শর্ত পর্ব – অন্তিম

#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#অন্তিম পর্ব(১ম খন্ড)

দেখতে দেখতে আটটা মাস কেটে গেলো।রাতের পেট বেশ ফুলে গেছে।শিশিরের যত্নে আস্তে আস্তে রাতের গর্ভে বেড়ে উঠছে শিশির আর রাতের ভালোবাসার প্রতীক।এদিকে সায়ান যে রাতকে জ্বালাচ্ছে এমনটাও কিন্তু নয়। সেও যেন নতুন বনু আসার সুবাদে মায়ের খেয়াল রাখছে।শিশির যত খেলনা তাকে এনে দেয় তার অর্ধেক রেখে দেয় তার পিচ্চি বোনের জন্যে। রাত হাসে আর বলে,

-“সায়ু, বনুর জন্যে তোর এত আয়জন?”

-“হবে না?আমার বনু পরীর মত হবে।বাবাই বলেছে। আর পরীদের তো রাণীদের মত করে রাখতে হয়। অনেক সুন্দরীও হয়। তাই না মাম?”

-“হুম একদম তোর মত। তুই রাজকুমার।আর তোর বনু রাজকুমারী।”

সায়ান গাল ভর্তি করে হাসে। মায়ের পেটে কান পেতে নিজের বনুর আনাগোনা অনুভব করে।রাতকে তেমন কাজ করতে দেয় না চৈতী বেগম আর শিশির।তাই রাত ঘরেই থাকে। সিড়ি দিয়েও বেশি উঠা-নামা করে না।রাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলের টবে পানি দিচ্ছে।রাতের বাবা-মা গ্রামে চলে গেছেন কয়েকমাস আগেই।রাত তেমন কথা বলে না তাদের সাথে। নিজের মেয়ের সাথে এমন স্বার্থপরতা করার দাগটা তার মনে রয়েই গেছে। চৈতী বেগমের সাথেও যে বেশি কথা বলে এমনটাও না।কিন্তু পরকে বলে আর কি লাভ যেখানে নিজের বাবা-মা ই মেয়ের সাথে এমন করলো।শিশিরও আর কিছু বলেনি। পিতা-মাতা আর সন্তানের মধ্যে গিয়ে সে কি করবে? তার যতদূর বোঝানোর ছিল বুঝিয়েছে। রাতের রাগটা কমেনি তার মা-বাবা আর শ্বাশুড়ির উপর থেকে। কিন্তু সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টায় আছে এত বড় ধোকাটা মেনে নিতে তার কষ্ট অবশ্য হচ্ছে।বাসায় সে একা।সায়ান বিছানায় বসে ড্রয়িং করছে।শিশির গেছে রাত আর সায়ানের জন্য চিপস আইসক্রিম আনতে।চৈতী বেগম একটু আগেই বের হলেন কিছু জিনিস কিনতে। আপাতত বাসা খালি।রাত দোলনায় বসে বসে ভাবতে লাগে,

-“আচ্ছা,মিতালি আপু যে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল যে উনি আবার ফিরবেন।এটা কেন বলেছিলেন? আজ ১ বছরেরও বেশি হচ্ছে।বেশ সুখেই তো আছি আমরা।আল্লাহ আমাদের বেশ সুখেই রেখেছেন।”

রাত উঠে দাঁড়ালো।রুমের দিকে যেতে যেতে ভাবলো,

-“ওনাকে থাকতে দেয়ার কারণটা জেনে ছিলাম।কিন্তু ওনার ফিরে আসার পিছনে কি কোনো কারণ নেই?অবশ্যই রয়েছে!উনি যদি পালিয়েই যাবেন তাহলে ফিরবেন কেন?”

ভাবতে ভাবতে রাত বিছানায় বসে পড়লো।সায়ান মাকে বসে দেখে গলা জড়িয়ে বললো,

-“মাম তুমি ঠিক আছো?পানি দিবো?”

রাত মুচকি হেসে বললো,

-“না আব্বু আমি ঠিক আছি। তুমি বরং একটু পানি খাও তো। দেখো কত্ত গরম।এক গ্লাস পানি খেয়ে দেখাও তো।”

সায়ান তার মাকে দেখাতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেতে লাগলো। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।রাত ভাবলো,

-“নিশ্চয়ই শিশির অথবা মা এসেছেন।”

ভেবেই রাত দরজার দিকে এগিয়ে যায়।সায়ান বলতে লাগে,

-“মাম তোমাকে তো বাবাই বেশি হাঁটতে নিষেধ করেছে।”

-“দেখি কে এসেছে।তোমার বাবাই আসতে পারে।তুমি পানিটা শেষ করো।”

সায়ান মাথা নাড়ালো।সে তার মায়ের সব কথা শোনে।
রাত আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।দরজাটা খুলতেই পরিচিত মুখ দেখে চমকে উঠলো রাত।ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আপনি!”

দরজার ওপাশে থাকা মিতালি শয়তানী হাসলো। রাতের বড় হয়ে থাকা পেটের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“ভিতরে ঢুকতে দিবে না?”

-“অবশ্যই না।এখন আমার বাসায় আমার স্বামী আর শ্বাশুড়ি নেই।তাই আপনি পরে আসুন।”

বলেই রাত দরজা লাগাতে নিলো।কিন্তু হাত ধরে ফেললো মিতালি। হালকা হেসে বললো,

-“নেই বলেই তো এসেছি রাত।শুনলাম তুমি নাকি প্রেগন্যান্ট।”

রাত কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।মিতালি রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“একটু কথা বলেই চলে যাবো।”

-“আমি ঢুকতে দিতে পারছি না সরি।”

-“প্লিজ রাত।”

রাত দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। মিতালি ঢুকে পড়লো।পড়নে তার সাদা টপস আর জিন্স।রাত সোফায় বসলো আর মিতালিও।রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“যা বলার একটু জলদী বলবেন প্লিজ!”

-“হ্যা বলছি।”

-“জ্বী।”(বিরক্ত হয়ে)

-“রাত,তুমি আমার বারংবার ফিরে আসার কারণ জানতে চাও?”

রাত কিছু বললো না। এটা তো তার বরাবরেরই প্রশ্ন।মিতালি বুঝলো হয়ত। নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে বললো,

-“নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।”

-“জ্বী জানতে চাই।চাওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?”(দাঁতে দাঁত চেপে)

-“হ্যা স্বাভাবিক।”

-“আপনি পালিয়ে গেছিলেন। তাহলে আবার কেন ফিরে এসেছিলেন?আর আজ কেন এসেছেন?”

-“আজ কেন এসেছি সেটা পরে জানতে পারবে কিন্তু আগে কেন এসেছিলাম এটা জানতে চাইবে না?”

-“জ্বী?”(ভ্রু কুঁচকে)

-“তো শোনো, শিশির, আমি আর নুশান যে ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ডস এটা তো জানোই।কিন্তু এর আগেও কলেজে শিশিরকে আমি চিনতাম।এবং আমার বোন তুলিও একই কলেজে পড়ত। আমাদের থেকে দুই বছরের জুনিয়র ছিল।আমরা ছিলাম সবচেয়ে সিনিয়র।তুলি যে শিশিরকে পছন্দ করত এটা আমায় ও বলেছিল। শিশিরের জন্যে চিঠিও দিতো।”

এতটুকু বলেই থামলো মিতালি। রাত মিতালির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতুহল নিয়ে। নতুন চরিত্র তুলিকে বোঝার চেষ্টা করছেমিতালির মুখের রং মুহূর্তেই বদলে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“কিন্তু ওই শিশির!আমার বোনকে বাচ্চা বলে একবার অপমান করে।কিন্তু তবুও তুলি মানে না।আমি শিশিরকে কখনো জানতে দিইনি যে তুলি আমার বোন।তুলি শিশিরকে পুরো কলেজের সামনে প্রপোজ করে বসে।আর শিশির সেটা খুব সুন্দর করে রিজেক্ট করে আর ব’লে, তুমি এখনও বাচ্চা মেয়ে তুলি। তোমার ক্যারিয়ার পড়ে আছে।”
তারপর আমার বোনটা..আমার বোনটা ভীষণ কষ্ট পায়।”

-“আমার তো শিশিরের কাজে কোনো ভুল নজরে পড়ছে না। সে তো তুলিকে পড়াশোনা করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলো সেটা আপনার করার কথা।”

মিতালি রেগে গেলো।টেবিলে বাড়ি দিয়ে বললো,

-“ফা*ক!ওর উৎসাহ চায়নি কেউ। তুলি শুধু ওর ভালোবসা চেয়েছিল।কিন্তু ওর রিজেক্ট করার পর তুলি সুইসাইড করে।এতে শিশিরের কোনো মাথাব্যাথাও ছিল না। সে তখন বলেছিল,মেয়েটাকে আমি বুঝিয়ে ছিলাম। ওর পিরো লাইফ পড়ে ছিল। নিজের লাইফ নিজে নষ্ট করেছে।”

-“এক্সেক্টলি!”

-“না না না!!লাইফটা ও নিজে নষ্ট করেনি। করেছে শিশির নিজে। কি হত যদি তুলিকে একসেপ্ট করতো?”

-“আপনি নিজের বোনকে বুঝ না দিয়ে ওকে আরো এসবের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।”

বলেই রাত মুখ ঘুরিয়ে নিলো।মিতালি রাতের এই কথাটায় পাত্তা না দিয়ে বললো,

-“সেদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করি যে শিশিরের লাইফটা আমি নিজের হাসে শেষ করব।তাতে নিজের সম্মান যাবে, যাক।তাই আমি শিশিরকে বিয়ের পর নুশানকেও ফাঁসাই। নুশানও আমাকে ভালোবাসতো।ওর সাথে পালিয়ে যাই। এসে শিশিরের সম্মান যাবে আর শিশির সুইসাইড করবে। এটাই ভেবেছিলাম আনি।কিন্তু না!রাত তুমি!তুমি এসে আমার পুরো প্ল্যান টা ভেস্তে দিলে।তাই আমি আবারো এসেছিলাম তোমাকে শিশিরের থেকে দূরে সরাতে। যেন এটার পর শিশির গুমড়ে গুমড়ে মরে যায়।কিন্তু তোমার শরীর আর বুদ্ধি!দুটোরই শক্তি বেশি। আমাকেই সরিয়ে দিলে!”

রাত এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিলো। তার সব প্রশ্নের জবাব সে পেয়ে গেছে। একটা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মিতালি নিজের ছেলেটাকেও কষ্ট দিলো।রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আপনার যা প্রাপ্য আমি আপনাকে তাই দিয়েছি। এখন দয়া করে বলবেন যে কেন এসেছেন? এসব গল্প বলতে এসেছেন?”

মিতালি উঠে দাঁড়ালো। আর সথে রাতও। মিতালি রাতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

-“এখন তোমার শেষ কুয়েশ্চন! যে আমি কেন এখন এসেছি।”

রাত পিছাচ্ছে। মিতালি বাঁকা হেসে বললো,

-“শিশিরকে সুখে থাকতে দিবো আমি রাত? এতই সহজ?”

-“ক..কি বলছেন আ..আপনি! ”

মিতালি কষে একটা চড় মারলো রাতকে। রাত ডাইনিং টেবিলে ছিটকে পড়লো।পেটে হালকা ব্যাথা পেয়েছে। পেটটাকে ধরে বললো,

-“মিতালি প্লিজ আপনি চলে যান।”

মিতালি রাতের চুলে গোছা ধরে বললো,

-“এত সোজা?১ টা বছর অপেক্ষা করেছি।তক্কে তক্কে রয়েছি কখন তোকে সরানোর সুযোগটা পাবো।আজ বাসায় কেউ নেই।আজ আমি সুযোগটা পেয়েছি।”

বলেই মিতালি রাতকে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। রাত চিৎকার করে উঠে।ঠিক তখনই পিছন থেকে সায়ান বলে উঠে,

-” মাম?”

রাত সায়ানকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভাবে, মিতালি তো এখন রাক্ষসী রূপে আছে।যদি ছেলেরও ক্ষতি করে দেয়?সে কাতরাতে কাতরাতে বলে,

-“আব্বু তুমি ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও।”

সায়ান এই প্রথম হয়ত মায়ের কথা শুনলো না। এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

-“কি হয়েছে মাম তোমার?”

মিতালির দিকে তাকিয়ে বললো,

-“এই পঁচা আন্টি কিছু করেছে?”

এদিকে মিতালি তার সেই বড় হয়ে যাওয়া সায়ানকে দেখছে যাকে সে ছেড়ে চলে গেছিল।মিতালি হাঁটু গেড়ে বসে বললো,

-“আমিই তোমার মাম সোনা!তুমি আমায় ভুলে গেছো?রাত তোমাকে চুরি করেছে আমার থেকে।”

সায়ান রাতকে জড়িয়ে ধরে মিতালিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

-“একদম চুপ করো।পঁচা ডাইনী একটা।আমার মামকে কষ্ট দিচ্ছো।চলে যাও এখান থেকে।”

-“গেলে তোকে নিয়েই যাবো।”

বলেই মিতালি সায়ানকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করলো।সায়ান তল সায়ানই।বাবার মত বড্ড জেদী সে।সে টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুঁড়ে মারলো জিদে। মিতালি রেগে সায়ানের দিকে আসতেই তার পায়ে কাঁচ ঢুকে গেলো। মিতালি চিৎকার করে বসে পড়লো।তার আর দাঁড়ানোর শক্তি নেই।এদিকে কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে! তারমানে শিশির এসে গেছে। রাত পেট চেপে ধর উঠার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারছে না। সায়ান মায়ের এই অবস্থা দেখে কাঁদছে। রাত মনে মনে ভাবছে,

-“মিতালিকে ঢুকতে দেয়াটাই আমার সব থেকে বড় ভুল আর বোকামি।”

তারপর আস্তে আস্তে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেলো। আর ধীরে ধীরে রাত সায়ানের কোলেই মাথা এলিয়ে দিলো। সায়ান তো অঝোরে কাঁদছে আর মিতালিকে বারবার বলছে,

-“আমার মামকে কষ্ট দিলা। তোমার কখনো ভালো হবে না। আল্লাহ তোমায় অনেক পাপ দিবে।”

দরজা ধাক্কা দিতে দিতে একসময় শিশির দরজাটা ভেঙে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু রাতকে এমতবস্থায় দেখে তার যেন নড়বার শক্তি নেই!!

__________

হাসপাতালে ক্রমাগত পায়চারী করছে শিশির। চৈতী বেগমকে জড়িয়ে ধরে সায়ান কাঁদছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। শিশিরের মাথা কোনোমতেই কাজ করছে না।মিতালিকে পুলিশে দপয়া হয়েছে। যে কাজটা শিশিরের আগেই করা চিত ছিল। মিতালি সবটা স্বীকারও করেছে।শিশির এখন শুধু দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে একটা জিনিসই চাইছে,

-“আল্লাহ তুমি দয়া করে আমার রাতকে ফিরিয়ে দাও।তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না আমি৷ ওর তো কোনো দোষ নেই।সবসময় আমাদের কথা ভেবে এসেছে। এত ভালো মানুষটার সাথে তুমি খারাপ হতে দিও না।”

শিশিরের ভাবনার মাঝেই ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“আপনি রাত চৌধুরীর হাসবেন্ড?”

শিশির চোখ মুছতে মুছতে বললো,

-“জ্বী আমি।রাত কেমন আছে?আর আমাদের বেবি?”

ডাক্তার মাথা নিচু করে বললেন,

-“উনি পেটে ব্যাথা পেয়েছেন। আমরা চেষ্টা করছি তবে আমার মনে হয় বেবি নয়ত মা দুজনের মধ্যে একজনকে বাঁচাতে হবে।আর তাছাড়া ওনার এখনো ডেলিভারী ডেট আসেনি।কিন্তু তবুও আমাদের ওনার ডেলিভারী করতে হবে।”

-“আমি দুজনকেই চাই। যত টাকা লাগে দিবো।”

-“বিষয়টা টাকার নয় মিস্টার চৌধুরী।আচ্ছা আমরা চেষ্টা করছি।বাকিটা আল্লাহ’র ইচ্ছে।”

শিশির ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে আবারো ঢুকে গেলেন।শিশির কি ভেবে চৈতী বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“মা আমি নামাজে যাচ্ছি। একমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।”

বলেই সে যেতে নিলো।পিছনে থেকে সায়ান বাবার হাত ধরে বললো,

-“বাবা,আমিও যাব।আমার মাম আর বনুকে চাইবো আল্লাহর কাছে।”

শিশির সায়ানকে কোলে নিয়ে নিলো।আল্লাহ কি সায়ানের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিবেন?শিশিরের মাথায় এখন নানান চিন্তা। তার রাত বাঁচবে তো? ফিরে আসবে তো তাদের মাঝে?রাতের হাসি মুখটা ভাসছে শিশিরের চোখে…
#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#অন্তিম পর্ব(শেষ খন্ড)

৪ বছর পর….
______________________________
বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাজ করছে রাত।আচমকা পেটে কারো হাতে স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে সে।কিন্তু স্পর্শ টা পরিচিত লাগায় আর কোনো রিয়াকশন দেয় না।মুচকি হেসে বলে,

-“কলেজে কখন যাবে?”

শিশির রাতকে নিজের সাথে মিশিয়ে বলতে লাগে,

-“ধূর দেরী আছে।”

-“দেরী নাই।”

বলেই সে নিজেকে শিশিরের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।শিশির ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

-“ইয়ার,এই মহিলাটা মুড নষ্ট করতে এক্সপার্ট।”

রাত কাপড় গুলো আলামরিতে রাখতে রাখতে চোখ বড় বড় করে বলে উঠে,

-“এই মহিলা কাকে বললে?নিজে কি? বুইড়া ধামড়া একটা।”

শিশির রাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-“হ্যা তুমি তো পরী। আমি নাহয় বুইড়া।”

রাত আড়চোখে তাকালো একবার।শিশিরের মনোভাব ভালো ঠেকছে না। শিশির রাতকে খপ করে ধরে ফেলার আগেই রাত সরে গেলো।তারপর চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“একটু পরেই সায়ান আর শিরাত আসবে।একদম এসব চলবে না।”

-“ওরা আসতে দেরী আছে রাত।”

শিশিরের অসহায় মুখটাকে পাত্তা দিলো না রাত।মুখ ভেংচি কেটে বললো,

-“তুমি কি কলেজে যাবেনা?”

শিশির রাতের হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো।হাত দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,

-“এত সুন্দর পরী রেখে তো কোথাও যেতে মন চায়না গো।”

রাত শিশিরকে চিমটি কেটে বললো,

-“সারাদিন তো কত কচি কচি পরীদের ভিরে থাকেন।জানি না আমি?”

-“ওরা তো ছাত্রী।”

-“আমিও ছাত্রীই ছিলাম।”

বলেই রাত শিশিরের হাতে একটা বাড়ি দিলো।শিশির আবারো রাতকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“আজ যেতে হবে না কলেজে।”

-“জানতাম!না যাওয়ার বাহানা।যেন তিনজন মিলে আমায় জ্বালাতে পারেন।”

-“নাহ,ভালোবাসা দিতে পারি।”

বলেই শিশির রাতের গালে শক্ত এক চুমু খেয়ে বসলো।রাত কেঁপে উঠলো।শিশিরের শক্ত হাতের উপর হাত রেখে বললো,

-“লিভ মি।”

শিশির শুনলো না।রাতকে জড়িয়ে ধরে রইলো।ঠিক তখনই কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকলো চার বছরের ছোট্ট শিরাত।রাত আর শিশিরের একমাত্র মেয়ে।হ্যা,চার বছর আগে আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে রাত আর শিরাত দুজনই বেঁচে যায়।মিতালি এখনো জেলে রয়েছে। নুশান পুলিশি ঝামেলা করতে চেয়েছিল কিন্তু লাভ হয়নি।রাত শুধু নুশানকে উদ্দ্যেশ্য করে একটা কথাই বলেছিল,

-“কার জন্যে এত করছেন নুশান?যে শিশিরকে ছেড়ে আপনার কাছে যেতে পারে সে কি আপনাকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে যেতে পারে না?”

নুশান সেদিন চুপচাপ বাসায় চলে যায়। হয়ত কিছুটা তার মাথায় ঢুকেছে।হয়ত সে মিতালির পিছু ছেড়ে নিজের কাজে ফোকাস করবে।নুশান এখন বিদেশে রয়েছে। তার আর মিতালির ডিভোর্সও হয়েছে।মিতালি অনেকবার রাতের সাথে দেখা করতে চেয়েছে আর মাফও চেয়েছে কিন্তু রাত না দেখা করেছে আর না মাফ করেছে। এই পাপের কি আদৌ ক্ষমা হয়?সেদিন যদি আল্লাহ না বাঁচাতেন তাহলে আজ রাতই বা কই থাকত আর শিরাতই বা কই থাকত।তাছাড়া সায়ান মিতালিকে ভালোই জব্দ করেছিল। নয়ত রাতের আরো ক্ষতি হত।তাইত আজও সে জেলের ভাত খাচ্ছে।ভেবেই রাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মেয়ের কান্না দেখে শিশির রাতকে ছেড়ে দিলো।দ্রুত মেয়ের কাছে গিয়ে কোলে নিয়ে বললো,

-“কি হয়েছে প্রিন্সেস,তুমি কাঁদছো কেন?”

বোনের কান্না শুনে সায়ানও দৌড়ে এসেছে। রাগী গলায় বলছে,

-“কে কি করেছে বনু?কাঁদছিস কেন?”

রাত মুখ টিপে হেসে বললো,

-“এইযে এলেন বোনের রক্ষা কবজ।”

৮ বছরের ছোট্ট সায়ান তো বেশ গম্ভীর আর রাগী।সে শিরাতকে উদ্দ্যেশ্য করে আবারো বললো,

-“বল বনু!”

শিরাত কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

-“নতুন আন্টির ছেলে আবির ভাইয়া আমায় মেরেছে।”

-“কিহ!আবিরের এত্ত সাহস!”

বলেই সায়ান বের হয়ে গেল। রাত তো সায়ানের রাগ সম্পর্কে অবগত। সে ব্যস্ত গলায় বলতে লাগে,

-“নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করেছে তোমার মেয়ে শিশির। হয়ত আবিরকেও মেরেছে আর তাই আবিরও মেরেছে।এখন সায়ান যে কি করবে আবিরকে!আমি ওকে আটকাতে গেলাম।”

বলেই রাত ছুট লাগায়। শিশির শিরাতকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে রুম থেকে বের হচ্ছে আর বলছে,

-“মাম্মা তুমি কি আবিরকে মেরেছো?”

শিরাত কিছুক্ষণ চুপ করে বাবার গলা জড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে,

-“তুমি কাউকে বলবে না তো?”

-“একদম না!”

-“আমি না ওকে কামড় দিয়েছি হাতে।”

শিশির বুঝে গেলো।মায়ের পুরো কার্বন কপি হওয়া শিরাতই আবিরকে কে ক্ষেপিয়েছে।তবুও মেয়ের মুখ থেকে কথা বের করতে সে বলে,

-“কেন মেরেছো মাম্মা?কি করেছে ও?”

-“আমায় চকলেট দেয়নি।”

-“আমি না তোমায় কত দিই? তবুও ওর থেকে নিতে হয়?”

-“ওটা ইয়াম্মি ছিল।”

শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মেয়েকে নিয়ে আবিরদের বাসার সামনে হাজির হলো।রাত সায়ান আর আবিরকে থামাচ্ছে।আবিরের মা নাতাশা বলছে,

-“ভাবী থাক,আবিরকে আমি বকে দিবো।বাচ্চাদের এভাবে মারে কেউ!”

আবির মাকে রাগী গলায় বলে,

-“ও আমায় কামড়েছে মাম্মি।”

নাতাশা চোখ রাঙায়। সায়ান আবিরকে ঘুষি দিয়ে বলে,

-“একদম আমার বোনকে কিচ্ছু বলবি না।আমার বনু সবচেয়ে ভালো।ও কখনো ভুল করতেই পারে না।আমার রাজকুমারী ও। আরেকবার ওকে মারলে হাতটাই ভেঙে দিবো।”

বলেই সে শিরাতের হাত ধরে ঘরের দিকে চলে যায়।শিরাত পিছনে ফিরে আবিরের দিকে তাকায়। আবির রাগে ফুঁসছে। শিরাত ভেঙালো তাকে।চোখ এড়ায় না শিশিরের।বিরবির করে বলে উঠে,

-“এ তো পুরোই মায়ের সব।”

রাত নাতাশার সাথে সব মিটমাট করছে।বুঝাচ্ছে যে ছেলে ছোট আর করবে না।শিশির মাথা চুলকে বলে,

-“মা -মেয়ে আর ছেলে একই রকম।গুন্ডা টাইপ।আমিই ভালো মানুষ।”

রাত শুনে ফেললো।চোখ ছোট ছোট করে তাকালো শিশিরের দিকে।শিশির জোরপূর্বক হাসলো।

____________________

সায়ান আর শিরাতের ছোট্ট রুমের বিছানায় বসে আছে রাত।সায়ান আর শিরাত দুজনই দুদিক থেকে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।শিশিরও রাতের কোমড় জড়িয়ে রাতের কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে।রাত সায়ান আর শিরাতকে বিভিন্ন গল্প শোনাচ্ছে।একসময় সায়ান তার মাকে প্রশ্ন করে,

-” মাম,রাজকুমারীর বিয়ে হয়ে গেল?”

-“হ্যা। তারপর তারা সুখে-শান্তিতে রইল।”

-“কিন্তু রাজকুমারী তো বিয়ের পর চলে গেলো তার বরের সাথে।”

শিশির হেসে সায়ানের গাল টেনে বললো,

-“যেতেই হয়। যেমন তোমার মাম এসেছে।তোমার দাদু এসেছেন।”

-“তাহলে কি বনুও চলে যাবে মাম?”

সায়ানের এমন প্রশ্নে শিশির আর রাত মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।সায়ান তার মায়ের আচল ধরে বললো,

-“ও মাম বলো না!”

-“হ্যা।যাবেই তো।বনুর জন্যে রাজকুমার আসবে।”(মুচকি হেসে)

সায়ান ভ্রু কুঁচকে বললো

-“একদম না। আমি আমার বনুকে কোথাও যেতে দিব না।এহ,কোথাকার কে এসে কিনা আমার বনুকে নিয়ে যাবে।”

বলেই সে ঘুমন্ত শিরাতকে জড়িয়ে ধরলো।শিশির মুখ টিপে হাসতে লাগলো।রাত শিশিরকে চোখ রাঙায়।সায়ানের মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-“এমন বলে না আব্বু। সব মেয়েকেই একদিন যেতে হয় পরের বাড়ি।”(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

শিশির ঘুমন্ত শিরাতের কপালে চুমু দিয়ে বললো,

-“হ্যা,শিরাতের জন্যেও রাজকুমার আসবে।”

সায়ান শিরাতকে আগলে বললো,

-“আমি আমার বনুর জন্যে বেস্ট রাজকুমার আনবো। ওয়ার্ল্ডের বেস্ট থাকবে একদম।যে আমার বোনকে আমার মত খেয়াল রাখবে।চকলেট দিবে।কিন্তু ওকে কেউ বাজে কিছু বললে একদম মেরে তক্তা বানিয়ে দিবো।”

বলেই সায়ান ফোঁস ফোঁস করতে লাগে।রাত আর শিশির শুধু একে-অপরের দিকে তাকায়।সায়ান যে তার বনুকে ভালোবাসে এটা তারা জানতো কিন্তু এতটা যে ভালেবাসে আজ সেটা তারা উপলব্ধি করছে।ভাইয়ের এমন ভালোবাসা যে পায় সে তো খুব ভাগ্যবতী!তেমনি শিরাতও!

🖤

শিশিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে রাত। রাত্রি বাজে হয়ত তিনটা।দীর্ঘ ভালোবাসাময় মুহূর্তের পর শিশিরের উম্মুক্ত বুকেই রাতের শান্তি লাগে।শিশির রাতের খোলা চুলে হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,

-“রাত,তোমার আম্মু -আব্বুর সাথে কথা বলো না কেন?”

-“…”

-“আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে বলে?এত বাজে আমি রাত?”(মুচকি হেসে)

রাত শিশিরের মুখ চেপে ধরে বললো,

-“একদম না।আমার তাদের কর্মকান্ডের উপর রাগ।তাদের স্বার্থপরতার উপর রাগ।”

-“তোমাকে ওই বাজে ছেলেটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই বিয়েটা দেয় রাত।নয়ত দিতো না।কোন বাবা-মা নিজের মেয়েকে এক বাচ্চার বাপের হাতে তুলে দেয়?”

রাত শিশিরের বুকে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

-“বাদ দিন তো।ভালো লাগছে না।”

বলেই সে উঠে বসলো।শিশির রাতকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“এবার অন্তত সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত।”

-“হুম।”

রাত চুপ করে রইলো।এ বিষয়ে সে আর কথাই বলতে চায় না। শিশির আবার বললো,

-“আমাদের সায়ানকে দেখলে? আমরা মরে যাওয়ার পরেও বোনকে আগলে রাখবে।”

-“হুম। ওর ভরসায় আমরা শিরাতকে রেখে যেতে পারব।”

-“একদম”(হেসে)

-“রাত?”

-“কি?”

-“তোমার হাসিটার প্রেমে পড়ে গেছি।ভালোবাসি। আমাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না প্লিজ!”

বলেই সে রাতকে ঝাপটে ধরলো।রাত হাসলো।আর ভাবলো,

-“শেষ #শর্ত টা আবারো জিতলাম।

ভেবেই সে শিশিরকে নিয়ে ঠাস করে বিছানায় পড়ে গেলো।জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর রাতের এই শেষ #শর্ত জেতা দিয়েই গল্পের সমাপ্তি।সবশেষে সে তার ভালোবাসাকে নিজের করেই নিলো।শিশিরও নিজের সাদা-কালো জীবনে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান পেলো।
.
এদিকে সায়ানের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় ভয়ংকর এক সপ্ন দেখে। তার বনুকে আবির তার থেকে নিয়ে নিচ্ছে।সায়ান ভয় পেয়ে যায়।শিরাতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। সায়ান শিরাতের মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-“আমার বোনকে নেয়া এতই সহজ? ৩টা বড় বড় #শর্ত দিয়ে তবেই না আমি আমার বোনকে দিবো।”

ভেবেই সে হাসলো। বোনের শরীরে চাদর দিয়ে দিলো। এখানেই কি গল্পের ইতি নাকি নতুন কোনো গল্পের সূচনা?

______________________________ সমাপ্ত
____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here