শেষ_বিকেলের_মায়া (২৪-স্পেশাল পর্ব)

0
546

#শেষ_বিকেলের_মায়া (২৪-স্পেশাল পর্ব)

তখন কেবলমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। ফারিহা আজ সারাদিন রান্না ঘরে ছিল। নিজ হাতে রিহানের সব পছন্দের খাবার রান্না করেছে। রিহান অফিস থেকে এসে দেখল ফারিহা গোসল করল সবে। ছেলেটা কপট রাগ হলো। চোখ মুখে যা দৃশ্যমান।

“তোমায় বলেছিলাম,লেট করে গোসল করবে না।”

“একদিন ই তো।”

“এভাবেই শরীর খারাপ করবে।”

“রাগ করছেন কেন?”

“ধ্যাত।”

রিহান ধপাস করে বেডের উপর বসল। ফারিহা চুল থেকে তোয়ালে সরিয়ে রিহানের নিকটে এল।

“কত দিন পর দেশে এসেছি বলেন তো। রান্না করতে ইচ্ছে হলো। ভাবলাম,আপনার সেবা করি একটু।”

“কে বলেছে এসব করতে? ঘাম ঝরিয়ে ওনি সেবা করতে এসেছেন।”

“রিহান,এমন করে কেন বলছেন? আমি শখ করে করতে পারি না?”

রিহান জবাব দিল না। ছেলেটা প্রতিনিয়ত অবাক হয়। একটি মেয়ে এত দিক কীভাবে সামলাচ্ছে। রিহানের মনে পড়ে এক যুগ আগের ঘটনা গুলো। ফারিহার সাথে তার বিয়ে হলো। সব কেমন ঘোরের মধ্যে। রিহান সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝে ঐ মুহূর্তে মেয়েটির হাত কতটা প্রয়োজন ছিল। তারপরের কিছু সময় রিহানের মনে হয়েছে ফারিহার সাথে অন্যায় হলো। কিয়া নেই বিধায় সে ফারিহার কাছে এসেছে। ভালো না বেসে কেমন করে সংসার হবে। তবে ওর ধারণা একটা সময় পর বদলে গেল। স্ত্রীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ থাকা অন্যায় নয়। তবে রিহান যে খানিক ভালোবেসেই কাছাকাছি হয়েছিল। ফারিহা অনেকটা সময় ধরে রিহানের পানে চেয়ে আছে। ছেলেটা ভাবুক হওয়া মুখশ্রী দেখে সে এবার ঝাঁকুনি দিল।

“কি হলো?”

“কিছু না। ফ্রেশ হয়ে আসি। ডিনার আমি সার্ভ করব।”

“আচ্ছা।”

রিহান ফ্রেশ হতে গেলে ফারিহা পুনরায় আয়নার সামনে এল। নিজেকে ক্ষণিক সময় খুটিয়ে দেখল। তার বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটেছে। আগের মতো শুকনো শরীর নেই। তবে শরীরে মেদ টা ও নেই। পূর্ণ নারী রূপ খেলা করছে। সে একটু হাসল। তারপর পাশের টেবিল থেকে ফাহানের ছবিটা তুলে নিল। মাতৃ মন সন্তানের জন্য সর্বদাই কাঁদে। ফারিহার বুকের ভেতর প্রতিটা সময় ফাহানের জন্য কান্না করে। অথচ বাহিরে সেটার প্রকাশ নেই। আদীবের প্রতি তার দায়িত্ব বোধ রয়েছে। কারণটা হলো তার মা। যদিও শুরুতেই বিষয় গুলো বলেছিল ফারিহা। কিন্তু আদীব তখন বাস্তবতা ভুলে কল্পনাকে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ফারিহা বেছে নিয়েছিল রিহানকে। দরজা খোলার শব্দে ফারিহা নিশ্বাস ফেলল। তার চোখের কোণের জল টুকু মুছে নিতে নিতে রিহান সামনে এসে দাঁড়াল।

“এখন খাবেন তো?”

“কাঁদছিলে?”

“কই, না তো। কাঁদব কেন?”

“আমি জানি কান্না করছিলে। এটাও জানি ফাহান কে অন্যের হাতে দিয়ে তুমি ভালো নেই।”

ফারিহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তবে একটু হেসে নিল।

“ফাহান আমাদের ও ভালোবাসে। একই সাথে দুটো পরিবার পেয়েছে সে।”

“হুম।”

“কষ্ট পেও না।”

“পাচ্ছি না। আপনি নেচে নেমে আসুন। আমি দেখি রান্না গুলো গরম করতে হবে কী না। যেভাবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে।”

ফারিহা যেন পালিয়ে বাঁচল। রিহান কিছু বলল না। গায়ের পানি শুকিয়ে নিয়ে ড্রেস পরে নিল। এসে দেখল ফারিহাই সার্ভ করে দিয়েছে। একসাথে খাবার শেষ করল ওরা। ঘুমানোর সময় মেয়েটি অন্য দিক ফিরে ছিল। রিহানের ভেতরটা ভালো লাগছে না। সে দু হাতে মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল। ওমনি ঝমঝমে কেঁদে উঠল ফারিহা। মা হয়ে ছেলেকে সেক্রিফাইজ করা পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত।

সকাল টা ভালো ভাবে শুরু হলো। যদিও রিহানের অফ ডে ছিল না তবু সে আজ অফিস যায় নি। বরং ভোরে উঠে নাস্তা বানিয়েছে। সেটা দেখতে পেয়ে ফারিহার চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা।

“আরে, কি করেছেন!”

“সারপ্রাইজ। জানি না কতটা ভালো হয়েছে। তবে খারাপ লাগবে না এটা সিউর থাকো।”

“আপনি ও না।”

“এখন কথা নয়। খাবে চলো।”

মেয়েটিকে ধরে বসিয়ে দিল রিহান। তারপর খাবার সার্ভ করে দিয়ে বরাবর বসল। এক টুকরো লুচি মুখে দিয়ে হাসল ফারিহা।

“বাহ, খুব ভালো হয়েছে তো। রান্না করেছেন এত বছর?”

“একটু আধটু।”

“বোঝা যাচ্ছে। আসলেই খুব ভালো হয়েছে।”

তারপরই এক টুকরো লুচি আর মাং স তুলে নিয়ে রিহানকে খাইয়ে দিল ফারিহা। রিহান খাবারটা শেষ করল। তারপর চা বানিয়ে আনল। শীতের সকালে গরম গরম চা। এ যেন অন্য এক তৃপ্তি। চা হাতে দুজন পুরো বাড়িটা ঘুরে নিল। এই সময়ে সব থেকে বেশি যাদের স্মরণ হলো তারা হলেন রিহানের বাবা মা। প্রতিটা অংশে তাদের স্মৃতি মিশে। আকাশের পানে চেয়ে রিহান ঠোঁট প্রসারিত করল। তারপর ধীরে ধীরে আওড়ালো।

“পৃথিবীর বুকে আমার মতো সন্তান আর কারো না হোক।”

ফারিহা সেটা শুনতে পেল বোধহয়। ওর চোখে বিষণ্নতা নেমে এল। তবে প্রসঙ্গটা ধরল না সে। বরং হাসি ফুটিয়ে তুলতে রিহানের হাত জোড়া শক্ত করে আলিঙ্গন করল।

ফাহানের আট তম জন্মদিনের রাতে ফারিহা কিংবা রিহান কারো চোখেই ঘুম নেই। দুজন ভীষণ যন্ত্রণায় রয়েছে। অথচ প্রকাশ করতে পারছে না। রোজ রিহান ফারিহাকে জড়িয়ে ঘুমালেও আজ সেভাবে ঘুমাচ্ছে না। দুজনেই বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। একে অপরের অস্থিরতা অনুভব হচ্ছে। তখন বারো টা বাজার কিছু সময় বাকি। কলিং বেজে উঠল। ফারিহার বুক ধক করে উঠল। রিহানের ও তাই। দুজনেই দোতলা থেকে ধপ ধপ করে নেমে এল। দরজা খুলে দেখল এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাহান। আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আদীব আর শারমিন। ফারিহার মাতৃ মন ব্যাকুল হয়ে গেল। ছেলেকে জাপটে ধরল। রিহানের চোখে জল নেই। তবে খুশিটা ফুটে উঠেছে।

“ফাহান, আমার সোনা। তুমি এসেছ।”

“মম, তুমি কাঁদছ কেন?”

এ কথা বলেই মায়ের চোখের জল মুছে দিল ফাহান। ফারিহা কান্নার মাঝেও হাসল। ছেলেটা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।

“আমি না এসে থাকতে পারি বলো?”

ফারিহা কিছু বলল না। রিহান একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা ছেলের সুন্দর মুহূর্ত দেখছে। ফাহান বাবার নিকট এগিয়ে গেল। লম্বাটে রিহানের নিকট সে বড়ো ছোট। তাই তার মন খারাপ হলো। সেটা বুঝতে পেরে কোলে তুলে নিল আদীব। ফাহান হাসল। তারপর রিহানের মুখে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,”হ্যাপি বার্থডে ড্যাড।”

ওমনি করে বারোটার ঘন্টা বেজে উঠল। রিহানের দু চোখে জল নেমে এল। বাবা ছেলের একই দিনে জন্মদিন। ছেলেকে কোলে তুলে নিল রিহান। শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বলল,”থ্যাংকস বেটা। এন্ড অলসো হ্যাপি বার্থডে।”

বাবা কে ওমন করেই জড়িয়ে রাখল ফাহান। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক একই সাথে এক জোড়া বাবা মা কে ভালোবেসে যাচ্ছে। এদের কেউ ই তার নিকট কম ভালোবাসার নয়।

বাবা ছেলে এক সাথে ঘুমিয়েছে আজ। ফারিহা একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলে ফাহানের অপর পাশে শুয়ে পড়ল। ফাহান শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। হাতটা বাবার গলায় জড়িয়ে রাখা। রিহান দু চোখ ভরে সন্তানকে দেখে চলেছে।

“আমি একটা কথা ভেবেছি।”

রিহান অন্যমনস্ক ভাবেই বলল,”হু?”

“ভেবেছি,ফাহানকে আর দিব না।”

রিহান যেন এবার ধ্যান পেল। একটু নড়ে চড়ে বলল,”মানে?”

“ওকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হয়। আমি বড়ো অসহায় অনুভব করি।”

রিহান একটু ভেবে বলল,”আদীব আর শারমিন?”

“তারা ও এখানেই থাকবে।”

“এটা ভালো বলেছ। তবে মানবে এটা?”

“মানবে। আমি ম্যানেজ করে নিব।”

“আচ্ছা।”

রিহান পুনরায় ছেলের দিকে মনোযোগ দিল। ছেলেটার মুখের আদলটা একেবারেই ওর মতো হয়েছে।

রিহান আর ফাহানের জন্মদিনটা ঘরোয়া ভাবে করা হলেও আয়োজনের ক্রুটি রাখছে না। শারমিন আর ফারিহা মিলে নানান রান্না করেছে। ভোর বেলা থেকে চলছে আয়োজন। আদীব সেই কাক ভোরে উঠে মাওয়া ঘাট থেকে ইলিশ মাছ কিনে এনেছে। সেটা তেলে দিতেই পুরো বাড়ি ঘ্রাণে ভরে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাবা ছেলে একসাথে গোসল করতে যাবে। সুইমিংপুলে জমিয়ে গোসল করবে বলে ঠিক করেছে। আদীব ড্রয়িং রুমে ছিল। সে ও তাদের সাথে যোগ দিল। তিনজনে সুইমিং শেষ করে এসে জামা বদলে নিল। সকাল সকাল গরম গরম ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা। এক অন্যরকম তৃপ্তি। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হলো ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে। পুরো দিনটা একসাথে ঘুরল তারা। নানান পোজে ছবি তুলল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত দশটা বেজে গেল। ফাহান ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে কোলে করে নামাল আদীব।

“ফাহান আজ আমাদের সাথে থাকুক।”

“আচ্ছা।”

রিহান গাড়ি পার্ক করে নিজ রুমে এল। দেখল ফারিহা ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয় পুনরায় সাজ গোজ ও করছে! রিহানের একটু সন্দেহ জাগল। সে আরশির নিকটস্থ হয়েছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ঘাড়ের কাছে থুতনি ঠেকাল।

“কি বলো তো। আবার তৈরি হচ্ছো যে।”

“এমনি।”

“সত্যিই কি তাই?”

“হুম।”

“মনে হচ্ছে না।”

ফারিহা হাসল। সেই হাসিতে প্রহেলিকার দেখা মিলে। রিহান কিছু সময় ভেবে মেয়েটিকে পুনরায় আলিঙ্গন করল। গলার কাছটায় ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল,”সবাই বার্থডে গিফ্ট দিয়েছে। তুমি তো দিলে না। এটা কি ঠিক হলো?”

“দিব।”

“এর জন্যে তৈরি হলে?”

ফারিহা এবার জবাব দিল না। রিহান ভাবুক হয়ে পড়ল। মেয়েটি বারান্দার দিকে যাচ্ছে। রিহান ও সেদিকে গেল। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে সামনের বড়ো বাগানটা। সেখান থেকে মিষ্টি এক ফুলের ঘ্রাণ নাকে এসে ধরা দিচ্ছে। রিহানের হাতটা তুলে নিল ফারিহা। তারপর চুমু খেল সময় নিয়ে। রিহান দু চোখ ভরে দেখে চলেছে স্ত্রী কে। যার রূপ গুণ সব থেকে সুন্দর, পবিত্র। রিহান তখনো জানত না তার জন্মদিনের উপহারটা এত সুন্দর হবে। হুট করেই একটা বাজি ফাটার আওয়াজ হলো। আকাশ জুড়ে আলো ছুটছে। রিহান অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক সে সময়ই কানের কাছে এসে ফারিহা বলল,”কংগ্রাচুলেশন। দ্বিতীয় বারের মতো বাবা হচ্ছেন আপনি।”

রিহান যেন একটা ঘোরে প্রবেশ করেছে। ও তখনো বুঝতে পারছে না কি হলো। যখন বুঝল তখন মেঝেতে হাঁটু ঠেকিয়ে দিল। পেট বরাবর চুমু খেল।

“কবে জেনেছ?”

“কিছু দিন আগে।”

“বললে না কেন?”

“আজকের দিনটার জন্য।”

“কত গুলো দিন মিস হয়ে গেল। এটা ঠিক করো নি।”

“আচ্ছা, সরি।”

রিহান একটু রাগ দেখিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। ফারিহাও এল পেছন পেছন। তারপর চলল রাগ ভাঙানোর প্রয়াস। কিন্তু রিহান কিছুতেই মানছে না। একটা সময় পর ফারিহা ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। সে নিজেই রাগ দেখিয়ে শুয়ে পড়ল। রিহান কিছু সময় চুপ করে থেকে হেসে ফেলল। কারণ সে জানে মেয়েটির রাগ ভাঙানোর জন্য একটা শক্ত আলিঙ্গন ই যথেষ্ট। হলো ও তাই। এক আলিঙ্গনেই মেয়েটির রাগ গলে গেল। তারপরই রিহানের বুকে মুখ গুজে দিয়ে চোখ বুঝল। তবে সে রাতে ওদের ঘুম হলো না। সমস্ত রাত জুড়ে ভাবতে লাগল নতুন অতিথির কথা। যাকে নিয়ে আরো একবার জাগ্রত হলো এক বুক স্বপ্ন আর আনন্দ।

~সমাপ্ত~

দেখে আসুন
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/337065272187707/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here