#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
#শেষ_পর্ব
সিয়ামের রাতটা কাটলো অসহনীয় যন্ত্রণায়। মিলি রুমে নেই, অথচ মনে হচ্ছে সে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। রুমের প্রতিটি আসবাবে মিলির ছোয়া, ঘ্রাণ। একসময় সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো। বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিল, বাতাস ঠান্ডা। পাতলা শার্টটায় শীতে জমে যাবার উপক্রম, সে আবার ঘরে ফিরলো।
সৌরভ রুমে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে ভাইয়ের কার্যকালাপ লক্ষ্য করছিলো।
নীরা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসেছে, সৌরভকে মিটিমিটি হাসতে দেখে বলল,
“আগে জানতাম তুমি আধা পাগল, এখন দেখছি মাথা পুরোপুরি গেছে! ”
সৌরভ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
“বলো কী?”
“যা দেখছি তাই, হাসছো কেনো একা একা?”
সৌরভ লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে এলো। তার কন্ঠে উত্তেজনা ঠিকরে পরছে।
“ভাইকে দেখছো নীরা!”
নীরা চাপা ধমকে উঠলো।
“ভাইকে শুধু দেখেই যাবা, ওরকম হতে আর পারবা না। বোনকে কী ভালবাসে সে দেখেছো? কখনও পারবা ওমন?”
সৌরভ চুপসানো মুখে পাশ ঘেঁসে বসলো। নীরার খুব মুড সুইং হয় ইদানীং। অল্প কথাতেই কেমন রেগে যায়! এখন যদি সৌরভ নীরার কথার উত্তর দিতে যায় তাহলে নির্ঘাত লঙ্কাকান্ড বাঁধবে।
সে মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তুমিই ঠিক নীরা, তুমি যা বলো সেটাই ঠিক। আমি কখনও সঠিক কথা বলিই না, আমিতো ভীতু, বউকে পর্যন্ত ভয় পাই।”
শেষের কথাটা সে একটু আস্তেই বলল, নীরা তবু শুনে ফেললো। কড়া চোখে তাকাতেই সৌরভ পড়িমরি করে ওয়াশরুমে ছুটলো।
…
সকালে নাস্তার সময় সিয়ামকে দেখে রেনু বেগম আতকে উঠলেন,
“তুই এখানে কেনো?”
সিয়াম পরোটা মুখে পুরতে পুরতে বলল,
“এখানে ছাড়া কোথায় বসবো? মেঝেতে?”
“না না, মানে এ বাড়িতে কেনো?”
সিয়াম কপাল কুঁচকে তাকালো,
“তুমি কী আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছো?”
রেনু বেগম কপাল চাপড়ালেন। তার ছেলেটা একটু বেশি বোঝে নাকি উল্টো বোঝে।
সৌরভ ততক্ষণে আবার মিটমিট করে হাসি শুরু করে দিয়েছে।
নীরা পাশ থেকে গুতো মারতেই সে চুপ হয়ে গেলো।
নীরা বলল,
“মা সেকথা বলেনি ভাই, বলতে চেয়েছে যে আপনি মিলির খোঁজে গেলেন না?”
“কোথায়, তোমাদের বাড়ি?”
নীরা সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো।
সিয়াম বলল,
“সেখানে গিয়ে আমি কী করবো? মিলি বেড়াতে গেছে বেড়িয়ে আসুক।”
রেনু বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“সে আর কখনও আসবে না বলেছে।”
সিয়াম খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়ালো। বলল,
“আচ্ছা। ”
…
অফিসে পৌঁছানোর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে খবর এলো নীরার লেবার পেইন উঠেছে। সিয়াম তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে গেলো।
সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি করতে হবে। সে কথা শোনার পর থেকেই সৌরভ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। রেনু বেগম একা তাকে সামলাতে পারছেন না।
সিয়াম গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
“কান্নাকাটি করলে তোকে হনুমানের মত দেখায় সৌরভ, নিজের ছেলে মেয়ের সামনে এই রূপ প্রদর্শন করিস না, ভয় পাবে।”
রেনু বেগম হেসে ফেললেন।সৌরভ ও হাসলো।
মিলি যখন হাসপাতালে এলো তখন রাত হয়ে গেছে। আতাউর রহমান ছুটে নীরার কেবিনে ঢুকলেন। তার ছোট্ট পুতুলগুলো আজ কত বড় হয়ে গেছে। এক পুতুলের কোলজুড়ে আরেকটা পুতুল খেলা করছে।
মিলি পাশে বসে বলল,
“মেয়েটা তোর মত হয়নি রে আপা, একদম সৌরভ ভাইয়ের মতো হয়েছে দেখ।”
নীরা বলল,
“তোর মেয়েটাও সিয়াম ভাইয়ের মত দেখতে হবে।”
মিলি প্রতিবাদ করে উঠলো,
একদম ঐ বদ লোকের কথা মুখে আনবি না আপা, শয়তান লোকটার উপর আমি রেগে আছি জানিস না?”
“এদিকে সেও যে উল্টো রাগ করে আছে, সে কথা জানিস?”
“তার রাগ আমি ছুটাবো তো.. কত বড় সাহস, আমি ঐ বাড়ি থাকলেও তার কিচ্ছু যায় আসে না? দিব্যি খেয়ে দেয়ে অফিসে গিয়েছিলো, এদিকে আমি বিরহে শেষ।”
..
সে রাতে সিয়ামের আর দেখা মিললো না। সারাদিন সে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। রেনু বেগম এক প্রকার জোর করেই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আগের রাতটাও তো তার নির্ঘুম কেটেছে।
সকাল সকাল হাসপাতালে পৌছুতে মিলির দেখা মিললো। সিয়াম পাশ কাটিয়ে নতুন সদস্যটিকে পুনরায়,দেখতে কেবিনে ঢুকলো।
মিলি ভেবেছিল সিয়াম তার সাথে কথা বলতে এলেও সে কথা বলবে না, মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবে৷ খুব জোর যখন করবে, বার কয়েক স্যরি বলবে তখন মিলি তাকে ক্ষমা করবে। কিন্তু সিয়ামের উল্টো এড়িয়ে যাওয়া দেখে সে অবাক হয়ে বসে থাকলো।
মিনিটখানেক পরে সিয়াম বাইরে এলো। বসলো মিলির পাশে, তবে খানিকটা দুরত্ব নিয়ে।
মিলি বলল,
“আমি আপনার উপর রেগে আছি।”
সিয়ামও পালটা জবাব দিলো,
“আমিও রেগে আছি?”
“কেনো?”
“এত বড় একটা ব্যপার তুমি আমার থেকে লুকালে কিভাবে? পারলে?”
মিলি এবারে খানিকটা লজ্জা পেলো।বলল,
“বলবো বলেই তো সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছিলাম, বাড়িতে বেলুন, কেক এনে একাকার। অথচ তুমিই তো এলে না। আমার কতটা খারাপ লেগেছিল জানো? এমনি সময় তো আমায় না পেলে সাথে সাথে চলে যেতে, এবার গেলে না কেনো?”
“রেগে ছিলাম তো।”
মিলি মিষ্টি হাসলো।
“আচ্ছা? তবে জানলে কিভাবে?”
“টেবিলের ওপর প্রেগনেন্সি রিপোর্টের কাগজগুলো ফেলেই চলে গিয়েছিলে যে, সেখান থেকেই জানলাম। বাড়ির লোকগুলো তো আর বলবে না। শিখিয়ে দিয়ে গেছিলে?”
মিলি জোরে মাথা নাড়লো। সিয়ামের আরেকটু পাশ ঘেঁষে এগিয়ে বলল,
“তুমিও রাগ করে আছো, আমিও রেগে আছি।তবে আসো রাগে রাগে কাটাকাটি করি।”
সিয়াম বাধ সাধলো,
“উহু আমি অন্য আরেক কারণেও রাগ করেছি!”
মিলি মৃদু চিৎকার করলো,
“আরও?”
“তুমি আরিয়ার সাথে আমায় দেখেও আমায় কিছু জিজ্ঞেস করো নি কেনো? সামনে কেনো যাওনি? আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমায় অবিশ্বাস করে তুমি চলে গেছো। পরে যদিও রিপোর্ট কার্ডটা পেয়ে ধারণা বদলেছে।”
“কি বলো, সামনে যাবো কিভাবে! কী পরিমাণ রেগে ছিলে তুমি, চোখ দুটো থেকে মনে হচ্ছিলো আগুন বের হচ্ছে। আমি শপিং সেরে হাসপাতাল থেকে একেবারে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম কিন্তু বান্ধুবিটাই জোর করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো।”
একটু চুপ থেকে আবার বলল,
“আরিয়ার সাহস আছে বলতে হয়, যে ভাবে ধমকাচ্ছিলে! আমি হলে নির্ঘাত হার্ট ফেল করতাম।”
“তোমার হিংসা হয়নি?”
মিলি হেসে ফেললো,
“সে আবার বলতে! মনে হচ্ছিল মেয়েটার চুল টেনে ছিড়ে ফেলি। ”
এ পর্যায়ে সিয়াম নিজেও হেসে ফেললো। বলল,
“অবিশ্বাস করবে না তো কখনও?”
তার আকুল কন্ঠ শুনে মিলির ভেতরটা কেঁপে উঠলো।
সে সিয়ামের কাঁধে আলতো করে মাথা রাখলো। বলল,
“কোনোদিন ও না।”
সমাপ্ত