#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
~শেষ পর্বের শেষ খন্ড~
স্কুল থেকে ফিরেই ফোন পেল মেঘা। ফোন না ধরেও দুর থেকেই মুচকি হাসলো সে। ফোন রিসিভ না করলেও সে জানে ওটা আরশের দাদীর ফোন। বুধবার হলেই ফোন করেন তিনি। কারণ বৃহস্পতিবার তাঁর আসার কথা থাকে।
প্রতিবার আসার আগে তার কমন প্রশ্ন থাকে, ” কিছু আনতে হইব বৌ ?” আর প্রতিবারই মেঘা হাসিমুখে জানিয়ে দেয়।
-” না, আম্মা। কিছু আনতে হবেনা।” ব্যস, তার পরদিন সকালেই এসে হাজির হন তিনি।
সেদিন মেঘা আরশকে সাথে নেয়না। ওর দাদীর কাছে রেখে তবে স্কুলে যায়। এই দিনটাতে এরা দাদী নাতি প্রানভরে খেলাধূলা করে আর মজা করে সময় কাটায়। এই দিনগুলিতে মেঘার বাড়ী ফিরতেও একটু দেরী হয় কারণ প্রতি বৃহস্পতিবার স্কুলে টিচার্স মিটিং থাকে এক ঘন্টার। মেঘাকে সেটা এটেন্ড করতে হয়। বিগত তিন বছর ধরে এই নিয়মই চলছে। মেঘা নিজেও বৃহস্পতিবারগুলো বেশ ইনজয় করে। ওর নিরানন্দ জীবনের একমাত্র আনন্দ এখন এই দুই অসমবয়সী মানুষ। আরশ আর ওর দাদী।
এদিনে মেঘার হাতে বেশী টাকা থাক বা না থাক, কিছু না কিছু সে আনবেই। কোনদিন পাকা পেয়ারা বা পাকা পেঁপে। কোনোদিন ভাজা পাপড় কিংবা মজার কোন পিঠা। কোহিনুর যেসব খুব পছন্দ করেন। সেকারণেই মেঘা ঐদিন এসব সাথে করে নিয়েই তবে বাড়ী ফেরে। রাতেও ভালো মন্দ রান্না করে খায় আর গুটগুট গল্প করে দুজনে। তবে কোহিনুর বেগমের গল্প মানেই তিন বউয়ের গীবত। শুনতে বেশ অস্বস্তি লাগে মেঘার। একদিন সাহস করে বলেই ফেলেছিল সে।
-‘ থাক না আম্মা। কী দরকার ওদের কথা বলে ওদের গুনাহ হাল্কা করে নিজেদের গুনাহ ভারী করে ফেলার।
কোহিনুর বেগম রেগে যান তাতেই। ধমক মেরে বলে উঠেন, ” কিয়ের গুনাহ ? অরা আমারে জ্বালায়া কইলা কইরা ফালাইলো আর তুমি কও এডি কওন যাইব না? গুনাহ হইবো ক্যান ? আর হইলে হউক গা গুনাহ।”
-” হায় আল্লাহ, এইভাবে বলেন না আম্মা।”
-” গীবত না করলে কথা কমু কেমনে। যত কথা কই সবই তো গীবত। তোমার কথা শুনতে গেলে তো মুখে তালা মাইরা রাখন লাগব দেহা যায়।” এর পরে আর কথা বাড়ায় না মেঘা। শ্বাশুড়ীকে সে ভালোই চেনে। যেটা বিশ্বাস করে তার বাইরে এক কদম পা ফেলতে রাজী নন। আর এ ব্যপারে তার বাপ-দাদার ভূমিকা অগ্রগণ্য। তিনি বাপ-দাদার নিয়মকে আঁকড়ে ধরে রাখাটাই সমীচীন বলে মনে করেন। তবে মনটা ভালো তার। এটা আর কেউ না জানলেও মেঘা জানে।
এই বৃহস্পতিবারও যথারীতি শ্বাশুড়ী আম্মা যথাসময়েই চলে এসেছেন । মেঘা তখন স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আরশকে তার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল, ” এই রইল আপনার নাতি। আমি এখন স্কুলে গেলাম।” বলেই আরশের থুতনী ধরে বলল, ” তুমি কিন্তু একদম দাদুকে বিরক্ত করবেনা। মনে থাকবে ? ”
-” আত্তা ! ” বলে বেশ বাধ্য ছেলের মত মাথা কাত করে বলল আরশ। ওর বলার ভঙ্গি দেখে পাশ থেকে সস্নেহে হেসে উঠলেন কোহিনুর।
-” দেখছ , আমগো আরশ কত ভালো ? এমন ভালো ছেলে পাইবা ? পাইবা না। ”
মেঘা হেসে যোগ করল, ” হম, বেশী ভালো আম্মা। এতো ভালো যে ও জেগে থাকলে আমি ঘুমাতে সাহস পাইনা। আপনার নাতি যে কী দুষ্ট হয়েছে তা যে ওর সাথে এক ঘন্টা থাকবে সে বলতে পারবে। সারাদিনে আমার কতগুলো চুল যে পাকায়। ”
-” হ। পাকাইবোই তো। পুলা জাত কইছে কারে।”
মেঘা সব গুছিয়ে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করতেই কোহিনুর পেছন থেকে বললেন,
-” অ বৌমা, তোমারে তো কইতে ভুইলা গেছি। আমি কিন্তু আইজকা থাকুম না। সন্ধ্যার পরপরই যামু গিয়া।”
-” সে কী। আপনার জন্য ক্ষুদের ভাত রান্নার আয়োজন করেছি আম্মা। তিন পদের ভর্তাও আছে সাথে। আর আপনি আজই চলে যাবেন ? কেন ? ”
-” আর ভর্তা। বাড়ীর অবস্থাই অহন ভর্তা হওনের যোগাড়।”
-” কী হয়েছে বাসায় ? “মেঘা না জিজ্ঞেস করে পারলো না। কোহিনুর ম্লান সুরে জানালেন।
-” বাড়ীর খবর ভালো না রে মা। নেহাইল্যা কাম বাড়াইসে। এইডা লইয়া দুইন্যার ক্যাচাল বাজছে। কামাইল্লা আমারে বারে বারে কইয়া দিসে। আম্মা আইজকা নাতির লগে থাইকো না। তাড়াতাড়ি আইসা পইড়ো।”
-” নেহাল কী করেছে ? ” বলেই হঠাৎ কী ভেবে হাত নেড়ে কথাটাকে বাতাসে মিলিয়ে দেবার মত করল মেঘা।
-” আচ্ছা থাক্, এসব জানতে চাইনা। আপনি বরং আমি এলে পড়ে যেয়েন। দুপুরের খাবার রান্না করে টেবিলের উপর রেখেছি। সময়মত খেয়ে নিয়েন আম্মা ।”
-” আচ্ছা, খামুনে। আরেকটা খবর শুনছো ? ”
-” কী আম্মা ? ”
-” বর্ষইন্যা বলে সামনের মাসে বাংলাদেশে আইতাসে। বিদেশে যে বিয়া করছে এইডাতো আমি আগেই শুনছি। এইবার নাকি বউ নিয়া আইতাছে।”
মেঘা পায়ে জুতা চড়াচ্ছিল। কিছুটা থেমে গিয়ে ফের সচল হয়ে আগের ভঙ্গিতেই বলল,
-” ভালো, খুব ভালো। এবার আমি যাই আম্মা।” বলেই দরোজা খুলে বেরিয়ে গেল মেঘা। অজান্তেই একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস পড়ে থাকবে হয়ত মেঘার। কিন্তু সে খবর কোহিনুরের জানার কথা নয়।
=====
রাত প্রায় বারোটা। মেঘা শোবার আয়োজন করছিলো। এমন সময়ে ফোন বাজল ওর। কিছুটা বিস্মিত হয়েই ফোন রিসিভ করলো মেঘা। কোহিনুরের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেল সে। শশব্যাস্তে বলে উঠলো, ” কী হয়েছে আম্মা ? আপনি কাঁদছেন কেন ? ”
-” অ বৌ। ছোট বউমা, আমাগো অনেক বিপদ হইসে গো বৌমা।” বলেই কোহিনুর বেগম হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।
-” কী কী হয়েছে আম্মা ? ” কোহিনুরের কান্না মেঘাকেও স্পর্শ করল।
-” এট্টু আগে পুলিশ আইয়া আমার কামাল আর সুরমারে ধইরা লইয়া গেছে। ”
-” সে কী কেন ? ” নিজের অজান্তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেঘা।
-” আরে তোমারে সকালে কইলাম না নেহাল হারামজাদা কুন নাবালক মাইয়ারে জানি ভাগায়া নিয়া গেছে। হারামজাদা আইজকা তিন দিন ধইরা বাইত আইয়ে নাই। অহন ঐ মাইয়ার বাপে কেস করছে নেহাইল্যার নামে। পুলিশ আইয়া নেহাইল্যারে না পাইয়া অর বাপ-মায়রে ধইরা নিয়া গেছে। কয় নারী শিশুর কেস অইসে। ”
-” হায় আল্লাহ, এ কী কথা। বাড়ীতে কেউ ছিলো না ? সেজ ভাই মেজ ভাই ? তারা বাধা দিতে পারলো না ? কামাল ভাইকে নিচ্ছে নিক সুরমা ভাবি কেন ?
-” অরা আছিলো তো। পুলিশ দেইক্কা হেরা ডরে কেউ ঘরোত্তন বাইরোয় নাই। হেরা ডরায়। যুদি বাধা দিতে গেলে হেগোরে শুদ্দা ধইরা লইয়া যায় ! হের লাইগা দুনুজনে ঘরের পলাইসিলো। পুলিশ কইলো এইটা নাকি অনেক কড়া কেস। নাবালক মাইয়া ফিরায়া না দেওন পর্যন্ত হেরা বাপ-মায় ভিতরে থাকবো। আমি অহন কী করুম বৌ ? আমার তো কিছু বুঝে আইতাছে না। কেউরে তো পাইও না যে সাহাইয্য চামু।”
-” মেজ ভাই সেজ ভাইকে বলেন না আম্মা, থানায় গিয়ে একটু চেষ্টা তদবীর করতে।”
-” হেরা আগেই মানা কইরা দিসে। কয় আমরা এডির মইদ্যে নাই। নেহাইল্যার কারণে বলে হেগো মানসম্মান গেছে গা। আর তো কেউরে দেহি না যে এডি নিয়া দুড় ঝাপ করবো।” বলে কোহিনুর কাঁদতে লাগলেন।
মেঘা শ্বাশুড়ীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
-” আম্মা আপনি কাঁদবেন না। আমি দেখছি কী করা যায়।” বলেই দ্রুত ফোন কেটে দিলো মেঘা। হঠাৎ মনে পড়লো ওদের এসিস্ট্যান্ট ম্যাডামের হাজবেন্ড ক্রিমিন্যাল লইয়ার। তাকে একবার বলে দেখবে নাকি ? ইতস্তত করে ঘড়ির দিকে তাকালো মেঘা। বারোটা দশ। এসময় কারো বাড়ীতে ফোন করা কী ঠিক ? কয়েক সেকেন্ড দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে অবশেষে ফোনটা করেই বসল।
এসিস্ট্যান্ট আপা জেগেই ছিলেন। তাঁর বিস্মিত কণ্ঠ শোনা গেল,
-” কী ব্যপার মেঘা ? এতো রাতে ? ”
-” মাফ করবেন আপা। খুব বিপদে পড়েই ফোনটা করেছি। আমার বড় ভাসুর আর জা’কে একটু আগেই পুলিশ এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। কারণ আমার ভাসুরের ছেলে এক নাবালিকা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আপা, আমার বড় জা স্ট্রোকের রুগী। তাকে কী কোনভাবে বাইরে আনা যাবে ? একটু ভাই কে জিজ্ঞেস করে দেথুন না, তিনি যদি কিছু করতে পারেন। খরচের জন্য ভাববেন না। টাকা আমি আমার শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে নিয়ে ফুল পেমেন্ট করে দেব ইনশাআল্লাহ।”
-” আপনি এক মিনিট হোল্ড করুন মেঘা।” মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো ও পাশ।
এক মিনিট বললেও ঠিক তিন মিনিট পর ফোন তুললেন এ্যাসিসটেন্ট আপা।
-” মেঘা শুনুন। আপনি আপনার শ্বশুর বাড়ীর এলাকার থানার নাম আর আসামীদের নামটা আমাকে মেসেজ করে পাঠান। তারপর বাকিটা ও দেখবে।”
-” অশেষ শুকরিয়া আপা।”
-” এক কাজ করুন মেঘা। আপনি আমার হাজবেন্ডের ফোন নম্বর রাখুন। প্রয়োজনে সরাসরি ওকেই ফোন দেবেন। কাল স্কুলে আমি আপনাকে ওর কার্ডটা দিয়ে দেব। আপনার কাজে দেবে।”
-” জি, আপা।” ফোনটা কেটে দিয়ে ফের শ্বাশুড়ীকে ফোন দিল মেঘা। টাকা রেডী রাখতে বলতে হবে তাকে।
=====
মেঘা পরদিনই এসিসট্যান্ট আপাকে পুরো ব্যপারটা ভালো করে জানিয়ে বলে দিলো যে, এই মামলাটায় তদবীর করার কোন লোক নেই কাজেই তার স্বামী যেন ব্যপারটা একটু গুরুত্বের সাথে দেখেন। তবে জামিন হয়ে গেলে টাকার জন্য আটকাবেনা। মেঘা নিজ দায়িত্বে সুরমার জামিনের টাকা এসিস্ট্যান্ট আপার হাতে হাতে পৌঁছে দিবে।
অবশেষে মোটা অঙ্কের বেলবন্ড জমা দিয়ে পরদিনই সুরমার জামিন হয়ে গেল কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কামালের জামিন হলো না। সুরমা একজন অসুস্থ মহিলা এবং স্ট্রোকের রুগী বিধায় তার বিষয়টি বিবেচনা করে আদালত জামিন মঞ্জুর করলেও কামালের জামিনটি সরাসরি না-মঞ্জুর করা হয়েছে। তাছাড়া নেহালের এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি বিধায় কামালের জামিন হবে না। নেহালের আত্মসমর্পনের ভিত্তিতেই কামালের জামিন হয়ে যাবে বলেও জানালেন আপার স্বামী।
মেঘা কোন দিশে না পেয়ে তার শ্বাশুড়ির মোবাইল থেকে নেহালকে ফোন দিলো। ওর কারণে ওর বাবা-মায়ের হাজত বাসের কথা জানানো হলে সে প্রথম দুদিন সাড়া না দিলেও তৃতীয় দিনের দিন আত্মসমর্পন করল সেই নাবালিকা সহ। এবং পুরো সাতদিন পর কামাল জামিন পেলেন। বাড়ী ফিরে তিনি সেই যে রুমে গিয়ে ঢুকলেন সারা দিনেও আর তার চেহারা দেখা গেলো না।
গভীর রাতে বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিনি মায়ের ঘরে চলে এলেন। কোহিনুর তখন ঘুমুবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমনিতেই থানা পুলিশ করতে গিয়ে তার বুড়ো হাড্ডি ভেঙে যাবার দশা হয়েছে তার। তারপরেও সন্তানের বিপদ দেখলে কোন মা শান্ত থাকতে পারে না। তিনিও পারেন নি। তার সাথে আজ সুরমার মাও ছিলেন।
তবে মেঘা টিচারের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আইনজীবির এসিস্ট্যান্টের সাহায্য নেয়ায় কোহিনুরদের পেরেশানি অনেক কম হয়েছে।
কামাল মায়ের রূমে ঢুকেই তার পায়ে গিয়ে পড়ল। মায়ের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে।
-” আমার একমাত্র ছেলে আমার সব শেষ করে দিলো আম্মা। আমি আর মানুষকে মুখ দেখাবার মত থাকলাম না।”
কোহিনুর ছেলের মাথায় হাত রেখে স্তব্ধ বসে ওর কান্না দেখলেন। একসময় কামাল শান্ত হলে কোহিনুর ধীরে ধীরে বললেন, ” একদিনে শালার উপর জোর দেখাইয়া কত চোটপাট করছোস। বেচারার বিয়াটা পর্যন্ত আটকায় দিসিলি। ঐ বেচারা তগো মানাইতে না পাইরা ভাঙ্গা মন নিয়া বিদেশে চইলা গেল তবু তর লগে বেদ্দবি করে নাই আর মেঘাটা নিজের স্বামীর ভিটা ছাড়লো তর আর তর বউয়ের জ্বালায়। ঐ মেঘা আইজকা তদবীর কইরা তরে আর তর বউরে বাইর করলো। আর তর পুলায় নিজের পছন্দের মাইয়া পাইতে গিয়া তরে আর অর মায়রে কিমুন নাকানি চুবানিডি খাওয়াইলো। এইটারে কয় ধার শোধ । শুন্ কামাইল্লা। আল্লাহর দুনিয়াডা অইল আয়না। যিমুন মুখ বানাবি তেমুনই চেহারা দেখবি। ঐ দিন বর্ষণ বিয়া করলে তর বলে মানসম্মান যাইত। আজকা তর মানসম্মান কই গেল ? আল্লাহর হালাল কামে বাধা দিছিলিলি। একটা বিধবার সংসার অইতে দেস নাই। অহন দ্যাখ তর কপালে কী দুর্গতি। মেঘা মহিলা মানুষ, অর ক্ষমতা কম। তারপরেও খুঁজ খবর কইরা তগো লিগা সেই উকিল যোগাড় করসে। তার সাথে কথা বাত্রা কইয়া ফাইসালা করসে। নাইলে তগো বাইরোইতে আরো দেরী অইত। এতো জলদি বাইরন লাগত না। ”
কামাল মাটিতে বসে মায়ের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে নিরবে সবটা শুনে চোখ মুছে বলল,
-” খালি এটা বললা মা। এতোদিন যাদের আপন ভেবে সবটাতে সাথে রেখেছি। আজ তারাই আমার এতবড় বিপদে পাশে থাকলো না। দুরে সরে থাকলো আর যাকে অবহেলা করে সরিয়ে দিয়েছি সেই পাশে এসে দাঁড়াল। আমার দুই ভাইয়ের স্বরূপটাও আজ জানলাম। জীবনে কোনোদিন ওদের কোনকিছুতে আমি নাই।”
-” এডি কইসনা। এইয়া কইয়া মেঘা যদি আইজ তর আর সুরমার পাশে না দাঁড়াইত তাইলে তগো কী অইতো এইটা ভাব। যে যার কামের ফল পাইব। হিংসায় কিছু অয়নারে বাবা। মেঘাটা আইজকা কামাই করতাসে, স্বাধীন চলতাসে কিন্তু মাইয়াটা বড় দুঃখী।
সে সবের লিগা করে কিন্তু বেচারীর নিজের কপালডা ভাঙ্গা।”
কামাল হঠাৎ মাথা তুলে বলল,” আম্মা, মেঘার তো এখনও বিয়ে হয় নাই। তাই না ? ”
-” হ। তাইতে কী অইসে ? অয় আর বিয়াশাদী করব না। ”
-” বর্ষণরে পেলে ঠিকই করবে। বর্ষণ আসলেই একটা ভালো ছেলে। ও দেশে আসতেসে সামনের মাসে।”
-” বর্ষণ আইলেই কী ? হেয় না বিদাশে বিয়া করসে? ”
-” কে বলছে তোমারে ? বর্ষণরে বিয়ের জন্য অনেক পারাপারি করসে আমার শ্বাশুড়ী। ঐ দেশে সুরমার এক দুর সম্পর্কের খালাত বোনকে দিয়েও বিয়ের কথা চালাইসিলো কিন্তু বর্ষণ রাজী হয় নাই। বলে মেয়ে পছন্দ না।”
-” তাইলে সুরমা যে কইলো। ”
কামাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জবাব দিলো না কোনো। কথাটা যে মেঘাকে শোনানোর জন্য ছিল এটা আর নতুন করে বলতে ইচ্ছে করছে না। কোহিনুর বললেন,
-” তর শালার চোখে মেঘা বইসা গেছিলো। সে ঐডারথন বাইরোইতে পারেনাই। ”
-” আম্মা, আমি একটা কাজ করতে চাই।”
-” কী কাজ ? ”
-” বর্ষণ এবার দেশে আসতেছে আমার শ্বাশুড়ীর অসুস্থতার কথা শুনে। আমার শ্বাশুড়ী ওর জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছে। মিথ্যা অসুস্থতার কথা বলে ওকে এখানে এনে এবার জোর করেই বিয়ে দিবে আম্মা। ভাবছি, মেঘাকে দিয়ে কথা লাগিয়ে দিলে কেমন হয়।!
কোহিনুরের মুখ নিমিষেই শুকিয়ে আমচুর হয়ে গেল। সেটা লক্ষ্য করে কামাল বলল, ” তোমার আবার কী অইল ? ”
-” কী অইব। কিছু অয় নাই।”
-” এতক্ষণ ধরে আমাকে দুনিয়ার নসিহত করলে আর এখন মেঘার বিয়ের কথা শুনে দেখি চুপসায়া গেলা ? বর্ষণের সাথে বিয়ে হলেও তো মেঘা এই পরিবারেই থাকছে। ”
-” এহেনে আর কই থাকবো। যাইবো গা তো কানাডা।”
-” কানাডা গেলে যাবে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা আম্মা।”
-” বুঝলাম। অহন নেহালের কী করবি ? অরে ছাড়ানির লাইগা উকিল ঠিক করবি না ? ”
-” না। মরুক হারামজাদা। ও আমার ছেলে না।” কামালের চেহারায় একই সাথে রাগ, বেদনা আর হতাশার মিশেল।
=====
ভাইয়া ঢাকায় আসবে শুনে মেঘা যারপরনাই বিস্মিত হলো। এরকম হুট করে তো ভাইয়া কখনো আসেনা তাই তার আসার কারণটাও ঠিক বুঝতে পারছেনা। তবে যাই হোক, ভাইয়া যে আসছে এটাই আনন্দের কথা। শুধু ভাইয়ার আগমন উপলক্ষেই স্কুল থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছে সে। কারণ ভাইয়া এবার অনেকদিন পর ঢাকায় আসছে। সেকারণে মেঘা আগে ভাগেই ছুটির দরখাস্ত দিয়ে রেখেছে। আর ছুটিটা এমন ভাবে নিয়েছে যেন সাপ্তাহিক ছুটির সাথে মিলিয়ে মোট চারদিন পাওয়া যায়। ছুটির প্রথম দিনেই ঘরবাড়ী ঝাড় মোছ করে ভাইয়াদের রূমটা গোছগাছ করে ফেলল মেঘা। তারপর বেছে বেছে ভাইয়া ভাবির পছন্দের রান্নাগুলো করে রাখলো। যেন ভাইয়ারা এলে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে না হয়। এতোদিন পর ভাইয়া ভাবিকে পেলে গল্প করেই সময় চলে যাবে। ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠছে ওর।
বিকেলে ফোন পেল মেঘা। হাসিব জানালো, ওদের পৌঁছাতে রাত হবে । মেঘা প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে রাখল। হঠাৎ মনে পড়তেই শ্বাশুড়ীকেও ফোন করে জানিয়ে দিলো ভাইয়াদের আসার কথা। শুনে তিনিও জানালেন, আগামী কাল এসে দেখা করে যাবেন।
রাত নয়টার দিকে হাসিব এসে পৌঁছালো। অনেকদিন পর ভাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা মেঘা ছুটাছুটি করে আপ্যায়ন করল ওদের। ভ্রমনের ক্লান্তিতে দুজনেই বিপর্যস্ত তাই রাতে বেশী কথা হলো না। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে মেঘা জানলো হাসিবের ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেঘা যখন জানলো কামাল ভাই নিজে ফোন করে ওকে আনিয়েছেন। সব শোনার পর ধাতস্থ হয়ে অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে পরিস্কার জানিয়ে দিলো, বিয়ে করার শখ ওর অনেক আগেই মিটে গেছে। হাসিব বোঝাতে চেষ্টা করলে মেঘা বাধা দিয়ে বলল, ” না ভাইয়া। মুমিন একই গর্তে দুইবার দংশিত হয়না। বর্ষণের মা যে নাটকটা রচনা করেছেন তাতে আমি ওনার ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছি। এ ধরণের মানুষ ভয়ংকর হয়। জীবনে এমন আরো অনেক পরিস্থিতি আসবে। আর এই মহিলা এরকম করবে। যার যা স্বভাব।”
-” তাহলে সুরমাকে এতো খেটেপিটে জেল থেকে বের করলি কেন। থাকতো পরে। প্রতিশোধ নেবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন গেলি তাকে বাঁচাতে ? ”
-” এটা মানবিক কারণে গেছি ভাইয়া। কোন কিছু ভেবে যাইনি। তাছাড়া এসিস্ট্যান্ট আপার স্বামী না হলে আমাকেও ক্ষান্ত দিতে হতো।”
-” যাই হোক, বর্ষণ তো কোন দোষ করেনি। বিনা অপরাধে সে কেন শাস্তি পাবে।”
মেঘা আর কোন কথা বলতে পারলো না। বিকেলের দিকে কোহিনুর বেগম। তবে এবার তিনি একা আসেননি। এবার তার সাথে আছে মেঘার বড় ভাসুর কামাৈ আর বড় জা সুরমা। মেঘা হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই শুনল আজ রাতেই তারা আকদ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারণ বর্ষণ খুব অল্প সময়ের ছুটিতে এসেছে এবার। যদিও তাকে এখনও মেঘার সাথে বিয়ের ব্যপারে জানানো হয়নি। আজ সকালেই সে ঢাকা পৌঁছেছে। রাতে ওর মা’কে নিয়ে এখানে আসবে। সবাই আশা করছে আজই বিয়ের কথা বললে বর্ষণ হয়ত আপত্তি করবে না। সব শোনার পর মেঘার বিশ্বাস হতে চাইছিলো না। সে রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। একটু পর সুরমা নিজেই এগিয়ে এসে মেঘার হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন। দারুণ লজ্জা আর সংকোচে মেঘা তেমন কিছু বলতে পারলো না।
বিকেলের দিকে রেহানা অনুরোধ জানালো মেঘা যেন ওর পরনের জামাটা বদলে নেয়। মেঘা আড়ষ্ট কণ্ঠে বললো, ” জামা বদলাতে হবে কেন ভাবি। উনি তো আমাকে আগে দেখেছেন। ”
-” তিন বছর আগের দেখা আর এখনকার দেখায় পার্থক্য আছে। বলা যায় না, ববর্ষণ তোকে রিজেক্ট করে দিলে তখন তুইই পস্তাবি।”
মনের আভা মুখে পড়ার আগেই দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল মেঘা। কোনমতে বলল, ওর মনমতো হতে আমার বয়েই গেছে।
রেহানা সাথে সাথেই টিপ্পনী কাটলে মেঘার মুখের হাসি মুছে গেল। চাপা ধমকের সুরে বলল, ” এসব নোংরা ফাজলামি করলে আমি কিন্তু সোজা হাঁটা দেব। পরে আমাকে আর খুঁজে পাবেনা।”
-” ইস্, কী যে সুপার সেনসিটিভ মেয়ে তুই। বর্ষণ তো রূপ দেখে মজেছে। যখন বিয়ে করবে তখন টের পাবে কোন নানীবুড়িটাকে বিয়ে করেছে। ঠাট্টাও সহ্য করতে পারেনা।”
-” এটা ঠাট্টা ? ঠাট্টা হলেই সেটা অশ্লীল হতে হবে? ”
-” মাফ চাই বাবা। বাসর ঘরে তুই বোরকা পড়ে ঢুকিস। আর নিকাব পড়ে কথা বলিস তোর জামাই এর সাথে। বাচ্চা কাচ্চা আসমান থেকে পড়বে।”
মেঘা কটমটিয়ে তাকানোর আগেই রেহানা ওর গালে ঠোনা মেরে বেরিয়ে গেল।
বর্ষণ তার মা’কে নিয়ে উপস্থিত হলো রাত আটটার দিকে। সম্ভবত বর্ষণকেও সেভাবে কিছু জানানো হয়নি। সে এসেই চাপা স্বরে রাগারাগি শুরু করে দিয়েছে মায়ের সাথে। সে বারবার বলছে, পাত্রী পছন্দ না হলে তাকে মোটেও জোর করা যাবেনা ইত্যাদী। বেশী চাপাচাপি করলে সে ঠিক পালাবে। আর এবার গেলে আগামী বারো বছরেও ওর মুখ দেখবেনা বাংলাদেশ ।
বর্ষণের আম্মা ছেলেকে শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত ওর কোলে আরশকে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ” শান্ত হ বাবা। বিধবা বিবাহ করা সুন্নাহ। সবাই যদি কুমারী মেয়ে বিয়ে করিস তো এই বাচ্চাটার অভিভাবক কে হবে বল তো ? ”
বর্ষণের কথা আটকে গেল। কিছু বলতে গিয়েও চোখ পিটপিট করে আরশকে খানিকক্ষণ দেখার পরই চিনতে পারলো ‘আরশ’ বলে। ঝাড়া দুই মিনিট নিঃশব্দে আরশকে দেখে আস্তে করে ওকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে মায়ের দিকে তাকালো, -” ও এখানে কেন মা ? ” বাকিটা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। মেঘার কী তবে হামিদ সাহেবের সাথে বিয়ে হয়নি ? বুকের ভেতরটা দেবদারু গাছের মতন থির থির করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। সত্যিই কী মেঘার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে ওর। এ কোন স্বপ্ন নয়তো ? বর্ষণ আরেকবার আরশের দিকে ভালো করে তাকালো। নাহ্, এটা আরশই তো। তবু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ” ওর মায়ের নাম কী আম্মু ? ”
-” মুসরাত বিনতে জামান।”
-” মুসরাত ? ” বোকার মত মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, পাত্রীর সাথে দেখা করব কখন?”
-” আরে, এসেছিস মাত্র। একটু তো অপেক্ষা করতেই হবে। তাছাড়া পাত্রী বিয়েতে রাজী না। তাকে বোঝাতেও তো একটু সময় লাগবে। ” বলেই কিছুটা সিরিয়াস হলেন বর্ষণের আম্মু। ” মেঘার কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি। ও কোনো অবস্থাতেই এ বিয়েতে রাজী ছিলো না। আমি কথা বলার পর এখন অনেকটা শান্ত হয়েছে। আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে, মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবার সুযোগ পেলাম। ”
চুপচাপ সবটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষণ আরশের দিকে তাকাল। ওর কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে বলল , ” এবার আমাকে ক্ষমা সুযোগ করে দাও।”
শত অনুরোধের পরও মেঘার সাথে দেখা মিললো অনেক রাতে। আকদ সম্পন্ন হবার পর। অবশ্য বর্ষণ নিজেই ভেবে রেখেছিলো এরা আয়োজন না করলে সে নিজে আজ কাজী ডাকিয়ে ঘটনা শেষ করবে। কিন্তু ওকে আর সেসব করতে হয়নি। আজ কামাল ভাই সুরমা আপা হাসিব ভাই সবাই স্বতস্ফুর্ত। কেবল কোহিনুর আন্টি ছাড়া। আকদ হবার পর থেকে তিনি সেই যে কান্না জুড়েছেন থামার নাম নেই। মেঘা নিজেও তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে।
এদিকে আরশ ঘুমে ঢুলুঢুলু। পুরোটা সন্ধ্যা সে বর্ষণের কোলেই ছিল। এবার ওকে কোহিনুরের কোলে তুলে দিয়ে সুরমা আর রেহানার সাথে মেঘার রুমে চলে এলো বর্ষণ। মেঘা কারো সাথে কথা বলছিলো। বর্ষণকে দেখে সে বেশ হকচকিয়ে গিয়ে মাথায় আঁচল টানলো। সুরমা ভাবি ওর মেহেদী রাঙা হাতটা নিজের ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ” একদিন আমার কারণেই তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলে। আজ নিজ দায়িত্বে তোমাদের মিলিয়ে দিলাম। আসলে, মেঘার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আশাকরি মেঘা আমাকে ক্ষমা করবে।”
মেঘা মুখ নামিয়েই রাখলো। কোন জবাব দিলো না। বলা ভালো জবাব দেবার মত শক্তি খুঁজে পেল না। বর্ষণকে দেখার পর থেকে আপনা হতেই সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে ওর। কারণটা কী কে জানে।
শাড়ী পড়া সুসজ্জিতা মেঘাকে চিনতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে বর্ষণের। মেয়েটা হালকা রোগা হয়েছে। তাতে ওর চেহারার লাবণ্য বেড়েছে বই কমেনি। এক নজরে যতটুকু দেখা সম্ভব ততটুকুই দেখে নিলো বর্ষণ। যদিও মেঘা তখনও মুখ নামিয়ে রেখেছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বর্ষণ এবার ওর কাছে গিয়ে বসে পড়ল। ঠিক আগের মত করেই সালাম দিয়ে কুশল জানতে চাইলে মেঘা মাথা নাড়ল। লজ্জায় মুখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না ওর। লজ্জা আরো বাড়ল যখন টের পেল বর্ষণ ওর কাছ ঘেঁষে বসেছে। থুতনী এবার বুকে ঠেকলো মেঘার।
বর্ষণ কানের কাছে মুখ রেখে বলল,” কী, আমার দিকে তাকাবেন না বলে ঠিক করেছেন ? ”
মেঘা তখনও মুখ নামিয়ে রেখেছে। বর্ষণ মুচকি হেসে পকেট হাতড়াতে গিয়ে হঠাৎ কিছু একটা পেয়ে সেটা টেনে বের করে আপনমনেই হেসে ফেলল। আর একবার লজ্জবনতা মেঘাকে দেখল। একটু ভেবে হঠাৎ মাস্কটার ভাঁজ খুলে সেটাকে মাথার উপর দিয়ে টেনে নামিয়ে আনল গলায়।
ফের কানের কাছে মুখ রাখল,” শুভ দর্শনে এত দেরী কেন বধূ ? এ প্রান যে যায় যায়।
বর্ষণের কথা শুনে এবার মুখ তুলল মেঘা। আর তারপরেই বিষম চমকে উঠে চিৎকার। ওর মুখ দিয়ে গোঙানী মত শব্দ বেরুলে দ্রুত মাস্ক টেনে খুলে ফেলে ঢলে পড়া মেঘাকে জাপটে ধরল সে। বুঝতে পারল জ্ঞান হারিয়েছে বেচারী।
এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়লো। বর্ষণ বুঝতে পারছে শব্দটা বাইরেও গেছে। দ্রুত মেঘাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসে দরজা খুলল বর্ষণ। চেহারায় কাচুমাচু ভাব স্পষ্ট।
দরজা খোলামাত্রই সুরমা আর রেহানা দুজনেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে অচেতন মেঘাকে দেখে বলল,” কী হয়েছে ওর ? ও চিৎকার দিল কেন ? ”
বর্ষন কিছুটা লজ্জিত হেসে হাতের মাস্কটা দেখিয়ে দিলে ব্যপারটা বুঝতে পেরে সুরমা শান্ত হলেন। কিছুটা লজ্জিত হয়েই ফিরে গেলেন তিনি। তবে রেহানা লজ্জিত হলেন না। উল্টো ডান হাতের তিন আঙ্গুল একত্রিত করে বর্ষণের কপালে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল, ” ভয় দেখানোর আর মানুষ পেলেনা। আমার ননদ এখনও তেলাপোকা উড়তে দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায়। তোমার এটা দেখে যে হার্ট এটাক করে মরেনি এ তোমার সাত কপালের ভাগ্য। নইলে বিয়ের রাতেই বিপত্নীক হতে তুমি।”
কথাটা ঠাট্টাচ্ছলে বললেও বর্ষণের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। দ্রুত মাস্কটাকে ছুঁড়ে ফেলে দ্রুত মেঘার ওপর ঝুঁকে পড়ে ডাকতে লাগল ওকে। রেহানা মুচকি হেসে দরজার লক টিপে বেরিয়ে গেলেন বর্ষণ কাতর স্বরে ডাকল,
-” মেঘা। এ্যাই মেঘা ? চোখ খোলো না । আর ভয় দেখাবোনা। এই কানে ধরছি। এবার তুমি আমাকে অন্তত ভয় দেখিও না প্লিজ।”
বর্ষণের কণ্ঠে কী ছিল মেঘা বলতে পারবেনা। বর্ষণকে পাল্টা ভয় দেখাবার চিন্তাটা দুর হয়ে গেল। আধবোঁজা চোখেই বর্ষণকে দেখল সে। কয়েক সেকেন্ড সময় স্থির তাকিয়ে থেকে হঠাৎ দু হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে ওর কাঁধে মুখ গুঁজল। দুজনেই খানিকক্ষণ নিঃশব্দে দুজনের হৃৎস্পন্দন শুনলো।
বর্ষণ অভিযোগের সুরে বলল, ” আমাকে সেদিন হামিদ মিয়ার কথা বলে ভয় দেখানো হয়েছিলো কেন ? ”
মেঘা হেসে ফেলে চোখ নামিয়ে বলল,” স্যরি।” বর্ষণ অপলক চেয়ে থেকে আলতো চুমু খেলো ওর টিকালো নাকের ডগায়।
মেঘাকে এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হবে ভাবেনি বর্ষণ। আজ মনে হতে লাগলো সে পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে কেবল মেঘ দর্শণেই।
বৃষ্টি হয়ে ঝড়ার আগ মুহূর্তে মেঘা বাধা দিয়ে জানতে চাইল, ” একদিন বলেছিলেন, আমাকে দেখলে বয়সের কথা মনে হয়না। অন্য কিছুই মনে হয়। সেই অন্য কিছুটা কী আজ আমি জানতে চাই।”
বর্ষণ শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দে বলল, ” কানে কানে বলব না অন্যভাবে ? ”
-” যেভাবে খুশি।”
-” তাহলে চোখ বন্ধ করো, বলছি।”
মেঘা লাজুক হেসে চোখ বন্ধ করলো। টের পেল তুমুল বৃষ্টি ঝরছে কোথাও। বর্ষণের জলে ধীরে ধীরে গলে গলে ঝরে পড়তে শুরু করেছে মেঘার এতোদিনের জমাটবদ্ধ মেঘ।
~সমাপ্ত~