মেঘমেদুর মন পর্ব -০৩

#মেঘমেদুর_মন [৩]
প্রভা আফরিন

রংপুরে আজ ঝুম বৃষ্টি। আকাশের গর্জনে, বাতাসের তাণ্ডবে অস্থির প্রকৃতি। ঘন, কালো আকাশ হতে সব মেঘ যেন গলে পড়ছে ধরনীর বুকে। ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। প্রগাঢ় সন্ধ্যার সান্নিধ্যে রিমঝিম অবাক হয়ে দেখে বর্ষণের বাধনহারা রূপ। সংকীর্ণ শহুরে জীবনের বাইরে ওর বেড়াতে যাওয়ার মতো কোনো স্থান নেই। বছরে দুই একবার ফ্যামিলি ট্যুর, স্কুল, কলেজ থেকে শিক্ষাসফরেই সীমাবদ্ধ ওর দূরযাত্রা। কাজেই গ্রামে আসার অভিজ্ঞতা এই প্রথম রিমঝিমের। এলো তো এলো, তাও আবার বিরামহীন বৃষ্টির মাঝে। কাদা-জলে ছয়লাব পথ-ঘাট। রিমঝিম কিছুদিন ধরে অসুস্থতায় এমনিতেই দুর্বল। তারওপর লম্বা বাস জার্নিতে শরীরটা একদম নরম হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে অটোতে করে মফস্বলের ভেতরের পথে কুড়ি মিনিট যাওয়ার পর চাকা থামে একটি প্রকাণ্ড উঠানের সামনে। সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। বৃষ্টির ফলেই চারপাশ একটু বেশিই অন্ধকার। রিমঝিম সেই বর্ষণমুখর আবছায়ায় ভালোমতো কিছুই দেখতে পেল না। দেখার ইচ্ছেটাও নেই। মাথাটা অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাসের ঝাকুনিতে এখনো চারপাশ দুলছে। ওর শরীর এখন শুধুই বিশ্রাম চাইছে।
কল্লোল অটো থেকে নেমে বলল,
“এসে গেছি আমরা। আপনারা একটু বসুন, আমি ছাতা নিয়ে আসছি।”

কল্লোল কাদা-জল মাড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘোলাটে আঁধারে মিশে গেল। ফিরে আসে দুটো কালো রঙের ছাতা নিয়ে। একটি তার মাথার ওপর ধরা অন্যটি হাতে। আলমগীর সাহেব কল্লোলের ছাতার নিচে আশ্রয় নিলে অপর ছাতায় রিমঝিম ও তাহমিনা বেগম ঠাঁই নেন। টর্চের আলো ফেলে সচেতন পায়ে হাঁটতে গিয়ে রিমঝিম শঙ্কিত। কাদা-জলে থৈ থৈ করছে চারপাশ। বুকে ভয় জমে, পা পিছলে পড়ে না যায়! ভীত তরুণী শক্ত করে ধরে খালার হাত। বিশাল উঠান মাড়িয়ে দালানের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে দুটো পা কাদায় মাখামাখি।

আলমগীর সাহেব জন্মভূমির নির্মল বায়ুতে প্রবেশ করে উৎফুল্ল হয়ে গেছেন। চেনা মুখ, চেনা স্থানের সংস্পর্শে এসে উনার কণ্ঠস্বরেও আঞ্চলিক টান চলে এসেছে। স্বল্পালোকিত কাঠের খোলা বারান্দায় উঠে নিজের বয়সী এক পুরুষকে সপাটে জাপটে ধরলেন তিনি। কোলাকুলি করে কুশল বিনিময় করলেন। লোকটির পরিচয় তিনি কল্লোলের বাবা। হায়দার মুন্সি সহাস্যে বললেন,
“এই তোর মেয়ে? মাশাআল্লাহ! কোলের নিয়ে গেলি আর নিয়ে এলি একদম অভিভাবক বানিয়ে!”

রিমঝিম সালাম দিল উনাকে। ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়সী নারীও বেরিয়ে এলেন। সম্পর্কে কল্লোলের মা। সাবিনা এসে তাহমিনাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা কথার সঙ্গী পেল, খালাও গল্পের সঙ্গী পেল। বড়োদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রিমঝিমের নিজেকে অসহায় মনে হলো, রাগও হলো। এখানে এসে কেউ তাকে খেয়ালই করছে না! সকলের মধ্যমনি হয়ে থাকা রিমঝিম এই অচেনা স্থানে মুরুব্বিদের মাঝে পাত্তা না পেয়ে গাল ফোলায়।

তখনই বারান্দায় উঠল কল্লোল। তার গা সম্পূর্ণ ভেজা। সাদা রঙের শার্টটা ভিজে লেপ্টে আছে বলিষ্ঠ বাহুর সঙ্গে। কল্লোলের চুল কোকড়ানো। বৃষ্টিতে ভিজে সেই চুল এখন খাড়া হয়ে কপালের সঙ্গে লেপ্টে আছে। যথারীতি চশমা ঝাপসা। রিমঝিম খোঁচা দেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করল না কিছুতেই,
“চশমা মুছে নিন। নয়তো কাকে আবার কী ডেকে ফেলেন!”
বড়োদের মনোযোগ এদিকটায় নেই। কল্লোলও কথা ছাড়ল না,
“সমস্যা নেই ম্যাডাম। কাছের মানুষদের না দেখেও তাদের গায়ের গন্ধেই চিনে নিতে পারি। দূরের মানুষদের কণ্ঠস্বর নিয়েই যত বিড়ম্বনা।”

রিমঝিম মুখ ফিরিয়ে রইল। চোখ থেকে চশমা খুলে মায়ের আঁচল দিয়ে মুছে নেয় কল্লোল। সাবিনা ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন,
“অসময়ে ভিজলি কেন? তোর তো ঠান্ডা সহ্য হয় না।”

কল্লোল চশমার পর নিজের মাথাটাও আঁচলে মুছতে থাকে। হেসে বলে,
“লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। ভাবলাম একেবারে বৃষ্টিতে গোসল সেড়ে ঘরে ঢুকি। তুমি চিন্তা কোরো না, আম্মা।”

রিমঝিম ক্লান্ত ভঙ্গিতে একবার চোখ তুলে চায় মা-ছেলের আদুরে আহ্লাদের দিকে। কৃত্রিম আলোয় মেয়েটির ক্লান্ত মুখ কিন্তু কল্লোলের নজর এড়ালো না। গলা উঁচিয়ে কাউকে নির্দেশ দিল পা ধোয়ার পানি দিতে।

পানিভর্তি বালতি ও মগ নিয়ে হাজির হয়েছে অল্পবয়সী এক মেয়ে। নাম তার বর্ষা। রিমঝিমকে দেখে সে লাজুক একটা হাসি দিল। বলল,
“বৃষ্টির পানি জমেছে। সেগুলোই এনেছি পা ধুতে।”

“হু, তাতে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে?” কল্লোল একমাত্র বোনের মাথায় চাটি মা’রল। অন্যসময় হলে ভাইয়ের এটুকু প্রহারে সে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বাবার কাছে নালিশ দিতো। কিন্তু নতুন অতিথিদের সামনে এসে এমনিতেই সে লাজুকলতা হয়ে গেছে। এখন আরো বেশি অপ্রতিভ হলো মুখখানি।

কল্লোল রিমঝিমের মুখপানে দৃষ্টিপাত করে বলে,
“ও বর্ষা। আমার ছোটো বোন।”
বর্ষার দিকে চেয়ে জোরপূর্বক হাসি টানে রিমঝিম। কল্লোল সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“জুতো খুলুন। পা ধুয়ে বর্ষার সঙ্গে সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে যান।”

রিমঝিম জুতো খুলল। ওকে ভড়কে দিয়ে কল্লোল নিজেই ওর পায়ে পানি ঢালল। কাদা না যাওয়া পর্যন্ত কচলে ধুতে নির্দেশ দিল। এরপর মাকে ডেকে বলল,
“আম্মা, উনাদের খাবার ব্যবস্থা করো। জার্নি করে সবাই ক্লান্ত ও খুদার্থ।”
_______________

ইট-পাথরের শৌখিন ঘরে বসে, কাচের জানালায় বৃষ্টি দেখা, সিক্ত পিচঢালা পথে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো ও কাদামাখা গ্রামের পথ প্রান্তরে যে বিস্তর তফাৎ একদিনেই তা বুঝতে অসুবিধা হলো না রিমঝিমের। ওর মনে হচ্ছে স্থান ভেদে বৃষ্টি তার রূপ বদলায়। নয়তো নিজ শহরে যা মনোরম মনে হয় এই অদূর অঞ্চলে তা এমন অচেনা লাগবে কেন? রিমঝিম বসে আছে কল্লোলদের বাড়ির কাঠের বারান্দায়, গতরাতে যা সে ঠিকঠাক খেয়াল করেনি। দিনের উজ্জ্বল আলোয় স্থানটা যেন মন ভালো করে দিল। কল্লোলদের বাড়িটা এলাকায় মুন্সি বাড়ি নামে খ্যাত। বাড়ির সামনের টানা বারান্দাটা কাঠের তৈরি। ভেতরে প্রশস্ত দালান। বাড়ির সামনে বিশাল এক উঠান। যাকে ঘিরে চারপাশে লম্বা লম্বা গাছ। সীমানার বাইরে সবুজাভ পুকুরঘাট। সিক্ত প্রকৃতিঘেরা এই ছিমছাম বাড়িটা রিমঝিমের পছন্দ হয়ে গেল বিনা দ্বিধায়।

বর্ষা এসে দাঁড়িয়েছে রিমঝিমের পাশে। এই অদেখা শহুরে আপুটির সঙ্গে এখনো ভাব হয়নি ওর। গতরাতেও বিশেষ কথা বলেনি। ওড়নার কোণা আঙুলে প্যাঁচাচ্ছিল ক্লাস নাইন পড়ুয়া কিশোরী মেয়েটি। সম্মুখের এই মাখনরঙা সুন্দরী মেয়েটিকে মনে মনে অহংকারী ভাবতে যাচ্ছিল ও। তখনই রিমঝিম ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। বলল,
“তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি। গতকাল খুব ক্লান্ত অনুভব করছিলাম বলে কিছুই ভালো লাগছিল না। কেমন আছো?”

বর্ষা প্রশস্ত হেসে আরেকটু এগিয়ে আসতেই গমগমে স্বরের সাবধান বাণী কানে এলো,
“ওর সঙ্গে যত কম মিশবেন ততই ভালো। কথা বলে কান ঝালাপালা করে দেবে।”

রিমঝিম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কল্লোল সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মোটা ফ্রেমের আড়ালে চোখদুটো যেন নিজ বাড়ির স্বতঃস্ফূর্ততায় একটু বেশিই সজীব। বর্ষা আহত চোখে চায় ভাইয়ের দিকে। কিশোরীর চোখে অফুরন্ত অভিমান। নতুন মেহমানদের সামনে তাকে অপদস্ত না করলেই হচ্ছে না! রাগী সুরে বলল,
“ভাইয়া, তুমি কাল থেকে জ্বালাচ্ছো আমায়। আব্বা ফিরলে নালিশ দেব কিন্তু।”

ভাইবোনের খুঁনসুটির মাঝে রিমঝিম হাত বাড়িয়ে বর্ষার একটা হাত ধরল। বলল,
“অন্ধের যষ্টি বাঁকা হলেই কি আর সোজা হলেই বা কী! পথ চলা নিয়ে কথা। এই অচেনা পরিবেশে আমি এখন অন্ধ। একজন মিষ্টি সঙ্গী চাই। বর্ষা নিশ্চয়ই বেটার অপশন!”

বর্ষা খুশিতে ডগমগিয়ে ওঠে। কল্লোল সুক্ষ্ম তিরস্কারের হাসি হেসে বলে,
“প্যাচপ্যাচে কাদায় সাবধানে পা ফেলবেন। তখন কিন্তু যষ্টিতে কাজ হবে না।”

দুপুরে খেতে বসে চেনা পরিচিত খাবারের মাঝে দুটো অচেনা খাবার চোখে পড়ল রিমঝিমের৷ তাহমিনা পরিচয় করালেন ওকে। একটা সিদল অপরটার নাম শোলকা। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী দুটো খাবার। শোলকা প্রস্তুতের মূল উপাদান পাটশাক ও সোডা। শোলকায় সোডা ব্যবহার করা হয় মূলত খাদ্যের মসৃণতা বৃদ্ধি করতে। পাটশাক যেহেতু কিছুটা তিতকুটে তাই তিতকুটে ভাব কাটাতে কুমড়ো শাক, পুঁইশাক, লাউশাক, সজনেপাতা ইত্যাদি পছন্দমতো শাকও এর মধ্যে যোগ করা হয়। সেই সঙ্গে স্বাদ অনুযায়ী মশলার মিশ্রণ। আর সিদল প্রস্তুত করা হয় ছোটো মাছ কড়া রোদে শুকিয়ে। সেটাকে পাটা কিংবা হামানদিস্তায় গুড়ো করে নেওয়া হয়। এরপর কচুর ডগা কেটে, পানি ঝরিয়ে, রোদে শুকিয়ে পেস্ট করে নেওয়া হয়। সেই পেস্টে গুড়ো শুটকির মিশ্রণ ঘটিয়ে তেল, মশলা, সোডা, এলাচ যোগ করে কাবাবের মতো দলা বানিয়ে প্রস্তুত করে সিদল। সংরক্ষণ করা যায় অনেকদিন। এরপর এটাকে ভর্তা কিংবা রান্না করে খাওয়া যায়। আজ সিদল ভর্তা করা হয়েছে। রিমঝিম শাকপাতা, শুটকি জাতীয় খাবার কম পছন্দ করে বলে তাহমিনার সন্দেহ ছিল এই খাবার মেয়েটি ছুঁয়েও দেখবে না। কিন্তু আগ্রহের আতিশয্যেই যেন নতুন পরিচিত দুটো খাবার রিমঝিম খেলো।

গ্রামে এসে অবধি আলমগীর সাহেবের দর্শন পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব চেনা, পুরোনো মানুষের সঙ্গে দেখা করছেন, জমিয়ে গল্প করছেন, ঘুরছেন-ফিরছেন। তাহমিনারও গল্পের শেষ নেই। তবে রিমঝিমের প্রতি সজাগ মনটা সর্বদাই সতর্ক। এলাকার মানুষ হাজারটা প্রশ্ন করে বিব্রত করতে ছাড়বে না বলে ওকে একা কোথাও যেতে দেননি উনি। কিন্তু তাতে বিব্রতকর কথা বন্ধ হলো না। চেনা পরিচিত মহিলারা বাড়ি বয়ে আলাপ করতে এসে তাহমিনাকে বললেন,
“সেই তো বোনের মেয়েকেই আগলে রাখলে সারাজীবন। বিয়ে করে নিলে না কেন? আলমগীরও তো করল না। অথচ এক বাড়িতেই রইলে এতগুলো বছর!”

তাহমিনা বিব্রত। এই প্রসঙ্গের মুখোমুখি হবেন বলেই গ্রামে আসতে দ্বিধা ছিল আলমগীর সাহেবের। একটা ভালো সম্পর্ক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে। মেয়েটার মাঝে না বিরূপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু রিমঝিম তাদের কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না। তেতো হেসে বলল,
“কারণ আমার কাছে মা ডাকের চেয়ে খালা ডাকটা বেশি প্রিয়। খালা মা হয়ে গেলে সম্বোধনের আগে সৎ শব্দটা জুড়ে যেত কিনা!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here