বেসামাল প্রেম পর্ব – ৮+৯

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৮
রেডি হতে হতে আধঘন্টা লেগে গেল হৈমীর। আজ সে সাজের বেলায় বেশ কৃপণতা করল। তার এরূপ আচরণ দেখে মা হামিদা নিজেই বিস্মিত হয়ে বললেন,
-” কীরে তোর হলো কী? মুখটা এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? ”

থতমত খেয়ে গেল হৈমী। সূচনা বলল,
-” তুমি তো সাজতে ভীষণ ভালোবাসো হৈমী তাহলে আজ কেন এমন করছো! সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে তোমার? ”

বারকয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল হৈমী৷ এতক্ষণ সাজের বেলায় কৃপণতা করলেও মা, ভাবির কথা শুনে ঠোঁটজোড়াতে গাঢ় করে লিপস্টিক লাগালো৷ এরপর তাদের সামনে এসে চোখ পিটপিট করে ব্যস্ত গলায় বলল,
-” এই তো সেজেছি আম্মু, ভাবি কেমন লাগছে আমায়? আচ্ছা আম্মু তুমি এমন কেন বলো তো, বেশি সাজগোজ করায় কম তো বকাঝকা করো না। বেশি কথা বললেও শাসন করে করে আমার ছোট্ট হৃদয়খানা অতিষ্ঠ করে ফেলো৷ আর আজ যখন কথা বলছি না, সাজছি না এতেও সন্দেহ করছো, চোখ পাকাচ্ছ। আমি যাব কোথায় বলো তো? ”

সূচনা তার কাঁধ চেপে ধরে বলল,
-” আমাদের বাড়ি যাবে চলো। ”

চমকে ওঠল হৈমী৷ নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বেড়ে গেল তার। হামিদা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
-” তুই যেমন তেমনি থাক মা, শুধু ও বাড়ি গিয়ে বুঝেশুনে কথা বলিস। ”

সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নব দম্পতি পা রাখল শেখ বাড়িতে। কিছু নিয়ম রীতি পালন করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করানো হলো তাদের। ভাই, ভাবির সঙ্গে শেখ বাড়ির ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই সোফার মাঝবরাবর পরিচিত দুর্ধর্ষ বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটিকে দেখে আত্মা শুকিয়ে গেল হৈমীর। ঘনঘন ঢোক গিলতে শুরু করল সে। যতটা সম্ভব ভাইয়ের গা ঘেঁষে থাকলে লাগলো।

পায়ের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করেই বসে আছে রুদ্র। তার পাশে গিয়েই বসল মাহের। টুকটাক কথা বলল সে রুদ্রর সঙ্গে। হৈমী তখন ড্রয়িংরুমের এক পাশে দাঁড়ানো। সূচনা রান্নাঘরে গিয়ে দাদিন আর চাচীদের সঙ্গে কথা বলছে৷ সোহান, রোশান হৈমীকে ইশারা করছে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য। সে প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর এলো সাদমান। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বলল,
-” আরেহ হৈমী যে, তোমাদের ওখানে যাওয়ার পর তো তোমার দেখাই মিলল না। ডেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কোথায় পালিয়েছিলে হুম? আজ রাতে কিন্তু আর পালানোর সুযোগ নেই। ”

রোশান চিল্লিয়ে ওঠল বলল,
-” ব্রো আজ কিন্তু আমরা সবাই মিলে লুডু খেলব। ”

সোহান শার্টের কলার উঁচিয়ে বলল,
-” কী আর খেলবি, হেরে যাওয়ার ভয়ে আগেই বেয়ানের গলা শুকিয়ে কাঠ! ”

তীব্র অপমান বোধ করল হৈমী। আঙুল উঠিয়ে বলল,
-” এই হৈমীকে লুডু খেলায় হারানো এত সোজা নয়। ”

বোনের কথা শুনে আলতো হেসে রুদ্রর সঙ্গে কথায় মনোযোগ দিলো মাহের। আকস্মাৎ সব ভয়, জড়তা ত্যাগ করে নিজের স্বভাবে চলে গেল হৈমী৷ ছোটোখাটো ঝগরা লেগে গেল সবার সঙ্গে। মাহেরের জরুরি কল আসায় সে রুদ্রর পাশ থেকে ওঠে বাইরে চলে গেল। তর্কবিতর্কে মশগুল হৈমী টেরই পেলো না রুদ্রর কঠোর দৃষ্টিজোড়া তার পানেই স্থির। যখন টের পেলো চুপসে গেল। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঘনঘন ঢোক গিলে আড়চোখে রুদ্রকে দেখতে দেখতে আমতা আমতা করে উত্তর দিলো সকলকে। এমন সময় রুদ্রর দাদিন কাজের মেয়েকে দিয়ে হালকা নাস্তা পাঠালো সকলের জন্য। সোহান, রোশান, সাদমান তিন ভাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল খাবারের দিকে৷ সূচনা পোশাক পরিবর্তন করার জন্য উপরে চলে গেল। হৈমী তার পেছন পেছন যেতে পা বাড়াতেই তাকে উদ্দেশ্য করে দাদিন বলল,
-” ও মেয়ে তুমি অমন চুপচাপ ক্যান গো? এমনিতে তো মুখে খই ফুটে। নাকি আত্মীয়তা করানোর জন্য ওটা নাটক ছিল! ”

চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল হৈমী। আড়চোখে রুদ্রর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সাহেব বেশ আয়েশ করে বসে ঠোঁটে তর্জনী ছুঁইয়ে বদমায়েশি হাসি হাসছে। নিমিষেই চিৎকার করে মাথায় বেঁধে রাখা ঝাঁকড়া চুলগুলো খামচে ধরতে ইচ্ছে করল হৈমীর। মনের বিশাল কষ্টটুকু চেপে রেখে জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” কইই আসলে শরীরটা ভালো নেই দাদি। ”

দাদিন সন্তুষ্ট হলো না। মুখে তীব্র অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে বলল,
-” থাক আর জোর করে হাসতে হবে না৷ নাস্তা করো।”

ঠোঁট উলটে হৈমী ডাকল,
-” ও দাদিন। ”

দাদিন চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল। হৈমীর কথায় ফিরে তাকাতেই হৈমী তড়াক করে তার সামনে এসে টোপ করে গালে চুমু খেলো। বলল,
-” রাগ করো না দাদিন প্লিজ। আসলে কী হয়েছে বলো তো আমার আশপাশে একটা লম্বা, মোটাসোটা , বড়ো বড়ো হাত, বড়ো বড়ো চোখ, বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা মৌমাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। তুমিই বলো মৌমাছি আশপাশে থাকলে কি আমরা স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারি? তারওপর যদি একবার সে মৌমাছির কামড়ায়… ”

ঠাশ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেতেই চমকে ওঠল সকলে। সবচেয়ে বেশি চমকাল হৈমী। যার ফলে ভয়ে সিঁটিয়ে দাদিনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। টি টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসটা কীভাবে পড়ল বুঝতে পারলো না কেউ। কিন্তু ওখানে রুদ্র বসা ছিল সে এখন নেই দাদিন বিচলিত হয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখতে পেল রুদ্র সিঁড়ি ডেঙিয়ে উপরে যাচ্ছে। বাকি তিন নাতির ঠোঁট অল্প ফাঁক, চোখ রুদ্রর যাওয়ার পানে স্থির।

ডিনার করার সময় সকলে একসাথে হওয়ার পর হঠাৎ দাদিন হৈমীকে জিজ্ঞেস করল,
-” তা হৈমী তুমি যেন কিসের মৌমাছির কথা বলছিলে? বড়ো বড়ো দাঁত, হাত কিসব যেন? ”

মাহের চিন্তিত হয়ে বোনের দিকে তাকাল। রুদ্রর ছোটো তিন ভাই হো হো করে হাসতে লাগল। মৌমাছির বড়ো বড়ো হাত, দাঁত! হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিল কাঁপিয়ে ফেলল ওরা৷ হৈমী কাচুমাচু হয়ে সম্মুখে গম্ভীর হয়ে বসে খাবার খাওয়া রুদ্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিলো। দাদিন আবারও হৈমীকে প্রশ্ন করল। সূচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” আহ দাদিন হৈমী মজা করেছে তোমার সঙ্গে। ”

সকলের খাওয়া শেষ শুধু হৈমীরই বাকি৷ দাদিন বলল,
-” এত সময় নিয়ে খাওয়া ঠিক না। তোমার মনে হয় খাওয়াতে মনোযোগ নাই। খাওয়ার সময় অমন উদাস ভাব ভালো লক্ষণ না বুঝছো? ”

এমন সময় হঠাৎ রুদ্র এসে চেয়ার টেনে বসল। দাদিন বলল,
-” কিছু বলবি? ”

রুদ্র উত্তর করল না। নিজের মতো গম্ভীর হয়ে কয়েক পল বসে থেকে হাত বাড়িয়ে জগ থেকে আস্তে আস্তে গ্লাসে পানি ভরলো। ভাবটা এমন যে সে পানি পান করতেই এসেছে। অথচ হৈমী বুঝল তার উদ্দেশ্য অন্যকিছু। হলোও তাই গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে সে হৈমীকে উদ্দেশ্য করে দাদিনকে বলল,
-” দাদিন সুরামাস চলছে, এ মাসে বড়ো বড়ো হাত, বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা মৌমাছিরা সুরাপানের জন্য ভোঁ ভোঁ করে। উপরওয়ালার দান করা মধুচক্র শুধু অমন মৌমাছির জন্যই বরাদ্দ। ”

দুর্বোধ্য কথাগুলো শেষ করে ঢকঢক করে পানি পান করল রুদ্র। অধরে তির্যক হাসি ফুটিয়ে তুলে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পল তাকিয়ে রইল হৈমীর দিকে। ঐ দৃষ্টির গভীরতা একদম বুকে গিয়ে লাগলো হৈমীর। অদ্ভুত এক যন্ত্রণাময় অনুভূতি হলো তার। থতমত খেয়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র নিজেও। রাশভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
-” সো হটেস্ট হানিকাম্ভ! ”

ধীরপায়ে চলে গেল রুদ্র। হৈমী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের ভিতর ধকধকে অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাদিন ডাকল,
-” ও মেয়ে খাওয়া শেষ করো। ”

হৈমী আনমনেই বলে ওঠল,
-” সুরামাস মানে কী দাদিন? ”

-” চৈত্রমাস। ”

-” কিন্তু এখন তো শ্রাবণ মাস চলছে। ”

ঠোঁট টিপে হেসে দাদিন বলল,
-” এ চৈত্রমাস সে চৈত্রমাস নারে। এ চৈত্রমাস মানে মধুমাস। যেমন তোর ভাই আর ভাবির মধুমাস চলছে!”

শেষ পর্যন্ত হৈমী যখন রুদ্রর বলা সুরামাসের অর্থ বুঝলো গাল দু’টো লাল হয়ে কানদুটো গরম হয়ে ওঠল তার। বিরবির করে আওড়ালো,
-” পুরাই নষ্ট মাইন্ডেড লোক! আল্লাহ কী বাঁশটাই খেলাম। এই বাঁশ কবে দূর হবে, কবে কবে উফফ। ”

লুডুখেলার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সূচনার ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল বলে সে রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। মাহের, হৈমী, সাদমান, আর সোহান একদান খেলল। এরপর মাহের ওঠে গেল। শুরু হলো সাদমান, হৈমী, সোহান আর রোশানের খেলা। মাহের সূচনার রুমে গিয়ে দেখলো সূচনা শুয়ে আছে। চোখদুটো বন্ধ। কেন জানি মনে হলো সে ঘুমায়নি। তাই বলল,
-” মাথা ব্যথা কমেছে? ”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল সূচনা। জিজ্ঞেস করল,
-” কে জিতল? ”

-” হৈমী। আমার প্রশ্নের উত্তর টা? ”

-” মেডিসিন নিয়েছি কমে যাবে। ”

মাহের কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। সূচনা তার দিকে তাকিয়ে। তার চাহনি দেখে সে বলল,
-” কিছু বলতে চান? ”

সূচনা ওঠে বসলো। গলায় ওড়নাটা আরো শক্ত মতোন জড়িয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে প্রশ্ন করল,
-” আমার প্রতি আপনার কোনো ক্ষোভ রয়েছে? ”

আশ্চর্য হয়ে মাহের বলল,
-” ক্ষোভ তাও আপনার ওপর? ইম্পসিবল এমন মিষ্টি একটা মেয়ে, বন্ধু, বউয়ের ওপর ক্ষোভ রাখা ইম্পসিবল। ”

মাহেরের মুখপানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সূচনা৷ আনমনেই ভাবলো,
-” আমি কি সত্যি আপনার মতো মানুষকে ডিজার্ভ করি? আপনি যে অনন্য আর আমি অতি নগণ্য। ”

মুখে বলল,
-” আমি আপনাকে বঞ্চিত করছি এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই? ”

ভ্রু বাঁকিয়ে মাহের প্রশ্ন করল,
-” ক্লিয়ার করে বলুন। ”

-” আসলে দাদিন আমার আর আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় সত্যি বলে দিয়েছি। বিয়ের পর এসব নিয়ে দাদিরা কথা তুলেই। দাদিনকে আমি মিথ্যা বলতে পারি না৷ তাই সত্যিই বলেছি। সব শুনে সে ভীষণ বকেছে আমায়। বলেছে আমি পাপ করছি। ”

ভীষণ রকম সিরিয়াস মুখো ভঙ্গি নিয়ে সূচনার সামনে বসলো মাহের। বলল,
-” তাই বুঝি? তো কী কী বলেছেন দাদিন? ”

-” বাসর রাতে স্বামীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে পাপ হয়। ”

-” উহুম শুধু বাসর রাতে নয় বিয়ের পর থেকে প্রতিটা রাতেই। ”

মুখ ছোটো করে তাকিয়ে রইল সূচনা। ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে বিছানা থেকে নামতে নামতে মাহের বলল,
-” ম্যাডামের মাথা ব্যথার কারণ তাহলে এটা? ”

ধীরগতিতে সূচনাও নেমে দাঁড়ালো। ট্রাউজারের পকেটে দু-হাত গুঁজে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে এক পা দু পা করে হাঁটতে লাগল মাহের। ঠোঁটে তার জগতের হাসি লেপটে আছে। হাঁটতে হাঁটতে বেলকনিতে চলে গেল সে। ইশারায় সূচনাকেও যেতে বলল। বড়োসড়ো বেলকনিতে বিভিন্ন রঙবেরঙের ফুলগাছ দেখতে পেলো মাহের। বলল,
-” ফুল ভালোবাসেন? ”

সূচনা মাথা নাড়ালো। সে মুচকি হেসে বলল,
-” ফুল ভালোবাসা মেয়েদের মন ফুলের মতোই সুন্দর হয়। এমন একটা ফুলকে দুঃখ দেয়ার দুঃসাহস কোন পাষাণের হলো কে জানে? ”

-” যাকে জন্মদাত্রী দুঃখ দিতে পারে তাকে পুরো দুনিয়ার মানুষ দুঃখ দেয়াও অস্বাভাবিক কিছু না। ”

কিঞ্চিৎ দমে গেল মাহের। বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” পাশে এসে দাঁড়ান । ”

সূচনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পাশ থেকে মাহেরের শেভ করা চোয়ালে দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি চাইলে আপনার অধিকারটুকুর ব্যবহার করতে পারেন। ”

স্পষ্টবক্তায় মাহের,
-” আমি বাজার থেকে কোনো পণ্য কিনে আনিনি যে ব্যবহার করব। আর আপনি আমার পরিহিত টিশার্টও নন। ”

সূচনা মাথা নত করে ফেলল। কয়েক পল সময় নিয়ে মাহের বলল,
-” যখন কোনো পুরুষ পারস্পরিক মিলনের উদ্দেশ্যল তার স্ত্রীকে তার শয্যায় ডাকে, এরপর স্ত্রী যদি স্বামীর আহ্বানে সাড়া না দেয়, আর স্বামী যদি তার এ আচরণে কষ্ট পেয়ে তার প্রতি নারাজ অবস্থায় রাত অতিবাহিত করে, এমতাবস্থায় জান্নাতের বাসিন্দারা তাকে সকাল হওয়া পর্যন্ত লানত দিতে থাকে। (বুখারি) আমি আপনাকে শয্যায় ডাকিনি আই মিন আপনার সঙ্গে ইন্টিমেট হতে চাইনি। সো পাপ, পূণ্যের কথা এখানে আসা বেমানান। ”

সূচনার হৃৎস্পন্দন চঞ্চল হয়ে ওঠল। চোখের পলক ঘনঘন ফেলতে শুরু করল সে৷ মাহের ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। শীতল কণ্ঠে বলল,
-” আমি ভেতরে বাইরে এক মানুষ সূচনা। একজন পুরুষ তার দৈহিক তাড়নার জন্য ভেতরে যদি একটা নারী শরীরকে চায়। আর তার পাশে তার জন্য আপনার মতো একজন বৈধ নারী থাকে তাহলে কিন্তু সে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। ইভেন আমি নিজেও চুপচাপ থাকতে পারতাম না৷ যদি আপনাকে চাইতাম৷ ”

অকপটে প্রশ্ন সূচনার,
-” তারমানে আপনি আমাকে চাইছেন না? ”

-” চাইছি তবে সেটা দৈহিক প্রয়োজন মেটাতে নয়। আপনি এতটা ইমম্যাচিওর নন, একজন পুরুষের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা অবশ্যই আপনার আছে। বিয়ের পর নারী, পুরুষকে শুধু শারীরিক সম্পর্ক করেই কেন স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের সূচনা করতে হবে? চেনা নেই, জানা নেই টুকটাক পরিচয়ে নরনারীর এই রূপ সম্পর্ক অন্তত আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। সম্পর্কের শুরুতে আমি আপনার কাছে বন্ধুত্ব চেয়েছি। হয়তো দুপক্ষের সম্মতিতে, মানসিকভাবে একটি সুন্দর অনুভূতি নিয়ে একদিন আমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে ওঠব। ঐ অনুভূতি যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমার তরফ থেকে কোনো অভিযোগ নেই। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ক্লিয়ারলি? ”

অদৃশ্য মোহে পড়ে মাথা নাড়ালো সূচনা। মৃদু হেসে মাহের বলল,
-” আপনি প্লিজ ভুল বুঝে টেনশন করবেন না। আর হ্যাঁ আপনি যেভাবে সেটিসফাইড থাকবেন আমাকে বলবেন। যদি আপনার মনে হয় আমাদের মাঝে গভীরতা আসা উচিৎ দ্বিধাহীন বলবেন। না বললেও আমি বুঝবো, আপনার চোখের ভাষা কেন জানি বুঝতে সক্ষম হই। ”

লজ্জায় আরক্ত হয়ে বেলকনি থেকে চলে গেল সূচনা। বলে গেল,
-” আপাতত আমি বন্ধু হিসেবেই সেটিসফাইড। ”

মাহের তার পিছন পিছন রুমে গিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে বলল,
-” এই দাদিন আমাদের প্রাইভেসি ভেঙে দিলো। শুনুন, ঘরের কথা পরকে বলবেন না। ”

-” দাদিন তো পর নয়। ”

অধর কামড়ে সূচনার দিকে তাকাল মাহের। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” স্বামী স্ত্রী মধ্যে সে পরই। আমাদের মধ্যে আজ বন্ধুত্ব আছে কাল সে সম্পর্কে প্রণয় আসবে পরশু পরিণয় এসব দাদিনকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে তারা নিজেরাই টের পাবে আমার প্রণয়, পরিণয় সব কমপ্লিট। ”

-” কীভাবে? ”

বিছানায় আলগোছে শরীর ছেড়ে দিলো মাহের৷ দু-হাত মাথার নিচে রেখে সন্তর্পণে চোখ বুঝে বলল,
-” যখন আমাদের বাচ্চারা কান্না করে সবার ঘুমে ডিস্টার্ব করবে তখনি সবাই টের পাবে। এই আমি চোখ বুজেছি আপনি যত লজ্জা পাওয়ার পেয়ে নিন। দেখব না। লজ্জা পাওয়া শেষ হলে গুড গার্ল হয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়ুন। ”

সূচনা হেসে ফেলল। তার মনে হলো ইতিহাসে তারাই প্রথম বন্ধু। যারা কিনা জেনে বসে আছে একদিন তাদের প্রণয় হবে, পরিণয় হবে আবার বাচ্চাও হবে। ইস কী ভয়ানক সুন্দর ব্যাপারটা!
___
দাদিনের সঙ্গে হৈমীর ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। লুডু খেলা শেষ করে হৈমী দাদিনের রুমে যাচ্ছিল। এমন সময় তার ফোনে ম্যাসেজ এলো,
-” অনেক লুডু খেলা হয়েছে ডার্লিং, এবার ছাদে এসো তোমার লম্বা, মোটাসোটা মৌমাছি অপেক্ষায় আছে। ”

ম্যাসজটি দেখামাত্রই আতংকিত হয়ে দাদিনের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো হৈমী৷ দাদিন গভীর ঘুমে তলিয়ে। সে বারকয়েক ঢোক গিয়ে কাঁপা হাতে রিপলাই করল,
-” দাদিনের সামনে কীভাবে যাব। ”

-” পা’য়ে হেঁটে আসবে। ”

-” উনি কী ভাববেন? ”

-” জাস্ট টু মিনিটস এর মধ্যে না এলে নিচে গিয়ে কোলে উঠিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে নিয়ে আসব।”

ম্যাসেজটি দেখে হাত থেকে টুশ করে মোবাইলটা পড়ে গেল৷ তরতর করে ঘামতে লাগলো সে। বুকের ভিতর হৃৎস্পন্দনের বাতিটা যেন ঠুশ করে নিভে গেল। শ্বাসরোধ করেই পা চালালো ছাদের দিকে। পুরো বাড়িতে ঝকঝকে আলো থাকায় মোবাইল ছাড়া যেতে তার একটুও অসুবিধা হলো না। ছাদের দরজা অবধি যেতেই বা দিকের দোলনায় বসে দোলখাওয়া রুদ্র বলল,
-” আ’ম হেয়ার ডার্লিং। ”

কেঁপে ওঠল সে। বাদিক ফিরে ঢোক গিলল ঘনঘন। রুদ্র তর্জনী উঁচিয়ে কাছে যেতে ইশারা করল। হৈমী অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। ফলে মৃদু ধমকে ওঠল সে। ধমক খেয়ে হকচকিয়ে একটু একটু করে এগুতে শুরু করল হৈমী। গলায় ঝুলানো ওড়নাটা দিয়ে বার বার শরীর ঢাকতে লাগলো। একবার একপাশ টানে আবার আরেকপাশ টানে। রুদ্রর তুখোড় দৃষ্টিজোড়া তাকে আপাদমস্তক এমনভাবে দেখছে যে মন চাইছে পুরো শরীরে কম্বল মুড়িয়ে রাখতে। যেন একটু ফাঁকও না থাকে আর ঐ বদ নজরটাও তার ওপর না পড়ে৷

হৈমী যখন রুদ্রর একেবারে কাছাকাছি চলে এলো, রুদ্র হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের ওপর ফেলল তাকে। কিঞ্চিৎ ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করল মেয়েটা। রুদ্র তাকে দু’হাতে আবদ্ধ করে নিতেই বলল,
-” উহ ছাড়ুন একদম ঠিক হচ্ছে না, আহ। ”

রুদ্র বাঁকা হেসে ছেড়ে দিলো। হৈমী উলটে পড়ল ছাদের মেঝেতে। দু-হাত মেঝেতে ভর করে মাথা উঁচু করে ভয়ার্ত চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” উহহ। ”

উচ্চরবে কতক্ষণ হেসে নিয়ে রুদ্র বলল,
-” এই অশ্লীল শব্দগুলো করে কী মিন করতে চাইছো ডার্লিং? ”

রেগেমেগে আগুন হয়ে ওঠে দাঁড়ালো হৈমী। আকস্মিক রুদ্রর গলা চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,
-” আপনি একটা অশ্লীল, অসভ্য বর্বর মানুষ একটা। আপনার সাহস কী করে হয় আমার সঙ্গে এই অসভ্যতা করার? আর ঐ ভিডিয়ো কেন করেছেন আপনি এসব কেন? ”

-” চুমু দাও।”

অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সর্বোচ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করার মাঝে এমন একটি কথা বলায় ভড়কে গেল হৈমী। গলায় চেপে রাখা হাতটি আরেকটু শক্ত করে বলল,
-” খু’ন করে দেবো একদম। ”

-” আর আমি চুমু দেবো। ”

ঘাড় বাঁকিয়ে হৈমীর ঠোঁটে আলতো করে চুমু দিলো রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে গেল হৈমী। ঠোঁটে হাত ঘষতে ঘষতে থুথু ফেলল,
-” ইয়াক থু। ”

চট করে ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র। এক এক করে পা ফেলে হৈমীর দিকে এগিয়ে বলল,
-” আমি বলেছিলাম সাদমানের থেকে দূরে থাকতে রাইট? থাকোনি! এতবড়ো ভুলের শাস্তি না দিয়ে চুমু চেয়েছি খুশি হওয়ার কথা রাইট? তা না করে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছো ডেম ইট! ”

বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে হৈমীর একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরল। উচ্চতায় হৈমী তার গলা সমান তাই তার দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে গিয়ে বলল,
-” চুমু দাও যেমনটা দাদিনকে দিয়েছো তখন। ”

দাদিনকে চুমু দিয়েছে বলে এখন তাকেও চুমু দিতে হবে। সে আর দাদিন কি এক হলো? তাছাড়া দাদিনকে সে গালে চুমু খেয়েছে এই অসভ্য লোকটা ঠোঁট আগাচ্ছে কেন? অস্থির হয়ে সহসা কেঁদে ফেলল হৈমী। বলল,
-” আপনি খুব খারাপ। আমি ভাইয়াকে সবটা বলে দিব। আপনি যতই ভয়ানক হোন না কেন আমার ভাইয়া আপনাকে ভয় পায় না। ”

-” এই মেয়ে চুমু দাও! ”

হৈমীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধমক দিলো রুদ্র। কাঁপতে কাঁপতে মুখ বাড়ালো হৈমী। রুদ্র ঠোঁটজোড়া এগিয়ে দিতেই হৈমী চট করে তার গালে সজোরে একটা কামড় বসালো। এমনভাবে দাঁত বসালো যে দাঁড়িভরা গাল বেয়েও বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়ে এলো। রুদ্র চোখ মুখ কুঁচকে মুখ দিয়ে ‘আহ’ শব্দ বের করল, তার হাত আলগা হয়ে এলে হৈমী ছুটে পালালো ছাদ থেকে। ছুটে চলে যাওয়ার সময় অবশ্য কয়েকটা কথা বলে গেল,
-” কীরে লু’চ্চা এখন তুই অশ্লীল শব্দ করিস ক্যান? হৈমীর চুমু খাবি তাইনা ? হৈমীর? খেলি তো কামড়, দেখ কেমন লাগে! শালা বদমায়েশ! ইতর লোক! ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৯
সারারাত বিছানায় ছটফট করল হৈমী। যে ভয়ানক কাণ্ডটা সে ঘটিয়েছে এর ফল কী হতে পারে, কী হবে ভেবে ভেবেই অস্থির হয়ে ওঠছে। একটু পর পর ওঠে পানি খাওয়ার ফলে এক জগ পানি শেষ। এরপরও গলা শুকিয়ে শুকনো কাঠ। পানির জন্য বাইরে যাওয়ার সাহসটুকুও নেই। মন বলছে বদমায়েশ লোকটা দরজার বাইরে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সে দরজা খুললেই বাঘের মতো থাবা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। এরপর তার শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে জুস টুস করে, পিণ্ডি চটকিয়ে খাবে। ঘনঘন ঢোক গিলল হৈমী। শোয়া থেকে ওঠে বসে রুমের চারপাশে সতর্ক নজর বুলালো। হঠাৎ মনে হলো কেউ আসছে, এই বুঝি দরজা ভেঙে তাকে ওঠিয়ে নিয়ে যাবে! অমনি তড়াক করে চোখমুখ খিঁচে শুয়ে পড়ল সে৷ মনে মনে দোয়া দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দিল। নিশ্বাসে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছেই, কমছে না। বারে বারে কপাল ঘেমে ওঠছে। বুকের ভিতরটায় তোলপাড় হচ্ছে অস্বাভাবিক রকমের৷ এমনই ভাবে ছটফট করতে করতে সারারাত কেটে গেল। ফজরের আজান পড়তেই হুঁশ ফিরল। আবারও ওঠে বসল। রাতটা রক্ষা পেলেও সকালে কি সে রক্ষা পাবে? এই ভাবনা মনে আসা মাত্রই বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠল। চলে গেল দাদিনের বেলকনিতে। উদ্দেশ্য বেলকনি ঝাপিয়ে শেখ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া। সত্যি সত্যি সে যখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। আঁতকে ওঠে ঢোক গিলল কয়েকবার। লাফ দিলে যদি পড়ে মরে যায়? সেও ভালো। সকালে রুদ্রর হাতে পড়ে মরার চেয়ে এখনি মরে যাওয়া ভালো! অমনি আবারও আঁতকে ওঠল বিরবির করে বলল,
-” না না এটা তো আত্মহত্যা হয়ে যাবে! ”

নিজের করুণ পরিণতির কথা ভেবে কান্না পেয়ে গেল খুব। রুমে গিয়ে মোবাইল নিয়ে আবারও বেলকনিতে চলে এলো। ভাবল নয়নকে ফোন করে সব ঘটনা খুলে বলে একটা উপায় ধার নেবে৷ অনেক ভাবাভাবি করে শেষ পর্যন্ত ফোন করল টিশাকে। টিশা তার খালাতো বোন৷ বয়সে তারা মাস দুয়েকের ছোটো বড়ো। তাদের দুজনের স্বভাব এতটা মিলে যায় যে অনেকে ধারণা করে তারা আপন বোনই। কাজিন মহলে তাদের দুজনকে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে, শয়তানের যেমন খালাতো ভাই থাকে তেমনি হৈমীরও খালাতো বোন আছে সে হচ্ছে টিশারানি। যার নিকনেম ম্যাসেন্জার গ্রুপে বাচালকন্যা-১ দেয়া আছে বাচালকন্যা-২ হৈমী নিজে। সেই টিশাকেই ফোন করল হৈমী। টিশা তখন স্বামীর আদুরে বুকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাই কল রিসিভ করল তার স্বামী রউফ। ওপাশে টিশা ভেবেই হৈমী হড়বড় করে বলতে লাগল,
-“বইন তুই কি ঘুমাচ্ছিস? প্লিজ আমাকে বাঁচা আমি ঘোর বিপদে আছি। কী বালের ক্রাশ খাইছিলাম রে জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা হয়ে গেলরে। প্লিজ তুই আমাকে বাঁচারে। বাঁচার জন্য একটা রাস্তা দেরে। আমি ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটিয়েছিরে টিশু, আমি ঐ গুন্ডাটাকে চুমুর বদলে কামড় দিয়ে ফেলেছিরে। এখন আমার কী হবে রে। তুই কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলিরে, দুলাভাইকে কেন আর কয়েকটা দিন রাজি করালি না রে। দুলাভাই কি আর দুইটা দিন তোরে ছাড়া থাকতে পারতো না রে। তোর তো চারমাস চলেরে এখন তোকে দিয়ে তার এত কাজ কী রে?”

ফোনের ওপাশে বিরক্ত না হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রউফ। ননস্টপ মুখ চলে এমন ঘরনিকে নিয়ে ঘর করছে সে। তাই শালিকার ননস্টপ কথাগুলো শুনে বিরক্ত হলো না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” চুমু দিলেই হতো কামড়ানোর কী প্রয়োজন ছিল? তোমরা দু বোন পারোও বটে! ”

লজ্জায় মরি মরি হয়ে ফোন কেটে দিল হৈমী। ছিঃ ছিঃ করে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। অমনি ম্যাসেজ এলো টিশার নাম্বার থেকে,
-” ভয় পেও না শালিসাহেবা মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ও বাড়িতে সব সময় মাহের ভাইয়ার গা ঘেঁষে ঘেঁষে থেকো। টিশা এখন ঘুমাচ্ছে সকালে বলে দিব ফোন দিয়েছিলে। বোঝোই তো শরীরটা তেমন ভালো নেই ওর, ঘুমিয়েছে দেড়টার দিকে তাই এখন জাগাতে চাচ্ছি না। ”

কাঁদো কাঁদো মুখ করে হৈমী রিপলাই দিল,
-” ঠিক আছে দুলাভাই সরি ফর ডিস্টার্ব। ”

-” ইট’স ওকে ডিয়ার শালিকা। “#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৯ ( বর্ধিত অংশ )
রুদ্রর ভয়ে আস্ত একটা রাত নিদ্রাহীন কাটাল হৈমী। অথচ সকাল সকাল রোশান এসে খবর দিল রুদ্রকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না৷ হৈমীকে এ খবর রোশানের মাধ্যমে রুদ্রই পাঠাল। সে সত্যি সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে৷ কারণ এক রাতের ব্যবধানে গালে ক্ষতের চিহ্ন দেখলে সকলের কাছে নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে৷ যার উত্তর তার কাছে আপাতত নেই। দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন অবশ্য এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে ফাঁকি দেয়া যাবে। ব্যান্ডেজের উপরে ক্ষতের পরিমাণটা নিশ্চয়ই কেউ আন্দাজ করতে পারবে না৷ রুদ্র বাড়িতে নেই এ সংবাদ শুনে হৈমী জ্বলে ওঠল৷ ফুঁস করে তার সমস্ত চিন্তা, ভয় দূর হয়ে গেলেও মুহুর্তে আবার রেগেমেগে আপনমনেই বলল,
-” আরে ব্যাটা আগে বলবি তো তুই সকাল সকাল গায়ে হাওয়া লাগাতে বেরিয়ে যাবি। শুধু শুধু সারারাত না ঘুমিয়ে, পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের দফারফা করে ফেললাম। ধ্যাৎ! ”

নিয়ম অনুযায়ী বিকেলবেলা শশুরবাড়ি ফিরে গেল সূচনা৷ রুদ্রর জন্য সন্ধ্যা ছ’টা অবধি অপেক্ষা করার পর রুদ্র না ফিরতেই চলে যেতে বাধ্য হলো৷ শাশুড়ির কড়া আদেশ নতুন বউ রাত করে ফেরা যাবে না৷ রুদ্রও ফোন করে তাকে চলে যেতে বলেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে সে তার শশুর বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবে৷ এ কথা শুনে সূচনা খুশি হলেও হৈমীর মাথায় টোপ করে চিন্তা ঢুকে পড়ল৷ বুকের ভিতর শুরু হলো দুরুদুরু। সারাপথ বার বার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল সে। এই বুঝি রুদ্র একটা থ্রেট মার্কা ম্যাসেজ করবে। এই বুঝি ভিডিয়ো পাঠিয়ে শাসাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সে-সবের কিছুই করল না রুদ্র।

বিয়ের কয়েক দিন পেরিয়ে গেল। ছুটি শেষ মাহেরের। রোজ সকাল ন’টার সময় রেডি হয়ে বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে ভার্সিটিতে চলে যায় সে৷ তৃতীয় বর্ষে ছাত্রী সূচনা। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস থাকে তার৷ যে দু’দিন তার ক্লাস থাকে সে দু’দিন মাহের বাইক করে তাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। অনেক সময় ছুটির পর সকল ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে নয় কি.মি অতিক্রম করে নিতেও যায়। সে যতই বলুক একা আসতে পারবে, একা যেতে পারবে মাহের কানে তুলে না৷ বিয়ের আগে নিজেদের পার্সোনাল গাড়ি করেই চলাফেরা করতো সে। মাহেরের পার্সোনাল চার চাকার গাড়ি নেই। এতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। কারণ তার স্বামীর যে পার্সোনাল মনটা রয়েছে তার অঢেল যত্ন সে পাচ্ছে। জীবনে টাকা, পয়সা, গাড়ি, বাড়ির চেয়েও পাশে একজন মানুষ থাকা কতটা জরুরি বাইশটা বছর তা সে খুব গভীর ভাবেই উপলব্ধি করেছে। বন্ধুত্বের বন্ধনে তাদের জীবনের গতিবিধি স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে…

সকলের জীবন স্বাভাবিক নিয়মে চললেও হৈমীর জীবন বড্ড অস্বাভাবিক চলছে। কারণ তার জীবনে সুনামি বয়ে আনা মানুষটি হুট করেই যেন থেমে গেছে। যে থেমে যাওয়াটাই মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিকঠাক খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না, কলেজ অবধি নিশ্চিন্তে যেতে পারছে না। খেতে বসলে মনে হচ্ছে এই বুঝি বাসায় এসে তার সামনে বসে কয়েকটা হুমকি-ধামকি দেবে। ঘুমালে মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে কামড় দেয়ার অপরাধে ঘুমন্ত অসহায়িনী তার ছোট্ট দেহখানি তুলে আছাড় মারবে। মোবাইলে যে কোনো ম্যাসেজ বা কল এলেই চমকে ওঠছে, হাত পায়ে কাঁপন ধরছে, গলা শুকিয়ে বেহাল দশা। দিনকে দিন জীবনটা যেন দুর্বিষহ হয়ে ওঠল তার। ঠিকঠাক না ঘুমানোর ফলে চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠল। আম্মু, ভাই, ভাবি এসবের কারণ জানতে চাইলে সে কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ ফার্স্ট ইয়ারে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা এরই মধ্যে হয়ে গেল। না পড়াশোনায় ঠিকঠাক মন বসল আর না পরীক্ষায়। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে রুদ্রের কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গকে কলেজের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল সে। তাদের সামনে দিয়েই অটো করে বাসায় ফিরেছে কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারেনি। অবশ্য চেনার কথাও নয়৷ কারণ সেদিনের পর থেকে রুদ্রকে নিয়ে মনের ভিতর ভয়টা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠেছিল যে কলেজ আসার সাহসটুকুও পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মা ভাইয়ের কঠিন বকা খেয়ে বোরখা, হিজাব পড়ে কলেজ এসেছে। এরপর থেকেই বোরখা পড়ে পড়েই কলেজ আসা তার৷ খুব কাছের এবং পরিচিত জন ছাড়া বোরখা পরিহিত এই বাচ্চা মেয়েটিকে কেউই চিনতে পারে না৷

সূচনার বিয়ের একত্রিশ দিনের মাথায় তার বাবা রিদওয়ান শেখ পুনরায় আমেরিকায় চলে গেলেন। বাসায় বসে শেখ বাড়ির খবরাখবর টুকটাক কানে এসেছে হৈমীর। এরপর ঠিক পনেরো দিন পেরোতেই শুনতে পেলো শেখ বাড়ি থেকে সূচনার দাদিন, রুদ্র এবং তার ছোটো চাচা আসছে তাদের বাসায়। এ কথা জানার পরই আত্মা হাতের মুঠো করে নিয়ে টিশাকে ফোন দিল সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্ল্যান করে হামিদা বেগমকে জানালো টিশা ভীষণ অসুস্থ। সাড়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা টিশা৷ আজকাল সত্যি সত্যি শরীর খুব একটা ভালো যায় না তার। বাবা, মা, শশুর, শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই। খালামুনি হিসেবে তার প্রতি কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারেননি হামিদা। কিন্তু বুকের ভিতর মেয়েটার জন্য খুব পুড়ে। তাই তো ছোটো বোনের মেয়েটার অসুস্থতার কথা শুনে নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দিল তার দেখাশোনা করার জন্য। শেখ বাড়ি থেকে লোকজন আসার পূর্বেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে হৈমী চলে গেল টিশার বাসায়।

দুপুর তিনটার দিকে রুদ্র, দাদিন, এবং ছোটো চাচা রিজওয়ান শেখ এলেন। বিয়ের পর এ প্রথম বাপের বাড়ির লোক এভাবে আসাতে সূচনা ভীষণ খুশি হলো। আদর, আপ্যায়নে কোনো প্রকার ত্রুটি রাখল না। কিন্তু দাদিনের মুখ ভার হলো হৈমী বাসায় নেই এ কথা শুনে। রুদ্রর মেজাজও কম বিগড়ে গেল না! সে কেবল দাদিনের চোখের ইশারায় দমে রইলমাত্র। খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেড়ে কথায় কথায় দাদিন মাহেরের মা হামিদাকে জানালেন, তাদের মনের কথা। বললেন,
-” আত্মীয়ে আত্নীয়ে এবার পরম আত্মীয় হতে চাই মা৷ তুমি যেমন তোমার সংসারে আমাদের ঘরের মেয়ে নিয়ে এসেছো, আমরাও তেমন আমাদের সংসারেও তোমার মেয়েকে নিতে চাই৷ ”

মুরুব্বির মুখে এমন একটি বাক্য শুনতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহের৷ তার এই দাঁড়ানো দেখে সূচনা থতমত খেয়ে গেল। প্রথমে দাদিনের কথায় বিস্ময় এবং স্বামীর আকস্মাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ায় থতমত খেল। চাপা স্বরে বলল,
-” দাদিন কী বলছো এসব তুমি? ”

শান্ত রইলেন হামিদা। ছেলেকেও ইশারায় শান্ত হতে বললেন। মায়ের আদেশে মাহের শান্ত হয়ে বসল। অত্যন্ত মার্জিত শব্দে বলল,
-” এসব কী বলছেন দাদিন? বোন আমার অনেক ছোটো তাছাড়া আমি এসব ভাবতে পারি না।”

দাদিন করুণ চোখে সূচনার দিকে তাকাল। সে তো কম বোঝানোর চেষ্টা করেনি নাতিকে। সূচনার সংসারে অশান্তি হবার ভয়ে এতদিন চুপই ছিল। কিন্তু রিদওয়ান শেখ চলে যাবার আগে মাকে অনুরোধ করে গেছেন। যেন যে করেই হোক রুদ্রর এই চাওয়াটা পূর্ণ করা হয়৷ এক বছরের মাথায় দেশে এসে যেন ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতে পারে৷ জীবনে প্রথমবার রুদ্র তার বাবার কাছে একটি জিনিস চেয়েছে। যে সে জিনিস নয় আস্ত একটা মানুষকে চেয়েছে। বাবা তাকে আশ্বাস দিয়েছেন। কাজের প্রয়োজনে দ্রুত ফিরে যেতে হচ্ছে কিন্তু সে আবার আসবে। ভাই, মা দিয়ে কাজ না হলে নিজে সশরীরে মেয়ে জামাই, বেয়ানের কাছে হাত পাতবে। ছেলের করা প্রথম আবদার বলে কথা! বাবা হিসেবে ছেলেমেয়ে দুটোকে জীবনে কিছুই দিতে পারেনি। দূর দেশে থেকে খবরাখবর নেয়া, অঢেল অর্থ ছাড়া কিছুই করতে পারেনি ওদের জন্য৷ মেয়েটা তো জীবনে কিছুই চাইল না, ছেলেটা মুখ ফুটে চেয়েছে এই তো ভাগ্য। যদিও সে জানে রুদ্রর মতো ছেলে চেয়ে নেবার অপেক্ষা রাখে না৷ শুধুমাত্র বোনের সংসারের প্রতি খেয়াল রেখেই এইটুকুন সভ্যতা দেখিয়েছে।

পরিস্থিতি ভীষণ এলোমেলো হয়ে গেল। কারো মুখ বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ়, কারো চোখে অসহায়তা, বা কারো তীব্র ক্রোধ মিলেমিশে খান মঞ্জিল অর্থাৎ মাহেরের একতলা বাড়ির পুরো পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠল৷ হামিদা পাংশু মুখে ছেলের পানে তাকিয়ে রইলেন। মাহের রিজওয়ান শেখকে হাতজোড় করে বললেন,
-” বেয়াদবি মাফ করবেন, এই প্রস্তাবে আমি সম্মতি দিতে পারছি না৷ ”

অবিশ্বাস্য চোখে সূচনা রুদ্রর রাশভারী মুখটায় তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। মুখ লুকিয়ে চলে গেল বেডরুমে। এক পর্যায়ে থমথমে মুখে বিদায় নিলেন শেখ বাড়ির প্রতিটি সদস্য। যাওয়ার আগে দাদিন হামিদাকে বলে গেলেন,
-” সূচনা এসবের কিছুই জানতো না। রুদ্র আপনার মেয়েকে ভীষণ পছন্দ করেছে বলেই বাধ্য হয়ে এসেছিলাম। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর ইশারায় হয়। এখানে আমার আপনার হাত নেই৷ আসি। ”

থেকে যাওয়ার জন্য তেমন জোর করতে পারলেন না হামিদা। শরীর, মস্তিষ্ক কেমন যেন অবশ হয়ে এলো তার। এরপর থেকে মাহের, সূচনার মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্কটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠল৷ এই অস্বাভাবিকতা আনলো সূচনা নিজেই। কেন জানি মাহেরের সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত লাগতে শুরু হলো। প্রয়োজন ছাড়া একটি শব্দও সে উচ্চারণ করে না৷ শাশুড়ির সঙ্গেও মেলামেশা কমিয়ে দিল। চারপাশের সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগতে শুরু হলো।

হাজার হোক রুদ্র সূচনার ভাই। তার ভাই সবার চোখে যেমনই হোক তার চোখে সেরা। কারণ যে বসয়ে একটা ছেলের বাবা, মাকে খুব প্রয়োজন পড়ে সে বয়সটায় সে বোনের দায়িত্ব নিয়ে একা একা বেড়ে ওঠেছে। সূচনা মেয়ে বলে হয়তো তার জীবনটা সঠিক পথে এগিয়েছে। ছেলে হওয়ার দরুণ বাইরে চলাফেরা করে সঙ্গ দোষে রুদ্র আজ গুন্ডা, মস্তান হয়ে ওঠেছে৷ তার এই গুন্ডা ভাইটা, নারী বিদ্বেষী ভাইটা যে হৈমীর মতো ছটফটে বাচাল মেয়েটাকে পছন্দ করতে পারে ভাবতেই পারেনি। কষ্টটা এখানেই বেশি লাগছে তার। মাহেরের প্রতি উচিৎ নয় এমন একটি অভিমান বুকে চেপে রয়েছে। স্বার্থপরতা হয়ে যাচ্ছে তবুও অভিমানটুকু সরাতে পারছে না। তার ভাইটা কি খুব খারাপ? তার কি অধিকার নেই পছন্দের মানুষটাকে পাওয়ার?
___
বাড়িতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই জানানো হয়নি হৈমীকে। বোনের বাসায় সে বিন্দাস দিন কাটাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন নয়নের কল পেয়ে ঘুরতে বের হয় হৈমী। তাড়াহুড়ায় বোরখা পরতে মনে ছিল না। যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই ফুচকা খেতে বেরিয়ে পড়ে সে। দুই বান্ধবী ফুচকা খেয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এমন সময় রুদ্রর গাড়ি এসে থামল তাদের পাশে। চমকে ওঠে দুকদম সরে গেল হৈমী, নয়ন৷ গাড়ির ডোর খুলে রুদ্র বেরিয়ে এলো। চোখে অদ্ভুত নেশা, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। দুই বান্ধবী ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে অপলক তাকিয়ে রইল। যেন কোনো সিনেমার ভিলেন এসে দারুণ এটিটিউড নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালো। হৈমীর অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠল যখন সেদিন রাতের ঘটনা টুশ করে মনে পড়ল! জোর পূর্বক মুখে হাসি টেনে নয়নের হাত চেপে ধরল সে৷ ফিসফিস করে বলল,
-” দোস্ত বিপদে পড়লে কোন দোয়া পড়তে হয় জানি? আমার সব গুলিয়ে গেছে মনে করাই দে। ”

-” আরে বান্ধবী আমিও ভুলে গেছি কী জানি! ”

-” শা’লি, হা”রামি যাহ। ”

-” হৈমী গাড়িতে ওঠে বসো। ”

সাদা রঙের প্রাইভেট কারের পেছনের ডোর খুলে আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল রুদ্র। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল হাতটি তার দিকে ইশারা করা। ঘাড় ভর্তি চুলগুলোর জন্য মুখ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। তবে কন্ঠস্বর শুনে যতটুকু বোঝা গেল দ্যা গ্রেট গুন্ডাসাহেব খুব একটা রেগে নেই। তাহলে কি সেই রাতের কামড়ের কথা ভুলে গেছে? গাছের সাথে মাথায় ঠুশ করে আঘাত পেয়ে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই খুশিতে গদগদ হয়ে হৈমী বলল,
-” ভাগ্যিস সব ভুলে গেছেন। একটা কামড়ের ঝাঁজ এত বেশি আগে জানতাম না। আমার কতগুলো দিন হারাম হয়েছে এটার জন্য জানেন? তা বেয়াইমশায় আমাদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেন নাকি? শুনুন আমি এখন আমাদের বাড়িতে থাকি না। আপনি আমাদের বাড়ি যাবেন শুনেই আমি পালিয়েছি বুঝেছেন। ”

হৈমীর কথা শুনপ নয়ন তার পেটে গুঁতো দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” কী বলছিস এসব? গাড়ির নিচে পড়ে ভর্তা হবার শখ হইছে তোর? পেটের ভিতর একটা কথাও চেপে রাখতে পারিস না। এই কথার জন্য কী বিপদে পড়বি আইডিয়া আছে তোর শালা পাগলা জানি কোথাকার! ”

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাতের চার আঙুলে ঠোঁট চেপে ধরল হৈমী৷ কাঁদো কাঁদো মুখে নয়নের দিকে তাকাল। রুদ্র খুব বেশি অপেক্ষা করতে নারাজ তাই ধমক দিল,
-” গাড়িতে ওঠো। ”

নয়নকে কঠিন স্বরে বলল,
-” এই মেয়ে বাসায় যাও। যাও এখান থেকে যাও। ”

ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে ব্যস্ত পায়ে চলে হে
গেল নয়ন৷ হৈমীও তার পিছু ধরতে চাইল কিন্তু তার পূর্বেই রুদ্র তার হাত চেপে ধরল। হৈমী বলল,
-” আমি কিন্তু চিল্লাব। ”

-” চিল্লালেই সর্বসম্মুখে চুমু খাব। তারপর সেটা ভিডিয়ো করে পাবলিক গ্রুপে ছেড়ে দিব। এ শহর যেমন তোমার আমার নষ্টালজিক সিন দেখবে তেমনি ফেসবুক শহরকেও দেখাব! ”

মুখ কাচুমাচু করে গাড়ির পেছন সিটে গিয়ে বসল হৈমী৷ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল রুদ্র। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করল মেইন শহরের রাস্তায়। হৈমী জিজ্ঞেস করল,
-” কোথায় যাচ্ছেন আমাকে নিয়ে? ”

-” কাজি অফিসে! ”

-” কীহ! কেন কার বিয়ে? ”

-” আমাদের বিয়ে। ”

-” কী বলছেন। আমার বিয়ে? আপনার সাথে? ওহ আল্লাহ গো এ আমি কী শুনি শেষ পর্যন্ত কিনা একটা গুন্ডা, সন্ত্রাস আমার জামাই হবে। হে আল্লাহ তুমি আমারে ওঠাই নেও। ”

ঠোঁটে কুটিল হাসি ঝুলিয়ে ড্রাইভ করতে লাগল রুদ্র।
হৈমীর মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বইতে লাগল। কাঁপা গলায় বলল,
-” আপনি এমন করবেন না, প্লিজ আপনার দুটো পায়ে পড়ি। ”

রুদ্র যেন শুনেও শুনল না৷ সে তার সিদ্ধান্তে স্থির। হৈমী যখন বুঝল রুদ্র সত্যি সত্যি আজ ভয়ানক কাণ্ড ঘটাবে তখন নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারল না৷ তার উপস্থিত বুদ্ধি তাকে বাধ্য করল নিঃশব্দে গাড়ির ডোর খুলে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মস্তিষ্ক এবং মনের প্ররোচনায় এক গুন্ডার হাত থেকে বাঁচতে রুদ্র কল্পনাও করতে পারবেনা এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল সে। গাড়ির ডোর খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তৎক্ষনাৎ। আকস্মিক হৈমীর এমন কাণ্ড দেখে ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠল রুদ্রর। স্টেয়ারিং থেকে আপনাআপনিই দুহাত সরে গেল তার। নিমিষেই ঘটে গেল ভয়ানক একটি এক্সিডেন্ট!

গাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ার পর হাত, কপাল ছিলে রক্ত বেরিয়ে ডান পা মচকে গেছে হৈমীর। সন্ধ্যার আবছা আলোতে রাস্তার আশপাশে চলাচল করা কিছু মানুষ ছুটে এসে তাকে ধরেছিল। ঠিক তার এক মিনিটের ব্যবধানে ভয়াবহ এক্সিডেন্টটি ঘটল। দূর থেকে সাদা রঙের গাড়িটার রাস্তার পাশের কড়ুই গাছের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগা স্পষ্টচোখে অবলোকন করে নিজের দেহের ব্যথা, বেদনা ভুলে গিয়ে জ্ঞান হারালো হৈমী। জ্ঞান হারানোর পূর্বে মস্তিষ্ক জানান দিল, শেষ সব শেষ রে হৈমী !

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here