#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১০||
বাড়ী ফিরে গোসল করে ফেলল মেঘা। শরীরের ক্লেদ তাতে দুর হলেও মনের ক্লেদ দুর হলো না। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ভাবতে বসে গেল বিকেলের ঘটনাগুলো নিয়ে । যদিও বর্ষণ আম্মার ফোন পেয়েই ওখানে গেছে কিন্তু আম্মা নিশ্চয়ই সজ্ঞানে বর্ষণকে ওখানে পাঠায়নি। আম্মার ছোট্ট একটা ভুলেই সংবাদটা বর্ষণের কানে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কাজটা কার ? বড়ভাবি এটা করবেনা কারণ তিনি মেঘাকে বর্ষণের আশেপাশেও দেখতে রাজী নন কাজেই তিনি বাদ। বাকি রইল মেজ আর সেজ ভাবি। এই দুজনের যে কোন একজন এই কাজটা করেছে। কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করতে গেলে অস্বীকার তো করবেই না উল্টো বিরাট কাহিনী করে তামাশা খাড়া করবে।
সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল মেঘা। যদিও পেটে ক্ষিধে প্রচুর তবু এক অন্যরকম অলসতা পেয়ে বসেছে ওকে। বৃষ্টিমুখর বিকেলটার কথা মনে পড়ছে। ভুলতে চাইলেও পারা যাচ্ছে না। মনকে চোখ ঠেরে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বর্ষণ ইতোমধ্যেই হৃদয়ের জমি কর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। আজ বিকেলেই বীজ বপনের কাজটা সফলতার সাথে করেছে পাজী ছেলেটা। এবার সেই বীজ অঙ্কুরিত হবার ভয়। মেঘা সতর্ক না হলে সেই চারাগাছ একটা সময় ফুলে রূপ নিবে তারপর ফল ফসলে ভরে যাবে। মনটা আবার আবাদ হতে শুরু করবে। ভাবনাটা এ পর্যন্ত এসেই থমকে গেল মেঘার। শুয়ে শুয়ে আনমনেই মাথা নাড়ল। নাহ্ তা হয় না।
একই সাথে অপর মন প্রতিবাদ করে বসল, ” কেন হয়না ? ”
-” সুরমা ভাবি সিনক্রিয়েট করবেন। আর এটাই একমাত্র বাধা যে বর্ষণকে চেয়েও মেনে নিতে পারছি না আমি। অযথাই সমাজ আর সংস্কারের দোহাই দিচ্ছি। সে কারণেই বর্ষণও রেগে গিয়ে এক চোট নিয়ে নিচ্ছে। আর আজ তো বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। রেগে গিয়ে মাঝপথেই নেমে পড়ল গোঁয়ারটা । বৃষ্টিতে ভিজেই চলে গেল একা একা। হয়ত আর ফিরে আসবেনা। আর কোনোদিন ডাকবেনা মেঘাকে। হয়ত এটাই ছিল ওর জীবনে শ্রাবনের শেষ বর্ষণ।
এক জীবনের নিদারুণ কষ্টে ভরা খড়ার মৌসুমে খটখটে শুষ্ক হ্রদয়টাকে যে তার বারিপাতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে প্রায় নরম করে ফেলেছিল আজ সে তিতিবিরক্ত হয়ে সরেই গেল। হয়ত এবার সে অন্য জমিতে বর্ষাবে। এখানে আর কত। এ জমি যে আবাদ হবার নয়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরল মেঘা। দু চোখ বুঁজল। চোখের কোলে জমে থাকা পানিগুলো আস্তে করে গড়িয়ে পড়ল একপাশে। সে অবস্থাতেই চোখ লেগে গেল মেঘার। অপ্রাপ্তির বেদনায়, একরাশ মনোঃকষ্টে নিজেকে ঘুমের কাছে সঁপে দেয়া ছাড়া আর কোন গত্যান্তর ছিলো না বলেই হয়ত।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবেনা মেঘা। আম্মার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল ওর। চোখ মেলতেই দেখল বৃষ্টি থেমে গিয়ে আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। উঠে বসতে গিয়ে মনে হল মাথাটা যেন কেমন ঘুরে উঠল। পেটের খিদে মরে গেছে অনেক আগেই। সারা শরীরে কেমন হালকা একটা অনুভূতি। মনে হচ্ছে শূণ্যে ভাসছে মেঘা। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলেই এমন হয় ওর। উঠে বসে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ভাত নিয়ে বসল । খাওয়া শেষ হয়নি তখনও। এরই মধ্যে ফোন বাজল। হাতে নিয়ে দেখল ভাইয়ার ফোন। রিসিভ করে কানে ঠেকাল। ভাইয়ার রাগী রাগী কণ্ঠ শোনা গেল।
-” এই তোর অফিসে কী হয়েছে বল তো ? সেদিন না তুই বললি, অফিস ছেড়ে দিয়েছিস ? ”
-” হ্যাঁ, রেজিগনেশন তো সেদিনই জমা দিয়েছি ভাইয়া। অফিসের নিয়ম মেনে এক মাস আগে জানানোর কথা ছিলো, আমি একমাস আগেই জানিয়েছি। আর তারপরই অসুস্থতার কথা বলে লিভ নিয়েছি। কেন, কী হয়েছে ভাইয়া ? ”
-” তোর বড় ভাসুর একটু আগেই আমার অফিসে এসেছিলো। আমাকে সবার সামনে একগাদা কথা শোনাল। তুই নাকি বর্ষণকে নানান ছুতোনাতায় ডেকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াস। আজও নাকী স্কুল থেকে ফেরার পথে বর্ষণের সাথে ফিরেছিস ? তোর বড় ভাসুর নাকি নিজের চোখে বর্ষণকে সিএনজি থেকে নামতে দেখেছে। এসব ঘটনা কী সত্য ? ”
-” ইয়ে, ভাইয়া। ব্যপারটা তিনি যেরকম করে বলেছেন সেরকম না।”
-” তারমানে ঘটনা সত্য ? কী মনে করে তুই ঐ ছোকরার সাথে লাইনঘাট করছিস শুনি ?” হাসিবের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল।
-” ভাইয়া এভাবে কথা বলা তোমার উচিত হচ্ছে না কিন্তু। আ’ম ফিলিং ইনসাল্টেড।”
-” রাখ তোর ইনসাল্ট। আমাকে জিজ্ঞেস কর আমি কতটা ইনসাল্টেড হয়েছি। তোর ভাসুর আজ তোর অফিস আর তোকে নিয়ে দুনিয়ার আজেবাজে কথা বলেছে হামিদ ভাইয়ের সামনে। আমার মানসম্মানের পরোয়া করেনি সে। উল্টো সরাসরি তোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে আমাকে বলেছে আমি যেন বোন সামলাই। ভাবতে পারিস অবস্থাটা কী হয়েছিল ? আচ্ছা, তুই আমাকে সত্যি করে বলতো বর্ষণের সাথে তোর কোন কমিটমেন্ট হয়েছে ? ”
-” না…!” তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে উঠলো মেঘা। “এসব কিছুই হয়নি ভাইয়া। উনি তোমাকে হঠাৎ এভাবে কথাগুলো বললেন কেন বুঝতে পারছিনা।” মেঘার গলায় ভাত আটকে যাবার যোগাড় হল। ভাবছে, বর্ষণ কী বাড়ী গিয়ে আবারও কিছু উল্টাপাল্টা করলো নাকি কে জানে।
-” তুই না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছি কিছু কিছু। আসলে ছেলেটা যে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে, এটা হলো তারই জের। ঐদিন তো দেখলাম ছেলেটাকে। বেশ ডেসপারেট। আর আত্মবিশ্বাসী। আমার কাছে মন্দ লাগেনি। কিন্তু তোর বড়জাকে যতটুকু জানি তুই সুখী হতে পারবিনা। আচ্ছা, হামিদ ভাই এর কথা তো শুনেছিস?”
-” হম, ভাবির কাছে জেনেছি।” ক্ষীণ কণ্ঠে বলল মেঘা।
-” হামিদ ভাই তোর কথাই বারবার বলছিলেন। সেদিন কামালের হৈ চৈ এর পর আমাকে বলল, ওকে ঐ নরক থেকে বের করে আনেন হাসিব ভাই। সব জেনেও সে তোকে নিতে চাইছে। এই সুযোগ তো হাতছাড়া করা উচিত না। কী বলিস?”
মেঘা নিরব রইল। জবাব দিলো না একথার। হাসিব বললেন, ” শোনরে মেঘা, একটা কথা বলি তোকে। আমি তোর বড় ভাই। তোর চেয়ে আমার বয়স বেশী। দুনিয়াও আমি তোর চেয়ে বেশী দেখেছি। তোর মত মেয়ের একা থাকা বড় বিপদ। মানুষ অকারণেই কথা রটাবে। তার উপর আমি থাকিনা ঢাকায়। বড় ভাই হিসেবে আমার এখন একটা কাজই উচিত আর তা হলো সব বাদ দিয়ে, তোকে জোর করে হলেও দ্রুত তোর বিয়ের ব্যবস্থা করা। তাছাড়া এটা আমাদের ধর্মীয় আদেশ। হাদিসে বলা আছে , জানাজার তৈয়ারীতে যেমন দেরী করা মোটেও উচিত না। যত দ্রুত সম্ভব লাশকে গোর দিতে হয়। ঠিক তেমনি বিধবার জন্য পাত্র পাওয়া গেলেও দেরী করা উচিত না। দ্রুত তাকে পাত্রস্থ করতে হয়। আমি তো দুই দুইজন পাত্র পেয়েছি। আর সবদিক বিচারে বর্ষণের চেয়ে হামিদ ভাই রিলায়াবেল। একেবারে সব কূল টানটান। ঝাড়া হাত পা। তুই একেবারে চড়ে খেতে পারবি। মাথায় চুল একটু কম, ঐটা সমস্যা না। শোন, আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি । তোর একমাত্র জীবিত অভিভাবক হিসেবে এই সিদ্ধান্তটা আমার আরো আগেই নেয়া উচিত ছিল কিন্তু যে কারণেই হোক গড়িমসি করে ভুল করেছি। এবার আর সেই ভুল করবো না। আমি হামিদ ভাইয়ের সাথে মোটামুটি কথা বলে রেখেছি। কাল ফাইনাল কথা বলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব। তোর ভাসুরের মুখের ওপর জবাবটা দিতে চাই আমি। আর এবার আমি তোর কোনো ওজর আপত্তি শুনব না।”
-” কিন্তু ভাইয়া..! ” রীতিমত আঁতকে উঠল মেঘা।
-” কীসের কিন্তু ভাইয়া…? তুই কী জেনেবুঝে নিজের আর আমাদের পরিবারের মানসম্মান ডোবাতে চাস ? তোর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ঐ বর্ষণ ছেলেটা তোকে স্বস্তি দেবে ভেবেছিস ? এরা চ্যাংড়া ছেলেপেলে। মনে একবার একটা ধরলে সহজে সেটার পিছু ছাড়েনা। তার উপর থাকছিস ওর বোনের সাথে এক বাড়ীতে। নিয়মিত দেখা হবেই। আর রোজকার ঝঞ্জাটও লেগেই থাকবে।”
-” বর্ষণ তো এ বাড়ীতে আসেনা ভাইয়া। সুরমা ভাবি নিজেই মানা করে দিয়েছেন ওকে।” রুদ্ধশ্বাসে তথ্য পেশ করার মত করে বলল মেঘা। শুনে হাসিব রেগে গিয়ে বলল,
-” আর তাতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ? বর্ষণ এখন আসেনা বলে কী কোনোদিন আসবেনা ? তুই এত বোকা হলি কীভাবে বল তো ? আচ্ছা, খুব তো বললি বর্ষণ আসেনা এ বাড়ীতে। তো আজ সে কী করে গেল তোকে পিক করতে ? ”
মেঘা থেমে গেল। কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। হাসিব কড়া কণ্ঠে বললেন,
-” তোকে আরো স্ট্রিক্ট আশা করেছিলাম মেঘা। তুই এখনো বুঝতে পারছিস না যে কত জটিল একটা তাল পাকানো সমস্যায় তুই জড়িয়ে পড়েছিস। আর যেভাবে এই সমস্যাটা এড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে চাচ্ছিস, এভাবে কোন সমাধান আসবে না। তোকে নিজে থেকে একটা সমাধানে আসতে হবে। আর এসব কিছু জানার পর তো এখন তোকে একা এ বাড়ীতেও আসতে দিতেও ইচ্ছে নেই আমার। এখানে তুই একা থাকবি আর ওখান থেকে দুনিয়ার কথা রটাবে তোর শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা। আমি কাল হামিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলব। আর এটাই ফাইনাল। উনি যেদিন সময় দেবেন সেদিনই তোর আকদ পড়িয়ে দেব আমি। কাল বললে কালই আর একমাস পর বললে একমাস পর।কথা বুঝেছিস?”
-” ভাইয়া….!” মেঘা কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে চাইল কিছু কিন্তু হাসিবের কথার তোড়ে পারলোনা। হাসিব নিজেই ভাঙ্গা গলায় বলতে লাগলেন,
-” এরপরেও যদি তুই গোয়ার্তুমি করিস তাহলে ঠিক আছে। কোন জোর নেই। তুই থাকবি তোর মত। এখন থেকে আমি আর তোর কোন কিছুতে নেই। ধরে নিবি তোর কোন বড় ভাই নেই। কারণ বড় ভাই বলে না মানলে এরকম নামের ভাই থাকা না থাকা সমান কথা।”
আচমকা কট করে কেটে গেল ফোনটা। তারপরেও ফোনটা কানে চেপে বসে রইল মেঘা। সুক্ষ্ম হামিং এর শব্দটা ছাড়া আর কোন শব্দ কানে বাজছে না।
বুকের ভেতর এবার এক অন্যরকম ঝড়। মেঘা পূর্ব বিবাহিতা। বিয়ে নিয়ে তরুণী সূলভ ভীতি নেই। কিন্তু অনীহা আছে নিদারুণ। পরশ চলে যাবার পর রিপু যে জ্বালায়নি তা নয় কিন্তু তাকে সামলে নেবার মত শক্তি আল্লাহ ওকে দিয়েছেন। তার উপর আরশ ওর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বলে সুস্থভাবে বেঁচে আছে। কেবল গত কয়েক দিন ধরে বর্ষণ নামের ছেলেটা ওর শুষ্ক মরুর বুকে অঝোরে যে বারিপাত ঘটিয়েছে তাতেই ওর জীবন নদীর কিনারা ধ্বসে পড়বার যোগাড় হয়েছে। কিন্তু মেঘা জানে। এই মন মোহনার পার একবার ধ্বসে পড়তে শুরু করলে মেঘাকে ভিটেমাটি হারা হতে হবে। ভাইয়া ভাবি শ্বশুরবাড়ী আর শ্বাশুড়ী সবাইকে হারাতে হবে। কাজেই বর্ষণের চিন্তা বাদ দিতে হবে ওকে। কিন্তু তাই বলে হামিদ ভাই ! ক্ষণিকের তরে হামিদ ভাইকে নিজের পাশে কল্পনা করতে গিয়ে মন তারস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল। না না চলবে না। চলবে না। বর্ষণ নাই তো নাই। কিন্তু এই পেঁজা তুলোর মত উড়ু উড়ু যৌবন যার তার হাতে তুলে দেবার কথা ভাবতে পারেনা মেঘা। তাছাড়া তার আরশের কথাও ভাবতে হবে। প্রয়োজনে মেঘা এভাবেই থাকবে। তবু হামিদ ভাইকে বিয়ে করবে না। একদম না।
সিদ্ধান্তটা নেবার পর মনটা শান্ত হলো মেঘার। দ্রুত ভাত শেষ করে শ্বাশুড়ীর ঘরে চলে এল। আজ তার সাথে সরাসরি কথাগুলো বলবে মেঘা। বলতেই হবে তাকে৷
শান্ত মুখে শ্বাশুড়ীর হাত ধরে টেনে নিজের সামনে বসালো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে একে একে বর্ষণের সাথে দেখা হওয়া, সিএনজি তে বাড়ী আসা, ভাইয়ার সাথে ফোনালাপ পুরোটাই খুলে বলল। কোহিনূর বেগম নিরবে সব শুনে বললেন, ” এই হামিদ ভাই ক্যারা ? ”
-” ভাইয়ার পুরোনো কলিগ আবার বন্ধুও।”
-” আইচ্ছা, তুমার ওপিসে আসলে কী হইসে ঠিক কইরা কও তো ? ”
মেঘা মুখ নামিয়ে বদরুল আলমের কথাটা ভেঙ্গে বলল। কোহিনুর বেগম থমথমে মুখে সবটা শুনে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” জুয়ান মাইয়া তুমি। ভাগ্য তোমারে বিধবা বানাইসে তো কী অইসে। শইল তো আর বুড়া অয় নাই। তার উপ্রে করো বাইরে চাকরী। এইসব সমস্যা তো অইবই। আসলে সবই বুজি। তয় মনেরে বুজাইতে পারিনা। তুমি আমার পোলার বউ এই কথাটাই মনে গায়। তোমার বিয়া অইলে নাতিডারে হারামু। এইটারেই ডরাই আর কিছু না। আইচ্ছা, বালো কতা। বর্ষণ জানলো কেমনে তুমি ঐখানে খাড়ায়া রইছো ? ”
-” আপনার কাছ থেকেই জেনেছে আম্মা। আপনি কাকে ফোন করে বলেছিলেন আমাকে আনতে যাবার কথা ? ”
-” এইডা তো আমি তুমার বড় বাইরে কইছি। হে জানলো কেমনে? ” কোহিনুর বিস্মিত।
-” না, আম্মা। আপনি ভাইয়া ভেবে যাকে ফোন দিয়েছিলেন সে বর্ষণ।”
কোহিনূর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে দিশেহারা ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, ” খাড়াও, খাড়াও। মনে পড়সে। আমি সেজ বৌ রে কইছিলাম তোমার বাইয়ের নাম্বারটা দিতে। হেয় কী কুনু ঝামেলা করলো নি ? ” কোহিনূর বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। মেঘা মাথা ঝাঁকাল।
-” জি, আম্মা। তা না হলে বর্ষণের জানার কথা নয় আমি যে ওখানে আটক পড়েছি।”
-” ঠিকই তো। ঐ মাগিরে অহনে চুলের মুঠঠি ধইরা জিগানের কাম। চিমাইন্যা মাগি। দেহোনা চেহারা সুরত। লাগে কবরস্থান তন উইঠ্যা আইছে। খায় লয় হাড়ে গুঞ্জে, বাড়েনা কপালের দুষে !”
-” থাক্, আম্মা। গালাগালি করেন না। এখন ভাবিকে এসব জিজ্ঞেস করতে গেলে ঝামেলা বাড়বে। সেজ ভাবি চোরকে পাঠিয়েছে চুরি করতে আর গৃহস্থকে বলেছে সজাগ হতে। বড় ভাইয়া বর্ষণের সাথে আমাকে বাড়ী ফিরতে দেখেছে। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে যেটা প্রায়াসম্ভবই বটে। ”
– ” বর্ষণ কী তুমার লগে গেট পর্যন্ত আইছিলো ? ”
-” ন্…না। ” বলতে গিয়ে লজ্জা পেল মেঘা।” বড় রাস্তার মোড়েই নেমে গিয়েছিল।”
কোহিনুর বেগম মেঘাকে লক্ষ্য করে আস্তে করে বলে বসলেন, ” বর্ষণরে তুমারও ভালো লাগে, ঠিক কইছি না ? তুমি হেরে অনেক ভালা পাও। ”
মেঘা নির্বাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নামিয়ে বলল, ” আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আম্মা। বিয়ে আমি করব না। না বর্ষণ না অন্য কেউ।” কোহিনুর আর কথা বাড়ালেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন।
রাতেই রেহানা ভাবিকে ফোন দিলো মেঘা। শান্ত স্বরে জানিয়ে দিলো হামিদ ভাইয়ের ব্যপারে নিজের অমতের কথাটা। সাথে এও জানালো, ভাইয়া রাগ করলেও মেঘার কিছু করার নেই। রেহানা সব শুনে বললেন, ” তার মানে তুই শেষ পর্যন্ত বর্ষণেই ভিজেছিস? ”
-” যা খুশি ভাবতে পারো। কিন্তু আমি আর বিয়ে করবো না। এটাই চুড়ান্ত।” রেহানা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলেন। মেঘাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশের পাশে শুয়ে পড়ল। সিদ্ধান্তহীনতার প্যারা থেকে তো অন্তত মুক্তি মিললো।
=====
এ বাড়ীর চিরাচরিত প্রথানুযায়ী রাতেই বিচার সভা বসল। আর বরাবরের মতোই আজকের বিচার সভার আয়োজক বড় ভাসুর কামাল নিজে। সে জরুরী ভিত্তিতে মেঘার বড় ভাই হাসিবকে ডাকিয়ে এনেছে। অথচ যাকে নিয়ে এত ঘটনা সেই বর্ষণকেই তারা এড়িয়ে গেছে। আবার ঘটনার সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্কহীন মেজ ভাসুর ও সেজ ভাসুর পত্নীসহ উপস্থিত আছেন এই বিচারে। সব দেখেও নিরব রইল হাসিব। বোঝাই যাচ্ছে এখানে একদল তামাশা করতে বসেছে আরেক দল এসেছে তামাশা দেখতে । আর যে দুজনকে নিয়ে তামাশা সেই বর্ষণ আর মেঘা উপস্থিত নেই সভায়। ইতোমধ্যে দু’বার মেঘার ডাক পড়লেও মেঘা ড্রইং রুমে আসেনি। সে আরশকে আকড়ে ধরে ঘরেই বসে আছে। এক অজানা আতঙ্কে ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত। ভয়ও হচ্ছে খুব। কে জানে কী আছে ওর ভাগ্যে। এরা আজ বেশ আয়োজন করে বসেছে মেঘাকে অপদস্থ করতে। আর ওর কারণে আজ ভাইয়াও চরম অপমানিত হবে নিশ্চিত। হায় আল্লাহ, মাত্র গতকালই এ নিয়ে রাগারাগি করেছে ভাইয়া আর আজই কি না !
ড্রইংরুম থেকে সবার কণ্ঠস্বরই কমবেশী শুনতে পাচ্ছে মেঘা। কেবল ভাইয়ার কোন শব্দই শুনতে পাচ্ছেনা। বেচারা ভাইয়া। মেঘার জন্য আজ আরেকবার বিনা দোষে শাস্তি পেতে হবে তাকে। সুরমা ভাবির নেচারটাই এমন। যার উপর রাগ হয় তাকে ধূলিস্যাৎ না করে ছাড়েনা। হয়ত আজকের ঘটনার পর বড় ভাইয়া ওর ওপর প্রচন্ড রেগে যাবেন। রেহানা ভাবিও আর ভাইয়াকে আসতে দেবেন না ওর কোনো ব্যপারে। কারণ মেঘার কারণে বারবার অপদস্থ হতে হচ্ছে ভাইয়াকে। আজ খারাপ কিছু হলে ভাইয়ার মুখোমুখি হওয়া সহজ হবে না মেঘার। ভাইয়া এখন সরাসরি একটা কথাই বলবে, তোর মত বোনের কারণে আজ আমার এই অবস্থা।
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ল মেঘার। বিচ্ছিন্ন চিন্তায় আছন্ন হয়ে রইল মনটা। এমন সময় বড় ভাসুরের পরিস্কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মেঘা।
-” আমি তোমাদের সবাইকে এইখানে জরুরী ভিত্তিতে ডেকেছি কারণ মেঘার বড় ভাই কালকে ঢাকা ছেড়ে যাবে। আর মেঘার গার্জেন বলতে সেই একজন আছে। কাজেই তাকে না টেনে উপায় নাই। ঠিক কী না হাসিব ভাই ? ” হাসিবের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন কামাল। হাসিব কোন কথা বললেন না। কোহিনুর এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-” কি জন্য ডাকছোস সেই কথা কইয়া তাড়াতাড়ি কথা শেষ কর। আমার শরীলডা ভালো লাগতাসেনা।”
-” তোমার শরীর তো ম্যাজিকের শরীর। ঠিক টাইম মত গিয়া খারাপ করে। এখন যে জন্য ডাকছি সেই কথা বইসা শুইনা, কথা বইলা তারপর যাইবা। কথা হইতেসে তোমার ছোট বউমা’রে নিয়া। খবর তুমি কিছু জানো কি না জানিনা সে আজকেও আমার শালারে ডাকায় নিয়া তার সাথে বাসায় আসছে। আর তুমি বাড়ীতে নাকে তেল দিয়া ঘুমাইসো। সারাদিন তুমি এগুলিই করো। হয় নাতি নিয়া পইড়া থাকো আর নয়তো নাক ডেকে ঘুমাও। তোমারে দেখলে মনে হয়, দুনিয়াতে তুমি আর তোমার নাতি ছাড়া আর কেউ নাই। এখন আমারে বলো, আমারে তোমরা ভদ্রসমাজে থাকতে দিবা না কী দিবা না। ” কথাটা বলে কোহিনুরের চেহারার দিকে তাকালেন কামাল। কোহিনুর কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন,
-” আরে, বর্ষণরে তো আমিই ভুল কইরা ফুন দিয়া ফালাইসিলাম। বর্ষণরে মেঘায় ডাকে নাই। এইটা আমার ভুল। এই সোজা কতাডা আমারে না জিগাইয়া তুই হের বাইরে ডাকছোস ক্যান ? আমারে জিগাইলেই তো সারতো। ” কোহিনূর বেগম সংক্ষেপে বলে কথাটা হালকা করতে চাইলেন কিন্তু সুরমা ছাড়লো না। সে তার মতো করেই বলল,
-” তারমানে আপনিও এর মধ্যে আছেন? ”
-” কিয়ের মইদ্যে আছি ? কী কও তুমি ? ”
-” ঢং করবেন না আম্মা। এইটা ঢং করার বয়স না। আমার ফ্যামিলি আর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করলে আমি কাঊরে ছাড়বো না বলে দিলাম। ডাকেন আপনার পুতের বউরে। ” সুরমা ধমকের সুরে কথাটা বললে হাসিবও এবার সাথে সাথেই বলে উঠল,
-” জি না। ভরা মজলিসে আমার বোনকে ডাকতে হলে আপনার ভাইকেও ডাকেন। তালি এক হাতে বাজেনি। ডাকলে দুজনকেই ডাকবেন। কারণ আপনার ভাই নাবালক না যে আমার বোন ডাকলো আর সে সুরসুর করে চলে এলো। আপনার দৃষ্টিতে যদি আমার বোন তার সাথে এসে দোষ করেছে তাহলে একই অপরাধ বর্ষণও করেছে। মেঘা একা দোষ করেনাই। আপনার ভাইও এর সমান অপরাধী। কাজেই আপনার ভাইকেও ডাকুন। নয়তো আমার বোনকে নিয়ে একা কোন বিচার আমি হতে দেব না। ফাজলামি পান নাই আপনি আর সে আপনার ছেলের বৌ না যে আঙ্গুলের ইশারায় তারে নাচাবেন। আপনার নামে আমি অনেক কমপ্লেইন শুনেছি। বিচার হলে আজ সেগুলোরও বিচার হবে। আমার বোন এখন আর আপনার জা নাই। কোন এককালে ছিলো। এখন সে বৈবাহিক সূত্রে এই বাড়ীর সহ অংশীদার। কথাটা মনে রেখে যা বলার বলবেন। বাড়ীর বৌ পান নি যে কথায় কথায় কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।” কথাগুলো শান্ত স্বরে বললেও হাসিবের কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চাপা ক্রোধ সবাইকে স্পর্শ করল। কামাল সাথে সাথেই বলল।
-” বাপরে, চোরের মায়ের বড় গলা।”
-” চোরের বোন আর বোনজামাই এর গলাও তো কম বড় না।”
-” এই, ফোন দাও বর্ষণকে।” ধমকে উঠলেন কামাল।
-” না, ওকে কেন ফোন দেব ? এটা এই পরিবারের ঝামেলা। ”
” কোন পরিবারের ? আপনার৷ পরিবার না আপনার শ্বাশুড়ীর পরিবার ? ” হাসিব রেগে গেল।” একবারই বলেছি, মেঘা আপনার পরিবারের কেউ না। তার সঙ্গে এরপর থেকে লাগতে এলে বুঝেশুনে আসবেন নয়তো আমি আইনের সাহায্য নেব। মানহানির মামলা করব আপনার নামে।”
-” তরে বলতেসি বর্ষণরে ডাক।” চিৎকার দিয়ে স্ত্রী’কে ধমক দিল কামাল। সুরমা সমান দাপটে স্বামীকে দাবড়ী মেরে থামাতে গিয়ে আচমকা মাথায় হাত রেখে থেমে গেল। তারপরই বুকে হাত চেপে মাটিতে বসে পড়ল সুরমা। কামাল তো বটেই বাকিরাও হৈ চৈ করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যেই আসর ছত্রভঙ্গ পঙ্গপালের মত অবস্থা দাঁড়াল। সুরমা বুকের ব্যথায় দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। এরই মধ্যে কামাল রেগে গিয়ে বলে উঠল, ” আজকে থেকে তুই চিৎকার করছোস তো তোর গলা টিপে ধরব আমি। ডাক্তার তোরে উত্তেজিত হতে মানা করসে তারপরেও তোর তেজ কমেনা। এরপর তুই চিৎকার করে দেখ। ঘাড়ে ধরে তোরে তোর বাপের বাড়ী না পাঠাইসি তো আমার নাম কামাল না।”
-” বাপের বাড়ী পাঠাইবা কেন ? কবরস্থানেই পাঠিয়ে দিও।” কাতর স্বরে বলল সুরমা।
-” আবার কথা কস ? মুখ একদম বন্ধ। বর্ষণ একটা কেন চারটা বিয়ে করুক, তোর কী। আজ থেকে ওর ব্যপারে কোন কথা এই ঘরে আমি শুনব না।” বলে কামাল রাগ করে বেরিয়ে গেলে সুরমা বালিশে মুখ গুঁজল। বুকের ব্যথাটা তিরতির করছে এখনও। ইদানীং এই এক সমস্যা হয়েছে। উত্তেজনা নিতে পারেনা। বুকে চাপ লাগে। কেন এমন হয় কে জানে।”
====
আজ স্কুল নেই মেঘার। সেকারণেই আজকের দিনটাকে অন্য কাজে লাগিয়েছে। কাল ভাইয়া খুলনা চলে যাচ্ছে। আর এবার সাময়িক যাওয়া নয়। রীতিমত পাততাড়ি গুটিয়ে যাওয়া। ভাইয়ার পোস্টিং হয়েছে ওখানে। সেই উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরেই ভাবির সাথে দেবার জন্য কিছু ভাল আচাড় আর আদরের ভাইঝিটার জন্য কুকিজ বানিয়ে রেখেছিল। আজ সেসব দিয়ে আসতে হয়েছে বিকালে। সকালে রেহানা ভাবি ফোন করে জানিয়েছিল, তার সাথে কিছু কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যেতে হবে। মেঘা ঘরের কাজ গুছিয়ে ভাবির সাথে মার্কেটে গিয়ে তাকে কেনাকাটায় সাহায্য করে এসেছে। ফেরার পথে বড় একটা ব্যাগে এটা সেটা ভরে ভাবির হাতে তুলে দিয়েছে। ভাবি একরকম সারাদিনই ওর সাথে ছিলেন কিন্তু বিয়ে প্রসঙ্গে আর কোন কথা বলেন নি। কেবল চলে যাবার সময় ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, ” জীবনটা তাহলে একা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলি?” মেঘা হেসে মাথা নেড়েছে। দীর্ঘশ্বাসের লু হাওয়াকে হাসির সাথে শীতল বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছে। গতরাতে ওর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে। ভাইয়া কড়া আলটিমেটাম দিয়ে গেছে কামাল ভাই সহ তার বাকি দুই ভাইকে। এর পর থেকে যদি এসব তুচ্ছ অযুহাতে মেঘাকে হয়রানি করা হয় তাহলে হাসিব এবার কাউকে ছেড়ে কথা বলবেনা। কামাল যেন তার শ্যালককে সামলায়। কারণ বর্ষণ মেঘাকে বিরক্ত করছে। ভাইয়ার এহেন বিপরীতমুখী বক্তব্যে সবাই আপাতত চুপসে আছে। ভাইয়া কায়দা করে সেজ ভাবির ফোন লাগিয়ে দেবার প্রসঙ্গটাও তুলেছেন। সেজভাবি চৃপচাপ সব শুনেছেন, কোন জবাব দেননি। বড় ভাই কামাল তো অবস্থা বেগতিক বুঝে আগেই সটকে পড়েছেন। বাকি দুজনও সময় সুযোগ বুঝে সটকে পড়েছে। তারপরে আর এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। মেঘা ভাবতেও পারেনি যে এত সহজে সব মিটে যাবে। তবে রাতের পর থেকে শ্বাশুড়ী আম্মা বেশ গম্ভীর হয়ে আছেন। মেঘা বুঝতে পারছেনা তার কী হলো।
-আগামী পর্বে সমাপ্য…