মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_৩৭ #মৌরিন_আহমেদ

0
314

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৩৭
#মৌরিন_আহমেদ

– “আপনি আসলে কে? কী নাম আপনার? পরিচয়ই বা কী?.. রিসেপশনে লোকটা আপনাকে বর্ষণ বলে সম্বোধন করলো, কিন্তু আপনি আমাকে বলেছেন আপনার নাম ধ্রুব। আপনি ওখানে যে বিল্ডিংয়ে থাকতেন সেখানকার বাড়িওয়ালাও বলেছে আপনি ধ্রুব নন, তাহলে কে আপনি? কী করেন?.. আমি খুব কনফিউশনে আছি, দয়া করে নিজের পরিচয়টা গোপন করবেন না! প্লিজ!… আপনার এই পরিচয়ের উপর আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। দয়া করে চুপ করে থাকবেন না!… আমি দেখেছি, আপনি রিসেপশনের ওই লোকটাকে কী যেন একটা কার্ড দেখালেন আর অমনই উনি খাতাটা বের করে দিলেন। অথচ আমি এতক্ষণ ধরে সেধে সেধে কিচ্ছু করতে পারি নি।.. আপনি এখনও চুপ করে কেন আছেন? কথা কেন বলছেন না? বলুন না, প্লিজ!”

– “বলছি, অনা। আমাকে একটু সময় দাও। আমি তোমাকে সবটা খুলে বলছি…”

বলেই একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে ধ্রুব। অনন্যা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকে। সেটা দেখে বড় বড় করে শ্বাস টানে ও। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইছে। মনের কথাগুলো গুছিয়ে নিতে চাইছে। কারণ ও ঠিক করেছে অনুকে আজ সবটা বলবে। ওর জীবনের আদি-অন্ত-সব!

– “আমার নাম আসলে বর্ষণ। বর্ষণ রাইয়ান। ধ্রুব আমার সার্টিফিকেটেড নাম নয়.. আমার মায়ের দেয়া নাম। যেটা আমি সবখানে ব্যবহার করি না। কেন করি না.. সেটা জানতে চাও?. এরজন্য তোমাকে আরও কিছু গল্প জানতে হবে। আমার জীবনের শুরুর গল্পটা। তুমি কি শুনবে?”

বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনন্যার চোখের দিকে তাকালো। ওর চোখে অসীম আগ্রহ বিদ্যমান! মানে ও জানতে চায়, জানতে চায় ধ্রুবকে! ধ্রুব সম্পর্কে! একটা শ্বাস ফেলে ধ্রুব। আবারও বলতে শুরু করে,

– “আমার বাবা-মার লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। তাদের গল্পটা ছিল অনেকটা সিনেমাটিক। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়েছে তারা।.. মা যখন কলেজে পড়তেন তখনই বাবার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার অথবা সেকেন্ড ইয়ার হবে, আমি সঠিক জানি না।.. সিনেমার গল্পের মতোই পরিবার মানলো না কারোরই। কিন্তু উভয় পরিবারই নিজেদের ছেলেমেয়ে কে ফিরিয়ে নিতে ছিলেন উদগ্রীব!..

বাবারা পালিয়ে গিয়ে উঠেছিলেন বরিশালে, বাবার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে। সেখানে একমাস থাকার পর ফিরে আসেন শহরে। তবে পরিবারের কাছে নয়, পরিবার ছেড়ে দিয়ে উঠেন ভাড়া বাসায়। এখানে বলা বাহুল্য বাবা তখনও বেকার। সম্ভবত মাত্রই এইচএসসি পাশ করেছেন। বয়স দুজনেরই অল্প। চাকরি বাকরি নেই, নতুন সংসার, দুজনেই আনাড়ি। কেমন করে দিন কাটিয়েছে ভাবো একবার?.. আর্থিক সংকট ছিল সবচয়ে প্রখর! তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না কোনোখানে। অভাব অনটনের মাঝেও কানায় কানায় পূর্ণ ছিল ভালোবাসায়। এরই মাঝে বাবার আর্মিতে চাকরি হয়ে গেল। বলে রাখি, আমার বাবা দেখতে ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন। সাউথ ইন্ডিয়ান নায়ক মহেশবাবুর মতো তার চেহারা ছিল। লম্বা-চওড়া, একেবারেই হিরো! চাকরি হয় তো সেই কপালেই পেয়েছিলেন!..

যাই হোক, এর মধ্যে কিন্তু কারো পরিবারই তাদের থাকার খোঁজ পায় নি। কিন্তু চিরুনি তল্লাশি তখনও অব্যাহত ছিল। হঠাৎ বাবার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড এসে খবর দিলো আমার দাদাজান নাকি ওনাকে ডেকেছেন। বৌ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে উঠতে বলেছেন, তারা নাকি সব মেনে নিবে।.. আমার নানা ছিলেন এই গল্পের প্রথম ভিলেন। যিনি কী না কখনোই চান নি তার একমাত্র মেয়ের জন্য আর্মির সাধারণ সৈনিক একটা ছেলেকে বেছে নিতে। তাও তারা যখন বিয়ে করেছেন তখন সে ছিল বেকার!..

নানা আমার বেজায় রাগী, মেয়ে না বলে পালিয়েছে মানতে পারেন নি। খুঁজছিলেন পাগলের মতো। পিছনে লাগিয়েছিলেন গুন্ডাও। পরিস্থিতি যখন এই, তখন নিজের বাবার আশ্রয় পেয়ে নিজেকে অনেক নিরাপদ মনে করলেন বাবা। কোনো কিছু না ভেবেই বৌকে নিয়ে উঠে গেলেন বাবার বাড়ি। মার তখন দ্বিমত করার উপায় নেই, তিনি নিজেও জানেন তার বাবা কী ভয়ঙ্কর!..

সবকিছু ঠিকই চলছিল। মাকে শ্বশুরবাড়িতে উঠতে দেখে নানাও দমে গিয়েছিলেন। গুন্ডা-পান্ডা ছাড়িয়ে, একপ্রকার বাদই দিলেন মায়ের আশা। এদিকে শ্বশুড় বাড়িতে যে মার অবস্থানটা খুব একটা ভালো ছিল তা নয়। একে অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করেছেন, তাতে ছিলেন আনাড়ি, সংসারে অপটু। স্বাভাবিক ভাবেই উঠতে-বসতে বকা-ঝকা খেতে হতো শাশুড়ির। সাথে ননদের অত্যাচার তো আছেই। তাও সেসব গায়ে মাখেন নি মা। কারণ তার নিজেরও তো দোষ ছিল।…

বিয়ের এক বছরের মাথায় কনসিভ করেন মা। আমি তখন পেটে। খবরটা বাবাকে জানাবেন কিন্তু তার আগেই বাবা তাকে শুনিয়ে দিলেন আরেক খবর। মিশনে যাওয়ার জন্য বাবার নাম এসেছে!.. আর বাবা সেখানে যাবেন। ব্যাপারটা কিছুতেই ভালো লাগে নি মায়ের। অনেক কিছু বলে-কয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন যেন পারেন নি। বাবার ভাষ্যমতে আর্মিতে জয়েন করার পর তার মনের ভেতর এক বিশাল পরিবর্তন আসে। সৃষ্টি হয় অগাধ দেশপ্রেম, আর মানবতার কল্যাণের চিন্তা। তাই তখন কিছুতেই মিশনে যাওয়ার মতো ভালো একটা সুযোগ কে মিস করতে চান নি উনি। মায়ের শত বাধাকে অতিক্রম করে চলে যান কঙ্গোতে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে…

উনি চলে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের উপর নেমে আসে তার শশুরবাড়ির লোকের নির্যাতন। তার দুই ননদ আর শাশুড়ি মিলে চড়াও হয় ওনার উপর। খুব অত্যাচার করতো। মাঝে মাঝে নাকি বেধড়ক পেটাত!.. এরকম শারীরিক এবং মানসিক চাপে পড়ে একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন মা। পালিয়ে বিয়ে করার কারণে ওনার খবর নিতেন না নানা। কিন্তু প্রশ্ন যখন নিজের মেয়ের জীবন-মরণের, তখন আর অভিমান করে থাকতে পারেন নি। ছুটে এসেছিলেন মাকে নিতে। সেখানেও অপমান!.. চরম অপমানের শিকার হয়েও অনেকটা জোর করেই বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন নানাভাই।..

আমার জন্ম হয়েছে নানার বাড়িতে। মা তখনও অসুস্থ। আমার নানীমা ছিলেন না, দেখাশুনা করতেন নানাভাই নিজেই। আমার নাম রাখা হয়েছিল ধ্রুব। মা খুব ভেবেচিন্তে নাকি এই নামটা দিয়েছিলেন। এছাড়া ভালো কোনো নাম রাখেন নি। এরমধ্যে বাবার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিল না মায়ের। কেন ছিল না, সেটা জানি না। এবং আমি দেখেছি শুধু এই সময়টায় না, অদ্ভুদ ভাবে এরপরে বাবার সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করেন নি মা। তার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। আমায় আদর করতেন না, যত্ন নিতেন না। সবসময় দেখতাম নিজের ঘরের রকিং চেয়ারে বসে থাকেন, একা একা আকাশ দেখেন। একেবারেই অন্যমনস্ক! আমার পৃথিবী তখন ছিল নানাভাই। তার সাথেই আমার চলাফেরা, উঠাবসা সব!

তারপর আমার বয়স যখন চার তখন হঠাৎ একদিন বাবা এলেন বাসায়, আমি তাকে আগে কখনো দেখি নি। চিনিও নি। কিন্তু মার সাথে তার কথোপকথন দেখে বুঝেছিলাম উনিই আমার বাবা। তিনি এসেই মায়ের কাছে গেলেন। প্রায় তিনঘন্টা দরজা আটকে তারা বসে রইলেন। কারও কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। ভেতরে কি হয়েছে আমি জানি না। আমি তখন নানাভাইয়ের কাছে ছিলাম। ওনাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, বাবা কেন এসেছে, কী চায়, উনি কিছুই বলতে পারেন নি।

তিনঘণ্টা পর যখন বাবা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তখন তার চোখ মুখ লাল, কেমন যেন ফোলা ফোলা। আমি তখন ড্রইং রুমে নানাভাইয়ের কাছে। উনি আমাকে দেখলেন, কাছে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন আমি তার সাথে যাবো কী না। স্বাভাবিক ভাবেই আমার উত্তরটা ছিল ‘না’। বাবা তাতে আর কিছু বলেন নি, শুধু কোলে তুলে চুমু খেয়েছিলেন মাথায়। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন।

এরপর মা আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেলেন। মাথার সমস্যাটা আরো বেশি চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। নানাভাই তখন সাধ্যমত চিকিৎসা করাচ্ছেন, বড় বড় ডাক্তার দেখাচ্ছেন কিন্তু লাভ হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে খুব বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে গেলে জিনিপত্র ভাঙচুর করতেন মা। অবস্থা ছিল ভয়াবহ। আমি পারতপক্ষে তার সামনে যেতাম না।

মাঝখানে বাবা বেশ কয়েকবার নানা ভাইয়ের কাছে এসে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানাভাই রাজি হন নি। আমিও যেতে চাই নি।

এর ঠিক একবছরের মাথায়, হঠাৎ করেই স্ট্রোক করে মারা গেলেন মা। আর ছয়মাস পর নানাভাই। আমি তখন অকূল পাথারে! বাবা এসে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। বাবার সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছিল খুব, বাবা আমাকে সময় দিতে পারতেন না। কিন্তু তারপরও আমাকে ভালোবাসতেন খুব। আমার নাম বদলে রাখলেন বর্ষণ। তার নামের সাথে মিলিয়ে হয়ে গেল বর্ষণ রাইয়ান। এই নামেই ডাকতেন। এই নামেই আমার সব পরিচয়। কলেজের বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ থেকে শুরু করে সবাই এই নামেই চেনে।

মার সাথে তার কী হয়েছিল এটা পরবর্তী জীবনে কোনদিন আমাকে বলেন নি বাবা। কিন্তু অদ্ভুদ ভাবে আমার জীবনে মায়ের অস্তিত্ব টাকে একপ্রকার মুছে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কেন, তা জানা নেই আমার। কিন্তু তারপরও মায়ের দেয়া সেই নামটা আমি কখনো ভুলতে পারি না। তিনি আমায় কাছে ডাকতেন না, আদর করতেন না, তবুও তাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু লোকের জন্য এই নামটা আমি তুলে রেখেছি। নামটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে, এই নামে কেউ ডাকলে আমার মনে হয় আমি সেই ছোট্ট ধ্রুবই আছি। নানাভাইয়ের আদরের চোখের মণি!

আমার বয়স যখন ছয় তখন রংপুর ক্যান্টনমেন্টে বাবার পোস্টিং। তখন সৈনিক পদ থেকে সার্জেন্ট পদে উন্নীত হয়েছেন তিনি। আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে। ক্লাস ফোরে উঠে আবার বদলি হলেন বাবা, চলে গেলাম ঢাকায়। আদমজী ক্যান্টে ভর্তি হয়ে গেলাম।

দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গেল। এরপর ক্লাস সিক্স। বাবার ইচ্ছা ছিল আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাবেন। তিনি চাইতেন আমি যেন সেনাবাহিনীর বড় কোনো পদে চাকরি করি। শুধু পেশা হিসেবে না, আমি যেন দেশকে ভালোবেসে নিজের দায়িত্ব পালন করি। দেশপ্রেমের বীজ আমার ভেতরে বুনে দিয়েছিলেন বাবা। আমি সেই আদর্শেই বড় হতে থাকি। সিক্সে ক্যাডেট পরীক্ষা দিয়ে, চান্স পাই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। ভর্তি হয়ে গেলাম সেখানেই। বাবা তখন বদলি হয়ে এদিক ওদিক ছুটছেন।

ক্লাস নাইনে থাকতে আবারও মিশনে নাম এসে গেল বাবার। চলে গেলেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে খবর এলো বাবা আর নেই। শত্রুর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার শরীর। শহীদ হলেন তিনি।

এরপর আমার পুরো খরচ নিয়েছিল সরকার। লেখাপড়া শেষ হলো। ভাগ্য সহায় হলো বাবার ইচ্ছে পূরণ করার একটা সুযোগ হলো র্্যাবে জয়েন করার, সিক্রেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা চাকরি। ঢুকে গেলাম এখানেই। ”

– “আপনার নানাবাড়ি থেকে আসার পর আর দাদার বাড়িতে যান নি কখনো?”

হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে অনন্যা। এতক্ষণ সে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ওর কথা। ওর আগ্রহী প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকায় বর্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– “নাহ্। বাবা কখনই ওমুখো হন নি। তাই আমিও কখনো যাই নি। আর সেখানকার কোনো ঠিকানাই আমার কাছে ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর একটা চিঠি পাই আমি। সেটা তিনি আমাকেই লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল বেশ কিছু কথা। কিছু উপদেশ। আর ছিল রহস্যের আংশিক সমাধান। তবে পুরোটা নয়, তাই সে রহস্য আমি আজও সমাধান করতে পারি নি। শুধু জানি কী যেন একটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল বাবা-মায়ের। সম্ভবত সেটা লাগিয়েছিলেন বাবার পরিবারের লোকজন। বাবা সেটা বুঝতে পারেন নি। তাই সংসারটা ভেঙে গেছে তার। তবে চেষ্টা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার, আর সেজন্যই বিদেশ থেকে ফিরে দেখা করতে গিয়েছিলেন মায়ের সাথে। মা অসুস্থ ছিলেন, মেনে নেন নি তাকে। বাবাও আর না ঘাটিয়ে অভিমান করে চলে আসেন। ভুল বোঝাবুঝির খেলায় তাদের জীবনটাই গেল শেষ হয়ে!

মৃত্যুর কিছুদিন আগে এসে সেই ভুলটা ভেঙেছিল বাবার। কিন্তু কী ছিল তার ভুল সেটা আমায় বলেন নি। হয় তো সুযোগ পান নি। তখনই বুঝতে পেরেছিলেন তার পরিবারের নিষ্ঠুরতা কতটুকু!

তবে দোষ যে পক্ষেরই থাক, বাবা কেন যেন আমাকে নিয়ে কখনোই দাদাবাড়ি যান নি। ইভেন কোনরকম যোগাযোগও করতে দেখি নি। সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে মানুষ করেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন বড় কিছু করার। দেশকে ভালোবাসার, দেশের জন্য করার!”

ধ্রুব চুপ করে। নিঃশ্বাস ফেলে অনুর দিকে তাকায়। মেয়েটা পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি অনিমেষ, অপলক। ও কিছু বলবে এটা ভেবেই আর কোনো কথা বলে না ধ্রুব। অপেক্ষা করে ওর জন্য।

অনেকটা সময় পর মুখ খুললো অনন্যা। মৃদু কণ্ঠে বললো,

– “কিন্তু আপনি যে আমাকে বলেছিলেন আপনি কোনো চাকরি বাকরি করেন না, ভবঘুরে.. এসব মিথ্যে কেন বলেছিলেন?”

– ” এলাকায় আমি গিয়েছিলাম আমার অফিসিয়াল একটা কাজে, ইফতেখার চৌধুরীর ড্রাগস এর ব্যবসা ধরিয়ে দেয়ার জন্য। টিভিতে তো দেখিয়ে ছিল, দেখ নি? তারপর চলে আসি আমার জায়গায়।… দেখ, আমার জীবন, আমার প্রফেশন কোনোটারই কোনো গ্যারান্টি নেই। সবসময় একটা রিস্কের মধ্যে থাকি। আর কাজগুলোও হয় খুব গোপনে। সিক্রেট ইনভেস্টিগেশনে। এসব ক্ষেত্রে আমরা কি করি, কোথায় থাকি, এসব কথা কাউকে বলতে নেই। আমিও বলি নি।.. আর একটা কথা কী জানো?”

– “কী?”

অবাক চোখে তাকায় অনন্যা। প্রতি উত্তরে মুখে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে তোলে ধ্রুব। তাতে যেন আরো অবাক হলো ও।

-” আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমাকে পছন্দ করো। তুমি আমাকে ফলো করতে সেটাও টের পেতাম সবসময়। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগতো। সবক্ষেত্রে মেয়েদের পেছনে ছেলেরা ঘোরে আর আমার পেছনে ঘুরতো একটা মেয়ে! মনে মনে বেশ মজা পেতাম আমি!”

এতটুকু বলে অনন্যার দিকে একপলক তাকায়। মেয়েটা লজ্জায় যেন কুঁকড়ে গেছে। রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে তার মুখমন্ডল, গাল দুটো যেন কাশ্মীরি আপেল। ফর্সা মুখে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাহির থেকে আসা মৃদু বাতাসে উড়ছে তার খোলা চুল। ললাটের অগ্রভাগের ছোট ছোট কেশগুচ্ছ এসে দোল খাচ্ছে তার লজ্জা রাঙা মুখে।

-” আমাকে যে ফলো করছে তার ব্যাপারে আমি খোঁজ নেব না তা তো হয় না। শত হোক, পেশাগত ইনভেস্টিগেটর!.. আমিও পাল্টা খোঁজ লাগালাম তোমার পিছে। তোমার পুরো বায়োডাটা চলে এলো আমার হাতে। দেখলাম তুমি জীবনে কি কি করেছ, কী ভালোবাসো, কী অপছন্দ করো। অ্যান্ড তুমি যে গল্প-উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের বাস্তবে খুঁজে বেড়াও সেটাও জেনে গেলাম।.. আমাকে দেখে হিমুর সাথে মেলাতে চেয়েছিলে। কারণ আমার অদ্ভুদ কথা-বার্তা, কাজকর্ম মুগ্ধ করতো তোমায়।.. ব্যাপারটা জানারপর শুরু করলাম মজা। তোমার সামনে হিমু সাজার চেষ্টা চালালাম। এবং মজার ব্যাপার হলো তুমিও তাতে বিশ্বাস করলে, আমাকে হিমু ভেবে একেবারে ভালোবেসে ফেললে।.. আমি মিথ্যে বলবো না, প্রথমে আমি শুধু তোমার সাথে মজা করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আমি তোমার নিছক আগ্রহ। কিন্তু সময়ের সাথে ধারণা বদলালো। ভেবে নিলাম হয় তো সত্যি সত্যিই ভালোবাসো আমায়। এটা ভাবতেই ভালো লাগতো। তোমাকে দেখলে অদ্ভুদ শিহরণ জাগতো শরীরে। ভালো লাগার আবেশে ছুঁয়ে দিত মন। ধীরে ধীরে জ্ঞান হলো, বুঝলাম ভালোবেসে ফেলেছি।..”

– “কিন্তু আপনি তো বলেন নি আমায়! ”

এতক্ষণে কথা বললো অনন্যা। লজ্জার আবরণ ছেড়ে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকলো ধ্রুবের মুখপানে। মনে হতে লাগলো সে স্বপ্ন দেখছে, ধ্রুব তার সামনে বসে আছে, তার সাথে কথা বলছে সবই তার অলীক কল্পনা! হ্যালুসিনেশন! কিন্তু না, এটা মিথ্যে নয়। সবই সত্য, ধ্রুব সত্য। আবার কথা বললো ধ্রুব,

-” সে সুযোগটা হয় নি। জরুরি কারণে কাউকে কিছু না বলেই চলে আসি ঢাকায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমি যেমন তোমাকে ভালোবাসি, তেমন তুমিও আমায় ভালোবাসো। তাই না বলে হারিয়ে গেলেও ঠিকই খুঁজে নেবে আমায়। তাই করিম চাচার কাছে তোমার নামে একটা চিঠি রেখে আসি। যেন খোঁজ করলে পেয়ে যাও তুমি! কিন্তু আফসোস!…”

– “চিঠিটা তো আমি পেয়েছিলাম!.. ”

– “পেয়েছিলে? কিন্তু…”

– “হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। ওখানে লেখা নাম্বারে কলও করেছিলাম কিন্তু.. কিন্তু আপনি ধরেন নি। ওটা বন্ধ ছিল!… আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাই নি! অনেক চেষ্টা করেছি!.. আপনাকে না পেয়ে অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, সারাক্ষণ শুধু আপনার কথা ভাবতাম। আর কিছু করতাম না, করতে ভালো লাগতো না। বাসার সবাই এটা নিয়ে টেনশনে পড়ে গিয়েছিল, একসময় সাইক্রিয়াটিস্টের কাছেও নিয়ে গিয়েছিল।.. আপনি যদি চিঠিটাই রেখে গেলেন তাহলে ওখানকার নাম্বারটা ভুল লিখেছিলেন কেন? কেন ভুল তথ্য দিয়ে বোকা বানিয়েছিলেন? আপনি জানতেন না আপনাকে ভালোবেসে ছিলাম আমি? আমার মন ছুঁয়েছেন আপনি?”

হঠাৎ কেঁদে ওঠে অনন্যা। দু’ চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় ঝরে পড়ে জলকণা। অভিমানী চোখে মেয়েটা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। দৃষ্টিতে তার মন ভাঙার অভিযোগ, অনুযোগেরা ভর করেছে।

ওর কথা শুনে হঠাৎ চুপ করে যায় ধ্রুব। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকে আসল ব্যাপারটা কি। অনু ওকে কল দিয়েছিল? তাহলে ওর কাছে সে কল এসে পৌঁছায় নি কেন? অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– ” তুমি ক’বে কল করেছিলে? ”

– “দিন সাতেক আগে!..”

এতক্ষণে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যায় ধ্রুবের কাছে। তারমানে অনু যখন কল করেছে তখন ফোনটা ছিলই না ওর কাছে! সেটা তো পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছে তারও পাঁচ সাতদিন আগে! আহত দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকায়।। মেয়েটা এখনো কাঁদছে। কাশ্মীরি আপেলের মতো টুকটুকে লাল গাল দুটো এখন আরও লাল রঙ ধারণ করেছে। এতক্ষণ তা লজ্জা বোঝাচ্ছিল এখন তা বোঝাচ্ছে ওর প্রতি অভিযোগ! নরম গলায় বললো,

– “ফোনটা আমার কাছে ছিল না অনন্যা। পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছে! ”

– “পাহাড় থেকে পড়ে গেছে? কীভাবে?.. আ.. আপনার কিছু হয় নি তো?”

বিস্ফোরিত নয়নে প্রশ্ন ছোঁড়ে অনন্যা। ওর উৎকণ্ঠা দেখে মৃদু হাসলো ধ্রুব। মাথা নাড়িয়ে বললো,

– “না, কিছু হয় নি। শুধু ফোনটাই পড়ে গেছে হাত থেকে!”

বলেই হাসার চেষ্টা করে। প্রতি উত্তরে কিছু বলে না অনন্যা। দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। চুপ করে থাকে দীর্ঘক্ষণ। ধ্রুবও আর কিছু বলে না। ওর নতমস্তকের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী! অনেকের মধ্যে এক, অনন্যা! এর আগেও বহুবার ওর এই রূপের কাছে হার মেনেছে সে। বারবার মন ছুঁয়ে গেছে! কখনো জানাতে পারে নি। আচ্ছা, আজ যখন সব ঠিকঠাক, সব জানাশোনা হয়ে গেল, তখন কী ও পারে না অনুর কাছে যেতে? ওর কাছে ভালোবাসার কথা বলতে?

– “আমি তোমাকে আমার সবকিছু বলেছি অনা। একেবারে সব! এখন তোমার কী মনে হয়, তুমি কী ভালোবাসবে আমায়? বারবার মন ছুঁয়ে দিবে আমার? সারাদিনের ব্যস্ততার পর তোমার হাসিমাখা মুখ দেখে শান্তি পেতে দেবে? কোথাও থেকে এলে জড়িয়ে ধরে নিমিষেই ক্লান্তি দূর করে দেবে? আমার শেষ বয়সের ফোকলা দাঁতের হাসির একমাত্র কারণ হবে? সারাজীবনের স্মৃতি সংরক্ষণের একমাত্র অ্যালবাম হবে? যার কাছে, লুকিয়ে থাকবো আমি, আমার সারাটাজীবন? বলো অনা, আমায় ভালোবাসবে?”

অনন্যা বিস্ময়ে-আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ে। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু শুনতে পাওয়া যায় না। সাথে সাথে নেত্র কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা অশ্রুজল! ধ্রুব মুচকি হাসে। উঠে এসে অনন্যার একদম সামনে এসে দাড়ায়। ওর গালে আলতো করে হাত রাখে। বৃদ্ধা আঙুলের ডগা দিয়ে মুছে নেয় মুক্তোর মতো চকচকে জলকণা। তারপর হাত সরিয়ে ওর মাথাটা কাছে টেনে আনে। নিজের মুখটা নামিয়ে এনে ওর ললাটের অগ্রভাগে অধর স্পর্শ করে, ধরে রাখে দীর্ঘক্ষণ। অনন্যা লজ্জায় লাল হয়ে যায়, কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোতে থাকে। এতদিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ধ্রুবের স্পর্শকে সে অনুভব করেছে। সেখানে লজ্জা ছিল না, সুখোনুভূতিও ছিল না। কিন্তু আজ সে সত্য, বাস্তব হয়ে এসেছে। তাই লজ্জায়, অস্বস্তিতে নুইয়ে যাচ্ছে বারবার। প্রেমসুখে আন্দোলিত হচ্ছে তার শরীর! তার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে!
____________________

প্রায় অনেক্ষণ পর ঘুম ভাঙে কানিজের। চারিদিক তখন এশার আযানের ধ্বনিতে মুখরিত। কানিজ যখন চোখ খুললো মুয়াজ্জিন সাহেব মাত্রই তখন “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার” ধ্বনি তুলে মাইক রেখেছেন। আশপাশে তখনও প্রতিধ্বনি হচ্ছিল সেই মধুর আওয়াজ।

কানিজ আরমোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ কচলে রুমের দিকে তাকায়। ঘরটা অন্ধকার। নিস্তব্ধ, নিঝুম হয়ে আছে। ঘরের বিশাল বিশাল জানালাগুলোও খুলে রাখা, বাতাসে পর্দা উড়ছে। আর তাল দিয়ে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে নিকষ কৃষ্ণ আঁধার! কানিজ অবাক চোখে তাকায়। নিজেকে কেমন যেন একা একা লাগে। ঘরের এমন হাল কেন? অনু কী তারমানে এখনো আসে নি? কিন্তু কেন? রিসেপশনে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে তো ওর খুব বেশি সময় লাগার কথা না! নাকি এসেছে? নিশ্চিত হওয়ার জন্য গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়ে,

-” এই অনু!.. অনু! কোথায় রে তুই?”

কেউ সাড়া দেয় না। অন্ধকার ঘরে সে তার নিজের কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। আশ্চর্য! অনু কী তারমানে সত্যিই আসে নি? নাকি ওর ডাক শুনতে পাচ্ছে না? উফ্! এই মেয়েটা যে কী না। কানিজকে অহেতুক টেনশনে ফেলে মেরেই ফেলবে! নিশ্চয় ঘরে বসে ওই ধ্রুবের ধ্যানে মগ্ন আছে! ভাবতেই ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়ে পড়ে। হাই তুলতে তুলতে বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়। পা চালিয়ে হেঁটে যায় পাশের ঘরে, অনন্যার সন্ধানে।

না, সত্যি সত্যিই অনন্যা সেখানে নেই। ঘরটা ফাঁকা। এবং এ ঘরের অবস্থাও তার ঘরটার মতোই। খোলা জানালা-দরজা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে ভেতরে। লাইট জ্বালানো নেই বিধায় এখানেও অমানিশা বিদ্যমান!

কী ব্যাপার? অনু তাহলে গেল কই? অবাক হয় কানিজ। আর কিছু না ভেবেই ফিরে আসে নিজের ঘরে। টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে কল করে অনন্যার নাম্বারে। রিং হয় দু’ বার। কিন্তু রিসিভ করে না অনু। কেটে দেয়। কানিজ অপেক্ষা করে ওর কলের জন্য। কিন্তু আর কল আসে না। হলো টা কি এই মেয়ের? বিরক্ত হয়ে আবারও কল করে। এবারও কেটে দেয় সে। তাতে যেন মাথায় খুন চেপে যায় ওর। ইচ্ছে করে অনন্যাকে ধরে এনে আচ্ছাসে পিটায়! বদ মহিলা কল রিসিভ করে না ক্যান?

এবারে রিসিভ হয় কলটা। রাগে ফেটে পড়ে ভয়াবহ কিছু গালি আওরাতে যাবে তার আগেই শোনা যায় অনুর গলা। ও কিছুটা ফিসফিস করে, কিছুটা অস্বস্তিতে বলে,

– “হ্যাঁ, কানিজ। বল্!..”

– “অনু, এই! কোথায় রে তুই? সেই বিকেলে বেরিয়েছিস এখনো রুমে আসিস নি কেন?”

– “ধ্রুবের কাছে আছি। আপাদত ব্যস্ত, পরে কথা হবে।”

বলেই কল কেটে দেয়ার চেষ্টা করে অনন্যা। কিন্তু তার আগেই কানিজের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। সে অবাক হয়ে বললো,

– “ধ্রুবের কাছে মানে?– এসব কী বলছিস তুই?.. তুই কি এখানে এসেও হ্যালুসিনেশন শুরু করেছিস? অনু দেখ, ভালো কথা বলছি। তুই কোথায় আছিস, আছিস, এক্ষুনি রুমে আয়। কাম ফাস্ট, অনন্যা!”

-” এতো বেশি বেশি চিন্তা করবি না তো তুই! আমার ভালো লাগে না। আমি যা বলি, সেটাই তো অবিশ্বাস করিস!.. কিন্তু আমি সত্যিই বলছি, আমি এখন ধ্রুবের সাথে আছি।”

কিছুটা রেগে যায় অনন্যা। কানিজ তাতে বেশ বিরক্ত হয়। শ্লেষ যুক্ত কণ্ঠে বললো,

-” তা ধ্রুবের সাথে কী করছেন আপনি? এক্কা দোক্কা খেলছেন? ধ্রুব বুঝি এক্কা দোক্কা খেলার জন্য দেখা করতে এসেছে?”

ওর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ দেখে মনঃক্ষুন্ন হলো অনুর। অসহায় গলায় বললো,

– “তুই আমার কথা কেন বিশ্বাস করছিস না, কানিজ? আই সয়ার আমি সত্যিই বলছি! ধ্রুবের সাথে আমার দেখা হয়েছে। কীভাবে দেখা হয়েছে, সেটা দেখা হলে বলবো। কিন্তু এখন আমি ওর কাছেই আছি।”

-” ধ্রুবের কাছে আছিস? আচ্ছা, বেশ। আমি মানলাম। তা কোথায় সে? ফোনটা দে দেখি ওর কাছে.. আমি কথা বলি!”

কানিজের ধারণা ছিল বরাবরের মতো এবারও অনন্যা হ্যালুসিনেশন করছে। আর ও সেটাকে মিথ্যে বলায় ক্ষেপে যাচ্ছে। তাই ওকে বললো ধ্রুব কে ফোনটা দিতে যেন সে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে একটা অচেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একটা পুরুষালি কণ্ঠ। কিন্তু ভারী সুন্দর,

– “মিস. কানিজ বলছেন? আমি ধ্রুব। কোন ধ্রুব সেটা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। আপনি বুঝতেই পারছেন।..”

– “অনুর সাথে আপনার দেখা হলো কী করে? আপনারা এখন কোথায়?.. অনু এখনও রুমে ফিরছে না কেন? দেখুন, আপনার সাথে ওর কী হয়েছে, আপনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন, এসব আপাদত শুনতে চাচ্ছি না আমি। দয়া করে অনন্যাকে চলে আসতে বলুন। ও আসলে তারপর আপনার সাথে কথা হবে…”

কানিজের কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে মুচকি হাসলো ধ্রুব। তার প্রেয়সী অনন্যা মেয়েটা যতটা বোকা, যতটা সহজ-সরল, অতীব মাত্রায় নমনীয়, প্রেমময় তার সম্পূর্ণ বিপরীত এই কানিজ নামের মেয়েটি। অসম্ভব রকমের বাস্তববাদী, কট্টর, কাঠখোট্টা টাইপ। একেবারেই যেন রসকষ নেই! অবশ্য ওর সাথে কোনোদিন সেভাবে কথা বলা হয়ে ওঠে নি। হতে পারে অনুর সাথে সে সহজ, রসিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ! কিন্তু ওর সাথে তার বিপরীত! ওকে কিছুটা সন্দেহের চোখেই দেখে। হয় তো খারাপও ভাবে!

সে যাই হোক, মিথ্যের বেড়াজাল চিরকাল থাকে না। ও যে খারাপ নয়, সে ব্যাপারটা অবশ্যই একদিন জানবে সে। তখন হয় তো অনুতপ্তও হবে। তবে এই মুহূর্তে ওই রস-কষহীন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মেয়েটাকে আরেকটু বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর। হয় তো অনুর প্রতি ওর দায়িত্ববোধ দেখেই। মুচকি হেসে বললো,

– “কিন্তু এতো তাড়াতাড়িই তো ওকে ছেড়ে দিতে পারছি না আমি।”

বলেই ফোন কানে রেখে আড়চোখে অনন্যার দিকে তাকালো ধ্রুব। মেয়েটা অতিরিক্ত লাজুক, এখনো লজ্জায় তার মুখটা রক্তিম। ওর কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো কানিজের। উত্তেজনায় লাফ দিয়ে উঠে বললো,

– ” তার মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”

ওর উৎকণ্ঠা দেখে আরও বেশি খুশি হয়ে উঠলো ধ্রুব। মেয়েটা তো দেখি অনুকে নিয়ে খুব বেশিই কনসার্ন! যাক, শ্যালিকার সাথে রসায়নটা জমবে ভালো! জব্দ করা যাবে আচ্ছা সে! ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে ঢুকে অনন্যার আড়াল হয়ে গেল। এখান থেকে কথা বললে অনুর কান অবধি যাবে না। দুষ্টু হেসে বললো,

-“কী বলতে চাইছি বুঝছেন না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন, মিস. শ্যালিকা? দাড়ান ভেঙেই বলছি… কতোদিন পর প্রেমিকার সাথে দেখা হয়েছে এতো জলদিই প্রেমালাপ শেষ হয়? রাত গড়াবে, গল্প হবে, দুজনের মধ্যে ভালোবাসাবাসি হবে.. এতসব কী তাড়া দিলে করা যায়, বলুন? আপনি তো বাস্তববাদী.. ভেবে দেখুন।”

– “কী বলছেন কী আপনি? আপনার মাথা ঠিক আছে?.. দেখুন, অনুর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না। ও বোকাসোকা মেয়ে, আপনাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। আপনি চাইলে হয় তো বা কোনকিছুতেই বাধা দিবে না। কিন্তু খবরদার, ওর সরলতার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবেন না, মি. ধ্রুব। আমি কিন্তু তবে ছেড়ে কথা বলবো না! আপনার শেষ দেখে ছাড়বো!”

– “বাব্বাহ! মিস. কানিজ আপনি তো বেশ ভয়ংকর! আমি তো ভয় পেয়ে গেছি! হা হা হা।… শুনুন, আপনি যাই করুন আর তাই করুন, আজকে অনু আমার সাথেই থাকবে। প্রচুর ভালোবাসাবাসি হবে দুজনের মধ্যে, সেসবের বর্ণনা আমি করতে চাইছি না। অনুর কাছে শুনে নেবেন। আর মামলা মোকদ্দমার ভয় আমাকে দেখাবেন না, ওসব আমার পানি ভাত!.. যাই হোক, আজকের রাতটার জন্য অনুর চিন্তা বাদ দিন, ও আজ ফিরবে না। আজ রাত ও আমার সাথে ইনজয় করবে। আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন। ওকে?.. নাও বাই!”

বলেই আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না ওকে। চট করে কলটা কেটে দিয়ে ব্যালকনিতে আসে। ফোনটা অনুর দিকে বাড়িয়ে দিলো। চারপাশ দেখতে দেখতে বললো,

– “রাত তো অনেক হলো, অনা। ডিনার করবে না? এসো ডিনারটা সেরে নেই। আজ আমার প্রেয়সীর জন্য সারপ্রাইজ আছে!”

– “কী সারপ্রাইজ?”

বেশ আগ্রহী চোখে তাকায় ধ্রুবের মুখের দিকে। ও হাসে। কী সুন্দর সেই হাসি। যে হাসিতে বারবার মুগ্ধ হয় অনন্যা। ওর মন ছুঁয়ে যায় যে হাসি! ধ্রুব হাসি থামিয়ে ওর কাছে এসে নাক টেনে দেয়। দুষ্টুমি করে বলে,

– “সেটা গেলেই দেখতে পাবে! চলো, যাই!”

একটা চারকোণা ঘরের মতো তৈরি কাঠামো। চারিদিকে পর্দা, বাতাসে সেগুলো উড়ছে। তার মাঝখানে একটা টেবিল। ধবধবে সাদা রঙের কাপড়ে মোড়ানো সে টেবিলের দু’ পাশে দুটো চেয়ার। একপাশে বসে আছে লাজুকতায় ঘেরা অনন্যা অন্যপাশে ধ্রুব। টেবিলের উপরে সাজানো অনন্যার প্রিয় প্রিয় খাবার, মাঝখানে রাখা একটা মোম দান। কারুকার্য মন্ডিত সে দানের উপর অনেকগুলো ছোট ছোট মোম জ্বলছে, মৃদু বাতাসে কাঁপছে তার অগ্নিশিখা। পাশেই খুব মোলায়ম সুরে গান বাজছে,

– “ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসাম্ নদীকা কিনারা, ইয়ে চঞ্চাল হাওয়া!..”

মোমের হলদেটে আলোয় অন্যরকম এক সৌন্দর্য বিদ্যমান পরিবেশে। একরাশ মুগ্ধতা ওদের চোখে মুখে। ধ্রুব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে অনন্যার মুখপানে। প্রেয়সীর সুন্দর, নিটোল, নিখুঁত রূপ দেখে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পরে ওর কাছে। অনন্যাও মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অনেকটা স্বপ্নের আচ্ছাদনেই ওরা শেষ করে তাদের ক্যান্ডেল নাইট ডিনার।

– “চলো এবার তোমাকে কটেজে রেখে আসি। তোমার বান্ধুবি নিশ্চয় টেনশনে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলেছে!”

ধ্রুবের কথা শুনে অবাক হয় অনন্যা। বলে,

– ” ও টেনশন করবে কেন? আপনি বলেন নি আমার ফিরতে দেরি হবে?”

– “বলেছি। আর বলেছি বলেই সে টেনশনে আছে।”

বলেই মুচকি মুচকি হাসতে থাকে ও। অনন্যা কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু ওকে বলতে না দিয়ে আবারও বলে,

– ” অত টেনশন নিচ্ছো কেন? চলো তো!”

বলেই হাত ধরে এগিয়ে যায় সামনে। কটেজের ঠিক সামনে এসে হঠাৎ আরেকটা কান্ড করে বসলো ধ্রুব। হুট করেই ওকে কাছে টেনে এনে দু ‘ গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তারপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে যায়। অনন্যা কিছুক্ষণ হতভম্ব চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। সম্বিৎ ফিরে পেতেই লজ্জায় হাত চলে যায় গালের কাছে। ধ্রুবের আজ কী হলো? ছেলেটা হঠাৎ করে এত বেশি রোমান্টিক হয়ে গেল কী করে? দিনে তিন বার চুমু… আর ভাবতে পারে না সে। লজ্জায় ভারী হয়ে আসে গাল। লজ্জিত মুখে এগিয়ে যায় রুমের দিকে।

#চলবে——-

[রিচেক করা হয়ে ওঠেনি,সময় ছিল না। মোটামুটি বড় পর্ব এবং রোমান্টিক টাইপের কিছু লিখেছি। অনেক সময় লেগেছে। তো এতকষ্ট করে লিখে কী আজ আপনাদের কাছে সুন্দর কিছু মন্তব্যের আশা করা যায় না? ভালো লাগলে কমেন্ট করবেন অবশ্যই। আমি পড়তে চাই, পাঠকের মন্তব্য।… হ্যাপি রিডিং 🙃]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here