমার শরীরের জন্য দরকার।এমন করো না?

শুভা তিমির কোথায়?

তিমিরের নাম শুনে শুভা কথা বলতে পারলো না।হুহু করে কেঁদে দিলো।শুভ্র শুভার কান্না দেখে দৌড় দিলো।শুভাও গেলো। ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখে নিপা এগিয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।শুভ্র তখনো তিমিরকে খুজছে?

মায়ের কাছে তিমিরের নাম করলো কিন্তু নিপা ছেলেকে উত্তর দিতে পারলো না ক্রমাগত কাঁদতে লাগলো।তখনি ওটি থেকে একজন ডাক্তার বের হলো।

রোগী বাচার সম্ভবনা নেই প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। একটু খানি চোখ খুলেছে শু শু করছে।শু দিয়ে কার নাম।

শুভ্র বুঝলো তাকে খুঁজছে সে দৌড়ে গেলো।তখনো তিমিরের পুরো বেড রক্তে ভাসছে।শুভ্র এগিয়ে গিয়ে তিমিরের মাথায় হাত রাখতে তিমির চোখ খুললো।কতটা কষ্ট, বেদনা আর অসহায় ্তা আছে এ চোখ জোড়ায়।তবুও তিমির হাসলো তারপর থেমে গেলো হৃদযন্ত্রটা।কেবিনে কয়েকজন ডাক্তার ছিল তারা ঘোষণা করলো তিমির মৃত।সাথে সাথে গগনবিদারী চিৎকারে পুরো হাসপাতালের করিডোর থেকে শুরু করে পুরো এলাকা শুভ্রর কান্নার প্রতিধ্বনি হলো।কেবিনে প্রবেশ করে শুভা নিপা দুজনে কান্না করে উঠলো।

মা মা তিমির নেই, ও মা তিমির চলে গেছে? মা গো আমার সন্তান কই মা কোথায় আমার ছোট বাচ্চাটা?মা তিমির আর কথা বলবে না,এ শুভা তোল তোর বান্ধবীকে, ঝগড়া কর তোরা,ও মা বকা দাও না তিমিরকে?এ তিমির আমার পেছনে লাগবে না,আমার কাছ থেকে আদর নিবে না,তিমির তুমি না বলেছিলে আমাদের একটা বাচ্চা হবে আর সে বাচ্চাটা আমার মতো সুন্দর হবে তাহলে তুমি শুয়ে আছো কেনো,তিমির উঠো না আমাদের বাচ্চার খোঁজ নিবে না তিমিরররর????

বিকট চিৎকারে পুরো পৃথিবী যেন ফাঁক হয়ে গেলো। সবাই কাঁদছে শুভ্রকে থামানো যাচ্ছে না।শুভ্র ডাক্তারের কাছে গিয়ে বাচ্চার খোঁজ করলো যে বাচ্চা এখনো পুরো গঠিত হয় নি যে বাচ্চা কখনো পৃথিবীর বুকে সুস্থ ভাবে আসার সুযোগ পায় নি।ডাক্তারটা ব্যাগে একটা থেতলে যাওয়া মাংসের পিন্ড আনলো যেটা সদ্য পিষ্ট হয়ে যাওয়া ভ্রুণ।নিজের অনাগত সন্তানের শোচনীয় অবস্থা দেখে শুভ্র জ্ঞান হারালো।

জ্ঞান ফিরতেই শুভ্র তিমির তিমির করে চিৎকার করতে লাগলো।শুভা গিয়ে তিমিরকে ডাকলো,

এ হা*রামি উঠনা, শুয়ে আছিস কেনো,দেখ আমার ভাই টা কেমন করছ,তুই না বলতি আমার ভাইয়ের কষ্ট সইতে পারবি না তাহলে উঠে তাকে শান্ত কর।এ ভাবি উঠনা আমার সাথে রুম ভাগ করবি না,ঝগড়া করবি না আমার চুল টানবি না।উঠনা? তুই না বলেছিল আমার ভাই কখনো তোর কষ্টে কাঁদবে না দেখ ভাই আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে উঠ প্লিজ?আমি তোকে কখনো রুমে থাকা নিয়ে কথা বলবো না,ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলবো না,আগে আগে ওয়াশরুম ছেড়ে দিব তবুও তুই উঠনা।

বলেই শুভা তিমিরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো।এ কোন দুঃস্বপ্ন তাদের জীবনে চলে এলো।যে শুভ্র পাথরের মতো মন ছিল বলে তিমিরের আফসোসের সীমা ছিল না সে তিমিরের জন্য তার ভাই য়ের আহাজারি পুরো দুনিয়া দেখলেও দেখতে পেলো না আফসোস করা সেই মেয়েটা।

বান্দরবন থেকে ফিরতি পথে গাড়ি বাক নেওয়ার সময় উল্টো পথ থেকে অন্য একটা গাড়ি এসে ঘর্ষণ লাগায় তিমিরদের বাসে।কুয়াশা থাকায় দেখার সুযোগ মিলে নি কিন্তু দুটো গাড়িই উল্টে যায়। এরপর হাসপাতাল থেকে খবর পেলে ছুটে যায় নিপারা।শুভ্র গুরুতর আহত হলেও লাইফ রিস্কে চলে যায় তিমির কারণ পেটে চাপ পড়ে তিমিরের ভ্রুণটা জরায়ুর মুখে চলে আসে সেই সাথে পিষে যায় তিমির।চিৎ হয়ে পড়ায় পেটে গিয়ে সমস্ত চাপ পড়ে তিমিরের।এরপর হাসপাতালে আনা হলে ডাক্তাররা অপারেশন করে পেট থেকে ভ্রুণটা বের করে আনে কিন্তু আঘাত এত বাজে ছিল যে ব্লিডিং শুরু হয় আর সেই বীভৎস ব্লিডিং এ মৃত্যু হয় তিমিরের।

শুভ্রর চোখে এখনো সেই বেডে পড়ে থাকা তিমিরের দেহটা ভাসে যার পুরো বেড লাল রঙে আচ্ছাদিত ছিল।শুভ্র আৎকে উঠে বারবার স্মরণ করতে গেলে সে মুহুর্ত গুলো।চোখ খুলে দেখে বেহায়া চোখ তার নিয়ম ভেঙে জল গড়াচ্ছে।শুভ্র উঠে তিমিরের ঝুলন্ত ছবির কাছে গেলো।ছবির হাসিমাখা মেয়েটার পেছন থেকে একটা কাগজ বের করলো।ভাজ খুলে পড়তে লাগলো

প্রিয় অনাগত সন্তানের বাবা,

আমার জীবনের অক্সিজেন, আপনাকে যখন এ পত্রটা লিখছি তখন আনুমানিক ৫ টা।আপনি বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছেন।আমার চোখে ঘুম নেই। খুশিতে আমার মন হৃদয় প্রফুল্ল হয়ে আছে। কীভাবে আপনাকে জানাবো আমার মনের সবচেয়ে লজ্জার সে অব্যক্ত কথাখানি।প্রিয় আপনি কি জানেন আমি আপনার সন্তানের মা হতে চলেছি,জানেন না কারণ আমি নিজেও জেনেছি দেরীতে।চাইলে জানাতে পারতাম কিন্তু আমি চাই নি আনন্দের এ খবরটা ব্যস্ততার মাঝো জানাতে তাতে আসল অনুভূতি হয়তো পাওয়া যাবে না।আপনার ছোয়ার প্রতিটা রাত আমার কাছে মধুর ছিল আর সেই ছোয়ার ফল স্বরূপ আল্লাহ আমাকে মা করেছেন।জানেন আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা বাচ্চা হবে।আমি মা হয়ে তাকে বড় করব।ছোট থেকে মাতৃ আদর পাই নি বলে মা হওয়ার আকাঙ্খা আমার মনে খুব ভালো করে গেঁথে ছিল কিন্তু ভয়ে ছিলাম যদি আপনি আমাকে না মানেন তাহলে আমার কি হবে?জানেন আমি কল্পনায় একটা বাচ্চাকে নিয়ে খেলতাম,তাকে গোসল করাতাম স্তন পান করাতাম,তার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতাম।কারণ মা হারা মেয়ে আমি তাই একজন আদর্শ মা হওয়ার খুব স্বাদ জেগেছিল। আমি ঠিক করেছিলাম আমি এমন এক মা হবো যে আমার সন্তান উদাহরণ দিতে গেলেই তার মাকে বারবার মনে রাখবে।কারণ মায়ের ভালোবাসার সবটা আমি তাকেই উৎসর্গ করবো।কখনো আমার কাছ ছাড়া করবো না সবসময় সব জায়গায় তাকে নিয়ে যাবো।আমার তৃষ্ণার্থ মাতৃ আদর আমি আমার সন্তানের দ্বারা পূরণ করবো।আপনি আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছেন।প্রিয় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।আপনার কাছে এ সত্যিটা জানাতে আমার লজ্জা করছে তাই সাদা কাগজে নিজের মনের কথাগুলো গুছিয়ে নিলাম।কখনো আপনার হাতে যাবে কিনা জানি না তবে খুব তাড়াতাড়ি আমার মনের কথাটা আপনাকে জানাবো।

ইতি আপনার অনাগত সন্তানের মা

শুভ্র চিঠিটা পড়ার প্রতিটা বাক্য চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে।চিঠিটা আগের জায়গায় রেখে ছবির দিকে তাকালো যেখানে তিমির তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

খুব মজা লাগছে তাই না,আমাকে জ্বালাতেই তো তুমি এসেছিলে কিন্তু এভাবে জ্বালিয়ে চলে যাবে এটা ভাবি নি।আমাকে তুমি নিষ্ঠুর পাথর আর হৃদয় হীন বলো আর তুমি যে আমাকে একা রেখে এভাবে সন্তানকে সহ নিয়ে চলে গেলে তার বেলায়। তুমি তো ঠিকই স্বার্থপরের মতো বাচ্চাকে কাছ ছাড়া না করে নিয়ে গেলে আর আমাকে রেখে গেলে এ কঠিন আর বীভৎস দুনিয়াতে।আসলে তুমি মেয়েটা খুব খারাপ এতটাই খারাপ যে আমার মনহীন মনে প্রেম জাগিয়ে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে গেলে অথৈজলে যেখান থেকে আমি আর ভেসে ওঠতে পারলাম না।ডুবে ডুবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এ প্রেম তো আমি চাই নি,এ ভালোবাসা তো আমি চাই নি,তোমার সাথে ই আমি সুখে থাকতে চেয়েছি তাহলে এ নিঠুর দুনিয়া কেনো সেটা হতে দিলো না!

কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পরলো শুভ্র। এ তার নিত্যকার কাজ।চিঠি পড়ার পর তিমিরকে হাজারটা দোষী করে নিজেকে সঁপে দিবে কান্নার দৌড়গড়ায়।

কতদিন,কতমাস,কতবছর এমনটা হবে জানা নেই তবে প্রেমের ম*রা মরে*ছে শুভ্র, প্রেম সাগরে পড়েছে, ডুবে তো মর*তে তাকে হবেই!

সমাপ্ত

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here