মেঘের ভেলায় চড়ে পর্ব -২৪+২৫

#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#part_24
#Ariyana_Nur

দূর আকাশে বিশাল বড় থালার মত চাঁদটা তার রুপালি আলো ধরণীর বুকে ঢেলে মেলে দিয়ে আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করছে।চাঁদ এর সাথে মিলে তারারাও মিটমিট করে জ্বলে নিজেদের আলো ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে।এক চাঁদের আলোতে আরেক চাঁদকে নিজের বক্ষ পিঞ্জরে আটকে চুপচাপ বসে রয়েছে তীব্র।রাই তীব্রর বক্ষ পিঞ্জরে মাথা রেখে নিরবে চোখের জল ফেলে চলেছে।মান-অভিমানের পালা শেষ করে নিজের সব থেকে আপন জায়গায় মাথা গোজার ঠাই পেয়ে আজ যেন চোখের জলের বাধই মানছে না।তীব্রও রাইকে আজ বাধা দিচ্ছে না।চুপকরে বসে রাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রাই এর কান্না দেখে যাচ্ছে।চাঁদের আলোতে তার অভিমানী চাঁদ এর কান্না দেখতে মন্দ লাগছে না।কান্নারত মায়াবী চেহারায় চাঁদের আলো পরে যেন মায়াবী চেহারার মায়া আরো শতগুন বাড়িয়ে তুলেছে।অনেকক্ষন অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন দেখলো রাই এর কান্না থামার নাম গন্ধ নেই তখন তীব্র রাইকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে রাই এর চোখের জল মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

—হয়েছে তো আর কতো কাদবে?আজ কি আমার বুকে ছোট খাট একটা পুকুর বানানোর পরিকল্পনা করেছো নাকি?

রাই ছলছল চোখে তীব্রর দিকে তাকিয়ে কন্দনরত গলায় বলল,

—এতোদিন কেন আমায় দূরে ঠেলে রেখেছিলেন?কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তাই না?জানেন কত রাত পযর্ন্ত আপনার অপেক্ষায় জেগে থেকেছি?আপনাকে আপনার মিষ্টি শ্বাষণ গুলো কত মিস করেছি।কেন এমনটা করলেন?কি ভূল করেছিলাম আমি?

কথাগুলো বলতে বলতে রাই এর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল।তীব্র পূনরায় রাই এর চোখের জল মুখে দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

—তুমি কোনই ভূল করনি চাঁদ।সব দোষ আমার।সত‍্যি বলতে আমার জন‍্য তোমার ঐ অবস্থা আমি মেনে নিতে পারিনি।তোমার ঐ অসুস্থ মলিন মুখটা দেখলেই আমার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যেত।নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে অসহায়,দূর্বল মানুষ মনে হত।নিজের প্রতি ঘৃণা কাজ করত।কেমন মানুষ আমি নিজের সামনে নিজের ভালো থাকার মানুষটাকে সেফ করতে পারিনি।নিজের কাছেই নিজেকে অনেক ছোট মনে হত।আয়নায় নিজের চোখে নিজে চোখ রাখতে পারতাম না।তাহলে সেখানে কিভাবে তোমার সামনে দাড়িয়ে তোমার চোখে চোখ রাখতাম বল।দ্বিতীয়ত তোমার উপর অভিমান হয়েছিলো কেন তুমি আমার জন‍্য নিজের ক্ষতি করতে গেলো?যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে আমার কি হত?এমন ভূল আর কখনো করোনা চাঁদ।

—জানেন তো এই সার্থপর দুনিয়াতে কেউ কোন কিছুই সার্থ ছাড়া করে না।ঠিক আমিও যা করেছি আমার সার্থের জন‍্য করেছি।আমার আমিটাকে বাচানোর জন‍্য একবার না বারবার আমি এমন সার্থপর হতে পারি।বুঝেছেন মিঃভিলেন।

রাই এর কথা শোনার সাথে সাথেই তীব্র রাইকে নিজের বক্ষ পিঞ্জরে আটকে নিল।বিরবির করে বলে উঠল,

—এতোটা সার্থপরের মত কথা বল না।তোমার কিছু হলে তোমার তুমিটা যে নিস্ব হয়ে যাবে।পুরো নিস্ব হয়ে যাবে।আমার জন‍্য তোমার কিছু হলে আমি বেচে থেকেও মরে যাবো।

_________

নাকে তেল দিয়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছে তিহান।ফাইজা তিহান এর ঘুমের বেঘাত ঘটিয়ে তিহানকে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো।তিহান ঘুমের ঘরেই একটু নাড়াচাড়া করে আবার আগের মত আয়েশ করে ঘুমিয়ে রইল।তিহান এর কাজে ফাইজা বিরক্ত হয়ে তিহানের হাতের আঙুলে কামড় বসিয়ে দিল।সাথে সাথেই তিহান ধরফর করে উঠে চেচিয়ে বলল,

—ইদুর!ইদুর! ফাইজা রুমে ইদুর ঢুকেছে।আমায় ইদুর কামড় দিয়েছে।

অন‍্যদিন হলে ফাইজা আজ তিহান এর সাথে তুরকালাম বাধিয়ে দিত।কিন্তু আজকে ফাইজার মনটা অনেক ভালো তাই তিহানের কথা গায়ে না মেখে তিহানের হাত জরিয়ে ধরে কাধে মাথা রেখে নরম গলায় বলল,

—তোমার ইদুর থাকতে অন‍্য ইদুরের সাহস আছে তোমায় ধারের কাছে আসার।মেরে না একেবারে আলুভর্তা বানিয়ে দিব।

তিহান ফাইজার দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে ফাইজার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করল।ফাইজার চেহারায় খুশির ঝিলিক দেখে তিহান এর কপালের ভাজ আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে গেলো।

—কি হয়েছে আমার ইদুর রানীর?এতো খুশি খুশি লাগছে কেন?

—তিহান! আজ আমি অনেক অনেক অনেক খুশি।আমরা মিথ‍্যে দিয়ে যেই সম্পর্কটা শুরু করেছিলাম তা আজ সত‍্যি রুপ নিয়েছে।আমি পেরেছি তিহান আমার রাইজুর কে তার যোগ‍্য কারো হাতে তুলে দিতে।যে আমার রাইজুকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসে আগলে রাখবে।আমার রাইজুর সকল দুঃখ কষ্টে ভাগ করে নিবে।আমি পেরেছি তিহান আমি আমার রাইজু তার যোগ‍্য মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরেছি।

কথাগুলো বলতে বলতে ফাইজার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল।এই জল খুশির না আনন্দের।

(ফাইজা রাই এর কাছে তীব্র আর তার মাঝে সকল মান-অভিমানান শেষ হয়েছে জানতে পেরেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে।)

ফাইজার কথা শুনে তিহান এর চেহারায় ও খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল।

—সত‍্যি বলছো ফাইজা!ভাইয়া আর ভাবির মাঝে সকল মান-অভিমান দূর হয়ে গেছে?

—হুম।সত‍্যি বলছি।

— আলহামদুলিল্লাহ্।যাক তাহলে এতোদিনে আমার ভাইয়ের মাথায় আল্লাহ একটু শুবুদ্ধি দিয়েছে।

_______

বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে নিজের বেন্ডেজরত হাতের দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলে চলেছে দিপা বেগম।যতবার নিজের হাত দেখে ততবার ফিহাদ এর হিংস্র রুপটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।মানুষ এতোটা খারাপ,র্নিদয় কিভাবে হয় তার জানা ছিলো না।যেই দু’হাতে সে তার আদরের ভাতিজাকে আদর করেছে, বিপদ আপদে নিজের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার সেই আদরের ভাতিজাই তার হাতের রগ কেটে দিয়ে কিভাবে ফুটন্ত গরম তেলের মাঝে হাত ডুবিয়ে দিল?তার সাথে এমন ব‍্যবহার করতে একটুও কি ফাহাদ কষ্ট হল না?দিপা বেগম এর হ‍াতের মধ‍্যে যতটুকু ব‍্যাথা, জ্বালাপোড়া করছে তার থেকে তার মনের কষ্টই তাকে বেশি পোড়াচ্ছে।

ফাহাদ কয়েকজন কাজের লোক সাথে করে দিপা বেগম এর রুমে ঢুকল।দিপা বেগম ফাহাদকে এক নজর দেখে মাথা নিচু করে বসে রইল।

—বলেছিলাম না ফুপি!তোমার সকল কাজের লোকের ব‍্যবস্থা করে দিব।দেখলে কতজন কাজের লোক নিয়ে এসেছি।তুমি একদম টেনশন করবে না।এরাই তোমার সকল কাজ করে দিবে।একজন খাইয়ে দিবে একজন গোসল করিয়ে দিবে।তুমি শুধু ঘুড়ে ঘুড়ে তাদের উপর হুকুম চালাবে।এরা যদি তোমার যন্তে একটু অযত্ন করে তাহলে সাথে সাথে আমায় জানাবে।এই যে তোমরা!(কাজের লোকদের উদ্দেশ্য করে)আমার ফুপি যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে।যদি একটু ভূল হয় তাহলে তোমাদের খবর আছে।আমার কলিজার ফুপি বলে কথা তার কোন অযত্ন আমি মেনে নিব না।

ফাহাদ এর কথা শুনে দিপা বেগম ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে ফাহাদ এর দিকে তাকালো।ফাহাদ তা দেখে একটা রহস‍্যময়ী হাসি দিয়ে বিরবির করে বলল,

—এটা তো কিছুই না।পিকচার তো আরো বাকি আছে আমার কলিজার টুকরা ফুপি।

_________

প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ দোয়াদুরুদ পড়ে হাটাহাটি করতে বাহিরে যান মুনিয়া বেগম।আজও তার ব‍্যতিক্রম হয়নি।সকাল সকাল বাহিরের মিষ্টি হাওয়া শরীরে লাগিয়ে শরীর মন ফুরফুরে করে বাসায় চলে এল।নিজের কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় ভিতরে প্রবেশ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল।কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ কানে ভেসে আসতেই তার পা থেমে গেল।এতো সকালে কিচেনে কে কি করছে সেটা দেখতেই সে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।কিচেনে রাইকে দাড়িয়ে কাজ করতে দেখেই মুনিয়া বেগম এর চোখ কপালে।মুনিয়া উওেজিত কন্ঠে বলল,

—তুই এখানে কি করছিস?কিছু লাগবে বল আমি করে দিচ্ছি।এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কিচেনে কেন আসতে গেছিস?

—শুধু শুধু কেন উওেজিত হচ্ছো মা।আমি ঠিক আছি।

—বললেই হল ঠিক আছিস।কথা না বাড়িয়ে কিচেন থেকে বের হ।

—উফ মা বললাম তো আমি ঠিক আছি।আমি এখন পুরো সুস্থ কাজ করতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।তুমি বাহির থেকে এসেছো রুমে যেয়ে রেষ্ট নাও।আমার অসুবিধা হলে তোমায় ডেকে নিব।

—চুপ কোন কথা না।তাড়াতাড়ি কিচেন থেকে বের হ।কিছু লাগলে আমায় বল।আমি করে দিচ্ছি।যদি তীব্র জানতে পারে তুই কিচেনে এসেছিস তাহলে খবর করে ছাড়বে।চিল্লিয়ে বাসা মাথায় তুলে নিবে।

রাই নিজের হাতের কাজ করতে করতে বলল,

—করুক তাতে আমার কি?তাকে আমি ভয় পাই নাকি?

—তুই ভয় না পেলেও আমি ভয় পাই।

—কেন? তাকে এতো ভয় পাও কেন?কিছু বলতে এলে কান মলে দিতে পারো না।

মুনিয়া বেগম রাইকে কাজ করতে বাধা দিয়ে করুন গলায় বলল,

—ভালো মা আমার।পাগলামি করিস না।আমার কথাটা একটু শোন।তুই কি চাস সকাল সকাল বাসায় ঝামেলা বাঝাতে?

—তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ মা।তেমন কিছুই হবে না।তাছাড়া আমি এখন সুস্থ।দেখোনা সারাদিন শুয়ে বসে থাকতে থাকতে মোটু গুলুমুলু হয়ে যাচ্ছি।

—কে বলেছে তুই মোট হয়ে গেছিস?একটুও তুই মোটা হসনি পুরো ঠিক আছিস।

—তুমি বলছো মোটা হয়নি ঐ দিকে তোমার ছেলে বলছে আমি নাকি ময়দার বস্তা হয়ে গেছি।

—কি ঐ বাদরটা তোকে এসব বলেছে?হাতের নাগালে পেতে দে একবার দেখিস কি করি।ওর খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ।সাথে ইচ্ছে করে বকে দিব ঠিক আছে।এবার ভালো মেয়ের মত যা এখান থেকে।আমার কথা না শুনলে তোকে কিন্তু এবার মাইর লাগাবো।

রাই কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,

—তুমি কি গো মা!অন‍্য সব শাশুড়িরা বাড়ির বউদের কে কাজের উপর রাখে।কাজ না করলেই এটা সেটা কথা শুনায়।আর এদিকে তুমি?আমাদের একটুও কাজ করতে দাও না।

—কারন আমি তোদের বউ না মেয়ে মনে করি।জানিস আমার একটা মেয়ের অনেক সখ ছিলো।তীব্রকে দিয়ে তো ছেলের সখ মিটিয়েছিই।তিহান এর সময় খুব করে চাইতাম ও যেন মেয়ে হয়।সখ করলেই তো আর হয় না বল।তিহান হল ছেলে।মেয়ের জন‍্য আফসোস করলে তোর ছোট বাবা বলতো এতো আফসোস করো না তো।দুই ছেলে বিয়ে করিয়ে দুজন পুতুল বউ ঘড়ে তুলে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে নিজের মেয়ের সখ পুরোন কর।এখন তাই করছি।

রাই ছলছল চোখে মুনিয়া বেগম এর দিকে তাকিয়ে বলল,

—তুমি এতো ভালো কেন মা?

মুনিয়া বেগম মুচকি হেসে বলল,

—ভালো আমি না ভালো তোরা।তোদের নিয়ে আমার ছেলেরা ভালো আছে সুখে আছে।সেখানে আমি তোদের সাথে খারাপ ব‍্যবহার করে কেনই বা আমার ছেলেদের সংসারে আগুন লাগাতে যাবো বল।ওরা ভালো আছে তোরা ভালো আছিস এটাই আমার বড় পাওয়া আর কিছুই চাই না আমি।

—তোমার মত যদি সব শাশুড়ি হত তাহলে হয়তো এতো ঘরে ঘরে বউ, শাশুড়ির অশান্তি হত না।

—ভূল বললি শুধু শাশুড়ি ভালো হলে হবে না।বউদের কেও তোদের মত ভালো, মিষ্টি হতে হবে।একজন ভালো হলে হবে না।বউ,শাশুড়ি দুজনকেই ভালো হতে হবে।একে অপরকে বুঝতে হবে।তাহলেই পরিবারে শান্তি আসবে আর অশান্তি চিরতরে বিদেয় নিবে।
#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_25
#Ariyana_Nur

মৃত মানুষ যখন হঠাৎ সামনে জীবিত অবস্থায় উপস্থিত হয় তখন কেমন রিয়েক্ট করতে হয় তা রাই এর জানা নেই।রাই ফ‍্যালফ‍্যাল নয়নে সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।না চাইতেও চোখের কোনে এসে ভিড় জমেছে নোনা জল।চোখের জলের কারনে সামনের দাড়িয়ে থাকা মানুষটা মুখশ্রী অস্পষ্ট দেখা গেলেও রাই একি ভাবে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রেয়েছে।এটা সত‍্যি নাকি কল্পনা রাই এর জানা নেই।যদি সত‍্যি না হয়ে কল্পনা হয় তাহলে তো চোখের পলক ফেললেই লোকটা বিলিন হয়ে যাবে।তাই তো রাই অস্রুভেজা নয়নেই এক ধ‍্যানে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।থাক না কিছু ঘোটালে কল্পনা।তাতে সমস‍্যা কি?

তীব্র আজ জোর করে রাইকে চেকাপ করার জন‍্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।ডাঃ দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় সামনে অতি পরিচিত একজন কে দেখে রাই এর পা থেমে যায়।

—কেমন আছিস রাই?

সামনের মানুষটার শীতল গলার কথা শুনে রাই ধ‍্যান ভাঙলো।গুটিগুটি পায়ে সামনের মানুষটার দিকে আরো দু’কদম বাড়ালো।মানুষটাকে ছুড়ে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে কাপাকাপা হাতে তার গাল স্পর্শ করল।মানুষটাকে ছুতে পেরেই রাই এর চেহারায় খুশির ঝিলিক চলে এল।না এটা কোন মিথ‍্যে বা কল্পনা নয়।সে তার অতি কাছের একজন কে পূনরায় ফিরে পেয়েছে।রাই প্রফুল‍্য কন্ঠে বলে উঠল,

—দিশা আপু!সত‍্যি তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে আছো?তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসেছো?

রাই এর খুশি দেখে দিশা মলিন হেসে হাত বাড়িয়ে দিতেই রাই দিশাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করে দিল।এতো বছর পর আদরের বোনটাকে কাছে পেয়ে দিশার চোখেও পানি চলে এল।

দিশা রাই এর চাচাতো বোন।দিশা ছোট থেকেই ফাহাদ বলতে পাগল ছিলো।ফাহাদের জন‍্য ছোট থেকে কম পাগলামো করেনি দিশা।তার পাগলামোর জন‍্য দিপা বেগম, ফাহাদ এর হাতে অনেক মার খেয়েছে।তার পরেও তার শিক্ষা হয়নি।সে তার পাগলামো চালিয়েই গিয়েছে।দিশার পাগলামি দেখে অতিষ্ঠ হয়ে ফাহাদ এক সময় দিশাদের বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দেয়।তাতেও কোন কাজ হয় না। দিশা নিত‍্য নতুন পাগলামো নিয়ে ফাহাদ এর সামনে হাজির হয়ে যেত।ফাহাদ এর বকা চাড়-থাপ্পড় না খেলে তার পেটের ভাতই হজম হত না।এক সময় ফাহাদ দিশার পাগলামো সহ‍্য করতে না পেরে বাহিরে চলে যায়।কয়েক বছর পর বাহির থেকে এসে দিপা বেগম এর সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর রাই কে দিপা বেগম এর বাসায় দেখে ফাহাদ এর চোখ রাইতেই আটকে যায়।আস্তে আস্তে শুরু হয় রাইকে নিয়ে ফাহাদ এর পাগলামো।এই সব যেন দিশার সহ‍্য হচ্ছিলো না।নিজে যাকে ছোট থেকে পাগলের মত ভালোবেসে এসেছে তাকে তারই সামনে অন‍্য মেয়ের জন‍্য পাগলামো করতে দেখলে কিভাবেই বা তার সহ‍্য হবে।রাইকে নিয়ে ফাহাদ এর পাগলামো দিন দিন বাড়তে থাকে।আর এসব দেখে এক সময় দিশা রাইকে সহ‍্য করতে না পেরে রাই এর সাথে খারাপ ব‍্যবহার করা শুরু করে দেয়।ফাহাদ এসব জানতে পেরে দিশাকে অনেক মারধর করে।রাই এর থেকে দিশাকে দূরে রাখতে দিশাকে জোর করে বাহিরে পাঠিয়ে দেয়।দিপা বেগম ফাহাদ এর কাজে কোন রকম বাধা দেয়নি উল্টো তাকে সাপোর্ট করেছেন।দিশা মায়ের কাছে অনেক আকুতি মিনতি করেছে বাহিরে না যাওয়ার জন‍্য।কিন্তু তিনি দিশার কোন কথাই শুনেন নি।দিশা সকলের প্রতি রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে দেশের মাটি ত‍্যাগ করে।বাহিরে গিয়ে দিশা সবার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়।কয়েক মাস পর দিশা ইচ্ছে করেই সবার কাছে মিথ‍্যে খবর পাঠায় যে সে গাড়ি এক্রিডেন্টে মারা গেছে।খবর পেয়ে দিপা বেগম পুরো পাগলের মত হয়ে যায়।তারপর থেকে যেন রাই আরো তার চোখের বিষ হয়ে যায়।দিশার মৃত্যুর জন‍্য সে রাইকে দোষারোপ করতে থাকে।দিশার মৃত‍্যুর সব দোষ রাই এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।দিশা ফাহাদ কে ভোলার জন‍্য সকল কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু কিছুতেই সে ফাহাদকে ভুলতে পারে না।ফাহাদ কে যত বেশি ভোলার চেষ্টা করে ততই যেন দিশা ফাহাদ এর প্রতি আরো তীব্র ভাবে দূর্বল হতে থাকে।শেষে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে তার এক ফ্রেন্ড এর সাহায্য নিয়ে নিজের চেহারা নিজের নাম পাল্টে দেশের মাটিতে পা রাখে।দেশে আশার পর যখন জানতে পারে ফাহাদ জোর করে রাই কে নিজের সাথে বেধে রেখেছে।রাই এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাইকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।তখন যেন তার ভিতরের হিংস্ররুপটা বের হয়ে আসে।ফাহাদ যদি ভালোবেসে জোর করে আরেকজনকে তার সাথে আটকে রাখতে পারে তাহলে সে কেন ফাহাদকে জোর করে তার সাথে আটকাতে পারবে না।রাই এর বিয়ের আগে দিশা নিজের পরিচয় গোপন করে দিপা বেগম এর কাছে ফোন করে বলে,তার মেয়ে দিশা বেচে আছে।যদি সে রাই আর ফাহাদ এর বিয়েটা থামাতে পারে তাহলেই দিশা তাদের সামনে আসবে তা না হলে চিরতরে তারা দিশাকে হাড়িয়ে ফেলবে।যে মেয়েকে মৃত ভেবে এতোদিন প্রতিনিয়ত দিপা বেগম চোখের জল ফেলেছে তাকে একটা নজর দেখার লোভ দিপা বেগম সামলাতে পারেনি।তাই তো মনজুর মা রাই এর বিয়ের দিন রাইকে পালাতে সাহায্য করছে জানা সত‍্যেও কিছু বলেনি।উল্টো সে আরো রাস্তা ক্লিয়ার করে দিয়েছে।

—দিশা আপু এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে?তুমি বেচে থাকা সত‍্যেও কেনই বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করনি।

রাই এর কথা শুনে দিশা মুখে কিছু না বলে শুধু মলিন হাসল।

__________

রেস্টুরেন্টে কোনার এক টেবিলে ফাহাদ এর মুখোমুখি হয়ে বসে রয়েছে রাই।রাই নিজ থেকেই আর ফাহাদকে খবর দিয়েছে দেখা করার জন‍্য।ভিতরে ভিতরে রাই এর মধ‍্যে ভয় কাজ করলেও মুখে কঠিনত‍্য ফুটিয়ে রেখেছে।অপর দিকে ফাহাদ এতোদিন পর নিজের প্রিয় মানুষটাকে এতো সামনের থেকে দেখতে পেয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার পাখির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।তার পাখি বললে ভূল হবে তার পাখি তো অনেক আগেই তার পিঞ্জর ভেঙে ঊড়ে চলে গিয়ে আরেক জনের মনের কুঠরিতে বাসা বেধেছে।ভাবতেই ফাহাদ এর ভিতরটা হাহাকার করে উঠে।ফাহাদকে নিজের দিকে এমন ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাই এর অস্বস্থি হচ্ছে।রাই নাড়াচাড়া করে বসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।কি দিয়ে কথা শুরু করবে তা ভাবতে লাগলো।

—কেমন আছো রাই পাখি?

ফাহাদ এর শীতল কন্ঠের কথা শুনে আজ আর রাই ভয় পেল না।নাই বা দমে গেলো।রাই তার কথায় কঠিনত‍্য বজায় রেখে বলল,

—প্রথমত আমার নাম রাইজা।ছোট করে সবাই রাই ডাকে।আপনার যদি ছোট নাম ধরে ডাকতে কষ্ট হয় তাহলে মিসেস তীব্র বলে ডাকতে পারেন।

রাই এর কথা শুনে ফাহাদ মুচকি হেসে বলল,

—বুলি তো দেখছি ভালোই ফুটছে।যাক ব‍্যপার না।এখন বল কেমন আছো?

—আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?

রাই এর কথা শুনে ফাহাদ মলিন হেসে বলল,

—আমার প্রান পাখিটা আমায় ছেড়ে অন‍্যের ঘরে বাসা বেধেছে তাহলে তুমিই বল আমার এখন কেমন থাকার কথা?যাকে মনের সবটা উজাড় করে দিয়ে জায়গা করে দিয়েছি সেই আমার নিস্ব করে ফাকি দিয়ে ঊড়াল দিয়েছে তাকে ছাড়া কি ভালো থাকা যায়?

রাই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

—কথাটা ভূল বললেন ভাইয়া।আপনি তাকে মনের ঘরে বাস করার জন‍্য জায়গা করে দেননি তার পায়ে শিকল বেধে পিঞ্জরে আটকে রাখতে চেয়েছিলেন।তাকে যদি পিঞ্জরে না বেধে মনের ঘরে বাস করার জায়গা করে দিতেন তাহলে আজ আর সে ঊড়ে গিয়ে অন‍্যের মনের ঘরে বাসা বাধার জায়গা খুজতো না।আপনার মনের ঘরেই বসবাস করতো।

ফাহাদ করুন কন্ঠে বলল,

—ফিরে আসো না পাখি আমার কাছে।প্রমিস করছি এবার আর তোমায় একটুও কষ্ট দিব না।আমার ভালোবাসার চাদড়ে মুড়িয়ে রাখবো।

—ভালোবাসার মানে বুঝেন আপনি?

—হাসালে পাখি।আমার এতোদিনের ভালোবাসা কি তোমার একটুও চোখে পরেনি।একটুও কি আমার ভালোবাসা তুমি ফিল করোনি?

—আপনার করা প্রতিটা টর্চার কে ভালোবাসা নাম দিয়ে ভালোবাসা শব্দটাকে অসম্মান করবেন না ফাহাদ ভাইয়া।

—আমার ভালোবাসায় কি এমন কমতি ছিলো?তোমায় পাগলের মত ভালোবাসার পরেও কেন তুমি আমার ভালোবাসাকে টর্চার বলছো?

—কেন বলছি বুঝতে পারছেন না?বুঝবেনি বা কিভাবে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হলে তো সহজ কথা মাথায় ঢুকবে।আপনি তো মানসিক রুগি একটা সাইকো।দিনের পর দিন ভালোবাসা নাম করে আমার উপর অধিকার খাটাতে এসে টর্চার করে গেছেন।আপনার পছন্দ মত খেতে হবে আপনার পছন্দের পোষাক পরতে হবে।একা বাহিরে যাওয়া যাবে না।বান্ধবীদের সাথে বেশি কথা বলা যাবে না।ছেলেদের থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে।যদি ভূল করে কোন ছেলে এসে হেন্ডসেক করে বা কথা বলে তাহলে আমার আপনার কাছ থেকে শাস্তি পেতে হবে।এগুলোকে কি ভালোবাসা বলে নাকি টর্চার?আমিও যে কি বলি যে মানুষ নিজে নিজেকে ভালোবাসতে পারেনা সে আবার অন‍্যকে কি ভালোবাসবে।

রাই এর কথা শুনে রাগে ফাহাদ এর চেহারার রং পাল্টে গেলো।ফাহাদ টেবিলের উপর বারি মেরে চেচিয়ে বলল,

—আমার এই পাগলামো ভালোবাসাকে বার বার টর্চার এর নাম কেন দিচ্ছিস তুই?কি নেই আমার মাঝে?তোকে পাগলের মত ভালোবাসার পরেও কেন তুমি আমায় ভালোবাসতে পারলে না?

রাই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

—তাহলে আপনি কেন আমার দিশা আপুকে ভালোবাসতে পারলেন না?

#চলবে,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here