বিবি পর্ব -০১+২

#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
#সূচনা_পর্ব

শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর স্বামীর মুখদর্শন পায়নি অনড়া। সুগন্ধি ফুলে সাজানো খাটটি শূন্য থেকে যায় সারারাত। বাসি ফুলের দিকে একভাবে চেয়ে থাকায় অনড়ার চোখ টলমল হয়। বুকের ভেতর ক্ষীণ ব্যথাটা প্রকট হতেই একটি কাগজ আর কলম তুলে নেয়। কাঁপা হাতে দুই-তিন লাইন লিখে ক্ষান্ত হয়। কলম পাশে ফেলে কাগজটি ভাঁজ করে উদাসভঙ্গিতে। সেসময় দরজায় কড়া পড়ার মৃদু শব্দ হয়। অনড়া উঠে দাঁড়ায়। পুরো দরজা না মেলে একটু ফাঁক করে। সেই ফাঁকে হাত গলিয়ে দিয়ে বলল,
” বুবু, এই কাগজটা তাকে দিও। ”

কোমল কাগজটা নিয়ে কিছু সুধানোর সুযোগ পেল না। অনড়া ভেতর থেকে দরজা আটকে দিল সশব্দে। আরও দুইরাত একা এক রুমে কাটানোর পর স্বামীর পদধ্বনি পেল অনড়া। ব্যাকুলচিত্তে দরজা মেলে সমুখে তাকাল। স্বামীর মুখদর্শনের সৌভাগ্য হলেও সুনজর পেল না। নিবিড়ের চোখ-মুখে রাজ্যের বিরক্ত, অনিচ্ছা, বিরাগ। এই অনাগ্রহ মুখটাতেও ভীষণ মায়া অনুভব করল অনড়া। নরমসুরে বলল,
” অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার সুতো কাটল! ”

অনড়ার আহ্লাদ ভাঙা কথা কর্ণপাত করল না নিবিড়। খনখনে গলায় বলল,
” কোমল জানাল, তুমি নাকি কারও সাথে দেখা করছ না, কথা বলছ না, সারাক্ষণ দরজা আটকে রাখছ? ”

অনড়া মান স্বরে যোগ করে দিল,
” খাচ্ছি না, গোসল করছি না, কাপড়ও বদলাচ্ছি না। ”

নিবিড় এক পলক চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মেয়েটা এখনও বধূসাজে আছে!

” কেন করছ এসব? ”
” কাগজে লিখে দিয়েছি। ”

নিবিড় একটু চুপ থেকে বলল,
” বাচ্চাদের মতো জেদ করো না। তুমি অবুঝ নও। বুঝার চেষ্টা করো। অন্য সবার মতো আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক না। এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে আমাকে যন্ত্রণা দিও না! ”

নিবিড়ের কণ্ঠে মিনতি। চোখের চাহনিতে অসহায়ত্ব। অনড়া বলল,
” তুমি স্বাভাবিক আচরণ করো। তাহলে আমিও করব। ”

অনড়ার ‘ তুমি ‘ সম্বোধনে নিবিড়ের চোখে রাগ তেজে উঠে নিভে গেল। দরজা থেকে ফিরে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” আপাতত সম্ভব না। ”

এক কদম এগিয়ে গেলে অনড়া উঁচু স্বরে বলল,
” আমি জানি, বুবু কখনও গোপনতা ভাঙে না। কাগজের লেখা বুবু পড়েনি। তুমি পড়েছ। বুবুকে শুনিয়েছ। হয়তো তার জোরাজুরিতে আমার মুখোমুখি হয়েছ। ”

নিবিড় থামল। পেছন না ঘুরেই মুক্তস্বরে বলল,
” তোমার বুবু আমার স্ত্রী। প্রাণপ্রিয় বিবি। তার সামনে আমার কোনো গোপনীয়তা নেই। আকাশের মতো স্বচ্ছ, নির্মল। ”

অনড়া চুপ হয়ে গেল। পরমুহূর্তে বলল,
” শুধু কাগজে না মুখেও বলছি, যতদিন না তুমি আমায় স্পর্শ করবে ততদিন আমি এভাবেই থাকব। অনাহারে, অযত্নে মৃত্যু গ্রহণ করব। ”

নিবিড়ের পায়ের গতি বেড়ে গেল। মূল দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মায়ের ডাক পেল। থামল নিবিড়। কুলসুম নাহার ছুটে এসে বললেন,
” না খাইয়া কই যাস? ”

নিবিড় জবাব দেয় না। কুলসুম নাহার শঙ্কিত গলায় আবার বললেন,
” খাউন-দাউন একবারেই ছাইড়া দিছস দেহি! রোগ বাঁধাইবি নাকি? ”
” রোগ বাঁধলেই কী, মা। আমার জন্য কারও চিন্তা হয়? হয় না। ”
” খামখেয়ালি কথাবার্তা! ”
” খামখেয়ালি না, মা। সত্যি কথা। ”
” বউ খাবার বাড়ছে, খাইয়া যা। ”

নিবিড় দূর থেকে কোমলকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার দিকে চেয়ে গাঢ়স্বরে বলল,
” খাবার শরীর সুস্থ রাখতে পারে, মন না। ”

নিবিড় আবারও সদর দরজার দিকে এগুলে কোমল দূর থেকে বলল,
” ঘরে দুজন থাকতে একজন সকল দায়িত্ব পালন করবে কেন? দায়িত্ব ভাগ করা হোক। আমি শরীরের দায়িত্ব নিচ্ছি, অনুকে মনের দায়িত্ব দেওয়া হোক। ”

কোমলের এমন কথায় বিস্ময়াপন্ন হলেন কুলসুম নাহার। স্তব্ধ থাকলেন এক মুহূর্ত। স্তব্ধ দৃষ্টি ছেলের দিকে ফেলেই ঘাবড়ে গেলেন। ছেলেকে শান্ত রাখতে কোমলকে ধমক দিতে চাইলেন। সুযোগ পেলেন না। নিবিড় ঝড়েরগতিতে কোমলকে নিয়ে ডানদিকের রুমটায় ঢুকে পড়ে। তীব্র শব্দে দরজা আটকালে কুলসুম নাহার ভয়ে শিউরে ওঠেন। ছুটে যান বন্ধ দরজার দিকে। ঘনঘন আঘাত করে বলেন,
” নিবিড়, শান্ত হ। বউ ভুল কইরা কইছে। ”

নিবিড় কোনোরূপ উত্তর করল না। দরজার দিক থেকে মন সরিয়ে কোমলের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ। মাথা নিচু করে আছে। হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। নিবিড় মৃদু হাসল। সহাস্যে জড়িয়ে নিল স্ত্রীর নরম শরীরখানা। ফিসফিসে বলল,
” শুভ বিবাহ বার্ষিকী। ”

বিস্ময়ে কোমলের বন্ধ চোখের পাতা আলগা হয়ে গেল। নিবিড় স্ত্রীকে বাঁধনে রেখেই বলল,
” আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের সাত বছর পূর্ণ হলো আজ। প্রতিবছর এই দিনটিতে আমরা ভালোবাসা বিনিময়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু এবার? ভালোবাসা তো দূর, তুমি দিনটিকেই ভুলে গেছ। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”

স্বামীর দুঃখ প্রকাশে কোমলের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

” অনড়া নামক এই ঝড়টা কেন টেনে আনলেন, কোমলমতি? কিভাবে সামলাব আমি? নিজেকে দিশাহারা মনে হচ্ছে, দিগভ্রান্ত! ”

কোমল জানে নিবিড় মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হলে তাকে আপনি সম্বোধন করে। মুহূর্তেই স্বামীর মনের অবস্থা বুঝে গেল। তাকে সাহস দিতে বলল,
” আপনি সামলাতে পারবেন। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি আছি তো আপনার পাশে। ”

নিবিড় একটু দূরে গিয়ে বলল,
” কোনো প্রয়োজন নেই সামলানোর। আমি শুধু আপনার থাকতে চাই। শরীর, মন সবকিছুর দায়িত্ব একমাত্র আপনার। কোনো ভাগ হবে না। ”

_________________

সাত বছর আগে,

থুতনি চেপে মুখ উঁচু করে বৃদ্ধ মহিলা কপাল কুঁচকে বললেন,
” রঙ তো কালা। বয়সও বেশি লাগতাছে। এ মাইয়া তোর বয়স কত? ”

কোমল ভয়ে ভয়ে বলল,
” চব্বিশ। ”

বৃদ্ধা আঁতকে উঠলেন। কোমলের থুতনি ছেড়ে চেঁচামেচি শুরু করেন। ভেতরের রুমে কোমলের সাথে তার মা রাবেয়া খাতুনও ছিলেন। তিনি বৃদ্ধাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। বসার রুমে সকলে ছুটে আসলে বৃদ্ধা চিৎকার করে বললেন,
” কিসের পর্দা? সব নাটক। ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমারে ভেতরে ডাইকা আনছে। ভাবছে, বয়স হয়ছে। দেখতে পারে না। কালা মাইয়ারে ফর্সা বানাইয়া দিলেও বুঝতে পারব না। ”

সকলের উদ্দেশ্যে এটুকু বলেই ঘটককে চেপে ধরলেন। তারমতে, মেয়ে সুন্দরী। সাদা চামড়া। রোদে গেলে রক্ত দেখা যায়। বয়সও কম। এসব শুনেই তো পাত্রী দেখতে এসেছিল। দেখতে এসে পেল উল্টো! পাত্রপক্ষের সকলেই খুব ক্ষ্যাপে গেছে। পারলে ঘটকের গর্দান নিয়ে নেয়। এসব দেখে কোমল চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। বিছানা থেকে উঠে মায়ের দিকে হেঁটে আসলে বৃদ্ধা রুম কাঁপিয়ে বললেন,
” এ মাইয়া তো খোঁড়া! ”

রুমের জিনিসপত্র উল্টে -পাল্টে ছেলেপক্ষ বিদায় হলো। রাবেয়া খাতুন চোখের পানি ফেলে বিলাপ করছেন। কোমলের বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। প্রতিবারের মতো এবারও পুরো ঘটনার সাক্ষী হলো অনড়া। অংকে কাঁচা মেয়েটি আঙুলের কড়া গুণে বিড়বিড় করল, ‘ এগারো। ‘

_________
এগারো নাম্বার ছেলেটির কাছেও অযোগ্য হওয়া কোমলের মনে কোনো দুঃখ নেই। উদ্বেগহীন, শান্ত। স্বাভাবিকভঙ্গিতে অংক করাচ্ছে অনড়াকে। স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির অংকে মন নেই। একটু পর পর কোমলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হয়ে বলল,
” তোমার কষ্ট লাগছে না, বুবু? ”
” কষ্ট হবে কেন? ”
” বিয়ে হচ্ছে না বলে। ”

কোমল একটু চুপ থেকে হালকা হাসল। মাথা নেড়ে বলল,
” না। ”
” কেন? ওরা তোমাকে কালো বললে খারাপ লাগে না? ”
” খারাপ লাগবে কেন? আমি তো কালোই। ”
” খোঁড়া বলে যে। ”
” খোঁড়াও তো। ”

অনড়া বসা অবস্থায় কোমলের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” না, তুমি খোঁড়া না। একটু বেঁকে চললেই খোঁড়া হয় নাকি? ওদের চোখ খারাপ। তাই দেখতে পায় না, তুমি কত সুন্দর। তোমার মতো হরিণচক্ষু এই গ্রামে কয়জনের আছে? ”

কোমল উত্তর দেয় না। মিটিমিটি হাসে। অনড়া আহ্লাদী হয়ে আবার বলল,
” আমার যদি একটা ভাই থাকতো, তোমাকে ভাবি বানাতাম। ”
” তাই? ”
” হ্যাঁ, একটুও মিথ্যা বলছি না। এই বই ছুঁয়ে বলছি। ”

অনড়া সত্যি সত্যি বই ছুঁলে হাতের মধ্যে হালকা থাপ্পড় দিল কোমল। রাগ হয়ে বলল,
” তোকে না কসম কাটতে নিষেধ করেছি? ”

অনড়া দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। কানে ধরে অপরাধি সুরে বলল,
” ভুলে গেছি। আর কাটব না, বুবু। ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২)

অনড়ার বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন ভালো ছিল না। একটুতেই তর্কে জড়িয়ে পড়ত দুজন৷ কথা কাটাকাটি থেকে মারামারি! রান্না বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, কথা বন্ধ থাকত প্রায়শই। এমন অবস্থায় জন্ম হয় অনড়ার। তার জন্মের পর এই ঝগড়াঝাঁটি বেড়ে হয় দ্বিগুণ। অনড়ার বয়স যখন দুই বছর তখন তার মা রাগ করে বাপেরবাড়ি চলে আসে। অনড়ার বাবা সেই রাগ না ভাঙিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এ খবর শোনার পর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি অনড়ার মা। কয়েকদিন চুপচাপ থেকে নদীর জলে নিজেকে বিসর্জন দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও অনড়ার বাবা দেখতে আসেনি। মেয়ের খোঁজ-খবর নেয়নি। তারপর থেকে নানি জমিলা বেগমের কাছে বড় হচ্ছে অনড়া।

জমিলা বেগম দরিদ্র মানুষ। হা-ভাতের সংসার। ধাইয়ের কাজ করে যা পান তাই দিয়ে নিজের পেট চালাতেন। তন্মধ্যে নাতির দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ায় বৃদ্ধ বয়সে কাজ নেন মোল্লাবাড়িতে। ছোট্ট অনড়াকে সঙ্গে নিয়েই সে বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে নানান কাজে সাহায্য করতেন। মোল্লাবাড়ির একমাত্র মেয়ে কোমল। সকলের আদুরের এই মেয়েটির আদর গিয়ে পড়ল অনড়ার উপর। কোমলের কোনো ভাই-বোন না থাকায় এই বাচ্চা মেয়েটি হলো তার খেলার সঙ্গী, ছোটবোন। ভাব একটু গভীর হতে বুবু ডাকা শেখাল। বইপত্র কিনে দিয়ে পড়ানো শুরু করল। জমিলা বেগমের দায়িত্বের বোঝাও যেন একটু কমল। প্রসূতিসদনে ডাক পড়লে কোমলের কাছে রেখে যেতেন নিশ্চিন্তে। কোমলও সুযোগে বড়বোনের মতো খায়িয়ে-দায়িয়ে নিজের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিত। আজও তাই ঘটেছিল। দূরপাড়া থেকে জমিলার ডাক পড়লে অনড়াকে কোমলের কাছে রেখে যান। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলেও তার ফেরার নাম নেই। পড়া শেষ করে খেয়ে নিয়েছে অনড়া। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ বলল,
” তুমি ছেলেকে দেখেছিলে? ”

কোমল দরজায় সিটকানি টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল,
” কোন ছেলে? ”
” তোমাকে দেখতে এসেছিল যে। ”
” না। ”
” আমি দেখেছি। মাথায় চুল নেই অথচ ঠোঁটের উপর ইয়া মোটা গোঁফ। ভালো হয়েছে বিয়ে ভেঙে গেছে। তোমার সাথে একটুও মানাত না। ”

কোমল বিছানায় উঠল। অনড়ার পাশে শুয়ে কাত হলো। কৌতূহলীভঙ্গিতে বলল,
” একটুও মানাত না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” দেখতে ভালো না তাই। ”
” দেখতে ভালো না হলে মানায় না? ”
” সবাই তো তাই বলে। ”
” ভুল বলে। ”

মাত্র কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি কোমলের কথার ভাবার্থ ধরতে পারল না। বলল,
” তোমার কম চুল, মোটা গোঁফ পছন্দ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” তোমার কেমন ছেলে পছন্দ? ”
” আমার পছন্দ শুনে কী করবি? ”
” ছেলে খুঁজে আনব। ”
” তাই? ”

অনড়া মাথা নাড়ে। কোমল একটু ভাবার ভঙ্গি করে বলল,
” যে ছেলের মন সুন্দর আমার তাকে পছন্দ। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” যে ছেলের ব্যবহার সুন্দর আমার তাকে পছন্দ।

আরেকটু থেমে বলল,
” যে ছেলের চরিত্র সুন্দর আমার তাকেও পছন্দ। ”

অনড়া চোখ বড় বড় করে বলল,
” তুমি তিনটা ছেলেকে বিয়ে করবে? আমি তিনজনকে দুলাভাই ডাকব? ”

কোমল শব্দ করে হেসে ফেলল। তার এই হাসির কারণ ধরতে পারল না অনড়া। জিজ্ঞেস করল,
” হাসছ কেন? ”

কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে হাসতেই থাকল। অনড়া মুখ কালো করে ফেললে সে বলল,
” এই তিনটি গুণ তিনজন আলাদা ব্যক্তি কেন? একজনের মধ্যে থাকতে পারে না? ”

অনড়া একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল,
” পারে তো। ”
” তাহলে সে ছেলে ধরে নিয়ে আয়। বিয়ে করে ফেলি। ”

অনড়া ভীষণ খুশি হলো। উৎসাহি কণ্ঠে বলল,
” সুন্দর মন, সুন্দর ব্যবহার, সুন্দর চরিত্রের ছেলেটিই হবে আমার বুবুর সুন্দর বর। ”

অনড়ার গাল টেনে ধরে কোমল বলল,
” উহু, উত্তম ব্যবহার, উত্তম মন ও উত্তম চরিত্রের ছেলেটিই হবে তোর বুবুর উত্তম বর। ”

_______________
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে নিবিড়। দু’মাস হতে চলল পরিবার থেকে দূরে। প্রিয়জনদের মুখ দেখছে না। যোগাযোগ রাখছে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে। রাত-দিন এক করে টানা পড়ার গতি আরও বেড়েছে আজ। কাল তার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম ত্যাগ করে একনাগাড়ে পড়ছে। ঠোঁটের সাথে হাতও চলছে তাল মিলিয়ে। লিখতে লিখতে হঠাৎ কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় কলম খুঁজছিল। তখনই একটি সোনার কানের দুলে চোখ পড়ে। মুহূর্তেই চঞ্চল দৃষ্টি আচঞ্চল হয়। অস্থির ঠোঁট জোড়া স্থির হয়। নিবিড় পড়া ভুলে, ধ্যান হারায়। অচেতনতায় দুলটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গভীর মোহ, মুগ্ধতা। শুষ্ক ঠোঁটদুটিতে লাজুক হাসি। সন্ধ্যার মায়া ঠেলে আবির্ভুত হয় দুটি চোখ। কী মায়া সে চোখে! কী নেশা তার পলকে! নিবিড়ের হৃদয় পুলকিত হয়। উন্মত্ত হয় চাওয়া-পাওয়া। সেসময় কেউ একজন ছোঁ মেরে দুলটি নিয়ে গেল। নিবিড় পাগলপ্রায় অবস্থায় পেছন ঘুরে। ব্যাকুল হয়ে বলল,
” দুলাল ভাই, দুলটা দেন। ”

দুলাল হলো নিবিড়ের রুমমেট। বয়সে বড় হওয়াই ভাই সম্বোধন করে নিবিড়। শ্রদ্ধাও করে। তার ছোট-খাটো প্রয়োজন দুলালভাই মিটিয়ে দেয়।

দুলাল ভাই দুলসহ ডানহাতটা পেছনে মুড়ে নিয়ে বললেন,
” আগে বল এর রহস্য কী? ”
” কোনো রহস্য নেই। ”
” আছে। অবশ্যই আছে। কেউ মারা গেলেও তোকে পড়ার টেবিল থেকে উঠানো যায় না। অথচ এই সামান্য দুলটা শুধু পড়া না, দুনিয়াটাই ভুলিয়ে দেয়। এর কারণ কী? কী আছে এতে? ”

নিবিড় উত্তর দিতে পারে না। চুপও থাকতে পারে না। অস্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলাল গভীরভাবে জরিপ করেন নিবিড়কে। সন্দিহানে বললেন,
” প্রেম করছিস? ”

নিবিড় লজ্জা পেল। দৃষ্টি নত করল। অস্থিরভাব দমিয়ে রাখার পুরো চেষ্টা চালালেও সফল হলো না। দুলাল ভাই ধরে ফেললেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
” নাম কী? ”
” জি? ”
” দুলকন্যার নাম কী? ”

নিবিড় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। খানিক্ষন ইতস্ততায় ভুগে ধীরে বলল,
” কোমল। ”

দুলাল বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
” তুই সত্যি প্রেম করছিস? ”

নিবিড় তড়িঘড়িতে বলল,
” একদম না। ”
” তাহলে? ”
” পছন্দ করি। ”

দুলাল জিজ্ঞাসা পর্ব শেষ করতে পারল না। মধ্যপথে একটি চিঠি এসে পৌঁছাল নিবিড়ের হাতে। ঠিকানা দেখে জানাল,
” বাড়ি থেকে এসেছে। ”
” চিঠি পড়ে শেষ কর। খেতে যাব। ”

নিবিড় অনুমতি পেয়ে চিঠির খাম খুলল। এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে আমচকা বলল,
” তোমার কাছে একশ টাকা হবে, দুলাল ভাই? ”
” একশ টাকা? কেন? ”
” বাড়ি যাব। ”
” চাচা-চাচির কিছু হয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

নিবিড়ের উত্তর দেওয়ার সময় নেই যেন। চটপটে শার্ট গায়ে দিয়ে বলল,
” এখন বলার সময় নেই। এসে বলব। টাকা থাকলে দেও। ”

দুলাল টাকা বের করতে করতে বলল,
” এখনই যাবি? কাল না তোর পরীক্ষা? ”
” সে পরে দেখা যাবে। ”

দুলালের দিতে হলো না। নিবিড় নিজেই একশ টাকার নোটটি নিয়ে দরজার দিকে ছুটল। দুলাল পেছন থেকে বলল,
” পরীক্ষাটা না দিলে তোর স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ”

নিবিড় চোখের আড়াল হতে হতে বলল,
” এখন না গেলে আমার ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবে। ”

________________

নিবিড় বাড়িতে পৌঁছাল মাঝরাতে। কুলসুম নাহার শঙ্কিত গলায় বললেন,
” তুই? এতরাতে? ”

নিবিড় মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। মায়ের পেছনে দাঁড়ানো বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি কোমলকে বিয়ে করব, বাবা। আজ, এখনই। ”

মতিন মিয়ার চোখ জ্বলে উঠল। স্ত্রীর পেছন থেকে সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” গাঞ্জা খাইছস? ”
” না, বাবা। ”
” তাইলে মদ খাইছস। ”
” আমি কিছু খাইনি, বাবা। ”
” তাইলে তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। ”

নিবিড় শান্ত থাকতে পারল না। অধৈর্য্য হয়ে বলল,
” এসব কেন বলছ, বাবা? আমার মাথা ঠিক আছে। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। মাথা ঠিক থাকলে কি তোর থেকে ছয় বছরের বড় মাইয়ারে বিয়া করতে চাইতি? ”

মতিন মিয়া স্ত্রীর দিকে ঘুরে আবার বললেন,
” তোমার পোলার মাথা নষ্ট হইয়া গেছে। জলদি সামলাও। নাহলে আমাগো পেটে লাথি মারব। ”

চলবে
চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here