#বাগান_বিলাস
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃচার
লাশের খাটিয়া ধরে আছে শৌখিন। যে মানুষটাকে সে ভালোবাসত সে মানুষটা তার হলো না। কোন আফসোস হয়নি তার কিন্তু এই মানুষটা আবার এভাবে চলে যাবেন তা ভাবেনি সে। মানুষ মারাগেলে বাড়ীগুলো এমন ভয়ানক রুপ ধারণ করে যে তখন শরীর খুব হিম হয়ে যায়।
প্রতেকের দিকে একবার তাকিয়ে সে স্মৃতির ভাইয়ের দিকে তাকালো ছেলেটার বয়সই বা কত? এতটুকু ছেলেটা কিনা এখন আপন মানুষ হারানোর শোকে কাতরাচ্ছে।
শৌখিন স্মৃতির ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। ছেলেটার তো বাবা আর মা ছিল তার তো তাও নেই। শৌখিনের আজ খুব মনে পরছে ছোটবেলার কথা। মাত্র সাত বছর বয়সে একবার তার মায়ের সামনে তার চাচি বলেছিল
–” ভাবী, পরের ছেলেকে আর কত মানুষ করবে? নিজের বলতে ও তো কিজু আছে? একটা বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করো না ভাবী। এইসব ছেলেরা বড় হলে আর থাকে না চলে যায়।”
সেদিন ছোট্ট শৌখিন চাচির কথায় অবাক হয়ে চেয়ে থেকে ছিল। চাচির কথায় মা আচলেঁ মুখ গুজে কেদেঁ উঠলেন আর বারবার শৌখিনের সামনে এই কথা বলতে মানা করলেন। চাচি মায়ের অবাধ্য হয়েই বলে উঠলো –
–” এই কয়েকবছর লুকিয়ে রাখবেন একদিন না একদিন ঠিকই শুনবে। শুনছে যখন শুনুক, শোন তোর মা ছিল পাগলি! ভাবী আর নিজাম ভাই তোকে ঘরে নিয়ে আসে।
তুই ছিলি ময়লায় পরে থাকা একটা জঞ্জাল! ”
শৌখিনের ছোট্ট হৃদয়টা তখন কেপেঁ উঠল চাচির কথা শুনে কেদেঁ উঠলো মায়ের কাছে বারংবার প্রশ্ন করে ও উত্তর বের করতে পারল না। সেদিন সেই কথার যেরে আজ প্রায় তেইশ বছর ছোটচাচা বা চাচির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি মা বাবা কেউই। কিন্ত যে পাড়ায় একসাথে বেড়ে উঠা সেই পাড়ার মানুষগুলোর মুখ কিভাবে বন্ধ করবে সে? এই একটা অবিশাপের কারনে সে যে কত নির্ঘুম কাটিয়েছে তাতো কেউ জানেনা। স্মৃতির সাথে যখন সম্পর্ক চলছিল স্মৃতির বাবা তখন তাদের সম্পর্ক কোনভাবেই মেনে নিলেন না। আর যাইহোক এমন ছেলেকে তিনি মেয়ের হাতে তুলে দিবেন না। নাম নেই নেই বংশ পরিচয়। পাগলীর পেটে জন্ম নেওয়া সন্তান জারজ!
কার না কার ছিহ! ঘেন্নার ব্যাপার! হলো না শৌখিনের ছোট্ট সংসার গড়া হলো না প্রিয়তমাকে নিয়ে অলস বিকেলে বাগান বিলাস গাছের লাগোয়া বারান্দায় দাড়িয়ে দুটো মধুময় কথা বলা।
শৌখিন আশপাশটা ভালো করে দেখেনিল বাড়িটা আজ কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েগেছে। একদিন এই বাড়ির সামনে দিয়ে কোন ছেলে গেলে সাদিক সাহেবের গলা পেলে কেউ আওয়াজ করার সাহস পেত না। আর আজ সেই সাদিক সাহেব কিনা নিজেই চুপ হয়েগেলেন?
পাশেই স্মৃতি এলোমেলো চুলে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে এমন একটা দিন আসে মানুষের জীবনে যা ঝড় বয়ইয়ে দিয়ে যায়। স্মৃতির জীবনটাও ঠিক তেমনই হয়েগেল।
কোথায় গেলো স্বামী? কোথায় গেলো বাবা? এদের দুজনই স্মৃতিকে খুব ভালোবাসত। এরা দুজনই তাকে ছেড়ে চলেগেল। স্মৃতিই যখন চোখ মেলল তখন শুনতে পেলো বাবা হাসপাতালে ভর্তি বাবাকে আইসিউতে ভর্তি করানো হয়েছে। হয়তো হার্টের ব্লকটা অপারেশন ও করানো হতো কিন্তু তার আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন।
বশির সাহেব স্ত্রীর অবাধ্য হয়ে বর্ষাকে নিয়ে এলেন স্মৃতির কাছে। তার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে স্মৃতি এমন কাজ করতে পারেনা। কেন যেন বিহানকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই তো এত ঘটনার পর ও তিনি তার পুত্রবধুর কাছে তার নাতনিকে নিয়ে আসলেন।
কেটেগেল ছয়মাস, স্মৃতি এখন তার বাবার বাড়িতে মেয়ে বর্ষাকে নিয়ে থাকে। এখান থেকেই নিয়ম করে অফিস করে। ছোটভাই, মা আর বর্ষাকে নিয়েই তার জীবন।
এর মধ্যে বশির সাহেব কয়েকবার এসেছিলেন তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে যায়নি। বর্ষণ মারা যাওয়ার পর তার ঐ বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়েগেছে। ঐ বাড়ির কলংকিত সেই রাতের জন্যই তো তার বাবা তাকে ছেড়ে চলেগেল চিরজীবনের মত। স্মৃতির কথায় বশির সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। তিনি ও বুঝতে পারলেন স্মৃতি আর ফিরবে না। তিন ও জোর করলেন না আজ তার পরিবারের জন্যই নিয়াজ সাহেব এই পরিবারে নেই। কোথাও না কোথাও তিনি ও দায়ী তার মৃত্যতে।
_______________________________
মায়ের কোলে মাথা দিয়ে আছে শৌখিন, মানুষ যতই বলুক তার আর মায়ের মাঝে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই।
কিন্তু শৌখিনের কাছে সব মিথ্যে মনে হয়।
এই যে দিন শেষে সুরাইয়া বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকার পর সুরাইয়া বেগমের হাতের স্পর্শে তার অন্তরে যে একটা গভীর শান্তি পাওয়া যায় তা কি রক্ত দিয়ে বিচার করা যায়? রক্তের সম্পর্ক কতটুকু একটা মানুষকে টানে? আত্মার সম্পর্কই তো মানুষকে টানে।
সুরাইয়া বেগম শৌখিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
–” শৌখিন,”
–” হুম,”
–” একটা কথা বলবো বাবা?”
–” বলো,”
–” তুই কবে বিয়ে করবি বাবা?”
–” মা কেন বারবার বিয়ের কথা বলো?”
–” আমার যে ভালো লাগে না বাবা, আমার ছেলে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াবে এটা যে আমার সহ্য হয়না রে!”
–” বিয়ে করে কি হবে বলো তো? শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে!”
–” কেন নষ্ট হবে? নষ্ট হতে কেন দিবি তুই? তোর ও জীবন আছে, আর পাচঁটা মানুষের মত সব ভুলে বিয়ে করে নে।
আমি আমার ছেলেটাকে এভাবে দেখতে পারব না। আমার ঘরে ও ছেলের বউ আসবে, নাতি-নাতনিতে ভরপুর হয়ে যাবে। চাস না তুই? অন্তত আমার মারা যাওয়ার আগে এই শখটা পূরণ করবি না?”
–” মা তুমি কি বলছো তুমি জানো?”
–” ভুল কিছু বলছি না,”
–” মা আমার পক্ষে আর সম্ভব না!”
–” একজনের জন্য কত কাদবি তুই? ”
–” যত জীবন পাড় হয়েযাক,মনে রেখো ঐ একজনই তোমার ছেলেকে সামলাতে পারবে আর কেউ পারবে না।
আর সে হলো স্মৃতি!”
–” এতই যদি চাও তাহলে একটা কাজ করবে?”
–” কি?”
–” স্মৃতিকে বউ করে নিয়ে আসো!”
–” কি বলছিস তুই?”
–” মা কোথায় লেখা আছে বিধবা মেয়েদের বিয়ে করা যায় না?”
–” শৌখিন আমি তা বলছি না, আমি বলছি স্মৃতির বাবা যেখানে তোকে তারিয়ে দিয়েছে সেই স্মৃতিকে তুই বিয়ে করবি?”
–” মা, স্মৃতির বাবা কি করেছে আমি জানতে চাইনা। আমি স্মৃতিকে চাই! দেবে কিনা বলো?”
–” আমি কিভাবে দেবো তোকে?”
–” তুমি না পারলে আমি যাবো!”
–” আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোর বাবাকে জানিয়ে আসি।”
চিঠি লিখতে ব্যস্ত সুপ্তি, আজকাল মনের যত কথা সে ডাইরির পাতায় পাতায় লিখে রাখে। জমা করে রাখে অশ্রু! পাতাগুলোতে থাকে সুপ্তির বিন্দু অশ্রু কখনো রাত কখনো দিন। কবি হয়েগেল নাকি সে? আজকাল নিয়ম করে কবিতা ও লিখছে সে! এতটুকু বয়সে কবিতা ও লেখে সে। নিজেই অবাক হয়ে যায়। শৌখিনকে সে দেখাবে! ডাইরিটা শৌখিনের হাতে দিয়ে বলবে –
–” শৌখিন ভাই, দেখুন এই ডাইরির প্রতি পাতায় শুধু আপনি! আপনার বিরহে আজ আমার রাত্রিগুলো বিষাদময় কেটেছে!”
লিখে নিজের মনেমনে হাসলো সুপ্তি। শৌখিনকে সে শুনাবে তার কথা!”
সুপ্তির বাবা সুপ্তির মায়ের কাছে সব শুনেছেন। শুনে তিনি সিধান্ত নিলেন মেয়েকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলবেন। তিনি ভালো করেই জানেন সুপ্তি কখনোই শৌখিনের হবে না। যেখানে শৌখিন নিজেই স্মৃতির জায়গা কাউকে দিতে চাইছে না। সুপ্তি হয়তো আবেগের বশে শৌখিনের প্রেমে অন্ধ হয়েগেছে। কিন্তু তিনি তো জানেন শৌখিন কখনো তাকে সেই নজরে দেখেনি। তিনি তাই সুপ্তির কিনাডায় যাওয়ার ব্যাবস্থা করলেন। ভিসা তৈরীর কাজ করছেন তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুপ্তিকে তিনি বাহিরে পাঠিয়ে দিবেন রাখবেন না এই দেশে।
স্মৃতি অফিস থেকে এসেছে মাত্র। ঘরে ঢুকেই দেখল শৌখিন আর তার মা, বাবা বসে আছে শৌখিনের কোলে বর্ষা বসে আছে। মেয়েটা শৌখিনের কোলে শৌখিনের হাত ধরে খেলা করছে। খিলখিল করে হাসছে, হাসির শব্দ স্মৃতি বাহির থেকেই পেয়েছে। ঘরে এসে হঠাৎ শৌখিন আর তার পরিবারকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। যতটা জানে শৌখিনকে বাবা তাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে আন্টি বা আঙ্কেল কেউই এই বাড়িতে আসতো না। স্মৃতির বাবা মারা যাওয়ার সময় সেদিন তারা সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন আর আসেননি, আজ কেন এলেন তারা?”
স্মৃতি খানিকটা অবাক হলো। বর্ষা স্মৃতিকে দেখে দৌড়ে চলে এলো তার কাছে। কথায় ব্যস্ত থাকা স্মৃতির মা আর শৌখিনদের নজর পরল সাদায় মিশ্রিত কালো রঙ্গের একটা শাড়ি পরা স্মৃতির উপর। চোখগুলো যেন গর্তে ঢুকে আছে, মলিন চেহারাটায় এখনো আগের মতই মায়া কাজ করে। প্রাণভরে প্রিয়তমার মুখের দিকে চেয়ে আছে শৌখিন। কত যুগের তৃষ্ণা! হৃদয় যেন এখনো তার ভরছে দেখে। শৌখিনের মা স্মৃতিকে কাছে ডাকলেন।
স্মৃতি ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন সোফায় বসতে।
স্মৃতি এখনো চেয়ে আছে, তাদের দিকে কি হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছেন না। শৌখিনের মা তাকে বসিয়ে বললেন-
–” আজ আমার স্বপ্ন পূরণের দিন, আমার ছেলেটার স্বপ্ন পূরণের দিন। খুব শখ ছিল তোকে আমার ঘরের পূত্রবধূ করবো।”
স্মৃতি চমকে তাকালো, কি বলছে এইসব?
–” ভাবী আমি ওকে নিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলি?”
–” জ্বী অবশ্যই বলুন,”
বসার ঘর থেকে উঠে এসে স্মৃতির রুমে দাড়ালেন শৌখিনের মা সুরাইয়া বেগম। স্মৃতি তার পাশেই দাড়িয়ে আছে।
–” আমার ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে স্মৃতি, এতটা কাল ও তোকেই চেয়ে ছিল। ছেলেটা তোর যখন বিয়ে হয়েছিল না সারারাত শুধু কাদঁতো। আমার হাসিখুশি ছেলেটা কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তুই জানিস? ও কি বলেছিল? ”
চলবে।