#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৪
আজ শাকিরার বিয়ে, এতগুলো বছর পর প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাবে সে কিন্তু পরিক্ষা শেষ করে বেরিয়ে সাজতে যাওয়ার সময় থেকেই মনটা কেমন যেন করছে তার। তার মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক নেই। বিয়েটা ঠিকঠাকভাবে হবে না খুব তাড়াতাড়ি। তার মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সেই বিপদটা কি!
সাজ যখন প্রায় কমপ্লিট তখন শাকিরা নিহানকে কল করে। নিহান তখন রাস্তায়, আর কিছুটা পথ বাকি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠকে বাইক থামিয়ে সাইডে দাঁড়ায়। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে শাকিরা কল করেছে। কল রিসিভ করে বলে, ” আমি প্রায় চলে এসেছি, তুই যে নাম বলেছিলি পার্লারের ওখানেই আছিস তো তাই না?”
” হ্যাঁ ভাইয়া ওখানেই আছি। কতক্ষণ লাগবে তোমার আসতে?”
” দশ থেকে পনেরো মিনিট। তোর হয়েছে সাজ?”
” প্রায় শেষ , তুমি আসতে আসতে হয়ে যাবে।”
” হ্যাঁ তাড়াতাড়ি নে, রায়হান হয়তো চলেই এসেছে বরযাত্রী নিয়ে। ”
” হ্যাঁ হ্যাঁ মনে করিয়ে দিতে হবে না। ওরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”
” হ্যাঁ আসছি।”
” ওহ শোনো, শুভ্রতা কি বাড়ি গিয়েছে?”
” দেখা হয়নি। হয়তো চলে গিয়েছে।”
” ওহ, ঠিক আছে এসো তুমি।”
” হুম।”
নিহান ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে। গাড়ি চালানোর সময় ফোন আসাটা খুব বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। ফোন পকেটে রেখে যাত্রা শুরু করে দেয়।
কয়েক মিনিটের মাঝে পৌঁছেও যায় শাকিরার কাছে। পার্লারের সামনে বাইক থামিয়ে শাকিরাকে কল দিলে শাকিরা বাহিরে চলে আসে। শাকিরা এসে নিহানের বাইকে উঠতে যায়। শাকিরার সাথে আরেকজন এসেছে তার জিনিসপত্রের ব্যাগ ধরে আছে। শাকিরা বাইকে উঠলেই সেটা তার কোলের ওপর দিয়ে দিবে। এমন সময় নিহান বলে ওঠে,
” এই আপনি কে, আমার বাইকে উঠছেন কেন?”
শাকিরা কোমরের দুইপাশে দুই হাত দিয়ে রাগের ভঙ্গিতে বলে, ” আমাকে চেনা যাচ্ছে না?”
” চেনা যাবে! কে আপনি?”
” ভাইয়া….”
নিহান হাসতে হাসতে বলে, ” আচ্ছা আচ্ছা ওঠ, মজা করছিলাম আমি।”
শাকিরা বাইকে উঠে বসলে নিহান বাইক চালানো শুরু করে। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। একটু পরেই হয়তো রাত হয়ে যাবে। ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় নিহান রাস্তার পাশেই মসজিদটায় গিয়ে ইফতার করে নামাজ আদায় করে আবার বের হয়েছিল শাকিরার উদ্দেশ্যে।
” আচ্ছা ভাইয়া, তোমরা বিয়ে করছো কবে?”
শাকিরার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় নিহান। তোমরা বলতে কি বুঝালো শাকিরা! তবে কি শাকিরাও জানে শুভ্রতার ব্যাপারে!
” কি হলো? কিছু বলছো না কেন?”
” তোমরা মানে?”
” তুমি আর শুভ্রতা, তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না? আমি সব জানি, তোমার চেয়ে বেশি কিছু।”
” তাই নাকি? কি জানিস শুনি?”
” শুভতা তোমাকে ভালোবাসে, এটা তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি।”
শাকিরার কথায় বাইক থেমে যায়। নিহান আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” শাকিরা কি বলছিস? শুভ্রতা আমাকে ভালোবাসে মানে? তুই কীভাবে জানতে পারলি?”
” বাইক চালাও, আমি বলছি। ”
নিহান আবারও বাইক চালানো শুরু করে। শাকিরাকে বলে, ” বল এবার।”
” শুভ্রতা বিয়েটাই করেছিল একটু চাপে পড়ে। ইমতিয়াজ ভাইয়া সারাক্ষণ ওকে পেইন দিতো। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি করত। কিছুর থেকে কিছু হলে গালাগালি অবধি করত। আবার এসব থেকে বাঁচতে যদি শুভ্রতা ব্রেকাপের কথা বলত তখন ইমতিয়াজ ভাইয়া সুইসা*ইড করতে চলে যেত। ভয় দেখাতো সে মা*রা গেলে শুভ্রতাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে যাবে। শুভ্রতাও ওকে ভালোবাসতো তাই সব সহ্য করে নিতো। বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শুভ্রতা। তখন থেকেই ডিভোর্সের কথা ভেবেছে সে কিন্তু নানারকম কারণে হয়ে ওঠে নি। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সাথে আসলেই থাকা যায় না। বিয়ের পর বেশিরভাগ সময়ই শুভ্রতা এই বাড়িতে কাটিয়েছে। বিয়ের সময় তোমার সাথে ওর কথা হয়েছিল সে কী কান্না! তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করে অনেক কান্না করেছে মেয়েটা আমি নিজে দেখেছি কিন্তু ওর তখন কিছু করার ছিল না। শুভ্রতা তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, সে ঠকবাজ উপাধি পেতে চায় নি। ভেবেছিল ইমতিয়াজ হয়তো বিয়ের পর ঠিল হয়ে যাবে, এটাই ছিল ওর ভুল সিদ্ধান্ত। ”
” আমার প্রতি ভালোবাসাটা তুই দেখলি কোথায়?”
” গত দুই মাসে। ও একপ্রকার তোমার থেকে পালিয়ে বেড়ায় যেন তুমি ওর অভ্যাস হয়ে না যাও।”
” আমি নিজেই তো ওর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি তাহলে ওর কীসের ভয়?”
” ও মূলত এখন ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে চাইছে। সেদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে নিহান ভাইয়া তোকে কতদিন ধরে পছন্দ করে আর তুই এখনো ‘না’ করে যাচ্ছিসই? তখন শুভ্রতা বলেছিল পছন্দ তো হয়তো আমিও উনাকে করি কিন্তু আমি এখনই আর সংসারে ঢুকতে চাইছি না। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছি। আমি জানি উনার মতো হয়তো আর কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমি উনার থেকে কিছু সময় চাইব যদি উনি দেয় তাহলে আমি ভালো একটা জীবন পাব আর যদি অপেক্ষা না করে তাহলে আরেকটা মানুষকে আমি আর আমার জীবনে জড়াবো না। এই কথায় বোঝা যায় না ভাইয়া? শুভ্রতা কেমন যেন হয়ে গেছে, আগের মতো একদম নেই।”
নিহান আর কথা বাড়ায় না। কারণ সে নিজেও সেদিন শুভ্রতার চোখে নিজের জন্য মায়া দেখেছে। সে মায়া কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। একসাথে থাকলে তো কুকুর বিড়ালের প্রতিও ভালোবাসা, মায়া জন্মে আর সে তো মানুষ!
~~
ফাউজিয়া ফোন হাতে নিয়ে বারবার শুভ্রতাকে কল করে যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না। ফোন রিং হয়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় সাহিল স্যারকেই সে কল করবে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে কল দেয়া উচিৎ হবে কী-না! না দিয়েও তো উপায় নেই সমস্যাটার সমাধান সে কিছুইতেই করতে পারছে না অথচ প্রশ্নটা আগামীকাল পরিক্ষায় আসতেও পারে৷ তাই সে আর দ্বিধা না করে সাহিল শেখকে কল করেই ফেলে।
সাহিল শেখ বসে বসে বই পড়ছিলেন। কফি নিয়ে বসেছিলেন হুমায়ুন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ বইটা শেষ করার জন্য কিন্তু এখনো অনেকটা বাকি। সুপ্রভার মৃ*ত্যুটা কেমন যেন খারাপ লাগা সৃষ্টি করেছে। এত তুচ্ছ বিষয়ের জন্য কেউ এমন করে!
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় বইটা বন্ধ করে কলটা রিসিভ করে।
” কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে ফাউজিয়া বেশ জড়তা নিয়ে বলে, ” স্যার আমি ফাউজিয়া।”
” ফাউজিয়া! কিছু হয়েছে? আন্টি ঠিক আছেন?”
” জি স্যার। একটা বিষয় জানার ছিল।”
” হ্যাঁ বলুন।”
” স্যার আপনার কাছে কি বই আছে?”
” কোন বই, ক্লাসের?”
” জি স্যার।”
” না, বই তো বাসায় নিয়ে আসি না।”
” তাহলে কীভাবে জিজ্ঞেস করি স্যার!”
” তুমি বিষয়টা বলো, দেখছি আমি সাহায্য করতে পারি কী না!”
ফাউজিয়া প্রশ্নটা বললে বেশ সাবলীলভাবে সেটার উত্তর সাহিল শেখ ফাউজিয়াকে বুঝিয়ে দেয়। কথা শেষ করে ফাউজিয়া ফোন রেখে দেয়। রান্নাঘরে চলে যায় এক কাপ চা বানানোর জন্য। পড়ার সময় এক কাপ চা খুব প্রয়োজন তার।
~~
ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের পিছনের সাইডে মেয়েদের ছেলেদের হোস্টেল। সিনিয়ররা প্রথমবর্ষের দুইটা ছেলেকে ডেয়ার দিয়েছে অর্থনীতি বিভাগের ডানে যে পুকুরটা আছে ওখানে একদমে সাতটা ডুব দিয়ে আসতে হবে। পর্যবেক্ষণের জন্য আরো দুজনকে সাথে পাঠানো হবে। যে দুজনকে ডেয়ার দেওয়া হয় তারা একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে রওয়ানা দিয়ে দেয়। পিছে পিছে আরও দুজন আসছে তারা ডেয়ারটা সম্পূর্ণ করে কি না সেটা দেখতে।
চারজন হেটে চলেছে, হোস্টেলের সিড়ি বেয়ে নেমে পিছন সাইডে চলে যায় তারা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে একে একে চারজন প্রাচীর টপকে বাহিরে চলে যায়।
ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে থেমে যায়। বিল্ডিংয়ের একদম শেষ মাথায় কোণার দিকে একটা পুরোনো ঘর আছে। পাশাপাশি দুইটা রুম, এদিক দিয়ে কেউ তেমন যাওয়া আসা করে না। ওদিকে মেয়েলি গলায় কেউ চিৎকার করছে। ঘর পুরোনো, অনেকদিন ধরে ওরকমই রাখা আছে। ওখান থেকে চিৎকারের শব্দ আসার কথা না। চারজন রাস্তায় থেমে যায়, চারজনের মনোযোগই সেদিকে। এখন কান্নার শব্দ আসছে, কেউ কাঁদছে। শরীর পুরো ভারী হয়ে আসে তাদের। এগোনো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। সবার মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
” ক কে রে ওখানে বল তো?”
একজন শুকনো ঢোক গিলে বলে, ” আ আমি জা জানি না। ”
” তোরা যা ভাই ডেয়ার সম্পূর্ণ কর নইলে রাতের খাবার পাবি না। ওখানে যা আছে আছে, সেটা তোদের ভাবতে হবে না। ”
” ওই পথ দিয়েই তো যেতে হবে ভাই। যদি ভূ*ত হয় তাহলে?”
” আমারও যে ভয় লাগছে না এমন না। কি ওখানে ওমন করছে বল তো!”
” আমাদের ভয় দেখানোর জন্য কাউকে পাঠানো হয়নি তো?”
” মাত্র সন্ধ্যা পার হয়েছে, এশার আজান এখনো দেয় নি। এই সময় ভূ*ত থাকার কথা নয় তো। আর এমনিতেও এখন রমজান মাস, ভয়ের কিছু থাকারও কথা না।”
” আচ্ছা চল, এখান থেকে এক দৌঁড়ে পুকুরপাড় চলে যাব। কোথাও কোন থামাথামি নেই।”
” ঠিক আছে। ”
সবাই সম্মতি জানিয়ে একসাথে জোরে দৌঁড় দেয়। ঘরটার সামনে দিয়ে দৌঁড় দিয়ে পার হতেই ঘর থেকে শব্দ আসে দরজা ধাক্কানোর।
” কেউ আছো? বাঁচাও প্লিজ, আমার এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে এখান থেকে বের করো না প্লিজ। কে যাচ্ছো এদিক দিয়ে, প্লিজ বাঁচাও আমাকে।”
#চলবে……