রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব -১৮

#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
#পর্ব_১৮
#ফারজানা_মুমু

অক্ষরের উৎফুল্লতা মুখশ্রী দেখে চয়নের ঠোঁটে হাসি ফুটল। উৎসুখ হয়ে বলল, কী প্ল্যান স্যার? তাড়াতাড়ি বলুন প্লিজ।

ঠোঁট চেপে ধরে ভ্রু নাচালো অক্ষর। মাথা ঝাকিয়ে শার্টের হাতা ঠিক করল। চয়ন বিরক্তি কণ্ঠে বলল, স্যার ভাব-সাব এখন নিতে হবে না। রাত শেষ হয়ে যাবে আপনার। আমার ধৈর্য শক্তি খুবই কম। প্ল্যান বলুন তাড়াতাড়ি।
-” চয়ন, ভুলে গেছ সবুরে মেওয়া ফলে? ধৈর্য ধরো বলছি তো!

চয়ন ভদ্র ছেলের মত বসে রইল। অক্ষর প্ল্যান বলল। প্ল্যান শোনার পর চয়নের দু’চোখ খুশিতে গদগদ করে উঠল। অজান্তেই অক্ষরকে জড়িয়ে ধরে বলল, ধন্যবাদ স্যারররর।
-” এহেম-এহেম মিস্টার চয়ন। আমি ঝুমুর নই।
-” সরি স্যার।

মাথা নিচু করে ফেলল চয়ন। অক্ষর তখন চয়নের পেটে গুতো দিয়ে বলল, আরেহ আমরা আমরাই তো। আমিও যেমন তোমার বড় শ্যালক। তুমিও আমার বড় শ্যালক। শ্যালকের সাথে দুষ্টুমি করাই যায়।

জোরে হাসলো চয়ন। অক্ষরও তাল মিলালো চয়নের সাথে।

দুজন রাস্তা ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্য যাত্রা দিল। কলিং বেল বাজার সাথে-সাথে ঝুমুর দরজা খুলল। দরজার ওপাশে চয়ন-অক্ষরকে দেখে আবারও নিজের রুমে হাঁটা দিল। ঝুমুর চলে যাবার পর অক্ষরের কানে ফিসফিস করে বলল, স্যার, ঝুমুর এখনও রেগে আছে। আমি পারবো রাগ দমাতে?

অক্ষর হাত রাখল চয়নের কাঁধে। ভরাসময় কণ্ঠে বলল, আলভাদ পারবে। দরকার পড়লে পা ধরে বসে থাকবে। আ’সা’মি’দে’র কাছে পুলিশ হলো বাঘ কিন্তু বউয়ের কাছে আমরা হলাম বিড়াল। সুখে-শান্তিতে থাকতে হলে বউয়ের কথায় চলতে হবে। বউকে ভালোবেসে বুঝাতে হবে। বুঝেছ?

হতাশ গলায় বলল চয়ন, পা ধরতে হবে তাহলে?

বিরক্তি নিয়ে বলল অক্ষর, পা ধরতে বলেছি বলে পা ধরবে? বুঝাবে। জানো মেয়েদের মন হচ্ছে পানির মত। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। মোম দেখনা আগুনের ছোঁয়া পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গলতে শুরু করে তেমন মেয়েদের মন। ভালোবেসে বুঝালে ঠিকই বুঝবে। তাছাড়া আমার বোন সহজ-সরল বুঝাতে সময় লাগবে না। আমি তো চিন্তায় আছি তোমার বোনকে নিয়ে। তোমার বোন কোথায়? সে তো তোমার মত ঘাড়ের র’গ ত্যারা। মনেমনে বেশি বুঝে।

চয়ন ফিক করে হেসে উঠল। তারপর বলল, আপনাদের জুটিটা দারুণ স্যার। দুজনেই ঘাড়ত্যারা, শান্ত,গম্ভীর। আল্লাহ মিলিয়েই তৈরি করেছে আপনাদের জুটি।

নিরাশ হলো অক্ষর। প্রশ্ন করল, কোথায় পাবো তাকে?
-” এখন ছাদে গিয়ে দেখতে পারেন। মন খারাপ হলে মানুষ প্রকৃতির মাঝে থাকতে পছন্দ করে।
-” ওকে। যাও রুমে যাও। বেস্ট-অফ-লাক।
-” আপনাকেও!

চয়ন রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়াল। অক্ষর ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়াল। আজকের দিনটা অদ্ভুদ, ভীষন অদ্ভুদ।

চয়ন রুমে প্রবেশ করতেই দেখল ঝুমুর আধশোয়া হয়ে কপালে এক হাত রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে। ধীরে-ধীরে চয়ন বসল খাটের মাঝ বরাবর। মৃদু কন্ঠে ডাক দিল, ঝুমুর।

সারাশব্দ নেই ঝুমুরের। মুখ ফুলিয়ে সাহস জুগিয়ে আবারও বলল, আই অ্যাম সরি ঝুমু। আমার জান পাখিটা খুব রেগে আছে।

নিশ্চুপ নির্লিপ্ত ঝুমুর। বুকে ফুঁ দিয়ে ঝুমুরের হাতে স্পর্শ করতেই ঝাড়া দিয়ে হাত সরালো ঝুমুর। খেক-খেক করে বলে উঠল, আমাকে স্পর্শ করবে না।
-” আমায় ক্ষমা করে দাও না প্লিজ। আমি তো স্বীকার করেছি আমার ভুল।
-” তুমি ভুল বলছো কীভাবে? অন্যায় করেছো তুমি? আমায় নিয়ে খেলেছ।
-” আমার ভালোবাসা মিথ্যা নয় ঝুমুর।
-” বিশ্বাস করি না।
-” প্লিজ। আচ্ছা কী করলে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে? পা ধরব তোমার?

চয়নের বেখাপ্পা কথা শুনে পা গুটিয়ে নিল ঝুমুর। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বুদ্ধি-শুদ্ধি হাঁটুতে চলে গেছে আজকাল?
-” না। বউয়ের রাগ কমানোর জন্য বুকের ভিতর আগুন জ্বলছে। মাথার ভিতরে নাট-বল্টু ঢিলে হয়ে গেছে।

ঝুমুর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো। কার সাথে রাগ করবে সে? লোকটার এহেন কথা শুনে আদৌ রাগ আছে? তবুও মুখে রাগের চট রেখে বলল, আমার জন্য এক্ষুনি অমলেট বানিয়ে আনো। রাগের সময় অমলেট খেতে হয়। তাহলে রাগ কমবে আমার।
-” এত রাতে?
-” আমি জানতাম তুমি আমায় ভালোবাসো না। রাত একটাকে তুমি গভীর রাত বানিয়ে ফেলেছো। যাও তো দূর হ‌ও।
-” এই না না আমি আনছি অমলেট বানিয়ে।

চয়ন রুম থেকে বের হতেই শব্দ করে হাসলো ঝুমুর। সে বেশিক্ষন রাগ করে থাকতে পারে না। চয়নের উপর তো আরো না। সে জানে চয়নের ভালোবাসায় মিথ্যে নেই। বিয়ের পাঁচ বছরে চয়নের ভালোবাসায় নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। অনেকক্ষণ পর চয়ন আসলো অমলেট নিয়ে। ভ্রু কুঁচকে বলল ঝুমুর, নাও খেয়ে নাও। তুমি তো ক্ষুদা সহ্য করতে পারো না।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, আমার জন্য?
-” হ্যাঁ তোমার জন্য।
-” তুমিও তো কিছু খাওনি।

জবাব দিল না ঝুমুর। চয়ন মুচকি হেসে অমলেট দুটো ভাগ করল। আদরে গলায় বলল, অর্ধেকটা তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে। বাকিটা আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো।

লজ্জায় লাল হলো ঝুমুর। বিয়ের পাচঁ বছরেও লজ্জারা তাকে বিদায় জানাতে পারেনি। কিন্তু চয়ন এক কথার মানুষ। ঝুমুরের হাতে না খেলে সে খাবে না। লজ্জাকে দূরে সরিয়ে প্রথম চয়নের মুখে ধরল অমলেট। চয়ন মাথা নাচিয়ে নাকচ করে প্রথমে সে খাইয়ে দিল ঝুমুরকে। ঝুমুর আবারও চয়নের সামনে অমলেট তুলল। অমলেট মুখে তোলার সময় ছোট্ট করে কামড় বসালো ঝুমুরের হাতে। শব্দ করে উঠল ঝুমুর। রাগের ভাব নিয়ে বলল, আবারও দুষ্টুমি?
-” দুষ্টুমির কী দেখলে জান? এখনও দুষ্টুমি শুরু করিনি।

তাদের কথার মাঝেই ঘুম থেকে উঠে বসল চাঁদ। ঘুমঘুম গলায় বলল, পাপ্পা তুমি বলো বয়সে দুত্তুমি কলবে? মাম্মা মাইল দিবে। আমি দুত্তুমি কললে আমায় দেবাবে মালে ওই ভাবে।

মেয়েকে কোলে নিয়ে মুখে অজস্র চুমু দিল চয়ন। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল, তাই? আচ্ছা আমরা আর দুষ্টুমি করব না।
-” প্লমিজ!
-” হুম প্রমিজ।

চাঁদকে ডান হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ঝুমুরের মাথা বুকে ঠেকিয়ে চোখ বুজে অনুভব করল পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ সে।

নিরিবিলি পরিবেশ। কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে এক পাশ থেকে। গোঙানো শব্দের ধ্বনি বাজলো অক্ষরের কূর্ণকুহুরে। ধুক-পুক হৃদয়ের বাদ্যযন্ত্র বেড়ে চলেছে আপন গতিতে। উড়ন্ত পাখির ন্যায় উড়ে চলেছে কৃষ্ণ কালো লম্বা কেশ। কিছু না ভেবেই সেই উড়ন্ত কেশে হাত রাখল অক্ষর। সমুধুর কণ্ঠে বলল, আমার ভুল কোথায় চৈতি?

ওড়না দিয়ে চোখ মুছে, না তাকিয়েই উত্তর দিল চৈতি, আপনি খু’ন করেছেন।

গরম নিঃশ্বাস ছাড়লো অক্ষর। চৈতি কেঁপে উঠল নিঃশ্বাসের সঙ্গে। কিছুটা দূরে সরতে চাইতেই ধরে ফেলল অক্ষর। পিছু ঘুরিয়ে চিবুক ছোঁয়ালো চৈতির ললাটে। শান্ত কণ্ঠে বলল, খু’নের কারণ জানার পরেও আমাকে দোষারোপ করে যাবেন? আমি তো আপনাদের রক্ষা করার জন্য অ’মানুষ হ’ত্যা করেছি। ভালো মানুষ তো নয়। আমার জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন? যদি জানতেন আপনার প্রা’ণ ভো’ম’রা’র দিকে কেউ হাত বাড়িয়েছে তখন কী তাকে ছেড়ে দিতে পারতেন?

চৈতি জবাব না দিয়ে কেঁদে চলল। অক্ষর চৈতির মাথা বুকে জড়িয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছেন কিছু?
-” ধুঁকধুঁক শব্দ।
-” আপনাকে হারানোর কষ্ট। আমার তো অন্যায় নেই চৈতি। আপনি কেন আমায় ভুল বুঝছেন।
-” আমি জানি না অক্ষর। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে।
-” কীসের ভয়?
-” আপনাকে হারানোর ভয়।

চৈতির কথায় হেসে দিল অক্ষর। চে’পে ধরল মাথা নিজের বুকে। বলল, আমাকে কাছে আসতে দিচ্ছেন বা কখন ম্যাম? হারানোর ভয় তো আমার পাবার কথা। আপনি তো আমায় দু’চোখে দেখতে পারেন না।

চোখ বন্ধ করে অক্ষরের শরীরের তীব্র পারফিউমের সুবাস অনুভব করতে লাগল চৈতি। পারফিউম নাকি অক্ষরের গায়ের সুবাস? বুঝতে উঠতে না পেরে প্রশ্ন করল, আপনার বুক থেকে সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে।
-” আপনাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত হলো হৃদ-পাঁজর তাই সুন্দর রমণীকে সুন্দর সুবাস পাঠাচ্ছে যেন রমণী বারবার এই বুকে মাথা রাখে।
-” আপনি ভীষন ঠোঁট’কা’টা লোক।
-” তাই বুঝি?

চৈতি কথা না বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, কে বলল আমি আপনাকে দু’চোখে দেখতে পারি না? সারাদিন যে চোখ আপনাকে খোঁজে আপনি জানেন?
-” আগে জানতাম না এখন জেনে নিলাম। ধন্যবাদ ম্যাম। আচ্ছা ম্যাম আমার একটা কথা রাখবেন?
-” বলুন?
-” আর কত আপনি-আপনিতে থাকবো। তুমিতে আসা যায় না?
-” উহুম। আপনি আমায় তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে এখন তুমি ডাকবো না।
-” কেন?
-” সময় হলে তুমি ডাকবো। বুঝেছেন সাহেব?

অক্ষর চৈতির একদম সামনে এসে দাঁড়াল। দুজনের মাঝে এক ইঞ্চি ব্যাবধান। আচমকা অক্ষরের হাত চৈতির কোমরে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠল চৈতি। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল, কী করছেন?

অক্ষর থামিয়ে দিল। আফিম মেশানো কণ্ঠে বলল, আজ বারণ শুনছি না ম্যাম।

চৈতির ঠোঁটজোড়া কেঁপে চলেছে ঠিক এই মুহূর্তে ফোন আসলো অক্ষরের। বিরক্তিতে ‘চ’ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে চৈতিকে ছেড়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। বিজয়ের নাম ঝলমল করছে। কপাল ভাঁজ করে বলল, এদের না আজকে বাসর রাত। ফোন দিচ্ছে কেন?
ফোন রিসিভ করল অক্ষর। অশ্লীল কতগুলো বাক্য ব্যবহার করে বলল, ফোন দেওয়ার সময় পাইলি না। শা’লা।

জয়-বিজয় কাচুমাচু মুখ নিয়ে সব শুনলো। বিরহী কণ্ঠে জয় বলল, দোস্ত অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। শান্তার বদলে কান্তাকে প্রপোজ করেছি। এখন ওরা দুবোন আ’ন্দো’ল’নে নেমেছে। যতদিন না পর্যন্ত ওদের ভালো করে চিনতে না পারি ততদিন বাসর রাত বন্ধ।

শব্দ করে হেসে দিল চৈতি। অক্ষর ছোট-ছোট চোখ নিয়ে বলল, তোরা আসলেই বলদ। চশমা ছাড়াটা হলো জাঁ’দ’রে’ল শান্তা। চশমা পড়ারটা গুড গার্ল কান্তা।

জয় ফোঁস করে উঠল বলল, শা’লা আমার বউকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না।
-” এখনও নিজের বউকে চিনতে পারিস না আবার বলছিস বাজে কথা বলব না। যা বউ নিয়ে ঘরে যা। অযথা আমায় বিরক্ত করবি না।

বিজয় তখন এক দমে বলে উঠল, আজ কান্তা চশমা পড়েনি। কালো লেন্স পড়েছে। সেজন্য আমরা ওদের চিনতে পারছি না প্লিজ দোস্ত হেল্প কর।

দাঁতে দাঁত চেপে বলল অক্ষর, আমায় তোদের দু’শ্চ’রি’ত্র মনে হয়? তোদের ধারণা আমি নিজের বউ রেখে অন্যর বউকে বেশি দেখি?

দুজন একত্রে বলল, না।
-” এখন ফোন রাখ। তোদের কর্মের ফল এটা। বিয়ের পর আমার মত সন্ন্যাসী থাক দু’আ রইল।

চট করে ফোন কাটল অক্ষর। চৈতির হাসি থামছেই না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অক্ষর। মক্তঝড়া হাসিতে সে কাবু।
-” তোমায় চিনতে আমার কোনো ভুল নেই চৈতি তাহলে আমাদের মধুচন্দ্রিমা?
-” এখনও সময় হয়নি সাহেব। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে বর সেজে এসে আমায় রাণী করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে চলুন। ধুমধাম বিয়ে না হলে ভালোবাসার পূর্ণতা পাবেন না।

চৈতি চলে গেল অক্ষরের বুকে পাহাড় সমান কষ্ট দিয়ে। অক্ষর বিরহী চোখে বলল, এখনো রয়েছে রাত যেও নাগো রূপসী।
তুমি ছাড়া আমি একা, বোঝ না কি প্রেয়সী।

##চলবে,
®ফারজানা মুমু

[বিঃদ্রঃ আপনাদের জন্য গল্প বড় করা হলো। কেমন হয়েছে জানাবেন প্লিজ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here