#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১
প্র্যাগনেন্সি কিট নিয়ে বরাবরেই খুব আগ্রহ থাকায় আমি আর আমার চাচাত বোন সন্ধি কিটটা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। প্রগন্যান্সি কিটটা মূলত আমার বড় আপু সায়রার। আপুর বিয়ে হয়েছে তিন মাস হলো। মূলত আপুর প্যাগনেন্সি টেস্টের জন্য কিটটা আনা হয়েছে। দুজনেই প্র্যাগনেন্সি কিটটা দেখছিলাম আর মুচকি মুচকি হাসছিলাম।বেশ কৌতুহল বশত সন্ধি বলে উঠল
– আচ্ছা তন্দ্রা এ কিটটা দিয়ে আমি আর তুই প্র্যাগনেন্সি টেস্ট করলে কেমন হয় বলতো।
আমার নাম তন্দ্রা। সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। বয়স ১৭ থেকে ১৮ ছুঁই ছুঁই। আমার পরিবারে আমি আর আমার বড় আপু সায়রা আছে৷ আমার বাবা মা দু বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
যাইহোক সন্ধির কথাটা শোনে আমারও বেশ কৌতুহল জাগল বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করার। আমিও বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললাম
– হুম করা যায়। তবে সায়রা আপু জানলে বকবে ইচ্ছা মতো।
সন্ধি আমার কথার পাত্তা না দিয়ে হালকা ঝেড়ে কাশি দিয়ে বলল
– সায়রা আপুর কথা বাদ দে। বলবই না আপুকে কিটটা আমরা নিয়েছি। তুই টেস্ট করবি নাকি আমি?
আমি মুখে হাই তুলে বললাম
– আমি করব না। তুই কর। কারণ তোর পেটে না ইদানীং কি নড়ে চড়ে বললি। মাথায় পেইন হয়। দেখ পেটে বাচ্চা কাচ্চা আছে কিনা।
সন্ধি ভ্রুটা কুঁচকে তার নীল ফ্রেমের চশমাটা ফাঁকা করে বলল
– তুইও না সবসময় মজা করিস। গ্যাস্ট্রিকে এমন হচ্ছে।আচ্ছা আমিই টেস্ট করাব। এখানে তো নিয়ম লেখায় আছে।
সন্ধির পরিচয় তো দেওয়া হলো না।সন্ধি আমার বড় চাচার মেয়ে আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করে। বড় চাচা মারা গিয়েছে সন্ধি পেটে থাকা অবস্থায়। সন্ধির জন্মের সময় তার মা ও মারা যায়। এরপর থেকে সে আমাদের বাসায় থেকে বড় হয়। সন্ধি ক্লাস নাইনে পড়ে বয়স পনের। বয়স কম হওয়ায় সব বিষয়ে কৌতুহল বেশি।
যাইহোক আমি সন্ধির হাত থেকে প্র্যাগনেন্সি কিটটা নিয়ে নিয়মগুলো পড়া শুরু করলাম। লেখা আছে সকালে উঠে প্রথম ইউরিন কিটে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।দুইটা দাগ আসলে পজিটিভ আর একটা দাগ আসলে নেগেটিভ।সন্ধির বেলায় একটা দাগ আসবে সেটা নশ্চিত ছিলাম। আমি আর সন্ধি কিট টা আস্তে হাতে সরিয়ে ফেলি সায়রা আপুর অগোচরে।
দিন পেরিয়ে রাত নামে। রাতে দুজনেই বেশ কৌতুহলী যে পরদিন সকালে কিটটা দিয়ে পরীক্ষা করব। তারপর কি আসে সেটা দেখার জন্য। সন্ধি বলে উঠল
– আচ্ছা কিটটা যদি পজিটিভ হয় তাহলে কি হবে?
আমি হাসতে হাসতে জবাব দিলাম
– তাহলে তোর পেটে একটা ভূতের বাচ্চা হবে।
সন্ধি ভয়ে আমাকে ঝাঁপটে ধরে বলল
– ধুর তুই সবসময় ভয় দেখিয়ে কথা বলিস।এমন ভয় দেখিয়ে কথা বললে রাগ লাগে খুব।
আমি সন্ধির ভয় দেখে সন্ধিকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম
-তুই অবিবাহিত মেয়ে তোর পজিটিভ আসবে নাকি বোকা। আমি তো মজা করলাম।মজাও বুঝিস না। কি যে পাগলি একটা।
সন্ধি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কৌতুহল গলায় বলল
– আচ্ছা ভূতের বাচ্চা দেখতে কেমন হয়?
মুখটাকে বাঁকা চাঁদের মতো প্রশস্ত করে প্রথমে একটা নিঃশব্দ হাসি তারপর একটা সশব্দ হাসি দিয়ে উঠে বসলাম। সন্ধিও আমার সাথে সাথে উঠে বসলো। পাশে বসে সন্ধি আমার দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে। আমিও তার মনোযোগের সুযোগ নিয়ে বললাম
– ভূতের বাচ্চার দাঁতগুলো রক্তে মাখা থাকে। চোখগুলো কালো থাকে। হাত একটা কাঁটা থাকে। পা উল্টো থাকে।
বলেই দাঁতগুলো বের করে হাসি দিলাম। খেয়াল করলাম সন্ধি বেশ ভয় পাচ্ছে। বুঝতে পারলাম আমার কথায় ভয় পাচ্ছে। তাই তাকে ধরে স্বাত্ত্বণা দিতে চাইলে সে ভয়ে দূরে সরে গিয়ে বলল
– তন্দ্রা আপু তোর দাঁত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কি বিচ্ছিরি দেখা যাচ্ছে তোকে। তোর চোখগুলোও কালো হয়ে গেছে। একদম ভূতের বাচ্চার মতো লাগছে যেমনটা তুই মাত্র বললি।
আমি বুঝতে পারছিলাম সন্ধি আমার কথাগুলে কল্পনা করে আমাকে ঐরকম ভাবা শুরু করেছে। আমি সন্ধির ভয় কাটানোর জন্য সন্ধির দিকে এগুতে থাকলাম। আর সন্ধি পিছুতে পিছুতে দেয়ালে ঠেঁকল। এবার সন্ধিকে ধরতে যাব সন্ধি দেয়াল থেকে সরে পাশের দিকে হেলে ভয়ে আঁচড়ে পড়ল।সন্ধির কান্ড দেখে নিজেই হতবাক হলাম। এবার কিছু রাগ নিয়ে সন্ধিকে ধরতে গিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। সত্যিই তো সন্ধি যা বলেছিল সেটাই ঠিক। মাথাটা ঝিম ঝিম শুরু করল সেই সাথে জোরে একটা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে। আমিও সন্ধির উপর পড়ে গেলাম।
খানিকক্ষণ পর পানির ঝাঁপটা পেয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম সায়রা আপু পাশে বসে আছে আর সন্ধিও পাশে বসে আছে। আমাকে সায়রা আপু চোখ খুলতেই জিজ্ঞেস করলো
– কি ব্যাপার কি এমন হলো পড়ে গেলি যে?
পাশ থেকে সন্ধি বলে উঠল
– কি হয়ছিল তোর এভাবে পড়ে গেলি কেন?
সন্ধির কথাটা শোনে একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম
– একটু আগে তুই আমার সাথে ছিলি না?
সন্ধি মাথা নেড়ে বলল না। তার মানে এটা আমার মতিভ্রম। চুপ হয়ে রইলাম খানিকক্ষণ এর মধ্যে সায়রা আপু পুনরায় ডেকে বলল
– আরে কি হয়েছিল বলবি তো?
আমি আমতা আমতা করে বললাম
– না কিছু না। এমনি মাথাটা ঘুরে গেছিল। তুমি যাও আমি আর সন্ধি ঘুমিয়ে পড়ছি এখনেই।
সায়রা আপু আমাকে হালকা বকতে লাগল। সারাদিন খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো না করলে এমনেই হবে তোর। এসব বলতে বলতে রুম থেকে প্রস্থান নিল। আমি সন্ধিকে আর কোনো প্রশ্ন না করে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
দুজন শুয়ে আছি এর মধ্যে সন্ধি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আর আমি শুধু কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছি। ভাবছি এটা কি আমার মতিভ্রম নাকি সত্যি। ভাবনার অতল সাগরে ডুবতে ডুবতে ঘুমের সাগরেও ডুবে গেলাম। সকালে সন্ধির হালকা হাতের ধাক্কায় আর ফিসফিস আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। উঠে খেয়াল করলাম সকাল সাড়ে ছয়টা বাজে আর সন্ধির হাতে সেই প্র্যাগনেন্সি কিট টা। সন্ধি কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বলল
– দেখ তো এমন কেন হলো? আমি তো বিবাহিত না।
আমি কিট টা দেখার পর আমার চোখ যেন মাথায় উঠল। কিটে বরারবর দুটো রেখা। তার মানে সন্ধি প্র্যাগনেন্ট। ভয়ার্ত স্বরে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। অবিবাহিত মেয়ে প্র্যাগনেন্ট বিষয়টা ভালো ঠেঁকল না। মনের মধ্যে প্রশ্ন চড়ে বসলো তাহলে কি সন্ধির কোনো ছেলের সাথে রিলেশন চলছে। সন্ধি বয়সে ছোট আবেগে হাবুডুবু খেয়ে এমন করতেই পারে। আমি খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেলাম এটা ভাবার পর। হালকা গলায় বললাম
– তোর পিরিয়ড হয়তো ঠিক করে?
সন্ধি ধীর গলায় জবাব দিল
– আমার তো এমনিই ইরেগুলার। দুমাস যাবত হয় না। এর আগেও তিনমাস পর হয়েছিল।
কথাটা শোনার পর অজানা একটা ভয় মনে বাসা বাঁধলো। আমি হালকা রাগী গলায় বলতে গিয়েও পরক্ষণে গলাটা শান্ত করে বললাম
– আমাকে সত্যি করে বল কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে কিনা?
সন্ধি নীরব আমার কথা শোনে। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে বলল তার কোনো সম্পর্ক নেই। রিতীমতো হাজার বার জেরা করার পরও তার উত্তর একই ছিল। বিষয়টা আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত। কিটে ভুল আসা অস্বাভাবিক না। আমি সন্ধিকে বললাম
– তোর কিট থেকে এটাই বুঝায় তুই প্র্যাগনেন্ট। কিন্তু কীভাবে হলি সেটা তুই বলতে পারবি। আমার সাথে তুই ডাক্তারের কাছে যাবি নাস্তা খেয়ে। আর আপুকে কিছু বলবি না। যদি সত্যি সত্যি তুই প্র্যাগনেন্ট হস তাহলে এ আকামটা কার সাথে করেছিস বলবি নাহয় প্রাণে মেরে ফেলব।
সন্ধি আমার কথা শোনে ভয় পেয়ে গিয়ে বলল
– সত্যি আমি কারও সাথে কিছু করেনি।
সেই সাথে চোখের জল ফেলতে লাগল। আমি সন্ধির দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। এরপর খানিকটা নাস্তা করলাম। সন্ধি নাস্তা করতে বসে শুধু নাস্তা হাত দিয়ে নাড়ছিল। একটা দমক দিয়ে বললাম
-তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হ তোকে নিয়ে একটু বাইরে যাব।
পাশ থেকে সায়রা আপু বলে উঠল
– এত সকাল সকাল কোথায় যাবি?
আমি আমতা আমতা করে বললাম
– হাসপাতালে যাবে?
সায়রা আপু চোখ বড় বড় করে বলল
– কেন?
– আমার বান্ধবীর বাবা অসুস্থ দেখতে যাব।
– ওহ আচ্ছা তাড়াতাড়ি ফিরিস।
– হুম
তারপর নাস্তা শেষে সন্ধিকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার চেকআপের পর সন্ধির প্র্যাগনেন্সি নিশ্চিত করার সাথে আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল।
চলবে?
(