রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব -০১


-শাড়িটা ঠিক করে বসুন।

লোকটির এহেন বক্তব্য কানে আশা মাত্রই সূক্ষ্ম নয়নে তাকিয়ে রইল চৈতালি। লোকটি অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে আবারও গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল, আপনি শাড়িটা ঠিক করে বসুন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

চৈতালি শাড়ির দিকে তাকাতেই হতবুদ্ধি হয়ে আঁচলটা ঠিক করে মিইয়ে পড়ল। শাড়িতে সে অভ্যস্ত নয় কিন্তু ভাবি জোর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে তাকে। হঠাৎ কখন শাড়ির আঁচলটা খানিক সরে গিয়েছে সে টের পায়নি। লজ্জায় এখন মাথা তুলতে পারছে না। সামনে থাকা লোকটি তখন একটু কেশে বলল, আপনি অস্বস্তিবোধ করছেন মনে হয়। আমি কী এখন চলে যাব?

চৈতালি ডানদিক বাঁদিক মাথা ঝাঁকাল যার অর্থ ‘ না ‘।

লোকটি নিরর্থক প্রশ্ন করল, বিয়েতে আপনার কোনো সমস্যা আছে? আমি কিন্তু বিয়ের আগে একটা আগরীম্যানট্ করতে চাই।

চৈতালি মুখ তুলে তাকাল। বিয়েতে ‘চুক্তি’ শব্দটি শুনে ভীষণভাবে চমকে উঠেছে সে। আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশ্ন করল, কীসের চুক্তি?
-” আপনি কখনই মা হতে পারবেন না। আমি চাই না বিয়ের পর আমাদের সন্তান হোক।

চৈতালি লোকটার কথায় উঠে দাঁড়াল। আতঙ্ক স্তম্ভিত মুখশ্রী নিয়ে লোকটার উদ্দেশ্য বলল, আপনি আমার সাথে মশকরা করতে এসেছেন? পছন্দ না হলে সোজাসাপ্টা বলবেন মেয়ে পছন্দ হয়নি। আমি মেনে নিবো তবুও ইয়ার্কি করতে আসবেন না।

-” আপনার সাথে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক বুঝি? আমি আপনাকে সত্যতা বললাম। যদি মানেন তবে বিয়েটা হবে নয়তো নয়। আমি বাধ্য করেনি আমাকে বিয়ে করার জন্য।

চৈতালি বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আমি আপনাকে বিয়ে করব না। আপনি যেতে পারেন।

লোকটি উঠে দাঁড়াল। মুখে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ধন্যবাদ মিস চৈতালি আপনি আজ আমার বড্ড উপকার করলেন। আপনার উপকার আমি কখনোই ভুলব না।

লোকটি স্থান ত্যাগ করল। চৈতালি এখনও হতভম্বের মত বসে রইল রেস্টুরেন্টের এক কোণে। এরই মাঝে ওয়েটারের কথায় বিস্ময় কাটিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?
-” ম্যাম বিল!

এবার সপ্তম আকাশে পাড়ি দেবার উপক্রম চৈতালির। ধুঁক ধুঁক করে উঠল হৃদয়ের ছোট্ট কুড়েঘর। মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, কিন্তু আমি তো টাকা আনিনি।
-” ম্যাম বিল তো আপনাকে দিতেই হবে। আপনার আত্মীয়দের ফোন দিয়ে বলুন টাকা পাঠানোর জন্য।
-” আমায় কিছুক্ষণ সময় দিন আমি টাকা আনানোর ব্যাবস্থা করছি।
-” ওকে ম্যাম।

চৈতালি তার ভাবিকে ফোন দিল এবং বলল সব কথা। টাকা পরিশোধ করার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে গমগম গলায় বিড়বিড় করে বলল, এক নম্বরের বদ লোক। রেস্টুরেন্টে মেয়ে দেখতে আসছে ভালো কথা কিন্তু ইয়ার্কি মশকারি কেন করবে? নিশ্চয় লোকটার মেইন পয়েন্টে সমস্যা তা-নাহলে কী বাচ্চা না নেওয়ার কথা বলত? আরেকবার যদি দেখা হয় রেস্টুরেন্টের বিল নিয়েই ছাড়ব। আমায় তো চিনে না। দেখতে ভদ্র কিন্তু ভদ্রের আড়ালে আমি যে কী দ্বিতীয়বার দেখা হলে বুঝাব। আমার সাথে ইয়ার্কি? এই চৈতালির সাথে ইয়ার্কি ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা না থাকলে বুঝিয়ে দিতাম ইয়ার্কি করার কি ফল।

***

ঘড়ির কাঁটায় এখন পাঁচটা দশ মিনিট। সোফার এক কোণে বসে মুড়ি খাচ্ছে চৈতালি। ‘ তুমি চোখের আড়াল হও দূরে কিংবা কাছে রও’ গানের তালে ঠোঁট মিলাচ্ছে সে। এরই মাঝে রাগী কণ্ঠ কুর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই সেদিকে তাকাল দেখল তারই বড় ভাই অগ্নিহায়ন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। গান বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে বলল, কিছু বললে?
-” ছেলেটি কে? আমাকে আগে বললেই পারতি তুই রিলেশনে আছিস তাহলে আমি আমার বন্ধুর ভাইকে পাঠাতাম না। আমার সম্মান কুয়াতে তোর খারাপ লাগল না চৈতি?
-” প্রেম তাও আবার আমি? জোক্স বল না তো ভাইয়া। তাছাড়া তুমি যে ছেলের সাথে দেখা করতে বলেছ সেই ছেলেটা এক নাম্বারের অসভ্য । জানো আমায় কী বলেছে? বলেছে বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা নেওয়া যাবে না। একবার ভাবোতো যে ছেলে বিয়ের আগেই বাচ্চা নিতে চায় না সেই ছেলে কেমন হবে? আমার তো মনে হয় ছেলেটার শারীরিক সমস্যা আছে। তুমি জেনেশুনে এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছো ভাইয়া? আমি বুঝি তোমার অন্ন ধ্বংস করছি। আজ মা বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে কখনোই অসভ্য ছেলেটার সাথে বিয়ে দিত না।

গলা ধরে আসল চৈতালির। চয়নের মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হলো। রাগান্বিত মুখ হলো সহজ। বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে শুধাল, কে বলেছে আমার চৈতি আমার অন্ন ধ্বংস করছে? আমার চৈতি আমার ভীষন পছন্দের। তাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলে আমার যে ভীষন কষ্ট হয় কিন্তু কী করব বল তুই তো বড় হয়েছিস বিয়ে তো দিতেই হবে। তুই আমায় কেন বললি না তুই কাউকে পছন্দ করিস তাহলে আমি রেগে যেতাম না। তোর যাকে পছন্দ তারই সাথে আমি তোর বিয়ে দিবো। জানিস তোর বয়ফ্রেন্ড আলিফকে কত মেরেছে? হসপিটালে ভর্তি ছেলেটা সেজন্যই তো রেগে আছি।

ভাইয়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল চৈতালি, কী বলছো এসব ভাইয়া? আমার বয়ফ্রেন্ড নেই। আর ওই ছেলেটাকে মেরেছে মানে? ছেলেটা তো নিজেই চাইছে বিয়েটা ভেস্তে যাক সেজন্যই তো আমার সাথে ইয়ার্কি করেছে।

চৈতালির কথায় ভড়কে গিয়ে ফোন বের করল চয়ন। একটা ছবি বের করে প্রশ্ন করল, দেখতো ছেলেটাকে চিনিস কিনা?

চৈতালি ছবিখানা দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে বুঝাল সে চিনে না। চয়ন কৌতূহল মুখে বলল, কিন্তু এই ছেলেই তোকে আজ দেখতে যাবার কথা। যদি আলিফ তোকে দেখতে না যেয়ে থাকে তাহলে রেস্টুরেন্টে যে ছেলেটি গিয়েছে সে কে?

সত্যিই তো তাহলে রেস্টুরেন্টের ছেলেটি কে ছিল। আর কেনই বা লোকটি যাবার সময় রহস্যময় হাসি দিয়ে গেল। আলিফকে মারার কারণ লোকটির নয় নয়তো? ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করছে চৈতালি কিন্তু কিছুতেই অংক মিলাতে পারছে না। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, আগেই বলেছি চৈতি ভালো করে অংকটা শিখ দেখ এখন জীবনের অংক মিলাতে পারছিস না।

***

পরেরদিন সকাল বেলা চয়ন এবং চৈতালি পৌঁছাল হসপিটালে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন ছেলে শুয়ে আছে। চয়ন মুখের ভঙ্গি সহজ করে ভিতরে প্রবেশ করতেই খেঁক করে উঠল ফাহাদ রোমন্থন কণ্ঠে বলল, আবার কেন এসেছিস? আমার ভাইকে মে’রে শান্তি পায় নাই তোর বোন?

প্রত্তুরে চয়ন বলল, দেখ ফাহাদ এখানে অনেক বড় একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন। শুধু তোর ভাই নয় আমার বোনও ভুক্তভোগী।

চয়ন যাবতীয় ঘটনা বিশ্লেষণ করল। সবকিছু শুনে ফাহাদ তার ভাইয়ের দিকে তাকাল। আলিফ তখন ভীতু সুরে বলল, চৈতালিকে আমি বিয়ে করতে পারব না ভাইয়া। দেখতে যাব এ কথা শুনেই আমার হাত পায়ের অবস্থা নাজেহাল এখন যদি বিয়ে করি তাহলে তো আমার জীবন শেষ করে দিবে। ভেজাল মুক্ত থাকতে পছন্দ করি। আপনারা বরং ওই ছেলেকে খোঁজে চৈতালির বিয়ে দিন।

এক আকাশ হতাশ হয়ে ফিরল চয়ন। চৈতালি তখন ডুবে আছে সেই আগুন্তকের মধ্য। গতকাল অব্দি সে যাকে চিনে না তার নাম পর্যন্ত জানে না কিন্তু সেই ছেলেটি তাকে পাওয়ার জন্য অন্য এক ছেলেকে মেরেছে? ভাবতেই হৃদয়ের গভীর থেকে দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসলো। বোনের মুখে হতাশার চাপ দেখে চয়ন জিজ্ঞাসা করল, চৈতি কী ভাবছিস তুই? ভয় পাবি না তোর ভাইয়া আছে না? আমি তোর ক্ষতি হতে দিবো না। তাছাড়া দুনিয়াতে কী ছেলের অভাব? আমার বোনের জন্য শতশত ছেলে বাসার সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই নরমাল মুডে থাক। পেঁচা মুখ করে থাকলে মাইর দিবো।

হাসলো চৈতালি। ভাইয়ের কথায় সকল চিন্তা মাথা থেকে সরে গেল। মৃদু হেসে বলল, ফুচকা খাবে ভাইয়া?
-” আমার বোন বলেছে ফুচকা খাবে তারমানে আমিও খাব। চল সামনের মোড়ে।

ভাইয়ের হাত ধরে এগুতে লাগল চৈতালি। পৃথিবীতে বাবার পর আরেকটি বিশ্বাসের হাত তা হলো ভাই। কথায় আছে শুধু মাত্র একজন বড় ভাই-ই বাবার অভাব পুরন করতে পারে ।

“ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার মতো আর কোনও ভালবাসা নেই। ভাইয়ের ভালবাসার মতো আর কোনও ভালবাসা নেই। “

***

ড্রইং রুমে কোলাহল। চৈতালির আজ কোলাহল একদম পছন্দ হচ্ছে না। আননোন নাম্বার থেকে বিপদসংকুল একটা বার্তা এসেছে। চৈতালির মন ভয়ে কাবু। পুরো শরীর ভয়ে কাঁপছে। এমন পরিস্থিতি সে আগে কখনো পড়েনি। কুণ্ঠিত হৃদয় জানান দিচ্ছে সে কী কোনো ভুল করেছে? চঁচল হৃদয় উত্তর দিচ্ছে, না চৈতি তুই কোনো ভুল করিস নি।

বাহিরে বাতাস বইছে। জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে বইছে মৃদুমন্দবাতাস। গায়ের ওড়নাটা অবাধ্য হয়ে দুলছে। সেদিকে চৈতালির মন নেই। তার উদ্বিগ্ন চোখ ফোনের স্ক্রিনে তাকানো।

” বিয়ে করার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। দ্বিতীয়বার ভুল সংশোধন করার সময় পাবেন না।”

নিমজ্জিত চোখজোড়া বার কয়েক দেখল বার্তা। তখনি তিন বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে ওড়না টেনে আদু আদু ভাষায় বলল, তুপ্পি তোমাতে ডাততে মাম্মা। তালাতালি আতো।
-” কারা এসেছে চাঁদ মামুনি?
-” নান্না,নান্নু।

গায়ের ওরনা মাথায় দিয়ে ড্রইং রুমে গেল চৈতালি। কুটুমদের সাথে ভাব বিনিময় করে নিজ রুমে যাবে এমন সময় চাঁদ চৈতির হাত ধরে বলল, তলো তলো আমাল টাতে তলো।

অন্য একটি রুমে চাঁদ চৈতিকে নিয়ে যায়। রুমের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখল হোয়াইট শার্ট গায়ে জড়ানো, বেশ লম্বা, দুহাত সামনে রেখে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকাল চৈতি। চাঁদ তখন উজ্জ্বল হেসে বলল, মামা তুপ্পি এতেতে।

লোকটি সামনে ঘুরে দাঁড়াল। প্রসারিত ঠোঁট জোড়া চেপে তির্যক চোখজোড়া শান্ত রেখে দুহাত পকেটে রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, কেমন আছেন মিস চৈতালি?

চৈতির পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল। সামনে যা দেখছে তা কল্পনা নাকি বাস্তব বুঝার চেষ্টা করছে। আশেপাশের সবকিছু অদ্ভুদভাবে ঘুরছে। লোকটি তখন আবার বিস্তার হেসে বলল, আমায় চিনতে অসুবিধে হয়নি তো আপনার? চৈতি রাণী!

কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে উত্তর দিল চৈতি, আপনি?

##চলবে,
#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
®ফারজানা মুমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here