মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -১১

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজনা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-১১
.
চার বছর পর,
আজ এগার বারের মত পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে পৃথুলাকে। এর আগে পর পর দশটি বিয়ে ভেঙে গেছে তার। সুন্দরী পৃথুলাকে এক পলক দেখেই যে কোনো ছেলে ওকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। কিন্তু খানিক বাদেই যখন পৃথুলার মুখ থেকে ওর অতীতের কিছু অনাকাঙ্খিত সত্যি শোনে, তখন দ্রুতই পৃথুলার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এভাবেই প্রতিবার পাত্রী পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপারটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না।
পৃথুলা জানে, আজও এর অন্যথা হবে না। কারণ, ও ধর্ষিতা জানার পর কোনো ছেলেই ওকে বিয়ে করবে না।

আজ যে ছেলেটা পৃথুলাকে দেখতে আসবে সে পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। নাম অভ্র। ছেলে ভালো, পরিবারও ভালো।

পৃথুলা আকাশী আর সাদা রঙের মিশেলে একসেট সালোয়ার – কামিজ পরেছে। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় ওড়না টেনে নিয়েছে।
মিসেস মাহিমা বেগম রুমে ঢুকলেন। পৃথুলাকে দেখে বললেন,
“উনারা এসে গেছেন পৃথুলা। তুই রেডি?”
পাশ থেকে প্রত্যাশা বলল,
“রেডি আর কই! কোনো সাজগোজ নেই। বললাম, অন্তত চোখে একটু কাজল টেনে দিই। সেটাও রাজি হলোনা।”
মাহিমা বেগম কিছু বললেন না। পৃথুলাকে বলে লাভও নেই। সে এমন নরমাল ভাবেই যাবে পাত্রপক্ষের সামনে।
পৃথুলা মায়ের দিকে তাকাল। তরঙ্গহীন গলায় বলল,
“আর কতবার এভাবে সঙ সেজে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হবে? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি মা। প্রত্যাশা বড় হয়েছে। এবার ওর কথা ভাব। ওকে বিয়ে দাও।”
“বড় মেয়ে থাকতে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে যাব কোন দুঃখে?”
“সবার ভাগ্যে সব থাকেনা মা।”
মাহিমা বেগম মেয়ের কথায় বেশ আহত হলেন। আস্তে করে পৃথুলার পাশে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“একটা অনুরোধ রাখবি মা?”
পৃথুলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“আমি জানি তুমি কি বলবে। আমার ধর্ষন হওয়ার ব্যাপারে পাত্রকে যেন কিছু না বলি তাইতো?”
প্রত্যাশা বলল,
“কেন বলতে যাস বলতো আপি? কত ভালো ভালো সম্বন্ধ আসে। প্রত্যেকবারই ছেলেপক্ষের সবাই তোকে পছন্দ করে। কিন্তু তুই বারবার সব ভেস্তে দিস। কি দরকার ওসব বলতে যাওয়ার? ‘ধর্ষিতা’ শব্দটা কি তোর গায়ে লেখা আছে? ঐ ঘটনার চারটা বছর পেরিয়ে গেছে। সমাজের মানুষ ওসব ভুলে গেছে।”
“আমি তো ভুলতে পারিনি। মৃত্যুর আগ অবধি ভুলতে পারব না। ওই মুহূর্তটা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়াতে থাকে।”
মাহিমা বেগম বললেন,
“ওসব ভুলে যা মা। আজ অনেক ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটা মাশাআল্লাহ রাজপুত্রের মত দেখতে। ভালো চাকরি করে। ওই ছেলেটাকে তোর অতীত নিয়ে কিছু বলিস না মা।”
“সম্ভব না। আমি কাউকে ঠকাতে পারবনা।”
“ঠকাতে যাবি কেন?”
“তোমার মেয়ে একজন ধর্ষিতা মা। তোমার মেয়ে এই সমাজের কলঙ্ক।”
“পৃথুলা!”
“জেনেশুনে কেউ একজন ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করবে না মা। আর না জানিয়ে বিয়ে করা মানে তাকে ঠকানো। সত্যিটা জানার পর কেউই রাজি হবেনা বিয়ে করতে৷ না জানিয়ে ঠকিয়ে বিয়ে করার চেয়ে বিয়ে না হওয়াই ভালো।”
“কিন্তু সারাজীবন তুই এভাবে কাটাবি? বিয়ে করবিনা?”
“আমি তো বললাম এসব বাদ দাও। ক’দিন পর পর এদিক ওদিক থেকে মেয়ে দেখতে আসে। আর আমাকেও সঙয়ের মতন পাত্রপক্ষের সামনে যেয়ে বসে থাকতে হয়। বন্ধ করতে পারোনা এসব? বিয়েটা কি জীবনে খুবই জরুরি? বিয়ে না করলে কি হয়? তোমাদের ধর্ষিতা মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন কেন দেখ মা? আমিতো এখন জীবন্ত লাশ হয়ে গেছি।”
মাহিমা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

প্রত্যাশা হাত রাখল বোনের কাঁধে। পৃথুলা বলল,
“জানিস প্রত্যাশা, সেই বিভৎস ঘটনার পরও আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়িনি। নিজেকে শক্ত রেখেছিলাম এটা ভেবে যে, সমাজের লোকেরা যা বলার বলুক, বিভোর তো আমার পাশে আছে। ও কখনোই আমার হাত ছাড়বে না। ওকে নিয়ে সারাজীবন কাটাব। কিন্তু তা হলোনা। বিভোর আমার মনটা ভেঙে দিল। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমি একজন ধর্ষিতা। আচ্ছা প্রত্যাশা, আমার ধর্ষনের জন্য কি আমি দায়ী? আমার কি কোনো দোষ ছিল?”
প্রত্যাশা কিছু বলার আগে পৃথুলা নিজেই স্বগতোক্তি করল,
” হয়তো আমারই দোষ ছিল। নয়তো বিভোর আমাকে ছেড়ে দেবে কেন?”
.
পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে পৃথুলা, মাথা নিচু করে৷ ছেলের মা, ছোট ফুপি আর ছেলে নিজে এসেছে৷ ছেলের ফুপি পৃথুলাকে দেখেই প্রশংসার বাক্য ছুঁড়ে দিয়েছেন। পৃথুলা মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসি হাসল। যখন জানবে সে ধর্ষিতা, তখন এই প্রশংসার বদলে উল্টো মুখ ঘুরিয়ে নেবে। ছেলের মা আঞ্জুমান পৃথুলার পাশে এসে বসলেন। পৃথুলার থুতনিতে চুমু খেয়ে বললেন,
“মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে৷ এমন মেয়েকে পছন্দ না হয়ে উপায় নেই।”
মাহিমা বেগম ও আনিসুল ইসলাম ভদ্রতাসূচক হাসি হাসলেন। ছেলের ফুপি মাহিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আপা, আমাদের তো পছন্দ হয়েছেই, আমাদের ছেলেরও আপনাদের মেয়েকে অপছন্দ হয়েছে বলে মনে হয়না। তবুও ওরা একসাথে সারাজীবন কাটাবে, ওদের মধ্যে একটু বোঝাপড়া দরকার। তাছাড়া, আপনাদের মেয়েরও তো একটা মতামত আছে। আমার মনে হয়ে ওদের একটু স্পেস দেওয়া দরকার।”
মাহিমা বেগমের মুখের হাসি উবে গেল। তিনি খুব ভালোমতই জানেন, এ সুযোগেই পৃথুলা ছেলেকে সব বলে দেবে। ছেলেটাকে বড্ড পছন্দ হয়েছে মাহিমা বেগমের। কিন্তু…
দীর্ঘশ্বাস লুকালেন তিনি। আনিসুল ইসলাম বললেন,
“তা ঠিক বলেছেন। পৃথুলা, অভ্রকে নিয়ে তোর ছাদে ঘুরে আয়।”

পৃথুলা উঠে দাঁড়ালো। অভ্রও উঠল। হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে এলো পৃথুলা৷ পেছনে অভ্র এলো। ছাদের এক কোণায় রেলিং ঘেষে দাঁড়ালো। অভ্র পাশে এসে দাঁড়ালে পৃথুলা খানিকটা সরে গেল। অভ্র মুচকি হেসে বলল,
“আমার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই।”

প্রত্তুত্যরে পৃথুলা কিছু বলল না৷ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখে শব্দ নেই। পৃথুলা রেলিং এ দুহাত ভর করে সামনে তাকিয়ে আছে৷ কিন্তু বুঝতে পারছে, পাশের লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
নীরবতা ভেঙে অভ্র বলল,
“আচ্ছা, আমার চেহারা টা কি এতটাই খারাপ, যে আপনি আমার দিকে একবার তাকালেন না পর্যন্ত। বুঝলাম আপনি লাজুকলতা। হয়তো ড্রইংরুমে সবার সামনে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন তো এখানে কেউ নেই। এখন অন্তত দেখুন এই জঘন্য চেহারার লোকটাকে।”

পৃথুলা কিছু বলল না। তাকালোও না।। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কিছুক্ষন পর অভ্র বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“হুম।”
“আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ? আপনি কি সম্মত নন বিয়েতে? ফ্যামিলি থেকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে? বয়ফ্রেন্ড কেস? স্যরি একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছি। তবে আপনার সমস্যাটা চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”
পৃথুলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল।”
অভ্রও পৃথুলার মত দুহাত রেলিং এ ভর করে দাঁড়াল। পৃৃথুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বলুন, শুনি।”
-“আমার একটা জঘন্য অতীত আছে। যেটা শুনলে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না।”
“আপনার মত সুন্দরীকে সহজে হাতছাড়া হতে দেব না৷ তবে হ্যাঁ, যদি বয়ফ্রেন্ড ঘটিত ব্যাপার স্যাপার হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। আপনার লাভ লাইফে বাগরা দেব না নিশ্চিত থাকতে পারেন।
“আমি ধর্ষিতা।”

হুট করে কথাটা শুনে চমকে গেল অভ্র। কয়েক সেকেণ্ড কাটল বিষ্ময়ে। ধাতস্থ হয়ে বলল,
“ঠাট্টা করছেন?”
পৃথুলা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“কোনো মেয়ে তার জীবনের এমন ব্যাপার নিয়ে কখনো ঠাট্টা করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
অভ্র নিশ্চুপ। এমন একটা কথা শুনবে এটা তার কল্পনাতীত ছিল।
“চার বছর আগে এই ধর্ষিতা তকমা টা আমার গায়ে লেগেছিল। আজও তা বয়ে বেড়াচ্ছি।”
অভ্র কিছুক্ষন নিরব থেকে বলল,
“ঘটনাটা আমাকে খুলে বলা যাবে?”

এর আগে দেখতে আসা কোনো ছেলেই এই প্রশ্নটি করেনি পৃথুলাকে। পৃথুলা ধর্ষিতা৷ এটুকুই ছিল তাদের জন্য যথেষ্ট। এই প্রথম অভ্র জানতে চাইল।
.
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here