লাবণ্যপ্রভা শেষ পর্ব

#লাবণ্যপ্রভা
#শেষ পর্ব
১৭.
প্রগতির ডায়েরি আমি সারারাত জেগে পড়লাম। যেখানে ও অনেক কিছু লিখে গেছে তুনিড়ের ব্যাপারে। তুনিড়ের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও লিখেছে। অনেক অনেক প্রশ্ন ছিলো যেগুলোর উত্তর আমার জানা দরকার ছিলো সেসব প্রশ্নের উত্তর ও জেনেছি প্রগতির ডায়েরি থেকে। এমনকি আমার ব্যাপার টাও লেখা ছিলো

ডায়েরি শেষ করে আমি লাবণ্যপ্রভা কে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার বাবা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনার পর সবাইকে কি বলেছে??
লাবণ্যপ্রভা উত্তর দিলো,
-বলেছে মায়ের মতো আমার ও মেন্টাল প্রবলেম আছে।

আমিও এরকম কিছুই ভেবেছিলাম। তুনিড় সবসময় কথা রেডি রাখতো। যে কোনো পরিস্থিতিতে এমন ভাবে মিথ্যে বলতো যে সেটা মানুষ বিশ্বাস না করে পারতো না

অনেক ভেবে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তুনিড়কে শায়েস্তা করতে হলে ওকে হাতে না মেরে ভাতে মারতে হবে। অর্থাৎ ওর জালে ওকেই ফাঁসাতে হবে।

আমি তুনিড়ের জন্য প্ল্যান বানালাম। আসিফের সাথে কথা বললাম। আসিফ আমাকে বারন করল যে এতো বছর পর কি দরকার আবর্জনা ঘাটার। আমি বললাম,
-আবর্জনা কে সরিয়ে ফেলতে হয় আসিফ। নাহলে সেটা পঁচে সবাইকে হয়রানি করবে।
আসিফ আর কিছু বলল না। আমি রাতে লাবণ্যপ্রভা কে বললাম কাল সকালে তোমার মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে আসবে।

পরদিন ও শুধু ল্যাপটপ নিয়ে আসে। মোবাইলের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে যে সেটা নাকি তুনিড় আগেই নিয়ে গেছে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-যে ছেলেটার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিলো তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে যে কনভারসেশন হয়েছে সেগুলো কি আছে??
-হ্যাঁ আছে।
-গুড। আমি এগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যাব। তুমিও আমার সাথে যাবে। যা যা ঘটেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কে বলবে। পারবে তো??
ও কিছু বলল না। আমি আবারও বললাম,
-লাবণ্যপ্রভা তোমার যা যাওয়ার তা তো গেছেই। এখন তুমি চাও না দোষী রা শাস্তি পাক?
ও ইতস্তত করে বলল, বাবাও তো দোষী। মায়ের সাথে অন্যায় করেছে। তাহলে তো তার ও শাস্তি প্রয়োজন।

আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর কথায়। যদিও অবাক হওয়ার কোনো কারন ছিলো না। প্রগতির ডায়েরি পড়ে ওর মনেও হয়তো ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

আমি বললাম তোমার বাবার ও শাস্তি হবে। কিন্তু তুমি কি মেয়ে হয়ে সেটা সহ্য করতে পারবে??

ও কিছু বলল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

ওকে আর বাড়িতে যেতে দিলাম না। ওর বাড়ি থাকা না থাকা নিয়ে হয়তো ওর বাবার কোনো মাথা ব্যাথা ও ছিলো না। পরদিন ওকে নিয়ে মানবাধিকার কমিশনে গেলাম। সেখানে গিয়ে সব টা খুলে বললাম। আমাকে সাহায্য করল সুমির হাজবেন্ড আর তার স্বামী। ওরা আমার কথা শুনে সাহায্য করতে রাজি হলো।

এরপর পুলিশের কাছে গেলাম ল্যাপটপ নিয়ে। ছেলেটার ফেসবুকে দেয়া ইউনিভার্সিটির নাম দেখে পুলিশ ছেলেটাকে খুঁজে বের করল।

ছেলেটা সত্যিই একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে পড়ে আর ভালো ফ্যামিলির ছেলেও।

একটু চাপ দিতেই সব টা স্বীকার করল। কিন্তু হোটেলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার টা স্বীকার করল না।

তখন লাবণ্যপ্রভা সাহসী কাজ করল। বলল হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সেটা হলো তুনিড়ের লোকলজ্জার ভয় থাকলেও তার মেয়ের সেটা নেই। হয়তো ছোটবেলা থেকে এভাবেই বড় হয়েছে।

সব প্রমাণ যোগাড় করে পুলিশ তুনিড় কে ফোন করে থানায় ডাকল। তুনিড় থানায় এসে সব শুনে বলল,
-আমার মেয়ের মানসিক সমস্যা আছে তাই এসব করেছে। ছেলেটার কোনো দোষ নেই।
আমি তখন বললাম, ওসি সাহেব সবসময় দোষ মেয়েটার কেনো থাকে?? শারিরীক সম্পর্কে তো নারী পুরুষ দুজনেই সমান ভাবে উপভোগ করে। তাহলে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে মেয়েটাকে কেন শুনতে হয় যে সে বেশ্যা কিংবা প্রস্টিটিউট?? মেয়েটা ছেলেটার কথায় রাজি হয় তাই? তাহলে ছেলেটা যে মেয়েটাকে প্রস্তাব দেয় সেটার জন্য কি বলা যায়?

তুনিড়ের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। একটু আগে মিথ্যে কথা বলার সময় চোখে যে দৃঢ়তা ছিলো এখন তার বদলে আছে ভয়। হ্যাঁ আমি স্পষ্ট তুনিড়ের চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছি। সেটা কেন?? বয়স হয়ে গেছে তাই! নাকি পুরনো পাপের কথা মনে পরে যাওয়ায়!

তুনিড় চোখ নামিয়ে নিলো। আমি তাকিয়ে রইলাম। একবার ও আমার চোখের দিকে তাকালো না।

ওসি সাহেব আবারও জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়ের মানসিক সমস্যা আছে???

তুনিড় আমতা আমতা করে বলল,
-ওর মায়ের ও ছিলো। আর তাছাড়া অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছে তো তাই আর কি,,,,

মানবাধিকার কমিশনের মহিলা প্রেসিডেন্ট বললেন,
-তাহলে ওকে কেন হোস্টেলে রাখা হলো? আর আপনি কি কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আলাপ করেছেন??
তুনিড় এবার আরও ঘাবড়ে গেল। এসির মধ্যেও তার কপাল ঘামতে শুরু করল।

আমি কিছু না বলে তুনিড়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টি তুনিড়ের দিকে নিবদ্ধ। বিশ বছর পর তুনিড় যে কখনো আমার সামনে পড়বে সেটা হয়তো ভাবতে পারেনি। আর আমি তখন আমাদের পাড়ার এককালের রাজপুত্র কে দেখছি। রাজপুত্রের বিশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে যখন হেটে এসেছে তখন পায়ের আগে তার বিশাল আকৃতির ভুড়ি টা এসেছে। মাথায় চুল আছে হাতে গোনা কয়েকগোছা। এই রাজপুত্রের প্রেমে একসময় যে আমি দিওয়ানা ছিলাম সেটা ভেবে আমার একটু হাসিও পেল।

১৮.

আমার প্ল্যান ছিলো কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে তুনিড় কে ফাঁদে ফেলা। প্রগতির ডায়েরি টা যে তুনিড় পড়েনি সেটা আমি ডায়েরির শেষ টা পড়ে জেনেছিলাম। প্রগতি তুনিড়ের ব্যাপারে যে অতকিছু লিখে গেছে সেটা সে জানলে এই ডায়েরি স্টোররুমে রাখতো না।
ডায়েরি টা লিখেছিল মেয়ের জন্য। প্রথম দিকে যেটা দুঃখের সাতকাহন দিয়ে শুরু হয়েছিল পরে সেটা যে অন্যদিকে যাবে সেটা তুনিড় হয়তো জানতো না।

পুলিশের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে একটার পর একটা মিথ্যে বলেছিল তুনিড়। তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো নিজের মান সম্মান রক্ষা করা। তাই দোষী ছেলেটাকেও নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়েছিলো।

কিন্তু যখন পুলিশ বলল, প্রগতির ডায়েরি আর ছেলেটার জবানবন্দি অনুযায়ী তুনিড়ের সব কথা মিথ্যে তখন তুনিড় গ্যারাকলে পড়ে গেল।

পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেলে বড় করে হেড লাইন হলো, শিল্পপতি তুনিড় হাসনাত প্রোপার্টির জন্য নিজের মেয়েকে পাগল সাজিয়েছেন।

লাবণ্যপ্রভা আমাকে বলল, এসব করার পর বাবা আমাকে আর তার সাথে রাখতে চাইবে না।
-তোমার মা চেয়েছেন তুমি যেন এখানে না থাক। তোমার মায়ের কাজিন কানাডায় আছেন তার সাথে আমি যোগাযোগ করেছি। সব শুনে সে তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন।

আমি আবারও বললাম, শোনো মেয়ে এই সমাজ তোমাকে ঠিকঠাক মতো বাঁচতে দেবে না। তুমি যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যাবে তখন একদল তোমাকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখবে আর একদল দেখবে সহানুভূতির চোখে। তুমি কেন সেভাবে বাঁচবে?
উপরওয়ালা তোমাকে যে জীবন টা দিয়েছেন সেই জীবন টা ভালোভাবে উপভোগ করতে হবে। এখানে থাকলে সেটা সম্ভব না। হ্যাঁ এখানে তবুও তোমার বাবা ছিল কিন্তু তার কাছে তোমার যে গুরুত্ব নেই সেটা তো তুমি দেখেছ। তার চেয়ে দূরে গিয়ে জীবন টাকে এমন ভাবে সাজাও যেন কারোর জীবনে তুমি প্রায়োরিটি হতে পারো।

লাবণ্যপ্রভা আমার কথায় রাজি হলো। প্রগতির সেই কাজিনের সাথে যোগাযোগ করলাম। প্রগতির ডায়েরি থেকে তার নাম্বার সহ আরও কয়েকজনের নাম্বার ছিলো সেখান থেকে সহজে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। এতো বছর পর তারা প্রগতির মেয়ের খবর পেয়ে কিছুটা চমকে গেলেও আমার প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।

লাবণ্যপ্রভার কানাডা যাওয়ার সব খরচ তুনিড়ের কাছ থেকে আদায় করা হলো। আমি ইচ্ছে করলেই দিতে পারতাম কিন্তু সেটা চাইনি। আমি চেয়েছি মেয়েটা অন্তত নিজের অধিকার টুকু আদায় করতে শিখুক।

কাগজ পত্র রেডি হওয়া পর্যন্ত লাবণ্যপ্রভা আমার সাথেই ছিলো। আইনের চাপে পড়ে সম্পত্তির ৬০ ভাগ লাবণ্যপ্রভাকে দিতে বাধ্য হলো তুনিড়।

কানাডা যাওয়ার আগে আমি জানতে চাইলাম লাবণ্যপ্রভা তুনিড়ের সাথে দেখা করতে যেতে চায় কি না। কিন্তু ও যেতে চাইলো না। হয়তো বাবার সাথে কোনো মধুর স্মৃতিও নেই যে যেতে চাইবে।

প্লেনে ওঠার আগে লাবণ্যপ্রভা আমাকে বলল,
-আপনাকে আমি কখনো ভুলবো না।
-আমিও তোমাকে মনে রাখব। আর হ্যাঁ তোমাকে নিয়ে কিছু একটা লেখার ও চেষ্টা করবো।
-প্লিজ আমাকে নিয়ে লিখবেন না। নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়ের গল্প কারও ভালো লাগবে না।
আমি এই কথার পিঠে কিছু বললাম না। আসলে বলতে পারলাম না। মনে মনে তখন একটা কথা ঠিক ই বলেছিলাম, আমিও যে তোমার মতো এক নষ্ট মেয়ে ছিলাম।
-আমি আপনাকে কি ডাকব??
-তোমার যা ইচ্ছে।
-আপনি তো আমাকে নতুন ভাবে জন্ম দিয়েছেন আমি কি আপনাকে মা ডাকব??
আমি কেঁদে ফেলে বললাম, আমি অনেক বছর আগের ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছি লাবণ্য। তুমি আমাকে এতো টা মহান ভেবো না।

লাবণ্যপ্রভার শেষ কথা টা ছিলো, আমি আপনাকে কখনো ভুলে যাব না মা!

আমি এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, তোমার মেয়ে একটুও তোমার মতো হয়নি প্রগতি। আমার মতোও হয়নি। তোমার আমার যে সাহসের অভাব ছিলো সেটা ওর নেই।

যে ছেলেটার সাথে লাবণ্যপ্রভার সম্পর্ক ছিলো সেই ছেলেটাকে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে হওয়ার সুবাদে পার পেয়ে যায়।

আর তুনিড়! লাবণ্যপ্রভা চলে যাওয়ার পর তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় তারই বন্ধুর সাথে। কিছুদিন পর উকিল নোটিশের সাথে সম্পত্তি চেয়ে নোটিশ পাঠায়।

তুনিড় আরও একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু উপরওয়ালা চাইলেন আরও কিছুদিন বেঁচে থাকুক। তাই এই যাত্রায় ও বেঁচে গেল। শুনেছি সোসাইটি থেকেও নাকি বের করে দেয়া হয়েছে তারপর কোথায় আছে সেটা জানিনা।

সেদিন ওইটুকু দেখা হওয়ার পর তুনিড়ের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তবে সে যে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেনি সেটা আমি টের পেয়েছিলাম।

আমার মনে একটা প্রশ্ন আজও আসে সেটা হলো তুনিড় কি আসলে কাউকে ভালোবেসেছিল? হয়তো রুপসা আপুকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু এতো মেয়েদের সাথে যে খেলা খেলল সেটা কি শুধু নিজের শান্তির জন্য! নাকি অন্য কোনো কারন! হতে পারে রুপসা আপু তার প্রথম প্রেম ছিলো আর সেই রুপসা আপু ব্রেকাপ করার কারনেই সে প্রতিশোধপ্রবন হয়েছিল। আবার হতে পারে এটা ওর সবসময়ের স্বভাব ছিলো এর আগে সুযোগ পায়নি কিংবা আমার মতো সুযোগ করে দেয়নি কেউ।

সমাপ্ত,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here