#লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৪৬
সামিরা আক্তার
** চৈতীর সাথে আমার যেদিন সিলেটে দেখা হলো সেদিন আদ্র আরিফ কে বা, বা করছিল। হয়তো অভ্যাসবসতো। আমি এই জন্য ভেবেছিলাম আরিফ আদ্রর বাবা আর চৈতী ওকে বিয়ে করছে।
আশ্চর্যের বিষয় চৈতী এই কথার কোন প্রতিবাদ করে নি বরং নীরব সম্মতি দিয়েছে।
কেন দিয়েছে এটার যুক্তি ও আমি পেয়েছি। ও হয়তো ভেবেছে আফরিন আমার সাথে আছে। আর আদ্র আমার ছেলে জানলে আমি নিয়ে আসতে পারি।
তাই এই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া।
তবে কাল আমার চোখে পড়লো আদ্রর ভ্রুর এই তিলটা।
বলেই আদ্রর তিলটা দেখালো সবাইকে রাফসান। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। কেননা সেদিন সিলেটে তারাও কেউ তিলটা খেয়াল করে নি।
আয়শা বেগম ছো মেরে নাতি কে কোলে নিলেন। বুকের সাথে মিশিয়ে বললেন- আমার দাদুভাই, তোমাকে আমরা চিনতে পারি নি। উল্টো তোমার মা কে বকা দিয়েছি। সে কি মাফ করবে আমাদের??
হঠাৎ করে অচেনা কেউ কোলে নেওয়ায় আদ্র আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাফসান দ্রুত কোলে নিলো ছেলেকে। বাবার কোল পেয়ে আদ্র চুপ করে গেলো।
রাফসান আবার বলতে শুরু করলো- তিলটা দেখার পরই মনে খচ খচ করছিল। কারণ তখনই মনে পড়লো….
বলেই চুপ করে গেলো রাফসান।
– কি মনে পড়লো ভাইয়া??
রাফসান একটু ইতস্তত ছড়িয়ে বললো- হারিয়ে যাওয়ার আগের মাসে চৈতী পিরিয়ড মিস করেছিল। আর যেদিন হারিয়ে যায় সেদিন ওর পড়নে লাল পাঁড়ের একটা সাদা শাড়ি পড়া ছিলো। আমি চৈতীকে বলেছিলাম ও যেন এই শাড়ি টা স্পেশাল ডে তেই পড়ে। তারপর সব কিছু একে একে মিলতেই হিসাব মিলে গেলো।
তারপর আজকে আরিফের ওয়াইফ বললো- আদ্রর বয়স সামনের মাসে ২ বছর হবে অর্থাৎ আদ্র জন্মেছে চৈতী নিখোঁজ হবার সাত মাসের মাথায়..বুঝেছো???
বলেই আদ্রর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাঁসি দিলো রাফসান। তারপর ওকে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। পিছন থেকে রেবেকা বলে উঠলো – আমার চৈতালী??
রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর বললো- কালকের মধ্যে চলে আসবে। আসতে বাধ্য। বলেই ছেলেকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো সে।
পিছনে রেখে গেলো কতগুলো অপরাধী চেহারা। যারা না জেনে না বুঝে চৈতালী কে কথা শুনিয়েছে। কিভাবে চৈতালীর সামনে দাঁড়াবে এটাই ভাবছে তারা।
ঐটুকু মেয়ে, কতকিছু সহ্য করেছে। কত কষ্ট পেয়েছে। কেউ তাকে না বুঝে অপমান করে এলো। এই অপরাধ বোধে সবার দৃষ্টি ঝাপসা। এখন দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই বোধহয়।
**আদ্রকে ঘুম পাড়িয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিলো রাফসান। তারপর আস্তে করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। কাল পর্যন্ত ও জানতো না ওর জীবনের এমন পরিবর্তন হবে। কিন্তু হয়ে গেলো।
আচ্ছা কাল কখন আসবে চৈতী?? তার সাথে কি কথা বলবে? না অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখবে?? উহু রাফসান অভিমান করতেই দেবে না। একদম কলিজার মধ্যে রেখে দেবে।
তাতে যদি এই কলিজাটা ঠান্ডা হয়। তার চৈতী। তার বাচ্চার মা। ভাবতেই কেমন ভালো লাগে। আজ অনেকদিন বাদে রাফসান অনুভব করলো জীবনটা সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর।
** চৈতালী অনেক দিন পর লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি টা বের করেছে। শুধু শাড়িটাই আছে। ভেবছিল এটার আর কোনদিন দরকার পরবে না। কিন্তু কে জানতো আজকের এই দিন আসবে??
চৈতালীর হঠাৎই লজ্জা লাগলো। কাল কিভাবে দাঁড়াবে রাফসানের সামনে??
আর কি আসা হবে শ্রীমঙ্গলে?? আরিফ ভাই, শিউলি ভাবী। কত স্মৃতি এখানে।
** পরদিন আরিফ চৈতালী আর শিউলী কে নিয়ে রওনা হলো টাঙ্গাইলের দিকে। মনটা খারাপ হলো তার আসার সময় তাকে আর শিউলীকে একা আসতে হবে। চৈতালী আর আদ্র তো আসবে না। আদ্র আর তাকে মামা ডাকবে না। আরিফ একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো। জীবন বড়ই অদ্ভুত। একদিন হঠাৎ করেই তার কাঁধে তুলে দিয়েছিল ভাইয়ের দায়িত্ব। আবার আজ হঠাৎ করেই সেই দায়িত্ব থেকে ছুটি দিচ্ছে।
রাফসান ঘুম থেকে উঠে আদ্র কে তুলে রেডি করিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেছে সেই সকাল বেলা। এখন বিকাল গড়িয়েছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। জুনায়েদ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো। রিসিভ করেনি।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠায় রাফসান এসেছে ভেবে দরজা খুলতেই থমকে গেলো আয়শা।
রাফিয়া আয়শা বেগমের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এলো। এসে সে নিজেও থমকে গেলো।
কারণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে চৈতালী। পিছনে আরিফ আর শিউলি।
রাফিয়া কেঁদে চৈতালী কে জরিয়ে ধরলো।
– আমাকে মাফ করে দে বোন। না বুঝে কি না কি বলে ফেলেছি তোকে।প্লিজ মাফ করে দে।
কেঁদে ফেললেন আয়শাও। চৈতালী অপ্রস্তুত বোধ করলো। তাকিয়ে দেখলো আসমাত শিকদার ও ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন।
চৈতালী আয়শার হাত ধরে বললো – কেঁদো না বড় মা। আমার ওসব কিছু মনে নেই। তোমাদের জায়গা আমি থাকলেও হয়তোবা সেম কাজটাই করতাম।
তারপর আসমাত শিকদারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো- তুমি কেন কাঁদছো বড় আব্বু। দেখো আমি ফিরে এসেছি। আর কোথাও যাব না। প্রমিজ।
আসমাত শিকদার জরিয়ে ধরলেন চৈতালী কে।
এর মধ্যেই রেবেকা আসলাম শিকদার সহ শিকদার বাড়ির বাকি সবাই চলে এলো। কয়েক দফা কান্নাকাটি শেষ করে চৈতালী যখন আদ্রর খোঁজ করলো তখন সবার মুখ শুকিয়ে গেলো।
রাফিয়া আমতা আমতা করতে করতে বললো- ভাইয়া সকালে বাবুকে নিয়ে বের হয়েছে। এখন আসে নি।
– ওহ্।
রাফিয়া একটু অবাক হলো চৈতালীর উদাসীনতা দেখে। চৈতালী বোধ হয় বুঝতে পারলো রাফিয়ার মনের কথা। হেঁসে বললো- আমি জানি ওরা কোথায়। তাই বিচলিত হলাম না। বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে।
রাফিয়ার কাছ থেকে এসে আরিফ আর শিউলির কাছে গেলো সে। এই দুইজন মানুষের কাছে সে আজীবন কৃতজ্ঞ। এরা না থাকলে তার কি হতো সে নিজেও জানে না। চৈতালী যেতেই শিউলি চোখ বড় বড় করে বললো- তুই এত বড়লোকের মেয়ে চৈতালী?? জানতাম না।
ওর কথার ধরণ দেখে চৈতালী হেঁসে ফেললো। তারপর বললো- তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?? এই অবস্থায় এত পথ জার্নি করলে।
শিউলি দু পাশে মাথা নাড়লো। আরিফ এসে বললো- কিন্তু তোর জামাই গেলো কই?? আমার ভাগ্নে টাকেও নিয়ে গেছে।
চৈতালী মৃদু হাসলো। তার মন বলছে সে না যাওয়া পর্যন্ত রাফসান আসবে না।
রাফসানের ঘরে আসতেই থমকে গেলো চৈতালী। দেয়ালে তার অনেক গুলো ছবি টাঙানো। চৈতালী মুচকি হাঁসলো। এই মানুষ টা তাকে একটু বেশিই ভালবাসে। সে নিজেও বাসে। অথচ একটু ভুল বোঝাবুঝিতে জীবন থেকে তিন বছর হারিয়ে গেছে।
মনে মনে বললো – কাল সকাল হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। আমি আসছি সেখানে যেখান থেকে আমাদের ভালবাসার গল্প টা শুরু হয়েছিল।
(ক্রমশ)#লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৪৭
# সামিরা আক্তার
** চৈতালী রাফসানের রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই রুমে সে কমই থেকেছে। তাদের ভালবাসার স্মৃতির পুরোটা জুরেই গুলশানের বাড়ি টা। সে জানে আজ রাফসান আদ্র কে নিয়ে ওখানেই আছে।
আচ্ছা রাফসান কি কাল তাকে বকবে??…. কি জানি।
মহা পাজি লোক, ঠিক তাকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিজে ধরা দিচ্ছে না। আগেই বুঝতে পেরেছিল সে আজ আসবে। এজন্যই চলে গেছে ছেলেকে নিয়ে। ছেলেও দেখা যায় আস্ত বেয়াদব। বাপ কে পেয়ে মা কে ভুলে গেলি??
নিশ্চিত রাফসান ঝাড়ফুঁক দিয়েছে। তা না হলে আদ্র না কি কাঁদছেই না।
চৈতালী রুমে এসে রুমের দিকে নজর দিলো। সারা ঘর আদ্রর জিনিস দিয়ে ভরা। বোঝাই যাচ্ছে সাহেব ছেলের জন্য পুরো শপিংমল তুলে এনেছে।
রুম টা গুছিয়ে শুয়ে পড়লো সে। কাল সকালে আসমাত শিকদারের কাছ থেকে গুলশানের বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে রওনা হবে সে। অনেক হয়েছে চোর পুলিশ খেলা।
** পরদিন সকালে চৈতালী গুলশানের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। যদিও আয়শা একটু অমত করেছিল। কারণ তার ধারণা চৈতালী আবার হারিয়ে যাবে।
কিন্তু রাফিয়া তাকে বুঝিয়েছে। তারপর তিনি মেনেছেন।
কারণ চৈতালী আর রাফসানের মান অভিমান ভাঙা জরুরি ।
গাড়িতে বসে চৈতালী হাতে থাকা শপিং ব্যাগটার দিকে তাকালো। ভিতরে লাল পাঁড়ের সেই সাদা শাড়ি টা। সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস। রাফিয়াই গুছিয়ে দিয়েছে। গুছিয়ে দিয়েছে আর মিটিমিটি হেসেছে।
মনে পড়তেই এক দফা লজ্জা পেলো চৈতালী। এই লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি টা সত্যি তার জীবনের ভাল মন্দের সাথে জরিয়ে আছে। আর এই শাড়িটা পড়ার জন্য আজকেই সব চেয়ে উপযুক্ত দিন।
চৈতালীর পৌছুতে ২ টা বেজে গেলো৷ গেট দিয়ে আসার সময় দারোয়ান সালাম দিয়ে অবাক হয়ে বললো- ম্যাডাম সেই যে গেলেন আপনি আইলেন না স্যার ও আর আইলো না। এখন আবার প্রায় তিন বছর পর দুজনেই আইলেন।
চৈতালী অবাক হলো। বললো- এর মাঝে উনি আসেন নাই??
– না ম্যাডাম। এই কালই আইলো। একটা বাবু নিয়া। বাবুটা না কি আপনাগো। এক্কেবারে আপনার মত দেখতে।
চৈতালী মৃদু হাসলো। তারপর উঠে এলো দোতালায়। আস্তে করে চাবি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
সেই ঘর। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল তাদের ভালবাসার গল্প। চৈতালী দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। চারিদিকে ঘুরে দেখলো। আগের মতই আছে। কেউ না থাকলেও যে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা হতো বোঝা যাচ্ছে।
চৈতালী আস্তে করে অন্য রুমে ঢুকে পড়লো। সে জানে রাফসান আর আদ্র ওই রুমেই আছে। কিন্তু কিভাবে রাফসানের মুখোমুখি হবে ভাবতেই অস্বস্তি লাগছে। এতগুলো দিন পর আবার এত কাছাকাছি।
উহু সেদিনও এসেছিল। কটেজে। বৃষ্টির দিন। সেদিনের কথা মনে হতেই আরেক দফা লজ্জা পেলো। সেদিন সে না কাঁদলে রাফসান৷……
উহু ভাবতে পারলো না। তার লজ্জার পারদ এক ডিগ্রি করে বাড়তে লাগলো।
কিন্তু লজ্জা পেলে তো চলবে না। সব ঝেড়ে ফেলে সে শাড়িটা হাতে নিলো।
আজকে নিজেকে সেভাবে সাজাবে। যেভাবে এই শাড়িটা প্রথম পড়ে সেজেছিল।
** বিছানার উপর আদ্র শুয়ে আছে। ঘুমানো অবস্থায়। চৈতালী মাত্রই এই রুমে এসেছে। কিন্তু রাফসান কোথায়?? বারান্দায়??
সে আদ্রর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কপালে চুমু দিলো। ২ দিন পর দেখলো ছেলেকে।
আস্তে করে কোলের সাথে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বললো- বাপ কে পেয়ে মাকে ভুলে গেছেন আব্বা? মার যে খুব কষ্ট হয়েছে। আপনার সাথে আড়ি আব্বা। ঘুম থেকে উঠেন আমি কথাই বলবো না।
আদ্র ঘুমের মধ্যে একটু নড়ে উঠলো। চৈতালী আস্তে করে আবার ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামলো।
নিজেকে একবার আয়নায় দেখলো। কেন জানি তার নিজেরই লজ্জা লাগলো। রাফিয়া কে বার বার বলেছিল হাতা কাটা ব্লাউজ না দিতে। কিন্তু শোনে নি।
সে ধীর পায়ে বারান্দার দিকে গেলো।
রাফসান বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। চৈতালী পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার মুখ থেকে কথা বের হলো না। রাফসান বাইরের দিকে তাকিয়েই বললো- কেন এসেছিস??
চৈতালী অবাক হলো। কিন্তু কিছু বললো না। কিন্তু অনুভব করলো তার হার্টবিট ধীরে ধীরে ফাস্ট হচ্ছে।
রাফসান ওদিকে মুখ করে বললো- কথা বলছিস না কেন?? কি জন্য এসেছিস?? আমি এই তিন বছরে কতখানি জ্বলেপুড়ে খাক হয়েছি সেটা দেখতে??
চৈতালী আমতা আমতা করতে করতে বললো – তাহলে চলে যাব??
ব্যাস সাথে সাথে রাফসান ঘুরে তাকালো। রাফসানের দিকে তাকিয়েই চৈতালী বুঝতে পারলো ভুল জায়গা ভুল কথা বলে ফেলেছে।
রাফসান ঘুরেছিল চৈতালী কে থাটিয়ে দুটো চড় দেবার জন্য। কত বড় সাহস বলে কিনা চলে যাব। এত দিন কষ্ট দিয়ে শান্তি হয়নি। এখন আবার যেতে চায় কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো।
এই মেয়ে নির্ঘাত তাকে দম বন্ধ করে মেরে ফেলতে চাইছে। না হলে এত আবেদনময়ী ভাবে কেউ আসে??
রাফসান একটা ঢোক গিললো। খেয়াল করলো তার সব রাগ আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এমন করলে তো হবে না। রাফসান প্রচুর রাগ করেছে হু।
সে ঠিক করলো চৈতালীর দিকে না তাকিয়ে কথা বলবে।
কিন্তু মন কি আর কথা শোনে?? সে চোখ দুটোকে বার বার বেহায়া হতে বলে।
ওদিকে রাফসানের এরকম হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে লজ্জা পেলেও মিটিমিটি হাঁসছে চৈতালী৷ তার উপর রাগ দেখাবে!! বললেই হলো।
চৈতালীর হাঁসি দেখে মেজাজ খারাপ হলো রাফসানের।।
এই মেয়ে তার উপর মজা নিচ্ছে?? সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো চৈতালীর দিকে। আর চৈতালী কিছু বোঝার আগেই নিজের ঠোঁট জোড়া আবিষ্কার করলো রাফসানের ঠোটের মাঝে।
এভাবে কতহ্মণ পেরিয়ে গেলো জানে না। রাফসান যখন চৈতালী কে ছাড়লো তখন চৈতালী হাঁসফাঁস করছে। রাফসান ওর দিকে তাকিয়ে বললো- হাঁসছিলি না? এটা তার শাস্তি ছিলো।
চৈতালী লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। এত মধুর শাস্তি কেউ দেয় এটা তার জানা ছিল না।
রাফসান চৈতালী কে রেখে ভেতরে আসতেই চৈতালী পিছন থেকে জাপটে ধরলো তাকে। রাফসান দাঁড়িয়ে গেলো। কিছু সময় চুপ থেকে বললো- কেন এমন করেছিলি চৈতী?? কেন ভুল বুঝেছিলি?? কি হতো সেদিন সত্যি মিথ্যা যাচাই করলে??
একটু ভুলের জন্য ৩ টা বছর দুজনেই কষ্ট পেলাম। আমার সন্তান কে গর্ভে বেড়ে ওঠা দেখতে পেলাম না। তাকে জন্মাতে দেখলাম না। জন্মের পর তার ছোট ছোট তুলতুলে শরীর অনুভব করতে পারলাম না। তাকে একটু একটু করে বড় হতে দেখলাম না। একজন বাবা হিসাবে এটা কত কষ্টের তুই জানিস?? তুই নিজেও চলে গেলি। সাথে বাচ্চাকেও। তোর তো বেঁচে থাকার কারণ হিসাবে আদ্র ছিলো। আমার তো সেটাও ছিলো না। নিজে জিন্দা লাশ ছাড়া কিছুই মনে হতো না আমার।
চৈতালী ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নারত অবস্থায় বললো- আমি তেমাকে কোন কিছু ব্যাখা করবো না। কারণ আমি জানি আমি ভুল করেছি। শুধু বলবো আমাকে মাফ করে দাও #লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
# অন্তিম পর্ব
#সামিরা আক্তার
** একটা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জরুরি বিশ্বাস। আর দরকার একে অপরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ। এগুলো থাকলেই মানুষ সেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তোর আমার প্রতি ভালবাসা থাকলেও এইগুলোর কোনটাই ছিল না। যদি থাকতো তাহলে ওইরকম একটা ডিসিশন নেবার আগে দুবার ভাবতি।
কারণ তুই তো জানতি আমাদের ভালবাসার উপহার হিসাবে আদ্র আসতে চলেছে।
এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলো রাফসান। চৈতালী তখন নিঃশব্দে কাঁদছে।
কিছুহ্মণ চুপ করে থেকে ওকে বুকে জরিয়ে নিলো সে। তারপর বললো- জীবনের এই তিক্ত অধ্যায় টা কে আমরা এড়িয়ে যাই চৈতী। মনে কর খুবই বাজে একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো।
চৈতালী কান্না থামিয়ে রাফসানের মুখের দিকে চাইলো। রাফসান ওর দু চোখের পাতায় দুটো চুমু দিয়ে বললো
– আমি একদমই রেগে নেই তোর উপর চৈতী। হ্যাঁ রাগ হয়নি সেটা বলবো না। হয়েছিল। তবে এই ছোট্ট পুতুল টা আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য তোর সাত খুন মাফ।
বলেই ছেলের কপালে একটা চুমু দিলো রাফসান।
– শুধু নিজের কষ্টের কথাই বললে, আমি ও তো কষ্ট পেয়েছি তোমাকে ছাড়া। ওই মেয়েটাকে তোমার সাথে হোটেল রুমে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল
তাই….
– তাই তুই গায়েব হয়ে গেলি রাফসান শিকদারের জীবন থেকে তাই তো??
চৈতালী মাথা নিচু করে ফেললো। রাফসান ওকে জরিয়ে ধরে বললো- আচ্ছা যা প্রথমে তুই আমাকে ভুল বুঝেছিলি তার আমি তোকে। শোধবোধ।
ওই প্রসঙ্গ বাদ। কিন্তু তুই কাল থেকে এখন পর্যন্ত যে অন্যায়গুলো করেছিস তার শাস্তি কিন্তু পেতেই হবে।
চৈতালী একটা ঢোক গিললো। কাল থেকে আবার সে কি করছে?? কই মনে পড়ছে না তো। আমতা আমতা করতে করতে বললো – কি করেছি।
রাফসান এবার চৈতালী কে পিছন থেকে জাপটে ধরে ওর কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো- প্রথমত আপনি কাল এসেছেন ম্যাডাম। আর আজ আমাদের বাপ বেটার কথা আপনার মনে পড়লো??
এটা হ্মমার অযোগ্য। আর….
– আর কি?? প্রশ্ন করলো চৈতালী।
এবার রাফসান আগের থেকে দ্বিগুণ আস্তে বললো- আর এই যে আমাকে ঘায়েল করা সাজ সেজেছেন। যার দরুন আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হার্ট এট্যাকের সম্ভবনা। এটার শাস্তি ও পেতে হবে।
চৈতালী রাফসানের কথার ধরণে লজ্জায় মিইয়ে গেলো। এভাবে কেউ বলে??
ওর ভাবনার মাঝেই রাফসান ওকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজে কাছে নিয়ে এসে জড়ানো গলায় বললো- আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত চৈতী। তোর ভালবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত। শাস্তি স্বরুপ আমার এই তৃষ্ণা মিটানোর দায়িত্ব তুই নে।
শুধু আজকের না আজীবনের।
চৈতালী মাথা নিচু করে ফেললো। আজ আর সে রাফসানের চোখে চোখ রাখতে পারবে না। আশ্চর্য সে ষোল বছরের কিশোরীর মত লজ্জা পাচ্ছে কেন। ভাবতে ভাবতে খেয়াল হলো রাফসান তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
এত কাছে যে একজন আরেক জনের শ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে।
রাফসান যখন চৈতালীর মাঝে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে তখনই পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো – বাবা।
রাফসান ছিটকে সরে এলো। -কি সাংঘাতিক ছেলে । একদম বাপের রোমান্টিক মুহূর্তে এন্ট্রি নিয়েছে। কেন আব্বা? আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি??আর কিছুহ্মণ ঘুমালে কি হতো?? আদ্র কে কোলে নিতে নিতে বললো রাফসান।
চৈতালী খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। মায়ের হাঁসির শব্দ শুনে বাবার কথাকে পাত্তা দিলো না আদ্র। দুই দিন পর মাকে দেখে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের হাঁসির সাথে তাল মেলালো।
স্ত্রী পুত্রের হাঁসির দিকে তাকিয়ে রাফসানের নিজে কে সুখী মনে হলো। ভয়ংকর রকমের সুখী।
** পরদিন ওরা শিকদার ভিলায় ফিরে এলো। ওরা আসতেই শিকদার ভিলায় উৎসব শুরু হয়ে গেলো। অতীতের তিক্ত স্মৃতি কে যেন সবাই এক সাইডে সরিয়ে দিলো।
রাফসান আরিফ কে জরিয়ে ধরে বললো- আমার বাবা মায়ের পর আমি যদি আর কারো কাছে ঋণী হয়ে থাকি সেটা তুমি। যেই ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। আর শোধ করতে চেয়ে তোমাকে ছোট করার মত ভুল আমি কোনদিন করবো না। শুধু বলবো আমার স্ত্রী সন্তান কে আগলে রাখার জন্য ধন্যবাদ।
আরিফ মৃদু হাসলো। তারপর বললো- চৈতালী আমার নিজের বোনের মত। মত নয় বোনই। আমি শুধু ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। তাই এসব সিরিয়াস প্রসঙ্গ এখন থাক। চলো আনন্দ করি।
এর মধ্যেই চৈতালী ওদের তারা দিলো৷। ছবি তোলা হবে। ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব জুনায়েদ কে দিয়েছে রাফিয়া। এতে তার অবশ্য মন খারাপ। তবে স্ত্রীর সিধান্ত মেনে নিয়েছে সে।
রাফসান কে হাঁসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রকে কোলে নিয়ে ওর কাছে এলো চৈতালী। তারপর ওর একটা হাত মুঠের মধ্যে নিয়ে বললো- এবার থেকে এভাবেই ভালো থাকবো আমরা। প্রমিজ।
রাফসান হাঁসলো। একজন সুখী মানুষের হাঁসি।
(সমাপ্ত)
(