বেপরোয়া ভালোবাসা পর্ব -২৮

#বেপরোয়া_ভালবাসা
#পর্বঃ২৮
#লিখনীঃ #মনা_হোসাইন

চারদিকে আলো ফুটে উঠলে ঘুম ভাঙল আদিবার। আদির কাঁধে নিজেকে দেখে কেন যেন একটু ছটকে সরে গেল…

-“ট্রেন চলে এসেছে…?

আদি বেশ নরম গলায় উত্তর দিল
-“অনেক আগেই…চল যাওয়া যাক.

আদিবা নামতে নিলে আদিত্য বলল,
-“ব্যাগটা আমার কাছে দে…

-“নাহ আমার কাছেই থাকুক

-“সাথে জলজ্যান্ত একটা ছেলে থাকতে মেয়ে ব্যাগ নিয়ে যাবে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।

-“বল্লাম তো আমি নিতে পারব।
বেশ ধমক দিয়েই কথাটা বলল আদিবা

-“আরে এত রেগে যাচ্ছিস কেন?যা করেছি তোর ভালর জন্যই ত করেছি।

-“আপনি একটা বিষয় কেন বুঝতে পারছেন না আমি বড় হয়েছি ভাইয়া। আমার ভাল বুঝার দায়িত্ব টা এবার আমাকে নিতে দিন। আপনি আমার জন্য যে ভাল গুলো বুঝেন সেগুলো আমার ভালর চেয়ে খারাপেই হয় বেশি…

-“কী সব বলছিস? কিসের মধ্যে কি বলতে চাইছিস..?

-” কিছুই বলতে চাচ্ছি না আমি মুক্তি চাইছি আপনি নামক কারাগার থেকে আমায় মুক্তি দিন প্লিজ…

যদিও আদি আজ আদিবার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল কিনন্তু এই কথাটা বলতে দেরি হলেও থাপ্পড় মারতে দেরি হল না। আদি স্বজোরে আদিবার গালে থাপ্পড় বসিয়েছে।না আদিবা তাতে কাঁদে নি জলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আদি চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করল তারপর শান্ত গলায় বলল,

-“আদিবা তুই জানিস আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না তবুও আমাকে কেন রাগাস…? চল বাসায় চল যা বলার বাসায় গিয়ে বলবি…

আদিবা কোন উত্তর না দিয়ে আদি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদিবা আদির ব্যাগ থেকে ছুড়িটা বের করে নিল আদি কিছুটা অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে তাকাল।

-“কি করবি? আমায় মারবি..?

-“নাহ..আপনাকে মা*রতে যাব কেন আপনার সাথে আমার কিসের শত্রুতা।

-“তাহলে ছুড়ি দিয়ে কী করবি..?

-“আমি আর ওই বাসায় ফিরব না।

-“বাড়াবাড়িটা এবার বেশি হয়ে যাচ্ছে না? বলেই আদি আদিবার দিকে এগিয়ে গেল

-“খবরদার আমার কাছে আসবেন না।

-“তোর কী মনে হয় তোর হাতের ছুরিকে আমি ভয় পাই..?চুপচাপ বাসায় চল বাড়াবাড়ি করবি তো হাত-পা ভে*ঙে বাসায় ফেলে রাখব.

-“ভাইয়া আপনাকে সাবধান করছি আমার পিছন পিছন আসবেন না…

-“আসলে কী করবি?

-“আমি আপনাদের হাতের পুতুল নই যে যখন যা ইচ্ছা করবেন আমার সাথে।আপনাদের অত্যাচার আর মেনে নিতে পারছি না। আজ হয় আমাকে এখান থেকে যেতে দিবেন অথবা আমি নিজেকে শেষ করে দিব…

আদিবার কথা শুনে থমকে গেল আদি,আদিবা এমন কিছু বলবে তার মাথায় ছিল না।সে ভ্রু কুচকে বলল,

-“আদিবা…এসবের মানে কী?

-“আমাকে ধমকে কোন লাভ নেই আমি আর কোন কিছুই ভয় পাই না। আমাকে যেতে দিন।

-“কোথায় যাবি..?

-“যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব…

-“জীবন এত সহজ নয়.একবার বাইরে বেরিয়ে দেখ তোর সাথে কি কি ঘটে..

-“কী আর ঘটবে..? যা যা খারাপ ঘটার সব ত এমনিতেই ঘটে আমার সাথে আর কী ঘটবে। বেরিয়ে গেলে অন্তত কথায় কেউ থাপ্পড় মারবে না উনিশ থেকে বিশ হলে বাথরুমে আটকে রাখবে না।

-“এরচেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটবে…

-“কী ঘটবে…? কেউ আমার সম্মানে হাত দিবে..? আপনার কি মনে হয় আমার সম্মান আছে? আপনি আমার সম্মানে হাত দেন নি? জোর করে…

-“আদিবা চুপ করবি তুই…?

-“কেন চুপ করব? মিথ্যে বলছি কিছু?আপনি আমার সাথে খারাপ কিছু করেন নি? এমন কোন জায়গা বাকি রেখেছেন যেখানে হাত দেন নি?

-“আদিবা….!!

-“গলা নিচু করছেন কেন চেঁচিয়ে বলুন যা করেছেন বেশ করেছেন।আপনার চোখে তো নিজের অন্যায় কোনদিনি পড়েনি।

-“মানছি যা করেছি ভুল করেছি তাই বলে আমি তোকে টাচ করা আর অন্যদের টাচ করা এক কথা?

-“এক হবে না কেন? আপনি আমার স্বামী? কেন করলেন এমন? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এগুলা করায় আমার কেমন লেগেছিল আপনি জানেন? শরীর দাগ না হয় জামায় ঢেকে ফেলেছি কিন্তু আপনি আমার সাথে এগুলো করার পর আমার মনে যে দাগ লেগেছে সেগুলো ঢাকব কি করে?আপনি আর কখনো আপনাকে সম্মান করতে পারব না।

-“আমি এতটাও খারাপ কিছু করিনি তুই যেভাবে বলছিস..তাছাড়া তুই চাইলে আমি তোকে আজকেই বিয়ে করব। যা হয়েছে ভুলে যা আমি যা করেছিলাম রাগের মাথায় করেছিলাম।

-“রাগ…? হ্যা আপনাদের সবারেই রাগ করা মানায় শুধু আদিবার রাগ থাকতে পারে না৷ আর কি বললেন বিয়ে…? আপনার কী মনে হয় জোর করে সব পাওয়া যায়..?জোর করে আর যাইহোক ভালবাসা পাওয়া যায় না। আপনি আমার জীবন টা নষ্ট করে দিয়েছেন। হ্যা আমি আপনাকে ভালবাসতাম কিন্তু এখন আর ভালবাসি না কোনদিন আর বাসবও না। যে ভালবাসায় কোন সম্মান নেই,স্বাধীনতা নেই সেই ভালবাসা আমার চাই না।

আদি আদিবার চোখের দিকে তাকাল চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে আদি একটু স্থীর হয়ে বলল,

-“বাসতে হবে না। বিয়েও করতে হবে না কিছুই করতে হবে না শুধু বাসায় চল। আদিবা রাস্তায় এমন করলে লোকে খারাপ ভাব্বে…

-“আপনার কি মনে হয় আমি আপনাকে চিনি না? ভুল ভাল বুঝ দিয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে মা*রবেন আমি আর কত সহ্য করব বলতে পারেন?নাহ আমি আপনাদের আর কোন সুযোগ দিব না। আপনারা আমার উপড় অত্যাচার করার আগে আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিব বলেই আদিবা ছুরিটা নিজের হাতে চালাতে চাইল।

আদি ঝরের গতিতে এসে ধরে ফেলল। আদিবা নিজেকে আঘাত করতে চাইছে আর আদি তাকে বাঁধা দিতে চাইছে। তাদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গিয়েছে। হাতাহাতির এক পর্যায়ে আদিবার হাতে ছুরিটা লেগে গেল। হাত থেকে র*ক্ত পড়তে শুরু করল সাথে সাথেই আদি স্বজোরে আদিবার গালে আবারো থাপ্পড় বসাল। আদিবা ছিটকে নিচে পড়ল।

-“দেখলেন? এতকিছুর পরেও আপনি নিজের রাগ সামলাতে পারলেন না। আপনিই বলুন আপনার সাথে সারাজীবন থাকা সম্ভব?

আদি নিচে পড়ে থাকা ছুরিটা তুলে নিয়ে। পকেট থেকে রুমালটা আদিবার উপড় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“অনেক হয়েছে আদিবা হাতটা বেঁধে এবার বাসায় চল প্লিজ।

-“ভাইয়া আপনি বাড়াবাড়ি করলে আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।

কথাটা শুনে আদি অবাক চোখে তাকাল

-“কি বললি তুই..?

-“যা বলেছি ঠিকি বলেছি আমি বড় হয়েছি। নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আমার আছে।

-“আদিবা তুই কি বলছিস বুঝতে পারছিস?

আদিবা উত্তর দিল না। আদিবা হাত বাঁধতে বাঁধতে কাঁদছে আদিবার দিকে তাকিয়ে হটাৎ করেই আদি শান্ত গলায় বলল,

-“যা তোকে আজ মুক্ত করে দিলাম আদিবা। যেখানে ইচ্ছে চলে যা….আমি আর তোর উপড় জোর করব না। আজ থেকে তুই আমায় চিনিস না আমিও তোকে চিনি না।

আদি আর কোন কথা বলল না। এমনকি আদিবার দিকে ফিরেও তাকাল না হনহন করে হেঁটে চলে গেল।

আদিবা উঠে আদির রুমাল দিয়েই হাত বেঁধে নিল তারপর হাঁটতে শুরু করল। যত কষ্টই হোক এই লড়াইয়ে তাকে জি মতরে হবে।নিজের উপড় হওয়া সকল অন্যায়ের জবাব দিতে হবে আদি সহ বাকি সবাইকে বুঝাতে হবে তারা আদিবার সাথে যা যা করেছে অন্যায় করেছে। তার বিশ্বাস সে যখন থাকবে না তখন সবাই তাদের ভুল বুঝতে পারবে।

এদিকে আদি হাঁটছে আর ভাবছে,
-“তোর উপড় যে মায়া টুকু অবশিষ্ট ছিল সেটাও আজ তুলে দিলি আদিবা..? কিন্তু কেন? তুই কী আমার রাগের পিছনের ভালবাসাটা কোনদিনি বুঝিসনি? তুই সত্যিই আমায় ভালবাসিস না? নাই বা বাসলি তাই বলে বাসা ছেড়ে চলে যাবি? এই দশ হাজার টাকায় তোর কতদিন চলবে..?ভালই হয়েছে বেরিয়েছিস আজ থেকে তুই বুঝবি বাইরের জগৎটা কতটা খারাপ। পরিবার যতই খারাপ হোক বাইরের নিষ্টুর দুনিয়া থেকে কতটা ভাল। তোকে আমি আর বাঁধা দিব না। আজ আমি যা হারালাম হয়ত এই শুন্যস্থান কোনদিন পূরন হবে না কিন্তু তুই আজ যা হারালি তাও আর কোনদিন ফিরে পাবি না। কথা দিলাম আমি নিজেকে বদলাব। আদিবা নামক মায়া থেকে নিজেকে বের করে আনব। যত কষ্টই হোক আমি তোকে ভুলব আদিবা।তোকে নিজের সাথে জড়িয়ে আর কষ্ট দিব না। তোকে আজ থেকে ভুলে যাব…

ভাবতে ভাবতে মন খারাপ করে বাসায় ফিরল আদি. আদিকে দেখে সবাই এগিয়ে আসল সবার ধারনা ছিল আদি,আদিবাকে নিয়েই ফিরবে।কিন্তু আদিবা নেই দেখে আদিবার মা এগিয়ে বললেন,

-“আদিবা কোথায় আদি…?

প্রশ্নটা শুনার সাথে সাথে আদি চেঁচিয়ে উঠল,
-“তোমার মেয়ে কোথায় তার জবাব আমি কি করে দিব…?

-‘ত ত তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?

-“কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছো জানো না? তাহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেন..?আচ্ছা আমি যাওয়ার সময় কী একবারো বলেছিলাম আমি আদিবার জন্য চলে যাচ্ছি? তাহলে কেন ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করলে? এতটাই খারাপ ব্যবহার যে ও আর এই বাসায় ফিরতে চায় না।

আদির কথায় সবাই মাথা নিচু করে নিল।

-“যাইহোক আমি আদিবাকে ফিরানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে ফিরবে না।

-“ফিরবে না তো কোথায় যাবে গ্রামে…?

-“নাহ আমাদের পরিবারের সমস্থ দরজা আজ থেকে আদিবার জন্য বন্ধ। ও আর কোন দিন এই বাড়িতে ফিরবে না এটাই আমার শেষ কথা…

-“তুই এসব কি বলছিস বাবা…?

-“যার যার আমার মতামত পছন্দ হবে না তারাও বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে পারো। আর একটা কথা এতদিন তো আমার বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলে আজ আমি নিজেই বিয়ে করতে চাই তবে বাইরের কোন মেয়েকে না। আমি সাদিয়াকে বিয়ে করতে চাই যদি রাজি থাকো বিয়ের আয়োজন করো অথবা এই বাসার দরজা তোমাদের জন্যও বন্ধ হয়ে যাবে…

আদি রেগে আছে বুঝতে পেরে আদির মা এগিয়ে আসলেন,

-“মাথা ঠান্ডা কর বাবা। তুই কী বলছিস হয়ত নিজেই জানিস না।

-” কেন জানব না? সাদিয়াকে বিয়ে করার যোগ্যতা আমার নেই?

-“আমি তা বলিনি কিন্তু তুই আদিবাকে পছন্দ করিস রাগের মাথায় এত বড় সিধান্ত নিস না।

-“আমার কথা কখনো নড়চড় হয় না মা। আর পছন্দ তো সাধারন বিষয় এই সমাজে বড় বোনের বরের সাথেও ছোট বোনের বিয়ে হয়। কাকিয়া এই যে এত বছর আমাদের বাসায় থাকলে এবার তার প্রতিদান দাও সাদিয়াকে আমাকে দাও প্লিজ। কথা দিচ্ছি কোন দিন এতটুকুও অসম্মান করব না। ওকে আমি সুখে রাখব। আমি জোর করছি না আমার কথাটা একটু ভেবে দেখো প্লিজ তোমার বড় মেয়ে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে তাই আমি সাদিয়ার মাঝেই আদিবাকে খুঁজে নিতে চাই। আমি বাঁচতে চাই কাকিয়া আমায় ফিরিয়ে দিও না বলতে বলতে আদি চোখের পানি ছেড়ে দিল।

সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এই প্রথম আদিকে কেউ কাঁদতে দেখল। আদি চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে গেল। আদি নিজেকে শান্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে৷ না এমন তো হওয়ার ছিল না। আদিবাকে ছেড়ে থাকার কথা তো ছিল না। আদিবাকে ছাড়া বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদিবাকে ছাড়া মিনিটে মিনিটে কাকে ডাকবে সে? যার মায়াবী মুখটা দেখার জন্য কারনে অকারনে ডেকে আনত তাকে ছাড়া চারদিকটা যে অন্ধকার লাগছে।আদিবা কী সত্যিই আর ফিরবে না? সে কেন আদির মনের লুকানো ভালবাসা বুঝল না? আদির দম বন্ধ হয়ে আসছে সে আদিবার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছে না…

.
.
.
চলবে…!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here