যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৪)
~মিহি
৪.
‘মেয়ে দেখি মাশআল্লাহ সুন্দর হয়েছে রে সায়েরা।’ বলেই সন্ধির গালদুটো আলতো করে টিপে ধরলেন রামিলা পারভীন। সন্ধি নাক কুঁচকে একবার সামনে বসে থাকা মহিলাটির দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার তাকাচ্ছে তার পাশে বসে থাকা লম্বা গড়নের শ্যামবর্ণের যুবকটির দিকে। যুবকটির দৃষ্টি অনেকক্ষণ থেকে তার উপর স্থির হয়ে আছে বুঝেই যেন সে আরো বিরক্ত হচ্ছে। এই দুজনের একজনকেও সে চেনেনা। তবে মায়ের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এই মহিলা তার কোনোকালের বোন ছিলেন। সন্ধির ভাবনা সত্যি হলো। সায়েরা জামান পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘সন্ধি, এটা তোর বড় খালা। আর ছেলেটা হলো তোর খালাতো ভাই নয়ন। ও এবার মাস্টার্স ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা দিবে।’ সন্ধি এখনো বিরক্ত। জন্মের পর থেকে নানাবাড়ির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে জানতো মা-বাবার পালিয়ে বিয়ে করা মায়ের বাবার বাড়িতে মেনে নেয়নি কেননা বাবা ছিলেন এতিম, সামান্য একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। মা বাবার জন্য নিজের পরিবার ছেড়েছে ভেবেই যেন মায়ের প্রতি সম্মান আকাশ ছুঁয়েছিল সন্ধির।
– ‘কীরে সন্ধি? কথা বলছিস না কেন খালামণির সাথে?’
– ‘একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
– ‘আচ্ছা যা। তাড়াতাড়ি আয়।’
তাড়াতাড়ি আসার কথাটা মা কেবল মুখ দিয়ে নয়, চোখ দিয়েও বুঝিয়ে দিলেন। সন্ধির কিছুতেই ইচ্ছে করছে না আবার লোকটার সামনে যেতে। কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে! তার উপর খালাও কেমন যেন। সন্ধি বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। হুট করে এত মাখো মাখো ব্যবহার নিতে পারছে না সে। খালার কথাবার্তা তার আলগা পিরিত মনে হচ্ছে। এতদিন খোঁজ নেওয়া নেই বোন-বোনজামাইয়ের অথচ আঠারো বছর পর এসে কিনা আলগা পিরিত দেখানো হচ্ছে!
রামিলা মুখের মধ্যে আরেকটা পান গুঁজতে গুঁজতে বলে উঠল, ‘তা সায়েরা, দুলাভাই কি মানবো? একে তো বাচ্চা মেয়ে! তার উপর আমার ছেলে ওর চাইতে মেলা বড়।’ সায়েরা কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে ও না মানার কে? তাছাড়া নয়ন তো ওকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে বিয়ে করেই। অতসব তোর দুলাভাইকে বোঝাতে হবে না তোর। যা করার আমি করবো।’ এসবের মাঝে নয়নের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সে ঠিক করে এসেছিল এ বিয়েতে মত দেবে না কিছুতেই। বাড়িতে এ নিয়ে মায়ের সাথে বেশ অশান্তিও করেছে কিন্তু এখানে আসার পর সব যেন বদলে গেল। সন্ধির মুখটা দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে না পেলে যেন জনম বৃথা তার। মা-খালার কথার দিকে ধ্যান নেই তার। মন অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন। বাধ্য হয়ে লাজ ঝেরে বলেই ফেলল সে, ‘খালা, আমি কি সন্ধির ঘরে গিয়ে বসতে পারি?’ সায়েরা জামান কিছুক্ষণ ভেবে হাসিমুখে সম্মতি দিলেন। নয়ন যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেল। আকুলতাকে মনে চেপেই ধীর পায়ে সন্ধির ঘরের দিকে এগোলো। সন্ধি এখনো বাথরুমে, ঝর্ণার মৃদু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নয়ন সন্ধির টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো দেখছে।
গোসল সেরে ভেজা চুলে মাত্র বের হতেই বিছানায় বসে থাকা লোকটাকে দেখে চমকাল সন্ধি। মেঝে পানি পড়ে পিছলে হয়েছিল, সেখানে পড়তেই পা ফসকে পড়তে ধরল সে। পড়ার আগেই হাতজোড়া আবদ্ধ করলো নয়ন। বড্ড বিরক্ত হলো সন্ধি। ওড়না ঠিক করে ভেজা চুলে তোয়ালে জড়ালো।
– ‘নয়ন ভাইয়া, আপনি আমার ঘরে কী করছেন?’
– ‘তুমি অনেকক্ষণ বেরোচ্ছিলে না, তাই তোমার ঘরে এলাম। ভাবলাম এই বাহানায় ঘরটাও দেখে ফেলি।’
– ‘আমার ঘর কি জাদুঘর?’
– ‘স্যরি?’
– ‘দেখার কথা বললেন যে। আমার ঘর তো জাদুঘর না যে দেখতে আসবেন। তাছাড়া দেখার মতো এ বাড়িতে বাগান আছে, ছাদ আছে, সেসব ট্রাই করতে পারেন।’
– ‘আমি তো চিনিনা কিছু। তুমি না হয় ঘুরিয়ে দেখাও।’
– ‘আসুন।’
না চাইতেও নয়নকে সাথে নিতে হলো সন্ধির। মুখের উপর নাও বলতে পারছে না। যতই হোক লোকটা তার খালাতো ভাই, এত বছর পর এসেছে নিজের খালার বাড়িতে। তার মুখের উপর না বলে তাকে অপমান করা মানে বাবা-মায়ের ঝগড়া করার একটা বাড়তি টপিক তুলে দেওয়া। ছাদের একপাশে কাপড় মেলছে সন্ধি। বাড়ির ছাদের সাথে লাগোয়া বাগান আছে সামনে। বাগানের নারকেল গাছটা এখন ছাদের একপাশে ছাতার মতো ঘিরে রাখে। মৌমাছির জ্বালায় ওদিকে যাওয়া যায় না সবসময়। সন্ধি অবশ্য মাঝে মাঝে নারকেলের পাতার নিচে চুপটি করে বসে থাকে। তার কাছে যেন এটা চিরশান্তির স্থান।
– ‘এবার যেন কোন ক্লাসে তুমি?’
– ‘টেন। নিউ টেন।’
– ‘সায়েন্স?’
– ‘আর্টসে পড়ছি।’
– ‘ওহ। এইম কী?’
– ‘ধরাবাঁধা কোনো লক্ষ্য নেই, পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করতে চাই, পাশাপাশি একটা এনজিও চালানোর শখ রাখি।’
– ‘এদেশেই সেটেল হতে চাও?’
– ‘অবশ্যই। ভিনদেশে গিয়ে কি স্বর্গসুখ আছে যে ওখানে সেটেল হবো?’
– ‘উমম…ধরো বিয়েশাদি করে বর বিদেশে সেটেলড হলো।’
– ‘বর থাকুক বিদেশে, ওখানে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে সংসার করুক।’
কথাটা শুনে হালকা হেসে নারকেল গাছের পাতার আড়ালে যাচ্ছিল নয়ন। প্রথমে বুঝতে পারেনি সন্ধি। ভেবেছে রোদের কারণে হয়তো একটু সরে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু যেই নারকেলের পাতা ধরে টানতে নিয়েছে সন্ধি একছুটে গিয়ে নয়নের হাতখানা ধরে টেনে আনলো যদিও বিপদ পুরোপুরি মোকাবিলা করা গেল না। একটা মৌমাছি ঠিকই নয়নের হাতের পিঠে হুল ফুটিয়েছে। ‘দাঁড়ান এখানে, আমি পেঁয়াজ আনছি। পেঁয়াজ ঘষলে ব্যথা কমবে।’ বলেই দৌড় লাগাল সন্ধি। নয়ন তার পানে চেয়ে নিজের ব্যথা ভুলেই গেল।
সন্ধি নয়নের হাতে কাঁটা পেঁয়াজ ঘষছে। নয়ন সন্ধির দিকে তাকাতেই ব্যস্ত, হাতের প্রতি তার ধ্যান নেই। সন্ধি অনেকটা সময় পর উপলব্ধি করল নয়ন তাকে দেখছে। সাথে সাথে তার হাত পা যেন অসাড় হয়ে আসতে চাইল। একছুটে পালাতে চাইল সন্ধি। সিঁড়িঘরের দিকে পা ফেলতেই পেছন থেকে টান অনুভব করলো। নয়নের শক্ত হাতের স্পর্শে তার ভেতরটা গুলিয়ে আসলো। স্বপ্নভীতিটা জন্মালো মনে। তবুও হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই বেসামাল হয়ে সিঁড়ি থেকে পড়লো সন্ধি।
________________________________________________
মাহিদের ফোনে গতরাত থেকে অজ্ঞাত বার্তা এসেই চলেছে। একেকবার একেক নম্বর থেকে। এই টেক্সটগুলো কে পাঠাচ্ছে এখনো ধরতে পারেনি সে। তার এ নম্বরটা বন্ধু আর পরিবারের বাইরে কারো কাছেই থাকার কথা নয় তবে স্কুলের রেকর্ডে আছে কিন্তু স্কুল রেকর্ড থেকে নম্বর চুরি করা তো এত সোজা না। তবে পিয়ন লোকটার পর সন্দেহ হয়। লোকটার মতিগতি সুবিধার না, পাঁচ টাকার সিঙারা পেলেই নম্বর প্রচার করে দেওয়ার লোক সে। এখন মাহিদের প্রথম কাজ পিয়নকেই ধরা, ধরে জিজ্ঞাসা করা নম্বরটা সে কাকে দিয়েছে।
পিয়ন আমানত আলী আরামসে মুখে পান পুরেই চলেছে। একটু আগেই সে দুটো পরোটা খেয়েছে মাহিদের টাকায়। এখন মাহিদ অপেক্ষায় আছে পিয়নের মুখ খোলার।
– ‘আমানত ভাই, তুমি তো এখনো কিছু বলছো না। এবার কিন্তু আমি চাচার কাছে যাবো। তিনি জানলে তোমার চাকরি নট।’
– ‘গরিবের ভাত মাইরা কী হবি স্যার? আমি কইছি যখন কমু, তখন কমু। পানডা শেষ কইরা লই।’
এই কথা সে ইতোঃমধ্যে দশবার বলেছে। একটা শেষ করে আরেকটা খাওয়া শুরু করছে, খাওয়া আর শেষ হচ্ছে না। পানের বেলাতেও এমন চিন্তাভাবনাই করে রেখেছে কিনা কে জানে!
– ‘আমানত ভাই, পান শেষ। এখন ফলো আমার নম্বর তুমি কাকে দিয়েছো?’
– ‘আপনার ক্লাসেরই এক মাইয়া। কইলো আপনার থেকে কি নাকি পড়া বুঝে নিবি। আমি না করছিলাম, সে শুনে নাই।’
– ‘নাম জানো মেয়ের?’
– ‘জানি তয় মনে আসতেছে না। খাড়ান একটু।’
– ‘ভালো করে মনে করে বলো।’
– ‘সব্জি…সজনী…নাহ নাহ স’ তার পরে জানি কী!’
– ‘সন্ধি?’
– ‘হ হ এডাই আছিল নাম।’
মাহিদ এতক্ষণ টেক্সটগুলো অবজ্ঞা করে এসেছে কিন্তু এখন টেক্সটগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলো।
চলবে…