মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব -৪৫+৪৬+৪৭

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৫
রুটব্রিজটা দেখতে এতো মোহনীয় ছিলো যে সবাই বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো।ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীটাও সবার দৃষ্টি কেরে নিয়েছিলো।রুটব্রিজ দেখা শেষ করে ওরা আবার ফিরে আসে।সবারই অবস্থা বেহাল।নামার সময় না যেতোটা কষ্ট হয়েছিলো। তার থেকে বেশি এখন হয়েছে।সবার পা গুলো প্রায় অবশ।ওরা আধাঘন্টার মতো বিশ্রাম করে নিলো।সবার বিশ্রাম নেওয়ার পালা শেষ হলে।রুদ্রিক সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,’ এখন কি তোরা সবাই আবার ঘুরতে যাবি?না-কি বিশ্রাম নিবি?’

অথৈ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’ না না ঘুরবো।আমরা এখন ঠিক আছি।কি বলো সবাই?আমি ঠিক বলছি না?’

রুদ্রিক অথৈয়ের উচ্ছ্বাস মৃদ্যু হাসলো।মেয়েটা যে ঘুরাঘুরি বেশ পছন্দ করে তা আর বলতে নেই।সাফাত পকেটে দু হাত গুজে দাঁড়িয়ে ছিলো।সে শান্ত কণ্ঠে বলে,’ আমরা এখন ওয়ারী ছড়া যাবো।তাহলে এখন সবাই গাড়িতে উঠে বসো।তাড়াতাড়ি রওনা হই।’

সবাই সাফাতের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল।তারপর গাড়ি চলল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।এদিকে ওদের যাওয়ার পথের দিকে চারজোড়া চোখ হিংস্রভাবে তাকিয়ে আছে।তার মধ্যে থেকে একজন রাগি গলায় বলে উঠল,’ ভাই?তোমার হয়েছিলোটা কি?তুমি এমন একটা মোক্ষম সুযোগ কিভাবে হাতছাড়া করে দিলে?’

অপর ব্যক্তিটি বিরক্ত চোখে তাকালো।বলল,’ তুই এতো অধৈর্য কেন জেনি?একটা কাজ কি মুখে বললেই হয়ে যায়?’

জেনি অধৈর্য কণ্ঠে বলে,’ আমি জানি না রিয়ান ভাই।যেভাবেই হোক ওই অথৈকে পথ থেকে সরিয়ে দেও।আমি জানি না।আমার জাস্ট রুদ্রিককে লাগবেই।’

রিয়ান বোনের কথায় বাঁকা হাসলো।তীর্জক স্বরে বলে,’ আর আমি যদি অথৈকে না মেরে।রুদ্রিককে মেরি ফেলি?’

জেনি যেন আকাশ থেকে পরলো।রিয়ানের কাছ থেকে এমন একটা কথা সে শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না।জেনি আশ্চর্য হয়ে বলে,’ কিসব বলছ ভাই?তুমি রুদ্রিককে কেনো মারবে ভাই?তুমি তো জানো আমি রুদ্রিককে কতো ভালোবাসি।তুমি ওই অথৈকে যেভাবেই হোক শেষ করে দেও।আর তুমি তখন সিড়ি থেকে ওকে ধাক্কা দিলে না কেন?ওখান থেকে পরলে আর বাঁচার চান্স ছিলো না।’

রিয়ান রাগি চোখে বোনের দিকে তাকালো।ধারালো গলায় বলে,’ তোর মাথাটা পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে বুঝেছিস?আর কিসের ভালোবাসার কথা বলছিস?এটা জাস্ট তোর সাময়িক মোহ।রুদ্রিককে টপকে দিলেই সেই মোহও কেটে যাবে।’

‘ ভাই নাহ।’
‘ জাস্ট সাট আপ জেনি। চুপচাপ কটেজে ফিরে যা।আমার যা মন চায় আমি তাই করবো।আর একটা কথাও তোর মুখ থেকে আমি শুনতে চাই নাহ।’ এটা বলেই রিয়ান চলে গেলো।আর জেনি বিরবির করল,’ তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না ভাই।আমারই যা করার করা লাগবে।আমি রুদ্রিককে যেকোনো মূল্যে আমার করেই ছাড়বো।’
————–
ওয়ারী ছড়া মেঘালয় রাজ্যের দক্ষিণ গারো পাহাড়ে পারমেগ্রে নামক একটি ছোট গ্রামে অবস্থিত একটি রিভার ক্যানিয়ন যা তুরা শহর থেকে ৮৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওয়ারী ছড়া শব্দের ওয়ারি মানে গভীর নদী। এই জায়গাটি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে তবে এটি ইতিমধ্যে একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এই ওয়ারী ছড়া প্রায় ৪৫ ফুট গভীর এবং ১ কিমি দীর্ঘ ট্রেইল। এটি বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে।

ওয়ারি নদীতে ক্যাসকেডিং ছাড়াও রয়েছে রে-নাং এবং চিবোক ডেয়ার নামে দুটি প্রধান জলপ্রপাত রয়েছে। এই দুই জলপ্রপাতে পৌঁছাতে চাইলে হাইকিং করে পৌঁছাতে হবে। তাই আপনি যদি একটি মুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে ইচ্ছুক হন তবে এটির জন্য যান। কারন এই জলপ্রপাতগুলিতে পৌঁছানোর পথটি খুব কঠিন। ঝর্ণাগুলি চমৎকার স্বচ্ছ পানির জলপ্রপাত যা আপনার চোখে আরামের অনুভূতি দিবে এবং মনের প্রশান্তির জন্য ভালো কাজে দিবে। এই দুই জলপ্রপাত ছাড়াও অগ্নিমা ওয়ারী মৎস্য অভয়ারণ্য নামে একটি মৎস্য অভয়ারণ্যও রয়েছে, তবে এটিতে যাওয়ার পথটিও কঠিন।
এখানকার আশপাশের এলাকা ঘন বন ও পাহাড়ে ঘেরা। তাই ওয়ারী ছড়া পরিদর্শনের সর্বোত্তম সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং খুব একটা বৃষ্টিপাত হয় না। বৃষ্টি এখানকার ভ্রমণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অন্যথায় আপনি স্বচ্ছ নীলাভ জল দেখতে পারবেন না।যদিও ওয়ারী ছড়া একটি নতুন আবিষ্কৃত পর্যটন গন্তব্য তবুও এরই মধ্যে এখানে অনেক এক্টিভিটি করার মতো সুবিধা গড়ে উঠেছে। পর্যটন অবকাঠামো ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে, কিন্তু স্থানীয়রা আপনার ভ্রমণকে যতটা সম্ভব স্মরণীয় করে তুলছে।এই শান্ত নদীতে রিভার র‍্যাফটিং আপনার অভিজ্ঞতার সেরা জিনিসগুলির মধ্যে একটি। নদীর পানি আসলে নীল। যদিও সেখানে বিভিন্ন গুহা রয়েছে, তাই এটি একটু কঠিন হতে পারে। তাদের বোটিং সুবিধাও বিকল্প হিসেবে রয়েছে তবে বেশিরভাগ মানুষ রিভার রাফটিংটাই পছন্দ করেন। এখানকার জলের শব্দ, জলপ্রপাত, সবুজ বনভূমি এবং পরম নিস্তব্ধতা এটিকে ভ্রমণের জন্য একটি আদর্শ গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলেছে।

পারমেগ্রে গ্রামে পৌছাতেই ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পরলো।গাড়ি আর সামনে যাবে না।এইবার হেটেই যেতে হবে।সবাই যার যার ব্যাগপত্র নিয়ে হাটা শুরু করে দিলো।আরহা সামনে এগোতে এগোতে বলে,’ এই পাহাড়ে এলে এই সমস্যা।শুধু পাহাড় বেয়ে বেয়ে নিচে নামো।নয়তো উপরে উঠো।’

আরহার কথায় সাফাত তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,’ তো এতো সমস্যা হলে এসেছো কেন?যারা হাইকিং করতে পারে না।তাদের না আসাটাই বেটার।’

আরহা একটুও ক্ষেপলো না।শান্ত কণ্ঠে বলে,’ হাইকিং করতে পারি না।কিন্তু তাই বলে কি পৃথিবী ঘুরে দেখবো নাহ?’

সাফাত চোখ উল্টিয়ে ফেলল।এই মেয়ের সাথে অহেতুক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।ওরা সবাই ওয়ারী ছড়া যাওয়ার জন্যে হাটতে লাগল।আরও অনেক অনেক পর্যটক দেখা যাচ্ছে।তারাও ওয়ারী ছড়া যাবে।ভীষণ দূর্গম পথ।পাহাড় গা ঘেষে ঘেষে নামতে হয়।সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে একজন একজন করে পাহাড়ের রাস্তায় মই দেওয়া সেগুলো পার হতে।কারন পাহাড়ের গা কেটে যে সিড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিলো। সেগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।তাই সেখানে বাঁশের তৈরি মই দিয়ে রাখা।সবাই বেশ কষ্টে নিচে নেমে আসল।কাঙ্ক্ষিত স্থানটায় আসতেই সবার চোখ জুড়িয়ে গেলো।এইযে কষ্ট করে কতোটা পথ পারি দিয়ে এখানে এসেছে।তা যেন একমুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো।প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে।বিশাল বড়ো বড়ো পাহাড়।সেই পাহাড়ের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে এলোমেলোভাবে বয়ে চলেছে ওয়ারি নদী।অথৈ যেন এই সৌন্দর্য্যের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।সবুজ ঘণ অরণ্য তার মাধ্যে বয়ে চলা নদীর জল নীল রঙের।সবাই নদীতে নেমে পরল।হাটু সমান পানি রয়েছে।ওখানে গিয়ে সবাই আনন্দে মেতে উঠল।অথৈ রুদ্রিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।ওর কাছে আসল।এসেই হাসি হাসি মুখে বলে,’ আপনি আসছেন না কেন?’
রুদ্রিক অথৈয়ের হালকা ভিজে যাওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো।বলল,’ ওখানে যদি যাই।তাহলে তো তোমাকে সেইভাবে দেখতে পারবো না।’

অথৈ রুদ্রিকের কথাটার মানে পুরোপুরি বুঝতে পারলো না।তাই বলে,’ মানে?সেইভাবে মানে কপি ভাবে দেখতে পারবেন না?’

রুদ্রিক ঝুকে আসল অথৈয়ের কাছে।ওর গরম নিশ্বাসগুলো অথৈয়ের কানে এসে বারি খাচ্ছে।অথৈ চোখ বন্ধ করে নিলো।পর পর শুনতে পেলো রুদ্রিকের ফিসফিসানো কণ্ঠস্বর,’ তুমি পানির মধ্যে নেমে উল্লাস করছে।দুহাতে পানি নিয়ে দূরে ছুড়ে মারছ।হিমেল হাওয়া এসে ক্ষণে ক্ষণে তোমার গা ছুঁয়ে গেলে।তুমি আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলো।পর পর তোমার ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসির রেখা দেখা যায়।তোমার এলোমেলো কেশগুলো আরও এলোমেলো হয়ে যায়।এইযে হালকা ভিজে যাওয়া কাপড়চোপড় তোমার।সব মিলিয়ে আমি তোমাকে আমি ঠিক কি বলে তোমার প্রসংশা করবো তা ভেবে পাই না।কিন্তু তোমাকে এই রূপে দেখে আমার হৃদপিন্ডটা যে আমার আয়ত্তে থাকে না।জোড়ালো শব্দ তুলে বাঁজতে থাকে।মনটা চরমভাবে বেহায়া হয়ে পরে।ইচ্ছে করে তোমার এই স্নিগ্ধ,কোমল, ভেজা দেহটা খুব করে ছুঁয়ে দিতে।খুব গভীরভাবে।এতোটা গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে যতোটা করলে তুমি আমার মাঝে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে।আর আমি তোমার মাঝে।আমাদের মাঝে ইঞ্চিখানেকও যেন দূরুত্ব না থাকে।’

অথৈ সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।এই লোকটার বলা প্রতিটা বাক্য ওর হৃদয়ের গভীরে গিয়ে গেঁথে যায়।এই যে এখন যা যা লাগামহীন কথাগুলো বলল লোকটা।ওই কথাগুলো দিয়েই যেন মনে হচ্ছে লোকটা ওকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।রুদ্রিক অথৈয়ের অবস্থা দেখে সরে আসল।ঠোঁটের কোণে ওর হাসি বিদ্যমান।রুদ্রিক এইবার ওর হাতদুটো অথৈয়ের কোমড়ে রেখে ওকে নিজের আরেকটু কাছে নিয়ে আসল।অথৈ হকচকিয়ে গেলো।চট করে রুদ্রিকের দিকে তাকালো।অথৈ ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে,’ কি করছেন?ওরা সবাই এখানে তো! সবাই দেখলে কি ভাববে?’

রুদ্রিক যেন অথৈয়ের কথাটায় ভ্রু-ক্ষেপ করলো না।চট করে অথৈকে কোলে তুলে নিলো।এতে যেন অথৈ আরও ঘাবড়ে গেলো।জলদি আশেপাশে নজর দিলো।না এদিকে কেউ তাকিয়ে নেই।সবাই যার যার মতো ব্যস্ত।তাও বলা তো যায় না।কেউ যদি দেখে ফেলে?অথৈ দুহাতে রুদ্রিকের গলা জড়িয়ে ধরল।তার নিজেরও ইচ্ছে করে না রুদ্রিকের সান্নিধ্যে থেকে যেতে।কিন্তু লজ্জা করে তো?অথৈ মিনমিন করে বলে,’ সবাই দেখে ফেলবে তো।কি করছেন?’

রুদ্রিক অথৈয়ের কপালে চুমু দিলো।অথৈ আবেশে চোখ বন্ধ নিলো।রুদ্রিকের দেওয়া প্রতিটি ছোঁয়ায় ওর শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়।রুদ্রিকের ঠোঁটজোড়া অথৈয়ের কপাল থেকে সরে আসতেই।অথৈ আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো।রুদ্রিক অথৈয়ের চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বলে,’ দেখুক!আমি আমার বউকে কোলে নিয়েছি।’

অথৈ ওর হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল।তারপর মাথাটা রুদ্রিকের বুকে এলিয়ে দিয়ে বলে,’ ওদিকটায় চলুন না।ওরা দেখলে আমি ভীষণ লজ্জা পাবো।’

রুদ্রিক হেসে দিলো অথৈয়ের কথায়।রুদ্রিক এখন নিজেই নিজের কাজে অবাক হয়।আগে ও কি ছিলো।আর এখন কি হয়ে গিয়েছে।এই মেয়েটা ওকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।আগে বিনা কারনে কখনই হাসতো না ও।হাসলেও তা মৃদু হাসতো।আর এখন এই মেয়েটা ওর কাছে থাকলে,পাশে থাকলে। কারনে অকারনেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।এই যে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে।কি যে শান্তি লাগে এতে।সকাল থেকে যেই নাম না জানা চিন্তারা হানা দিয়ে বেড়াচ্ছিলো এই মেয়েটা ওর বুকে মাথা রাখতেই যেন সব গায়েব হয়ে গিয়েছে।রুদ্রিক এখন অথৈকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করতে পারে না।এই মেয়েটাকে সর্বদা মুখের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে মন চায়।খুব করে তো বলেছিলো ওর মাস্টার্স শেষ করে। অফিসে জয়েন করবে।তারপর কিছুদিন পর অথৈকে ওর কাছে একেবারে নিয়ে আসবে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা বলে বড্ড ভুল করে ফেলেছে।এখন যেন অথৈকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারে না রুদ্রিক।এইযে মেয়েটাকে ছাড়া নিসঙ্গ রাতগুলো কাটায়।তা যে কতোটা কষ্ট কাটায় ও জানে।এই মেয়েটাকে ওর পাশে চায় ও খুব করে।এতোটা কাছে চায় যতোটা কাছে আসলে ওদের আর কখনও কেউ আলাদা করতে পারবে না।রুদ্রিক একপা একপা করে এগিয়ে যাচ্ছে।অথৈ চুপটি করে রুদ্রিকের বুকে লেপ্টে আছে।রুদ্রিক হাটতে হাটতে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে উঠল,’ ওরা দেখলে তুমি লজ্জা পাবে।আর যদি আমি তোমার সব দেখে ফেলি?তখন লজ্জা পাবে নাহ?’

রুদ্রিকের এমন লাগামছাড়া কথা শুনে অথৈয়ের কান গরম হয়ে গেলো।গালগুলো ভারি হয়ে আসল।লজ্জায় ঠিক কি বলবে ভেবে পেলো না।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রিক ভ্রু নাচিয়ে ফের বলে,’ কি বলো?আমি দেখলে লজ্জা পাবে?’

অথৈ চট জলদি রুদ্রিকের ঠোঁটে হাত রেখে ওর মুখ বন্ধ করে দিলো।লজ্জায় হাশফাশ করতে করতে বলে উঠে,’ এমন কেন আপনি?শুধু শুধু আমাকে এতো লজ্জা দেন কেন?’

রুদ্রিক চোখে হাসে। ওর ঠোঁটে রাখা অথৈয়ের হাতে চট করে চুমু দিয়ে বসে। অথৈ শিউরে উঠে হাত সরিয়ে ফেলে।রুদ্রিক শান্ত কণ্ঠে বলে,’ তোমাকে লজ্জা দিবো না তো কি?আমার পাশের বাড়ির আন্টির মেয়েকে লজ্জা দিবো?’

অথৈয়ের ভ্রু-জোড়া কুচকে আসে।কি থেকে কি বলল এই লোক?আর লোকটার পাশের বাড়িতে মেয়েও আছে?অথৈ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল,’ আপনার পাশের বাড়ির মেয়েকে বুঝি এর আগে কিছু বলে লজ্জা দিয়েছিলেন বুঝি?’

রুদ্রিক বুঝতে পারছে।অথৈ ক্ষ্যাপে যাচ্ছে।তাই অথৈকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্যে রুদ্রিক বলল,’ হ্যা দিয়েছিলাম তো।মেয়েটা না ভারি মিষ্টি জানো।ও তো পুরো আমার জন্যে পাগল।আমারও ওকে অনেক ভালো লাগে।’

রুদ্রিকের মুখে এমন কথা শুনে।রাগে ওর সারা শরীর রি রি করছে।নাক ফুলিয়ে বলে,’ তো?এতোই যখন ভালোলাগে।আমাকে তাহলে বিয়ে করলেন কেন?ওই মেয়েকেই বিয়ে করতেন।’

রুদ্রিক মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে।তবে তা বাহিরে প্রকাশ করল না।মুখটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে,’ আর বলো না।ও না আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো হয়ে যায়।আর দাদুর ওকে পছন্দ না।তার তো তোমাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো।তাই তো দাদুর জন্যেই তোমাকে বিয়ে করতে হলো।এখন আর কি করবো বলো?বিয়ে তো আমার হয়েই গিয়েছে।’

অথৈয়ের ভীষণ কষ্ট লাগল।এটা স্বাভাবিক নিজের স্বামী মুখে এমন কথা শুনলে প্রতিটি স্ত্রীই কষ্ট পাবে।অথৈ চোখ ভরে আসল।নিজেকে সামলাতে না পেরে।ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে উঠে।অথৈকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে রুদ্রিক হতভম্ব হয়ে পরল।ও ভাবেনি অথৈ যে এইভাবে কেঁদে দিবে।রুদ্রিক অস্থির হয়ে বলে উঠে,’ হেই, হেই কাঁদছ কেন?কাঁদে না।এই মেয়ে?অথৈ?আমি মজা করেছি।মজাও বুঝো না?কান্না থামাও।’

রুদ্রিকের কথা শেষ হতে দেরি।অথৈয়ের রাগ করতে দেরি নেই।ও রাগে রুদ্রিকের বুকে ঘুষি দিতে লাগল।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,’ আপনি একটা খারাপ লোক।আমার সাথে এমন করলেন কেন?অসভ্য লোক।নামান আমাকে কোল থেকে।নামিয়ে দিন।আমাকে ধরবেন না।’

রুদ্রিক হাসছে। প্রাণখোলা হাসি।রুদ্রিকের এহেন হাসি দেখে অথৈয়ের হাতজোড়া আঘাত করা থামিয়ে দিলো।কান্নাভেজা চোখে এসে ভড় করে একরাশ মুগ্ধতা।এই লোকটা হাসলে এতো সুন্দর লাগে।যে অথৈয়ের আশেপাশে কি হচ্ছে সব ভুলে যায়।শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।অথৈয়ের কান্নাও থেমে গিয়েছে।রুদ্রিক অথৈয়ের কোন নড়চড় না দেখে হাসি থামালো।তবুও ওর ঠোঁটের কোণে এখনও হাসির ছোঁয়া লেগে আছে।রুদ্রিক ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে বলে,’ কি কান্না শেষ?’

অথৈ কিছুই বলল না।ও এখনও রুদ্রিককে দেখছে।রুদ্রিক নরম সুরে বলে উঠে,’ কি দেখছ ওমন করে?’

অথৈ কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই অকপটে বলে,’ আপনাকে দেখি।আপনি এভাবে হাসলে না আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে।আমি চোখ সরাতে পারি না।আপনার ওই হাসিতে আমার বুক ব্যথা করে।’

রুদ্রিক দুষ্টুমি স্বরে বলে,’ তাহলে তো সর্বনাষ।আমার হাসিতে বুক ব্যথা করলে তো আর আমার হাসা যাবে না।’

অথৈ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না ইঙ্গিত দেখিয়ে বলে,’ এই না না হাসবেন না কেন?একশবার হাসবেন।আমার যে এই ব্যথা ভীষণ ভালো লাগে।মিষ্টি ব্যথা।’

রুদ্রিকের মনটা যেন জুড়িয়ে গেলো অথৈয়ের কথায়।ও আর কিছু বলল না।অথৈকে নিয়ে চুপচাপ হেটে নদীর অন্য বাঁকে চলে গেলো।একটু সাইডে জায়গাটা।এখানে কেউ নেই।আর ওপারপাশ থাকে এদিকটা দেখাও যায় না।রুদ্রিক অথৈকে নিয়ে পাহাড়ের গা ঘেষে দাঁড় করিয়ে দিলো।রুদ্রিকের চোখে ঘোর লেগে আছে।অথৈ সেই চোখের ভাষা স্পষ্টই বুঝতে পারছে।অথৈ মাথা নিচু করে নিলো।ওর হৃদস্পন্দন হু হু করে বেড়ে গিয়েছে।অথৈ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলে উঠে,’ এভাবে তাকাবেন না।এভাবে তাকালে আমার যেনো কেমন কেমন লাগে।’

রুদ্রিক টু শব্দও করল না।একটা হাত রাখল অথৈয়ের কোমড়ে।আরেক হাত অথৈয়ের গালে স্পর্শ করল।অথৈয়ের গালগুলো গরম হয়ে আছে।রুদ্রিকের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ লাগতেই।অথৈ কেঁপে উঠে।শিরশির করে উঠে সর্বাঙ্গ।রুদ্রিক মাথা নুইয়ে আলতো করে চুমু খেলো অথৈয়ের ঠোঁটে। পর পর গভীরভাবে ডুবে গেলো ওষ্ঠচুম্বনে।অথৈও হাত বাড়িয়ে খামছে ধরল রুদ্রিকের পিঠ।রুদ্রিকের ভালোবাসাময় স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলল।এদিকে রুদ্রিক মনে মনে ভাবছে,
‘ আমি আর তোমার থেকে দূরে থাকতে পারব না অথৈ। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না।আমার সাধ্যে যে আর কিছু নেই।তোমাকে সম্পূর্ণ রূপে নিজের করে পাওয়ার জন্যে যে আমার বুকের ভীতরটা তীব্র দহনে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।আমি তোমার থেকে একমুহূর্তও দূরে থাকতে পারবো না।তুমি আমার অথৈ। তোমাকে পুরোটাই আমার আমার করে চাই।তীব্রভাবে চাই।’

#চলবে_____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। এর থেকে বড়ো করে আর লিখতে পারলাম না।গরমের কারনে আমি অসুস্থ হয়ে পরেছি।আজ বৃষ্টি আসায় একটু ভালো লাগছিলো।তাই এইটুকুই লিখলাম।#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৬
ওয়ারী ছড়াতে ওরা বেশ এঞ্জয় করল।রিভার রাফটিংও করেছে ওরা।আবার সেখানে নাম করা দুটো ঝর্না আছে রে-নাং এবং চিবোক ডেয়ার সেগুলোও দেখেছে।সবাই যেন হারিয়ে গিয়েছিলো প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য।এখানে গুহাও আছে অনেকগুলো।সেখানের একটাতে গিয়ে সবাই জামা-কাপড় চেঞ্জ করে নিয়েছে।ঠান্ডায় সবার অবস্থাই খারাপ।নদীর পানি ভীষণ শীতল তো তাই।এখন সবার ফিরার পালা তাই ব্যাগপত্র নিয়ে রওনা হলো।পাহাড় বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে একেকজনের অবস্থা পুরো কাহিল।তাই আজ আর কেউ কোনো জায়গায় ঘুরতে যাবে না।সোজা রিসোর্টে চলে যাবে।আর বিশ্রাম নিবে।এদিকে আরহার তো প্রায় জ্বর চলেই এসেছে।ওর অবস্থা নাজেহাল।তারপরেও মেয়েটা টু শব্দ অব্দি করেনি।চুপচাপ হেটে যাচ্ছে।মেয়েটা যে কি কষ্ট পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেছে সেই জানে।কিন্তু কিছু করার নেই।এমন দূর্গম রাস্তায় কি আর কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে?সবারই কষ্ট হচ্ছিলো।আরহা হাটটে নিয়ে হঠাৎ করে পরে যেতে নেয়।ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে আরহা।কিন্তু না পরেনি।কারো শক্ত,নিরেট হাতখানা ওর হাত পেছন থেকে চেপে ধরে রেখেছে।যার ফলে ও পরে যায়নি।এদিকে সাফাত আরহা পরে যেতে নিতে দেখেই ওর হাত দ্রুত ধরে ফেলে।আরহার হাতটা স্পর্শ করতেই বুঝতে পারে মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর এসেছে।গা ভীষণ গরম।সাফাত একটান দিয়ে আরহাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়।আরহা একেবারে সাফাতের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। আরহা নিভু নিভু চোখে সাফাতের দিকে তাকিয়ে আছে।শরীরের তাপমাত্রা এতোটাই বারছে যে ওর চোখজোড়াও মনে হচ্ছে ধাউ ধাউ করে জ্বলছে।ঠিকভাবে তাকাতে পারছে না ও।এদিকে সাফাত একধ্যানে তাকিয়ে আছে আরহার দিকে জ্বর আসার কারনে আরহা ফর্সা মুখশ্রীটা রক্তিম আকার ধারন করেছে।আধভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।কপালে পরে আছে কয়েকটা বেবি হেয়ার।মেয়েটার বোধহয় ঠান্ডা লাগছে।তাই কেমন একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে।ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাশে হয়ে আছে।যা ঠান্ডা লাগার কারনে কাঁপছে।আরহাকে কেন যেন এই বেশে সাফাতের একটা কথাই মাথায় আসল মেয়েটা অনেক কিউট।সাথে মেয়েটার মনটাও অনেক ভালো।একমুহূর্তেই কিভাবে ওদের বন্ধুদের সাথে মিশে গিয়েছে।ভীষণ মিশুক।আর মেয়েটা চঞ্চলও বটে।সাফাতের অজান্তেই সাফাতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।আর তা দেখে আরহা হা করে তাকিয়ে থাকলো।ও বোধহয় স্বপ্ন দেখছে।নাহলে যে লোক ওকে দেখলেই সবসময় মুখটা গম্ভীর,শক্ত করে রাখে।আর আজ সেই লোক কিনা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।এটা আদৌ হবার?তবে যা হচ্ছে, হচ্ছে।আরহা চায় এই স্বপ্ন যেন কোনোদিন না ভাঙ্গুন।সাফাত এইভাবে হাসতে থাকুক ওর দিকে তাকিয়ে।আরহাও হাসল।আরহা হাসতে দেখে সাফাত থতমত খেয়ে গেল।সে কি করছিল?কি হয়ে গিয়েছিল ওর?আর আরহার দিকে তাকিয়ে ও হাসছিলই বা কেন?আশ্চর্য কারবার।সাফাত দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।মুখটা গম্ভীর করে ফেলল চটজলদি।বলল,’ তুমি এতো সেন্সেটিভ একটা পারসোন।এটা জেনেও কেন এসেছ এখানে?এখন জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছ।তোমার মা বাবা এখানে নেই যে দিনরাত তোমাকে সেবা করবে।এখন তুমি কি করবে?’

আরহা মলিন হাসল।তার তো মা নেই।আর বাবা থেকেও না থাকারই মতো।আরহার কণ্ঠে বিষাদের ছায়া নেমে এলো।বলল,’ আমার মা নেই।আর বাবা থেকেও না থাকার মতো।তাই মা বাবার সেবা আমি আগেও কোনোদিন পায়নি।আর এখনও পাবো না।’

সাফাতের বুকটা ধ্বক করে উঠল।অজান্তেই এমন একটা কথা বলে ফেলেছে ও।কিন্তু ওর তো দোষ নেই। ও আর জানতো না যে আরহার মা নেই।আর বাবা কথা যেটা বলল সেটা নাহয় আপাতত থাক।সাফাত জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,’ আই এম সরি।আমি জানতাম নাহ।’

আরহা মলিন হেসে বলে,’ ইটস ওকে।আপনার সরি বলতে হবে না।আপনি তো আর আমার লাইফের ব্যাপারে কিছু জানেন না।তাই এটা স্বাভাবিক।’

সাফাত চিন্তিত কণ্ঠে বলে,’ আর ইউ ওকে আরহা?ইজ দ্যেয়ার এনিথিং রং?’

আরহাকে বেশি একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।মেয়েটা কেমন টলছে।জ্বরটা কি খুব বেশিই বেড়ে গেলো?সাফাত হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে দিলো আরহার।আরহা সাথে সাথে কেঁপে উঠল।সর্বাঙ্গে যেন ঝংকার দিয়ে উঠল।ওর উত্তপ্ত শরীরে সাফাতের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ যেন ওর শরীরকে কাঁপিয়ে তুলেছে।আরহা চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।এদিকে সাফাতের চেহারায় চিন্তার ছাপ।মেয়েটার শরীর ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে।আরহার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো সাফাত।বলল,’ ভীষণ জ্বর তোমার।জলদি কটেজে ফিরতে হবে।আরহা শুনছ তুমি?’

আরহা পিটপিট নয়নে তাকায়।সাফাত আরহার হাত চেপে ধরল।সহসা কণ্ঠে বলে উঠে,’ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে চলো।বলা তো যায়না কখন পরে যাও।আর তোমার বন্ধুরাই বা কেমন?তোমার এই অবস্থা কারও নজরে আসল নাহ?সবগুলো তোমাকে ফেলে আগে আগে চলে গিয়েছে।’

আরহা সাফাত আর ওর হাতের দিকে তাকিয়েছিলো।যা এখন একে অপরের সাথে পেঁচিয়ে আছে।সাফাতের কথা শুনে ওর দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,’ আমার আর বন্ধু?হাসালেন আমাকে।ওরা তো আমার সাথে বন্ধুত্ব করেনি।করেছে আমার টাকা পয়সার সাথে।’

সাফাত বারে বারে আরহার প্রতিটি কথায় চমকাচ্ছে ভীষণভাবে।সাফাত বুঝল জ্বরের ঘোরে এই মেয়ে মনের সব কথা উগলে দিচ্ছে।সাফাত কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।তবে সাফাত আর বেশি আরহাকে ঘাটলো না।আরহার কথা আপাততো পরেও শোনা যাবে।এখন মেয়েটাকে নিয়ে রিসোর্টে ফিরতে হবে দ্রুত।নাহলে অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যাবে। আর সাফাত তাই করল দ্রুত আরহাকে নিয়ে সাবধানে গাড়ির কাছে আসল।আরহার কথা শুনে যেটুকু মনে করল ওর ফ্রেন্ডরা ওর টাকা পয়সা দেখে ওর সাথে বন্ধুত্ব করেছে।আ হলোও তাই।ওরা আরহাকে না নিয়েই গাড়ি নিয়ে রিসোর্টে চলে গিয়েছে।এটা জানতে পেরেই সাফাতের রাগে যেন সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে।পারলে এক্ষুনি গিয়ে সবগুলোকে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দিতে।রাগটা মনের মাঝেই পুষে রাখল সাফাত।আরহাকে নিজেদের সাথে করে নিয়েই গাড়িতে উঠে বসল।অথৈ দ্রুত আরহাকে দুহাতের মাঝে আগলে নেয়। মেয়েটা প্রায় আধমরা।জ্বরের কারনে কাঁপছে।অথৈ আতঁকে উঠে বলে,’ ওর তো ভীষণ জ্বর সাফাত ভাইয়া।’

সাফাত মাথা দুলিয়ে বলে,’ হ্যা ওয়ারী ছড়া পানিটা দেখেছিলে কি ঠান্ডা? সেখানে গিয়ে সবার থেকে ওই বেশি লাফালাফি করেছে পানির মধ্যে।তো জ্বর আসবে না আবার?’

অথৈ হঠাৎ নাক মুখ কুচকে বলে উঠে,’ ওর ফ্রেন্ডগুলাও কেমন?ওকে এই অবস্থায় একা ফেলে চলে গেলো?আমি তো ভেবেছিলাম আরহাও বুঝি ওর ফ্রেন্ডদের সাথে চলে গিয়েছে।পরে দেখি না আপনি ওকে নিয়ে আসছেন।’

সাফাতের চোয়াল শক্ত হয়ে আসল।হাত দুটো পুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বলে,’ ওইগুলোকে বন্ধু বলে বন্ধু শব্দের অপমান করো না অথৈ। ‘

সবাই সাফাতের আচমকা রাগ দেখে অবাক হলো।তবে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
রুদ্রিক সাফাতের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার আরহার দিকে তাকালো।পর পর চোখ বন্ধ করে নিলো।তার মন বলছে।এই দুটোর মাঝে কিছু হতে চলেছে।ও যেটা ভাবছে সেটাই যেন হয়।সাফাতকে কেউ যেন খুব করে ভালোবাসুক।এতোটাই ভালোবাসুক ওকে যেন সাফাতের সেই ভালোবাসার তীব্রতায় নিজের ভালোবাসা হারানোর ব্যথা ভুলে যায়। নতুন করে আবার সবকিছু যেন শুরু করে।

রিসোর্টে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসল।আরহার শরীরের দূর্বলতার কারনে ও অথৈয়ের কোলেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে সাফাত আরহাকে কোলে তুলে নেয়।সাথে যায় রুদ্রিক।যাওয়ার আগে অথৈকে রুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসলও নিতে বলে গিয়েছে।এদিকে আরহাদের বুকিং করা কটেজটায় এসে দাঁড়ালও সাফাত।রুদ্রিক বার দুয়েক দরজায় টোকা দিলো।কিন্তু না দরজা খুলছে না।পর পর চোখ যায় দরজায় তালা ঝোলানো।এটা দেখে সাফাত আর রুদ্রিক দুজনেই বেশ অবাক হয়।এভাবে তালা ঝুলছে কেন?আরহার ফ্রেন্ডরা তো অনেক আগেই চলে এসেছিলো।ওদের তো এখানেই থাকার কথা।আর বাহিরে যাবে সেটাও হবে না সম্ভবত।কারন এতো দূর থেকে জার্নি করে এসে।সবাই নিশ্চয়ই বিশ্রাম বাদ দিয়ে বাহিরে ঘুরঘুর করবে নাহ?রুদ্রিক এইবার সাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ তুই আরহাকে নিয়ে মারিয়া আর সিয়ার কটেজে যাহ।আমি ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আসছি।বিষয়টা বুঝতে হবে তো।এখানে কি হয়েছে।’

সাফাত সম্মতি দিতেই রুদ্রিক চলে গেলো।সাফাত আরহাকে নিয়ে মারিয়া আর সিয়ার কটেজে চলে আসল।বাহির থেকে বার কয়েক সিয়া আর মারিয়াকে ডাকতেই সিয়া এসে দরজা খুলে দিলো।আরহাকে কোলে নিয়ে ওদের কটেজের সামনে এইভাবে সাফাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় সিয়া।ভ্রু-কুচকে বলে,’ তুই আরহাকে কোলে নিয়ে আমাদের রুমের সামনে এমনে সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

সাফাত বিরক্ত হলো সিয়ার কথায়।বলে,’ তুই আপাততো সামনে থেকে সর।ওকে অনেকক্ষণ যাবত কোলে নিয়ে আছি।আর সামলাতে পারছি না।’

সিয়া এই কথা শুনে দ্রুত সরে দাঁড়ালো।সাফাত আরহাকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে। গায়ে কম্বল টেনে দিলো।এর মধ্যে মারিয়াও ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে।সাফাতকে ওদের রুমে দেখে প্রশ্ন করে,’ সাফাত?কোনো সমস্যা হয়েছে?তুই এখানে?’

সাফাত কিছু না বলে শুধু চোখের ইশারায় বিছানায় শুয়ে থাকা আরহাকে দেখালো।তা দেখেই মারিয়ার ভ্রু-কুচকে এলো।ফের বলে,’ ওকে এখানে এনেছিস কেন?’

সাফাতের আর কিছু বলতে হলো না।এর মধ্যে রুদ্রিক চলে এসেছে।রুদ্রিক বলে উঠে,’ আরহার ফ্রেন্ডরা ওকে রেখেই দেশে চলে গিয়েছে।’

চমকে উঠল ওরা সবাই।সাথে সাফাতও।সাফাত এটা আশা করেনি।যে ওরা এইভাবে আরহাকে একা ফেলে আচমকা চলে যাবে।তাও এমন অসুস্থ মেয়েটাকে একা ফেলে? সাফাত চেচিয়ে উঠে,’ হোয়াট?মাথা ঠিক আছে তোর?কিসব বলছিস?এটা কিভাবে হবে?দেখ আশেপাশেই হয়তো আছে।’

রুদ্রিক পকেটে হাত গুজে টান টান হয়ে দাঁড়ালো।শান্ত কণ্ঠে বলল,’ আমি ঠিকই শুনেছি।মাত্র ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম।আর ওর বন্ধুরা ম্যানেজারের কাছে এই চিঠিটাও দিয়ে গিয়েছে।’

রুদ্রিক পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সামনে এনে ধরল।তারপর আবার বলে,’ অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস ধরা বা পড়া ঠিক না।তবে এখন যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন তাই এই চিঠিটা না পড়েও পারি নি।’

সাফাতের অধৈর্য কণ্ঠস্বর,’ কি লিখা আছে এখানে?’
‘ এখানে লিখা ওদের সবার নাকি বিশেষ জরুরি তলব পরে গিয়েছে।তাই ওদের দ্রুত দেশে ফিরতে হয়েছে।এইজন্যে আরহাকে একা ফেলে চলে গিয়েছে।আর আরহা যেন কষ্ট করে দেশে এসে পরে। এটাই লিখা।’

সিয়া নাক মুখ কুচকে বলে উঠে,’ ছিহ! এইগুলা বন্ধু নাকি অন্যকিছু। এইভাবে মেয়েটাকে একা ফেলে চলে গেলো?একটাবার মেয়েটার সাথে দেখা করেও গেলো না?’

সাফাত আরহার মুখের দিকে তাকালো।আরহার ফ্যাকাসে দূর্বল মুখশ্রীটা দেখে বড্ড মায়া লাগলো।মেয়েটার চেহারা অনেক মায়া মায়া।কেউ কিভাবে ওর সাথে এমন করতে পারে?ভাবলেই সাফাতের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে।সাফাত চোখ বন্ধ করে জোড়ে শ্বাস ফেলল।সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,’ আপাততো এই টপিক বাদ দে।আরহা সুস্থ হোক।তারপর নাহয় ওর থেকেই সবকিছু ভালোভাবে জেনে নিবো।’

একটু থেমে আবার বলে,’ মারিয়া,সিয়া আরহা এখন একা।ওর সাথে কেউ নেই।এখানে আমরাই এখন ধরতে গেলে ওর পরিচিত।আমাদের সাথে মেয়ে আছে পাঁচজন মেয়ে আছে।তাদের মধ্যে তোরা দুজনেই সবচেয়ে বড়।আর বুঝদার বেশি।তাই তোদের কাছেই ওকে রেখে গেলাম।মেয়েটাকে দেখে রাখিস।ওর শরীরে অনেক জ্বর।আমি এখনই যাচ্ছি মেডিসিন আনতে।তোরা একটু ওকে পানিপট্টি কর।’

মারিয়া আলতো হেসে বলে,’ চিন্তা করিস না।আমরা দুজন ওকে দেখে রাখব।ও তো এখন আমাদের ছোটো বোনের মতোই।মেয়েটা অনেক মিশুক।’

সাফাত সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো মেডিসিন আনতে।রুদ্রিক শান্ত স্বরে বলে,’ তিনজন থাকতে তোদের সমস্যা হবে না তো?’

সিয়া বলে,’ আরে কিসের সমস্যা হবে?এমনিতেই এখানে প্রচুর ঠান্ডা পরেছে।তিনজন এক বিছানায় মিলেমিশে থাকব।এতে আরও মজা হবে।তুই চিন্তা করিস না।’

সিয়া আর মারিয়ার ভড়সা পেয়ে রুদ্রিক রুম থেকে বেরিয়ে আসল।বাহিরে সাফাত দাঁড়িয়ে আছে।রুদ্রিক সাফাতের কাছে গিয়ে বলে,’ চল মেডিসিন নিয়ে আসি।’

সাফাত বলে উঠল,’ তোর যাওয়া লাগবে না।তুই রুমে যা। ফ্রেস হয়ে নেহ।আমি এই যাবো আর আসব।’
‘ কিন্তু…’
‘ কোনো কিন্তু না। আমি পারব বললাম তো।’
‘ আচ্ছা।কোনো সমস্যা হলে ফোন করিস। ‘
‘ আচ্ছা।’

রুদ্রিক নিজের রুমের দিকে হাটা ধরল।সাফাত চাপা শ্বাস ফেলে চলল মেডিসিন আনার জন্যে।
————–
অথৈ ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ওর ভেজা চুলগুলো মুছছিলো।এমন সময় রুমে আসে রুদ্রিক।রুদ্রিক দেখেই চুল মুছতে মুছতে অথৈ বলে,’ এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন?’

রুদ্রিক দরজা আটকে অথৈয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো।মৃদ্যু হেসে বলে,’ ক্যান?মিস করছিলে বুঝি আমায়?নাকি তখনকার চুমুটা মিস করছিলে?’

অথৈ লজ্জায় হতভম্ব হয়ে গেলো।এই লোক কিসের মধ্যে কি বলছে?ও কতো একটা ভালো কথা বলল।আর এই লোক কিনা সেটা ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ত্যানাত্যানা করে ফেলে।অথৈ মুখ ফুলিয়ে বলে,’ উফ, আপনি চরম অসভ্য একটা লোক।সরুন তো আপনি।সরুন!’

রুদ্রিক শব্দ করে হেসে দিলো।রুদ্রিকের সেই হাসি ঝংকারে পর পর অথৈয়ের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল।ও মিষ্টি করে হেসে মাথা আচঁড়াতে লাগল।রুদ্রিক সময় নিয়ে হাসি থামায়। রুদ্রিককে থামতে দেখে অথৈ বলে,’ প্লিজ বলুন না।কোথায় ছিলেন?দেরি হলো যে?আরহার শরীর কি খুব বেশি খারাপ?’

রুদ্রিক এইবার সিরিয়াস হয়ে গেলো। মুখটাকে মূহুর্তেই গম্ভীর করে নিলো।তারপর আস্তে আস্তে অথৈ সবটা খুলে বলল।সব শুনে অথৈ ভেজা কণ্ঠে বলে,’ এতো খারাপ আরহার ফ্রেন্ডগুলো।এইভাবে অসুস্থ মেয়েটাকে একা ফেলে চলে গেলো কিভাবে?একবার মেয়েটার সাথে দেখা করেও গেলো না।মেয়েটা হুঁশে আসলে না জানি কতোটা কষ্ট পায়।’

রুদ্রিক অথৈয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ মন খারাপ করো না।আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।আরহার জন্যে এটা ভালো হয়েছে না বলো?যে মেয়েটা ওর ওই মিথ্যে বন্ধুগুলোর আসল মুখোশটা চিন্তে পারবে।বুঝতে পারবে যে বিপদের সময় যারা একজন মানুষকে এইভাবে ফেলে চলে যায়।তারা কোনোদিন কারো বন্ধু হতে পারে না।’

অথৈ চোখ মুছে নিলো।তারপর দুহাতে গিয়ে রুদ্রিককে জড়িয়ে ধরে।রুদ্রিকও আগলে নেয় প্রিয়তমাকে।অথৈ রুদ্রিকের বুকে মুখ গুজে দিয়ে বলে,’ এদিক দিয়ে আপনি আমি দুজনেই খুব লাকি জানেন।আমরা জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কিছু পেয়ে থাকলে তা আমাদের বন্ধুদের পেয়েছি।যারা আমাদের জন্যে বিপদের সময় সর্বদা ঝাপিয়ে পরার জন্যে প্রস্তুত থাকে।’

রুদ্রিক সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে বলে,’ হ্যা এটা একদম ঠিক বলেছ।এদিক দিয়ে আমরা পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে সুখী কাতারের মানুষদের মধ্যে পরি।উপরওয়ালার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া তার জন্যে।’

অথৈ এইবার সরে আসল।তারপর রুদ্রিকের হাতে একটা তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বলে,’ অনেকক্ষণ হয়েছে। বাকি কথা পরে হবে।এখন ফ্রেস হয়ে আসুন।’

রুদ্রিক ঠোঁট কামড়ে হাসল।মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে,’ ফ্রেস হয়ে আসলে তো কোনো কথা হবে না ম্যাডাম।ভালোবাসাবাসি হবে।’

অথৈ লজ্জামিশ্রিত হাসি উপহার দিলো রুদ্রিককে। তারপর রুদ্রিককে ঠেলতে ঠেলতে ওয়াশরুমের দিকে পাঠালো।ফিরে আসতে নিতেই রুদ্রিকের কণ্ঠ, ‘ আমার জামা কাপড় বের করে রেখো।’

অথৈ পাজোড়া থামিয়ে ফেলে।ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,’ কি পরবেন আপনি?’

প্রতিত্তুরে রুদ্রিক বলে,’ স্বামীটা যেহেতু তোমার।তাই সে কি পরবে না পরবে সেটা নাহয় তুমিই ডিসাইড করে দেও।’

এই বলে রুদ্রিক ওয়াশরুমে চলে গেলো।আর অথৈয়ের ঝলমলে মুখে মিষ্টি হাসি।সে দ্রুত গিয়ে রুদ্রিকের জন্যে ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট। আর কালো রঙের ট্রাউজার বের করে বিছানায় রেখে দিলো।তার কেমন যেন লাগছে।মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি রুদ্রিকের সাথে সংসার করছে।এইযে রুদ্রিকের ছোটো খাটো সবকিছু এখন সে নিজ হাতে করছে।রুদ্রিকও ওকে এটা সেটা ছোটো খাটো হুকুম দেয়। এসব সে বেশ এঞ্জয় করছে।ওর বেশ ভালো লাগছে ব্যাপারগুলো।আচ্ছা,সে যখন সত্যি রুদ্রিকের বউ হয়ে রুদ্রিকের বাড়িতে যাবে।ঠিক এখন যেভাবে রুদ্রিকের সবকিছু ও নিজ হাতে করছে।আগলে রাখছে।ও বাড়িতেও এমনভাবেই সব করবে।ইনফেক্ট আরও ভালোভাবে করবে।তখন কেমন লাগবে?ওর তো অনেক ভালো লাগবে।এইযে এসব কল্পনা করতে গিয়েও কেমন খুশিতে ওর বুক কাঁপছে।এইভাবে কি রুদ্রিকও খুশি হবে?আচ্ছা ও যেভাবে রুদ্রিককে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখে।রুদ্রিকও কি এভাবে ওর সাথে সংসার করার কল্পনা করে?
ও কি একবার লোকটার থেকে জিজ্ঞেস করবে একবার?কিন্তু কিভাবে করবে?এইটা জিজ্ঞেস করার আগেই ও লজ্জায় মরে যাবে।
______________
সিয়া কটেজ থেকে বের হয়ে এসেছে।এখান আসার পর সে কটেজের পাশেই একটা তুলসীগাছ দেখেছিলো। সেখান থেকে পাতা আনতে যাচ্ছে।আরহার বেশ কাশি হচ্ছে।তুলসীপাতার রস খাওয়ালে যদি একটু নিস্তার পায় মেয়েটা।কয়েকপা এগুতেই হঠাৎ সিয়া থমকে গেলো।সে কি ভুল দেখছে?চোখ কচলে নিয়ে আবারও ভালোভাবে তাকায় সিয়া।নাহ,ও ভুল দেখছে না।সত্যিই এটা সেদিনকারই লোক।সিয়া বেজায় খুশি হলো।এই লোকটাকে সকালে কতো খুঁজেছিলো। কিন্তু সিয়া পায়নি।ওকে অতো বড়ো একটা বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে লোকটা।আর ও একটা ধন্যবাদও দেয়নি।সিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো লোকটার কাছে।কাছে গিয়েই হাসি মুখে বলে উঠল,’ এক্সকিউজ মি।এইযে মি. শুনছেন?’

#চলবে_____________
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৭
জেনির সাথে ফোনে কথা বলছিলো রিয়ান।হঠাৎ পিছন থেকে চিকন রিনিঝিনি মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌছাতেই চটজলদি পিছনে ফিরে তাকায়।তাকাতেই সিয়ার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা ভেসে উঠে ওর অক্ষিপটে।সিয়াকে সে চিনে।কিন্তু সিয়াও ওকে চিনে।কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে চিনছে না।না চিনবারই কথা।কারন রিয়ান মুখে মাস্ক পরে আছে।গায়ে ব্লাক কালারের হুডি জড়ানো।সেই হুডির টুপিটা মাথায় দেওয়া।যার কারনে চোখের অর্ধকখানি ঢেকে আছে।চোখে সানগ্লাসও পরা আছে।তাই ও যে রিয়ান তা কেউ বুঝবে না।সিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।এদিকে সিয়া রিয়ান তাকাতেই চুপ হয়ে গেলো।প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে।লোকটাকে ডেকে তো ফেলল এখন কি বলবে?এদিকে রিয়ান সিয়ার কোনো নডচড় না দেখে এইবার নিজেই বলে উঠে,’ জি বলুন?কিছু বলবেন?’

রিয়ানের কথায় নড়েচড়ে উঠে সিয়া।শুকনো ঢোক গিলে নেয়।জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,’ আসলে হয়েছে কি।ওই আরকি…’

সিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রিয়ান বলে উঠল,’ আসলে নকলে পরে বলা যাবে।আগে কিজন্যে আমায় ডেকেছেন সেটা বলুন।’

সিয়া নাক মুখ কুচকে আসতে চাইছে।তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে।এই লোক তো ভারি বজ্জাত।এইভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?আরে ও তো বলতেই নিয়েছিলো।বেটা খবিশটাই তো থামিয়ে দিলো।মনের কথা মনের মাঝে চেপে রাখল সিয়া।বলল,’ আসলে সকালে আমি রুটব্রিজ যাওয়ার পথে ওই পিচ্ছিল সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পরে যাচ্ছিলাম।আপনিই তো আমাকে হ্যাল্প করলেন।আমাকে এতো বড়ো একটা বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।আপনাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত আমি দেয়নি।আমি আপনাকে পরে অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু আপনাকে পায়নি।এরজন্যে আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু এখন আবার আপনাকে খুঁজে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে।আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তখন আমাকে এতো বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে।’

রিয়ান শান্ত হয়ে সিয়ার পুরোটা কথা শুনল।কেন যেন ওএ সিয়ার কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগেনি।বিরক্ত ফিল হয়নি ওর।রিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলে,’ ইটস ওকে।আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আপনাকে হ্যাল্প করত।’
‘ কিন্তু এখন হ্যাল্পটা তো আপনি করেছেন।তাই ধন্যবাদটা আপনিই পাওনা।’
‘ হুম!’

রিয়ান আবার অন্যদিকে ঘুরে যেতে নিতেই সিয়া উত্তেজিত হয়ে বলে,’ আরে আরে?কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’

রিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরল।বলল,’ তো?এখন কি আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো?’
‘ না সেটা বলছি না।’
‘ তো?’

সিয়া আমতা আমতা করে বলে উঠল,’ আপনি আমার এতো বড়ো একটা উপকার করেছেন।বিনিময়ে শুধু আমি ধন্যবাদ জানালে বিষয়টা অনেক খারাপ দেখায়।’

রিয়ান বলে,’ সমস্যা নেই।আমি আপনার ধন্যবাদ নিয়েছি।’
‘ এভাবে তো বললে হবে না।’
‘ তাহলে কি বলব?’

সিয়া ঠোঁট প্রসস্থ করে হেসে বলে,’ ওইযে দূরে দেখছেন।এখানের ওই টং দোকানটায় অনেক মজাদার চা পাওয়া যায়।আপনি যদি আমার সাথে এককাপ চা খান এখন।তাহলে বুঝে নিবো আপনি আমার ধন্যবাদ গ্রহন করেছেন।’

কথাগুলো বলতে বলতে সিয়া দূরে থাকা টং দোকানটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।রিয়ান সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবার সিয়ার দিকে তাকালো।তাকাতেই রিয়ানের বুকের বা-পাশটায় কেমন যেন করে উঠল।চারদিকে আবছা অন্ধকার।এই রিসোর্টার প্রতিটি কোনে কোনে একটা করে বাঁশের খুটি গেড়ে রাখা হয়েছে।সেই বাঁশের খুটির সাথে একটা করে হ্যারিকেন টানানো।সেই হ্যারিকেনের হলদে আলোতে সিয়ার মুখশ্রীটা বড্ড আদুরে দেখালো।ঠোঁটের ভাজের ওই হাসিটুক বড্ড কোমল লাগলো।হৃদয়ে গেঁথে রাখার মতো।ওই হলদে আভায় সিয়ার ডাগরআঁখিজোড়া যেন জ্বলজ্বল করছে।রিয়ানের ঘোর লেগে যাচ্ছে ওই চোখজোড়ার দিকে তাকাতেই।কি হচ্ছে এসব ওর সাথে?আগে তো এমন হয়নি।এ কেমন অনুভূতি।

‘ কি হলো?যাবেন নাহ?’

আচমকা সিয়ার কণ্ঠে ঘোর কাটে রিয়ানের।নিজের বেহায়াপনায় নিজেই অবাক রিয়ান।এভাবে কোনো মেয়ের দিকে ও কোনোদিন তাকায় না।কোনো মেয়ের মুখটা এতো আদুরে লাগেনি ওর কাছে।তবে আজ হঠাৎ এমন কেন হলো?এই সিয়াকে তো ও বহু দেখেছে।যেহেতু সে জেনির ফ্রেন্ড।অহরহ ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে।তখন তো এইভাবে কোনোদিন সিয়াকে ও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেনি।তবে আজ কেন?বার বার মনকে একই প্রশ্ন করল রিয়ান।কিন্তু এই ‘ কেন?’ এর উত্তর মিলল নাহ।রিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।’
‘ আমি মেয়ে মানুষ হয়ে আমার সমস্যা হচ্ছে না।তবে আপনি এমন করছেন কেন?নাকি আমার ধন্যবাদটা এক্সেপ্ট করতে চাইছেন নাহ?’
‘ এমন কিছু না।’
‘ তাহলে চলুন।’

সিয়ার জোড়াজুড়িতে শেষমেষ বাধ্য হয়ে রিয়ান রাজি হলো।আর এমনিতেও কেন যেন ওর মন সম্মতি দিচ্ছিলো না যে ও সিয়াকে নাকচ করে ফিরিয়ে দিবে।সিয়া আর রিয়ান চুপচাপ বেশ খানিকটা দুরুত্ব রেখে পাশাপাশি হাটছে।এমন নিরবতা ভালো লাগছিলো না সিয়ার।তাই সিয়া নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে বলে,’ আপনি কি এখানে একা এসেছেন?’

রিয়ান শান্ত চোখে সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,’ না,আমি আর আমার বোন এসেছি।’
‘ ওহ! আমরা যেই রিসোর্টে উঠেছি।সেখানেই উঠেছেন তাই নাহ?’
‘ নাহ!’

অবাক হলো সিয়া।প্রশ্ন করল,’ তাহলে এখানে আপনি কি করছিলেন?’
‘ একটা কাজে এসেছিলাম।এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।সেও নাকি এখানে ঘুরতে এসেছে।তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।’

রিয়ানের মিথ্যে কথাটা একটুও ধরতে পারলো না সিয়া।সরল মনের সবটা বিশ্বাস করে নিয়ে বলে,’ ভালো করেছেন।তা এখন কি করবেন?রাত হয়ে আসছে।আপনার বোন তো মেইবি একা আছে।রিসোর্টে ফিরে যাবেন?’

রিয়ান হালকা হেসে বলে,’ না গিয়ে উপায় নেই।একমাত্র বোন আমার।’

মাস্কের আড়ালে যেই হাসি দেখতে পেলো না সিয়া।বলে,’ আপনার বোনকে অনেক আদর করেন তাই নাহ?’
‘ একটা মাত্র বোন আমার আদর তো করবই।ওর জন্যে সব করতে প্রস্তুত।’
‘ খু/নও করতে পারবেন?’

চমকে উঠল রিয়ান।প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো।সিয়া কি কিছু টের পেলো নাকি?নাহলে এমন একটা কথা কেন বলবে?রিয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।আবারও কোনো বানোয়াট মিথ্যে বলার আগেই সিয়ার খিলখিল হাসির শব্দে চারদিক মুখোরিত হলো।রিয়ান যেন আটকে গেলো সেই হাসির মাঝে।হুঁশ ফারিয়ে ফেলল।মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেই থাকলো সেই হাসি।এতো সুন্দর কারো হাসি হয় বুঝি?কারো হাসির শব্দের ঝংকারে বুঝি এইভাবে বুক কেঁপে উঠে?সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়?সিয়া হাসি থামালো।তবে এখনও ঠোঁটে মুচঁকি হাসি লেগে আছে।
‘ আমি তো মজা করলাম।ভয় পেয়েছেন নাকি আপনি?নাকি সত্যি সত্যি কাউকে খু/ন করবেন?’

রিয়ান নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলো।শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’ ফারদার এমন মজা কারো সাথে করবেন না।এটা ব্যাড ম্যানার্স।’
‘ আচ্ছা সরি।’

নিভিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে সিয়া।রিয়ান থমকে গেলো।মেয়েটা কি ওর শক্ত কথার ধাঁচে রাখ করেছে?কষ্ট পেয়েছে? নাহলে এভাবে কথা বলল কেন?কণ্ঠটায় কেমন যেন মন খারাপের আভাস পেলো।রিয়ান ধীর স্বরে বলে উঠে,’ আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করেছেন?’

সিয়া অবাক হলো।পর পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ আমার মন খারাপ হলেই বা কি?আপনি কি করবেন?’

রিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,’ আপনার সাথে এককাপ চায়ের জায়গায় দু কাপ চা খেলে,আপনার মন ভালো হবে?’

সিয়া হেসে ফেলল রিয়ানের কথায়।মন ভালো করার উপায় শুনে বেশ মজা পেয়েছে ও।এদিকে সিয়ার হাসি দেখে যেন হৃদয় জুড়িয়ে গেলো রিয়ানের।একটা কথাই মাথায় আসল।মেয়েটা মন খারাপ করলে ওর একদম ভালো লাগে না।একটুও না।মেয়েটা হাসুক।এইভাবেই হাসুক।সবসময় এমনই প্রাণজ্জ্বল থাকুক।এইভাবেই ওদের মাঝে টুকটাক কথা হলো এককাপ চায়ের সাথে।রাত সাড়ে আটটা নাগাত সিয়াকে রিসোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রিয়ান চলে যায়।

সিয়া রিয়ানকে বিদায় দিয়ে যখন নিজের কটেজে ফিরে যাবে।তখনই ওর কটেজের সামনে অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।অনিককে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো সিয়া।তবে কিছুই বলল না।অনিকের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো।কিন্তু পারলো না।তার আগেই অনিক শক্ত করে সিয়ার হাত চেপে ধরেছে। এতোটাই শক্ত করে ধরেছে যে মনে হচ্ছে সিয়ার হাতটা কবজি থেকে ভেঙ্গে যাবে।সিয়া ব্যথাতুর আওয়াজ করে উঠল।চাপা কণ্ঠে বলে,’ কি করছেন আপনি?এইভাবে হাত ধরেছেন কেন?হাত ছাড়ুন।আমার ব্যথা লাগছে। ‘

অনিক পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। সিয়ার দিকে তাকায়।সিয়া অনিকের দিকে তাকাতেই সাথে সাথে ভয় পেয়ে যায়।অনিকের চোখজোড়া অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে আছে।সেই সাথে ফর্সা মুখটাও রক্তিম আকার ধারন করেছে।হ্যারিকেনের হলদেটে আলোতে তা দেখতে আরও ভয়ানক লাগছে।অনিক শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’ ছেলেটা কে ছিলো সিয়া?’

অনিকের এহেন শীতল কণ্ঠে সিয়ার ভীতর শুদ্ধ নড়ে উঠে ভয়ে।সিয়া হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। সিয়ার কোনো জবাব না পেয়ে।অনিক এইবার আর নিজের রাগ সামলাতে পারলো না।ভয়াবহ রেগে চিৎকার করে উঠে,’ ছেলেটা কে ছিলো সিয়া?জাস্ট আন্সার দ্যা কুয়েশ্চেন।কে ছিলো?’

কথাটা বলার সময় অনিক সিয়ার হাতে প্রচন্ড জোড়ে চাপ দিচ্ছিলো।ব্যথায় সিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে।সহ্য করতে না পেরে সিয়া সজোড়ে চ’ড় মেরে দেয় অনিক।সিয়ার দেওয়া চ’ড়টা যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে বসল।অনিক প্রচন্ড রেগে সিয়ার গাল চেপে ধরল।অন্য হাতে সিয়ার চুল।এতোটাই চাপ দিয়ে গালগুলো ধরেছে যে মনে হচ্ছে সিয়ার জান বের হয়ে যাবে।সিয়া শব্দ করে কেঁদে উঠল।কিন্তু সেই কান্না অনিকের মন গলাতে পারলো না।আজ রাগে অনিক নিজের দিক বেদিক ভুলে বসেছে।সে চিৎকার করে বলে উঠে,’ আমাকে তোর ভালোলাগে না।আমার সাথে তুই সম্পর্ক রাখবি না।আমাকে তুই বিয়ে করতে পারবি না।তুই নানান বাহানা দিয়ে আমাকে বার বার রিজেক্ট করেছিস।কিন্তু তলেতলে ঠিকই নাগড় জুটিয়ে রেখেছিস।সেই নাগড় এখন এখানেও এসেছে।তার সাথে আবার রাতের অন্ধকারে দেখাও করছিস।আর সবার সামনে তুই ইনোসেন্ট সাজিস।বুঝাস তুই ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিস না।আরে তুই আমাকে বলিস আমি প্লেবয়। আমি তোকে ঠকিয়েছি।তোকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করেছি।আরে হ্যা করেছি।তো?আমি যা করেছি সবার সামনে করেছি।আমি যেমন সবাই আমাকে তেমনভাবেই দেখেছে।কিন্তু তুই?তুই কি হ্যা?তুই তো একটা চরিত্রহীনা।রাতের অন্ধকারে প্রেমিকের সাথে গিয়ে নিজের ইজ্জত বিলিয়ে আসিস।আর দিনের আলোতে ভদ্রতার মুখোশ পরে সবার সামনে ঘুরে বেড়াস।আরে তুই আমাকে কি রিজেক্ট করবি?আমিই তোকে রিজেক্ট করলাম।তোর মতো চরিত্রহীনার পিছনে আমি অনিক আর কখনও সাবো না।চরিত্রহী…..’

বাকিটা আর অনিক বলতে পারলো না।তার আগেই চোয়াল বরাবর শক্ত হাতের শক্তিশালী একটা ঘুষি খেলো।ঘুষিটা এতো জোড়েই ছিলো যে অনিক ছিটকে মাটিতে পরে গিয়েছে।সিয়াও পরে যেতে নিয়েছিলো।তার আগেই অথৈ সিয়াকে ধরে ফেলে।অনিনের নাক থেকে গলগল করে রক্ত পরছে।ঠোঁট ফেটে রক্ত পরছে।
একটা ঘুষি মেরে যেন রুদ্রিক শান্তি পেলো না।আবারও তেড়ে গিয়ে অনিকের কলার ধরে ওকে সোজা করে দাঁড় করালো।তারপর কোনোকিছু না ভেবেই আবারও ঘুষি মারলো।আরেক গালে।এরপর অনিকের পেটে।ইচ্ছেমতো মারল।রুদ্রিকের মারের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আগেই নীল আর সাফাত গিয়ে ধরল রুদ্রিককে। আর সাফাত ধরল অনিককে।অনিকের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এতেও যেন রাগ কমছে না রুদ্রিকের।রুদ্রিক রাগে চিৎকার করে উঠে,’ তোরা কেনো আটকাচ্ছিস আমায়?কেন?ওর জন্যে?’

আবার অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে,’ আরে এই তুই এমন জা/নোয়ার হলি কবে থেকে রে?তুই সিয়াকে এসব কথা বলার সাহস কোথায় পাস?তুই যেই মুখ থেকে সিয়াকে চরিত্র/হীন বলেছিস আমি সেই ঠোঁট ছিড়ে ফেলব।ছাড় আমায়।তোকে বন্ধু ভাবতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে।যেই ছেলের মন মানুষিকতা এতো খারাপ সে আমার বন্ধু কখনও হতে পারে না।তাকে আমি আমার বন্ধু মানি না।’

নীল আর ইহান রুদ্রিককে টেনে সরিয়ে আনল।সাফাত অনিককে ধরে নিয়ে আসতে নিলে।অনিক সাফাতের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনে।তারপর নিজেই টলতে টলতে সিয়াদের কটেজের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে সিয়া অনবরত কাঁদছে।আজ যেন ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে।যাকে সে মনের সবটা দিয়ে ভালোবাসল আজ তার মুখ থেকে এমন সব কথা শুনেছে। যা শোনার আগে সিয়া মরে কেন গেলো না।অনিকের বলা প্রতিটি কথা ওকে ভীতরে ভীতরে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।আজ যেন নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছে কেন সে ভালোবাসল অনিককে?কেন এইভাবে নিজের সবটা উজাড় করে পাগলের মতো ভালোবাসল?অথৈ সিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বলে,’ আপু কেঁদো না আর। থামো আপু।অসুস্থ হয়ে যাবে আপু।’

সিয়া জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।অনেক কষ্টে নিজের কষ্টগুলোকে ভীতরে চাপা দিয়ে দিলো।না এইভাবে কাঁদলে চলবে না।আজ যেসব কথা অনিক বলেছে তার মুখ্য জবাব দিতেই হবে।নাহলে নিজের বিবেগের কাছে সিয়া ছোটো হয়ে যাবে।সিয়া নিজের চোখ মুছে নিলো।অথৈ থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই অথৈ বলে,’ আপু তুমি…’
‘ আমি ঠিক আছি অথৈ। চিন্তা করো না।’

অথৈ আর কিছু বলল না।সিয়া নিজেকে কঠোর রূপে রূপান্তরিত করল।একপা একপা করে এগিয়ে যায় অনিকের দিকে।অনিকের অবস্থা অনেক খারাপ।সিয়াকে নিজের কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে অনিক নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

সিয়া শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমি রাতের অন্ধকারে কার সাথে দেখা করেছি।কি করেছি! এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে মি.অনিক হাসান?আপনি কে হোন আমাকে প্রশ্ন করার?কেউ না।কেউ নন আপনি আমার।তবে কেন আমাকে চরিত্র/হীন বললেন?কোক সাহসে?বলুন কোন সাহসে?’

সিয়া সজোড়ে চড় মেরে বসল অনিকের গায়ে।
তারপর আবার চিৎকার করে বলে,’আমাকে আপনি রিজেক্ট করেছেন তাই নাহ?আরে আপনি আমার জীবনে এক্সিট করলে তো আমায় রিজেক্ট করবেন?আপনি তো আমার জীবনে কোনো ম্যাটারই করেননা।তবে কোন সাহসে আমাকে এসব বিশ্রি কথাগুলো বললেন?’

আবারও চড় মারলো সিয়া। অনবরত পাঁচ ছয়টা চড় মারলো।অনিক কিছুই বলল না।ও শুধু স্তব্ধ হয়ে সিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
সিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।কান্নায় ভেঙে পরল।

‘ তোরা সবাই শুনে নেহ এই লোকটাকে…এই লোকটাকে ভালোবেসে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাপ করেছি।যেই পাপ কোনোদিন মাফ করা যাবে না।ঠিক শুনেছেন মি.অনিক হাসান।আপনাকে ভালোবেসে আমি সবচেয়ে বড়ো পাপ করেছি।আজ নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা হচ্ছে।যে আমি কিনা এমন জঘন্য মন মানুষিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে ভালোবেসেছি।’

সিয়ার কথা একেকটা কথা যেন অনিকের পুরো সত্তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে যে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা আজ করেছে।

সিয়া দুহাতে চোখ মুছে নিলো।কিন্তু বেহায়া চোখের জল আবারও গাল বেয়ে গড়াতে লাগল।সিয়া ভেজা কণ্ঠে বলে উঠে,’ আজ আমার বন্ধু বান্ধব।আরও যারা আছে।এই আকাশ,বাতাশ সব কিছু সাক্ষি রেখে আমি বললাম।আপনার প্রতি আমার যেই ভালোবাসা মনের মধ্যে আছে তা এখানেই এই মেঘালয়ের মাটিতেই আমি কবর দিয়ে দিলাম।আজ থেকে আমার মনের মধ্যে অনিক হাসান নামক মানুষটির জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই।আজ আমি নিজ হাতে তা মাটি চাপা দিয়ে দিলাম।তবুও যদি এই বেহায়া মন আপনাকে আবারও কোনোদিন স্মরণ করে।তাহলে আজকের ঘটনা মনে করব আমি।আর সেদিন নিজেকেই নিজে শেষ করে দিবো।এটা আজ আমি ওয়াদা করে গেলাম।’

কথাগুলো বলেই সিয়া কাঁদতে কাঁদতে নিজের কটেজে চলে গেলো। অথৈ,রিধি,পিহু,মারিয়া ওরা সবাই সিয়ার পিছু পিছু চলে গেলো।

এদিকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে অনিক।কি করে ফেলল সে আজ? এ কি করে ফেলল?এইভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এতোবড়ো কষ্ট,আঘাত কিভাবে দিয়ে ফেলল?এইজন্যেই বলে রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।মানুষকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে দেয়।তাদের দ্বারা এমন সব পাপকার্য করিয়ে ফেলে যা কোনোদিন জীবন থেকে মোছা যাবে না।

ইহান অনিকের কাছে এসে বলে,’ তুই তো আমাদের বন্ধু?তাই না রে অনিক?তাহলে তোর মন এমন কুৎসিত কেন রে?তুই নিজের ভীতরে এসব পুষে আছিস? তুই যে আমার বন্ধু ভাবতেই আমার ঘৃনা হচ্ছে।’

নীল বলে,’ মেয়েটা তোকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিলো অনিক।আজ তুই সেই ভালোবাসা একেবারে নিজ হাতে গলা টিপে নিঃশেষ করে দিলি।কিভাবে পারলি অনিক?একবারও তোর বুক কাঁপল নাহ?ওইসব ভাষা উচ্চারণ করতে একবারও বিবেকে নাড়া দিলো নাহ?এতোটা খারাপ তুই কবে হলি?’

রুদ্রিক রাগি গলায় বলে,’ তোরা কাকে কি বলছিস?ওকে ওকে এসব বলে লাভ নেই।যেই মানুষটার হৃদয় নোংরামো চিন্তাভাবমায় ঠাসা।সেই মানুষটার এসব কথাতে কোনোকিছু যায় আসবে না।আর কিসের বন্ধু?ও কোনোদিন আমাদের বন্ধু ভেবেছিলো?যে ও আমাদের কথা চিন্তা করবে?কিসের ভালোবাসার কথা বলে ও?ও সিয়াকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি।যদি ভালোইবাসত।তাহলে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে এমন জঘন্য/নোংরা কথা বলতে পারতো নাহ।’

এই বলে রুদ্রিক চলে গেলো নিজের কটেজে।নীল আর ইহানও চলে গেলো।অনিক একা রয়ে গেলো।একটু পর সাফাত আসলো।ও-ও চলে গিয়েছিলো।এখন আবার এসেছে।সাফাত এসে অনিকের পাশে এসে দাঁড়ালো।অনি তা দেখে ভাঙা গলায় বলে,’ তুই..তুই কেন এসে..এসেছিস?’

সাফাত কিছু না বলে অনিককে ধরে একটা বেঞ্চে নিয়ে বসালো।এখানে একেক জায়গায় বেঞ্চ বানানো।যেখানে মানুষ বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য লুফে নেয়।সাফাত ফার্স্টএইড বক্স বাহির করল।তুলোতে হেক্সোসেল লাগিয়ে অনিকের আঘাতে চেপে ধরল।তা পরিষ্কার করতে লাগল।অনিক টু শব্দ করল না।আজ এই আঘাতগুলোতে বিন্দু পরিমান ব্যথা অনুভব করছে না।ও যা করেছে এর বিনিময়ে তা কমই হয়েছে।অনিক আবার বলে,’ চ..চলে যাহ সা..সাফাত।এসবের দর..দরকার নেই।আমি ঠিক আছি।’

সাফাত কিছুই বলল না।চুপচাপ অনিকের ব্যথাযুক্ত স্থানগুলো পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।তারপর অনিককে জোড় করে একটা ব্যথার ঔষুধ খাইয়ে দিলো।কাজ শেষ করে সাফাত উঠে দাঁড়ালো।অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলে উঠল,’ রাগের কারণে মানুষ শুধু তার জীবন নষ্ট করে না, অন্য মানুষের হৃদয়েও আঘাত করে।আর আজ তা তুই করেছিস।এরপর সিয়ার আশেপাশেও যেন তোকে না দেখি।সিয়াকে পাবার আশা চিরতরে ত্যাগ করে দে।তাহলে তোর জন্যেই ভালো হবে।কথাটা আমলে নিয়ে নিস।’

একটু থেমে আবার বলল,’ রাত হচ্ছে তোর কটেজে ফিরে যা।’

সাফাত হনহন করে চলে গেলো।সাফাত যেতেই অনিক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।আজ নিজ হাতে সব শেষ করে দিলো না।বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সব হারিয়ে ফেলল।কেউ তাকে চায়না।সবাই তাকে এখন ঘৃনা করে।কি করবে অনিক?ঠিক কি করলে আগের মতো সব ঠিক হবে?মনের ভীতর থেকে আওয়াজ আসল।
‘ আর কিছু ঠিক হবে না অনিক।কিচ্ছু ঠিক হবে না।তুই হ্ব্রে গেছিস অনিক।গেরে গেছিস।’

অনিক দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল।বলে উঠল,
‘ আ’ম সরি সিয়া। আ’ম রেয়েলি ভেরি সরি।আমি এমনটা করতে চায়নি সিয়া।করতে চায়নি।আ’ম সরি এভ্রিওয়ান।সরিইইইইইই।’

#চলবে_____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here