#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব_১৪
#আলিশা
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কিছু বাসা দেখে নিলাম। ভাড়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে। আসার পথে আরো কিছু বাসা দেখলাম। মোটামুটি দু’টো পছন্দ হলো। কিন্তু সমস্যা হয়ে দেখা দিলো টাকা। মদথা ভার্তি ভাবনা নিয়ে রওনা হলাম ভার্সিটিতে। আজ শুধু প্রিয়ার সাথে দেখা হলো। নীলিমা আর শান্ত, সজীব কেউই ছিলো না। দু’জনে ক্যান্টিনে বসে ছিলাম বিরস মুখে। প্রিয়ার নাকি বড্ড মন খারাপ। কারণ তার পেটে দানা পানি কিছু নেই। টাকা যে ওর কাছে নেই এমনটাও না। ওর অতিরিক্ত মানষিক পীড়ায় খাবার চিবোনোর শক্তি নাকি গায়ের হয়ে গেছে। আর তার সংবিধানের নিজস্ব কিছু নিয়মের মাঝে নাকি লেখা আছে, অতিরিক্ত টেনশন প্রহর চলা কালীন সময়ে খাওয়া দাওয়া করা যাবে না।
— টেনশনটা কি নিয়ে?
নিজের পীড়া ঠেলে পাশে সরিয়ে দিয়ে প্রিয়ার পীড়া শোনার জন্য আগ্রহ দেখালাম। প্রিয়া টেবিলে কনুই রেখে মাথার ভর ছেড়ে রেখেছিল হাতের তালুতে। আমার প্রশ্নে সোজা হয়ে বসলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল
— আম্মুর জ্বালায় আর বাঁচতেছিনা। আবার বিয়ে নিয়ে আসছে। আমি কতবার বলছি আমি হঠাৎ করে সংসার পাততে পারবো না। আগে প্রেমে পরতে চাই৷
— তো পর? বসে আছিস কেন?
— কাউরে দেখেই মনে সাইরেন বাজে না কচু।
— যত্তসব ঢং!
আমার রাগ মিশ্রিত কথায় প্রিয়ার তেমন ভাবান্তর হলো না। সে তার মনের সাদ ব্যাক্ত করতে ব্যাস্ত হলো। তার ইচ্ছে হঠাৎ কাউকে দেখে সে থমকে যাবে। বুক ধড়ফড় করবে। সেই মানুষটা সামনে এলে সে পৃথিবীর অন্য সব ভুলে যাবে। তার চোখে চোখ রাখার সাহসটা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু হায়! বেচারি এমন কাউকে এখন অব্দি খুঁজে পায়নি।
— ঐ খই, ঐ
টেবিলে মাথা রেখে চোখটা বন্ধ করেছিলাম। হঠাৎ প্রিয়ার ডাক। আমি অবস্থার কোনো রূপ পরিবর্তন না করে বললাম
— হুম
— তুই না হসপিটালে যেতে চেয়েছিলি। চল যাই।
প্রিয়ার কথায় হঠাৎ মনে পরে গেলো আমার হসপিটালে যেতে হবে। হাতের ছেঁকা খাওয়া জায়গাটুকু কালো হয়ে গেছে। ফুলে আছে এখনো। ডাক্তার দেখাতে চেয়েছি।
— চল।
.
ভর দুপুরে দু বান্ধবী রিকশা নিয়ে হসপিটালে পৌছে গেলাম। টিকিট সংগ্রহ করে নিয়ে আমি যে ঘরে পৌছালাম সেখানে অঙ্কন ছিলো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই। তবে পরক্ষণেই আবার ভাবলাম সে একজন ডাক্তার। থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অঙ্কন বেশ ভালো ট্রিটমেন্ট করার চেষ্টা করলো আমার। সেই সাথে ব্যাস্ত হয়ে গেলো নাস্তার ব্যাবস্থা করার জন্য। আমি বারণ করে দিলাম। কিন্তু সে আমার কথা গ্রাহ্য করলো না। কফির জোগাড় করে বসলো। প্রিয়া আর আমি না চাইতেও তার আপ্যায়ন গ্রহণ করলাম। এরই মাঝে হঠাৎ আগমন ঘটলো স্মরণের। বিষয়টা হুট করেই। সে আমাকে দেখে যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো। তার মুখটা ভার হলো। আমি তার মুখ ভার হওয়ার রহস্য খুঁজে পেলাম না। শুধু দ্রুত রওনা হলাম বাড়ির পথে।
.
আছরের ওয়াক্ত পেরিয়ে গেলো। সূর্য রওনা হয়েছে পশ্চিম আকাশে। আজ জয়নব খালার আসলো না। এক সপ্তাহ হলো সে এ বাড়ি ছেড়ে অন্য আরেক বাড়িতে ভাই নিয়েছে। কাজকর্ম সব আগেরই মতো এখানেই করে। তবে বাবা তাকে একটু খানি জায়গা দিয়ে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সে এই সংসারের জন্য অনেক কিছু করেছে। বলতে গেলে নাকি আত্মা দিয়ে ধরে রেখেছে এই সংসার। তাই এই সামান্য একটুখানি বাবা কৃতজ্ঞতার থেকে করে দিয়েছেন। সব মানুষের মনেই তো একটু আশা থাকে নিজের একটা ঘর থাকবে। একটা বাড়ি থাকবে। জয়নব খালা তার ব্যাতিক্রম হবে কেন?
খালার অনুপস্থিতে আমিই রান্না বসিয়ে দিলাম। ভাত আর বড় মাছের ঝোল করলাম। ছোঁয়ার জন্য খিচুড়ি। কিছুটা ভয় মনে চেপে বসলো। স্মরণ স্মরণ খাবে কিনা বড় মাছ। পূর্বে একদিন খালা বড় মাছের ঝোল করেছিল। সে খায়নি। সে নাকি বড় মাছ খায় না। কিন্তু আজ আমি এই মাছ ব্যাতিত ফ্রিজে অন্য কিছু পাইনি। শুধুই বড় মাছ ছিলো। মাংসটাও শেষ হয়ে গেছে আজ সকালে। মনে এক রাশ চিন্তা নিয়ে রান্নার কাজ সমাপ্ত করলাম। অতঃপর বাবাকে চা বানিয়ে দিয়ে এসে নিজের ঘরে আদায় করে নিলাম মাগরিবের নামাজ। একবার ছোঁয়ার ঘরে উঁকি দিতে গেলাম। মেয়েটা একা আছে কিনা। কিন্তু নাহ! স্মরণ এসে পরেছে। ছোঁয়া বিছানায় বসে পড়ায় মগ্ন। আর তাকে দেখলাম সোফায় বসে বন্ধ চোখে ভাবনায় হাবুডুবু খেতে। সুন্দর মুখশ্রীতে চিন্তার তরতাজা ছাপ। পরখ পর্যায় শেষ করে ঘরে চলে এলাম। ঘড়ির পানে দৃষ্টি রাখতেই দেখি সাতটা বেজে গেছে। এটা এবাড়ির রাতের খাবারের সময়। আবারও ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে খাবার সাজাতে ব্যাস্ত হলাম। বাবা বলেছিল আজ দেরিতে খাবে তাই ওনার ঘরে আর এগোলাম না। সব খাবার টেবিলে সাজিয়ে অপেক্ষায় রইলাম স্মরণের আসার। সেই সাথে অপেক্ষা কিনা কি বলে তা শোনার। একটা সময় অপেক্ষার অবসান হলো। স্মরণ এসে টেবিলে বসেই জিজ্ঞেস করলো শুকনো মুখে
— খালা আসেনি আজ?
— নাহ।
সে এরপর আর কথা বাড়ালো না। আমি একে একে তাকে ভাত, মাছ দিলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো সে নীরব রইলো। আলগোছে শান্ত হয়ে খাবার মুখে দিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সে খাচ্ছে। বিরস মুখ। ভাবটা আজ গম্ভীর নয়। বড্ড শান্ত।
— অঙ্কনের কাছে গিয়েছিলেন যে?
আমি তার ভাবগতি ধরতে পারছি না। আজ সে এতোটা নির্লিপ্ত কেন? আবার আমার সম্পর্কে খোঁজ?
— আমার হাতের ক্ষতটা আছেই… তাই ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।
— ওহ আচ্ছা।
এরপর নীরবতা। আমি লক্ষ করলাম স্মরণ এক লোকমা ভাত মুখে দিলে দু ঢোক পানি পান করছে। হঠাৎই সে ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে উঠে পরলো। আচমকা আমাকে বলল
— এরপর আর অঙ্কনের কাছে ট্রিটমেন্টের জন্য যাবেন না।
আমি তার কথার বিপরীতে আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলাম
— কিন্তু কেন?
আগুনে যেন ঘি দিলাম আমি। স্মরণ কড়া মেজাজ দেখিয়ে বলল
— আমি বললাম তাই।
— কিন্তু সে তো আপনার বন্ধু।
— আমি অস্বীকার করেছি? আমি বলেছি ও আমার বন্ধু নয়?
আমি স্মরণের কথার বিপরীতে কিছু বললাম না। শুধু কিছু না বুঝে দেখে গেলাম স্মরণকে। তার হুটহাট রেগে ওঠার কারণ খুঁজে পেলাম না। ছোঁয়ার জন্য খাবার গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে চলে এলাম।
সেদিনটা এভাবেই কাটলো। পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাঁধলো বিপত্তি। বাবা হঠাৎ জেরা করলেন আমাকে। আমি প্রত্যহ কোথায় যাচ্ছি। থতমত খেয়ে যাই আমি। বলে দিলে কি বাবা রাগ করবেন? এমন ভাবনা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বের মুহূর্ত পেরিয়ে অবশেষে বলে দিলাম আমি চাকরি করছি। বাবা অবাক হলেন। কারণ জানতে চাইলে বললাম আমার আর তার ছেলের সম্পর্ক টিকবে না। জোর করে তার সাথে সংসার করার ইচ্ছে আমার নেই। তাই আলাদা হওয়ার পথ খুঁজছি। বাবা নিশ্চুপ ছিলেন। অতঃপর আর বাঁধা দেননি স্কুলে যাওয়ার পথে। কিন্তু একথা শুনে নিয়েছিল স্মরণ। সে যে কখন বাবার রুমের দরজার ওপাশে দাড়িয়ে ছিল তা আমার অজানা। শুধু ঘর থেকে বের হওয়ার পথে তাকে দেখে আমি চমকে উঠি। অতঃপর পাশ কাটিয়ে চলে যাই।
.
দেখতে দেখতে দু’টো দিন পেরিয়ে গেলো। বাবা নীরব হয়ে গেলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে স্মরণের মুখোমুখি পরা হয়না আমার। ছোঁয়া জানে না কিছু। কাল আমার বাড়ি ওয়ালাকে এডভান্স দিতে যাওয়ার কথা। আজ স্মরণের সাথে কিছু কথা বলার আছে আমার। তার ঘরের দরজার এপাশে দাড়িয়ে কথাগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিলাম।
চলবে….#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১৫
বিবস মন নিয়ে মিনিট দুয়েক অকারণে সময় নিলাম স্মরণের দরজায় টোকা দিতে। রাত বেশ গভীর। মধ্যরাত পেরিয়ে শেষ দু প্রহরের অন্তপ্রান্তে রাতের সীমা। কিছুটা ভাবনা, কিছুটা দুঃখ আর এই৷ অল্প একটু অভিমান ললাটের প্রতি। এসব জড়ো করে অবশেষে দরজায় করাঘাত করলাম। ওপাশ হতে কেউ বলল সেকেন্ড দুয়েকের মাঝে
— দরজা খোলা আছে। ভেতরে আসুন।
আমার বুকটা ঢিপঢিপ ছন্দ তুলল। সে কি জানতো আমি আসবো? ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। স্মরণ বিছানায় বসে আছে। বিশৃঙ্খল বাসার ধরণ। একহাঁটু ভাজ করা অপর পা সোজা রাখা। ডান হাতের আঙ্গুল গুলো বিচরণ করছে তার চোখ ও কপালে। আমি হুট করে কিছু বলে ওঠার প্রস্তুতি নিতেই সে আচমকা আগ বাড়িয়ে বলল
— দুদিন আগে বাসা ঠিক করেছেন, কাল টাকা দিতে যাবেন আর দু’দিন পর চলে যাবেন। এটাই তো?
আমি চমকে না উঠলেও তার আচমকা বলা কথায় অবাক হলাম। সে ততক্ষণে মাথা তুলে চাইলো। পুনরায় বলল
— এটাই তো বলবেন তাই না?
হিম কন্ঠ। আমি আজ মনকে শক্তপোক্ত করে বেড়ি দিলাম। ভয়ের যে এক সুপ্ত দলা বুকে লুকিয়ে থাকে তাকে আজ বন্দি করলাম খাঁচায়। কোনো রূপ জড়তা ভীরুতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বললাম
— হ্যা এটাই। আর একটা কথা। সরি। আপনাদের ঘরে এতোদিন বোঝা হয়ে থাকার জন্য। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। অথৈয়ের শাড়ি অধিকার না থাকা সত্ত্বেও পরার জন্য, ঐ দিন আপনার পিছু নেওয়ার জন্য। সরি ফর এভ্রিথিং। এক্সকিউজ মি ইফ পসিবল।
আমার এতোগুলা কথার কবলে পরে স্মরণ যেন দিশা হারিয়ে ফেলল। কিছুসময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর যেন আমি দেখলাম তার চোখে অসহায়ত্ব।
— আসছি। দোয়া করি মেয়েকে নিয়ে অনেক ভালো থাকুন।
স্মরণ নিশ্চুপ রইলো। আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। সে বিদায় মুহূর্তেও নির্লিপ্ত। এতো নিষ্ঠুর কেন সে? এতো কেন পাথুরে হৃদয় তার! বেপরোয়া চোখে অশ্রু চলে এলো। হুড়মুড় করে বেড়িয়ে আসতে চাইলাম তার ঘর থেকে। ঠিক করে নিলাম এই মুহূর্তে, শুধু রাতের আঁধার পেরিয়ে সূর্যের উঁকি দেওয়ার অপেক্ষা। অতঃপর খুব ভোরে, পাখিদের প্রভাত কলরবের পূর্বেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো আমি। অশ্রুভেজা ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে হাটাছিলাম এমন ভাবনা মনে চেপে। হঠাৎ হোটচ খেলাম যেন। খেই হারিয়ে সম্মুখের আলমারির কোণাতে পা লাগলো। প্রায় পরছিলাম। তৎক্ষনাৎ সামনের দরজা ধরে সমলে নিলাম নিজেকে। পেছন থেকে ভীতু গলার আওয়াজ এলো
— আস্তে…
স্মরণ হুটোপুটি খেয়ে নেমে পরলো বিছানা থেকে। কয়েক কদম ব্যাস্ততার সাথে হেঁটে এসে আমাকে শুধালো
— ঠিক আছেন তো?
— এর চেয়ে বড় বড় ধাক্কায় ঠিক ছিলাম, ঠিক আছি। আর এটাতো সামান্য। আমি ঠিকঠাক।
বুকের যখন এক চিলতে শুকনো হাসিতে লুকিয়ে বলে দিলাম কথাটা। স্মরণ প্রতিত্তোরে করলো না। আমিও তার উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম না। সাধ্য মতো দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলাম তার সম্মুখ হতে।
.
জীবনের সব হিসাব নিকাশ আজ ধামাচাপা দিলাম। কি পেয়েছি আর কি পাইনি এসব আজ মাথায় না এনে রাতের শেষ তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটালাম। ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়। খুব আফসোস হলো। ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গেলো। চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম রান্না ঘরের পানে। সাড়ে আটটায় স্কুল। রান্নাঘরে জয়নব খালা রুটি বেলছিলেন। ছেঁকে নিলাম গোটা সাতেক। ইতিমধ্যে খাবার টেবিল হতে নিয়ম মাফিক ডাক পরলো আমার। কেউ ভীষণ মিষ্টি করে ডাক দিলো
— মাআআ? মাআআআ?
ভালোই ছিলাম এই ডাক শ্রবণ করার আগে। কিন্তু এখন হঠাৎ মনে বাসা বেধে নিলো আবেগ। ছোঁয়ার ডাকের সাড়া দিতে গিয়ে অনুভব করলাম আমি স্বাভাবিক নেই। গলা দিয়ে কথা আসতে নারাজ। চোখ টলোমলো। এখনই যদি আমি ডাকে সাড়া দেই তবে তা কান্না হয়ে প্রকাশ পাবে। ইশ! এই ডাকটা আর দু’দিন পর কেউ নিয়ম করে ডাকবে না। আর কেউ রোজ রাতে আমার নিকট এসে বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে অবস্থান করবে না।
— তুমি কানতেছো বউ?
অণুক্ষণের চিন্তায় সব ছেড়ে ভাবনা জগতে পারি দিয়েছিলাম যেন। খালার ডাকে হুঁশ হলো। তড়িৎ গতিতে চিকচিক করা চোখ মুছে নিলাম। থতমত ভাবটা কাটাতে পারলাম না। আড়ষ্টতা নিয়ে খালাকে বললাম
— কই৷ না তো? কাঁদিনি।
— কি ইইছে বউ? স্মরণ কিছু কইছে? জামাই বউয়ের মধ্যে টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়ই। এই নিয়ে মান করতে নাই, মা।
আমি মুচকি হাসলাম খালার কথাতে। তার ঘরে এখন অব্দি এক রাতও অতিবাহিত করতে পারিনি। কথা-কাটাকাটি, আবার এ নিয়ে মান করা তো অনেক অনেক দূরের কথা।
— আমি দুই দিন পর চলে যাচ্ছি খালা। ছোঁয়ার খেয়াল রাখবেন। নিজেও সাবধানে চলবেন।
— ও কি কথা? কই যাবা?
— বেশি দূর যাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই খালা। শুধু চোখের আড়াল পর্যন্ত দূরে যাচ্ছি।
আমার কথার পিঠে খালা কিছু ব্যাক্ত করতে উদ্দ্যত হলো। কিন্তু সে সুযোগ আমি দিতে বড্ড কৃপাণতা করলাম। প্লেটে দু’টো রুটি আর ডিম ভাজি নিয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে প্রস্থান পথ ধরলাম। মুখে বললাম
— ছোঁয়া বোধ হয় খাবার চাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি।
.
দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিলাম। যদিও কাল রাতে মনস্থির করেছিলাম খুব দ্রুত চলে যাবো এবাড়ি ছেড়ে কিন্তু তা হয়ে উঠলো না অধিক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অপরাধে।
আজ হয়তোবা ভাড়া নেওয়া বাসায় ঠাঁই হবে না। চিন্তা নেই। দু’টো রাত প্রিয়ায় বাসায় কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসে। দিনে স্কুল আর ভার্সিটি আছে। শুধু চিন্তা ছোঁয়ার জন্য। তাকে কি বলে বিদায় জানাবো? বাচ্চা মেয়েটা অনেকখানি আমার মায়ায় বাঁধা পরেছে। আমি হয়তোবা ওর অভ্যাসের কিছু জায়গা জুড়ে আছি।
— ছোঁয়ার জন্য থেকে যেতে পারিস না?
বাবার কন্ঠ। আমি পেছন ফিরে চাইলাম। একটা লাঠি হাতে বাবা ভর করে চলে এসেছেন আমার ঘরে। ওনার ফিজিওথেরাপি চলছে। ক্রমে ক্রমে উনি সুস্থ হয়ে উঠছেন।
— আমি ছোঁয়ার সাথে দেখা করবো বাবা। ও মাঝে মাঝে আমার কাছে গিয়ে থেকে আসবে।
— আমার কিছু বলার নেই।
— দূরে গেলে ভালোবাসা বাড়ে। ছোঁয়া হুট করে একদিন আমার কাছে যাবে। ও ভীষণ খুশি থাকবে তখন।
বাবা আমার যুক্তিতে কেবল অসহায় দৃষ্টিতে চাইলেন। মুখে কিছু বললেন না তিনি। আমার দৃষ্টি অধোগামী হয়ে গেলো। বুকে সুক্ষ্ম ব্যাথার জোয়ার উঠলো। মিনিট তিনেক পেরোতেই বাবা আমার ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। আমি উদাসীন হয়ে বসে রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম ছোঁয়ার স্কুলে যাওয়ার। ওকে আমি কি বলে বিদায় নেবো তা ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তবুও বলার মতো কিছু খুঁজে পাইনি।
আমার অপেক্ষার অবসান হলো ন’টা বাজার দশ মিনিট পূর্বে। ছোঁয়া চলে গেলো স্কুলে। সে স্কুলের জন্য বিদায় নিতে এসেছিল আমার কাছে। আমি মনে মনে তাকে তার অজান্তে বিদায় দিলাম আমার জীবন থেকে।
পাঁচটা শাড়ি দিয়ে পূর্ণ করা ব্যাগটা টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে হাজির হলাম। জয়নব খালা আমার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। আমি মিহি সুরে খালাকে বললাম
— বাবাকে একটু ডেকে দেবেন খালা?
খালা আপত্তি করলো না। ছুটে চলে গেলেন বাবার নিকট। যাওয়ার আগে জানতে চাইলেন দুঃখী কন্ঠে
— না গেলে হয় না বউ?
আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম
— একদমই হয় না খালা। জোর করে সংসার হয় না। দু’টো মানুষের মনে শান্তি থাকে না। সুখ পাওয়া যায়। শুধু বিসুখের অস্তিত্ব থাকে। তার চেয়ে ঢের ভালো কেউ থাকতে না চাইলে তাকে ছেড়ে দেওয়া।
চলবে….
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)