রংধনুর রঙ কালো পর্ব ১১

#রংধনুর_রঙ_কালো
১১.

চারিদিকে এখন ভোরের আবির্ভাব। মেলবোর্নের সকাল অনেক সুন্দর। বারান্দার গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শিশির জমেছে। অরিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে বারান্দা দিয়ে ওই আকাশে। আস্তে আস্তে আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। সে বেডরুমের বিছানায় শুয়ে আছে। বারান্দার দরজা খোলাই ছিল। হিমশীতল বাতাস মাঝে মাঝে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। অরিনের পাশে ইলহান ঘুমাচ্ছে বেকায়দায়। তার বামহাতের সাথে অরিনের বামহাত হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকানো। গতরাতে কিছু হয়েছিল। কিন্তু অরিনের মনে পড়ছে না কেনো? নিজের পোশাকের দিকে তাকালো সে। না, সবই ঠিকাছে। তবুও কিছু একটা অদ্ভুত ঠেকছে। মনে পড়েছে, কালরাতে অরিন এসেছিল তার স্যুটকেস গুছিয়ে নিতে। ইলহানের থেকে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এরপর ইলহান তাকে এই রুমে এনে আটকে ফেললো। অরিন কি জ্ঞান হারিয়েছিল? কিভাবে জ্ঞান হারিয়েছিল তার মনে পড়ছে না। কিন্তু এখন চোখ খুলে সে দেখছে ইলহানের পাশে শুয়ে আছে। আর অদ্ভুতভাবে তাদের দু’জনের হাত আটকানো। কি আশ্চর্য! অরিন ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো। কিন্তু সে যাবে কিভাবে? ওয়াশরুমে গেলেও কি ইলহানকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে? এছাড়া অন্যকোনো রাস্তা অরিন দেখছে না। এই হ্যান্ডকাপের লক খুলতে চাবি প্রয়োজন। সেই চাবি কোথায় আছে অরিন জানে না। সারাদিন ইলহানের সাথে আটকে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব না। অরিনের ইচ্ছে করলো রান্নাঘর থেকে ছুড়িটা এনে ইলহানের হাতের কবজি বরাবর কেটে ফেলতে। তারপর সেই কবজি নিয়েই অরিন ওয়াশরুমে ঢুকবে। আর ইলহান হয়ে যাবে কবজীকাটা ইলহান। একহাতের কবজী না থাকলে কি মেয়েরা তার পেছনে ঘুরবে? অরিন অনেকক্ষণ ধরে নিজের বামহাতটা টানছে। এতে ইলহানের ঘুম ভেঙে গেল। চোখমুখ কুচকে সে জেগে উঠলো। অরিনের বিরক্তমাখা মুখের দিকে চেয়ে সুন্দর করে টোল পড়া হাসি দিল। একসময় যেই হাসি দেখে প্রাণ জুড়োতো এখন সেই হাসি দেখে অরিনের মাথায় রক্ত উঠে গেল। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বললো,
” এইসব কি তামাশা শুরু করেছো তুমি? কি চাইছো তোমার হাত আমি কবজিসহ কেটে ফেলি? ভাগ্য ভালো থাকলে এখনি হ্যান্ডকাপের লক খুলো। নাহলে তোমার একদিন কি আমার। ”
ইলহান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাই তুললো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অস্পষ্টভাবে বললো,” কেনো? লক খুলে দিলে কি হবে? অন্বয় শিকদারের কাছে চলে যাবে তুমি?”
” আমার যেখানে খুশি যাবো। তোমাকে কেনো কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”
” চুপ। একদম শাট আপ। আমাকে কৈফিয়ৎ দিবে না মানে?”
অরিনের ঠোঁটে আঙুল চেপে থ্রেট করলো ইলহান। অরিন বিস্মিত হয়ে গেল। তার মেজাজ আরও চড়া হলো। চিৎকার করে বললো,” আমাকে শাট আপ করার তুমি কে? এখন তুমি যেটা করছো সেটাকে স্বার্থপরতা বলে বুঝেছো?”
” আর তুমি যেটা করছো সেটা কি? ভালো কাজ?”
” যার সাথে যেমন। তুমি যদি একশোটা মেয়ের সাথে ঘুরতে পারো তাহলে আমিও পারি অন্বয়সাহেবের সাথে মিশতে।”
” তুমি নিজের চোখে দেখেছো আমাকে একশোটা মেয়ের সাথে ঘুরতে? প্রমাণ আছে কোনো? মানুষের কথার উপর ভিত্তি করেই এতোবড় অপবাদ কি করে দিচ্ছো? পৃথিবীর সবার কথা তোমার বিশ্বাস করতে হবে শুধু নিজের স্বামী ছাড়া তাই না? এটাই তো তোমার নিয়ম।”
” বিশ্বাসঘাতক স্বামীকে আবার কিসের বিশ্বাস? আর আমি কোনো অপবাদ দেইনি। সত্যি কথা বলেছি। আমি বোকা না ইলহান। খুব ভালো করেই সবকিছু জানি আমি। প্রথম যেদিন তোমার বাড়িতে এসেছি, তোমারই খাওয়া কফিমগে আমি লিপস্টিকের দাগ দেখেছি। তোমার গা থেকে লেডিস শ্যাম্পুর ঘ্রাণ পেয়েছি। তোমার বেডরুমে মেয়েলী জিনিসপত্র দেখেছি। এমনকি খাটের নিচে মেয়েদের..।”
অরিন আর বলতে পারলো না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল। বার কয়েক শ্বাস নিয়ে আবারও বললো,” আজকের মতো ঘটনা সেদিনও হয়েছিল। আমি হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর কি দেখলাম? অপরিচিত দু’জন ছেলে-মেয়ে যোয়ী আর ক্লিফোর্ডকে। তাদের দিয়ে কত সুন্দর মিথ্যে নাটক সাজালে তুমি। বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাদের কাপল পিকচারও রুমের দেয়ালে টানিয়ে দিলে। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে ছিল ওই দেয়ালে এর আগে কোনো ছবি ছিল না। সম্পূর্ণটাই সাজানো নাটক জেনেও আমি তোমাকে কিচ্ছু বলিনি তখন। আমাকে নির্বোধ মনে হয় তোমার ইলহান? যা বুঝাবে তাই বুঝবো আমি কি দু’বছরের বাচ্চা?”
অরিনের চেহারাটা কয়েক মুহুর্তেই লালবর্ণ ধারণ করেছে। প্রচন্ড আক্রোশে শরীরজুড়ে তীক্ষ্ণ কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। ইলহান দুইহাতে অরিনের বাহু স্পর্শ করে বললো,” আমার কথা বোঝো অরিন।”
অরিন ঝারি মেরে ইলহানকে সরিয়ে দিয়ে বললো,” তুমি একটা নোংরা,প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। এতোকিছুর পরেও তুমি কিভাবে পারলে আমার পরিবারের কাছে আমার নামেই বদনাম রটাতে? তোমার সাহস কি করে হয় অন্বয়সাহেবের গাঁয়ে হাত তোলার? আমার প্রতি অধিকার দেখাও তুমি? সব অধিকার তোমার একার আর আমার বেলা শুধু প্রতারণা তাই না? এতোকিছুর পরেও অন্বয়সাহেবকে রিকোয়েস্ট করে তোমাকে হাজত থেকে বের করে এনেছি আমি। নয়তো কি অবস্থা হতো তোমার? তিনমাসে ওই অন্ধকার জায়গায় পঁচে মরতে। সেটাই বোধ হয় ভালো ছিল। আমি বোকা তাই তোমার মতো কীটের জন্য মায়া দেখিয়েছি। এখন আবার নতুন নাটক শুরু করেছো আমাকে আটকে রেখে। কি চাও তুমি আমি মরে যাই?”
অরিনের ক্রোধে লাল হয়ে যাওয়া মুখমন্ডল স্পর্শ করে ইলহান নরম গলায় বললো,
” অরিন, আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। তোমার মৃত্যু কি আমি চাইতে পারি?”
অরিন সশব্দে চপোটাঘাত করলো ইলহানের গালে। গর্জিত কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো শব্দ করে বললো,” কোনো ভালোবাসার অধিকার নেই তোর৷ তুই একটা প্রতারক। ”
ইলহান অরিনের হাতগুলো চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,” কি এমন অন্যায় করেছি আমি? কাউকে ধর্ষণ করেছি? খুন করেছি? কোন জঘন্য অপরাধের জন্য আমাকে এভাবে শাস্তি দিতে হচ্ছে শুনি?”
” প্রতারণা করেছিস তুই। আমার সাথে, আমার ভালোবাসার সাথে৷ দিনের পর দিন শুধু ঠকিয়েছিস আমাকে। মিথ্যে বলেছিস, স্বপ্ন দেখিয়েছিস তারপর সবকিছু এক নিমেষে ভেঙে গুঁড়ো করেছিস। আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিস তুই। এর চেয়ে যদি আমাকে ধর্ষণ করতি, খুন করতি তাও অনেক ভালো ছিল।”
ইলহান কিছুসময় চুপ থেকে শীতল গলায় বললো,” সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়েও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। এই সত্যি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমি নিজেও না।”
” ভালোবাসার নমুনা যদি এমন হয় তাহলে দরকার নেই এই ভালোবাসা আমার।”
” অরিন, আমি তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইনি বিশ্বাস করো। কিন্তু আমি অপারগ ছিলাম।”
” কি এমন অপারগতা তোর? তুই কি অস্বীকার করতে পারবি ওই বাড়িটা তোর নয়? ওই বেডরুমে সেদিন রাতে কোনো বিদেশীনির সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত ছিলি না তুই? সোফিয়ার বলা প্রত্যেকটি কথা কি সত্যি না? ক্লাবের মেয়েরা কন্টেস্ট খেলে তোকে পাওয়ার জন্য। আর তুই বেহায়ার মতো একটার পর একটা মেয়েকে ভোগ করিস। ”
ইলহানের গাল শক্ত করে চেপে ধরে অরিন আরও বললো,” তোর এই সুন্দর চেহারার সবচেয়ে সুন্দর ব্যবহার তো এটাই। নারীদেহ তোর নেশা নয় পেশা। ঠিক বলেছি না আমি?”
তারপর ঝাড়ি মেরে ছাড়লো ইলহানের চেহারা। কিন্তু কথা বলা বন্ধ করলো না।
” আর ওই সোফিয়ার সাথে নিশ্চয়ই তোর ঘনিষ্ঠতা আছে। নাহলে ওই মেয়ে তোর পাশে আমাকে সহ্য করতে পারে না কেনো? আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে ওইভাবে কেনো আঘাত করবে সে? একটা মেয়ের প্রতি আরেকটা মেয়ের এতো ক্ষোভ কেনো আসে সেটা কি বুঝি না আমি? আমি তো এটাও নিশ্চিত সেদিন বেডরুমে যত মেয়েলী জিনিস দেখেছি সব সোফিয়ার ছিল। তার শ্যাম্পুর ঘ্রাণ আমি কিভাবে ভুলি? সে যখন আমাকে আঘাত করছিল তখনই আমি আন্দাজ করেছিলাম সবটা। কিন্তু কিচ্ছু বলিনি। তোর থেকে ডিভোর্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমি এভাবেই নেইনি। সোফিয়া তোর আরেকটা বউ তাই না? সত্যি করে বল, বিয়ে করেছিস ওকে?”
” না, শুধু চারবছর ধরে লিভিং করেছি।”
ইলহানের স্বীকারোক্তি শুনে অরিনের ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠলো। প্রচন্ড কান্না এসে গলার মাঝখানে দলা পাকিয়ে আটকে গেল। অসম্ভব যন্ত্রণা সৃষ্টি হলো সেই জায়গায়। বুকজ্বালা কষ্টের তোলপাড়ে পৃথিবী নিঃস্ব মনে হতে লাগলো। চারদিকে এতো বিষাক্ততা কেনো? অরিন খুব কষ্টে চারটি শব্দ উচ্চারণ করলো,
” আমি, আমি ওয়াশরুমে যাবো।”
ইলহান উঠে দাঁড়ালো অরিনকে ওয়াশরুমে নেওয়ার জন্য। গোসলরুম আর টয়লেট রুম একই জায়গাতে। শুধু কাঁচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। ইলহান কাঁচের দেয়ালের অপর প্রান্তে দাঁড়ালো৷ এই প্রান্তে অরিনের গুমরানো শব্দের কান্না শোনা যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর অরিন পানি খেতে কিচেনে গেল। ইলহানকেও সাথে যেতে হলো। কাঁদতে কাঁদতে অরিনের হিঁচকি উঠে গেছে। আগে থেকেই সব জানতো সে। তাও কেনো ইলহানের মুখে কথাটা শুনে সহ্য করতে পারলো না? কেনো মন চাইছে সবকিছু ভেঙে ফেলতে? নিজেকে শেষ করে দিতে? ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে এক গ্লাস পরিমাণ গিলে খেলো অরিন। পানির গ্লাস জায়গামতো রাখতে নিয়ে ফেলে দিচ্ছিল, ইলহান হাত দিয়ে ধরলো বলে রক্ষা হলো। অরিন সিংকের বামপাশে বড় ছুড়িটা দেখতে পেয়েই হাতে তুলে নিল। রান্নাঘরের এক কোণায় খাচা বন্দী বিড়ালের বাচ্চাগুলো ঘুমাচ্ছে। অরিন ছুড়িটা নিজের পেছনেই রাখলো। ইলহানের দৃষ্টিগোচর হলো না সেটা। অরিন থেমে থেমে বললো,” শুধু কি সোফিয়া? নাকি আরও মেয়ের সাথে লিভিং করেছো?”
অরিনের ভোকাল কর্ড কাঁপছে। ইলহান বললো,” আরও আছে। কিন্তু সোফিয়ার সাথে সম্পর্ক সবচেয়ে দীর্ঘতম।”
অরিনের মন চাইল মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে একাধারে অনেকক্ষণ কাঁদতে। তারপর ইলহানের ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে নিজেকে শান্ত করতে। অরিন জোরে একটা শ্বাস নিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
” হুম। আমাদের বিয়ের চেয়েও দীর্ঘতম সম্পর্ক তোমাদের।”
ইলহান কিছু বললো না। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল অরিনের ফোলা ফোলা চোখের দিকে। অরিন কান্না আটকে বললো,” সোফিয়া ছাড়া আর কয়জন আছে?”
” সঠিক হিসাব আমার জানা নেই। অনুমান করেও বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তোমার নখের যোগ্যতাও তাদের নেই। আমার কাছে তুমি সেরা। আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি।”
অরিন পেছনে লুকিয়ে রাখা ছুড়িটা সামনে এনে ইলহানের মুখ বরাবর তাক করে বললো,” একদম খতম করে ফেলবো তোকে।”
ছুড়ি দেখেও ইলহানের অভিব্যক্তি বদলালো না। সে আগের মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,” মরে গেলে মরে যাবো। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে আছি, অন্তত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তুমি আমার।”
অরিন বিস্ফোরিত গলায় বললো,
” আর তুই কার? খবিশের খবিশ বল তুই কার?”
ইলহান আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললো,” অরিন, কি করছো এইসব? ছাড়ো প্লিজ।”
দুইহাতে শক্ত করে ইলহানের গলা টিপে ধরে অরিন প্রশ্ন করেই চলেছে,
” তুই কার? বল তুই কার?”
ইলহান এইবার নিষ্ঠুর হলো। সর্বশক্তি দিয়ে অরিনের হাত গলা থেকে ছাড়িয়ে বললো,” আমি শুধু তোমার অরিন। শুধুই তোমার।”
অরিন ঠাস ঠাস করে ইলহানের গালে চড় মারতে লাগলো। একসাথে চার পাঁচটা করে চড়। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্তি না আসলো ততক্ষণ মেরেই গেল। চড় খেতে খেতে ইলহানের সারামুখ গোলাপি আভায় পরিপূর্ণ হলো। অরিন হাঁফাতে হাঁফাতে থামলো। ইলহান পেছন থেকে তার কোমড় ধরে উঠিয়ে তাকে সোফায় নিয়ে বসালো। তারপর ওর পা দু’টো নিজের কোলে নিয়ে বললো,” আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি পাপী। জঘন্য একজন পাপী। সেই পাপী ব্যক্তিই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমাকে। আর কখনও এমন হবে না বিশ্বাস করো! যদি তুমি ছাড়া অন্যকারো দিকে তাকাই তাহলে সেদিনই তুমি আমার এই চোখ তুলে ফেলবে।”
ইলহান কথাগুলো বলেই অরিনের ডানপায়ে চুমু দিল। অরিন পা দিয়ে লাথি মারলো ইলহানের চেহারায়। তার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের সাথে ইলহানের নাক ঘষা লেগে কেটে গেল খানিকটা। রক্ত বেরিয়ে এলো। ইলহান রক্ত মাখা নাক নিয়ে মুচকি হেসে বললো,” আমাকে লাথি মেরে যদি শান্তি পাও তাহলে যত খুশি লাথি মারো। তবুও ছেড়ে যেও না প্লিজ।”
অরিন পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ইলহানের গলা চিপে ধরে বললো,
” তাহলে তোকে মেরেই ফেলি। ছাড়তে যখন পারবো না মারতে তো পারবো।”
অযথাই ইলহানের গলা ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে লাগলো অরিন। ইলহান করুণ দৃষ্টিতে বললো,” শান্ত হও মায়াপরী। প্লিজ আমার কথাগুলো একটু শোনো।”
ইলহানের মুখে এই ডাক শুনে অরিনের মন চাইলো তার ঠোঁট দু’টো শীল দিয়ে থেতলে দিতে। কিভাবে পারে এই মানুষটা? তার কি একটুও লজ্জাবোধ নেই? অরিন ইলহানের গলা ছাড়লেও শান্ত হয়ে বসতে পারলো না। ক্রমাগত অস্বাভাবিক শ্বাস ফেলতে লাগলো। ইলহান পকেট থেকে মুঠফোন বের করলো। অরিনের দিকে একটা ছবি তাক করে শান্ত কণ্ঠে বললো,
” এই কবরটা দেখো অরিন। আমার বাবার কবর এটা। পৃথিবীর নিয়ম কত অদ্ভুত তাই না? যার গর্জনে একসময় সারা বিশ্ব কাঁপতো সে নিজেই এখন নিঃশব্দে মাটির নিচে শুয়ে আছে। কোথায় গেল এতো ক্ষমতার বড়াই?এতো শক্তি, বিত্ত, তেজ! কিচ্ছু কাজে লাগেনি।সবই মাটির সাথে পঁচে, গলে নশ্বর হয়ে গেছে।”
ইলহানের কথা শুনে অরিন ছবিটির দিকে তাকালো। কবরের সাইনবোর্ডে নামটি জ্বলজ্বল করছে। মিস্টার ইভলিন এলেন। ইলহানের বায়োলজিক্যাল ফাদার। আইনত এখন ইলহানের বাবার নাম শায়িখ আহমেদ। শায়িখ আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার একটি এতিমখানা থেকে ইলহানকে দত্তক নিয়েছিলেন। জন্মগতভাবে ইলহান অস্ট্রেলিয়ান। কবরে শুয়ে থাকা মানুষটিই তার জন্মদাতা। এক সময় তিনি ছিলেন নামকরা গ্যাংস্টার। তাঁর নাম শুনেই শহরের অর্ধেক মানুষ কাঁপতো।অরিন যতদূর জানে, ইলহান তার বাবাকে ঘৃণা করে। প্রচন্ড ঘৃণা করে!কারণ এই লোকটি কখনও ইলহানকে পৃথিবীতে আনতে চাননি। জন্মের আগেই তিনি ইলহানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। এমনকি জন্মের পরেও চেষ্টা করেছিলেন মেরে ফেলার। ইলহানের মা অলিভিয়া চ্যান জন্মের পরপরই নবজাতক ইলহানকে ডাস্টবিনে ফেলে চলে যায় শুধুমাত্র এই লোকটির ভয়ে। কারণ মি. ইভলিন এলেন বাচ্চা সমেত অলিভিয়াকে খুঁজে পেলে দু’জনকেই খুন করে ফেলতেন। ইলহানের মা-বাবার সম্পর্কটা ছিল একপ্রকার অবৈধ। ইলহানের জন্মটাও হয়েছিল অবৈধ পন্থায়। তার বাবা ছিলেন একজন চরিত্রহীন,নারী লোভী, শিশু বিদ্বেষী। ইলহান কিছুটা তার বাবার মতো হয়েছে। কিন্তু সে শিশু বিদ্বেষী নয়। বরং বাচ্চাদের প্রতি ইলহানের আলাদা দূর্বলতা আছে। নিজে অবহেলিত ছিল বলে অবহেলিত বাচ্চাদের কষ্ট ইলহান সহ্য করতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তিকে ইলহান সবচেয়ে ঘৃণা করে তার আদর্শই নিজের চরিত্রে ধারণ করে রেখেছে। বংশগত প্রথা বলে একটা ব্যাপার আছে। ইলহানের ব্যাপারটাও হয়তো তেমন। ইলহান বললো,
” আমি যে আমার বাবা-মায়ের আসল সন্তান না সেটা ছোটবেলা থেকেই সবার মুখে মুখে শুনেছি। শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। অরিন তুমি একবার ভেবে দেখো তো, যাদের কাছে জন্ম থেকে মানুষ হয়েছো, যাদের আপন ভেবে ভালোবেসেছো, বুঝ হওয়ার পর জানতে পারলে তারা আসলে তোমার কেউ হয় না। কারো সাথে তোমার রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই। কেমন লাগবে তখন? অবশ্যই খুব খারাপ লাগবে। ভেতর থেকে তুমি একদম ভেঙে পড়বে। নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মনে হবে। ক্ষোভ জন্মাবে নিজের প্রতি। যতই তারা তোমাকে ভালোবাসুক, আপন ভাবুক, তুমি কিছুতেই একটা কথা ভুলতে পারবে না যে তুমি এদের কেউ নও। তোমার জায়গা অন্যকোথাও।নিজের আসল জায়গা খুঁজে পেতে তুমি কি মরিয়া হয়ে উঠবে না? আমার অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসার মুখ্য কারণ এটাই ছিল। যেনো আমি আমার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু তখন আমি জানতাম না যে এতো ভয়ানক সত্যি’র মুখোমুখি আমাকে কোনোদিন হতে হবে। আমি যখন জানতে পারলাম আমার বাবার সাথে মায়ের সম্পর্কটা কখনও বৈধ ছিলই না, আমি তাদের অবৈধ সন্তান, এমনকি জন্মের আগেই বাবা আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল তখন আমার মনের অবস্থা ঠিক কিরকম হয়েছিল সেটা আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না অরিন! এই লোকটার জন্য আমি আমার আসল মাকে কোনোদিন চোখে দেখিনি। আমার মা আমাকে উচ্ছিষ্টের মতো ডাস্টবিনে ফেলে গিয়েছিল তুমি চিন্তা করতে পারো অরিন? আমি ঠিক করেছিলাম জীবনে আর যাইহোক, এই লোকটিকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না। কিন্তু মৃত্যুর সময় বাবা যখন আমাকে দেখতে চাইলেন, জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন, আমার মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন, তার ফেলে যাওয়া সবকিছু আমার নামে হস্তান্তর করে একমাত্র সন্তান হওয়ার অধিকার দিলেন এবং আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন তখন আমি আর কঠিন হয়ে থাকতে পারলাম না৷ তুমি হলে কি পারতে বলো? একজন মৃত্যু পথযাত্রীর উপর কি করে বিদ্বেষ পুষে রাখা যায়? আমি পারিনি তাকে ক্ষমা না করে থাকতে। শেষবারের মতো বাবাকে বাবা বলে ডেকেছিলাম। বাবা তার সহায় সম্পত্তির সাথে সাথে আরও একটা জিনিসের দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়েছেন। সে হলো সোফিয়া। আমার জীবনের প্রথম নারীসঙ্গ। বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল আমি যেনো সোফিয়াকে বিয়ে করি। তখন আমার বয়স মাত্র উনিশ। সোফিয়ার ষোল। আমরা লিভিং রিলেশনশীপে জড়িয়ে যাই। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর বিয়ে করবো। এইদেশে তো এইসব নরমাল। সোফিয়ার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই আমি আরও অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছি। কিন্তু এতে সোফিয়ার কখনও কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ সে জানতো, দিনশেষে আমি তার। বাবাকে দেওয়া ওয়াদা তো আমি ভাঙতে পারবো না। সত্যিই পারিনি। কোনো মেয়েকেই আমার একমাসের বেশি সহ্য হয় না। কিন্তু সোফিয়াকে আমি চারবছর ধরে সহ্য করেছি।”
” তাই? তাহলে আমাকে দুইবছর কিভাবে সহ্য করলে?”
” তোমাকে তো ভালোবাসি অরিন। তোমার ব্যাপার সবার চেয়ে আলাদা।”
” সোফিয়ার সাথে তোমার বাবার সম্পর্ক কি?”
” বাবার পাতানো এক বোনের মেয়ে সোফিয়া। এ্যানি আন্টি। পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র সুন্দরী মহিলা। যাকে বাবা বোনের চোখে দেখতেন।”
কথাটা বলতে নিয়ে হেসে ফেললো ইলহান। আরও বললো,” বাবার একটা এক্সিডেন্টে একবার এ্যানি আন্টি রক্ত দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এ্যানি আন্টি বাবার বোন হয়ে গেছেন।”
” আর সোফিয়া হয়েছে তোমার হবু বউ। তাই না? জানতেই যখন সোফিয়াকেই বিয়ে করতে হবে তাহলে আমার জীবন নষ্ট করতে কেনো এলে?”
” তোমার জীবন নষ্ট করতে আসিনি বিশ্বাস করো।নিজের নষ্টজীবন তোমার সান্নিধ্যে এসে বদলাতে চেয়েছি। সোফিয়া তো আমার দায়বদ্ধতা। কিন্তু তুমি বললে সব ছাড়তে পারি। একশোটা সোফিয়াকেও অনায়াসে ছাড়তে পারি।”
” হুম, এজন্যই তো আমাকে ছেড়ে সোফিয়ার কাছে চলে এসেছো। দিনের পর দিন আমাকেই ধোঁকা দিয়েছো।”
” এইখানে আসার জন্য আমাকে কে জোর করেছিল বলো তো? তোমার জোরাজুরিতেই আমি অস্ট্রেলিয়া এসেছি। নাহলে তো আমি আসতেও চাইনি।”
” আমি তো তোমাকে লেখাপড়া করার জন্য আসতে বলেছিলাম ইলহান। আমাকে ধোঁকা দিতে তো বলিনি।”
” আর করবো না। আর কখনও করবো না। তোমাকে পেয়ে গেলে সব ভুলে যাবো।”
” আমাকে আরও আগেই পেয়ে গেছো। কিছু কি ভুলেছো? তোমার অভ্যাস পাল্টেছে? তাছাড়া একশোটা মেয়ের হৃদয় নিয়ে যে খেলতে পারে সে আমাকে পেয়ে সব ভুলে যাবে বিষয়টা কৌতুকের মতো হয়ে গেল না?”
” আমার সম্পূর্ণ জীবনটাই কৌতুকের মতো অরিন। মাই লাইফ ইজ আ সার্কাজম। কিন্তু আমি সবকিছু সহ্য করতে পারলেও তোমার হারিয়ে যাওয়া সহ্য করতে পারবো না। আর না পারবো তোমাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখতে।”
” ও, তার মানে আমার সাথে অন্বয়সাহেবকে দেখেই তোমার বুক ফেটেছে? এজন্যই ভালোবাসা উথলে উঠেছে? এটা তো তাহলে ভালোবাসা না, ঈর্ষা। এখন যদি আমি সবকিছু ভুলে আবার তোমার কাছে ফিরে আসি তাহলে তুমিও আগের মতো হয়ে যাবে। আবারও অন্যমেয়েদের সঙ্গ দেওয়া শুরু করবে।”
” বিশ্বাস করো, আর কক্ষনো এমন হবে না। তুমি শুধু একবার বলো, আমি পৃথিবী ছেড়ে দিবো তোমার জন্য। নারীসঙ্গ তো খুব তুচ্ছ বিষয়৷ আমার শুধুই তোমাকে লাগবে।”
” তার মানে তুমি বলছো আমি তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিবো? সবকিছু ভুলে আবার তোমার সাথে হ্যাপি হ্যাপি লাইফ লিড করবো? এত্তো ইজি?”
” তুমি চাইলেই তো ইজি। অপরাধ তো সবাই করে। আমি আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি। প্রয়োজনে তোমার পা ধরে পড়ে থাকবো। কান ধরে উঠ-বস করতে বললে তাও করবো। তুমি আমাকে শুধু একবার ক্ষমা করে দেখো!”
” তাহলে আমাকেও যে তোমার ক্ষমা করতে হবে ইলহান!”
” কেন?”
” কারণ আমিও অন্বয়ের সাহেবের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি। যে ছয়মাস তুমি বিদেশ ছিলে সেই ছয়মাসে আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া আসার পরেও হয়েছে।”
” কি বলছো এইসব?”
” হ্যা সত্যি! ইলহান, অপরাধ তো সবাই করে। তুমিও তো অপরাধী। সবকিছু ভুলে চলো আমরা আবার হ্যাপি হ্যাপি লাইফ লিড করি। এটা তো খুব ইজি। তুমি চাইলেই ইজি হবে! আমি আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি। প্রয়োজনে তোমার পা ধরে পড়ে থাকবো। কান ধরে উঠ-বস করতে বললে সেটাও করবো। তুমি আমাকে শুধু একবার ক্ষমা করে দেখো!”
ইলহান চট করে উঠে দাঁড়ালো। অরিনকেও দাঁড়াতে হলো। সে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলো ইলহানের হাত-পা কাঁপছে। কপাল ঘামছে। চোখ-মুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। গলার শিরা ফুলে উঠেছে! তার বুকের বামপাশটাও নিশ্চয়ই চিনচিন করছে! অরিন কাছে গিয়ে বললো,” কি হয়েছে ইলহান? কষ্ট হচ্ছে? আমারও কষ্ট হয়েছিল। আমি তো তাও একজন পুরুষকে জীবনে এনেছি। কিন্তু তোমার জীবনে তো নারীর অভাব নেই। এবার আমার কষ্টের পরিমাণ চিন্তা করে দেখো!”
ইলহান বুকের অদ্ভুত জ্বালা নিয়ে কটমট করে বললো,” অরিন সত্যি কথা বলো। আসলেই ওই ব্যারিস্টারের সাথে তোমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে?”
অরিন শব্দ করে হাসতে লাগলো। ওর ওই হাসি দেখে ইলহানের সমস্ত রক্তনালী জুড়ে বিষাক্ত স্রোত বাহিত হতে লাগলো। ইচ্ছে করলো পুরো পৃথিবী ভেঙে চুরমার করে দিতে।

চলবে

-Sidratul Muntaz

( গল্প উপন্যাসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নায়ক-নায়িকাদের মহান বানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে কেউ নিঁখুত চরিত্রের হয় না। ভুল সবাই করে। কেউ কি বুকে হাত রেখে বলতে পারবে সে জীবনে একটা অন্যায়ও করেনি? আমার এই গল্পের নায়ক-নায়িকার চরিত্রটাও তেমন। তবে হ্যাঁ, পাপের শাস্তি কিভাবে মানুষ সঠিক সময়ে ফেরত পায় সেটাই এই গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here