#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪০
স্বচ্ছ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল নিজের বোনের দিকে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে নিজের হাত দিয়ে ফারাহর গালে-মুখে হাত দিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“একারণেই তো আলুর মতো মুখটা শুঁকিয়ে শুঁকনো কিসমিসের মতো হয়ে গিয়েছে।”
ফারাহ মুখ বাঁকিয়ে স্বচ্ছের হাত ঝেড়ে ফেলে বলল,
“হয়েছে কেয়ার করার নামে ইনসাল্ট করছ এবার।”
“খাওনি কেন তবে?”
ফারাহ মুখ নিচু করে মিনমিন করে বলল,
“খাবার টেবিলে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কেউ নাই যে। একমাত্র তোমার সাথেই কাড়াকাড়ি করে খাবার খেয়ে তৃপ্তি পেতাম আমি।”
স্বচ্ছ এবার অপ্রস্তুত হাসল নিঃশব্দে। তাদের মাঝে সবসময় রেষারেষি লেগেই থাকে। অথচ নিঃসঙ্গতায় তারাই যেন একে অপরের পাশে এসে থাকে সকলের আগে। ভাই-বোন বোধহয় একেই বলে। ফারাহ এবার তাড়াতাড়ি করে খাবারের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল,
“অনেক খিদে পেয়েছে আমার। এখন আর কোনো কথা বলার মতো শক্তি নেই। খাওয়া শুরু করো, চলো।”
স্বচ্ছ মানা করতে চায়। তবে ফারাহ চোখ বড়ো করে বলে,
“মানা করলে খবর আছে। তুমি বলেছ বাবার টাকায় কিছু করবে না। এটা বলো নি নিজের বোনের টাকাতেও খাবে না। খাওয়া শুরু করো।”
স্বচ্ছ এবার আর বারণ করল না। তারও যে ভীষণ খিদে পেয়েছে। আগের মতোই যেন কাড়াকাড়ি করে একে অপরের কাছ থেকে খাবার ছিনিয়ে খেতে আনন্দ উপভোগ করল তারা। স্বচ্ছ খাওয়ার এক পর্যায়ে শুধাল,
“মা কেমন আছে? প্রেশার নাকি লো হয়ে গিয়েছিল আবার!”
“তোমার সাথে কথা বলার পর দুপুরে তো খাওয়াদাওয়া করল। তবে এখনো মনমরা হয়ে বসে রয়েছে। তোমার কাছে আসতে চাইছে বারবার। কিন্তু তুমি মানা করার জন্য নিয়ে আসিনি।”
“ভালো করেছ।”
ফারাহ এবার গলা খাঁকারি দিয়ে মুচকি হেসে পাশে খেতে থাকা স্বচ্ছকে হালকা ঠেলে বলল,
“তা প্রেমের টেম্পু কতদূর এগোলো?”
স্বচ্ছ খাওয়া বন্ধ করল। ভ্রু কুঁচকে নেত্রপল্লব দুটো সরু পাল্টা প্রশ্ন করল,
“মানে?”
“মানে আবার কী? বিয়েশাদি কবে করছ? ওই ছোটোখাটো পুতুলকে বউ কবে বানাচ্ছ? আমি ফুপি কবে হচ্ছি? তুমি বাবা কবে হচ্ছো? বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানিং কবে করবে?”
বেশ উত্তেজনা নিয়ে জানতে চাইল ফারাহ। তার এসব প্রশ্নে মাথা ঘুরে এলো স্বচ্ছের। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এটা তার নিজের বোন হয়। খাবারটা কোনোরকমে গিলে বলল,
“তোমার কি মনে হয় না? তুমি একটু আগে আগে দৌড়ে যাচ্ছো? ব্যাক করো পেছনে। আমি তো এখনো কিছু শুরুই করতে পারলাম না।”
চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল ফারাহ। ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
“মানে? এখনো তুমি কিছু বলতে পারো নি তাকে?”
“না।”
স্বচ্ছের সহজ উত্তর। ফারাহ নাক ফুলিয়ে স্বচ্ছের মতো মুখটাকে কঠিন বানিয়ে তার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলল,
“ওকে আমি ভালোবাসি বাবা! এই কথাটা পুরো ফ্যামিলি এমনকি আমাদের ঘাড়ত্যাড়া বাবার সামনেও সাহসের সাথে প্রকাশ করতে পারলে। আর আসল মানুষটার সামনে প্রকাশ করতে পারছ না?”
“সুযোগ পাচ্ছি না। আর বুঝতেও পারছি না এখনো অবধি ও কী চায়। গতবার ওর গ্রামের বাড়ি ও আমায় রিজেক্ট করেছিল। আমার নিজেকে ছোটো লেগেছে। আবার ছোটো হতে চাইনা।”
ফারাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“এটাই তোমার সমস্যা। তুমি সবসময় নিজেকে বড়ো দেখাতে যা করতে হয় সেটাই করো। কিন্তু নিজের মনের শান্তি পেতে সেসব কাজগুলো তুমি এড়িয়ে যাও যেটা করতে হলে তোমার এই জেদটাকে বলি দিতে হবে।”
স্বচ্ছ ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠল,
“তার কথার ধাঁচ দেখেছ একবারও? তার মুখের প্রতিটা শব্দে শব্দে ছু/রি চালায় মনে হয়।”
“চালাতে পারে। কিন্তু একটা মেয়েকে নমনীয়তা কখন স্পর্শ করে জানো? যখন সে কোনো শুদ্ধ ভালোবাসার সন্ধান পায়। যেখানে বিন্দুমাত্র ভেজাল থাকে না।”
স্বচ্ছ কিছুটা সময় নিশ্চুপ থাকে এবার। তারপর চক্ষুদ্বয় ছোটো করে বলে,
“প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে খুব অভিজ্ঞতা আছে দেখছি তোমার! এই অভিজ্ঞতা কি নিজের জীবন থেকে এসেছে?”
ফারাহ অসাময়িক হেসে ভাইকে ঠেলে দিয়ে বলে,
“এখনো অবধি না। আমার প্রেম-ভালোবাসা একটাই সেটা হচ্ছে ফ্যাশন। আই লাভ ফ্যাশন।”
গল্পে গল্পে শেষ হলো ভাই-বোনের খাওয়াদাওয়ার পালা। ফারাহ বিদায় নিয়ে চলে গেল বাড়ির দিকে। সন্ধ্যার মধ্যে তাকে তৈরি হতে হবে। কোম্পানিতে নতুন উইন্টার প্রোডাক্ট লঞ্চ করছে সে। তা নিয়েই আয়োজন হয়েছে পার্টি। সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে তাকে।
ফারাহকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে স্বচ্ছ খেয়াল করে মেয়েটা তার রুমাল রেখে চলে গিয়েছে। সেটা উঠিয়ে নিতেই নিচে পড়ে যায় কিছু টাকা। স্বচ্ছের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে টাকা হাতে তুলে নেয়। সে ভুল না হলে ফারাহ ইচ্ছে করে কাজটা করে গেছে। তৎক্ষনাৎ তার ফোনে মেসেজ আসে। সে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ফারাহর মেসেজটি। সেখানে লেখা, ‘জানি, টাকা খরচ করবে না বলে ভাবছ। কিন্তু এটা মোটেও করবে না। আমি জানি তোমার কাছে টাকা নেই। এগুলো খরচ করবে। এগুলো আমার নিজের টাকা। ছোটো ভাইয়ার থেকে টাকা নিতে না তুমি। তাই আমিই দিলাম। দরকার হলে যেদিন তোমার টাকা হবে সেদিন না হয় ফিরিয়ে দিও। ধার হিসেবেই দিলাম।’
স্বচ্ছ প্রথমে রাগতে চেয়েছিল। তবে এই মেসেজে মৃদু হাসল সে। রাগ উবে গেল। ছোটো বোনেরা বোধহয় এমনি হয়!
বাড়িতে মেহমান। মেহমান বলতে মোহের মামা-মামী সাইফুল এবং আফিয়া এসেছে মোহের বাড়িতে। মোহের পুরো পরিবারের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে যেন। তাই তাদেরকে দেখতে এসেছে সাইফুল এবং তার স্ত্রী। মোহের কোলে ইথান একেবারে জাপ্টে ধরে রয়েছে। নামছেই না। এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মাকে পেয়ে যেন আহ্লাদে গলে পড়েছে ছোটো ছেলেটি। মাঝে মাঝেই মোহের গালে আলতো করে চুমু বসিয়ে দিচ্ছে ইথান। আর আহ্লাদী কণ্ঠে বলছে,
“আই মিস ইউ, মাম্মা! আমাকে রেখে আর কোথাও যাবে না। মনে থাকবে?”
মোহ আলতো হেসে মাথা দুলাচ্ছে। মিসেস আফিয়া অর্থাৎ মোহের মামী সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“এ তো একেবারে মন্ত্রী মোহের পিছে পড়ে গিয়েছে। তাও ভাগ্য ভালো মোহ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে।”
মিসেস সুফিয়া স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলেন,
“সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ।”
“তবে তুমি যাই বলো সুফিয়া, মোহ নিজেকে একটু সংযত করলে কিন্তু এত কিছু ঘটত না।”
কথাটা গায়ে লাগল মোহের। তবে কিছু বলতে পারল না। কথাটা হয়ত খানিকটা হলেও সত্যি। তার যে মুখের উপর কথা বলে দেওয়ার স্বভাবটা রয়েছে সেটাই তো বিপদের মূল কারণ৷ কিন্তু তবুও মোহ মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। সেটা সে জানে। পাশ থেকে সাইফুল ইশারা করে নিজের স্ত্রীকে বেশি কথা বলতে মানা করলেন। তৎক্ষনাৎ মোহের বাবা আজহার সাহেব উত্তর দিলেন,
“চুপ আর সংযত থেকে লাভটা কী? সাইফুল ভাই নিজেও কিন্তু যথেষ্ট সংযত ছিলেন। তবুও কিন্তু নিজের এতদিনের পরিশ্রমের ফ্যাক্টরি হারিয়েছেন।”
এবার আফিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হলো যোগ্য জবাবে। মোহের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল যেন। যোগ্য জবাবে সবসময় যেন তার বাবাই শ্রেষ্ঠ। তাকে আর কিছু বলতে হলো না। ইথানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে এলো সে। অতঃপর ইথানকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই মুখ ভার করল ইথান। মোহ তার গালে হাত রেখে বলল,
“তোমার মাম্মা তো এখানেই আছে তোমার কাছেই। আমার একটু কাজ আছে ইথান। সেরে নিই। রাতে অনেক গল্প করব আমরা।”
ইথান হাসে এবং রাজি হয়। মোহ নিজের ফোনটা হাতে নেয়। কল করে স্বচ্ছকে। তাও মনের মাঝে রাগ পুষে রেখেই।
তীব্র মাথাব্যথার ফলে একপ্রকার বেঘোরে ঘুমাচ্ছে স্বচ্ছ৷ ঘুমানোর আগে হালকা ঠাণ্ডা অনুভব করছিল সে। হয়ত অতিরিক্ত শরীর ঘেমে যাওয়ার কারণে জ্বর এসেছে তার। তবে সেসব মাথায় নেয়নি সে। হুট করে ফোনের রিংটোনে ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেলেই সরাসরি সোফা থেকে নিচে পড়ে যায় সে। ধপ করে শব্দ হয়। কোমড় তীব্র ব্য/থায় চিনচিন করে ওঠে। কোমড় একহাতে ধরে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে রাগ ঝেড়ে বলে,
“যে কল করেছে আজ তার একদিন কি আমার একদিন!”
ফোনটা হাতে নিতেই রাগ উবে গেল স্বচ্ছের। জড়িয়ে রাখা চোখমুখে দেখা গেল রাজ্যের উচ্ছ্বাস। তবুও তার রাগ দেখাতে প্রবল ইচ্ছে করল। কিন্তু পারল না। ঢক গিলে কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো।”
মোহ সরাসরি জিজ্ঞেসা করে বসল,
“কোথায় আছেন এই মুহূর্তে?”
মোহের এমন গম্ভীর সুর এবং সরাসরি এই প্রশ্নে থতমত খায় স্বচ্ছ। পাল্টা প্রশ্নে জানতে চায়,
“কেন বলো তো?”
“উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা কি জরুরি?”
মোহের তেজ দেখে বিস্মিত হয় স্বচ্ছ। অথচ রাগ তার দেখানোর কথা। কিন্তু রাগ দেখাচ্ছে উল্টো জন। তবে কেন দেখাচ্ছে? নারীর মন আসলেই ভীষণ অদ্ভুত। স্বচ্ছ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“বাড়িতে আছি।”
“বাড়িতে? তাই নাকি?”
মোহের কণ্ঠে স্পষ্ট সন্দেহ। স্বচ্ছ ইতস্ততবোধ করে। জানতে দিতে চায়না সত্যটা। জোর দেখিয়ে বলে,
“তাছাড়া আবার কী? এমন হাবভাব করছ যে আমি আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডের বাড়িতে এসে তোমার কাছে লুকাচ্ছি।”
“এটা অসম্ভব কিছু না।”
স্বচ্ছ হতবাক হয়। এই মেয়ে বলে কী! চরম বিস্ময়ের সঙ্গে বলে,
“তোমাদের মাঝে জন্মগত সন্দেহ নামক রোগটা রয়েছে। কিন্তু আফসোস কী জানো! কোনো বিজ্ঞানী তোমাদের এই রোগের সমাধান বের করতে পারে নি।”
মোহ বেশ বুঝতে পারল স্বচ্ছ তাকে নিয়ে মজা করছে। সে তেতে উঠে বলল,
“তাহলে একটা কাজ করলেই তো হয়। আপনি সমাধানটা করে দিন।”
স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ ভয় পাওয়ার ভান ধরে এবং একরাশ অনীহা নিয়ে বলল,
“অসম্ভব! এতগুলো নারীর সমাধান আমি করতে পারব না। আমার সাধ্যের বাহিরে। একজনকে নিয়েই আমার ম/রি ম/রি অবস্থা। এতজনের দায়িত্ব গ্রহণ করলে প্রাণটা বেরিয়ে যাবে নিশ্চিত।”
মনে রাগটা নিয়েও বেশি কড়া কথা বলতে পারল না মোহ। ফিক করে হেসে উঠল এক পর্যায়ে। উৎসুক হয়ে শুধাল,
“তা বিশেষভাবে কার দায়িত্ব নিয়ে বসলেন যার জন্য আপনার অবস্থা একেবারেই ম/রি ম/রি?”
“ভীষণরকম একগুঁয়ে, মনে ভয়-ডর খুবই কম। খুবই ধুরন্ধর নারী। আমাকে তার পেছনে মাইলের পর মাইল ছুট করাচ্ছে। নিজে কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না।”
মোহের মুখটা মলিন হয় হঠাৎ। কণ্ঠস্বর নরম হয়। নিচু সুরে বলে ওঠে,
“হতে পারে তার কোনো বাধ্যবাধকতা রয়েছে।”
“কীসের বাধ্যবাধকতা বলে তোমার মনে হয়?”
মোহ সেই প্রসঙ্গে আর কিছু বলে না। ঘাড় ঘুরিয়ে একমনে তাকিয়ে থাকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে খেলা করা ইথানের দিকে। চোখ বুঁজে ঢল গিলে নেয় সে। প্রসঙ্গ দ্রুত পাল্টে বলে,
“কথা বলার ছিল আপনার সাথে সামনাসামনি। দেখা করুন আজকে এখনি আমার বাড়ির সামনে।”
স্বচ্ছ ফের চমকে গেল। মেয়েটা দিনদুপুরে কী উদ্ভট আবদার করছে! সে পুনরায় বলল,
“হ্যাঁ?”
“দেখা করতে বললাম আপনাকে। দেখা করুন৷ আমি অপেক্ষায় থাকলাম আপনার।”
নিজের কথাটুকু শেষ হতেই কল কাটল মোহ। স্বচ্ছ হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল শুধু। হুট করে মোহের এমন আবদারের কারণ খুঁজে পেল না সে। কোনো গুরুতর কারণ কিনা ভাবতে গিয়ে চিন্তায় পড়ল সে।
সন্ধ্যেবেলা গা ছাড়া ভাব নিয়ে ঘুমে নিমগ্ন সৌমিত্র। এই সময় তার ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এলেন মিসেস যামিনী। বেশ কয়দিন পর আবারও এলেন তিনি নিজের বোনের বাড়িতে। এসেই উনার প্রথম কাজ বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বিয়ের কথা তোলা। তবে এবারও রিহানের বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক করতেই এসেছেন তিনি। এসেই সৌমিত্রকে এমন ঘুমোতে দেখে তিনি ডেকে উঠলেন,
“এই ছেলে অবেলায় ঘুমাচ্ছিস কেন? উঠে পড়। সন্ধ্যা হলো যে।”
সৌমিত্র নড়েচড়ে উঠল। অন্যদিকে ফিরল। তবে ঘুম ভাঙল না। মিসেস যামিনী ফের কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
“এই সৌমিত্র! এভাবে সন্ধ্যাবেলা কেউ পড়ে পড়ে ঘুমায়? এজন্য তোদের মাকে বলি তোদেরকে বিয়েশাদি দিয়ে একটু সাংসারিক বানাতে। কাজ আর সংসারের চাপে এমনি সবাই সোজা হয়ে যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!”
ঘুমের ঘোরে তানিয়ার বিয়ের স্বপ্ন দেখছিল সৌমিত্র। স্বপ্নে বিষণ্ন মনে বিয়ে করছিল তানিয়া এবং তাকে দোষারোপ করছিল। সৌমিত্রের মুখের মাঝে ফুটে ছিল অস্থির এক মনোভাব। বারবার বোধ হচ্ছিল তার জন্য মেয়েটার খুশি হারিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে মিসেস যামিনীর বিয়ের কথা বলায় সেটা তার কান অবধি এলে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে সে। আশেপাশে তাকিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বলে,
“বিয়ে! কার বিয়ে? কীসের বিয়ে? এই বিয়ে হওয়া উচিত নয়।”
মিসেস যামিনী ভ্রু কুঁচকান। সৌমিত্রের নিকটে গিয়ে বলেন,
“কী রে! কী বলছিস এসব?”
সৌমিত্র ঘোলা দৃষ্টিতে মিসেস যামিনীর দিকে চাইল। তখনি চক্ষু ছানাবড়া হলো তার। মিনমিন করে বলল,
“আন্টি?”
“হ্যাঁ রে আমি। তোর রিহান ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করতে চলে এলাম আবার।”
সৌমিত্র মাথা চুলকে বলল,
“রিহান ভাই অবধিই তাহলে বিয়ের বিষয়টা সীমাবদ্ধ থাক। আমাদের দিকে আবার বিষয়টা টেনে এনো না।”
মিসেস যামিনী কিছু বলার আগেই রিহান ব্যাগ নিয়ে ঘরে আসে। সোফায় ব্যাগ রেখে প্রথমে সৌমিত্রকে আবেশে জড়িয়ে ধরে।
“কী খবর তোর?”
“এইতো চলছে জবরদস্ত। তার উপর বিয়ের ব্যাপারটা!”
সৌমিত্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হুঁ আন্টি বলেছে। জানিস, আজকাল আমার চারিপাশে শুধু বিয়ে আর বিয়ের ব্যাপারই ঘটছে। কেন বল তো!”
রিহান হেসে বলে,
“কী বলিস?”
“যা সত্যি তাই। ফ্রেশ হয়ে আসি থাম।”
সৌমিত্র ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হয়। রিহান ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে। সৌমিত্র ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে রিহান হাসিমুখে বলে,
“তোর হবু ভাবীকে দেখবি না?”
সৌমিত্র বিছানায় ধপ করে বসে বলে,
“মুড নেই। পরে দেখব।”
“আরে দেখ না! বল তোর পছন্দ হলো কিনা!”
সৌমিত্র দেখতে না চাইলেও জোরপূর্বক তার সামনে নিজের ফোনে থাকা পাত্রীর ছবি দেখাল রিহান। সঙ্গে সঙ্গেই সৌমিত্রের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে রিহানের ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে দেখতে লাগল ছবিটা। সে ঠিক দেখছে তো? অস্ফুটস্বরে সে বলে,
“এই মেয়েটা?”
“হ্যাঁ জানি পূর্বে তার বান্ধবীর জন্য ঝামেলা হয়েছিল। পরে মেয়ের পরিবার থেকেই আমরা ইতিবাচক ইঙ্গিত পাই। তাই মা ঠিক করে বিষয়টা নিয়ে এগোনোর। তাছাড়া মেয়ে তো ভালো। দেখতেও সুন্দর। তাই না বল?”
সৌমিত্র কোনো কথা ব্যতীত আচমকা রিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“থ্যাংক ইউ রে! তোর জন্য আমার কষ্ট কমে গেল।”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪১
মোহের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল স্বচ্ছ। দোতালা বাড়িতে তখন লাইট জ্বলছে। স্বচ্ছ ভেবেই পায় না এসময় মেয়েটা তাকে কেন ডাকল! রাস্তার একপাশ হয়ে মোহের নম্বরে কল করল সে। কিছুসময় পরই কল রিসিভড হলো। মোহ ওপাশ থেকে চাপা সুরে বলল,
“আপনি এসেছেন?”
“হ্যাঁ। বাহিরে অপেক্ষা করছি।”
“আচ্ছা। একটু দাঁড়ান। আমি আসছি।”
কল কেটে যায়। স্বচ্ছ একমনে দাঁড়িয়ে মোহের অপেক্ষা করে। শরীর টলমল করছে তার৷ মাথা ভীষণ ব্যথা। গায়ে জ্বর হানা দিয়েছে। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়। স্বচ্ছ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মাথায় কাপড় জড়িয়ে এগিয়ে আসছে মোহ রাস্তার এপাশে। রাস্তার আশেপাশে তাকাচ্ছে বারংবার। চোখেমুখে আতঙ্ক। হয়ত কাউকে না জানিয়েই বেরিয়েছে সে। হাত খোঁপা করা চুল অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে তার। সেটাই একহাতে ঠিক করছে মোহ। স্বচ্ছের নিকটে এসেই চক্ষুদ্বয় বড়ো করে তাকায় সে। কঠিন রাগ ঝাড়তে চায়৷ তবে সামাল দেয় পরক্ষণেই। স্বচ্ছ চেয়ে রয়েছে তার চোখের সেই ঘোলাটের মণির দ্বারা। যেটা মোহের আস্ত একটা সমুদ্র পৃষ্ঠের সেই ভয়ানক চোরাবালি মনে হয় যা থেকে উঠে আসা অসম্ভব। স্বচ্ছ হঠাৎ প্রশ্ন করে,
“মোহ ম্যাডাম! হঠাৎ এত জরুরি তলব?”
“জরুরি কথা ছিল বলেই ডেকেছি। এমনি এমনি ডেকে বিরক্ত কেন করব আপনাকে?”
স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ ধীর সুরে বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
“এটা যদি বিরক্ত হয় তবে এই বিরক্তিটা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর একটা বিরক্তি।”
মোহ স্বচ্ছের কথা অস্পষ্ট শুনতে পাওয়ায় কপাল কুঁচকে জানতে চাইল,
“কিছু বললেন?”
স্বচ্ছ অপ্রস্তুত হয়। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“বলছিলাম কী এমন জরুরি কথা?”
“চলুন সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলছি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
মোহ হাঁটতে শুরু করে আগে আগে। স্বচ্ছ তার পাশ ধরে হাঁটার চেষ্টা করে। মোহ শুধায়,
“আজকেও আপনার কোনো গাড়ি বা বাইক সাথে নেই?”
স্বচ্ছ খানিকটা থমকাল। গলার জোর যেন কমে এলো। তবুও দম নিয়ে বলল,
“সবসময় কি মানুষের এক জিনিস ভালো লাগে? আজ একটু এসব ছাড়াই চলতে চাইছিলাম।”
“তাই? সবসময় এক আপনার জিনিস ভালো লাগে না? তাহলে তো চিন্তার বিষয়। বিয়ের পর এক স্ত্রীকে নিয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। কিন্তু হ্যাঁ আপনি চাইলে স্ত্রী বদলাতে পারেন। তবে সেখানে আপনার চরিত্রবান উপাধি নষ্ট হবে।”
স্বচ্ছ অমায়িক হাসে। নির্দ্বিধায় বলে,
“তখন সেই একজনকেই আমি ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজিয়ে ফেলব। নিজের মন মতো রঙে রাঙিয়ে রাখব। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো? কিছু কিছু জিনিস এক রূপেই বেশি মোহনীয়। সেই এক রূপ দেখে হয়ত আমি এই জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। আমার বিশ্বাস, আমার নিজের সকল রঙ তার কাছে ফিকে পড়বে।”
মোহ স্বচ্ছের এই জবাবে যেন মোটেও প্রস্তত ছিল না। লোকটির জবাব হজম করার মতো ক্ষমতা পাচ্ছে না সে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাথার কাপড়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। অথচ স্বচ্ছ তার নাম উল্লেখই করেনি। তবুও কেন এত অস্বস্তি?
“এখনো কিন্তু বললে না কীসের জরুরি তলব করা হয়েছে আমায়!”
মোহ নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল। আগের কড়া রূপে ফিরল পরক্ষণেই। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“সারাদিনে কিছু খাওয়া হয়েছে?”
স্বচ্ছ হকচকিয়ে ওঠে। ঘাড় বাঁকিয়ে মোহের শুকনো মুখের দিকে চায়। হঠাৎ মেয়েটার এই প্রশ্ন মাথা ঘুরিয়ে দিলো স্বচ্ছের। তবুও বলল,
“খাওয়া হবে না কেন? খেয়েছি তো।”
এখনো সত্যিটা লুকোনোতে মোহের রাগ বাড়ে। জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী খাওয়া হয়েছে? টাকা ছিল আপনার কাছে?”
স্বচ্ছ দাঁড়িয়ে পড়ে। বুঝতে পারে সবটা জানাজানি হয়েছে। তবে কে জানাল ভাবতে গিয়ে মোহ কঠোর সুরে বলে,
“বাড়ি থেকে কেন বেরিয়ে এসেছেন? কীসের জন্য?”
স্বচ্ছ আসল কারণ তবুও বলতে চায় না। সে একটু হলেও মোহকে চিনেছে। সে জানে মোহ বিষয়টা জানলে নিজের কাছে ছোটো লাগবে তার। তাই গলায় জোর এনে বলে,
“বাবার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল তাই আরকি।”
“কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল?”
ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল মোহ। স্বচ্ছ এবার মিছি রাগ দেখিয়ে বলল,
“বাবা ছেলের মাঝে কথা কাটাকাটি হয় না মাঝে মাঝে? আমাদেরও তেমনটা হয়েছিল। এই আর কী! তুমি এত জেনে কী করবে? আর আমি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি এটা তোমায় কে বলেছে বলো তো?”
“যে বলেছে বলুক। আমার মূল কথা হচ্ছে আপনার আর আপনার বাবার মাঝের সমস্যার প্রধান হচ্ছে আমি। আমার জন্যই আপনি আপনার বাবার সাথে ঝামেলা করেছেন তাই তো?”
স্বচ্ছ নীরব হয় প্রথমে। একটু পরেই হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
“তোমার জন্য কেন ঝগড়া করব বাবার সাথে? মানে আমি কেন তোমার জন্য ঝামেলা করতে যাব? আমার কীসের দায়?”
“সেটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন আমার থেকে। কিন্তু মিথ্যে বলবেন না। আমি সত্যিটা জানি।”
বেশ শান্ত সুরে এবার কথাটি বলল মোহ। স্বচ্ছ পেরে উঠল না আর। হাফ ছাড়ল। মোহের ভার মুখ পর্যবেক্ষণ করল সে। মোহ ব্যাকুল হয়ে বলল,
“কেন এসব কষ্ট আপনি আমার জন্য করছেন? আপনার সুন্দর জীবনযাপন, বড়ো বাড়ি, শৌখিন জীবন ছেড়ে দিলেন কেন এভাবে? আমি কখনো চাইনি আপনি আমার জন্য কোনো কষ্ট ভোগ করুন। আপনি যেমন আপনার কারণে আমার সমস্যা হোক সেটা চান না। আমিও ঠিক তাই।”
স্বচ্ছ বড়ো শ্বাস নিলো। শান্ত গলায় বলল,
“আমার কষ্ট হচ্ছে না মোহ।”
“মিথ্যে বলবেন না। আবারও বলছি। আপনি তো এই জীবনযাপনে অভ্যস্ত নন। শুধুমাত্র আমার জন্য আপনি আপনার পরিবারের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এই ব্যাপারটা আমায় ছোটো করছে নিজের কাছে। আমার ছোটো লাগাকে বাড়িয়ে দেবেন না। ফিরে যান নিজের বাড়ি। শত্রুতা আমার আর আপনার বাবার মাঝে। আমি এখানে অন্য কারোর হস্তক্ষেপ চাইনা।”
স্বচ্ছ চুপচাপ মোহের কথা শোনার পর মাথা নাড়াল দুপাশে। সে ফিরবে না বাড়ি। মোহ ব্যর্থ হলো বোঝাতে। স্বচ্ছ বলল,
“আমি বাড়ি ফিরলে আমার আত্মসম্মান মিশে যাবে। আর প্রধাণ কারণ তুমি ছিলে না আমাদের ঝামেলার। আমার সমস্যা ছিল বাবার অনুতপ্ত হওয়া নিয়ে। উনি নিজের দোষ স্বীকার করতে রাজিই ছিলেন না। নিজেকে উঁচু পদে নিয়ে যেতে যেতে উনি ভালোমন্দের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছে। আমি সেটাই ধরিয়ে দিতে চেয়েছি।”
মোহ ধীর সুরে প্রতিত্তোরে বলে,
“কিন্তু সবাই তো ভাবছে আপনি আমার জন্যই নিজের বাবার সাথে ঝামেলা করেছেন।”
স্নচ্ছ হেসে বলে,
“সবার ভাবনার কথা তুমি কবে থেকে ভাবো? আমি তো জানতাম তুমি কাউকে পরোয়া করো না।”
মোহ ফের রাগ নিয়ে বলল,
“করি না তো। কিন্তু সবক্ষেত্রে সব নিয়ম একই হয়না। আপনি বাড়ি ফিরবেন।”
স্বচ্ছ কিছু বলতে গেলে মোহের ফোনে কল আসে। ফোনটা হাতে ধরে দেখে মিসেস সুফিয়ার কল। মোহ আঁতকে ওঠে তৎক্ষনাৎ। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের ধমকের সুর শুনতে পায়।
“মোহ! কোথায় গিয়েছিস তুই?”
“মা, আমি একটু বাহিরে হাঁটতে… ”
মোহের কথা মাঝপথে থামিয়ে মিসেস সুফিয়া জোর দিয়ে বলেন,
“বাড়ি আয় এখনি।”
কল কেটে গেল। মোহ তড়িঘড়ি করে স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাড়ি ফিরতে হবে। আপনি এখান থেকে সোজা বাড়ি যাবেন।”
মোহ তাড়াহুড়ো করে চলতে আরম্ভ করে। ইতিমধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সূচনা হয়েছে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তাদের দুজনের গালে মুখে। সামনে রাস্তার বড়ো গর্ত খেয়াল করে না মোহ। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে সেখানে পা পড়লে সামলাতে পারে না সে। পাশে থাকা স্বচ্ছের হাত ধরে ফেলে নিরুপায় হয়ে। স্বচ্ছ আরেক হাতে ধরে তাকে সাহায্য করে বলে,
“এখনি পা ভাঙতে যাচ্ছিল। অতঃপর পা ভাঙা মেয়েটাকে কে বিয়ে করত?”
“করতে হবে না কাউকে বিয়ে। আমি একা চলতে পারি।”
“হ্যাঁ সেটা দেখাই গেল একটু আগে।”
মোহ তেতে ওঠে। কিছু বলতে উদ্যত হলে সে অনুভব করে স্বচ্ছের স্পর্শ অস্বাভাবিক গরম। নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত স্বচ্ছের কপালে হাত রাখে সে। চোখ গোল গোল করে বলে,
“আপনার জ্বর?”
স্বচ্ছ নিজের অগোছালো চুল দুহাতে নাড়িয়ে বলে,
“ওই হালকা। চিন্তা করো না। জ্বর হয়েছে। ডেঙ্গু বা মরণব্যাধি নয়। যে ম;রে যাব।”
“উল্টোপাল্টা কথা বাদ দিয়ে দ্রুত বাড়ি যান বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লে জ্বর বাড়বে।”
প্রজেক্ট পার্টি শেষ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ফারাহ। লাগাতার কল করে যাচ্ছে কাউকে। কলে না পেয়ে বিরক্তির সীমানা থাকছে না তার। আবারও কল করে যখন কাউকে পেল না তখন ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল তার। বৃষ্টির বিন্দু যখন তাকে স্পর্শ করল তখন আরো হতাশ হলো সে। রাগে-দুঃখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার এত সুন্দর ডিজাইনার ড্রেসটা যদি আজকে বৃষ্টিতে ভিজে দফারফা হয়ে যায় তাহলে আমি হেস্তনেস্ত করে ফেলব আজ।”
নিজের বলা কথা শেষ হতে না হতে তার ফোনে কল এলো। এতক্ষণ যার নম্বরে কল করে চেষ্টা চালাচ্ছিল তার নম্বর দেখে উচ্ছ্বসিত হলো সে। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে বলল,
“ড্রাইভার আংকেল কোথায় আপনি? কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি আপনার জন্য? আমি অফিস ছেড়ে বেরও হয়ে এসেছি।”
ওপাশ থেকে অপরিচিত মেয়েলি কণ্ঠ পেল ফারাহ।
“হ্যালো, ম্যাম! আসলে এই ফোনটা যার তার এক্সি/ডেন্ট হয়েছে আর তিনি এই মুহূর্তে হসপিটালে আছেন। আপনি যদি উনার পরিচিত কেউ হোন তবে তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসুন।”
ফারাহ খানিকটা থমকাল। সে এই মুহূর্তে যেতে পারবে না। অন্য কাউকে পাঠাতে হবে। কিন্তু সে বাড়ি অবধি যাবে কী করে ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়াল সে। ততক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি চলে এসেছে। ফারাহ অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে রইল অন্যমনস্ক হয়ে। কিছু সময়ের মাঝে বাসের দেখা পাওয়া গেল৷ তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে পড়ল ফারাহ। বাসের ভেতরে গিয়ে শেষদিকের একটি ফাঁকা সিটে বসে হাফ ছাড়ল সে। ততক্ষণে বাসে আরো দুয়েকজন যাত্রী উঠেছে। বাসে বেশিরভাগই পুরুষ মানুষ৷ এরই মাঝে একটি যুবক এসে দাঁড়ায় ফারাহর সামনে। উদ্দেশ্য, ফারাহর পাশে বসা। ফারাহ তা বুঝল। জানালার দিকে চেপে বসল সে। ছেলেটি বসে পড়ল তার পাশে। বাস ছেড়ে দিলো৷ মেইন রাস্তা খুব একটা খারাপ নয়। ফলে ঝাঁকুনিও হচ্ছে কম। তবুও হুটহাট ফারাহর গা ঘেঁষে যাচ্ছে তার পাশে বসা পুরুষটি। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাচ্ছে ফারাহ। অসহ্য লাগছে তার। প্রথমে কিছু না বললেও একটা সময় সে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“এইযে আপনি উঠুন তো। অন্য কোথাও গিয়ে বসুন। আমি দুটো সিট নিয়ে বসব। আমার অসুবিধা হচ্ছে।”
নাছোরবান্দা ছেলেটিও জোর দেখিয়ে বলল,
“বললেই হলো নাকি ম্যাডাম! চেয়ে দেখেন তো আর কোনো সিট ফাঁকা আছে কিনা? এটা পাবলিক বাস। সবার সাথে শেয়ার করে যাইতে হবে।”
ফারাহ দাঁতে দাঁত চেপে আশেপাশে তাকাল। আসলেই অন্য কোনো সিট ফাঁকা নেই। তাই সে ফের কড়া কণ্ঠে ছেলেটিকে বলল,
“তাহলে দূরে সরে বসুন।”
“কী আশ্চর্য! জায়গা না থাকলে কোথায় দূরে সরব? বাস যে তৈরি করছে তারে বলেন সিটগুলো বড়ো তৈরি করতে।”
ফারাহ লোকটির সাথে কথায় পেরে উঠল না। এর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না সে। হুট করে উদয় হলো এক চশমা পরিহিত লম্বাটে লোকের। পরনে তার হালকা রঙের পাঞ্জাবি। ফারাহর পাশে বসা লোকটিকে বলতে শুরু করল,
“এইযে ভাই, আপনি ওঠেন। আমার সিটে গিয়ে বসেন। যান।”
শৌভিকের কথায় ছেলেটি পেছনে তাকাল। বলল,
“ধুর, না। আপনার সিট তো একদম পেছনে। এত পেছনে যেতে পারব না।”
শৌভিক চোয়াল শক্ত করে বলল,
“কিন্তু আমি তো এখানে বসব ভাই। তাই আপনাকে উঠতে হবে।”
ছেলেটি চোখমুখ জড়িয়ে বলে,
“আপনাকে কেন এখানে বসতে দেব?”
“কারণ আপনি যার পাশে বসেছেন সে আমার পরিচিত তাই।”
“বললেই হলো! কে হয় আপনার?”
শৌভিক এবার চটে গেল। কর্কশ গলায় বলল,
“বউ, গার্লফ্রেন্ড, বোন লাগে কিছু একটা। সেই কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব?”
শৌভিকের সাথে তর্কাতর্কিতে না পেরে উঠে গেল ছেলেটি। শৌভিক দাঁড়িয়ে পড়ল ফারাহর নিকটে। কণ্ঠস্বর নরম করে জিজ্ঞেস করল,
“আমি আপনার পাশে বসলেও কী সমস্যা হবে? তাহলে আমি দাঁড়িয়ে থাকছি। আপনি বসুন।”
ফারাহ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, না বসুন এখানে। আবার অন্যকেউ বসে গেলে? আপনি বসুন।”
শৌভিক আস্তে করে সিটে বসে ফারাহর সাথে দূরত্ব বজায় রেখে। বলে,
“আমাকে এত বিশ্বাস করার কারণ? আমিও তো অন্যকারোর মতোই হতে পারি।”
ফারাহ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
“না পারেন না। ফারাহ মানুষ চিনতে পারে।”
শৌভিক আর কোনো জবাব দিলো না। খোলা জানালা দিয়ে তখন বৃষ্টির পানি আসছে। ফারাহ জানালা বন্ধ করতে গেল। তবে পারল না। উল্টে বাসের ঝাঁকুনিতে তাল সামলাতে পারল না সে। শৌভিক কোনোরকমে তার দুটো হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজে জানালা বন্ধ করে দিলো আর বলল,
“বাসে যাওয়া-আসার অভ্যেস নেই?”
“না। ড্রাইভার আংকেল এক্সি/ডেন্ট করেছে আজ। তাই যেতে হচ্ছে।”
টুকটাক কথা বলতে বলতে ফারাহর বাস থেকে নামার সময় হয়ে এলো। তবে সে ভেবে পেল না এই বৃষ্টির মাঝে বাকিটুকু পথ সে কী করে যাবে। বাস থেকে নামতে নামতে খেয়াল করল তার পিছু পিছু শৌভিকও নামছে। তার কাছে ছাতারও রয়েছে একটা। শৌভিক কিছু না বলেই ছাতা ফারাহর মাথার উপরে ধরে বলল,
“প্রথমে ভেবেছিলাম ছাতা আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাব। কিন্তু পরে মনে হলো আপনি নিজেকে সামলাবেন নাকি ছাতা! যেমন পোশাক পড়েছেন সেটা সামলাতে গিয়েই তো ফিসাবিলিল্লাহ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আমি এগিয়ে দেব?”
ফারাহ ইতস্তত বোধ করে শুধাল,
“আপনার দেরি হয়ে যাবে না?”
“হলেও বা কী করার! সুন্দরী নারীকে রাস্তায় একা ছাড়তে নেই। পরে বিপদ হয়ে গেলে আমার আফসোস হবে।”
ফারাহ কিঞ্চিৎ হাসল। তারা ছাতা ধরে পাশাপাশি এগোতে থাকল। শৌভিক হঠাৎ বলল,
“আপনাকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে তো যাচ্ছি। কিন্তু আপনার বাড়ির লোকজন বিশেষ করে আপনার বাবা মন্ত্রী সাহেব আমাকে দেখলে পি/স্তল ধরবে না তো?”
ফারাহ হতবাক হয়ে জানতে চাইল,
“কেন, কেন?”
“এই ভেবে যে ভোটের জন্য আমি উনার মেয়েকে হাত করছি।”
ফারাহ এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
“বাবা জানে তার মেয়েকে হাত করা এত সোজা না। এটা একটা বিরল ঘটনা।”
শৌভিক অনেকটা ভেবে বলল,
“তার মানে এই বিরল ঘটনা যে ঘটাতে পারবে সে নিশ্চয় চমৎকার কোনো উপহায় পাবে!”
“হুঁ পাবে তো। আমাকে…!”
চলবে….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। পরবর্তী পর্বে চমক রয়েছে।]