#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১১)
” বাবা কেমন আছে, কোমল? ”
কোমল মায়ের হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে কাঠ হয়ে থাকল। পেছন না ঘুরেও বুঝতে পারল এটা নিবিড়ের গলা। তার পেছনে নিবিড়ই দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরের অপেক্ষা করছে নির্দ্বিধায়। এমন দুঃসময়েও সেই রাতটির কথা মনে পড়ল কোমলের। একের পর এক গেঁথে দেওয়া শর্তগুলো ভ্রমরের মতো ভনভন করছে মস্তিষ্কের চারপাশে। সে শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সংযত করল। নরম মনটাকে শক্ত শিঁলে পিষে দিয়ে আরও কিছু সেকেন্ড চুপ থাকল। চোখের ইশারায় মাকে কিছু বুঝিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে চলল ধীর পায়ে। মেয়ে প্রস্থান হতেই রাবেয়া খাতুন মুখ খুললেন,
” ভালো আছে। ভেতরের রুমে শুয়ে আছে। যা, গিয়ে দেখা করে আয়। ”
নিবিড় মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। চৌকাঠে একপা ফেলে ফিরে তাকাল রান্নাঘরের দিকে। দরজা নেই বিধায়, দূর থেকেও কোমলের দেহাবরণ দেখা যাচ্ছে৷ সেখানে চেয়েই বিনয়ের সাথে সুধাল,
” আপনারা ভালো আছেন, কাকিমা? ”
রাবেয়া খাতুনও দূর থেকে মেয়েকেই দেখছিলেন। সহসা নিবিড়ের প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। সময় নিয়ে সংক্ষেপে বললেন,
” হ্যাঁ। ”
নিবিড় চাপা হেসে ভেতরে চলে গেল। রাবেয়া খাতুন ভ্রূ কুঁচকালেন। এইটুকু ছেলে তার মেয়েকে নাম ধরে ডাকছে! ভাবতেই একগাদা বিরক্ত ভর করল কপালে ভাঁজে, নাকের আগায়। একটু সময় নাক-মুখ কুঁচকে রেখে আপনমনে বললেন, ‘ তাও ভালো, আমাকে কাকিমা বলেছে। শাশুড়ি ভেবে মা ডাকতে শুরু করেনি। ‘ বিরক্তের মাঝেও পাখির মতো খানিকটা স্বস্থি উড়ে এলো তার মুখটায়।
মাটির চুলায় আগুন ধরিয়ে ভাতটা করে দিয়েই বাড়ি চলে এলো কোমল। বাকি ব্যবস্থা করতে মায়ের সাথে নিজেও বাড়ি চলে গেল। পাছে নিবিড়ের সাথে দেখা হয়ে যায় সেই সঙ্কায় কুলসুম নাহারের কাছ থেকে বিদায়টাও নিল না।
________________
জমিলা বেগমের মুখ-আলগা স্বভাব। পান থেকে চুন খসে পড়লেই গালাগাল শুরু করেন। অনড়াকে দেখলেই যেন এই স্বাভাবটা গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে। চলতে থাকে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো বাঁধাহীন, বিরামহীন। আজও তাই হলো। বিদ্যালয়ের বিশেষ পোশাকটির সাথে থাকা ওড়নাটি বুকে না দিয়ে মাথায় বেঁধে উঠানে পা রাখতেই তিনি তেড়েফুঁড়ে এলেন। সলার ঝাটা দিয়ে দু-একটা বাড়ি দিতেই অনড়া ছুটে পালাল ঘরের ভেতর। বন্ধ দরজায় কয়েকটা বাড়ি দিলেন জমিলা বেগম। বকাঝকা চলতে থাকল বৃষ্টির মতো। অনড়াও কম যায় না। সেও আনাড়ি শব্দ ব্যবহার করে উত্তর দিতে থাকল। একটা সময় পর হাঁপিয়ে গেলেন জমিলা বেগম। দোয়ারেই বসে পড়েন ক্লান্তভাবে। কপাল চাপড়াতে থাকেন অনড়ার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। মেয়েটা বড় হচ্ছে, শরীর বাড়ছে, যৌবন ফুটছে ফুলের মতো। কিন্তু ছেলেমানুষি পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। বুড়ো মানুষ সে। আর কত বুঝাবে? শাসন করবে? শরীরেরও তো কুলাতে হয়! তাও যদি মেয়েটা বুঝতো!
নানি চুপ হয়ে যেতেই নীঃশব্দে দরজা খুলল অনড়া। মাথা বের করে নানিকে খুঁজতে গিয়ে দেখে দোয়ারে বসে আছে পা ছড়িয়ে। সে সাবধানে বের হয়ে আসল। পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমি মেট্রিক পাশ করেছি, নানি। প্রথম বিভাগ পেয়েছি। পুরো স্কুলের মধ্যে মাত্র দুইজন প্রথম বিভাগ পেয়েছে, তার মধ্যে আমিও আছি। ”
পড়ালেখার ব্যাপারে জমিলা বেগম একেবারেই অজ্ঞ। অনড়ার কথার অর্থ-টর্থ বুঝল না কিছুই। তবুও রাগ পড়ে গেল। স্নেহ জমল ঠোঁটের কোণে, হাতের পরশে। নাতনির মাথা স্পর্শ করে বললেন,
” এই হাসিটা চিরঞ্জীবী হোক। আমি মইরা গেলেও যেন আল্লাহ তোরে এমনে হাসায়। ”
অনড়া মুখকালো করল। নানির গলা ছেড়ে বলল,
” মরার খুব শখ না? দাঁড়া, এখনই আযরাইলকে ডেকে আনছি। ”
কথাটা বলতে বলতে নানির গলা চেপে ধরল অনড়া। জমিলা বেগম নিশ্বাস আটকে গেল। চোখ বড় হলো, মুখ বর্ণ নীল হলো। সহ্য করতে না পেরে হাতের ঝাটা দিয়ে অনড়ার পিঠে বাড়ি মারলেন অবিরত। অনড়া আরও কিছু সেকেন্ড পর গলা ছেড়ে দিল। একটু দূরে সরে হাসতে হাসতে বলল,
” এখন মারিস কেন, বুড়ি? মরার শখ মিটে গেছে? আযরাইল পছন্দ হয়নি? ”
জমিলা বেগম হাঁ করে নিশ্বাস গিলছেন। সে অবস্থায় গরম চোখে তাকালেন। ঝাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেই অনড়া দৌড় দিল। নানি পেছন থেকে হাঁক ছাড়লেন,
” আবার কই যাস, ছেড়ি? ”
” বুবুর কাছে। ”
” ভাত খাইয়া যা। ”
অনড়া আর উত্তর দিল না। এক ছুটে মোল্লাবাড়ি পৌঁছাল। কোমলকে খুঁজে পেল রান্নাঘরে। মাচা থেকে কিছু নামানোর চেষ্টা করছে। উচ্চতায় মিলছে না বলে পারছে না। সে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে বলল,
” কোন বয়ামটা লাগবে, বুবু? ”
কোমল হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলে, সে নামিয়ে দিল। কোমল মৃদু হেসে বোয়ামের মুখ খুলে বলল,
” বেশ লম্বা হয়েছিস তো! ”
অনড়া লাজুক হেসে বলল,
” বড় হচ্ছি তো তাই। ”
কোমল তরকারি নাড়া বন্ধ করে অনড়ার দিকে তাকাল নিরীক্ষকের ভঙ্গিতে। বিভ্রম দৃষ্টিতে স্বীকার করল অনড়া বড় হচ্ছে। শিশুত্বের খোলস খুলে কিশোরী অবয়ব উঁকি দিচ্ছে সসজ্জায়। কোমল দৃষ্টি সরিয়ে ঠাট্টা সুরে বলল,
” চালচলন-বেশভুষা তো বলছে, এখনও খুকি আছিস। ”
অনড়া হাসল। সেই হাসিতে দুঃখ নেই, আনন্দও নেই। তরকারিতে নুন ছিটিয়ে কোমল পুনরায় বলল,
” দরকারে এলি, নাকি এমনি? ”
অনড়া হাসি থামাল। রেজাল্ট কার্ড মেলে ধরে বলল,
” এটা দেখাতে এসেছি। ”
পরীক্ষার ফলাফল দেখে খুব খুশি হলো কোমল। পড়ালেখাই অনাগ্রহ মেয়েটা এত ভালো রেজাল্ট করেছে! আগ্রহ থাকলে আরও ভালো করত এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। রোজ পড়িয়ে পড়িয়ে এর মেধা সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান হয়েছে কোমলের। তার ইচ্ছা অনড়া উচ্চশিক্ষিত হবে, আত্মনির্ভর হবে। গাঁয়ের কলেজে ইন্টার পড়ালেও অনার্সের জন্য ঢাকা পাঠানোর দায়িত্বটাও সেই নিবে।
” তুমি খুশি হওনি, বুবু? ”
কেমলকে চুপ থাকতে দেখে প্রশ্ন করে অনড়া। কোমল মুক্ত হাসল। বলল,
” খুব খুশি হয়েছি। আয় একটু জড়িয়ে ধরি। ”
অনড়া ছোট্ট শিশুর মতো বুবুর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। এমন সুযোগ বারবার তো আসে না। অনড়াকে জড়িয়ে নিয়েই কোমল ভাবল, মেয়েটাকে কিছু একটা উপহার দিলে ভালো হয়। উৎসাহ পাবে। কিন্তু কী দেবে? মনে মনে খোঁজ চালাতে গিয়ে একজোড়া সোনার দুলের কথা মনে পড়ে। এই দুলজোড়া তার বাবা গড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ অন্য স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাবে, নতুন কিছু না হলে চলে? তাই বানিয়ে আনলাম, মা। প্রথম পরীক্ষার দিন এটা পরে যাবি, কেমন? ‘ সেদিন কোমল খুব খুশি হয়েছিল। তারপরেই তো অঘটনটা ঘটল। এত অশান্তির মধ্যে দুলজোড়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল, একদম পরা হয়নি। অনড়াকে ছেড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের রুমে দুলের খোঁজ করে পেল না। মায়ের কাছে ছুটে গেল। সেখানেও না পেয়ে একটু মনখারাপ হলো তার। মাকে চিন্তায় ফেলবে না দেখে বলল,
” আমার রুমেই রেখেছিলাম, মা। আরেকবার খুঁজে দেখি। ”
নিজের রুমের দিকে হেঁটে যেতেই অনড়া সামনে এসে বলল,
” কুলসুমকে দেখছি না যে? কাজে আসেনি? ”
” না। ”
” কেন? ”
কোমল কারণটা উল্লেখ করতে চাইল, সময় হলো না। অনড়া দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” তার বাড়িতে গিয়েই বলে আসি, আমি তার ছেলের চেয়েও ভালো করেছি। মুখটা নিমফলের মতো তেতো হয়ে যাবে। ”
কোমল দূর থেকেও অনড়ার মুক্ত ঝরার হাসির শব্দ শুনল।
______________
নিবিড় মেডিসিন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করেছে। সেই সুবাদে ঔষধ সম্পর্কে ধারণা বেশ। তাই বাবার ওষুধপত্র ঘেটে দেখছিল। তখনই শুনল কেউ একজন তার মায়ের নাম ধরে ডাকছে। মা বাসায় নেই। একটা দরকারে পাশের বাড়িতে গিয়েছে। নিবিড়কে বলে গেছে কেউ খোঁজ করলে সেখানে পাঠিয়ে দিতে। সেই দায়িত্ব পালন করতেই নিবিড় বাবার কাছ থেকে সরে এলো। দরজার নিকট এসে বাইরে তাকিয়েই বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। এই কচি মেয়েটা তার মায়ের নাম ধরে ডাকছে? এত সাহস! এত উচ্ছন্ন! মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। চোখদুটোতে আগুনের ছায়া। ভীষণ রাগে ধমকাতে যাবে তখনই কুলসুম নাহারের আগমন ঘটল। অনড়ার অযত্নে ফেলে রাখা বিনুনি টেনে ধরে কিছু একটা বলছিলেন অনর্গল। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অনড়ার। তার চোখদুটো তীরের মতো বিঁধে আছে দরজায় দাঁড়ানো নবপুরুষটির দিকে। ভীষণ আহ্লাদে সুধাল,
” ও কে গো, কুলসুম? ”
” আমার ছেলে। ”
অনড়ার পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে গর্ব করা হলো না। কয়েকটা মুহূর্ত ঘোরে থেকে বাড়ি ফিরে গেল। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গালে হাত দিয়ে কাটিয়ে দিল সারাবেলা। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে খুব ভোরে হাজির হলো মোল্লাবাড়ি। কোমল তখন জায়নামাজে মোনাজাত করছে। শেষ হতেই অনড়া বলল,
” আজ দারুন একটা স্বপ্ন দেখছি, বুবু। ”
” তাই নাকি? শুনেছি, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। ”
” সত্যি, বুবু? ”
অনড়ার চোখে-মুখে সমুজ্জ্বল আনন্দ, উৎসাহ। কোমল মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল,
” খুব ভালো স্বপ্ন নাকি? তোকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। ”
অনড়া উত্তরে দৃষ্টি নামাল। লজ্জার আবরণ ছড়িয়ে দিল সারা অঙ্গে। তার হাব-ভাবে ভারি আশ্চর্য হলো কোমল। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কী দেখেছিস রে? ”
” আমার বিয়ে। ”
কোমলের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অত্যাশ্চর্য কণ্ঠে সুধাল,
” কার সাথে? ”
” এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষের সাথে। ”
কোমল আর প্রশ্ন করল না। বুঝে গেল, এই মেয়ে নাম বলবে না। তাছাড়া স্বপ্নে তো কত পুরুষ, মহাপুরুষই আসে। সবাই কি সত্যিতে আছে? বাস্তবে দেখা মিলে? অনড়ার বয়স অল্প, বুঝের সাগরে পা দিচ্ছে, তাই মনের মধ্যে এসব উঁকি দিচ্ছে। হয়তো স্বপ্নটাও তার মনগড়া, কল্পনা। কিশোরী বয়সটাই এমন। মনগড়া আর কল্পনার!
অনড়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উত্তেজিত হয়ে বলল,
” গায়ের রঙটা একদম কাঁসার মতো উজ্জ্বল, নিটোল। আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা। আমি তো কাঁধও ছুঁতে পারব না। যদি সে আমায় গ্রহণ না করে? ও বুবু, কী করলে আমি আরেকটু লম্বা হব? ”
অনড়ার খামখেয়ালি দুশ্চিন্তার সুযোগ নিল কোমল। বলল,
” পড়াশোনা করলে। ”
” সত্যি? ”
” হুম, পড়াশোনা করেই তো আমার মাথা ছুঁয়েছিস। আরও ভালো করে পড়লে তার কাঁধ ছুঁতে পারবি। ছেলেমানুষিও ছাড়তে হবে। বড়দের মতো চলতে হবে, কাপড় পরতে হবে। আর..”
” আর? ”
” বড় হওয়াকে ঢাকতে জানতে হবে। ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১২)
শেষরাতের দিকে অনড়ার ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটুও ভয় হলো না তার। মনের ভেতর উপচে পড়া আনন্দ, খুশির ঢেউ দোল খাচ্ছে। অদ্ভুত এক সুখবোধে ডুবে থাকল কয়েক পল। আচমকা ঘুমন্ত নানির শরীর ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
” নানি উঠ। দেখ, আমার বিয়ে হচ্ছে। ”
জমিলা বেগম হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলেন। ঘুম চোখে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করছেন,
” চোর, চোর। আমি নাতনিরে চুরি কইরা নিয়া গেল! কেউ ধর ওরে। ”
কান ঝালাপালা করে দেওয়া চিৎকারে ঘোর কেটে গেল অনড়ার। চেতন ফেরা মাত্র নানির মুখ চেপে ধরল। শাসিয়ে বলল,
” চুপ বুড়ি। তোর নাতনিকে চুরি করবে এমন সাধ্য কার? দা দিয়ে কুপিয়ে ধড় আলাদা করে ফেলব! ”
নাতনির হাত খামচে ধরে আলগা করলেন জমিলা বেগম। ঘনঘম শ্বাস টেনে সুধালেন,
” রাত-দুপুরে গলা টিপা ধরছ, মুখ চাইপা ধরছ, মাইরা ফেলবি নাকি আমারে? ”
” আবার যদি আমার বিয়ে ভেঙে দিস, মেরেই ফেলব। ”
অকপটে কথাটা বলে শুয়ে পড়ল অনড়া। জমিলা বেগম মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে আছেন৷ নিষ্পলকে চেয়ে থাকলেন অনড়ার দিকে। কিছু সেকেন্ড পর বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোর বিয়া? ”
অনড়া চোখ বুঝে সংক্ষেপে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
” কোনহানে? কার লগে? ”
” স্বপ্নে। আমার স্বামীর সাথে। ”
জমিলা বেগমের বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। আঁধারেও নাতনির মুখটা দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না এই মেয়েটি তার নাতনি। হাত দিয়ে অনড়ার পুরো শরীর স্পর্শ করতে শুরু করলে সে ধমকে উঠল,
” ঐ বুড়ি, কী হয়েছে তোর? ”
জমিলা বেগম ধমকের তোয়াক্কা করলেন না৷ অনড়া এক হাত সরালে তিনি অন্য হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। পালা করে দু-হাতে সার শরীর হাতিয়ে নিশ্চিত হলেন এই মেয়েই তার নাতনি। তারপরেই আপনমনে ভাবলেন, ‘ দুইদিন আগে শরীর খারাপ হওয়া মাইয়া স্বপ্নে বিয়া দেখে। আবার স্বপ্ন ভাইঙা যাওয়ার লাইগা আমার গলা টিপে ধরে, মুখ চেপে ধরে। মাইরা ফেলার হুমকি দেয়। আমি কি সাপ-কলা দিয়ে কাল সাপ পুষছি এতদিন? ‘
শেষ কথাটা একটু জোরেই উচ্চারণ করে ফেলায় অনড়া শুনতে পায়। বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলে বলল,
” আমি কাল সাপের চেয়েও খারাপ। ”
জমিলা বেগম আঁতকে উঠেন। অজান্তেই একহাত দিয়ে বুক চেপে ধরেন ভয়ে। অনড়া মাথার নিচের বালিশ মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। চৌকি থেকে নামতে নামতে বলল,
” আজ থেকে আমি নিচে ঘুমাব। নাহলে তুই আবার আমার বিয়ে ভেঙে দিবি! ”
নানির দিক থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ পেল না অনড়া। মাটির মধ্যে আরাম করে শুয়ে পড়ল। অনেক্ষণ এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি করে উঠে বসল হঠাৎ। ঘুম আসছে না কিছুতেই। কেমন যেন অশান্তি লাগছে অন্তরে। হাঁসফাঁস লাগছে বুকের ভেতরটায়। মগজের ভেতর পিঁপড়ের মতো কিছু একটা পিলপিল করছে। কী সেটা? অনড়া থম মেরে বসে থাকে কতক্ষণ। একহাত গালে ঠেকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিতেই মনে পড়ল তার স্বপ্নে নিবিড় বিয়ে করতে আসে। বিয়েও হয় কিন্তু সংসার দেখে না, স্বামীর আদর দেখে না, ছেলেমেয়েও দেখে না। কেন? অনড়ার গভীর চিন্তা আরও গভীর হয়। ডানহাতের বদলে বাম হাত ঠেকে গালে। অন্তরের অশান্তি বাড়ে, হাঁসফাঁস বেড়ে নিশ্বাস আটকে দেয় তবুও প্রশ্নের উত্তর মেলে না। অনড়া দিশাহারা হয়ে পড়ে। বসা থেকে দাঁড়ায়। ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে। নিঝুম রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে বাড়ি খায় অনড়ার নরম শরীরটায়। একটু কেঁপে উঠতেই বুদ্ধি খুলে। স্বগতোক্তি করে, ‘ যে বিয়ে করতে আসে তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো সমস্যা সমাধান! ‘ নিবিড়ের কথা মনে হতেই ব্যাকুল হয়ে পড়ে অনড়া। সময়, পরিস্থিতি ও অবস্থান ভুলেই রাস্তার দিকে ছুট দিল। কিশোরী চঞ্চলতা হারিয়ে দিল ভয়কে। হাজির হলো নিবিড়ের বাড়ির সামনে। ছোট্ট উঠোন পেরুতে গিয়ে পা বাঁধল কিছু একটাতে। হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। ঠিক তখনই দৃষ্টিসীমায় এলো চারপাশের অন্ধকার, শেয়ালের ডাক, নিশাচর প্রাণীর ডানা ঝাপটানো, বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ, জানপ্রাণহীন নিস্তব্ধতা। মুহূর্তেই চঞ্চলতা হারিয়ে গেল। ফিরে এলো ভয়, জড়তা। কান্না করে দেওয়ার অবস্থা হলো তার। ফিরে যাওয়ার সাহসটুকুও সঞ্চয় করতে পারল না। বহুকষ্টে কদম মেপে মেপে এগিয়ে গেল কুলসুম নাহারের রান্নাঘরটায়। চুলার পেছনে হাত দিতে ম্যাচের শলা পেল। কুপিও। কেরাসিন তলাতে পড়ে থাকায় আগুনে শিখা ছোট হলো। আলো ছড়ালো ক্ষীণ। সেই আলোতে অনড়া হাত-পা গুটিয়ে বসল। ঠিক করল, সকালে নিবিড়ের সাথে কথা বলে তবেই বাড়ি ফিরবে। সে শুধু বিয়ে না, স্বামীর আদর, সংসার, বাচ্চা-কাচ্ছা সব দেখতে চায়।
_______________
রাবেয়া খাতুনের ফযরের নামাজ পড়তে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আজ। তাড়াহুড়ো করে ওযু শেষ করে নামাজে দাঁড়াতেই সেলাই মেশিনের শব্দ পেলেন। সেই শব্দ কানে নিয়ে পুরো নামাজ শেষ করেছেন। জায়নামাজ ভাঁজ করে হাতে তসবিহ নিয়ে হাঁটা ধরলেন মেয়ের রুমের দিকে। দরজার কাছে পৌঁছে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন, মেয়ে কাপড় সেলাই করছে। তার ভ্রূ-দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো। দূর থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এত সকালে মেশিন নিয়ে বসেছিস? ব্যাপার কী? ”
কোমল মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। কালো রঙের একটা কাপড় দেখিয়ে বলল,
” অনড়ার জন্য বোরকা বানাচ্ছি। আগে কখনও বোরকা বানাইনি, এটাই প্রথম। দেখ তো মা হচ্ছে নাকি? ”
রাবেয়া খাতুনের সেলাই বিষয়ক কোনো জ্ঞান নেই। এ কথাটি জানা স্বত্তেও কোমল প্রায়শই মায়ের সামনে বানানো কাপড় তুলে ধরে। উপদেশ চায়, ভুল ধরিয়ে দিতে বলে। অথচ তিনি জানেন, তার মেয়ে এ ব্যাপারে ভীষণ পটু। তবুও মেয়ের এই সরলতাকে দারুন উপভোগ করেন, ভালোবাসেন। সাহায্য করতে চান। উৎসাহ দেখান। কিন্তু আজ পারলেন না। কেমন যেন একটা বিরক্তবোধ করলেন। খানিকটা কড়া গলায় বললেন,
” ঘুম নষ্ট করে সেলাই করছিস? আমার এটা একদম ভালো লাগেনি। আলো এখনও ভালো করে ফুটেনি, একটু ঘুমিয়ে নে। ”
” আরেকটু বাকি আছে, মা। শেষ হলেই বিশ্রাম করব। ”
কোমল এত নরম করে কথাটা বলল যে রাগটা বাড়াতে পারলেন না তিনি। ধমকও দিতে পারলেন না। তাই বেরিয়ে এলেন দ্রুত। ততক্ষণে আনিস মোল্লা মসজিদ থেকে ফিরেছেন। তার সামনে গিয়ে নালিশের ভঙ্গিতে বললেন,
” তোমার মেয়েটাকে একটু শাসন করতেও তো পার। ”
” কেন, কী করেছে? ”
” নিজের সব অন্যের পিছনে খরচ করছে। এত দয়ার শরীর হলে হয়? ”
” আবার কার পেছনে খরচ করল? ”
রাবেয়া খাতুন অনড়ার জন্য বানানো বোরকার কথা বলতে গিয়ে অনেক কিছুই তুলে ধরলেন। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো কাল রাতে অনেকগুলো টাকা নিয়েছে কোমল। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানিয়েছে, অনড়ার কলেজে ভর্তির জন্য লাগবে। স্ত্রীর নিকট সবটা শুনে মৃদু হাসলেন আনিস মোল্লা। সহাস্যে বললেন,
” অন্যকে ভালো রেখে যদি আমাদের মেয়ে খুশি থাকে তাহলে আমরা কেন তার খুশিতে খুশি হতে পারব না, রাবেয়া? সন্তানের খুশিই তো বাবা-মায়ের পরম চাওয়া। সে খুশির জন্য যদি আমার সব অন্যকে দিয়ে দিতে হয় তাহলে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিব। রাবেয়া, আমাদের একটিমাত্র সন্তান। সে হিসেবে আমার স্থাবর-অস্থাবর সবই তো কোমলের। এখন যদি সে এখান থেকে কিছুটা অন্যকে দিয়ে ভালো থাকে, তবে ক্ষতি কী? ”
” আমার যে ভীষণ ভয় হয়! ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয়। ”
” আমার হয় না। ”
” কেন? ”
” কারণ, কোমলের ভবিষ্যৎকে এমন একজনের কাছে সমর্পণ করেছি যার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। ”
” কার কথা বলছ? ”
” নিবিড়। আমার মেয়ের জামাই। ”
________________
সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল অনড়ার। আড়মোড় ভেঙে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে কিছু সময় নিল। তারপরেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। নিবিড়দের দরজা এখনও ভেতর থেকে বন্ধ। এদের ঘুম এখনও ভাঙেনি? সে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল। আক্রমণ বসাল বন্ধ দরজায়। জোরে জোরে থাপ্পড় মেরে ডাকতে লাগল,
” কুলসুম? এই কুলসুম। দরজা খোল এখনই। নাহলে কিন্তু ভেঙে ফেলব। ”
বাবার পাশে সারারাত জেগে থেকে ভোরের দিকে চোখ লেগেছিল নিবিড়ের। তন্মধ্যে এমন ভারী শব্দ ও চেঁচানোতে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দের উৎস খুঁজে বের করতেই কানের মধ্যে মায়ের নামটি ভেসে এলো। এত সকালে কে ডাকতে এসেছে? ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। তার সাথে মাও জেগে ছিলেন। সে চাচ্ছিল না মায়ের ঘুম এখনই ভেঙে যাক। তাই বড়বড় পা ফেলে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। সিটকিনি খুলেই স্তব্ধ হয়ে যায়। অবাক হয়ে দেখল সেই কচি মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ওড়না মাথায় বেঁধে সিংহের মতো গর্জন তুলছে। মুহূর্তেই নিবিড় রেগে যায়। রক্ত উঠে যায় মাথায়। কোনো কিছু না ভেবেই চড় মেরে বসল অনড়ার বা’গালে।
আকস্মিক ঘটনায় অনড়া প্রতিক্রিয়া করতেও ভুলে গেছে যেন। গালে হাত দিয়ে বোকা চোখে চেয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। নিবিড় বাইরে থেকে দরজার পাল্লা টেনে নিল। অনড়ার একহাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে আসল উঠোনের মাঝামাঝিতে। সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথাও একটা ছুটে গেল। ফিরে এলো ছোটছোট পাতায় ভরা একটি ডাল নিয়ে। সেই ডালের পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলতে ফেলতে বলল,
” ফের যদি আমার মাকে নাম ধরে ডেকেছ তাহলে এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলব। ”
অনড়া আগের মতোই চুপ করে থাকলেও চোখদুটো অশ্রুতে টলমল হলো। সেই চোখে চেয়ে নিবিড় ধমকে উঠল,
” মাথা থেকে ওড়না খোল। ”
অনড়া কেঁপে উঠল। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল এঁকেবেঁকে। ঝটপট ওড়না খুলে নিবিড়ের দিকে বাড়িয়ে ধরল। নিবিড় সেই ওড়না স্পর্শ করল না। আগের মতো ধমকেই বলল,
” গলায় পরো। ”
অনড়া দড়ির মতো গলায় ফেললে নিবিড় আরও একবার ধমক দিল,
” ঠিকমতো পরো। পুরোটা মেলে। ”
অনড়া পুরোটা মেলে সুন্দর করে ওড়না জড়িয়ে নিলে নিবিড় শাসিয়ে বলল,
” আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন তোমাকে না দেখি। এখন যাও। ”
অনড়া বাধ্য মেয়ের মতো ফিরে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরলে নিবিড় থামাল। লাঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল,
” এটা সবসময় সাথে রাখবে তাহলে ওড়না মাথায় উঠবে না আর বেয়াদবীও করতে পারবে না। এখন মাথা নিচু করে যাও। ”
অনড়া মাথা নিচু করে রাস্তায় নেমে আসার পর মনে হলো, কুলসুমকে নাম ধরে ডাকতে মানা করেছে কিন্তু কী বলে ডাকবে এটা তো বলেনি। অনড়া মাথা সোজা করে পেছন ফিরল। নিবিড় এখনও উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে, সে কি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসবে?
চলবে
[