ফিলোফোবিয়া পর্ব -৩৩

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

৩৩

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

নিকষ কালো রাত পেরিয়ে উজ্জ্বল ভোর নেমেছে ভুবনে। কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে নরম আলো এসে বারান্দা ছুঁইছে। খানিক পূর্বেই প্রাতঃ ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরেছে শতাব্দ। ময়না এসে চা দিয়ে গেল। বারান্দাটা মোটামুটি বড়সড়, সাজানো। চারিদিক নানারকম ফুল গাছ। মাঝখানে সিলেটি বেতের চেয়ার টেবিল বিছানো আছে এক সেট। ইমান্দিপুর আসলে এখানে বসে সকালের চা খেতে পছন্দ করে।
আচমকা দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল প্রিয়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগেছে আজ। এবাড়িতে সবাই বেশ সকালে উঠে। কুয়াশা ঘেরা ভোরে, হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে একহাত ঘোমটা টেনে ঘুরতে হচ্ছে তাকে। ভেজা চুল বেঁধে রাখায় মাথাটা টিসটিস করছে।
বিরক্তি নিয়ে মাথা থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে চুল মেলে দিয়ে শতাব্দের সামনের চেয়ারে বসলো প্রিয়। রাশভারি আওয়াজ করে বলল,
‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’
যেন শুনেও শুনলো না শতাব্দ। না শোনার মত করে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখলো। প্রিয় লক্ষ্য করল, গতরাতের ঘটনার পর আরো গম্ভীর হয়ে গেছে শতাব্দ। খানিক এড়িয়ে চলতে চাইছে প্রিয়’কে। জবাবের অপেক্ষায় থেকে প্রিয় আবারো বলল,
‘ আপনি কি ব্যস্ত?…কিছু কথা ছিল!’
বইয়ের পাতায় চোখ রেখে আওড়াল শতাব্দ,
‘ বলো শুনছি।’
প্রিয় ঝটপট করে জিজ্ঞেস করল,
‘ আর কতদিন ছুটি আছে আপনার? ডিউটিতে কবে থেকে জয়েন করছেন।আমরা ঢাকায় ফিরছি কবে?’
‘ সাতদিন ছুটি আছে। বোধহয় না ছুটির দরকার আছে আর। আগামীকাল ঢাকায় ফিরছি। পরশু ডিউটিতে জয়েন করব।’
গম্ভীর হয়ে কিছু চিন্তা করছিল প্রিয়। ভাবনাতুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ এখান থেকে ঊষ্ণচড় কত দূর?’
প্রিয়’র মুখে ‘ঊষ্ণচড়ের’ নাম শুনে চমকাল শতাব্দ। ঊষ্ণচড় তার নানার বাড়ি। সেখানকার কথা জানতে চাইছে কেন প্রিয়! কপাল কুঁচকে প্রিয়’র দিক তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ কেন?’
শতাব্দের সন্দিহান মুখশ্রী দেখে, প্রিয় চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এঁটে নিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিলো,
‘ শাড়ির ফটোশুটের জন্য। কম্পানি জায়গাটা পছন্দ করেছে।’
প্রিয়’র কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না শতাব্দ’র। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ ফসলবিহীন খোলা মাঠে তোমার কম্পানির লোকজন কি সৌন্দর্য দেখল?’
ফেঁসে গেল প্রিয়। একটু চুপ থেকে আটকে আটকে বলল,
‘ আমি কি জানি। আপনি কি বলবেন ঊষ্ণচড় এখান থেকে কতদূর?’
‘ না, বলবো না। কারণ তুমি যাচ্ছ না।’ শতাব্দের রুখা আওয়াজ।’
‘ এখন কি আপনার জন্য আমার কাজ ছেড়ে দিবো? আমার কাজ করা মানসম্মানে লাগছে আপনার?’
‘ আশ্চর্য! আমি তা কখন বললাম। তোমার ভালো লাগে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে চাও করতে পারো। আমার মানসম্মানে বাঁধবে কেন? তুমি ঊষ্ণচড় যাবেনা জাস্ট এতটুকুই।’
‘ আপনার কথা মানতে আমি বাধ্য নই।’
প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো শতাব্দের। প্রিয়’র দিক শক্ত চাহনিতে চেয়ে রইল। ঊষ্ণচড় লুবনাদের বাড়ি। ছবি বেগম সেখানে নেতৃত্ব করছে। হাতে রাজনৈতিক বল আছে। চাইলেই প্রিয়’র ক্ষ*তি করতে পারবে। জেনেশুনে প্রিয়’কে যেতে দিবেনা সেখানে। খানিক চুপ থেকে থমথমে আওয়াজে বলল,
‘ ঝামেলা চাইছিনা কোন। তুমি ঊষ্ণচড় যাচ্ছো না প্রিয়। ব্যাস’
কাঠকাঠ চাহনি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ।

কাজ ছাড়া অলস বসে থেকে কোমর লেগে আসছে প্রভার। কাজের জন্য বাড়িতে লোক আছে দুজন। কোন কিছুতে হাত লাগাতে দেয়না। ঢাকা বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। সকাল থেকে এখন অবধি মাকে তিনবার ফোন করেছে। এখন আবার ফোন করলে নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। খানিক ফোন টিপাটিপি করে বিরক্ত হয়ে উঠল প্রভা। বিছানায় ফোন ছুঁড়ে, উঠে দাঁড়ালো। লাগেজের কাপড় বের করে আলমারি গোছাতে লাগল। আচমকা নিচের সারির দিক চোখ গেল। পুরাতন একটা কাঠে বাক্স। ভ্রু কুঁচকে এলো প্রভার। হাতে নিতেই দেখল তালাবদ্ধ। ব্যাপারটা তার মনে ভীষণ কৌতূহল জাগালো। বাক্সটা বিছানায় নামিয়ে, তালার চাবি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেকের ভেতর পেয়ে গেল। আলমারির ডয়ারেই রাখা ছিল। তালা খুলে বাক্স মেলতেই হতভম্ব প্রভা। অনেক গুলো চিঠি আর গিফট। এগুলো কার সমুদ্রের? মনে অদ্ভুত এক ভয় চাপলো। একটা চিঠি হাতে নিলো। কোথা থেকে পড়বে বুঝতে পারছেনা। সব এলোমেলো। কিছু চিঠি ছিঁ*ড়া ফাঁড়াও। প্রভার মাথায় কোনকিছু যেন ভর করল।ব্যস্ত হাতে তড়িঘড়ি করে বাক্সটার ভিতর কিছু খুঁজতে লাগলো। আচমকা কয়েকটা ছবি দেখে থমকে গেল। হাতে তুলে ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। সমুদ্রের সাথে একটা মেয়ে। কিছু ছবি বেশ ঘনিষ্ঠ। মাথা শূন্য লাগছে প্রভার। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এলো। বুকের ভেতর বিষন্ন ঝড়ে তোলপাড় হতে শুরু করল। বুক চিড়ে হাহাকার চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল।
সকালে সমুদ্রের ফুফাতো বোনদের বলা কথা মনে পড়ল। কথায় কথায় তাদের একজন বলছিল, কলেজ লাইফে একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতো সমুদ্র। যার জন্য ত্যাজ্যপুত্র হতেও রাজি ছিল।’ আরো কিছু বলতে চাইছিল জুবাইদাধমকে থামিয়ে দিয়েছিল। কথাগুলো তখন আমলে নেয়নি প্রভা। হাসিঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে কি সব কথা সত্যি ছিল। এই মেয়েটাই কি সেই! এতদিনের সম্পর্ক তাদের! কই একবার তো বলল না সমুদ্র। এখনো কি মেয়েটাকে ভালোবাসে। তাই বলেই এতো যত্ন করে তার স্মৃতি গুলো গুছিয়ে রেখেছে! ভেবে কেঁদে ফেলল প্রভা। বুকে প্রচন্ডরকম যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আজ মনে হচ্ছে সব মিথ্যা। সব!

গ্রামের কিছু কাজে বেরিয়েছিল শতাব্দ। বাড়ি ফিরে, ঘরে প্রিয়’কে না দেখে হাঁকডাক শুরু করল। ময়না পানি নিয়ে ছুটে এলো। শতাব্দ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ প্রিয় কোথায়?’
নিচু স্বরে উত্তর দিলো ময়না,
‘ বাহিরে গেছে।’
‘ বাহিরে কোথায়?’
‘ জানিনা ভাইজান। বড় আম্মা জানে।’
ক্ষিপ্ত ধাপ ফেলে নিচে নেমে এলো শতাব্দ। অভিলাষা বেগম রান্নাঘরে ছিল। দুপুরের রান্না হচ্ছে। কাজের লোকেদের তদারকি করতে ব্যস্ত। আচমকা রান্নাঘরে ছেলেকে দেখে অবাক হলেন। কিছু বলবেন তার পূর্বেই শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,
‘ প্রিয় কোথায় বেরিয়েছে?’
অভিলাষা বেগম স্বাভাবিক উত্তর,
‘ ফটোশুট আছে। বিকালের আগে চলে আসবে বলল।’
‘ কোথায় গেছে জায়গার নাম বলেছে নিশ্চয়ই?’
‘ না, বলল ইউনিট জানে।’
বিরক্ত হলো শতাব্দ। রাগ চেপে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায় যাচ্ছে তুমি জিজ্ঞেস করবে না! গাড়ি গিয়ে গেছে? ‘
‘ না, বলল কম্পানি থেকে গাড়ি পাঠিয়েছে। বাজার থেকে তুলে নিবে।’
রাগে চেঁচিয়ে উঠল শতাব্দ।বলল,
‘শিট! তাই শুনে তোমরা একাএকা যেতে দিলে?’
হুট করে ছেলেকে এমন রেগে যেতে দেখে অভিলাষা বেগম ঘাবড়ে গেল। অশান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে আব্বা! এমন রেগে যাচ্ছিস কেন। প্রিয়’র সাথে পুরো টিম আছে চলে আসবে।’
রাগ চেপে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করল শতাব্দ। চুলে আঙ্গুল চালিয়ে পেছনে টেনে। স্বাভাবিক কন্ঠ বলল,
‘ তুমি জানো কোথায় গেছে প্রিয়? ঊষ্ণচড়! তোমার ভাইয়ের গ্রামে। ওই হিং*স্র মানুষ গুলোর ভেতর।’
অভিলাষা বেগমের ভয় করতে শুরু করল এইবার। ছবি আর তার মেয়েকে দিয়ে বিন্দু পরিমান ভরসা নেই। তাদের কানে গেলে প্রিয়’র ক্ষ*তি করতে চাইবে নিশ্চয়ই। ছেলেকে শান্ত করতে তিনি বললেন,
‘ প্রিয়’র সাথে পুরো টিম আছে। এতো লোকের ভেতর ক্ষতি করতে পারবেনা কেউ।’
শতাব্দের রাগ আরো বেড়ে গেল। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
‘ ওদের আশায় থাকবো? আমার সন্দেহ মিথ্যা বলেছে প্রিয়। কোন ফটোশুট হচ্ছেনা।ওর মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে।একা গিয়েছে ঊষ্ণচড়ে। যদি আমার সন্দেহ একটুও মিলে যায়। সামনে বিপদ আসছে। আর এবার যদি আমার প্রিয়’র কিছু হয়। সম্পর্ক যাইহোক না কেন। কাউকে ছাড়বো না। শাহরিয়ার সাহেব বাঁধা হলে তিনিও ছাড় পাবেনা!’
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। ছেলের এমন কড়া শাসানিতে থমকে গেল আভিলাষা বেগম। স্বামী ছেলের ফেসাদে সবসময় তাকেই জ্ব*লতে হয়। এইতো সবেমাত্র এতবছরের ঝামেলা বিবাদ কা*টিয়ে বাপছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। বিয়ের উছিলায় হলেও, সম্পর্কগুলো সহজ হচ্ছিল। কিন্তু আজ যদি প্রিয়’র সামান্য আঁচড়ও লাগে কাউকে ছাড়বেনা শতাব্দ। সারাজীবনের জন্য সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে যাবে।

‘ আজ পনেরদিন তুমি ঊষ্ণচড় এসেছ। আমাকে একবার জানালে না কেন?’
শাদের ক্রো*ধানিত্ব আওয়াজে খানিক কেঁপে উঠল তুরফা। মাথা নত করে বাঁশের বেড়ার দিক চেয়ে রইল। তার মৌনতা শাদের রাগ বাড়াল আরো। অনেকটা চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমার কোন কথার কোন দাম নেই? তাইতো!’
তুরফা মৌনতা ভেঙ্গে ধীর স্বরে বলল,
‘ তোমাকে জানানোর প্রয়োজন আছে কি কোন?’
হতাশ হয়ে তাকাল শাদ। এই মেয়েটা কোনদিন তার মন বুঝবে না বলে, কছম কে*টেছে কি! সেই ক্লাস টেন থেকে পেছনে পড়ে আছে। ভালোবাসে! এই সাধারণ কথাটা কি বুঝেনা সে! এভাবে বারবার কেন এড়িয়ে চলে। শাদ শীতল স্বরে বলল,
‘ ভালোবাসি তুরফা।
তুরফা কেঁপে উঠল। মনে মনে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। একটু সময় নিয়ে মাথা উঁচিয়ে, শাদের চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ আমাদের মধ্যে কখনো কোন সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না।’
‘ কারনটা কি? দুজন সমবয়সী।’
‘ না, পারিবারিক। আমার পরিবার কখনো মেনে নিবেনা এই সম্পর্ক।’
‘ আমি মানিয়ে নিবো।’
‘ তারা কোনদিন মানবেনা। এক মেয়ে হারিয়েছে, সেই বাড়িতে আরেক মেয়ের বিয়ে দিবেনা।’
রেগে গেল শাদ। গর্জন করে বলল,
‘ আমার আত্মীয়’র জন্য জীবন গেছে বলে সেই দায়ভার কি আমার? আমি কেন গিভ আপ করব। তাছাড়া খু*নের ব্যপারটা স্পষ্ট হয়নি! ওইটা এ*ক্সিডেন্ট ছিল।’
তেতে উঠল তুরফা। গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ আপাকে খু*ন হতে আমি নিজ চোখে দেখেছি।’
‘ অনেকবছর আগের ঘটনা। তুমি তখন ছোট ছিলে। হয়তো দেখার ভুল ছিল!’
আ*হত হলো তুরফা। ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ভারী আওয়াজে ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,
‘ অতটাও ছোট ছিলাম না যে খু*ন আর এ*ক্সিডেন্টের পার্থক্য বুঝব না। তোমার ফুপুর ছেলে মেয়ে আমার আপাকে অমা*নবিক নি*র্যাতন করছিল। সবকিছু আমার চোখের সামনে হচ্ছিলো। আমি চাইলেও কিছু করতে পারছিলাম না তখন।’
তুরফার কাছে যেয়ে আলতো করে কাঁধে হাত রেখে। বুঝানোর স্বরে বলল শাদ,
‘ তোমার হয়তো ভুল হচ্ছে। রাগ থেকে এসব বলছ। সবাই জানে তোমার আপা পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল।’
কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল তুরফা। বলল,
‘ তুমি মানবেনা সেটা আলাদা কথা। তাই বলে তো সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবেনা।’
বড্ড কান্না পাচ্ছে তুরফার। বড়বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। একটু থেমে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,
‘ ‘ভালোবাসার’ প্রথম শর্ত বিশ্বাস। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসাও নেই। অনেক আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। তোমার পরিচয় না জেনে বন্ধুত্ব করা মারাত্মক ভুল ছিল। আমার পিছু নিবেনা প্লিজ। কিছুদিনের জন্য দাদীর কাছে এসেছি। ঝামেলা চাইছিনা কোন।’
পেছনে ঘুরে বাড়ির দিক পা বাড়াল তুরফা। শাদ পিছুপিছু হাঁটতে লাগল। তুরফাকে বোঝানোর জন্য। যেই কিছু বলবে অমনি সামনে প্রিয়’কে দেখল। তুরফাদের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। বিস্ময়ে থমকে গেল শাদ। প্রিয় এখানে কেন?
মুখোমুখি শাদকে দেখে প্রিয়’ও চমকে উঠল। কপাল কুঁচকে নিলো।
গম্ভীর রুখা আওয়াজে জিজ্ঞেস করল শাদ,
‘ এখানে কি করছেন আপনি?’
‘ আমারও একই প্রশ্ন, তুমি এখানে কি করছ?’
বিরক্ত হলো শাদ। প্রিয়’কে মোটেও তার পছন্দ নয়। আড়ষ্ট মুখ করে জবার দিলো,
‘ আপনাকে বলতে বাধ্য নই।’
ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,
‘ আমিও জবাব দিতে বাধ্য নই!’
প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো শাদ। তুরফা প্রিয়কে দেখে হাসিহাসি মুখ করে বলল,
‘ চলে যাচ্ছ আপু। থেকে যাও আজ।’
‘ অন্য একদিন আসবো আবার।’

প্রিয়’র সাথে তুরফার এতো ভালো পরিচয় দেখে হতভম্ব শাদ। তুরফাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ উনাকে কি করে চিনো?’
‘ আপাকে কে না চিনে। সোসাল মিডিয়ার পরিচীত মুখ।তাছাড়াও প্রিয় আপু আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। আপার খালা আমার মায়ের স্কুল ফ্রেন্ড ছিল।’
শাদের দিক তাকিয়ে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমরা একে অপরকে কি করে চিনো?’
তুরফা ‘ফ্রেন্ড’ বলতে যাবে তার পূর্বেই শাদ বলল,
‘ আমার গার্লফ্রেন্ড।’
থমকে গেল তুরফা। ফ্যালফ্যাল করে শাদের দিক চেয়ে রইল। বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রিয়। শাদের স্বভাব হুবহু শতাব্দের মত। স্পষ্টভাষী, বেশরম!
খানিক চুপ থেকে মিহি হেসে বলল প্রিয়,
‘ তোমরা ভাইদের প্রেমের রাশি ভীষণ বাজে। সবসময় ভিক্টিমের পরিবারের কাউকে ভালোবেসে ফেল।’
ফ্যালফ্যালে তাকিয়ে রইল শাদ।
তুরফাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়। ভরদুপুর। রাস্তাঘাট ফাঁকা, যানবাহন নেই কোন। বিরক্ত হলো প্রিয়। আসার সময় অটোরিকশায় এসেছিল। রাস্তা খারাপ হওয়ায় ঝাঁকুনিতে কোমরে হাঁড় খুলে পরার উপক্রম ছিল। শরীর হাতপা ছেড়ে দিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ওড়নার কোন দিয়ে কপালে ভেসে থাকা ঘাম মুছলো। পা চালিয়ে সামনের দিক হাঁটা ধরল। অমনি একটা অটোরিকশা দেখে হাত বাড়িয়ে থামানো ইশারা করল। ইমান্দিপুর যাওয়ার কথা বললে প্রথমে নাচক করল। পরবর্তীতে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললে রাজি হয়ে গেল। ক্লান্ত প্রিয় যেই অটোরিকশায় উঠবে অবনি হুড়মুড়িয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি এসে থামলো। অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ধুলোবালিতে জমে আছে রাস্তাঘাট। গাড়ির গতির কারণে বাতাসে ধুলোবালি উড়ে অন্ধকার হয়ে এলো চারিপাশ। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে কেশে উঠল প্রিয়।
গাড়ি থেকে শতাব্দ নেমে প্রিয়’র বাহু চেপে ধরল। চোখেমুখে আ*তঙ্ক ,ভয়।
হতভম্ব, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়। শতাব্দের এখানে আসা অপ্রত্যাশিত ছিল। রাগী গর্জন করে বলল শতাব্দ,
‘ তুমি ঠিক আছো! কেউ দেখেনিতো। নিষেধ করেছিলাম। কাউকে কিছু না জানিয়ে একাএকা এখানে এসেছ কেন?’
‘ ওহ! বলে আসার উচিত ছিল।’
প্রিয়’র ভাবলেশহীন উত্তরে হতাশ শ্বাস ফেলল। বলল,
‘আমার কথার কোন দাম নেই? এখানে আসতে কড়াকড়ি নিষেধ করেছিলাম।’
‘ আমিও আসবো বলেছিলাম।’
‘ তুমি এতো জেদি কেন?’
‘ এখানে আমার কাজ ছিল।’
‘ আচ্ছা! কি কাজ? তোমার তো ফটোশুট ছিল। তাই না? টিমমেডরা কোথায়?’
শতাব্দের ক্রোধান্বিত আওয়াজে থতমত খেলো প্রিয়। উত্তরের আশায় চেয়ে আছে শতাব্দ। প্রিয় কি বলবে উত্তর পাচ্ছেনা কোন। শতাব্দের গম্ভীর, ঠান্ডা আওয়াজ,
‘ মাথায় কি চলছে তোমার! কোন ঝামেলায় জড়িও না প্লিজ!আমি স্ট্রং ফিল করতে পারছি সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে ।’
শতাব্দের মুখপানে চেয়ে রইল প্রিয়। অমনি অটো ড্রাইভার তাড়া দিলো। প্রিয় অটোরিকশায় উঠতে নিলে হাত আটকাল শতাব্দ। রাশভারি আওয়াজে বলল,
‘ গাড়িতে উঠো।’
শুনল না প্রিয়। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে শতাব্দ আরো চেপে ধরল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে রাগাতে ভালো লাগে তোমার?’
‘ উহু, পৈ*শাচিক আনন্দ পাই।’
হাত ছাড়িয়ে, অটোরিকশায় উঠতে গেলে শতাব্দ ক্ষুব্ধ কন্ঠে আওড়াল,
‘ রাস্তায় সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য করোনা!’
শতাব্দের রাগী চোখের চাহনিতে থেমে গেল প্রিয়। অটোরিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। অটো ড্রাইভার ঘ্যানঘ্যান করায় কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলো শতাব্দ।
প্রিয় চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ি স্টার্ড দিতেই মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে ছবি বেগমের আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ বাজান তুমি নাকি গ্রামে আসছ। কোন কারণ ছিল? ‘
শতাব্দের অকপটে ক্ষুব্ধ আওয়াজ,
‘ প্রিয়কে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছি।’
‘ বাড়িতে আসো। দুপুরের খানা খাইয়া যাও।’
ছবি বেগমের ভালোমানুষি আচরণের কারণ বেশ ভালো করে জানে শতাব্দ। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,
‘ আপনার মেয়ে গতকাল বাড়িতে যেই কান্ড করে এসেছে তারপর আরো? অসম্ভব! আপনাদের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।’
ছবি বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। কথার ধাঁচ দেখে প্রিয় বুঝল ছবি বেগম ফোন করেছিল। শতাব্দ ফোন রাখতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি এখানে এসেছেন উনি কি করে জানলো?’
‘ এটা ওদের গ্রাম। চারিপাশে সব ওদের লোক। খবর ছড়াতে সময় লাগে না।’
শতাব্দের চোখেমুখে এখনো ক্রোধ ছড়িয়ে। যেই শতাব্দ রেগে কিছু বলতে যাবে, অমনি প্রিয় গাড়ির রেডিও ছেড়ে দিলো। ক্লান্ত মুখভঙ্গিতে সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে নিলো। হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শতাব্দ।
রেডিওতে গান বাজছে,

ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়

যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না (মানি না)
যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না

জানি না, কেন তা জানি না
জানি না, কেন তা জানি না…..

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।

টাইপোগ্রাফি : sadia siddiqa আপু🌺❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here