#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ সাইত্রিশ
তুলতুলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় সবাই রয়েছে। অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড ঝামেলা। বোঝার উপায় নেই এটা সত্যিই ভালো নাকি খারাপ। বাড়ির সবার কাছে প্রত্যেক টা মূহুর্ত যেনো একেকটাকে বছরের মতো লাগছে, যেনো পারই হতে চাচ্ছে না। তুলতুল বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে আফসা বেগম এসে তাকে জাপ্টে ধরে কেঁদে ফেলে৷ একটা মেয়েকে হারিয়ে তিনি এখন ভীতিগ্রস্ত, তুলতুলকে হারানোর শক্তি আর নেই তার। তুলতুল ছোট দেখে এমনিও আদরের তারপর তিয়াসা চলে যাবার পর তিনি যেনো মেয়েকে চোখে হারান, কখন কি হয় সে ভয়তে তুলতুলকে বেশি বের হতে দেয় না। কিন্তু তুলতুল তাকে ফাঁকি দিয়ে ঠিক বাইরে চলে যায়। তিনি যখন খুঁজে পায় না তুলতুলের স্বভাবগতভাবেই ধরে নেয় যে সে ইচ্ছে করে বাইরে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি চিন্তায় থাকেন, মাঝে মাঝে মেন গেটের সামনে গিয়ে দেখে আসে মেয়ে আসছে কিনা বা তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় কিনা। কিন্তু সেদিন রাতে তিনি কাজে ব্যস্ত ছিল আর ভেবেছে রাতে তুলতুল ভুতে ভয় পায় তাই বের হবে না তাই আর খেয়াল করেন নি।
-” কোথায় ছিলি তুই? হ্যাঁ? কত ভয় পেয়েছিলাম আমরা জানিস? কেন একটুও কথা শুনিস না? তুই বাইরে বের না হলে কারো সাহস নেই যে তোকে রুম থেকে তুলে নিয়ে যাবে। তাহলে কেন এমন করে নিজের বিপদ ডেকে আনিস? কবে বুঝবি তুই? তিয়াসাকে হারিয়েছি এখন তোকেও যদি হারাতে হয় তাহলে আর বেঁচে থাকবো কিভাবে?” মায়ের কথা শুনে তুলতুল এবার জোরে কান্না করে দেয়। মাকে দেখেই তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল আর এখন এমন কথা শুনে সে আর কান্না আটকাতে পারে নি। সেসময় তিয়াস বলে
-” মা ওকে এখন কান্না করতে মানা করো। ও কেন কান্না করছে? সবসময় আমাদের টেনশনে রাখবে। হাজার বলার পরও কথা শুনে না। রাত বিরাতে একা একা ঘর থেকে কেন বের হতে হবে? আর তোর এতই ঘোরার ইচ্ছে ছিল তাহলে আমাকে কেন বলিস নি? বললে কি আমি নিয়ে যেতাম না?” তিয়াসের কথা শুনে তুলতুল আরো কান্না করে বলে
-” ভাইয়া তুমিও আমাকে বকছো?”
-” মা ওকে বলে দাও আমি কারো ভাই না। আমার সাথে কথা যেন না বলে।”
-” কি শুরু করেছিস তোরা? মেয়েটা কেবল বাড়ি এলো, কোথায় কিভাবে, কি হয়েছিল? সে ঠিক আছে কিনা তা জিজ্ঞেস না করে এখন কিসব বলছিস? থাম এখন!” তফিজ আহমেদ এসে মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসালেন।
-” কি হয়েছে সেটা শুনা যাবে। তার আগে তোমার মেয়েকে আগে বকে নেই। ও কেন এমন করেছে? আর ঠিক থাকার কথা বলছো? সে এখন ঠিক আছে। যার কাছে এতক্ষণ ছিল সে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক ভাবে তোমার মেয়েকে দিয়ে যাবে না বাবা।” তিয়াস বলে।
-” তুই কার কথা বলছিস? ও কার কাছে ছিল?”
-” রাফসানের কথা বলছি। আবার কার কথা বলবো?”
-” তুই জানলি কি করে যে ও রাফসানের কাছে ছিল? আর রাফসান কেন ওকে তুলে নিয়ে যাবে? ছেলেটাকে তো অসভ্য মনে হয় না দেখে।”
-” উফফ! বাবা রাফসান কেন নিয়ে যাবে তোমার মেয়েকে? সে কি পাগল হয়ে গেছে যে তোমার আধপাগল মেয়েকে নিজের কাছে রাখবে? তাছাড়া রাফসানের কোন কাজেই প্রমাণ করে না যে ওকে সে তুলে নিয়েছিল৷ আমি নজর রেখেছিলাম। রাফসানই ওকে বাঁচিয়েছে। ফোনে কন্ঠ শুনেই বুঝেছি কে ছিল।” তিয়াসের আড়চোখে একবার তুলতুলের দিকে তাকায়। আর তুলতুল কাঁদো কাঁদো হয়ে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তিয়াস তা পাত্তা দিল না। তাই তুলতুল অভিমানে বিরবির করে। আফসা বেগম তুলতুলকে পানি দেয়। তুলতুল পানি খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে।
-” কি হয়েছে? খারাপ লাগছে খুব?” আফসা বেগম জিজ্ঞেস করে।
-” মাথা ব্যাথা করছে অনেক।” তুলতুলের কথায় আফসা বেগম তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলায়। আর তাওহী এগিয়ে এসে তার আরেকপাশে বসে। মন খারাপ তাই সে আজকে একটাও কথা বলেনি। দুইদিন সে আপুর জন্য অনেক কান্না করেছে। ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে ঘুম থেকে উঠে তুলতুলকে দেখে খুশি হয় কিন্তু কথা না বলে তুলতুলের গা ঘেঁষে বসে। তফিজ আহমেদ এবার তুলতুলকে বলে
-” মা আস্তে আস্তে বল তো এখন কি হয়েছিল?” তুলতুল তার বাবার কথায় চোখ খুলে তারপর সবকিছু বলে তাকে। সেদিন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর তার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে পড়া দেখে। অনেক চিৎকার করে কান্না করেও কিছু হয়নি কেউ আসেনি তাকে বাঁচাতে। পরেরদিনও তার সামনে কেউ আসে নি। কিন্তু রাতে কেউ এসে দরজা খুলে রুমে ঢোকে। কিন্তু লাইট অন করে না। অন্ধকারেই তুলতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে কয়েকটা থাপ্পড় মারে। যেন তার ওপর কত বছরের জমে থাকা ক্ষোভ মেটাচ্ছে। অন্ধকার থাকার কারনে তুলতুল চেহারা দেখতে পায় না ব্যক্তিটির। কিন্তু মেয়েলি কোন পারফিউমের ঘ্রাণ পায়। এতে সে বুঝতে পারে আঘাতকারী একজন নারী। পরে তুলতুলকে ইনজেকশন পুশ করে ওকে ওভাবে ফেলে চলে যায়। পরেরদিন সকালে চোখ খুললে নিজের সামনে পাউরুটি, কলা আর পানি দেখতে পায়। হাত পায়ের বাঁধন খোলা। সে কোনরকমে খেয়ে নেয় তা কাঁদতে কাঁদতে। সে সময় আর কারো কথা মাথায় না এসে তার রাফসানের কথা মাথায় আসে। সে যখন বড় কোন বিপদে পড়েছে রাফসান তাকে তা থেকে উদ্ধার করেছে। যদিও মস্তিষ্ক তাকে বলে যে রাফসান কিভাবে জানবে যে সে এখানে? সে হয়তো জানেই না তুলতুল নামের একটা মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছে। তারপরও তার মন বলে রাফসান আসবে, তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। মনে প্রানে এটাই বিশ্বাস করছিল তখন। কেন সেই মূহুর্তে তার অন্য কারো কথা মনে না হয়ে রাফসানকে মনে পড়েছিল তা সে জানে না। হয়তো সে তাকে ভালোবাসতো বলে আর আগেরদিন রাতে রাফসানের বলা ভালবাসি কথা শুনে। খাবার পড়ে তুলতুল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে তার চেতনা শক্তি রাশ পেতে থাকে। হালকা হালকা কিছু মনে পড়ে কেউ এসে তাকে জোর করে পানি খাওয়ায় আর ইনজেকশন পুশ করে চলে যায়। এভাবেই অর্ধ চেতনা আর অর্ধ জ্ঞানহীন ভাবে তার আরেকটা দিন কেটে যায়। পরেরদিন খাবার দিতে আসার সময় সে জাগ্রত ছিল। কিন্তু যে লোকটি তাকে খাবার দিতে আসে সে তার দিকে কুনজরে তাকায়। একসময় তাকে জোর করতে থাকে। পরে সে পায়ের জুতা আর চেয়ার দিয়ে মারে লোকটিকে। লোকটি এতে আরো রেগে তাকে মুখ চেপে ধরে পানি খাওযায় তারপর আবার ইনজেকশন দেয়। ভেবেছিল এর সুযোগ নিবে কিন্তু ফোন আসায় আর পারে নি। এরপর তো তার মনের কথা সত্যি করে রাফসান সত্যিই এসেছিল তাকে বাঁচাতে। তুলতুলের কথাগুলো শুনে তার মা আর তাওহী কান্না করে তাকে ধরে আর বাবা আর তিয়াসের চোখ ছলছল করে উঠে। তাদের জীবনে একটার পর একটা বিপদ যেনো লেগেই রয়েছে। তিয়াস আর রাগ করে থাকতে পারে না। সে এসে তুলতুলকে সব ধরে বলে
-” তোর এই অপদার্থ ভাইকে মাফ করে দিস। তোকে সঠিক সময়ে রক্ষা করতে পারিনি।”
-” ভাইয়া কি বলছো তুমি? তুমি কখনোই ব্যর্থ নয়। সবসময় আমাকে আগলে রেখেছো। পুরো পরিবারকে আগলে রেখেছো। আর আজকে এটা আমার নিজের জন্যই হয়েছে। সরি।” বলে তুলতুল মাথা নিচু করে রাখলো। আর আফসা বেগম বলে
-” আর কখনো এমন করিস না। কত কষ্ট দিয়েছে ওরা তোকে। আজ যদি ওই ছেলেটা না যেত তাহলে কি হতো তোর? আমার ভাবতেই ভয় করছে। আজ থেকে তোমার বাড়ির বাইরে একা একা যাওয়া মানা। বুঝেছো?” এমন সময় দিয়া হন্তদন্ত ভাবে ছুটে এসে তিয়াসকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে তুলতুলকে ধরে কেঁদে দেয়।
-” তু.. তুই খুব খারাপ। তোর আমার কথা একবারও মনে পড়লো না? কিভাবে তুই চলে গেলি?” দিয়ার কথায় তুলতুল কিছু বলার আগেই তিয়াস দিয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলে
-” এমন ভাব করছে যেন ও পিকনিকে গিয়েছিল আর তাকে নেয়নি তাই এভাবে কাঁদছে।” তিয়াসের কথায় দিয়া রাগ করে তাকায় তার দিকে। সেদিনের পরে দিয়া আর তিয়াসের মুখোমুখি হয়নি ভয়ে আর লজ্জায়। কিন্তু তুলতুলকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে সে এ বাড়িতেই ছিল শুধু তিয়াস আসলে লুকিয়ে থাকতো।
-” সমস্যা কি আপনার? সবসময় আমার পেছনে লাগেন কেন? আর তুলতুল পিকনিকেই যাক আর বিয়ে বাড়িতেই যাক বা অন্য কোথাও যাক সবসময় আমাকে নিয়ে যাবে তাতে আপনার কি?”
-” আমার কি তা তোকে পরে বোঝাবো” বিরবির করে বলে তারপর দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে
-” আমার তো কোথাও সমস্যা নেই। একদম ফিট আছি। আর আমি তোর পেছনে না সামনেই আছি বুঝেছিস?” কিন্তু দিয়া তার কথায় রাগী ভাবে তাকিয়ে তুলতুলকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে। তুলতুল সংক্ষিপ্ত ভাবে তাকে বুঝিয়ে বলে।
-” যাক রাফসানকে তো অন্তত কাজে লেগেছে। এ লোক যে ভয়ংকর, কাউকে বাঁচাতে পারে জানা ছিল না। যাইহোক তাকে আমার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ আমার মেন্টাল ফ্রেন্ডকে বাঁচানোর জন্য। ছেলেটা অনেক ভালো,শুধু একটু রাগ বেশি আর ধমকি ধামকি করে তাছাড়া একদম দশে দশ প্রাপ্ত ছেলে।” দিয়ার কথায় তিয়াস আর তুলতুল রাগী ভাবে তাকায়। আর দিয়া তাদের রাগের কারন না বুঝে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায় যে কি হয়েছে? আর আফসা বেগম দিয়ার কথা শুনে বলে
-” একদম ঠিক বলেছিস তুই দিয়া। ছেলেটা না থাকলে তো তুলতুলকে পেতামই না। কিভাবে কি করে ওকে খুঁজে বের করে বাঁচিয়েছে। কিন্তু ছেলেটার নামই শুধু শুনেছি দেখিনি কোনোদিন। আরো একদিন তুলুকে বাঁচিয়েছিল। বাড়িতে মনে হয় তিনবার দিয়ে গেছে কিন্তু ভেতরে আসেনি। হ্যাঁ রে তুলতুল তুই ছেলেটাকে আসতে বলবি না বাড়িতে? শুধু সামনে থেকেই চলে যায়। যতই গ্যাংস্টার হোক না খারাপ তো না, হলে তো তোকে আর বাঁচাতো না। তাহলে কেন আসতে বলিস না? জানি যা করেছে তাতে ধন্যবাদ দিয়ে আর ছোট করবো না কিন্তু কৃতজ্ঞতা তো স্বীকার করতেই পারি।অনেক করেছে সে। সেজন্য তার কাছে আমরা ঋণী। আবার দেখা হলে বাড়িতে আসতে বলবি আমি নিজে রান্না করে খাওয়াবো তাকে। এটুকু তো করাই যায়। হ্যাঁ রে তিয়াস তুই কি বলিস?”
-” আমার সমস্যা নেই। কিন্তু দেখো তোমার মেয়েই হয়তো আসতে দেবে না। সে তো আবার তাকে ভয় পায়।”
-” সেকি তুলতুল? তুই ছেলেটাকে ভয় পাস কেন? তোকে তো কিছু করেনি। ভয় পায় না। একদিন বলিস ঠিকাছে?”
-” মিস্টার গুন্ডা মহাশয়, আমার মনকে তো দখল করেছেন আর এখন আমার পরিবারও আপনার সুখ্যাতি করছো। বাহ বাহ ভালোই! বিয়ে করতে দেরি হবে না।” ভেবে তুলতুল দুষ্টু হাসি দিল। সাথে তার গালও লাল হয়ে গেছে। এখনই বিয়ের কথা ভাবছে সে? কি সাংঘাতিক! সে এবার প্রেমে পাগল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
তুলতুল রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কাঁথা টা নাক পযন্ত টেনে নেয়। চোখের দৃষ্টি সিলিং ফ্যানের ওপর আবদ্ধ কিন্তু মন অন্যদিকে। রাফসান তার মাথায় ঘুরছে। এক মূহুর্তের জন্যও তাকে ভুলছে না। তাকে মনে করে নিজের মনেই হাসা, নানারকম ভাবনা ভাবা। আবার নিজেই লজ্জা পাওয়া। তার কথা ভাবলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করা, হার্ট বিট দ্রুত হওয়া, আবার বুকের ভেতর সুক্ষ্ম চিনচিনে মিষ্টি ব্যাথা হওয়া। প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভতি গুলো এমনই। তার কিশোরী মনের সবটুকু আবেগ, ভালোবাসা রাফসানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। গাড়ি থেকে নামার আগ মূহুর্তে তার চুল ঠিক করে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু উপদেশ দিয়েছে, সাবধানে থাকবে, একা বের হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকে কথা বলার সময় সবসময়ের মতো রুড়তা ছিল না, ভালোবাসায় ঘেরা ছিল। চোখ, মুখে ছিল তার জন্য একরাশ স্নিগ্ধ ভালোবাসার আবেশ। তুলতুলের শান্তি শান্তি লাগছে এখন। রাফসানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি। কিন্তু রাতে ফোনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমের ভেতর হাতরিয়ে হাতরিয়ে ফোন খুঁজে কোনরকম চোখ খুলে ফোন রিসিভ করে। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ কথা বলে না। তুলতুল ঘুমে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে
-” হ্যালো? কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? আরে কথা বলবেন না যখন তাহলে ফোন করেছেন কেন? মাঝরাতে মানুষের ঘুমে ডিস্টার্ব করে। আজব পাবলিক! ফোন রাখেন।”
-” আমার চোখের ঘুম হারাম করে নিজে এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছ তাই না?”
-” শালার মানুষের সমস্যা কি? রাতে….” তুলতুল তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে বসে। রাফসানের কন্ঠ শুনলো না? রাফসান তাকে ফোন দিয়েছে? আর সে ঘুমের ভেতর তাকে উল্টো পাল্টা বকছে? তুলতুল দাঁত দিয়ে জিহবায় কামড় দিয়ে অস্বস্তি নিয়ে ফোন কানে নিয়ে বলে
-” হ্যালো?”
-” যাক মহারানীর ঘুম ভেঙে হুঁশ এসেছে তাহলে।আমি তো ভাবলাম আজ বুঝি রাজ্যের বকা আমাকে খেতে হবে।” রাফসানের কথায় তুলতুল নিজের মাথায় একটা বারি দিল। তারপর আমতাআমতা করে বলে
-” সরি, ঘুমের ভেতর কি থেকে কি বলি আমি নিজেই জানিনা।”
-“তাই?”
-” হুম! আচ্ছা আপনি আমার নাম্বার কিভাবে পেলেন? আমার যে ফোন আছে তা আমার ফ্যামিলি আর কয়েকজন ফ্রেন্ড ছাড়া কেউ জানে না। তাহলে কিভাবে পেয়েছেন?”
-” তোমার মনে কে আছে তা জেনে গিয়েছি আর ফোন নাম্বার তো মামুলি জিনিস।”
-” ওহ!” তুলতুলের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। তার মনে হচ্ছে সে শব্দ রাফসান ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পারছে। এভাবে রাফসান শান্ত স্বরে ভালোভাবে তার সাথে কখনো কথা বলেনি তাই আজ একটু কেমন যেন লাগছে তার। তারপরও রাফসান আর কোন কথা বলছে না। সে অস্বস্তি কাটাতে রাফসানকে জিজ্ঞেস করে
-” কি করছেন?”
-” তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি।” রাফসানের সহজ স্বীকারোক্তিতে তুলতুল মনে হয় একটা হার্ট বিট মিস করলো। তারপর আবার দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করলো তার হার্ট নামক লাফানা বস্তুটি, তার মনে হচ্ছে তার হার্ট নিজের কাজ ভুলে গিয়েছে, নাহলে এভাবে কারনে অকারনে বিট করে তাকে কেন ঝটকা দিচ্ছে? হার্টের কাজ হবে তার রক্ত পাম্প করা, তা না করে কেন জিনিসটা তাকে এতো ঝটকা দিচ্ছে? উফফ! তুলতুল এমন একটা ভাব করলো যেন সে রাফসানের উত্তর শোনে নি। তাই সে প্রশ্ন করলো
-” আপনি কোথায়?”
-” মরে যাচ্ছি!”
-” কিহ? কোথায় আপনি? কি বলছেন এসব আপনি? কি হয়েছে? হ্যালো? প্লিজ নিজের ক্ষতি করবেন না। আমি আসছি কোথায় আপনি? এই কি হয়েছে আপনার?” তুলতুল উত্তেজিত ভাবে বলে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন। কোনকিছু না ভেবেই সে চট করে উঠে দরজার দিকে আগায়। কিন্তু রাফসানের হাসি শুনে সে থেমে যায়, সাথে ঘাবড়েও যায়। রাফসান বলে
-” তোমার প্রেমে মরেছি আমি। তুমি কি ভাবছো আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি? রিলাক্স! রাফসান এতো আবেগি নয় যে সে সুইসাইড করবে। এমন হলেতো আমার চিহ্নও থাকতো না এতদিন। হাজার কষ্ট পেলেও সে মোকাবেলা করে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। সে ডোন্ট ওয়ারি!” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল কান্না করে দেয়।
-” আপনি খুব খারাপ। জানেন আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলা?” বলে কান্না করতে করতে বিছানায় এসে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। তারপর বলে
-” কথা বলবেন না আমার সাথে আর সামনেও আসবেন না আমার।” বলে ফোন কেটে দিতে চায় কিন্তু রাফসানের চিৎকার শুনে আবার ফোন কানে নিয়ে শুনে রাফসান চিৎকার করে বলছে
-” একদম ফোন কাটবে না। ফোন কেটে দেখো আমি কি করি। জানতো আমি অনেক খারাপ। সো আমাকে উল্টো পাল্টা করতে বাধ্য করবে না।” তুলতুল একথা শুনে নাক টেনে বলে
-” একদম ভালো না আপনি।”
-” ইয়াহ, আই নো বেবি।”
-” ডোন্ট কল মি বেবি।”
-” আমি বলবো তাতে তোমার কি?” তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে
-” তুলতুল?”
-” হু?” তার কেমন যেন লাগলো নিজের নাম রাফসানের মুখে শুনে। রাফসান কখনো তাকে এভাবে ডাকে না। কিন্তু খারাপ নয় বরং ভালোই লাগছে।
-” তোমার নিঃশ্বাসের প্রতিটা শব্দ শুনে আমার বুকে লাগছে। মনে হচ্ছে আমি তোমাকে অনুভব করতে পারছি। এত কেন মায়া তোমার ভেতর? কেন এভাবে আমায় টানো বলোতো? নেশা হয়ে যাচ্ছ আমার। এমন হলে আমি নিজেকে তোমার থেকে এক মূহুর্তোও দূরে থাকতে পারবো না। তাহলে আমার কাজের কি হবে বলোতো? তোমার কান্নামাখা কাজল ল্যাপ্টানো মায়াবী চেহারা, তোমার ঘুমন্ত চেহারা, ঘুম ঘুম কন্ঠ সবকিছুই নেশাময়। উফফ!
-” আপনি রোমান্টিক মুডে যাচ্ছেন কেন? প্লিজ গুন্ডা মুড অন করুন। ওটাতেই আপনাকে মানায়। আপনার কথা শুনে আমার যেন কেমন লাগছে।” তুলতুল মুখ ফুলিয়ে বলে। আর তুলতুলের কথা শুনে রাফসান হেসে দেয় তারপর বলে
-” কেমন লাগছে? অবশ্য আমি অনেক রোমান্টিক কিন্তু সেটা এখনি তোমাকে দেখাচ্ছি না। সো চিল! আর গুন্ডা মুড অন করতে বলছো? তাহলে এসে গলাটা চেপে ধরি?”
-” ধুর! খালি ভয় দেখায়।” তুলতুল রাগ করে বলে।
-“এখনো অনেক ভয় পাও?”
-” জানিনা।”
-” আচ্ছা, একটা কথা বলো তো।”
-” কি?”
-” যদি কখনো শোনো যে আমি আগে অন্য কাউকে ভালোবাসতাম তাহলে কি করবে?” রাফসানের কথা শুনে তুলতুল মুখ কালো করে বলে
-” জানতাম তো! আমি ধরেই নিয়েছিলাম আপনি প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে এমন ব্যাকা হয়ে গেছেন। হুহ! আমার ভাবনা সত্যি হয়ে গেলো।”
-” তাই নাকি? কিন্তু আমি তো ছ্যাঁকা খাই নি।” রাফসানের এই কথাটা তুলতুলের কানে মনে হলো দুইবার বাজলো। সে বারান্দার দিকে তাকায়, রাফসানকে দেখে আনমনে আবার ফোনের কথা বলতে গেলে খেয়াল এসে সে উঠে বসে চোখ বড় বড় করে তাকায়। তার হেঁচকি উঠে। রাফসান তা দেখে হেসে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে তুলতুলের হাতে দেয়। তুলতুল তা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে
-” আপনি? সত্যি এসেছেন? কখন এসেছেন? আর কিভাবে এসেছেন? মানে কি করছেন?” তুলতুল এক নিঃশ্বাসেই বলে। তা দেখে রাফসান তার পাশে বসে
-” আস্তে, কুল! উত্তর হলো আমি সত্যিই এসেছি যখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তো তারপর ভাবলাম আমার ঘুম কেড়ে তুমি বেঘোরে কেন ঘুমাবে? তাই বাইরে গিয়ে ফোন দিলাম, ফোনে কথা বলছিলাম আর রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, তারপর তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাইচলে এলাম। আর কিভাবে এসেছি তা তোমার না জানলেও চলবে।” রাফসান তুলতুলের দিকে তাকায়, দেখে সে হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফসান তুলতুলের গাল টেনে দিলে তার হুঁশ হয়। সে বলে
-” দেখেছেন এমনি আপনাকে গুন্ডা বলি। এত রাতে গুন্ডা গিরি করতে চলে এসেছে। গেটের তালা নিশ্চয়ই ভেঙে ফেলেছেন? গুন্ডা, পান্ডা একটা।”
-” তাহলে তো একটু গুন্ডাগিরি করতে হয় তাইনা? তারা তো খারাপ হয়।” বলে তুলতুলের দিকে ঝুঁকে তার মুখের সামনে চলে যায়। আর তুলতুল ভয়তে গড়িয়ে খাটের ওপাশ থেকে নেনে দাঁড়িয়ে রাফসানের দিকে ভয় নিয়ে তাকায়। রাফসান তা দেখে মুচকি হাসে। সে তুলতুলকে তারপাশে বসতে বলে যে কিছু করবে না। তুলতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভয় নিয়ে রাফসানের পাশে বসে। রাফসান তার নাক টেনে দিয়ে বলে
-” এখন কেমন লাগছে? ”
-” ভালো”
-” খেয়েছো?”
-” হুম,আপনি?”
-” খেয়েছি। বাড়িতে বকা দিয়েছে?”
-“বলবো না।। কিন্তু সবাই আপনার প্রশংসা করেছে। আর আপনাকে বাড়ি আনি নি বলে রাগ করেছে। আমি বলেছি তারপরেও কিন্তু আসেন নি আপনি। ব্যাপার কি? ”
-” ব্যাপার কিছুনা আমার কাজ ছিল। আর প্রশংসা করেছে তো আমাকে আর তোমার ফ্যামিলিকে রাজী করতে বেশি কষ্ট হবে না।” আরো নানারকম কথা চলতে থাকে তাদের ভেতর। তারপরেও মনে হয় আরো অনেককিছু বলার আছে। রাত অনেক হয়ে গেলে কথা বলতে বলতে রাফসান তুলতুলের দিকে তাকায়। দেখে সে তার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে তার একহাত ধরে। রাফসান হাসলো। কেমন বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়েছে। মায়াবী দেখতে লাগছে এখন তাকে। তাকে ভয় পায় অথচ সে রুমে থাকতেও অল্প সময়ের ভেতর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। এ-থেকেই বোঝা যায় তাকে অনেক ভরসা করে মেয়েটা। রাফসান নিজের হাত তুলতুলের থেকে ছাড়িয়ে তাকে ভালো করে বালিশে শুয়িয়ে কাঁথা টেনে দেয় গায়ে। তারপর তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথায় হাত বুলায়। রাত অনেক হয়ে গিয়েছে এখন আর থাকা চলে না এখানে তার, সে তুলতুলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তার দিকে তাকায় তারপর হাতের উল্টো পাশে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে হাত ঠিক ভাবে রেখে রুমে থেকে চলে যায়। মনে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে।
চলবে…..