মন দিয়েছে ধরা পর্ব -১৫

১৫

রিপের ফোনটা বেজে উঠলো ছাদের দিকে পা বাড়ানোর সময়। রিক ফোন করেছে। রিপ ফোন তুলতেই রিক অধৈর্য গলায় বলল

পৌঁছেছিস?

হ্যা।

খাসনি?

না।

নীরার সাথে খেয়ে নে। আমাদের আসতে দেরী হবে। তোকে ফোন দেব দরজা বন্ধ করে দিস।

আচ্ছা।

রিক ফোন রেখে দিতেই রিপ ছাদের পা বাড়ালো। পা দুটো তার কাঁপছে। ভেতরের অস্থিরতা কমছে না। ঘেমে উঠেছে ললাট। হাতের কব্জি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ছাদের দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। অন্ধকারে ডুবে আছে ছাদের একোণ-ওকোণ। রাতের আকাশে দু একটি তারা দেখা যাচ্ছে। মন্দীভূত বাতাস। সে আতঙ্কিত গলায় ডাকলো

নীরাহ!

নীরা কোপিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে মাথা কাত করে চোখ বুঁজে আছে। হয়ত ঘুমিয়ে গেছে। চোখমুখ স্ফীত, ফ্যাকাশে, পান্ডুর। খোঁপাটা ঢিলে হয়ে এসেছে। বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল রিপের। শব্দহীন পায়ে নীরার কাছে হেঁটে গেল সে। রিপের উপস্থিতি টের পেয়ে ধীরেধীরে চোখ মেললো নীরা। চোখদুটোর অবস্থা দেখতে ভয়ংকর। রিপের কোথাও একটা ভীষণ খারাপ লাগলো। দুমড়েমুচড়ে গেল। যেন এ তার পূর্বের প্রতিচ্ছবি। নিজের প্রতিভিম্ব আজ তার সম্মুখে। সে অনুভব করতে পারে এই নিদারুন মর্মপীড়া।

নীরার সামনে সিমেন্টের বাঁধাই করা শানে বসলো সে। নীরা জর্জরিত চোখে তাকালো। রিপ ধীরেসুস্থে শান্ত মোলায়েম কন্ঠে বলল

তোমার এখানে ভয় করছে না?

নীরা চেয়ে রইলো নির্নিমেষ।

ভয়?

ঘরে যে একা থাকতে ভয় করে।

আমি আমার জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হয়েছি। ভয় কেটে গিয়েছে।

তোমার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছিনা। ওঠো। খাবে চলো। দেখো আমি কত তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।

রিপ হাত ধরতেই ও হাত ছাড়িয়ে নিল সাথে সাথেই। চোখেমুখে আগুনের লালিমা যেন। অক্ষিকোটর গলে হুমড়ে পড়লো কবোষ্ণ পানির ফোয়ারা। রিপ হতভম্ব।

তুমি যাবে না বলছো?

হ্যা বলছি। চলে যান।

কান্নায় ভেঙে পড়লো নীরা। রিপ ওর হাতটা আবারও ধরলো। বলল

নীরা স্টপ। কেন এমন করছো তুমি? আমি কি করে না যেতাম? অনেকদিন পর দু পরিবারের মনোমালিন্য কাটিয়ে উঠার একটা সুযোগ এসেছে আমি না গেলে কি হতো তুমি জানো না? আমি জানি আমার ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে তুমি এমন করছো না। কি কারণে এমন করছো সেটাও তো বলছো না।

নীরা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল

আপনি আমার সামনে থেকে যান। যান প্লিজ।

আমি যাব না। সবটা না জেনে আমি যাব না নীরা। তোমার এরূপ অবস্থা আমার দিকে আঙুল তুলে আছে। আমাকে বলতে হবে কি করেছি আমি। অতটা অসামাজিক তুমি না যে ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য তুমি এমন করবে। তাহলে কি হয়েছে?

কিছু হয়নি। আপনি আমাকে একা ছেড়ে দিন। চলে যান। আমার চাই না আপনাকে।

রিপ তার সম্মুখে গিয়ে বসলো। হাতটা নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে বলল

নীরা আমাকে বুঝার চেষ্টা করো। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না। আমি তোমার কাছ থেকে সময় নিয়েছিলাম। আমি আমার জীবনের সমস্ত ভুলগুলো তোমার কাছে অকপটে স্বীকার করেছি। কোনোকিছু লুকোয়নি। কোনোকিছু গোপন করিনি। আমি এও বলেছি আমার কারো প্রতি কোনো পিছুটান নেই, আমি সম্পূর্ণ নতুন একজন শুদ্ধ মানুষ হতে চাই। তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সাথে কোনো অন্যায় করতে পারি?

আপনি কোনো অন্যায় করেননি। সব দোষ আমার কপালের। আমি আমার স্বপ্নের সাথে বাস্তবতাকে মেলাতে গিয়েছি তাই আমার এই দশা। আমার আবদারটা অন্যায় ছিল। ভুল মানুষের কাছে ভুল আবদার। আমায় ক্ষমা করুন। কোনোদিন কোনোকিছু চাইবো না আপনার কাছে। কোনোদিন না।

আমি ভুল মানুষ?

আমার জন্য ভুল। আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি, ঘর বেঁধেছি, স্বপ্ন দেখেছি। আপনার কাছে আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। নিতান্তই তুচ্ছ একটা জীব আমি আপনার কাছে। আপনার কাছে কাজ, আপনার ইগো আর আপনার দায়িত্ব সবকিছুর উর্ধ্বে। আমি কোথাও নেই। লোকদেখায় আমি আপনার সহধর্মিণী প্রকৃতপক্ষে আমার আপনার সম্পর্কটা এতটাই ঠুনকো যে টান দিলেই ছিঁড়ে পড়বে। আমি এমনটা কখনো চাইনি। আমি এমন একজন মানুষ চেয়েছিলাম যার কাছে আমার গুরুত্বটা সবচাইতে বেশি থাকবে অথচ আমার জীবনে এমন একজন মানুষ এল যার কাছে আমার কোনো মূল্যই নেই।

তুমি আমাকে ক্রমশ ভুল বুঝে যাচ্ছ। অথচ আমি মনে করেছি সবকিছু ভালো যাচ্ছে। আমি ঠিকঠাক একজন মানুষকে পেয়েছি যে আমাকে পুরোপুরি বুঝতে পারে। কিন্তু না তুমি আমাকে একটুও বুঝো না নীরা। ছিটেফোঁটাও না।

নীরা কেঁদেই যাচ্ছে। রিপ ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল

এই, তুমি কি চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছো?

নীরার চোখগুলো এতক্ষণ অন্যদিকে ঘুরানো ছিল। এবার সে রিপের চোখ বরাবর তাকাল। গড়গড়িয়ে চোখের পানি পড়লো আর সে উত্তর দিল

হ্যা। আপনি অন্তত নিশ্চিন্তে আপনার দায়দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

রিপ অসহায়ত্ব লুকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,

আরেহ সাবাশ। যাও তবে। দেরী করছো কেন? যাও। আটকে রেখেছে কে? এগিয়ে দেব? ব্যাগপত্র গুছিয়ে দেব? চলো এগিয়ে দিই।

নীরাকে টেনে তুললো সে। নীরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল

আমি জীবনেও ফিরব না আর।

রিপ তার দিকে অগ্নিতূল্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল

বেশ ভালো খবর। তোমাকে আটকে রাখার সাধ্য কার? আমার অন্তত নেই। আমি খারাপ মানুষ।

নীরার কান্না থামে না।

রিপ ধমকে উঠে বলল,

কেন কাঁদছো এইভাবে? কান্নার কি বলেছি আমি, কি করেছি? তোমাকে ঠকিয়েছি? তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি? কি করেছি? শুধুমাত্র ওই বাড়িতে গিয়েছি বলে? ইশুর অনুরোধ রেখেছি বলে? তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কেন গিয়েছি। আমার বন্ধুর অনুরোধ রক্ষার্থে আমি গিয়েছি। একটা সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে আমি গিয়েছি। এতেই আমার দোষ হয়ে গেল? চলো তোমাকে দিয়ে আসি। আমি মরে গেলেও আসবে না এটা কথা দিয়ে যাবে। শুনেছ আমার কথা? কান্না থামাতে বলছি নীরাহ।

নীরা কান্নাদের থামাতে পারে না। সে কখনোই এসব চায়নি। সে ছেড়ে গেলে যদি আবারও মানুষটার সত্যি সত্যি কিছু হয়ে যায়? এভাবে তার স্বপ্নগুলো ভেঙে যাবে? তার কত শখের ঘর, সংসার, স্বামী।

নীরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। নড়লো না একপাও। রিপ ঘাড় ফিরিয়ে বলল

কি হলো? কি চিন্তা করছো? আপোস করার চিন্তা করছো? আমার সাথে? ভুলেও করোনা। কখনো যদি তোমাকে ঠকায়, তোমার সাথে প্রতারণা করি, বেইমানি করি? একদম সুযোগ দিও না। আমি বড়ই সুযোগসন্ধানী। চলো।

নীরা ঠোঁটউল্টে কেঁদে বলল

আমাকে এভাবে টানবেন না।

রিপ তার পায়ের দিকে তাকালো। বুড়ো আঙুলটা ফুলে ডবডবে হয়ে আছে।

পায়ে কি হয়েছে?

হোঁচট খেয়েছি।

অন্ধকারে ছুটলে তো হোঁচট খাবেই।

রিপ ওকে পাঁজা খোলা করে তুলে নিল। নীরা কিচ্ছু বললো না। শারিরীক মানসিক যন্ত্রণায় সব অবশ লাগছে। এসব দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক।

ঘরে এনে রিপ বিছানা বসিয়ে দিল নীরাকে। নীরা চোখ বন্ধ করে আছে। ফোলা চোখদুটোতে হাত লাগাতে পারছে না। ব্যাথা করছে। রিপ ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলল

গতবার অনেককিছু ফেলে রেখে গিয়েছ এবার একটা জিনিসও রেখে যাবে না। আরেকটা কথা আমি তোমাকে পাত্তা দিই না তুমিও আমাকে দেবে না। আমি তোমাকে মূল্য দিই না তুমিও দেবে না। আমি তোমাকে দু পয়সার মূল্য দিই না তুমি আমাকে এক পয়সারও দেবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা তুমিও আমাকে ভালোবাসবে না।

আজ স্বীকার করেছেন তবে।

রিপটা ব্যাগ গোছানো থামিয়ে তার দিকে তাকালো।

কি যায় আসে তাতে? অস্বীকার করলে থেকে যাবে? থাক অত দয়া না দেখালেও চলবে। এত জঘন্য একটা মানুষের সাথে কি ঘর করা যায়? আগে ভাবতাম দোষ তাদের যারা আমাকে বুঝতে পারেনা এখন বুঝতে পারছি দোষ আসলে আমার। ঠক, প্রতারক, জোচ্চর আমি। তুমি কি কাল সকাল অব্দি একটু অপেক্ষা করতে পারবে প্লিজ? আমার মাথা ব্যাথা করছে খুব। মনে হচ্ছে রগ ছিঁড়ে যাবে। একটু ঘুম দেব। আই প্রমিজ আর একটা রাতও তোমার এই ফালতু মানুষটার সাথে কাটাতে হবে না।

নীরা আর্ত দৃষ্টিতে তাকালো। তাকিয়েই থাকলো। রিপ ব্যাগটা ফেলে তার কাছে এল।

উত্তর দিচ্ছ না কেন? এখনি চলে যাবে? সকাল অব্দি থাকবে না?

নীরা কথা বলে না। নিঃশব্দে জল গড়াতে থাকে গাল বেয়ে।

রিপ মাথার দু’পাশে চেপে ধরে বসে পড়ে নীরার সামনে। ধীরেধীরে মাথাটা তুলে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলে

শুধু একবাড়িতে, একঘরে, পাশাপাশি ছিলে নীরা। আমার জীবনে কোথাও কি ছিলে তুমি? নাহলে কি করে একটা মানুষকে তুমি এতটা ভুল বুঝতে পারো? এখন আমি বেশ বুঝেছি কেন তুমি যেতে দিতে চাওনি। আমাকে অতটা হীন না ভাবলেও পারতে। অথচ দেখ আমি তোমার সাথে নতুন জীবনের রঙিন খাতায় নাম লিখিয়েছি মাত্র ক’দিন হলো। তন্মধ্যেই তোমার চলে যাবার কত বাহানা। তবে এলে কেন? চলেই যখন যাবে তখন এত রঙ চেনালে কেন? উত্তর আছে তোমার কাছে?

নীরা উত্তর দিল না। ভুলটা তার হলেও একপ্রকার ভালোই হয়েছে। আজ কত প্রশ্নের উত্তর পেল সে।

কি হলো? উত্তর দাও।

ঘুম থেকে উঠার পর পাবেন।

রিপ ঘুমিয়ে পড়লো। নীরা জেগে থাকলো। আঙুলে যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকটা জ্বালাপোড়া করছে। পা টিপে টিপে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখলো দুজনের জন্য খাবার। মানুষটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো? সে ধীরপায়ে হেঁটে রিপের পাশে বসলো। নীচু হয়ে এই প্রথম নিজের ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো রিপের ললাটে। গভীর আশ্লেষে।

তারপর চলে গেল নীচে।

ঘুম ছোটার সাথে সাথেই নীরাকে দেখতে পেল না রিপ। ঘর অন্ধকার। বিছানা থেকে নেমে ঘরে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই নীরাকে দেখতে না পেয়ে খালি পায়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নীরা নীরা বলে ডাকতেই নরমতরম একটা হাত এসে চেপে ধরলো তার মুখ। ফিসফিসিয়ে বলল

ওরা এসেছে। দরজা খুলে দিতে গিয়েছি।

রিপ তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে অন্ধকারে আবছা আলোয় নীরার মুখটা দেখে কি অপূর্ব এক শান্তি পেল তার বর্ণনা সম্ভব নয়। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রাখলো। নীরা তার বাহুবন্ধনে সুখের আবেশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল

আমি তো কালই চলে যাব।

ভালোবাসলেই মানুষ দূরে চলে যায় তাই আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসব না নীরা।

আমি যে ভেসেছি।

এজন্যই তো ছেড়ে যাচ্ছ।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here