মেঘ পরশে বর্ষণ শেষ পর্বের ১ম খন্ড

#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি

~শেষপর্ব প্রথম খন্ড ~

রাত কত বাজে মেঘা জানেনা। জানতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। কেবল এতটুকু জানে এখন থেকে সে এ বাড়ীতে অনাহুত। এর কারণ সমস্ত দুর্ঘটনার শুরুতে সে আবার শেষেও ঘটনার দায় ওর জন্যেই বরাদ্দ। নইলে সুরমা ভাবি নিজস্ব কারণে অসুস্থ হবার পর কেনই বা দায়টা উড়ে ওর কাঁধে চলে আসবে। কেন মেজ ভাই সেজ ভাই আর তাদের স্ত্রী’রা আলাদা করে আম্মাকে বলে যাবেন যে মেঘা এই বাড়ীতে অশান্তির মূলে ?
একটু আগেই তা নিজ কানে শুনেছে মেঘা।
প্রতিদিনের মত আজও আরশকে আম্মার ঘর থেকে তুলে এনে নিজের ঘরে শুইয়ে দিচ্ছিল। তখনই খেয়াল করেছে আরশের কোল বালিশটা ওর দাদীর ঘরে রয়ে গেছে। সেকারণেই ফিরতি পায়ে কোলবালিশ আনতে আম্মার ঘরের সামনে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হয়েছে ওকে। ভেতর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো ওর পা’ কে আগে বাড়তে দেয়নি। স্পষ্ট শুনেছে মেজ ভাইজানের তীব্র ধিক্কার, মেজ ভাবির নিন্দাসূলভ ব্যঙ্গাত্মক হাসি, সেজভাইয়ের বাঁকা বাঁকা কথা আর সেজ ভাবি’র তাচ্ছিল্য ভরা কথা। সবার বক্তব্য একটাই। মেঘা এ বাড়ীর অশান্তি। ওর কারণেই আজ সুরমা ভাবি বিছানায় পড়েছেন আর নেহালের এতিম হবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হচ্ছে। বড় ভাইয়া আজ দিশেহারা হয়ে কাঁদছে আর তার ভরা সংসারে আগুন লেগেছে। না মেঘা বর্ষণের সাথে বাড়ী ফিরতো না এতো কথা বাজ খেতো। সব কথাই মেঘার কানে তীরের খোঁচার মত লাগলেও সেজ জা’র একটা কথা সরাসরি বল্লমের আঘাত হানল মেঘার বুকে। তার মতে, পরশের মৃত্যুও মেঘার উন্নাসিকতার কারণেই হয়েছে। পরশ ভাই মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেন নি কিন্তু মনে মনে ভেঙ্গে পড়েছিলেন বলেই অন্যমনস্ক থাকতেন। যার কারণে অনাকাঙ্খিতভাবে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন। বর্ষণ এখনও বুঝতে পারছে না যে পুরোটাই মেঘার ঘোলাটে মায়াজ্বাল। যেদিন বুঝবে সেদিন হাত কামড়াবে। দুনিয়াতে কী মেয়ের অভাব !
ওদের কথাগুলো শোনার পর আর বালিশ আনতে যেতে ইচ্ছে করেনি মেঘার। ঘোরের মধ্যে নিজের ঘরে চলে এসেছে। ঘুমন্ত আরশের মুখের দিকে তাকিয়ে একেকবার ইচ্ছে হচ্ছিল কাল সকালেই কাউকে কিছু না বলে কোথাও চলে যায়। পরক্ষণেই মনে হয়েছে, লাভ নেই। বরং ওর চলে যাওয়া নিয়ে আরো বাজে কথা রটাবে এরা। তাছাড়া মেঘা যাবেই বা কোথায় ?

পরদিন সকালে রান্না ঘর থেকে বেরোবার মুখেই দেখা হয়ে গেল বর্ষণের সাথে। মেইন ডোর খুলে প্রবেশ করেছে বর্ষণ। ওর সাথে ওর মা’ও আছে। সম্ভবত মেয়ের শরীর খারাপ শুনে দেখা করতে এসেছেন। ওদের মুখোমুখি পড়ে বেশ হকচকিয়ে গেল মেঘা। এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারলো না। অবশ্য ওকে দেখেই দ্রুত সালাম দিয়ে উঠল বর্ষণ। মেঘার ধারণা ছিল সিএনজির ওসব কথাবার্তার পর বর্ষণ ওর ওপর কিছুটা হলেও রেগে আছে। কিন্তু এ দেখি বিশ্ববেহায়া। দাঁত বের করে আসছে আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য, মেঘার চড় দিতে চাওয়ার কথাটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল সে ?

নিজেকে সামলে নিল মেঘা। বর্ষণের সালামের প্রত্যুত্তরে তাকেও সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে জবাবের একটা ভঙ্গি করতে হলো। বর্ষণের মা’ও ওকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছেন। মেঘা খানিক ইতস্তত করে তাঁকে সালাম দিল। একজন বয়োজ্যেষ্ঠার মুখের উপর দিয়ে ডাঁট দেখিয়ে চলে আসার বিদ্যেটা অর্জন করতে পারেনি বলেই পাল্টা সালাম দেয়াটা সমীচীন মনে করলো মেঘা। জবাবে অবশ্য তিনি মেঘাকে চমকে দিয়ে অমায়িক হাসলেন।
– ” ভালো আছো মা ? ”

মনে মনে দারুণ চমকে গেল মেঘা। গত রাতের ঘটনা নিশ্চয়ই তার অজানা নেই। যার কারণে তার মেয়ের এই আচমকা অসুস্থতা তার সাথে এমন সৌজন্যালাপের মানে কী ! ব্যপারটা ঠিক হজম হতে চাইছে না মেঘার।
তাঁর জবাবে কী বলবে ভেবে পেলো না। কাঁপা হেসে মাথা ঝাঁকালো। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। তবে বর্ষণের মায়ের স্মিত হাসি, মা বলে ডাকা আর সস্নেহ চাহনী মুহূর্তেই মেঘার ভেতরকার সমস্ত মালিন্য দুর করে দিল এক ঝটকায়। গতরাতের অসম বিচার, তারচেয়েও গভীর রাতে দুই ভাসুর জায়ের বিষেদগার থেকে মনের ভেতর যে উষ্মাটুকু জন্মেছিল তা নিমিষেই যেন উধাও হয়ে গেল। সেও এবার বলতে পারলো, ” আপনি ভালো আছেন আন্টি ? ”
” এই তো। তা তোমার বাবুটা কেমন আছে মা ? ”
মেঘা ঘাড় কাত করে জানালো, ” জি, আলহামদুলিল্লাহ।” বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলো বর্ষণ ওর মায়ের কানের কাছে মুখ রেখে কিছু একটা বলেই সুরমা ভাবির ঘরের দিকে চলে গেল।
মেঘা ভদ্রতার হাসি হেসে সরে আসতে গিয়ে শুনল, ” ইয়ে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো মা। তুমি কী আজ বাসায় থাকছো ? ”
-” জ…জি আন্টি। আজ তো আমার স্কুল বন্ধ।”
-” ও আচ্ছা। ঠিকআছে, আমি সুরমাকে দেখে একটু পরে তোমার রুমে আসছি, কেমন? ” বলে ভদ্রমহিলা মেয়ের রুমের দিকে রওনা দিলেন।

মেঘা পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে এল। মাথার ভেতর এলোমেলো চিন্তার ঝড়। বর্ষণের মা কী বলবেন ওকে ? বর্ষণ ওর মা’কে কানে কানে কী বলে গেল আসলে ? তবে বর্ষণের আচরণে স্পষ্ট, সে সহজে ক্ষান্ত দেবার পাত্র না। গতরাতের অতসব ঘটনার পর মেঘার ধারণা ছিল, বর্ষণ এবার হয়ত থামবে। কিন্তু তার দেখা যাচ্ছে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। এ তো দেখি আরেক মহা অশান্তি। আবার কী ঘটতে যাচ্ছে কে জানে। আচ্ছা, সে কী গতরাতের বিচার সভার কোন খবরই জানেনা ? জানা তো উচিত ছিলো। আর না জেনে থাকলেও এখন নিশ্চয়ই জানবে। সব জানার পরেও কী সে মা’কে পাঠাবে ? আর বর্ষণের মা ? তিনি কী ছেলের মন রাখতেই আসবেন না মেয়ের মন রাখবেন ? দুজনের এই বিপরীতমুখী চাওয়ায় তিনি আসলে কোন পক্ষে ? এতো বড় ঝামেলার পর তার অমন সদালাপী হাস্যমুখ বুঝে আসছে না। আল্লাহই জানেন আবার কী ঘটতে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস চেপে নিজের ঘরে চলে এলো মেঘা। মাথার মধ্যে আবছাভাবে একটা কবিতার লাইন বারবার ঘুরপাক খেতে লাগলো, “যতবার ছাড়াতে যাই, জড়ায়ে যায় বারেবারে।”

শ্বাশুড়ী আম্মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে কথাটা চাপতে পারলো না মেঘা। গড়গড় করে বলে দিল একটু আগের সমস্ত কথা। বর্ষণের মায়ের সাথে দেখা হবার মুহূর্ত আর তার বলা কথাগুলো। তিনি যে কথা বলতে এ ঘরে আসবেন সেটিও বলতে ভুললো না মেঘা। এমনিতেও শ্বাশুড়ীর কাছে কথা লুকানোর অভ্যাস নেই মেঘার। এখন তো প্রশ্নই আসেনা। আর কোন কিছুই সে নিজের মধ্যে রাখতে চায়না। রাখাটা উচিতও হবে না বোধকরি। তাছাড়া যেখানে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্ষণের সাথে কোন অবস্থাতেই আর জড়াবে না। কোহিনুরের কাছেও স্বীকার করেছে যে সেদিন বর্ষণের সাথে বাড়ী ফেরাটা ওর ভুল ছিল। তারপরেও এই কথাটা চেপে রাখলে দেখা যাবে আম্মা ওকেই ভুল বুঝবেন। তাছাড়া সত্যি যদি বর্ষণের মা এ ঘরে আসেন তাহলে এমনিতেও ব্যপারটা প্রকাশ পেয়েই যাবে। কাজেই লুকিয়ে লাভ নেই।

মেঘার মুখে সব শুনে কোহিনুর কেবল গম্ভীর মুখে এতোটুকুই বললেন, ” আবার কুন নতুন তামশা করব কে জানে।”

পরের সময়টুকু দারুণ উৎকণ্ঠায় কাটলো মেঘার। দ্রুত হাতে ঘরের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে ফেলল। আরশের খাবার তৈরী করে ঠান্ডা হতে দিয়ে নিজেও হালকা পরিপাটি হল। আর কাজটা করতে গিয়ে নিজেকেই ধমকালো, ” এতসব সাজ পোশাক কিসের। বর্ষণের মায়ের মুখে কী শোনার আশায় এতো উচাটন হয়ে আছিস তুই ? পরক্ষণেই লজ্জিত হয়ে ভাবল, ‘ এটা তো সাধারণ ভদ্রতা। একজন বাইরের লোক ঘরে আসবে। পরিপাটি হব না কেন।’
ভাবনার পরিসমাপ্তি ঘটল একেবারে বিকেলে। মেঘা তখন মনে মনে বর্ষণের মায়ের আসার আশা ছেড়ে দিয়ে ভাত-ঘুমের আয়োজন করছিল। সে ধরেই নিয়েছিল ভদ্রমহিলা মেয়ের ঘরে গিয়ে সব শোনার পর হয়ত মত বদলেছেন। এদিকের পথ আর মাড়াবেন না। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে অবশেষে বর্ষণের মা চলেই এলেন। তবে রক্ষে বর্ষণ আসেনি।
কোহিনুর বেগম সামনেই ছিলেন। ভদ্রমহিলা মেয়ের শ্বাশুড়ীর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নিলেন। নিজের স্বাস্থ্য নিয়েও কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। মেঘা চা নাস্তা আনতে গেলে বাধা দিয়ে ওকে নিজের পাশে বসালেন। কোহিনুর কথাবার্তা স্বাভাবিক ভাবে চালিয়ে গেলেও বর্ষণের মায়ের হাবভাব তার পছন্দ হচ্ছিলো না। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন যে, মহিলা ছেলের হয়ে বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছেন। সম্ভবত বর্ষণের চাওয়ার কাছে সুরমার চাওয়া হার মেনেছে। তাছাড়া কামাল তো আগেই রণেভঙ্গ দিয়েছে। তার মতে, বর্ষণের ব্যপারে সে আর সুরমা নেই। তারমানে সহজ। এই মহিলা ছেলের মন রাখতে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
কোহিনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন মূল বক্তব্যের। এক পর্যায়ে বর্ষণের মা মুখ খুললেন,
-” আপা, আপনিই এখন মেঘার মুরুব্বী। মেঘার গার্জিয়ানও আপনি। তাই আপনার সামনেই বলছি। আমার বর্ষণ মেঘাকে বিয়ে করতে চায়। আপনাদের অমত না থাকলে আমি শিঘ্রীই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই। ”
কোহিনূর মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন এই কথাটার জন্য। তবে এত অনাড়ম্বর প্রস্তাব আশা করেন নি। তিনি প্রায় সাথে সাথেই বললেন, ” মেঘার গার্জেন তো আর আমি না অর গার্জেন অইল অর ভাই। আপনে অর ভাইয়ের লগে কথা কন। আমি কেডা ?”
-” তবু আপনি মেঘার মা হলেও আছেন শ্বাশুড়ী হলেও আছেন। মেঘা আপনার সাথেই থাকে। তাই আপনাকেই বলছি।”

কোহিনুর মুখ কালো করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ” মেঘা তো আর পোলাপান না। অর বিয়ার সিদ্ধান্ত অয়ই তো লইতে পারে। আমারে লাগে নাকি।” বলে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। এবার মেঘার পালা। সে মনে মনে ঘামতে লাগল। কী জবাব দেবে সে এর ? একটা মেয়েকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব করা হয় তখন কী সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে ? পারলেও কতটুকু !
মেঘা মনে মনে প্রস্তুতি নিতে লাগল কিছু বলার জন্য। তার আগেই বর্ষণের মা হঠাৎ খপ করে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে বললেন,
-” আমার মেয়েটাকে বাঁচাও মা। বর্ষণের জেদের কাছে হার মেনে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এদিকে সুরমাটার কী অবস্থা তাতো জানো। তার এক কথা। বর্ষণ তোমাকে বিয়ে করলে সে মরে যাবে। সব শুনে তোমার ভাসুর আমাকে বলেছে, হয় ছেলেকে ফেরান নয়তো মেয়ে ফেরত নিয়ে যান। অাপনার ছেলে দুনিয়াতে আর মহিলা পায় নাই। আমার ভাইয়ের বিধবাকেই তার মনে ধরেছে। সমাজ সংসার বলে কিছুই মানতে রাজী না সে। আমার মানসম্মানের দিক দেখলো না আপনার ছেলে। এখন দেখি, বোনের সংসার নষ্ট করে কীভাবে নিজের সংসার সাজায়। আমাকে তো চিনে না। আপনার ছেলে আমাকে মেঘার ভাইয়ের কাছে নত করবে আর আমি বুঝি ওকে ছেড়ে দেব ? আপনার মেয়ে নিয়ে যাবেন আপনি।’ এসব বলেছে কামাল। বর্ষণের মা কাঁদতে লাগলেন আর মেঘা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল বর্ষণের মায়ের দিকে।
মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” তুমি যদি বর্ষণকে না ফেরাও মা তাহলে আমার মেয়ের জীবনটা অশান্তিতে ভরে যাবে। কামাল আমার মেয়েকে ছেড়ে দেবার হুমকি দিচ্ছে। বর্ষণ একথা এখনও জানেনা। জানলে আরেক কাহিনী বাজ খাবে। সুরমা একটু আগেও কেঁদে আমাকে বলেছে, মেঘা নিজে বিধবা তো তাই সধবাদের সুখ সে দেখতে পারেনা। নইলে আমার সংসার ভাঙ্গতে উঠে পড়ে লাগবে কেন সে। ”

-” আমি তার সংসার ভাঙছি? ” অস্ফুট স্বরে প্রতিবাদ করে উঠল মেঘা।
বর্ষণের মা দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন, ” তুমি ভাঙছো না কিন্তু তোমার কারণেই তো ভাঙছে। ”
-” তাহলে বর্ষণকে থামাচ্ছেন না কেন আপনারা ? আমি কী একবারও বলেছি যে আমি বর্ষণকেই বিয়ে করব? ” মেঘার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল।

বর্ষণের মা মাথা নাড়লেন,
-” মানাও তো করোনি। ছেলে আমার কী পরিশাণ পাগল হয়ে আছে তুমি হয়ত জানো না। বর্ষণের বাইরে যাবার সব কাগজপত্র তৈরী হয়ে গেছে। সামনের মাসেই ও কানাডা চলে যাবে। সেকারণেই আমাকে জোর করে পাঠালো যেন আমি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রাজী করি। ওর বক্তব্য আমি বুঝি। ওর মতে, বিয়ের পর তোমরা দুজন যেহেতু বাংলাদেশে থাকছ না। সেহেতু এ বিয়েতে কারো আপত্তি থাকার কথা না। ও তোমাকে সাথে নিয়েই যেতে চায়। কিন্তু মা, আমি তো জানি, সম্ভব না? ”
-” কেন সম্ভব না ? ” প্রশ্নটা মনে ধাক্কা খেলেও মুখে বলল, ” আমাকে আপনি কী করতে বলেন? ”
-” তুমি বর্ষণকে এমন কিছু বলো যেন দোষটা আমার উপর না আসে। বর্ষণ জানুক যে আমি তোমাকে রাজী করাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি নিজেই এখানে রাজী না। তাহলে সে হয়ত অন্য দিকে মন দেবে। নয়তো সে তো কোন পাত্রী দেখতেও রাজী না। কী জাদু করেছ কে জানে ! ”
-” আন্টি, আপনি আমাকে এসব বলে অপমান করছেন। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমি যেতে বলব এবার।”
-” তারমানে তুমি বর্ষণকে মানা করবে না? আমার মেয়ের সংসারটা ধ্বংস হতে দেখবে তুমি? ”
মেঘা কান্না চাপতে পারলো না। কেঁদে বলল, ” আপনি প্লিজ যান আন্টি। বর্ষণকে আমি কখনোই বিয়ে করতে চাইনি। ঝামেলাটা ও তৈরী করেছে। অথচ আপনারা আমাকে বারবার চাপছেন। কী অদ্ভুত বিবেচনা আপনাদের।”
-” যদি বিয়ে করতে না চাও তো ওর সাথে সিএনজিতে উঠেছিলে কেন? এটা আবার কোন পর্দা যে গায়ের মাহরামের সাথে ঢলাঢলি করেও ঠিক থাকে ? ”

মেঘা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বর্ষণের মা এবার দাঁড়িয়ে গেলেন। কঠিন অথচ চাপা স্বরে বললেন, ” বর্ষণকে উৎসাহিত করেছ তুমি। নইলে সে তো হিমাকেই বিয়ে করত। তুমি যদি মনে করো বর্ষণকে বিয়ে করে নিজের আর আরশের গতি করবে তাহলে মনে রেখো, আমার বদদোয়া থেকে বাঁচতে পারবেনা কোনোদিন। একজন মা’কে কাঁদিয়ে কোন ছেলে সুখী হতে পারেনা। ”

=====

বর্ষণের মা চলে গেছেন অনেকক্ষণ হয়। মেঘা তখনও ঠায় বসে আছে। প্রায় আধাঘন্টা একভাবে বসে থাকার পর সে দু চোখ বন্ধ করল। মনের জ্বলুনি চোখ দিয়ে পানি হয়ে বেরিয়ে এলো ওর। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিল মনের যাবতীয় গ্লানি। তারপরেও বুকের ওপরে যেন কিছু একটা চেপেই রইল।
একরকম ঘোরের মধ্যেই মাগরিবের নামাজটা আদায় করল। সারাটা সন্ধ্যা আর ঘর থেকে বেরুলো না। কোহিনুর বেগমও আর এ ঘরে এলেন না। বিকেলে বর্ষণের মায়ের কথাটা শোনার পর থেকেই তার চেহারা আর দেখেনি মেঘা। এমনকি আরশকে দেখতেও তিনি আসেন নি। মেঘা নিজেও তার ভুল ভাঙানোর কোন চেষ্টা করেনি।
রাতে হালকা পাতলা মুখে কিছু মুখে দিয়েই শুয়ে পড়ল আজ। কেন যেন আজ আর আম্মার সাথে কথা বলে তার ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে করলো না।

চোখটা প্রায় লেগেই এসেছিল। হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘুম ছুটে গেল ওর। এত রাতে কে হাতে পারে। স্ক্রিণে নাম দেখে মুখটা শক্ত হয়ে গেলো ওর। রিসিভ করবে কি না ভাবতে ভাবতে একসময় সিদ্ধান্ত নিলো কথা বলবে। আর কোন নতুন ফ্যান্টাসীর জন্ম দিতে চায় না মেঘা। শান্ত ভঙ্গিতেই রিসিভ করলো ফোনটা। বর্ষণের আনন্দিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
-” কেমন আছেন মেঘা ? বিরক্ত করলাম ? আসলে সারা সন্ধ্যা দারুণ ব্যস্ত ছিলাম। জানেন হয়ত আমার বাইরে যাওয়া কনফার্ম হয়েছে। বাড়ী ফিরে শুনলাম, আম্মার সাথে আপনার অনেক কথা হয়েছে। সবটা জানার পর আর থাকতে পারলাম না। এমনিতেও সারাটা সন্ধ্যা ছটফট করে কাটিয়েছি। আম্মা এখন জানালেন যে আপনার সাথে তার সাকসেসফুলি কথাবার্তা হয়েছে তখন রীতিমত অস্থির হয়ে গেছি। আম্মা বলল, আপনি ভাবার জন্য সময় নিয়েছেন। আসলে সেদিনের ব্যপারটার জন্য আমি স্যরি। ওভাবে সিএনজি থেকে নেমে যাবার পর আমার নিজেরই পরে খুব খারাপ লাগছিল। যাই হোক, রাগ থেকেই অনুরাগের জন্ম। এবার আপনার কথা বলুন। অনেকক্ষণ ধরে তো আমিই বকবক করে যাচ্ছি। আমার আম্মুর সাথে কথা বলে কেমন লাগল আপনার ? একটা কথা বলে রাখা ভাল, আমার আম্মু কিন্তু খুব সহজ সরল ধরণের মানুষ। আমাদের ব্যপারটায় প্রথমটায় তারও কিছু আপত্তি ছিলো কিন্তু যখন তাকে বুঝিয়ে বলেছি তখন সে হাসিমুখেই সব মেনে নিয়েছে ।” বর্ষণ থামলো। কিন্তু মেঘার দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। বর্ষণ তাগিদ দিলো, ” কী হয়েছে আপনার ? কথা বলছেন না যে ? ”

মেঘা কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিজের ভূমিকা ঠিক করে নিল প্রথমে। তারপর হালকা কেশে বলল,
-“আসলে আপনার কথাই ঠিক। আপনার মা চমৎকার মানুষ। আর আপনার আব্দার মেনে নিয়েছেন এ কথাটাও মিথ্যে নয়। উনি বিকেলে আমাকে আপনার হয়ে প্রস্তাব দিতেই এসেছিলেন। কিন্তু বর্ষণ….! আমার পক্ষে যে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না। মানে, আপনি তো হামিদ ভাইকে চেনেন। ভাইয়ার খুব ইচ্ছে আমি হামিদ ভাইকে বিয়ে করি। ভাবিও তাই চান।”
-” আশ্চর্য্য, ভাই ভাবির ইচ্ছে হলেই আপনি যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলবেন এটা কেমন কথা ? দাঁড়ান, দাঁড়ান। হামিদ….মানে ঐ টাক মাথা মোটা লোকটা ? যে আমার সামনে আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল।? ”
-” জি।” ইতস্তত করে জবাব দিল মেঘা।
-” হ্যাভ ইউ গন ম্যাড মেঘা। আপনাকে ওর সাথে একদম মানায় না।”

” বর্ষণ, আপনি হয়ত মানবেন যে বাহ্যিক সৌন্দর্য সবসময় মানুষের ভেতরের খবর সমানভাবে প্রকাশ করেনা। আমি হামিদ ভাইয়ের বাহ্যিক চেহারা দেখে তাকে অবমূল্যায়ন করতে রাজী নই।”
-” মেঘা, এসব কী বলছেন আপনি ? ইউ মাস্ট বি জোকিং। ঠাট্টা করছেন আপনি আমার সাথে। নাকি রেগে আছেন আমার উপর ? ”
-” জি না। না ঠাট্টা না রাগ। আমি আপনার আম্মাকেও জানিয়ে দিয়েছি যে আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না।”
-” কিন্তু কেন মেঘা। আমি বলে বুঝিয়ে আম্মাকে রাজি করালাম। আর আপনি কিনা, আচ্ছা, ঠিক করে বলুন তো, আম্মু আপনাকে কী কী বলেছে? ”
-” সেটা আপনি ওনার কাছ থেকেই জেনে নেবেন। রাখি।”
-” এক মিনিট। তারমানে আম্মু আপনাকে কোনভাবে মিসগাইড করেছেন, তাই না ? যেন আপনি নিজে থেকে মানা করে দেন ? প্লিজ, টেল মি দা ট্রুথ মেঘা ।”
-” বর্ষণ কেন অযথা জিনিসটাকে তাল পাকাচ্ছেন। তিনি আমাকে খারাপ কিছুই বলেন নি। তাছাড়া আপনি এমন কেন ভাবছেন, যে আপনি প্রস্তাব দিলেই আমি লাফ দিয়ে রাজি হয়ে যাব। আমি কী বাধ্য আপনাকে বিয়ে করতে? ”
-” হ্যাঁ। বাধ্য। ”
-” কী ? বাধ্য মানে ? ”
-” বাধ্য কারণ আপনি আমাকে পছন্দ করেন। আর এটা আপনি জেনেও লুকাচ্ছেন। আসলে আপনি একটা অকৃতজ্ঞ। ভেবেছিলাম আমি আপনার মন ছুঁতে পেরেছি। সেজন্যেই বারবার আপনার কাছে গেছি। আপনাকে বুঝতে চেয়েছি। তাছাড়া আরশকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। সেও আমাকে দেখলে খুশি হয়। অথচ আপনার ফাজলামির জন্য আমরা দুজন এক হতে পারছি না। ”
-” ফাজলামি ভাবলে ফাজলামি। আমি নিরুপায়।”
-” আপনি মোটেও নিরুপায় নন। আপনাকে আসলে লোভে ধরেছে। আসল কথা বলেন না কেন ?” বর্ষণ রেগে গেল।
-” কিসের লোভ ? ” হতভম্ব মেঘা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না।
-” কিসের লোভ তা আপনি জানেন। আসল কথা, হামিদ মিয়াকে খুব বেশী মনে ধরেছে, এটাই লোভ। আপনি নিজেও জানেন না, আপনি কতটা ন্যারো মাইন্ডেড।” ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল বর্ষণ।
-” এরকম ভাবলেও ভুল করবেন না। আপনার মত ব্রড মাইন্ডেড লোকের সাথে আমার আসলেই যায় না।”
-” আমার এখন কী ইচ্ছে হচ্ছে জানেন ? একটা চড় মেরে আপনার গালটা ফাটিয়ে ফেলি।”
-” আপনি কী এবার অধিকারের সীমা অতিক্রম করছেন না ? ”
-” একশ বার করব। করতেই থাকব। আপনার মত….!” কট করে ফোনটা কেটে দিয়ে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মেঘা। দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকল। কিসের এ কান্না সে নিজেও জানেনা। সমস্ত শিরা উপশিরায় এক অদ্ভুত কাঁপুনি। এ কান্না রাত ভরই চলল। যতক্ষণ পর্যন্ত না উষার আলো ওর মাথায় স্নেহের পরশ বুলালো।

আলোর ইশারা টের পেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মেঘা। দ্রুত অযু করে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ পড়া শেষ হতেই মনে পড়ল গত কালকের কথা। একে একে বর্ষণের মায়ের নাটুকেপণা আর সেটা জেনে শ্বাশুড়ী আম্মার জেদ আর অনাবশ্যক অভিমান। পুরোটা সন্ধ্যা তিনি এ ঘরে আসেন নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিল মেঘা। এক অদম্য কষ্ট বারবার দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে অন্তরটা।
মোটামুটি দুটো ব্যাগে ওর নিজের আর আরশের কাপড় ভরে ফেলল সে। আপাতত পরনের কাপড়গুলো আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে যাবে তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য জিনিস নেবে। এ বাড়ীর মায়া ছাড়তেই হবে ওকে। এছাড়া আর কোন পথ নেই। ভাগ্য থেকে পালাতে না পারুক পরিস্থিতি থেকে তো পালাতে পারবে। এখানে এদের ত্রিমুখী ষড়যন্ত্রে মেঘা এক রাতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর পক্ষে আর এভাবে মিথ্যে বলা সম্ভব না। সে হামিদ ভাইকে বিয়ে করেছে এই সংবাদটা একসাথে অনেকগুলো আগুনে পানি ঢালার কাজ করবে। বর্ষণও থামবে। সুরমা ভাবির সংসারও বাঁচবে সাথে বাঁচবে কামাল ভাইয়ের মানসম্মান। আর আরশের দাদীকেও আর দ্বিধামনস্ক থাকতে হবেনা। মেঘাও পাবে একটু স্বস্তির পরশ। এরপর কে ওকে কী বললো তা সে শুনতেও যাবেনা কষ্টও পাবেনা। এখানে হাজার চেষ্টা করেও যখন ভালো থাকতে পারছে না তখন আর কী। ভাইয়ার আজই যাত্রা। খুব ভালো সময়েই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছে। ভাইয়া থাকতে থাকতেই সে উঠে যেতে পারবে ঐ বাড়ী। হঠাৎ ভাইয়াকে ফোন দেবার সিদ্ধান্ত নিলো মেঘা।
ভাবনাটা মনে আসার সাথে সাথেই কল করলো মেঘা। হাসিবই ধরলো। ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে আবেগগুলো হুড়মুড় করে প্রকাশ পেতে যাচ্ছিল। সযত্নে সেগুলোকে একপাশে সরিয়ে গত পরশু রাত থেকে শুরু করে গতরাতের বর্ষণের ফোন পর্যন্ত সবই খুলে বলল মেঘা। হাসিব নিরবে সবটা শুনল তারপর বলল, ” ভাল করেছিস, ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিস। হামিদ ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলব। তুই সোজা চলে আয় এখানে। তোর হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে তবেই বেরোবো আমরা। আর সব গোছানো হয়ে গেলে আমাকে ফোন দিস। লেবার পাঠিয়ে দেব। ”

সকাল আটটার দিকে মেঘার ঘরে ঢুকেই চোখ কপালে তুললেন কোহিনুর। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ঘরময় ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র দেখলেন। তারপরই দিশেহারা ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, ” এ….এসব কী বৌমা ? ”
মেঘা তখন নিজের পার্সে জরুরী কাগজপত্র ভরছিল। সেভাবেই বলল, ” ভাইয়া ফোন করেছে আম্মা। আমাকে বাসায় যেতে হবে। ”
-” বাসায় যেতে হইব মানে ? এই না সেদিন বললা তুমি ঐ বাড়ী যাইবানা? ”
-” জি, বলেছিলাম। কিন্তু তখন পরিস্থিতি এত জটিল ছিলো না আম্মা। এখন আমার নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য হলেও এখান থেকে চলে যেতে হবে ”
-” তাই বইলা তুমি মন চাইলেই পোলা নিয়া দৌড় দিবা? ”
-” উপায় নেই আম্মা। আমার ভালো তো আমাকেই দেখতে হবে। আমার ভাই ছাড়া তো আর কেউ দেখলো না। আপনিও না। আপনিও আমাকে সব সহ্য করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেই বলবেন আর কেউ ঘরে বয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এলে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন। তারচে আমার একা থাকাই ভালো। এই রোজকার হাঙ্গামা আর নিতে পারছি না আম্মা।” বলে ব্যাগ গোছানোয় মনোযোগ দিলো মেঘা। কোহিনুর বেগম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

মোটামুটি সব গুছিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখেছে মেঘা। সে একলা মানুষ। ঝামেলা কম। ফার্নিচার বলতে একটা খাট, ওয়্যারড্রব আর আলমিরা। আরশের একটা ছোট্ট ড্রয়ার আছে যেটা কয়েক মাস আগেই নতুন কিনেছে। আর আছে পানির ফিল্টার আর একটা ফ্রিজ। সব একটানেই নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানালো সে তৈরী। হাসিব জানালো, ঘন্টা দুয়েক পর আসবে লেবাররা।

======

” প্রস্তাবটাতে তুমি রাজী হয়া যাও বৌমা। আমি বর্ষণরে আইতে কইছি। ”

জানালার ধারে বসেছে মেঘা। এখানটায় বসলেই বাইরে চোখ চলে যায় আনমনে। বড় রাস্তার পুরোটা দেখা যায় এখান থেকে। চোখ কুঁচকে আকাশটা দেখলো মেঘা। ঈষাণ কোণে মেঘের ঘনঘটা। শেষতক বৃষ্টি হবে কি না কে জানে। রাস্তার পারের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাল। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে গাছের ওপর আর নিচটা। সবুজের সমারোহে লালের উৎসব। লাল সবুজের এমন চমৎকার মিতালী সচরাচর চোখে পড়েনা। মেঘার প্রিয় দৃশ্য এটা। কিন্তু বড় অসময়ের ভালোলাগা। অন্তত গত দুদিনের ঘটনার পর মনটা এবার সরাসরিই বিদ্রোহ করে বসেছে। সে আর অপদস্থ হতে রাজী নয়। যথেষ্ট হয়েছে। এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তার সবটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও গত কালকের ঘটনাটা মেঘার মনটাকে ভেঙেচুরে রেখে গেছে। এতো জটিলতা আর ভালো লাগেনা। খুব অল্প সময়ের এ জীবন। এটুকু জীবনে ভুলের বোঝা আর বাড়াতে চায়না। সামনের দিনগুলোতে জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠে একটু মসৃণ পথে হাঁটতে চায়। আচমকা কথাগুলো কানে আসতেই ঘাড় ফেরালো মেঘা। হাতে কাজ নেই বলে বাচ্চাদের খাতাগুলো নিয়ে বসেছিল। শ্বাশুড়ীর দিকে তাকাতেই দেখলো তার হাতে একটা বাটিতে কয়েকটা শসা। তিনি সেগুলো হাতে নিয়ে বিছানার এক কোণে বসেছেন।

আস্তে করে কথাটা বলেই শসা কাটায় মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তাকে দেখে মনেই হচ্ছেনা একটু আগের কথাগুলো তিনিই বলেছেন। এই মুহূর্তে তার যাবতীয় মনোযোগ শসার দিকে। মেঘা তার কথার কোন জবাব না দিয়ে ফের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনে পড়ল বিয়ের দিনগুলোর কথা। আজ অনেকদিন পর সবকিছু গোড়া থেকে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেভাবেই শুনতে পেল কোহিনুর বলছেন,

-” বর্ষণরে ফোন দিসিলাম। সে কইছে। তুমি হ কইলেই সে আসব। অয় তুমারে প্রস্তাব পাঠাইসিল কালকা। আমি নিজের কানে হুনসি বর্ষণের মায়ের কথা। তুমি আমার উপর রাগ কইরা বাড়ী ছাড়বা এইটা আমি হইতে দিমুনা। তারচেয়ে তুমি বর্ষণের প্রস্তাবটা মাইনা ন্যাও। আর কেউ রাজী থাউক না থাউক। আমি রাজি। তবু তুমি আমার নাতিডারে নিয়া চইলা যায়োনা বৌমা।” শ্বাশুড়ীর কাতর স্বরে বলা কথাগুলো শুনে মেঘার চোখ জ্বলে ভরে গেল।
সে উঠে এসে শ্বাশুড়ীর হাত ধরে বলল,
– “বর্ষণকে আমি কোনোদিনই বিয়ে করব না আম্মা। বর্ষণ যা ইচ্ছে বলুক। আমার তাতে কিছু যায় আসেনা। আমি আজ থেকে আমাদের বাড়ীতে থাকব। আপনি যখন খুশি চলে আসবেন। মাঝেমধ্যে দু একরাত থেকেও যাবেন। কিন্তু এ বাড়ীতে আর না।”
-” কিন্তু ক্যান বৌ মা ? আমি তো রাজী হইলাম। অহন তুমার কিয়ের অসুবিদা ? ”
-” আমার কোন অসুবিধা নেই আম্মা। আমি তো শুধু বর্ষণকে আমার জীবন থেকে দুরে সরাতে চাচ্ছি। আর আমি হামিদ ভাইকে বিয়ে করছি এটা না শোনা পর্যন্ত বর্ষণকে সরানো যাবেনা। আপনি ওকে ফোন করে মানা করে দিন। সে এলেও লাভ নেই। আমি মরে গেলেও ওকে বিয়ে করব না।”
-” ঐ হামিদ মিয়া রে করবা ? ”
মেঘা ভেজা চোখে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লে কোহিনুরের চোখ জ্বলে ভরে গেল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here